২১.
জাইমে মিয়োর ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি বুঝতে পারছেন, কিছু একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। মেগান কি করছে? প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছেন কি?
সানসি বাসস্ট্যান্ডে অতি দ্রুত পৌঁছোতে হবে। কর্নেল আকোকার সৈন্যরা চারপাশ ঘিরে ধরেছে।
তিনি মেগানের দিকে হেঁটে গেলেন, তার কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণতা।
–আমি বলেছিলাম ঘুমিয়ে নিতে। আপনি কেন উঠে দাঁড়িয়েছেন?
মেগান বললেন, আমি যদি কিছু করে থাকি তার জন্য দুঃখিত।
সিস্টার, কোনো রকমে আমি রাগ চেপে আছি। আপনার আচরণ আমাকে অবাক করে দিচ্ছে।
মেগান বুঝতে পারছেন না কী বলবেন।
জাইমের মনে পড়ে গেল অনেক কথাই, তখন তিনি এক ছোট্ট ছেলে ছিলেন। এইসব স্মৃতি কি এখনও আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করবে।
.
বোমাবর্ষণের শব্দে মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। তখন তিনি একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলেন।
বাবা বলেছিলেন, জাইমে উঠে পড়, তাড়াতাড়ি। গুরমিকা শহরটি হল বাস্তবের শক্ত ভূমি। জেনারেল ফ্রাঙ্কো এই শহরটিকে ধ্বংস করতে চাইছেন।
প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। ইটালীয় বিমানগুলি আকাশে ঘোরা ফেরা করছে। জাইমের মা, বাবা এবং দুজন দিদি অন্ধকারের মধ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জাইমের বাবা বলেছিলেন- আমরা চার্চে যাব। ওরা চার্চে বোমা ফেলবে না।
তিনি ঠিকই বলেছিলেন, সবাই জানতেন চার্চে গেলে জীবন বাঁচানো যেতে পারে। মিরো পরিবার সেদিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। চারপাশে ভয়ার্ত মানুষের মুখের মিছিল।
ছোট্ট ছেলে হিসেবে জাইমো বাবার হাত চেপে ধরেছিলেন। এক আতঙ্কঘন পরিবেশ।
আমরা যুদ্ধে চলেছি বাবা?
-না জাইমে, এটা খবরের কাগজের প্রচার। সরকার আমাদের স্বাধীনতা দেবে না, লড়াই চলতেই থাকবে। ভাবতে অবাক লাগে, স্পেনের বাসিন্দা স্পেনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে।
জাইমে তখন খুবই ছোটো, এসব বোঝার মত বুদ্ধি ছিল না তার। লড়াই শুরু হয়ে গেছে, একদিকে প্রজাতন্ত্রী সরকার অন্যদিকে জাতীয়তাবাদীরা। এই লড়াইতে কতজনকে প্রাণ দিতে হবে।
ফ্রাঙ্কোর দলবল ইতিমধ্যেই গণতন্ত্রপ্রেমীদের হারিয়ে দিয়েছে। এখন জাতীয়তাবাদীরা কোনোরকমে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। ফ্রাঙ্কো চাইছেন বিরুদ্ধ পক্ষকে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দিতে।
জাইমের বাবা ছিলেন অহিংসাত্মককারী। হিংসাকে তিনি ঘেন্না করতেন। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব এমন কথাও তিনি বলতেন।
কিন্তু, দিনকাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। ঈশ্বর কি আমাদের রক্ষা করতে পারবেন?
চারপাশে উন্মত্ত সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। জাইমের বাবা হঠাৎ বুঝতে পারলেন, একঝাঁক বুলেট এসে তাকে আক্রমণ করেছে। কথা বলার শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তার শরীরটা নরকের অন্ধকারে মিশে গেল।
সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু, বুলেটের শব্দ। আর্তনাদ। জাইমে চোখ খুললেন। অনেকক্ষণ সেখানে শুয়েছিলেন। বাবার মৃতদেহ তার ওপর পড়ে আছে আহা বুঝি একটা উষ্ণ কম্বলের আবরণ। মা বাবা বোনেরা কেউ বেঁচে নেই। আরও অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
রাত ফুরিয়ে আসছে, জাইমে এখন কোথায় যাবেন? ওই শহর থেকে এসে তিনি পৌঁছেছিলেন বিলবাওতে, পি টি এন এ নামে একটি গোপন সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন।
রিক্রুটিং অফিসার তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, তুমি তো নেহাত দুধের শিশু, এখন তোমার স্কুলে যাওয়া উচিত।
জাইমে বলেছিলেন, আপনি কি জানেন ওরা আমাদের সকলকে মেরে ফেলেছে?
জাইমে আর পেছন ফিরে তাকাননি। অগ্নিমন্ত্রে শপথ নিয়েছিলেন। যে করেই হোক এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই হবে।
.
ধীরে ধীরে তিনি কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে উঠলেন। তিনি জানেন না শেষ পর্যন্ত কী লেখা আছে ভাগ্যে। তবে তাকে কাজ করতেই হবে।
অরণ্য পথে রাত্রি নেমেছে। আকাশে চাঁদের নিষ্প্রভ আলো। শহরের পথ ধরা সম্ভব হচ্ছে না। সর্বত্র বিপদের পদচিহ্ন। জাইমে আর মেগানের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। ফেলিক্সের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছেন। অতীতের অভিযানের গল্প।
মেগান ভাবলেন, মেননেভিয়াতে আমাকে কে পৌঁছে দেবেন? একমাত্র এই মানুষটি পারেন।
সিস্টারের জন্য জাইমের মনে মাঝে মধ্যে করুণা জেগে ওঠে। আহা, সিস্টার সত্যিই অসহায়।
অ্যাম্পায়রা জিরনের কথা মনে পড়ছে। একরাতে জাইমে তার কাছ থেকে অশেষ সুখ পেয়েছিলেন।
অ্যাম্পায়রা সত্যিই এক কর্তব্যনিষ্ঠ মহিলা। জাইমে ভাবলেন।
জাতীয়তাবাদী সৈন্যরা অ্যাম্পায়োর গোটা পরিবারকে পৃথিবী থেকে মুছে দিয়েছে। অ্যাস্পারো এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন কিন্তু, মনের ভেতর আবেগ রয়ে গেছে।
ভোর হবার আগে, তারা সালামানতার কাছে পৌঁছে গেলেন, লিওটমেস নদীর ধারে।
ফেলিক্স মেগানকে বললেন- স্পেনের নানাপ্রান্ত থেকে ছাত্ররা এখানে আসে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব নাম আছে।
জাইমে কিছুই শুনছেন না, তিনি-পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবছেন। তিনি ভাবছেন, যদি আমি একজন শিকারী হতাম, কোথায় শিকারের সন্ধানে যেতাম?
তিনি ফেলিক্সকে বললেন- আমরা সালামানতে ঢুকব না। শহরের বাইরে কোথাও থামতে হবে।
তাঁরা পানাডোরে পৌঁছে গেলেন। একটা ছোট্ট সরাইখানা, শহরের বাইরে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। চারপাশে গুপ্তচর ছড়ানো আছে।
অ্যাম্পায়রা ডিওন হাসি মুখে বললেন– ঈশ্বরের অনুগ্রহে আমরা পৌঁছে গেলাম।
মেগান জবাব দিয়েছিলেন- হ্যাঁ, মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আমরা জয়যুক্ত হব।
দশমিনিট কেটে গেছে।
জাইমে অ্যাম্পায়োকে বললেন- তুমি এবং সিস্টার একটা ঘরে থাকো। ফেলিক্স আমার সঙ্গে থাকবে।
অ্যাম্পায়রা বলেছিলেন- না আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
-আমি যা বলছি তাই করো, এই সিস্টারের ওপর কড়া নজর রেখো।
সিস্টারকে নিয়ে অ্যাম্পারো একটা ঘরে চলে গেলেন।
মেগান চারপাশে তাকালেন। ঘরটা সুন্দর। অ্যাম্পায়োর মনে রাগ হয়েছে, মেগান থাকার জন্যই তার স্বপ্ন সফল হল না।
অ্যাম্পায়ো মেগানের দিকে তাকালেন। তারপর হেসে ফেললেন। সত্যিই তো, যে সেলে সিস্টার বসবাস করেছেন, তার তুলনায় এটা তো স্বর্গ।
অ্যাস্পারো পোশাক খুলতে শুরু করলেন। প্রকাশ্য দিবালোকে এই প্রথম অ্যামাপরাকে ভালোভাবে দেখলেন মেগান। আঃ, মহিলা সত্যিই আকর্ষণীয়া। সবদিক থেকে। লাল চুলের বাহার। সাদা ধবধবে চামড়া, দুটি স্তন যেন উপচে পড়ছে, সরু কোমর, নিতম্ব বেশ উঁচু, হাঁটলে লীলায়িত ছন্দ জাগছে।
অ্যাম্পায়ো দেখতে থাকেন সিস্টার, আপনি আমাকে কিছু বলবেন? আপনি কেন কনভেন্টে যোগ দিয়েছেন?
ভগবানের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করব বলে।
না, এসব মিথ্যে কথা। অ্যাম্পায়ো সেই অবস্থায় বিছানাতে গিয়ে বসলেন, তিনি বললেন- আপনি ওই খাটে শুয়ে পড়ুন। আমার মনে হয় না কনভেন্ট থাকার একটা আদর্শ জায়গা।
মেগান হাসলেন- যার যা ধারণা।
জাইমে বিছানাতে বসে আছেন। ফেলিক্স কিছু বলার চেষ্টা করছেন। ফেলিক্সের বন্দুকটা ছোটো, টেবিলে রাখা আছে।
ফেলিক্স বললেন- এর পরবর্তী পদক্ষেপ?
জাইমে কাঁধ ঝাঁকানি দিলেন- জানি না, আগে সিস্টারকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে, তারপর ভাবব।
জাইমে অ্যাম্পায়োর কথা ভাবছিলেন, অ্যাম্পায়োর সাহচর্য তিনি এখন কামনা করছেন। ওই সিস্টার না থাকলে স্বপ্ন সফল হত। কিন্তু কিছু করা বাকি থেকে গেছে কী?
ম্যানেজার শান্তভাবে বসেছিলেন, নতুন অতিথিরা ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত তার শাস্তি নেই। তার হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করেছে। তিনি একটা নাম্বারে ফোন করলেন।
জান্তব কণ্ঠস্বর শোনা গেল– পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
জাইমে মিরো এবং তার তিনজন অনুগামী এখানে এসেছেন। আসুন, সবকিছু সাজিয়ে রেখেছি।
.
২২.
পূর্বদিকে একটা জায়গা, আছে, বেনাফিল। লুসিয়া কারমাইন ঘুমিয়ে আছেন। রুবিও আরজানো তাকে দেখছেন। এই ঘুম এখন ভাঙাবে না। আহা, কী মধুর।
সকাল হয়েছে, এখন যেতে হবে।
রুবিও বললেন– সিস্টার লুসিয়া?
সিস্টার চোখ খুললেন
–আমাদের যেতে হবে।
সিস্টার আড়মোড়া ভাঙলেন। ব্লাউজের একটা বোম খুলে গেছে। স্তনের কিছুটা উন্মুক্ত। রুবিও তাকিয়ে থাকলেন।
না, মন থেকে এইসব চিন্তা দূর করতে হবে। কারণ লুসিয়া হলেন যিশুর পত্নী।
–সিস্টার?
কী?
–একটা কথা জিজ্ঞসা করব?
–বলুন।
–আপনি কি আমার হয়ে প্রার্থনা করবেন? আমি একজন ক্যাথোলিক।
কতদিন বাদে প্রার্থনা? রুবিও ভাবলেন। মাঝেমধ্যে মানুষ যে কী হয়ে যায়?
দুজনে কিছু খুচরো কথা হয়েছিল। তারপর? লুসিয়ার মনে হল, তিনি কেন জীবনটাকে ভালভাবে কাটাতে পারলেন না? অ্যানজেলো কারমাইনের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও?
মনে কত চিন্তা, ভগবান আমার জন্য কী সাজিয়ে রেখেছেন। লুসিয়া নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলেন। ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর, ভবিষ্যতে কী হবে তা কেউ জানে না। লুসিয়া বলতে থাকলেন, পুরোনো দিনের গল্প, কিছুটা মিথ্যে কিছুটা সত্যি।
রুবিও হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলেন সিস্টার, আপনি আমাকে অবাক করছেন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবী সম্পর্কে আমরা কতটুকুই জানি।
পাঁচ মিনিট কেটে গেছে, তারা এগিয়ে চলেছেন।
ঝিরঝিরে বৃষ্টি, ফাঁকা কেবিনে এসে তারা দাঁড়িয়েছেন। টিনের ছাদে বৃষ্টি পড়ার শব্দ।
ঝড় কী চলতে থাকবে?
