জবানবন্দি নেবার জন্য প্রস্তুত হয় শিউশরণ। যার জবানবন্দি নেওয়া হবে তাকে ছাড়া অন্য সকলকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বলা হয়।
প্রথমেই ডাক পড়ল ডাঃ রণেন চৌধুরীর।
ডাঃ রণেন চৌধুরী। বলিষ্ঠ গঠন। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। হত্যার অকুস্থানের সর্বাপেক্ষা নিকটে ছিল; পাশেই ঘর। দুই ঘরের মধ্যবর্তী একটি দরজা ছিল। দরজাটায় অতুলের ঘর হতে শিকল ভোলা ছিলো। ডাঃ রণেন নিহত অতুলের বিশেষ বন্ধু। দীর্ঘদিনের পরিচয়। অবিবাহিত,
অবস্থাপন্ন, বৃত্তি চিকিৎসক।
শিউশরণ তার প্রশ্ন শুরু করে, আপনি সকালে কটা আন্দাজ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান?
সকাল নটায়। জবাব দেয় ডাঃ চৌধুরী।
রাত্রি সাড়ে এগারোটার পর খেলা শেষ হতেই ঘরে গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন? কিন্তু ঘুমোবার আগে পর্যন্ত পাশের ঘরে কোনো শব্দ শুনেছিলেন?
শুনেছিলাম। কি যেন একটা কবিতা মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করছে অতুল।
মাঝরাতে একবারও আপনার ঘুম ভাঙেনি?
না।
মণিকা দেবীর ডাকে এ ঘরে আজ সকালে ঢোকবার আগে পর্যন্ত ওঁর মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানতেন না?
না।
ডাঃ চৌধুরী একটা কথা, আপনি জানতেন নিশ্চয়ই পরশু রাত্রে এই ঘরের আলোটা খারাপ হয়ে গিয়েছে? প্রশ্ন করে কিরীটী।
জানতাম।
আচ্ছা আলোটা ঠিক করবার জন্য কে এবং কখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে খবর দিয়েছিল জানেন কিছু?
বলতে পারি না। বোধ হয় মণিই দিয়ে থাকবে।
অতুলবাবু গতকাল বিকেলে স্টেশনে যাবেন জানতেন? কই, না তো?
হুঁ। আচ্ছা একটা কথা, কিছু মনে করবেন না—মণিকা দেবীকে আপনি ভালবাসেন নিশ্চয়ই?
বাসি।
কখনও মণিকা দেবীকে নিয়ে আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবীর অনুপস্থিতিতে কোনো আলোচনা হত না?
কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে হঠাৎ যেন ডাক্তার একটু বিহ্বল হয়েই পড়ে, কয়েক সেকেণ্ড স্তব্ধ হয়ে থাকে। পরে মৃদুচ্চারিত কণ্ঠে বলে, হয়েছে দু-একবার কিন্তু সেও উল্লেখযোগ্য এমন কিছু নয়।
প্রশ্নটা যদিও একান্তভাবেই ব্যক্তিগত তবুও জিজ্ঞাসা করছি ডক্টর চৌধুরী, আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবীর প্রতি কারও বেশী দুর্বলতা ছিল বলে কি আপনার মনে হয়?
থাকতে পারে কারও তবে আমি জানি না। আমার অন্তত ছিল না।
না, জানলেও আপনি বলতে ইচ্ছুক নন! কোটা সত্য ডক্টর চৌধুরী?
কিরীটী স্মিতভাবে প্রশ্ন করে।
যা মনে করেন। নিরাসক্ত উদাস মৃদু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় ডাঃ চৌধুরী।
আচ্ছা এখানে আসবার পর মণিকা দেবী সম্পর্কে আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে কি কোনো আলোচনা বা বচসা হয়েছিল recently?
না।
আপনার বন্ধুর মৃত্যুর ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন?