–না, এটা ঝড় নয়, একে আমরা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বলতে পারি। পৃথিবী আবার শুকনো হয়ে যাবে।
সত্যি? হ্যাঁ আমি একজন চাষীর ছেলে আমি সব জানি।
-সিস্টার, আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে কি?
–কেন হবে না?
–সিস্টার, কনভেন্টে বসে আপনি ভগবানের কথা চিন্তা করতেন। তাই কি?
-হ্যাঁ।
সারা পৃথিবীটাই আমার কাছে একটা কনভেন্ট। ভেবে দেখুন তো, প্রতি মুহূর্তে কত অলৌকিক ঘটনাই না ঘটে যাচ্ছে। আমরা সবকিছু ভাবছি কি?
বৃষ্টি থেমে গেল।
–সিস্টার, এবার আমরা পথে নামব।
আমরা বায়ডরর কাছে পৌঁছে যাব। এবার আরমারডোর দিকে, তারপর লগরোনো। সেখানেই সাথীরা আসবেন।
লুসিয়া ভাবলেন, আমি তো যাব সুইজারল্যান্ডে, কবে? এবং কীভাবে?
ঝরনার শব্দ শোনা গেল। আহা, প্রকৃতি কত বিস্ময়কর। অসাধারণ দৃশ্য।
আমি চান করব, লুসিয়া বললেন, কত বছর বাদে তিনি এইভাবে চান করবেন।
রুবিও জানতে চাইলেন–এখানে?
না, রোমে নয়, হা- এখানে প্রকাশ্যে। সিস্টার বললেন।
-সাবধানে করবেন, রাস্তাঘাট পিছল হয়ে গেছে।
–ভয় পাবেন না, লুসিয়া দাঁড়ালেন, দাঁড়িয়ে থাকলেন—
–আমি চলে যাচ্ছি, আপনি পোশাক খুলে চান করুন।
কাছাকাছি থাকবেন, লুসিয়া বললেন, বুনো জন্তু থাকতে পারে, মনে মনে ভাবলেন।
লুসিয়া পোশাক খোলার চেষ্টা করলেন। রুবিও কয়েক গজে দূরে চলে গেলেন। পেছন ফিরে দাঁড়ালেন।
তিনি বললেন- বেশি দূর যাবেন না সিস্টার, নদীটার মতিগতি ভালো নয়।
লুসিয়া কিছু দূর চলে গেলেন। আহা, সকালের শীতল বাতাস। নগ্ন শরীরকে কাঙ্খিত উপশম দিয়েছে। সবকিছু ভোলা হয়ে গেল, একপা একপা করে তিনি জলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সুশীতল পরিবেশ। তিনি দেখলেন, রুবিও অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি হাসলেন, অন্য কেউ হলে হয়তো চোরা চোখে এই নগ্ন শরীরটা দেখত। তিনি আরেকটু ভেতরে এগিয়ে গেলেন। পাহাড়কে অতিক্রম করে। আহা, এবার চানের আনন্দ।
জলধারা নেমে এসেছে। লুসিয়া দেখলেন, কিন্তু, নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। আর্তনাদ, তিনি পুড়ে গেছেন, বোল্ডারে মাথা ফেটে গেছে।
রুবিও ছুটে এসেছেন। কিন্তু, লুসিয়াকে দেখা গেল না, উন্মক্ত জলরাশি তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল!
.
২৩.
সালামানতার পুলিশ স্টেশন। সার্জেন্ট ফ্লোরিয়ান সামতিয়াগো ঘোরাঘুরি করছেন। তার হাত-পা কাঁপছে।
জাইমে মিরো এবং তিনজন অনুগামী, কখন আমরা বেরিয়ে পড়ব।
জাইমে মিরো, ধরতে পারলে পুরস্কার। ভাবতে ভাবতে কেমন করতে থাকেন তিনি।
জাইমে মিরো নামটা তার কাছে পৌঁছে গেছে। কিন্তু জীবন বিপন্ন করে কী লাভ? অন্য কেউ এই ব্যাপারে অভিযান করুক, পুরস্কারের টাকাটা আমি যেন পাই।
কীভাবে এই বিষয়টা করা যেতে পারে? কর্নেল আকোকার নাম মনে পড়ে গেল। কর্নেলই এই ব্যাপারে ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন।
টেলিফোন ধরলেন, দশ মিনিট বাদে কর্নেলের সঙ্গে কথা হল।
সার্জেন্ট ফ্লোরিয়ান সামতিয়াগো, সালামানতার পুলিশ স্টেশন থেকে কথা বলছি। জাইমে মিরোকে পাওয়া গেছে।
কর্নেল র্যামন আকোকা-আপনি সুনিশ্চিত।
-হ্যাঁ, কর্নেল। তিনি পারাডর হোটেলে আছেন। শহরের বাইরে। সারা রাত সেখানেই থাকবেন। এই হোটেলের ম্যানেজার আমার কাকা। তিনি নিজে আমাকে ফোন করেছেন। মিরোর সাথে আরেক অনুগামী আছে, দুজন মহিলা।
–আপনি ঠিক বলছেন তো?
–হ্যাঁ, কর্নেল।
আকোকা বললেন আমার কথা শুনুন, আমি এখনই ওই হোটেলে যাব। আপনারা হোটেলের চারপাশে চলে যান। একঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছেচ্ছি। আপনি কিন্তু ঢুকবেন না। ঠিক বলছি তো?
-হা স্যার, আমি এখুনি বেরোচ্ছি। তিনি ইতস্তত করলেন। কর্নেল, পুরস্কারের টাকা।
–যখন আমরা মিলোকে ধরব, পুরস্কারের টাকাটা আপনিই পাবেন।
–কর্নেল আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সামতিয়াগো রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। পাশের ঘরে যে মেয়েটি শুয়ে আছে, তার রক্ষিতা, তার ঘুম ভাঙিয়ে উঠিয়ে দেবে কি? না, পরে চমকে দেবেন।
এখন একটা কাজ করতে হবে। তিনি একজন পুলিশকে ডাকলেন।
–আমি বেরোচ্ছি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।
মনে মনে হাসলেন, অনেক অনেক টাকার মালিক হব আমি। কিন্তু আমাকে একটা নতুন গাড়ি কিনতে হবে, নীল রঙের গাড়ি। না, গাড়ির রং হবে সাদা।
.
আকোকা রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলেন। সময় ফসকে যাচ্ছে। মিরোর সাথে নিশ্চয়ই সশস্ত্র রক্ষী আছে, তা হলে?
ফোন করলেন, বললেন চব্বিশজন পুলিশকে তৈরি হতে বলুন। তাদের হাতে যেন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থাকে। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা সালামানতার দিকে যাত্রা করবো।
মিরোর এবার আর কোনো মুক্তি নেই। কর্নেল মনে মনে হাসলেন। কীভাবে এই অভিযানটা হবে তার ছক কষলেন। চারপাশে কর্ডন তৈরি করা হবে। হঠাৎ ভেতরে ঢুকে পড়তে হবে।
.
পনেরো মিনিট কেটে গেছে, এবার যাত্রা শুরু হল।
.
সার্জেন্ট সামতিয়াগো পৌঁছে গেলেন বায়ডরের কাছে। কর্নেলের বিপদবাণী তিনি শোনেননি। তিনি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু, এখন দাঁড়িয়ে থাকলেন। রাত্রির বাতাস শীতল হয়ে উঠেছে। সামতিয়াগো ভাবলেন, টাকাটা আমার চাই। টাকার চিন্তা তাকে ক্ষয়িষ্ণুও করে রাখল।
র্যামন আকোকা এসে গেছেন, সামতিয়াগো ভাবলেন।
–আমি সার্জেন্ট সামতিয়াগো।
–কেউ কি সরাইখানা থেকে বেরিয়েছে?
না স্যার, ওরা সকলে ঘুমিয়ে আছে।
কর্নেল বললেন- এবার অভিযান শুরু করতে হবে।
সামতিয়াগো তাকিয়ে থাকলেন। কর্নেলের চোখে আগুন জ্বলছে। তারা সিঁড়ির মাথায় চলে গেলেন।
আকোকা বললেন দেখামাত্র গুলি করতে হবে।
কর্নেল, আমরা কি আদেশের অপেক্ষা করব?
–না, তোমরা কেউ জাইমেকে হত্যা কোরো না, এ কাজটা আমিই করব।
–বায়ডরের শেষ প্রান্তে দুটি ঘর, সেখানে মিরো আর তার অনুগামীরা আছেন। কর্নেল শান্তভাবে তাকিয়ে থাকলেন।
এবার শুরু হবে।
আগুন জ্বলে উঠল, দরজা ভেঙে ফেলা হল। ঘরের ভেতর সৈন্যরা ঢুকে পড়ল। — তাড়াতাড়ি, আকোকা চিৎকার করলেন।
কিন্তু কোথায়? প্রত্যেকটা দরজা ভাঙা হচ্ছে, জাইমে আর তার সঙ্গী সাথীদের কোথাও পাওয়া গেল না। কর্নেল হোটেল ম্যানেজারকে চেপে ধরলেন। লবিতে কেউ ছিল না। তিনি চিৎকার করলেন। ভীতুরা লুকিয়ে থাকে।
কর্নেল? একজন সৈন্য বলেছে। আকোকা দেখলেন, ম্যানেজারের মৃতদেহ পড়ে আছে। আর একটা চিহ্ন তার পিঠে– লেখা আছে আমাকে কেউ বিরক্ত করো না!
.
২৪.
রুবিওর মন আতঙ্কে ভরে উঠেছে। উচ্ছ্বসিত জলরাশি লুসিয়াকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এক মুহূর্তের মধ্যে তিনি ভাবলেন, এবার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। লুসিয়ার দেহের কিছুটা দেখা গেল। জলের ঢেউয়ে কাছে চলে এসেছে। রুবিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অসম্ভব, তিনি নিজেই ভেসে যাচ্ছেন। লুসিয়ার শরীরটা দশ ফুট দূরে। মনে হচ্ছে যেন কয়েক মাইল। তিনি শেষবারের মতো চেষ্টা করেছিলেন। একটা হাত চেপে ধরলেন। মৃত্যু উপত্যকা।
রুবিও শেষ পর্যন্ত নদীর ধারে পৌঁছেছিলেন। তারপর? লুসিয়াকে টেনে এনে ঘাসের ওপর ফেলে দিলেন, কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে। লুসিয়া অজ্ঞান হয়ে গেছেন, নিঃশ্বাস পড়ছে না। রুবিও জল বের করার চেষ্টা করলেন। বুকে হাত দিলেন। একটির পর একটি মুহূর্ত কেটে গেল। মুখ দিয়ে হুড় হুড় করে জল বেরিয়ে এল। লুসিয়ার গোঙানি শোনা গেল। রুবিও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন।
রুবিও ধীরে ধীরে বুকে চাপ দিচ্ছেন। লুসিয়া কাঁপতে শুরু করেছেন। রুবিও কয়েকটা গাছের পাতা নিয়ে এলেন। চেষ্টা করলেন লুসিয়াকে উত্তাপ দিতে। রুবিও নিজেও ভিজে গেছেন। কিন্তু নিজের দিকে তাকাবার সময় কোথায়? তার কেবলই মনে হচ্ছে, সিস্টার লুসিয়া বুঝি মারা যাবেন। তিনি ওই উলঙ্গ শরীরটা শুকনো গাছের পাতা দিয়ে ঢাকবার চেষ্টা করলেন। এখন মন থেকে বাসনা উধাও হয়ে গেছে।
দেবীর মতো চেহারা, ঈশ্বর, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। এখন আমার মাথায় যেন কোন দুষ্টু বুদ্ধি না আসে।
লুসিয়া জেগে উঠলেন। এই ব্যবস্থা কাজে দিয়েছে। আমি কোথায়? আমি কি স্বর্গে পৌঁছে গেছি? আহা, এভাবে আমাকে আদর করো।
যখন লুসিয়া জলে পড়ে গিয়েছিলেন, তিনি হয়তো মরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন বেঁচে উঠেছেন।
কণ্ঠস্বর ভেসে এলসিস্টার, আমরা বেঁচে গেছি।
রুবিও চিৎকার করতে গিয়েছিলেন আতঙ্কে। লুসিয়া বললেন তাড়াতাড়ি।
এই পুরস্কারটা দিতেই হবে, লুসিয়া ভাবলেন।
রুবিও তখনও ইতস্তত করছেন তিনি বললেন সিস্টার।
লুসিয়া কোনো কথা বলছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন, দুটি শরীর এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখন শুধু আদর আর ভালোবাসা। মনের ভেতর উত্তেজনা জাগছে। জীবনের সুখী মুহূর্তগুলো ভেসে উঠেছে।
রুবিও প্রেম নিবেদন করতে জানেন। একাধারে কোমল এবং বন্য। অসাধারণ পৌরুষের অধিকারী। তারপর? খোলা আকাশের নীচে, নারী পুরুষের মিলন।
এই লোকটা কোনোদিন আমাকে ভালোবাসবে না। ভালবাসাকে আমি প্রত্যাখ্যান করি। এখন আমি শরীর চাইছি। কাঁচা মাংসের সমাহার। লুসিয়া ভাবলেন, রুবিও আরজানো, আপনাকে আমি মনে রাখব, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমি লুসিয়া কারমাইন, অ্যানজেলো কারমাইনের কন্যা।
রুবিও তখনও শক্ত করে লুসিয়াকে চেপে ধরে আছেন। তিনি বলতে থাকেন–লুসিয়া, আমার লুসিয়া।
তার চোখে ভালোবাসার আগুন। তার সমস্ত মনে ভালোবাসার বাজন। লুসিয়া তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমার দেবী! তুমি আমার প্রতিমা।
লুসিয়া উঠে বসলেন- বললেন রুবিও, আমি একটা জিনিস ফেলে এসেছি, নদীর ধারে; তুমি নিয়ে আসবে কি? সোনার ক্রশ আর আমার জামাকাপড়।
–আমি এখনই আসছি।
লুসিয়ার চোখে মুখে শূন্যতা। কি যেন হয়ে গেছে। সোনার ওই ক্ৰশ? কোথায় গেল? ওটা না থাকলে আমি নিঃস্ব ভিখারী।
লুসিয়া দেখলেন, রুবিও ফিরে আসছে, তার হাতে ওই ক্ৰশ, লুসিয়া বললেন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
রুবিও পোশাক তুলে দিলেন। সেদিকে তাকিয়ে লুসিয়া হেসেছিলেন– না, এগুলোর এখন আর দরকার নেই।
.
সুর্যের আলো, লুসিয়ার নগ্ন শরীরের সবখানে। অলসতা জাগছে মনে। উষ্ণ, রুবিওর আলিঙ্গনে তিনি এখন আবদ্ধ। আহা, তারা বোধহয়, এক শান্তি সমৃদ্ধ মরুদ্যানে পৌঁছে গেছেন। বিপদের কোনো চিহ্ন নেই।
লুসিয়া বললেন রুবিও, তোমার ফার্মের কথা বলল।
বিলবাও গ্রামের পাশে, আমরা বংশ পরম্পরা সেখানে ভূমি চাষ করি।
দুজনের কথা গম্ভীর হচ্ছে। একজন অন্যজনকে আরও বেশি ভালোবাসার চেষ্টা করছেন।
লুসিয়া একমুহূর্ত ভাবলেন, আমার দুই ভাই আর বাবা এখন কারাগারে।
লুসিয়া অনেক কিছু জানতে চাইছিলেন। পরিবারের সকলের কথা, কে কোথায় বাস করেন।
অন্তরঙ্গত জমে উঠেছে। তারপর? এবার যেতে হবে। সময় বয়ে চলেছে।
.
উত্তর-পূর্ব দিকে তারা হেঁটে চলেছেন। ডুরো নদীর প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেলেন। পাশে একটা পাহাড়ি টিলা। সবুজ গাছের সমারোহ। হিলিবা গ্রাম। পাহাড়ের পাদদেশে।
এখন দুজনের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্ব। পরবর্তী শহরের দিকে তারা এগিয়ে চলেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, ভালোবাসা জেগেছে। একে অন্যকে অধিকার করার চেষ্টা করছেন।
.
দীর্ঘ সেতু তার পার হলেন। ক্যাসটিলাতে পৌঁছে গেলেন। শহর দেখা যাচ্ছে। দোকান জেগে উঠেছে। লুসিয়া ভাবলেন, এবার কিছু খেলে কেমন হয় কোনো একটা হোটলে। তারা হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলেছেন।
একগ্লাস মদ, এখন জীবন দিতে পারে। জনাকীর্ণ পথ, রুবিও অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন।
একটা দরজা দেখা গেল। কালো চিহ্ন দেওয়া। লেখা আছে পোলিসিয়া। লুসিয়া সেদিকে তাকালেন। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত চলছে।
কাউন্টারে কে? এক মোদো মাতাল।
–আমি কিছু বিক্রি করব। লুসিয়ার কণ্ঠস্বরে কাঁপুনি।
তিনি ওই সোনার ক্রশটা বের করলেন। বললেন– আপনি কি এটা কিনবেন?
ভদ্রলোকের চোখে মুখে বিস্ময়।
–এটা কীভাবে এসেছে?
–আমার এক কাকা এটা আমাকে দিয়েছেন। উনি এইমাত্র মারা গেলেন।
ভদ্রলোক ক্রশের ওপর হাত রাখলেন। বললেন– এর জন্য আপনি কত চাইছেন?
দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পেস্তা।
না, এক লক্ষ পেস্তা দিতে পারি।
তাহলে আমার শরীরকে আমি বিক্রি করব।
–এক লক্ষ পঞ্চাশ?
–তাহলে তা গলিয়ে ফেলব। বাজারে সোনাটা বেচে দেব।
দু লক্ষ? এটাই আমার শেষ কথা।
লুসিয়া দোকানদারের কাছ থেকে সোনার ক্রশটা নিয়ে নিলেন– আপনি কি আমাকে অন্ধ ভেবেছেন নাকি? কিন্তু আমি আপনার এই দরটা কিনতে পারি।
তিনি দেখলেন, দোকানদারের মুখে উত্তেজনা থরথর করে কাঁপছে একটা শর্ত আছে।
–সিনোরিয়া, কী শর্ত?
আমার পাশপোর্টটা চুরি হয়ে গেছে। আমাকে একটা নতুন পাশপোর্ট তৈরি করতে হবে। আমি এই দেশের বাইরে যাব, আমার বিধবা কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে।
ভদ্রলোকের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে। উনি বললেন- ঠিক আছে আমি দেখছি।
এ ব্যাপারে আপনি কি আমায় সাহায্য করবেন? তাহলে ক্রশটা আপনারই হবে।
একটি দীর্ঘশ্বাস না সিনোরিয়া, পাশপোর্ট তৈরি করা খুব একটা সহজ নয়। এখন কর্তৃপক্ষ অনেক সজাগ হয়ে গেছে।
লুসিয়া তাকালেন, কিছু বললেন না।
–আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না।
ঠিক আছে সিনর, ধন্যবাদ।
লুসিয়া দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন আবার তার ডাক পড়ল।
–একটা কথা মনে পড়েছে, আমার এক মাসতুতো ভাই আছে, সে এইসব বেআইনী কাজ করে থাকে। আপনি বুঝতে পারছেন?
–হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
–আমি কি তার সঙ্গে কথা বলব? আপনার পাশপোর্ট কবে চাই?
–আজকেই।
–ঠিক আছে, দেখি হয় কিনা।
কখন আমি পাশপোর্টটা পাব?
–আটটার পরে আসুন, আমার ভাই এখানেই থাকবে। সে আপনার ফটো তুলে নেবে। ফটোটাকে পাশপোর্টে মেরে দেবে।
লুসিয়া বুঝতে পারলেন, তার হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে- সিনর, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
–আপনি কি ক্ৰশটা এখানে রেখে যাবেন?
–না, এটা আমার কাছে নিরাপদে থাকবে।
লুসিয়া দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। পুলিশ স্টেশনকে এড়িয়ে চললেন। এবার টাফওয়ানে যেতে হবে। রুবিও সেখানে অপেক্ষা করছেন। ইচ্ছে করেই তিনি চলার গতি, কমিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত জয় করায়ত্ত হয়েছে। সুইজারল্যান্ড। তার মানে মুক্তির ঠিকানা। আনন্দ-শুধুই আনন্দ।
আমি কি কিছু ভুল করছি? রুবিওকে ভুলে যাব, দুঃখ হচ্ছে, এতটুকু।
আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। এই কথা আমি কাউকে কোনোদিন বলিনি।
না, রুবিওকে নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই। টাফওয়ানের পাশে এসে লুসিয়া দাঁড়ালেন, দীর্ঘশ্বাস নিলেন। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
.
২৫.
খবরের কাগজে সংবাদটা প্রকাশিত হয়েছে। শিহরিত খবর। কনভেন্টের ওপর আক্রমণ, সন্ত্রাসবাদীদের উল্লাস, চারজন সিস্টার পালিয়ে গেছেন। অনেকের মৃত্যু ঘটেছে। অনেক সিস্টার আহত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক খবর হয়ে গেছে এই খবরগুলো।
সারা পৃথিবী থেকে সংবাদ মাধ্যমের লোকেরা এসেছেন মাদ্রিদ শহরে। প্রধানমন্ত্রী মার্টিনেজ সব ব্যাপারটা শান্ত করা চেষ্টা করছেন। তিনি একটা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন। তার অফিসে ভিড় জমে গেছে। কর্নেল র্যামন আকোকাকে দেখা যাচ্ছে। কর্নেল কার্ল সোসটেলোও প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসে আছেন।
প্রধানমন্ত্রীকে অনেক অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। তিনি কর্নেল আকোকাকে এগিয়ে দিলেন। আকোকার ওপরেই সার্চ অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ছুটে আসছে, বুঝি বিষ মাখানো তীর। আকোকা শান্তভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করছেন। সব প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। বারবার তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, সৈন্যরা কেন উন্মত্ত আচরণ করেছে, এক অসহায় সিস্টারকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
আকোকা বলেছিলেন- এটা তাৎক্ষনিক আবেগের প্রতিফলন।
সাংবাদিকরা খুশি হতে পারছেন না। বোঝা গেল প্রধানমন্ত্রীর আসন এখন টলমল করছে। মধ্যরাতে আকোকা একটা ফোন পেলেন।
.
পরিচিত কণ্ঠস্বর, কে? কী ঘটতে চলেছে তা কি আপনি জানেন? আপনি এভাবে বেহিসেবি কাজ করবেন না।
আকোকা রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। লাইনটা মরে গেল, কে কথা বলল? মনে হচ্ছে মিয়োর কোনো অনুচর? কিন্তু মিরো কোথায়?
.
২৬.
-আমি ওকে মেরে ফেলব, রিকার্ডো মেলোডো বলেছিলেন, নিজের হাতে গলা টিপে। সিস্টার গ্রাসিলা কোথায় চলেছেন? জাইমে মিরো কি তাঁকে নিরাপদ জায়গাতে পৌঁছোতে পেরেছেন? রিকার্ডো খুশি হয়েছেন। হ্যাঁ, গ্রাসিলা একজন সিস্টার, কিন্তু তার সৌন্দর্য চেয়ে দেখার মতো। যে করেই হোক তাকে অধিকার করতেই হবে। ওই স্কার্ট এবং ব্লাউজের তলায় যে, অতুল সম্পদ লুকিয়ে আছে, আহা, আমি কবে তা অধিকার করব। এটাই হবে আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান। রিকার্ডো ভাবলেন।
ঘটনাগুলো অভাবিত। সিস্টার গ্রাসিলা তার সঙ্গে কথা বলছেন না। অভিযানের শুরু থেকে তিনি একেবারে নিশ্চুপ। এর কারণ কী বুঝতে পারা যাচ্ছে না। অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্যপট। আঙুর ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পথ এগিয়ে গেছে। বার্লির ক্ষেত চোখে পড়ছে, সূর্যের উজ্জ্বল আলোক শিখা। সূর্যমুখী ফুল অভিবাদন জানাচ্ছে।
তারা মরোস নদী পার হলেন। রিকার্ডো জিজ্ঞাসা করলেন সিস্টার, আপনি একটু শান্ত হবেন কি? কিছুক্ষণের বিশ্রাম?
থমথমে নীরবতা। সেভোগিয়ার দিকে তারা এগিয়ে গেলেন। দূরে পাহাড়শ্রেণী চোখে পড়ছে। আহা, এইভাবে কথা বলা যায় কি?