বাইরের আর কাকে করব বলুন। করতে হলে সন্দেহও আমাদের তিনজনকেই করতে হচ্ছে। হয় আমি, নয় সুকান্ত, নয় তো মণি।
হতে পারে, হয়ত আপনাদের তিনজনের মধ্যেই একজন আপনাদের বন্ধুকে হত্যা করেছেন। গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত কিরীটীর কথাগুলো যেন অকস্মাৎ বজ্রসম ধ্বনিত হল।
সোজা সরল স্পষ্ট অভিযোগ।
রণেন, যতই বলুক, কিরীটীর শেষের কথার কঠিন ইঙ্গিতে যেন সে বিমৃঢ় নির্বাক হয়ে যায়।
আপনি মানে–বলতে চান আমাদের—
হ্যাঁ, আপনাদের তিনজনের মধ্যেই একজন।
কিন্তু–
এর মধ্যে আমার কোনো সংশয় বা কোনো কিন্তুই নেই ডক্টর চৌধুরী। প্রথমতসম্ভাবনার দিক দিয়ে যদি আপনাদের বন্ধুর হত্যার ব্যাপারটাকে বিচার করেন তাহলে আপনাদের তিনজনের পক্ষেই তা সম্ভব। দ্বিতীয়ত মোটিভ যদি বা বলেন, উদ্দেশ্য আপনাদের তিনজনের যতটা ছিল আর কারোরই সেটা থাকা সম্ভব নয়।
বন্ধু হয়ে বন্ধুকে হত্যা করব! এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?
সে আলোচনা পরের জন্য আপাতত তোলা রইল, এইটুকু বর্তমানে শুধু বলতে পারি, মোটিভ একটা ছিল যার জন্য বন্ধু হয়েই বন্ধুকে পথের কাঁটা হিসাবে সরানো হয়েছে।
তাহলে ধরেই নিচ্ছেন আপনি এটা একটা দুর্ঘটনা নয়—হত্যা? এবং—
হ্যাঁ, নিষ্ঠুর হত্যা। কঠিন ঋজু কণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
এবার ডাক পড়ল সুকান্ত হালদারের।
অতীব সুশ্রী বলিষ্ঠ চেহারা। কেবল নারী কেন, যে কোনো পুরুষের চোখেও আকর্ষণীয়। ধনী মেসো-মাসীর আশ্রয়ে পালিত, উচ্চশিক্ষিত। ইঞ্জিনীয়ার বৃত্তি, ভাল চাকরিতে নিযুক্ত। অবিবাহিত। রণেন, অতুল ওমণিকার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা।
ঘটনার দিন রাত্রে তারই ঘরে তাস খেলা হয়, তারপর রাত সাড়ে এগারোটায় খেলা ভাঙার পর অন্য সকলে যে যার ঘরে শুতে গেলে নিজেও শয্যায় আশ্রয় নেয়। রাত্রে ঘুম ভাঙেনি বা কোনোরূপ শব্দও শোনেনি।মণিকার ডাকে বাইরে এসে আজ সকালে অতুলের ঘরে ঢুকে জানতে পারে যে অতুল মৃত।
কালকের আপনার movements সম্পর্কে আমাকে in details একটা idea দিতে পারেন মিঃ হালদার?প্রশ্ন করে এবারে কিরীটী।
কাল সকাল থেকেই শরীরটা ভাল না থাকায় সারাটা দিনই প্রায় ছটা পর্যন্ত ঘরে খিল এঁটে শুয়েছিলাম। সারাদিন কিছু খাইওনি। সন্ধ্যায় অতুলের ডাকাডাকিতেই বাইরে বের হই। রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত গঙ্গায় নৌকোয় ঘুরে রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত তাস খেলে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙিয়েছে মণিকা সকালে চা নিয়ে এসে।
অতুলবাবু যে কাল বিকেলের দিকে স্টেশনে যাবেন তা আপনি জানতেন?
না।
সন্ধ্যায় ফিরে আসবার পর রাত্রে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত অতুলবাবু কি তাঁর ঘরে গিয়েছিলেন?
যেতে পারে তবে আমি দেখিনি।
বিয়ে না করবার কোনো কারণ আছে আপনার এত বয়স পর্যন্ত?
মনের মত সঙ্গী না পেলে বিয়ে করে কি হবে?
মণিকা দেবীকে আপনারা সকলেই ভালবাসেন?