–আমরা সেভোগিয়ারতে পৌঁছে যাব সিস্টার।
কোনো উত্তর নেই। কীভাবে ওই মেয়েটির মুখে কথা ফোঁটানো যেতে পারে? আপনার কী খিদে পেয়েছে?
আবার কোনো উত্তর নেই। এই মহিলা কি জীবন সম্পর্কে হতাশ? এমন বোবা হয়ে হাঁটছেন কেন? আহা তাকে ভগবান অসাধারণ সৌন্দর্য দিয়েছেন। কিন্তু মনটাকে করেছেন রুক্ষ এবং কর্কশ।
.
তারা সেভোগিয়ার প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেলেন। রিকার্ডো বুঝতে পারলেন শহরে অনেক মানুষের ভিড়। তার মানে? এই শহরটায় প্রবেশ করা উচিত হবে না।
এগিয়ে গেলেন প্লাজা চেস্টের দিকে। অনেক সৈন্য চোখে পড়ল, তিনি বললেন সিস্টার, আমার হাত ধরুন, আচরণের মধ্যে প্রেমিকার শিহরণ নিয়ে আসুন। মনে হবে আমরা যেন প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়েছি।
কোনো কথা বেরোল না গ্রাসিলার মুখ থেকে। হায় ঈশ্বর, মেয়েটি বোরা কালা নাকি? শেষ পর্যন্ত জোর করে হাত ধরলেন, অদ্ভুত একটা প্রতিবাদ ভেসে এল। গ্রাসিলা হাত সরিয়ে নিলেন।
রিকার্ডো বললেন– আপনি রাগ করবেন না। আমার বোন হলে হয়তো এধরনের আচরণ করত। কিন্তু এখন এই অভিনয় করতেই হবে।
সৈন্যরা পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। রিকার্ডো আবার গ্রাসিলার মুখের দিকে তাকালেন। অভিব্যক্তি বিহীন মুখ। রিকার্ডো ভাবলেন, জাইমেকে অভিশাপ দেওয়া উচিত। অন্য সিস্টাররা কত হাসি-খুশি আর একে দেখে মনে হচ্ছে, বুঝি বিষাদের পাষাণ প্রতিমা। কোনো কথা বলতে পারছেন না, তীক্ষ্ণ শীতল চোখের চাহনি।
রিকার্ডো ভাবতে পারছেন না, এর অন্তরালে কী আছে, এই জীবনে অনেক মহিলার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। কিন্তু এমন কাউকে দেখেননি।
কথার বলার চেষ্টা, কিন্তু কথা শুনবে কে?
অতীতের দিন মনে পড়ে যাচ্ছে। কত ঘটনাই না ঘটে গেছে এই জীবনে। কত উত্তেজনা, কত আবেগ, কত অভিমান।
উনি সিস্টার গ্রাসিলাকে বললেন- আমরা এই পথে যাব।
পথ চলে গেছে সেন্ট ভ্যালেনটিনের দিকে। দোকানের সামনে তারা দাঁড়ালেন। এখানে গানের জিনিসপত্র বিক্রি হয়। রিকার্ডো বললেন, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, একটুখানি দাঁড়ান সিস্টার, আমি এক্ষুনি আসছি।
রিকার্ডো দোকানের মধ্যে ঢুকে গেলেন। একজন ক্লার্ক বললেন আপনাকে কী করে সাহায্য করব?
–আমি দুটো গীটার কিনব।
–ঠিক আছে, রামিরেস চলবে? সেটাই বাজারের সেরা।
ভালো জিনিস চাই। আমার বন্ধু আর আমি বাজাব, তবে আমরা কিন্তু অ্যামেচার।
–কোনাস? পাঁচ হাজার পেস্তা?
রিকার্ডো বললেন, হ্যাঁ, এতেই চলবে।
রিকার্ডো বাইরে বেরিয়ে এলেন, দুহাতে দুটি গীটার। মনে হল, সিস্টার গ্রাসিলা বোধহয় চলে গেছেন। কিন্তু সিস্টার দাঁড়িয়ে আছেন, শান্তভাবে কী করছেন। রিকার্ডো একটা গীটার তুলে দিলেন সিস্টারের হাতে। বললেন, এটা আপনার কাঁধে বুলিয়ে নিন।
সিস্টার তাকালেন।
রিকার্ডো বললেন- এটা লোককে বোকা বানাবার চেষ্টা।
গ্রাসিলা গীটারটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখলেন। এবার যাত্রা শুরু হবে সেভোগিয়ার দিকে। চারপাশে রোমান স্থাপত্যের নিদর্শন।
রিকার্ডো আবার বললেন সিস্টার, আপনি কথা বলছেন না কেন? কথা বলার চেষ্টা করুন। দেখুন তো, চারপাশে কী অসাধারণ ভাস্কর্য। ইতিহাসে লেখা আছে, দুহাজার বছর আগে শয়তান এই বাড়িগুলো তৈরি করেছিল। পাথরের পর পাথর জুড়ে। কীভাবে একটা অন্যের সঙ্গে আটকে আছে বলুন তো?
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। রিকার্ডোর খিদে পেয়েছিল। সিস্টার কোনো কথা বলছেন না।
–আমরা কিছু খাব কি সিস্টার?
সিস্টার তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। রিকার্ডো একটা ছোটো কাফের মধ্যে ঢুকে গেলেন। গ্রাসিলা তাকে অনুসরণ করছেন।
সিস্টার আপনি কী খাবেন? এখনও জবাব নেই। রিকার্ডো ওয়েট্রেসকে বললেন– সুপ দিন, সসার আছে কি?
গ্রাসিলা চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন। অন্যদিকের টেবিলে যারা বসে আছে, তারা আমার দিকে দেখছে কেন? আহা, আমি কী অসাধারণ সুন্দরী?
গ্রাসিলার ওই নীরব আচরণ, কিন্তু রিকার্ডো তখনও তাকে ছাড়তে পারছেন না। তিনি মাঝে মধ্যে চোরা চোখে গ্রাসিলাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কী নামে এই মেয়েটিকে ডাকব? আকর্ষণীয় নাকি বোকা? ঠাণ্ডা রক্তের নাকি কামনাময়ী? আমার মনে হয় না উনি এত বোকা? যে কোনো কারণে এখন এই অভিনয় করছেন।
চলে যাবার সময় হয়েছে, রিকার্ডো বিল মিটিয়ে দিলেন। তিনি দেখলেন, সিস্টার গ্রাসিলার মুখে সামান্য আলোক উদ্ভাস।
তারা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললেন। শহরকে দূরে রেখে। মাঞ্জারাসের কাছে পৌঁছে গেলেন। একদল জিপসী এগিয়ে চলেছে, চারটি সুন্দর করে সাজানো ওয়াগন, ঘোড়ায় টানছে। রিকার্ডো বললেন, সিস্টার, দেখা যাক লিফ পাওয়া যায় কিনা।
–লিফ পেতে পারি?
গ্রাসিলাকে দেখে জিপসী বলল- হ্যাঁ হতে পারে, আপনারা কোথায় চলেছেন?
–গোয়াডারমা পাহাড়ের দিকে।
–আমরা সেরেজ পর্যন্ত যাব।
–অসংখ্য ধন্যবাদ।
যাত্রা শুরু হল। কিন্তু গ্রাসিলা কি রাজী হবেন? গ্রাসিলা শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন। ওয়াগনের ভেতর জনা ছয়েক জিপসী বসে আছে। তারা রিকার্ডো এবং গ্রাসিলাকে জায়গা করে দিল।
ক্যারাভ্যান এগিয়ে চলেছে। দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে। সূর্য বুঝি ফার্নেসের আগুন। অসম্ভব উত্তাপ। পৃথিবী ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। আকাশের কোথাও মেঘের আনাগোনা নেই। ওয়াগন এবার সমতল ভূমিতে এসে গেছে। রিকার্ডো ভাবলেন, আকাশে উড়ছে শকুনের দল।
সন্ধ্যে হব হব, এবার ক্যারাভ্যান থামবে। নেতা এগিয়ে এলেন।
এখানেই নামতে হবে। আমরা ভিনিউয়েল পর্যন্ত যাব।
–অনেক ধন্যবাদ।
গ্রাসিলার হাত ধরলেন রিকার্ডো।
জীপসীর দিকে তাকিয়ে বললেন– কিছু খাবার দেবেন কী? আমরা বড়োই ক্ষুধার্ত। অবশ্য দাম দেব।
দুটি ফলের প্যাকেট, আহা, জিপসীদের মন কত ভালো। কিন্তু কেউই তাদের পছন্দ করে না।
.
অসাধারণ একটি উপত্যকা, আপেল গাছ, ডুমুর গাছ। কয়েক ফুট দূরে টমাস নদী, আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। কতদিন আগে রিকার্ডো এখানে মাছ ধরতে আসতেন।
অদূরে গোয়াডারমা পাহাড়শ্রেণী, রিকার্ডো এই জায়গাটা খুব ভালোভাবেই জানেন। ছোটোবেলা থেকে এখানে তার আনাগোনা।
না, ওই পাষাণ প্রতিমার সাথে কথা বলে লাভ নেই। সিস্টার গ্রাসিলা আপন মনে পথ হাঁটছেন। সামনের দিকে পথটা খুব একটা ভালো নয়। আকোকা কি এখানে কোন পুলিশ ক্যাম্প বসিয়েছেন?
আমরা গ্রামে দিকে চলে যাব, কোথাও গিয়ে সামান্য বিশ্রাম নিতে হবে।
আবার রিকার্ডো কথা বলার চেষ্টা করলেন, সিস্টার কিন্তু জবাব দিলেন না।
.
এটা হল সেই গ্রাম, শান্ত এবং সুশীতল। অদূরে অরণ্যের ঘন ছায়া। সন্ধ্যে হয়েছে। রিকার্ডো ভাবলেন, সব ঘটনা ভুলে যেতে হবে। একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল। এই শব্দের উৎস কোথায়? একটা প্লেন আকাশে উড়ছে। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
রিকার্ডো চিৎকার করলেন, মাথা নীচু করুন। প্লেনটা অতি দ্রুত নীচে নেমে এল। আবার আকাশের দিকে উড়ে গেল। আর একটু হলে গ্রাসিলা আহত হতেন। ঠিক সময়ে রিকার্ডো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে সরিয়ে দিলেন। এর পরবর্তী মুহূর্তে যা ঘটল, রিকার্ডো অবাক হয়ে গেছেন। গ্রাসিলা চিৎকার করতে শুরু করলেন। লড়াই শুরু হয়ে গেছে। তিনি লাথি মারছেন, ঘুষি মারছেন। চোখ অন্ধ করার চেষ্টা করছেন। তিনি কোনো কথা বলার চেষ্টা করছেন না, কিন্তু এমন কিছু শব্দ তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে, যা অশ্লীলতায় ভরা, এমন সুন্দরী একটি মহিলা এমন কথা বলতে পারেন।
নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেন। মনে হচ্ছে একটা বুনো বেড়াল বোধহয় রাগে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
রিকার্ডো চিৎকার করলেন– আমাদের এখানে থাকাটা মোটেই উচিত হবে না। এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে।
তখনও ওই সিস্টার লড়াই করছেন। এর কারণ কী? গ্রাসিলা আপনি এমন করছেন কেন? শান্তভাবে জানবার চেষ্টা করলেন রিকার্ডো।
রিকার্ডো বললেন– সিস্টার, লুকিয়ে থাকার একটা জায়গা আবিষ্কার করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে সোলজাররা এসে যাবে। আপনি যদি কনভেন্টে যেতে চান তাহলে আমাকে অনুসরণ করুন।
গ্রাসিলা এখনও চিৎকার করার চেষ্টা করছেন। গ্রাসিলা শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখে কীসের ছায়া পড়েছে। চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখ লাল। এখনও এক অসাধারণ সৌন্দর্য।
রিকার্ডো বললেন– আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য দুঃখিত। আমি জানি না আপনার মতো সিস্টারের সাথে কী ধরনের ব্যবহার করা উচিত। ভবিষ্যতে আমি আরও সতর্ক থাকব।
কালো চোখে অদ্ভুত চাউনি। চোখ জলে ভরে গেছে। রিকার্ডো জানেন না, এখন সিস্টার কী চিন্তা করছেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আশেপাশে অনেকগুলো গুহা আছে, রিকার্ডো বললেন, কোনো একটা গুহার মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে। সমস্ত রাত সেখানেই থাকতে হবে। সকালবেলা আমরা আবার পথ দিয়ে হাঁটবো।
রিকার্ডো বুঝতে পারলেন, মুখের নানা জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে। সিস্টার নখ দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছেন। যা হয়েছে তার জন্য দুঃখ করে কী লাভ? এখনও ওই মেয়েটি সম্পর্কে তার আকাশ ছোঁয়া কৌতূহল।
এখন চারপাশে নীরবতা, নেমে আসছে ঘন অন্ধকার।
.
বাতাস বয়ে চলেছে, অন্ধকার গুহার ভেতর ঢোকার অনুমতি পাচ্ছে না। আশেপাশে পাহাড়চূড়া।
যেখানে ওই প্লেনটির সাথে দেখা হয়েছিল, তার থেকে তারা একমাইল দূরে চলে এসেছেন। এই গুহাটি রিকার্ডোর পছন্দ হয়েছে। ঘন ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা এর প্রবেশ পথ।
উনি বললেন- এখানেই থাকতে হবে। হামাগুড়ি দিয়ে তারা ভেতরে ঢুকে গেলেন। একটুখানি আলো দেখা যাচ্ছে, বাকিটুকু অন্ধকারে ঢাকা।
রিকার্ডো বললেন, ভেতরে অপেক্ষা করুন। আমি কটা গাছের ডাল নিয়ে আসছি। মুখটা ভালো করে বন্ধ করতে হবে। যাতে সৈন্যরা আমাদের দেখতে না পায়।
তিনি দেখলেন, গ্রাসিলা অন্ধকারে চুপ করে বসে আছেন। রিকার্ডো ভাবলেন, আমি ফিরে আসা পর্যন্ত সিস্টার এখানে থাকবেন তো? অজ্ঞাত কারণে রিকার্ডোর মনে হল, এখন গ্রাসিলার সাহচর্য বড্ড বেশি দরকার।
.
গ্রাসিলা গুহার মধ্যে ঢুকে পড়লেন। দেখলেন রিকার্ডো সেখান থেকে চলে যাচ্ছেন। ঠাণ্ডা মাটিতে বসে থাকলেন। নিরাশার মধ্যে।
আর ভালো লাগছে না, তিনি ভাবলেন, যিশু তুমি কোথায়? আমাকে নরকের এই অন্ধকার থেকে উদ্ধার করো।
প্রথম থেকেই তাকে লড়াই করতে হয়েছে। রিকার্ডোর প্রতি একটা অজানা আকর্ষণ। মুরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকেই ভয় পাচ্ছি। আমি এই পুরুষটিকে চাইছি, কিন্তু কেন?
তাই তো নীরবতার এই প্রাচীর। এই নীরবতার মধ্যেই কনভেন্টের জীবন কেটে গেছে। কিন্তু এখন তো আমি বাইরে এসেছি। এখন আমাকে প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে হয় না। নির্দিষ্ট নিয়মনীতি পালন করতে হয় না। গ্রাসিলার মনে হল, মনের মধ্যে আলো জ্বলে উঠেছে। অনেক বছর ধরে আমি লড়াই করেছি, অনেক আর্তনাদ, অনেক দীর্ঘশ্বাস, আর ভালো লাগছে না।
মুর তাকিয়ে আছে আমার নগ্ন শরীরটার দিকে। না, তুমি একাট শিশু, জামা কাপড় পড়ে নাও, এখানে থেকে চলে যেও।
না, না মুর, আমি এক পূর্ণবয়স্কা যুবতী, তুমি তাকিয়ে থাকো, আমার উদ্ধত দুটি স্তনের দিকে। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে আরাম দেব।
এই অনুভূতিটা ভুলতে অনেক বছর সময় লেগেছে। এখনও মনে পড়ে, এখনও মনে পড়ে অনেক কিছু।
মায়ের চিৎকার, কুকুরীর বাচ্চা!
ডাক্তার বলেছিলেন আমাদের চিফ সার্জেন্ট নিজে তোমাকে দেখবেন। তোমার মাথায় যেন কোনো কাটা চিহ্ন না থাকে।
রিকার্ডো মেলাডোর দিকে তাকিয়ে গ্রাসিলার বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠেছিল। অতীতের অনেক স্মৃতি ফিরে এসেছিল। ভদ্রলোক সত্যিই সুন্দর, সরল স্বভাবের। গ্রাসিলা যখন ছোট্ট শিশু, তখন তিনি রিকার্ডোর মতো এক প্রেমিকের স্বপ্ন দেখতেন। তারপর স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। গ্রাসিলা যুবতী হয়ে উঠেছেন। এখন তিনি যিশুখ্রিস্টের সহধর্মিণী। এখন তিনি মনে কোনো পাপ চিন্তা আনতে পারেন না।
গ্রাসিলা তাই এই নীরবতার বাঁধনে নিজেকে বেঁধে রেখেছেন।
শেষ পর্যন্ত কী হবে? একটা শব্দ শোনা গেল। চারটে সবুজ চোখ, তাকিয়ে আছে, এক দৃষ্টিতে। গ্রাসিলার মনে আতঙ্ক এবং ভয়, তবু তিনি চিৎকার করতে পারলেন না। নেকড়ের বাচ্চা। জুলজুল করে দেখছে। গ্রাসিলা হাত বাড়িয়ে দিলেন। তোক না ভাব ভালোবাসা। বাচ্চা দুটো ভাবছে, আমাদের গুহায় এ কোন্ অচেনা অতিথি।
দরজায় পায়ের শব্দ। গ্রাসিলার মন শান্ত। রিকার্ডো ফিরে এসেছেন।
পরমুহর্তে আগুন জ্বলে উঠল, বিরাট আকারের একটা নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গ্রাসিলার বুকের ওপর!
.
২৭.
লুসিয়া টাভারনার পাশে এসে দাঁড়লেন। দীর্ঘশ্বাস নিলেন। রুবিও ভেতরে বসে আছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?
আমি এমন কোনো আচরণ করব না, যাতে সন্দেহ হতে পারে। আটটার সময় নতুন পাশপোর্ট পাব, সুইজারল্যান্ডের দিকে যাত্রা করব।
রুবিও তাঁকে দেখে খুশি হলেন। উঠে দাঁড়ালেন।
–আমি খুব চিন্তা করছিলাম। এতক্ষণ সময় কেটে গেল, আমি ভেবেছিলাম হয়তো ভয়ংকর কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে।
লুসিয়া রুবিওর হাতে হাতে রেখে বললেন কিছুই হয়নি।
আমি আমার স্বাধীনতা কিনেছি, একথা তিনি মুখে বললেন না। কাল আমি এদেশ থেকে চলে যাব, না, একথাও জানাননি।
রুবিও লুসিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতে হাত রেখেছেন। ভালোবাসার বিশুদ্ধ উচ্চারণ।
টাভারনার চারদিকে চোখ মেলে দিলেন লুসিয়া। মানুষজন আনন্দে হৈ হৈ করছে। গান বাজনা হুল্লোড়।
একজন এই টেবিলে চলে এলেন।
–গান গাইতে পারেন? আমাদের সঙ্গে আসুন।
রুবিও মাথা নাড়লেন–না।
–সমস্যা কী হয়েছে?
–তোমরা গান করো। রুবিও দেখলেন, এসব পুরোনো গানে ফ্রাঙ্কোকে প্রশংসা করা হয়েছে।
বেশ কয়েকজন যুবক তখন চারপাশে ঘিরে ধরেছে। তারা সকলেই মত্ত মাতাল, তাদের আচরণে বোঝা যাচ্ছে।
–সিনর, আপনি কি ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে নাকি?
লুসিয়া বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা গুরুতর। এখনই হৈ হট্টগোল শুরু হবে।
লুসিয়া ডাকলেন–রুবিও?
রুবিও সংকেতটা বুঝতে পেরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিলেন– না, আমি ভাই কারোর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এই শব্দগুলো আমি জানি না।
-ঠিক আছে, আমরা সকলে একসঙ্গে গাইব।
সকলে রুবিওর জন্য অপেক্ষা করছে।
রুবিও লুসিয়ার দিকে তাকালেন– চলল, এখান থেকে চলে যাই। কিন্তু তার আগে? গান শুরু হয়ে গেছে। লুসিয়া বুঝতে পারলেন, রুবিও নিজেকে নিজের মধ্যে আটকে রাখতে পারছেন না।
গান শেষ হয়ে গেল, একজন যুবক রুবিওর পিঠ চাপড়ে বলল– ভালো গেয়েছেন, আপনার গলা তত বেশ ভালো।
রুবিও চুপচাপ বসে রইলেন। ওরা কখন যাবে?
একজন লুসিয়ার কোলে ওই জ্যাকেটটা দেখতে পেল।
–এখানে কী লুকিয়ে রেখেছেন মিস?
তার বন্ধু বলল দেখা যাক, কি আছে সেখানে।
আপনি কি আপনার প্যান্টিটা খুলে দেখাবেন, সেখানে কী লুকোনো আছে?
এই কথা শুনে রুবিও খুব রেগে গেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘুষি চালিয়ে দিলেন। লোকটা পড়ে গেল।
লুসিয়া চিৎকার করছেন–না, রুবিও এমন কোরো না। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। মারামারি শুরু হয়ে গেল। কে যেন মদের বোতল ছুঁড়ে ভেঙে দিয়েছে। চেয়ার টেবিল উল্টে ফেলা হল। মনে হল লোকগুলো বোধহয় বাতাসে ভর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। অশ্রাব্য গালিগালানজ। রুবিও দুজন মানুষকে মাটিতে ফেলে বেদম পেটাতে শুরু করে দিয়েছেন। তৃতীয় জন তার দিকে ছুটে আসছে। রুবিওর পেটে লাথি মেরে দিল। রুবিও কঁকিয়ে উঠলেন।
রুবিও চলো এখান থেকে চলে যাই।
কোনোরকমে রুবিও বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেন।
লুসিয়া বললেন– চলো চলো এখানে আর থাকব না।
কিন্তু? আটটার সময় আমাকে যে এখানে আসতেই হবে। আটটা পর্যন্ত কোথায় লুকিয়ে থাকব? রুবিও মাথা মোটা, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না।
তারা ক্যালেসানটা মারিয়ার দিকে চলে গেলেন। গোলমালের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। বিরাট একটা চার্চ, টিগলেশিয়া সানটা মারিয়া। লুসিয়া সিঁড়ির ওপর দাঁড়ালেন। হাঁফাচ্ছেন তখনও। তারপর? দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। এই চার্চে কেউ নেই।
রুবিও ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছেন।
লুসিয়া বললেন– এখানে আমরা নিরাপদ। তুমি খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারো।
কিন্তু একী? ভলকে ভলকে রক্ত বেরোচ্ছে রুবিওর পেট থেকে। লুসিয়ার মনে হল তিনি বোধহয় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন– কী হয়েছে?
ফিসফিস করে রুবিও জবাব দিলেন– গুণ্ডাটা একটা ছুরি ব্যবহার করেছিল। রুবিও থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝের ওপর পড়ে গেলেন।
লুসিয়া হাঁটু গেড়ে বসে বললেন– একদম নড়াচড়া করো না।
লুসিয়া শার্ট খুলে দিলেন। শার্টটা পেটের ওপর চেপে ধরলেন। যদি রক্ত স্রোতকে বন্ধ করা যায়। রুবিওর মুখ এখন চকের মতো সাদা।
তুমি যে কেন এই লড়াই করলে? লুসিয়া রেগে জানতে চাইলেন।
–তোমাকে এত খারাপ কথা বলল, আমি সহ্য করতে পারিনি।
কথাগুলো লুসিয়ার হৃদয় স্পর্শ করেছে। হায় ঈশ্বর, এই লোকটা আর কতবার আমার জন্য জীবন উৎসর্গ করবে!
লুসিয়া বললেন– আমি তোমাকে মরতে দেব না। দেখা যাক কী করা যায়।
কিন্তু কী হবে? জল এবং তোয়ালে পাওয়া গেল, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করা হল। বুঝতে পারা যাচ্ছে, সমস্ত শরীর জুড়ে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। লুসিয়া মাথার ওপর তোয়ালে বুলিয়ে দিলেন। রুবিওর চোখ দুটো বন্ধ। মনে হয় উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। লুসিয়া তার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাবলেন, এ বাঁচবে তো?