প্রশ্নটা একান্ত ভাবেই ব্যক্তিগত নয়, কি, মিঃ রায়? রূঢ় কণ্ঠে যেন জবাব দেয় সুকান্ত।
নিশ্চয়ই। প্রশ্নটা করতে বাধ্য হয়েছি এইজন্য যে, নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে আপনাদের বন্ধু অতুল বোস নিহত হয়েছেন।
নিহত হয়েছেন মানে? আপনি কি মনে করেন—
কথাটা সুকান্তের শেষ হল না, কিরীটী সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দেয়, হ্যাঁ—তাঁকে হত্যাই করা হয়েছে এবং শুধু তাই নয়, আপনারই কোনো এক বন্ধু, আপনার অতি নিকট বন্ধু অতুল বোসকে হত্যা করেছেন।
আপনি পাগল মিঃ রায়! আপনি জানেন না আমাদের সম্পর্ক একদিনের নয়। দীর্ঘ নয় বৎসরের ঘনিষ্ঠতা আমাদের। তাছাড়া একটা কথা নিশ্চয়ই আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, এখানে আপনাকে ডেকে এনেছেন কে? দারোগা সাহেব—শিউশরণের দিকে ফিরে তাকিয়ে সম্বোধন করে সুকান্ত, আপনার করণীয় আপনি করতে পারেন, third person-এর interference আমরা সহ্য করব না।
জবাব দিল এবারে শিউশরণ, মিঃ রায়ের কথার জবাব দেওয়া-না-দেওয়া আপনার ইচ্ছে মিঃ হালদার, তবে জানবেন যাই আপনি বলুন সেটা আপনার against-এ বা for-এ evidence হিসাবেই আমরা নেব। আর উনি তৃতীয় ব্যক্তি নন। আমারই লোক। এই হত্যার তদন্তের ব্যাপারে উনি সরকারের পক্ষ হতেই কাজ করছেন।
কিন্তু–
এর মধ্যে আর কোনো কিন্তু নেই মিঃ হালদার। উনি যা প্রশ্ন করছেন তার জবাব দেবেন কিনা আমি জানতে চাই।
মিনিট দুই স্তব্ধ হয়ে থেকে সুকান্ত মৃদু কণ্ঠে বলে, বেশ কি জানতে চান বলুন?
আপনি তো একজন ইলেকট্রিকাল ইনজিনীয়ার, তাই তো? আবার কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
বাড়িতে ছোটখাটো ইলেকট্রিক সংক্রান্ত কিছু হলে আপনি দেখেশুনে দেন না কখনও?
সে রকম কাজ হলে দিই, তবে ছোটখাটো ব্যাপারে আমার মিস্ত্রীরাই কাজ করবার যা করে।
এ ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা পরশু রাত্রে খারাপ হয়েছিল আপনি জানতেন?
না, আজ সকালেই প্রথম মণির মুখে একটু আগে শুনলাম।
মিস্ত্রী কাল কাজ করতে এসেছিল দুপুরে তাও কি জানতেন না?
না। বললাম তো একটু আগে আপনাকে শরীর খারাপ ছিল বলে সারাদিন ঘর থেকে বের হইনি।
এখানে আসবার পর খুব ইদানীং আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবী সম্পর্কে কোনোরূপ আলোচনা বা বচসা কিছু হয়েছিল কি?
কি mean করছেন আপনি?
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মিঃ হালদার, কি আমি বলতে চাইছি
আপনার ও প্রশ্নের জবাব দেবার মত আমার কিছু নেই।
মণিকা দেবীকে ডাকা হল। এবারে তার জবানবন্দি।
সুন্দরী শিক্ষিতা, দিল্লীতে অধ্যাপিকার কাজ করে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় সমস্ত মুখের ওপরে যেন একটা নিরতিশয় বেদনার ছায়া ফেলেছে। দীর্ঘ নয় বৎসরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব মণিকার অতুল, রণেন ও সুকান্তর সঙ্গে। দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় যেন ও ভারী মুষড়ে পড়েছে।
বসুন মণিকা দেবী। কিরীটীই বলে।
আমি এবারে ওদের পুজোর ছুটিটা এখানে কাশীতে কাটাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে এনেছিলাম মিঃ রায়। আবেগে কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হয়ে আসে, চোখের কোল দুটি ছলছল করে, এমনি একটা দুর্ঘটনা ঘটবে যদি স্বপ্নেও জানতাম! সত্যি, ভাবতেও পারছি না—অতুল, অতুল নেই আর!
অন্যদিকে মুখটা ফেরায় মণিকা বোধ করি উগত অশ্রুকে সকলের দৃষ্টি হতে আড়াল করবার জন্যই।
আপনার লজ্জা ও দুঃখ আমি বুঝতে পারছি মিস গাঙ্গুলী, কিন্তু কি করবেন বলুন?
বোধ হয় সান্ত্বনা দেবারই চেষ্টা করে কিরীটী, আকস্মিক দুর্ঘটনার ওপরে তো আমাদের কারোরই কোনো হাত নেই, দৈব!
কিরীটী কিছুক্ষণ সময় দেয় মণিকাকে কিছুটা সামলে নেওয়ার জন্য।
কিরীটী আবার শুরু করে, এই নিষ্ঠুর হত্যার—-
কিরীটীর কথা শেষ হল না, চমকে অশ্রুসিক্ত চোখে ফিরে তাকায় চকিতে মণিকা প্রশ্নকারী কিরীটীর মুখের দিকে। অর্ধস্ফুট বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়, হত্যা!