আমরা তোমাদের খামারে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করব রুবিও। তোমার মা আর বোনেদের সঙ্গে দেখা করব। তোমার কী মনে হয়, ওরা কি আমাকে মেনে নেবেন? আমি খুব ভালো কাজ করব দেখো।
সমস্ত সন্ধ্যেটা এইভাবে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল।
তারপর? তারপর হঠাৎ লুসিয়া দেখলেন, আকুল কান্না এসে তার দুচোখ ভাসিয়ে দিয়েছে। তিনি ভাবলেন, এটাও কী একটা স্বপ্ন হয়ে থেকে যাবে!
চার্চের দেয়ালে সন্ধ্যের ছায়া ঘন হচ্ছে। কাঁচের জানলার ভেতর দিয়ে বিদায়ী রশ্মির শেষে কিরণ। তাও হারিয়ে গেল। এখন চারপাশ ঘন অন্ধকারে মুখ ঢেকেছে। লুসিয়া ব্যাণ্ডেজটা পালটে দিলেন। চার্চের ঘণ্টা ধ্বনি বাজতে শুরু করেছে। এক-দুই-তিন-চার পাঁচ ছয়, আটটা বাজল, এবার তো যেতেই হবে।
রুবিওর গায়ে হাত দিলেন। জ্বর এসেছে। ঘাম হচ্ছে, নিশ্বাস খুব ধীরে। এখন রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। হয়তো ভেতরে? জানি না, ঈশ্বর তুমি একে বাঁচাও।
রুবিও, ডার্লিং।
রুবিও চোখ খুললেন। অর্ধ অচেতন।
–আমি এখুনি আসছি।
রুবিও অসহায়ের মতো হাত ধরে বলেছিলেন– প্লীজ।
–আমি এখুনি আসছি।
লুসিয়া হাত ছাড়িয়ে নিলেন। শেষবারের মতো তাকালেন। আঃ, একে আমি সাহায্য করতে পারলাম না।
লুসিয়া দ্রুত সোনার ক্রশ তুলে নিলেন। চার্চের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। চোখ ভরতি জলে, কিন্তু কী করা যাবে। জনাকীর্ণ পথ দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলেছেন। ওই দোকানটাতে পোঁছোতে হবে। ছাড়পত্র এসে গেছে?
আরও জোরে, আরও জোরে!
পুলিশ স্টেশনের ভেতর একজন ইউনিফর্ম পরা অফিসার বসেছিলেন। তিনি লুসিয়ার দিকে তাকালেন। তারপর? লুসিয়া বললেন, একজনকে ছুরি মারা হয়েছে। লোকটা বোধহয় মরে যাবে। আপনার সাহায্য চাইছি।
পুলিশের কর্তা কোনো কথা বললেন না। তিনি একটা টেলিফোন নিয়ে কিছু বললেন। এখুনি ওরা সাহায্য করতে আসবেন।
চোখের পলক ফেলার আগেই দুজন গোয়েন্দা পৌঁছে গেছেন।
–একজনকে ছুরি মারা হয়েছে।
চলুন যাচ্ছি।
রাস্তায় একটা ডাক্তারকে তুলতে হবে। একজন গোয়েন্দা বললেন।
বাড়ি থেকে একজন ডাক্তারকে তুলে নেওয়া হল। লুসিয়া চার্চের দিকে এগিয়ে গেলেন।
একটু বাদে ডাক্তার বললেন- লোকটা এখনও বেঁচে আছে, অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে।
লুসিয়া মাথা নেড়ে ভাবলেন, আহা, আমার কাজ আমি করেছি। আর হয়তো কখনও তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।
দুজন গোয়েন্দা হঠাৎ লুসিয়ার প্রতি এত আগ্রহী কেন? লুসিয়া জানেন না, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাঁর ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
একটু বাদে একজন বললেন– সিনোরিটা, অনুগ্রহ করে আপনি একবার পুলিশ স্টেশনে আসবেন কি? আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে হবে।
.
২৮.
রিকার্ডো মেলাডো একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দেখলেন একটা বিরাট নেকড়ে গুহার ভেতর ঢুকে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য তিনি পাথর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর প্রাণ হাতে করে এগিয়ে চললেন।
–সিস্টার?
আবছা আলোয় দেখা গেল, ওই বিরাট জন্তুটা গ্রাসিলাকে আক্রমণ করছে।
রিকার্ডো কী করবেন বুঝতে পারছেন না। যুদ্ধ শুরু করে লাভ কি?
চেতনা হারাতে থাকেন তিনি, গ্রাসিলা বলছেন– কী হবে?
সত্যিই তো, একমুহূর্ত বাদে হতবাক গ্রাসিলা বাইরে বেরিয়ে এলেন। রিকার্ডো ইতিমধ্যেই তার কাছে পৌঁছে গেছেন। মস্ত বড়ো একটা পাথরের টুকরো ছিল, সেটা দিয়ে কোনোমতে দরজাটা আটকিয়ে দেওয়া হল। তারপর? অন্ধকার অরণ্যে তারা দুজন। মনে হচ্ছে এবার বোধহয় মৃত্যুর উপত্যকা থেকে জীবনের সমতলে ফিরে আসতে পেরেছেন।
.
স্তেপ পাহাড়ের পথে তাদের ভ্রমণ শুরু হয়েছে। ঘণ্টা কেটে গেছে, ছোট্ট একটা ঝরনা, রিকার্ডো বললেন, আসুন, এখানে কিছুক্ষণ বসা যাক।
ব্যাণ্ডেজ নেই, অ্যান্টিসেপ্টিক নেই, এখানে সেখানে নখরের আঁচড়। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। ঠাণ্ডা জলে ব্যথা কিছুটা উপশম হল। দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। কেউ কোনো কথা বলতে পারছেন না। হঠাৎ কী যেন ঘটে গেল। রিকার্ডো আলিঙ্গন করলেন গ্রাসিলাকে। ঠোঁটে ঠোঁট এবং হাতে হাত। অনেক কথা না বলা থেকে গেছে।
গ্রাসিলার অতীত? গ্রাসিলার ভবিষ্যৎ? গ্রাসিলা কি ঈশ্বরকে ভাবছেন? হায় ঈশ্বর, তুমি আমার জন্য এত আনন্দ জমিয়ে রেখেছ? অথচ আমি তার হদিস পাইনি। দুজনে কথা বলছেন, গ্রাসিলার সৌন্দর্য এখনও রিকার্ডোকে আকর্ষণ করছে। রিকার্ডো ভাবলেন, এই সিস্টার এখন আমার, সম্পূর্ণভাবে আমার। তিনি আর কখনও কনভেন্টে ফিরে যাবেন না। আমরা বিয়ে করব, আমাদের ছেলেমেয়ে হবে, উপযুক্ত সংসার।
কথাটা ভাসিয়ে দিলেন রিকার্ডো।
গ্রাসিলা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ আমি রাজি। তখনও আলিঙ্গনের পালা চলেছে। কিন্তু? এটাই তো আমি চেয়েছিলাম, গ্রাসিলা ভাবলেন। কিন্তু আমার স্বপ্ন সফল হয়নি।
রিকার্ডো বললেন– আমরা ফ্রান্সে যাব। সেখানে আমরা নিরাপদে থাকব। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে আমরা স্পেনে ফিরে আসব।
গ্রাসিলা জানেন তিনি ওই লোকটির সাথে পৃথিবীর যে কোনো দেশে যেতে পারেন। যদি বিপদের সম্ভাবনা থাকে, তিনি তা ভাগ করে নেবেন।
অনেক কথাই বলা হল, রিকার্ডো জানালেন কীভাবে তিনি জাইমে মিরোর সংস্পর্শে এসেছেন। কীভাবে বাবার সাথে মনোমালিন্য দেখা দিয়েছিল। গ্রাসিলাকে বলা হল তার অতীত সম্পর্কে বলতে। গ্রাসিলা কিন্তু কিছুই বললেন না। গ্রাসিলা ভাবলেন, আমি বলতে পারব না, তাহলে দেখা দেবে শুধু ঘৃণা আর লজ্জা।
সকাল হয়ে এসেছে, সূর্য হামাগুড়ি দিচ্ছে। পাহাড়ের ওধারে লাল আভা দেখা যাচ্ছে।
রিকার্ডো বললেন– আজ সারাদিন এখানে কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। অন্ধকারে আবার যাত্রা শুরু হবে।– জিপসীদের দেওয়া খাবারের কিছুটা তখনও ছিল। তারা খেলেন, খানিকটা জমিয়ে রাখলেন ভবিষ্যতের জন্য।
সুখের পরিকল্পনা, আগামী দিন যাপন। কোথা থেকে শুরু হবে, কেউ তা জানেন না। কিন্তু এখানে এত গোলমাল? রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা? স্পেনে আবার ফেরা সম্ভব হবে তো? নাকি আরব ইজরায়েলের মতো চিরদিন অনিশ্চয়তা? মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি এবং তার বাবা রবার্ট কেনেডিকে হত্যা করা হয়েছে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ারকেও মেরে ফেলা হয়েছে। বার্লিন দেওয়াল? দুর্ভিক্ষ? বন্যা? ভূমিকম্প? ধর্না? বিক্ষোভ? এইভাবেই তো মানুষের স্বপ্ন আজ ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবন? শুধু আমাদের কেন? হাজার লক্ষ মানুষের?
অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে রিকার্ডো বললেন দেখো, শেষ অব্দি আমরা তো জীবনকে আঁকড়ে ধরতে পেরেছি। আমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি। এটাই বোধহয় ভগবানের সবথেকে বড় উপহার।
গ্রাসিলার কণ্ঠস্বরে জেগেছে একটা অদ্ভুত কোমলতা। তিনি অতীতের কথা বলতে শুরু করলেন। পরিষ্কার জানালেন আমার মা ছিলেন এক বারাঙ্গনা। প্রতি রাতে আমি নতুন এক পুরুষ খদ্দেরকে দেখতে পেতাম। চোদ্দো বছর বয়সে আমি এক পুরুষকে আমার শরীরটা দিয়েছিলাম। তার পৌরুষ আমাকে আকর্ষণ করেছিল। চোখের সামনে মা তার সাথে অসভ্য খেলা খেলবে, আমি তা সহ্য করতে পারিনি। আমিও হয়তো একটা বেশ্যায় পরিণত হতাম, কিন্তু তা হইনি, কেন জানো? আমি বিশ্বাস করি দৃঢ় মন থাকলে মানুষ অনেক বিপদকে অতিক্রম করতে পারে। আমি শেষ পর্যন্ত একটা শান্ত পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছিলাম, শান্ত এবং পরিচ্ছন্ন।
রিকার্ডো চিৎকার করে বললেন- না-না, আর বলতে হবে না। আমাদের অনেকেরই একটা দুঃখজনক অতীত থাকে। তাকে ঘাটিয়ে কী লাভ!
সময় বয়ে যাচ্ছে, রিকার্ডো বললেন ফেডারিকো গার্সিয়া লোরকার একটা কবিতা শুনবে?
রাত্রিটা আর কখনো আসবে না।
তুমিও আসবে না
আমিও যাব না কোথাও
কিন্তু তোমাকে আসতে হবে
তোমার ঠোঁট লবণাক্ত বৃষ্টিধারায় দগ্ধ,
দিনের স্বপ্ন সফল হবে কি
না, তুমিও আসবে না
আমিও আসব না।
আমি কোথাও যাব না।
কিন্তু আমাকে আসতে হবে
অন্ধকারের কাদায় আচ্ছন্ন জল ভেঙে
রাত কিংবা দিন আমাদের স্বপ্ন সফল করবে না
তোমার জন্য আমার মৃত্যু হবে এবং
আমার জন্য মারা যাবে তুমি
কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে এসেছে, ভাবতে পারা যাচ্ছে না, এমন সুন্দর সুখী একটি ভবিষ্যৎ?
বিশ্ব চরাচর জুড়ে নিঃসীম নৈঃশব্দ।
গ্রাসিলা চোখ বুজলেন, এই প্রথম একটা অদ্ভুত আনন্দ তার সমস্ত শরীরকে পরিপ্লবিত করছে।
.
২৯.
একটা সূত্র হারিয়ে গেছে। কিন্তু সূত্রটা বের করতে হবে।
অ্যালান টাকার ভাবতে থাকেন। কীভাবে? বুঝতে পারা যাচ্ছে না।
ব্যাপারটার মধ্যে গোলমাল আছে, বিপদসংকুল পথ। টাকার জানেন তাকে আরও সতর্ক এবং সচেতন হতে হবে। যেন এটা কোনো দিবা স্বপ্নে পরিণত না হয়, তাকে অসম লড়াইতে অবতীর্ণ হতে হয়েছে।
ফাদার বেরেনডার সাথে কথাবার্তা শুরু হল।
ফাদার, সেই চাষী দম্পতির খবর কী? মেগান প্যাট্রিসিয়াকে যারা দেখতে পেয়েছিল?
বৃদ্ধ যাজকের মুখে হাসি অনেক দিন তুমি ওদের সাথে কথা বলতে পারবে না। কেন বল তো? হয়তো কোনো দিনই পারবে না।
টাকার অবাক হয়েছেন তার মানে!
অনেক বছর আগে ওই চাষী দম্পতির মৃত্যু হয়েছে।
নরকের অন্ধকার, কিন্তু আলো কোথায় ছোট্ট শিশুটার নিউমোনিয়া হয়েছিল তাই তো? কোন হাসপাতালে ওকে নিয়ে যাওয়া হয়?
হাসপাতালটা ১৯৬১ সালে পুড়ে গেছে। একটা নতুন হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। তাই কোনো রেকর্ড পাওয়া যাবে না। আঠাশ বছর আগের ঘটনা, পৃথিবীটা অনেকখানি পান্টে গেছে ভাই। এখন কি আর সেই দিনকাল আছে?
না, চারপাশে শুধুই হতাশা। কোথায় যাওয়া যেতে পারে? ওই অনাথ আশ্রম।
.
এলেন স্কট রোজই জানতে চান, মেয়েটিকে পাওয়া গেছে কিনা। অ্যালান বুঝতে পারেন, কণ্ঠস্বরে ব্যাকুলতা ঝরছে।
তার মানে? রহস্য ঘণীভূত হচ্ছে কি?
অ্যালান টাকার অনাথ আশ্রমে। বিচ্ছিরি পরিবেশ, একদল ছেলে গান গাইছে, কথা বলছে, এখানে স্কট সাম্রাজ্যের মহারানী বড় হয়ে উঠেছে? ব্যাপারটা ভাবতে কেমন খারাপ লাগে। আর ওই কুকুরিটা কিনা নিউইয়র্কে অভিজাত জীবন কাটিয়েছে?
একজন তরুণী এসে দাঁড়ালেন, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, সিনর?
অ্যালান টাকার হাসলেন–হ্যাঁ পারেন, কোটি ডলার দিয়ে। মুখে বললেন- এখানকার দায়িত্বে কে আছেন?
–সিনোরা অ্যাঞ্জেলস।
–উনি কি আছেন?
–হ্যাঁ, আমি আপনাকে ওঁর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।
দেখা হল। ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে, আশি বছর পার হয়েছে। চেহারাটা বেশ বড়ো, চোখে কেমন কঠিন আভা। মাথার চুল ধূসর এবং পাতলা। চোখ দুটি উজ্জ্বল ও পরিষ্কার।
–আপনি কি আমাদের কোনো একটি শিশুকে দত্তক নিতে এসেছেন? দেখুন কাকে পছন্দ হয়।
না সিনোরা, আমি একটি শিশু সম্পর্কে জানতে এসেছি, অনেক বছর আগে সে এই আশ্রম ছেড়ে চলে যায়।
অ্যাঞ্জেলস বললেন–আমি তো জানি না। কিছু বুঝতে পারছি না।
একটা ছোট্ট মেয়েকে এখানে আনা হয়েছিল, ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে।
অনেক দিন আগের কথা। হয়তো মেয়েটি এখানে নেই। পনেরো বছর বয়স হলে আমরা…
না সিনোরা, আমি জানি সে এখানে নেই। আমি জানতে চাইছি ঠিক কবে এখানে আনা হয়েছিল।
–এ ব্যাপারেও আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না।
ডিটেকটিভের হৃদয় গলছে- কেন? তার নাম জানা আছে। প্যাট্রিসিয়া স্কট, গোয়েন্দা মনে করলেন, কিন্তু অ্যালান মুখে বললেন– মেগান, তার নাম হল মেগান।
মার্সিডিজ অ্যাঞ্জেলসের মুখে আলো- না, কেউ এই মেয়েটিকে ভুলতে পারবে না। সে একটা শয়তানি ছিল, একদিন সে কী করেছিল জানেন?
.
পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার ইচ্ছে অ্যালানের নেই। সময় খুবই কম, শেষ অব্দি রেকর্ড ঘরে তারা পৌঁছে গেলেন।
ওই ফাইলে একটা ছবি থাকলে কেমন হত? পরবর্তীকালে ফটোকপি করতেই হবে। ফাইলটা নিজের চোখে দেখতে চাইলেন অ্যালান। কিন্তু রাজী হচ্ছেন না ওই ভদ্রমহিলা। সত্যিই তো, ফাইলগুলো একান্ত এবং গোপনীয়।
-ছোট্ট মেগান, তাকে কীভাবে সাহায্য করেছেন? তার জন্য কিছু ভালো খবর আছে।
–আপনি জানতে চাইছেন মেয়েটিকে কবে এখানে আনা হয়েছিল?
হ্যাঁ, মেয়েটির বাবা মারা গেছে, কিছু টাকা পয়সা আছে, তার হাতে তুলে দিতে হবে।
বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন। তাকিয়ে থাকলেন অ্যালানের মুখের দিকে।
অ্যালান হাসি হাসি মুখে বললেন আপনি আমার জন্য এত কষ্ট স্বীকার করছেন, আমি যদি এই অনাথ আশ্রমে একশো ডলার দান করি আপনি কিছু মনে করবেন? তারপর বাড়িয়ে বললেন দুশো? ঠিক আছে পাঁচশো ডলার?
অ্যাঞ্জেলসের মুখে হাসি আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সিনর। আমি দেখছি ফাইলটা পাওয়া যায় কিনা।
কাজটা করা সম্ভব হয়েছে। অ্যালান ভাবলেন। যিশু, তুমি মহান, তুমি করুণাঘন।
পয়লা অক্টোবর তারিখে প্লেনটা ধ্বংস হয়ে যায়, মেগানকে নিশ্চয়ই তার দশদিন বাদে : হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছিল। দিনটা এগারোই অক্টোবরের কাছাকাছি হবে।
অ্যাঞ্জেলস ফিরে এলেন– একটু খোঁজাখুঁজি করতে হল।
উনি ফাইলটা অ্যালানের হাতে তুলে দিলেন। লেখা আছে, মেগান, শিশু কন্যা, মা বাবার পরিচয় নেই। তারিখটা? ১৪ জুন, ১৯৪৭।
হতেই পারে না, অ্যালানের চোখে মুখে বিস্ময়। বিমানটা ধ্বংস হয়েছে ১ অক্টোবর তারিখে।
-তারপর? কী বলছেন সিনর? আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
–এই রিপোর্ট কে রাখে বলুন তো?
–আমাকে নিজেকেই সব কাজ করতে হয়। যখন কোনো শিশুকে এখানে আনা হয়, তার সম্পর্কে প্রাপ্তব্য সব তথ্য আমি লিখে রাখি।
স্বপ্ন ভাঙছে– আপনার কোনো ভুল হয়েছে কি? দিনটার ব্যাপারে?
রাগত কণ্ঠস্বর– আমি জানি সিনর, জুন এবং অক্টোবরের মধ্যে কী তফাত।
স্বপ্নটা ভেঙে গেছে। তার মানে? প্যাট্রিসিয়া স্কটের মৃত্যু হয়েছে বিমান দুর্ঘটনায়। এলেন স্কট কাকে খুঁজছেন?
অ্যালান টাকার উঠলেন– ধন্যবাদ।
অ্যালান টাকার চলে যাচ্ছেন, আহা, লোকটি বড়োই ভালো। কত উদার, পাঁচশো ডলার, অনাথ আশ্রমের অনেক কিছুই কেনা যাবে। নিউইয়র্ক থেকে একটা ফোন এসেছিল, এক লক্ষ ডলারের চেক, আহা, ভগবান ক্রমশ মুখ তুলে তাকাচ্ছেন। তাতেই তো সব কিছু…
.
অ্যালন টাকার রিপোর্ট দিলেন।
এখনও কোনো খবর পাইনি শ্রীমতী স্কট, বুঝতে পারছি না, অনেকে বলছেন মেয়েটি এখনও বেঁচে আছে।
এখন কণ্ঠস্বর একেবারে পালটে গেছে। খেলাটা শেষ হয়েছে, এলেন স্কট ভাবলেন, তা হলে? প্যাট্রিসিয়া? কী হল তার? কেউ তার খবর রাখল না।
.
৩০.
সিস্টার মেগান ফেলিক্স কারপিওর দিকে তাকিয়ে আছেন। যাত্রাপথ এগিয়ে গেছে, মেগান কি ভয় পেয়েছেন? ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কত বছর ধরে তাকে কনভেন্টের বদ্ধ ঘরে জীবন কাটাতে হয়েছে। আর কখনও যেন এই অনুভূতি না হয়।
মেগান এখন কী প্রার্থনা করছেন? তিনি কি অতীত দিনের কথা ভাবছেন? অনাথ আশ্রমের সেই কালো অন্ধকার দিন? সেই দিনগুলি কি আবার ফিরে আসবে? কিন্তু এখন? এখন তো তাকে সন্ত্রাসবাদীরা ঘিরে ধরেছে, তার জীবনটা এখন সরু সুতোর ওপর ঝুলছে। তা হলে?
সমস্ত রাত ধরে তারা হেঁটেছিলেন। ভোরবেলা থেমে গেলেন। মেগান আর অ্যাম্পায়রা জিরন, জাইমে মিরো ও ফেলিক্স কারপিওকে দেখা গেল, সামনে একটা মানচিত্র।
জাইমে বললেন- মেরিনা জেল ক্যাম্পোটে পৌঁছোতে আর চার মাইল। এই পথটা, আমরা যাব না। এখানে আমি গ্যারিসনের লোকজন থাকে। আমরা ভেলাডরি দিয়ে উত্তর পূর্ব দিকে এগিয়ে যাব। মনে হচ্ছে বিকেলের আগেই সেখানে পৌঁছতে পারব।
সিস্টার মেগানের মনে আনন্দের ঝরনা। সমস্ত রাত কীভাবে কেটে গেল। জাইমে দলের কর্তা। মেগান বুঝতে পেরেছেন, জাইমের মধ্যে একটা অসাধারণ পৌরুষ আছে।
সিস্টার মেগানের কথাবার্তা শুনে জাইমের কেবলই মনে হয়েছে, ইনি বোধহয় সত্যিকারের সিস্টার নন। এঁর অবস্থান কনভেন্ট থেকে অনেক হাজার মাইল দূরে।
অ্যাম্পারো জিরনকেও কিছুটা প্রভাবিত করা গেছে। পথ চলে গেছে গ্রামের পাশ দিয়ে। প্রকৃতি বন্য এবং শূন্য। নিরাঘ বাতাসের সুগন্ধ, পুরোনো গ্রাম, কোনো কোনো গ্রামে মানুষ নেই, নিস্তব্ধ নিথরতায় ভরা, পাহাড়ের ওপর পুরোনো দিনের একটা ভাঙা দুর্গ।
মেগানের চোখে অ্যাম্পায়রা বুঝি এক বুনো বেড়াল, অনায়াসে পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে হাঁটতে পারেন। কখনও ক্লান্তি বোধ করেন না।
শেষ অব্দি দূরে ভেলাডরি গ্রামটা দেখা গেল। জাইমে থেমে গেলেন।
সব কিছু ঠিক করা আছে।
কোনো চিন্তা নেই।
ব্যাঙ্ক কখন বন্ধ হয়?
–পাঁচটার সময়, অনেকটা সময় পাওয়া যাবে।
–আজকে ভালো টাকা জমেছে তাই তো?
হায় ঈশ্বর, এরা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করবেন? মেগান ভাবলেন, সামান্য উত্তেজনা।
.
তারা ভেলাডরি শহরের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন। জাইমে বললেন- জনগণের ভিড়ে লুকিয়ে থাকতে হবে। আজকে বুল ফাইটের লড়াই, হাজার হাজার মানুষ এখানে আসবে। কেউ যেন কারো কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না হই, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
কথা বলতে বলতে জাইমে জনগণের সঙ্গে মিশে গেলেন। মেগান এত মানুষের সমাবেশ কখনও দেখেননি। পথচারীরা আনন্দের সঙ্গে হেঁটে চলেছেন। গাড়ি এবং মোটর সাইকেল। বুল ফাইটের আসর জমে উঠবে। টুরিস্টরা এসেছেন, আশেপাশের শহর থেকে আরও নাগরিক। ছোটো ছেলেদের দেখা গেল নকল যুদ্ধের মহড়া দিতে।
শব্দ এবং শব্দ, কত রকম খাবার বিক্রি হচ্ছে। এটা সেটা কত কী?
মেগানের মনে হল, সত্যি খিদে পেয়েছে।
ফেলিক্স বললেন– জাইমে আমরা সকলেই ক্ষুধার্ত। আমরা কিছু কিনে খাব কি?
মেগানের হাতে কিছু খাবার তুলে দেওয়া হল।
খাবারটা চমৎকার। অনেক বছর বাদে মেগান রাস্তার খোলা খাবার খেতে পারলেন।
এইদিকে অ্যারেনা। জাইমে বললেন।
পার্কের মধ্যিখানে আসর বসবে, অ্যারেনাতে অনেক মানুষের ভিড়, চারটে টিকিট কাটার ঘর রয়েছে। লোকের লাইন পড়ে গেছে।
–আমরা কি ষাঁড়ের লড়াই দেখব? মেগান জানতে চাইলেন।
হ্যাঁ, দেখবো, দেখবেন কেমন উত্তেজনা। ফেলিক্স জবাব দিলেন।
মেগানের মনে নানা চিন্তার ভিড়, ফেলিক্স জবাব দিলেন– মাদ্রিদ আর বাকটোনাতে আসল লড়াই হয়। এখানে বুল ফাইটের আনন্দ নেই। নবীনরা যোগ দেয়, অ্যামেচারের দল। তাদের শক্তি নেই, সাহস নেই। মেগানের মনে হল, তাও তো উত্তেজনা থাকবে।
ওঁরা অ্যারেনাতে প্রবেশ করলেন। দেওয়ালে একটা পোস্টার রয়েছে। মেগান তাকালেন। জাইমে মিরার ছবি, তলায় লেখা আছে, হত্যার জন্য খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে। দশলক্ষ পেস্তা পুরস্কার দেওয়া হবে, জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে।
বোঝা গেল, যে মানুষটির সাথে মেগান হাঁটছেন, তিনি হলেন এক ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী, জাইমে ছবির দিকে তাকালেন– অনেকটা আমার মতো দেখতে, তাই নয়! তিনি চট করে পোস্টারটা ছিড়লেন, পাট করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন।
অ্যাম্পারো অবাক হয়ে গেছেন। একটা পোপার ছিড়লে কী হবে? সরকার কি আর বসে আছেন? হাজার হাজার পোস্টার ছেপে চারদিকে লটকে দিয়েছে।
জাইমে ভাবলেন, এই পোস্টারটা বোধহয় আমাদের জন্য সৌভাগ্য বহন করবে।
মেগানের চিন্তা এখন শান্ত হয়ে গেছে।
আমরা ভেতরে যাব।
বারোটা দরজা, এই বিশাল বাড়িটির মধ্যে। লাল লোহার দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। মানুষজন হৈ হৈ করছে। জাইমে ইতিমধ্যে টিকিট কেটেছেন। পাথরের বেঞ্চের ওপর বসার ব্যবস্থা। ছোটোবেলায় ষাঁড়ের লড়াইয়ের ছবি দেখতেন মেগান, মাদ্রিদে, হাজার লোকের সমাবেশ, কিন্তু এখানে অত আতিশয্য নেই।
ষাঁড়ের লড়াই শুরু হল। মেগান চোখ ভোলা রেখেছেন, সবকিছু তাঁকে দেখতে হবে। বিরাট একটা ষাঁড় ঢুকে পড়েছে, ওপাশ থেকে একটা মানুষকে দেখা গেল।
জাইমে তাকিয়ে আছেন মেগানের মুখের দিকে। জাইমের মনে হচ্ছে, ষাঁড়ের লড়াই মেয়েটিকে অসুস্থ করবে।
কিন্তু, সময় এগিয়ে চলেছে, লড়াই বেঁধে গেছে। উত্তেজনা, দুপক্ষ সমান লড়ছে।
বুল ফাইটের কথাগুলো মেগান পরপর বলে যাচ্ছেন, কিছু ইঙ্গিত কিছু সংকেত।
জাইমে অবাক হয়ে গেছেন সিস্টার, এ ব্যাপারে এত শব্দ আপনি জানলেন কী করে?
মেগান জবাব দিলেন আমার বাবা ছিলেন বুলফাইটার। ভালো করে দেখুন।
অ্যাম্পায়োর হঠাৎ মনে হল, জাইমে বোধহয় এই সিস্টারের প্রতি একটু বেশি আকর্ষণ বোধ করছে। কিন্তু কেন?
একজন ফেরিওয়ালাকে দেখা গেল, সে চট করে জাইমে মিরোর হাতে কিছু একটা খুঁজে দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল, জাইমে উঠে দাঁড়ালেন।
মেগান প্রশ্ন করলেন কী হয়েছে? চিন্তার কোনো কারণ ঘটেছে কি?
জাইমে বললেন- আমরা এখুনি লগনোর দিকে যাত্রা করব। সিস্টার, আপনি আমাকে লক্ষ্য রাখবেন। গেটের দিকে এগিয়ে আসবেন।
জাইমে অতি দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। জাইমে চোখের বাইরে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মেগান উঠে দাঁড়ালেন। জনগণের মধ্যে থেকে চিৎকার শুরু হয়েছে। এক অল্পবয়সী মাতাডোর শুয়ে পড়েছে, তার শরীরের সর্বত্র ক্ষতচিহ্ন। রক্ত বেরিয়ে আসছে, বালিতে রক্ত মিশে যাচ্ছে।
জাইমে অ্যাম্পারো এবং ফেলিক্স প্রবেশ পথের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।
জাইমে বললেন–তাড়াতাড়ি ছুটতে হবে।
ফেলিক্স জানতে চাইলেন–কী হয়েছে?
সৈন্যরা টমাসকে মেরে ফেলেছে, রুবিও ধরা পড়েছে, মদের আসরে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল সে।
মেগান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলেন সিস্টার, থেরেসা আর লুসিয়ার খবর কী?
–আমি জানি না, তাড়াতাড়ি করতে হবে, ব্যাঙ্কে লোকের ভিড় জমে উঠবে।
জাইমে চকিতে তার হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকালেন।
ফেলিক্স বলেছিলেন– আমরা আরেকটু অপেক্ষা করব কি? ঘণ্টা দুয়েকের জন্য?
মেগানের মনে নানা চিন্তার ভিড়।
তারা অ্যারেনা থেকে বাইরে চলে এসেছেন। ফেলিক্স একটা নীল রঙের সেডান গাড়ির দিকে তাকালেন।
ফেলিক্স বললেন- এটা কী হতে পারে।
গাড়িটা খুলে ফেলা হল গোপন চাবি দিয়ে। তারপর? অ্যাম্পারো বললেন– এবার এমন অভিনয় করুণ, মনে হবে আপনি বুঝি সত্যিই সিস্টার। যিশুর দোহাই, এখন কোনো গোলমাল করবেন না।
সামনে দুজন পুরুষ যাত্রী, জাইমে গাড়ি চালাচ্ছেন। অ্যাম্পায়রা পেছনের সীটে বসেছেন।
মেগান তার পাশে বসে পড়লেন। মেগান চোখ বন্ধ করেছেন।
হায় ঈশ্বর, এ কোন্ পাপ কাজের সঙ্গে আমাকে যোগ দিতে হল।
জাইমে বললেন- আমরা এই গাড়িটা চুরি করব না। এটাকে আমরা বাসকোর নামে অধিগ্রহণ করেছি।
.
নতলা বাড়ি, তারই একতলাতে ব্যাঙ্কের অবস্থিতি। গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। জাইমে ফেলিক্সকে বললেন- ইঞ্জিনটা চলতেই থাকবে। কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা এখানে চলে আসব।
ফেলিক্স অবাক হয়ে তাকালেন– কী বলছেন? আপনি একা যাবেন? এটা হতে পারে না। জাইমে, ব্যাপারটায় বিপদ আছে।
জাইমে বললেন আমার সঙ্গে অস্ত্র আছে, আমার জন্য চিন্তা করো না।
জাইমে হারিয়ে গেলেন ব্যাঙ্কের মধ্যে।
মেগানের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়েছে, মেগান প্রার্থনা করলেন, কনভেন্টে যেমন করতেন–
প্রার্থনার মাধ্যমেই আমরা হৃদয়ের উদ্বোধন ঘটাতে পারি। প্রার্থনা হল ধৈর্য, প্রার্থনা হল সেই অনির্বাণ শিখা, আমার হৃদয় শান্তিতে পরিপূর্ণ হোক।
কিন্তু মেগানের মন শান্ত হবে কী করে?
.
জাইমে মিরো দ্রুত ব্যাঙ্কের মধ্যে ঢুকে গেলেন। কাজকর্ম ঠিক মতো এগিয়ে চলেছে। কোথাও অশান্তির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। তিনি চট করে কাউন্টারে বসে থাকা লোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। লোকটি একমনে ফাইল দেখছিল। জাইমে পকেট থেকে পোস্টারটা বের করলেন। লোকটির সামনে পোস্টারটি খুলে ধরলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন- দেখুন তো, মিল পাচ্ছেন কি না?
পোস্টারটির দিকে তাকালেন ওই ভদ্রলোক, তারপর জাইমেকে দেখলেন। চোখ দুটো কপালে উঠে গেছে তার। হায় ঈশ্বর, সেই ভয়ংকর খুনে সন্ত্রাসবাদী! চোখের নিমেষে যিনি মানুষ হত্যা করতে পারেন। ভদ্রলোক ঠকঠককরে কাঁপছেন।কাতর কণ্ঠস্বরে বলছেন- দোহাই, বাড়িতে আমার বউ ছেলেমেয়ে আছে। আমি টু শব্দটি করব না। আমাকে মারবেন না।
.
জাইমে হাসলেন, সাপের মতো নীরর শীতল হাসি।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। ক্যাশিয়ারের দিকে। সেখানে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ক্যাশিয়ারের চোখ মুখ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, শীতল শিহরণ মেরুদণ্ড বেয়ে। চাবির গোছার দরকার হল না। টাকার স্তূপ, টেবিলের ওপর, ভালোই আমদানি হয়েছে আজ। ব্রিফকেস তৈরি ছিল পাশেই, জাইমে টাকা ভরে নিলেন। টা টা গুডবাই করতে করতে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এলেন, না, অপারেশনটা সত্যিই ভালো হয়েছে।
গাড়িটা স্টার্ট দেওয়া অবস্থাতেই ছিল। দ্রুত হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলল। জাইমে পাশে বসে থাকা মেগানের দিকে তাকালেন। এ কী? ভুল করে গাড়িটা অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। এখানে ওয়ান ওয়ে, ট্রাফিক সার্জেন্ট ছুটে এসেছেন–দেখি মিস্টার আপনার রেজিস্ট্রেশনটা।
জাইমে জানেন, এখনই কিছু একটা ঘটবে।
অভ্যাসবশত পিস্তলে হাত দিলেন। পেছনে বসে থাকা অ্যাম্পায়ো তৈরি। এখনই রক্তারক্তি শুরু হবে।
কিন্তু এ কী? নারীকণ্ঠে আর্ত চিৎকার। রাস্তার ওপর একটা মেয়ে শুয়ে পড়েছে, একটা উম্মত্ত পুরুষ তাকে প্রচণ্ড পেটাচ্ছে। আর একটু হলেই ও হয়তো মরে যাবে। ট্রাফিক সার্জেন্ট সেদিকে ছুটে গেলেন। চোখের নিমেষে জাইমে গাড়িটাকে অন্য হাইওয়েতে ঢুকিয়ে দিলেন। নিরাপদ দূরত্বে আসার পর একটুখনি থামলেন।
মেগানের দুটি চোখে বিস্ময়– ভাগ্যিস, ওই ঘটনাটা ঘটল। তা না হলে কী যে হত?
জাইমে হাসছেন সিস্টার, সবকিছু আমাদের সাজানো নাটক। ভাববেন না, আমরা এখানে একা, সমস্ত দেশ জুড়ে এমন অনেক বন্ধু আছে আমাদের। তারা এভাবেই আমাদের সাহায্য করে।
মেগান আরও অবাক হয়েছেন। হায় ঈশ্বর, একদল সন্ত্রাসবাদী, চুরি করা একটা গাড়ি, ব্যাঙ্ক থেকে লুট করা টাকা নরকের এ কোন অন্ধকারে তুমি আমাকে নিয়ে এলে!