হ্যাঁ, মণিকা দেবী। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি, অতুলবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—নিষ্ঠুর হত্যা।
না–না! আর্ত চাপা কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় মণিকা, You dont really mean it!
সত্যিই হত্যা মণিকা দেবী! অতুলবাবুকে হত্যা করাই হয়েছে!
অতুল—
হ্যাঁ। এবং হত্যা বলেই এই ব্যাপারের একটা মীমাংসা হওয়া একান্তই প্রয়োজন, নয় কি?
মণিকা চুপ। মণিকার মনের অবগহনে তখন যেন একটা প্রচণ্ড ঝড়ের আলোড়ন চলেছে। অতুল নিহত! কিন্তু কেন? কেন সে নিহত হল? নিরীহ অতুল! কে তাকে হত্যা করলে? এ কি ভয়াবহ নিষ্ঠুর কথা!
মিস গাঙ্গুলী?
অ্যাঁ! চমকে তাকায় মণিকা কিরীটীর ডাকে তার মুখের দিকে।
এ ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা যে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সে সংবাদ আপনি কখন মিস্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন?
আমি! আমি সংবাদ পাঠিয়েছিলাম? কই না তো! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় মণিকা কিরীটীর মুখের দিকে।
আপনি সংবাদ দেননি?
না। চিরদিন অত্যন্ত ভোলা মন আমার। বরং কাল দুপুরে ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আসবার পর, অতুল যে তার ঘরের আলোটা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল, হঠাৎ সে কথাটা মনে পড়ায় বিশেষ লজ্জিতই হয়েছিলাম।
আপনি তাহলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রীকে খবর দেননি?
না।
যে মিস্ত্রী আলো সারাতে এসেছিল সে কি আপনাদের পূর্বপরিচিত?
না।
হুঁ। লোকটার বয়স কত হবে বলে আপনার মনে হয়?
একটু বেশী বলেই মনে হয়েছিল। জাতিতে বোধ হয় বেহারী।
আপনার সঙ্গে লোকটার কি কথা হয়?
তার সঙ্গে আমার কোনো কথাই হয়নি বলতে গেলে। বংশী লোকটাকে নিয়ে এসেছিল—আমি শুধু ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিলাম।
লোকটা যখন ঘরে কাজ করে আপনি তখন ঘরে ছিলেন না?
না। কতক্ষণ যে কাজ করেছে এবং কখন যে কাজ করে চলে গিয়েছে তাও জানি না।
আশ্চর্য! লোকটা কাজ করে পয়সা নিয়ে যায়নি?
হ্যাঁ, সুবালাদিই নাকি দিদিমার কাছ থেকে চেয়ে তিন টাকা দিয়ে দিয়েছিল।
হুঁ। কিরীটী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবে। অতঃপর বলে, আচ্ছা অতুলবাবু যে দুটোর সময় চিঠি ফেলতে বাইরে বের হয়েছেন বলে আপনার ধারণা, তখন যে তিনি স্টেশনে গিয়েছিলেন তা জানেন?
স্টেশনে! কই না তো! স্টেশনে সে যাবে কেন?
গিয়েছিলেন তিনি। আচ্ছা কোনো চিঠি গতকাল তাঁর নামে এসেছিল জানেন?
হ্যাঁ, একটা চিঠি এসেছিল বটে।
কার চিঠি সেটা জানেন?
না। বংশী এনে আমার হাতে দেয়, আমি চিঠিটা তার হাতে দিয়ে দিই।
বাড়িতে ফিরে তিনি ঘরে যাননি?
যতদূর মনে পড়ছে, না। সে যখন ফিরে আসে, আমরা, মানে আমি ও রণেন বাইরের বারান্দায় বসে চা ও ডালমুট ভাজা খাচ্ছিলাম। অতুল ডালমুট বড় ভালবাসত,How nice ডালমুট, বলতে বলতে সে বারান্দাতেই একটা মোড়ায় বসে চা ও ডালমুট খেতে শুরু করে। তারপরই বোধহয় পৌনে ছটা বা ছটা নাগাদ আমরা গঙ্গায় নৌকোয় ঘুরতে বের হই। যতদূর মনে পড়ছে সে ঐ সময়টা বাইরেই বারান্দায় ছিল, ঘরে যায়নি।
রাত্রে বাসায় ফিরে?
বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ আমরা সকলে তিনতলার ছাদে গল্প করে নীচে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে সুকান্তর ঘরে গিয়ে তাস খেলি।
সুকান্তর ঘরে বসেই কি বরাবর তাস খেলতেন আপনারা রাত্রে?
তার কোনো ঠিক নেই, প্রতিরাত্রেই গত সাতদিন ধরে তাস খেলেছি আমরা—কখনও বারান্দায়, কখনও রণেনের ঘরে। তবে গতকাল রাত্রে সুকান্তই তার ঘরে খেলতে বললে, তাই–
হুঁ। রাত সাড়ে এগারোটায়খেলা শেষ হবার পর অতুলবাবুকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন?
দেখেছি এবং তাকে দরজা বন্ধ করতেও শুনেছি। তাই তো আজ সকালে তার ঘরের দরজা খোলা দেখে আমি আশ্চর্যই হয়েছিলাম!
এমন তো হতে পারে কোনো এক সময় হয়ত রাত্রে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন? কথাটা বলে শিউশরণ।
তা হতে পারে। কিরীটী বলে।
রাত্রে একবার অতুল উঠতই। তবে উঠলেও শোয়ার আগে আবার সে দরজা বন্ধ করেই দিত বরাবর। কখনও তার দরজা দিতে ভুল হত না-বললে মণিকা।
মিস গাঙ্গুলী, আপনি বলেছিলেন গতরাত্রে খেলা শেষ হবার পর অতুলবাবু আপনার সামনেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর দরজা বন্ধ করবার সঙ্গে সঙ্গেই কি আপনি শুতে যান?
হ্যাঁ। আমার আগেই অতুল শুতে যায়।
রণেনবাবু?
রণেন আমাদের আগেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল।
আচ্ছা মিস গাঙ্গুলী, রাত্রে শোবার পর কোনোপ্রকার শব্দ বা অস্বাভাবিক কোনো কিছু শুনতে পেয়েছিলেন?
না।
বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েননি নিশ্চয়ই?
না।
ঘুম আসছিল না বলে অনেক রাত পর্যন্ত, তা প্রায় গোটা দুই হবে জেগে বই পড়েছি। ওই সময়ের মধ্যেও কোনো শব্দ বা কিছু–
সেরকম কিছু না, তবে বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়েছি। ভাবছিলাম হয়ত কেউ বাথরুমে যাচ্ছে রাত্রে।
ঘরে আপনার দিদিমা ও সুবালাদি ছিলেন, বলছিলেন না? আপনি যখন ঘরে শুতে যান তখন কি তাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন, না জেগে ছিলেন?
দুজনেই ঘুমিয়ে ছিল।
সকালে আপনার ঘুম ভাঙে কটায়?
ভোর ছটায়। দিদিমা উঠে যাবার কিছু পরেই।
এবার একটু ইতস্তত করে কিরীটী বলে, মণিকা দেবী, অতুলবাবুর এই ধরনের আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যুতে আপনি যে অত্যন্ত শ হয়েছেন বুঝতে পারছি। এবং এও নিশ্চয়ই আপনার মত একজন শিক্ষিত মহিলা বুঝতে পারছেন—আমাদের পক্ষে এ রহস্যের মীমাংসায় পৌঁছাতে হলে কতকগুলো delicate প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতেই হবে। সেক্ষেত্রে আপনাদের প্রত্যেকেই বিশেষ করে আপনি যদি আমাদের সর্বতোভাবে না সাহায্য করেন, তাহলে—
বলুন কি জানতে চান?
কিছু মনে করবেন না, আপনাদের চারজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা, কথায় বলে দশ পা একত্রে গেলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়, তা এক্ষেত্রে আপনারা চারজন নিশ্চয়ই একে অন্যের খুব নিকটতম সংসর্গেই এসেছিলেন এবং আপনাদের চারজনের মধ্যে একা আপনিই নারী। পুরুষ ও নারীর এই বয়সের ঘনিষ্ঠতার মধ্যে সাধারণত যে সম্পর্কের সম্ভাবনাটা দেখা দেওয়া খুব স্বাভাবিক বুঝতে পারছেন আশা করি, কি আমি বলতে চাই মিস গাঙ্গুলী?
তিনজনই আমার অত্যন্ত প্রিয়। মৃদুকণ্ঠে মণিকা জবাব দেয়।
তাহলেও হাতের পাঁচটা আঙুল তো সমান হয় না মণিকা দেবী।
না। কিন্তু এক্ষেত্রে বোধ হয় কারও প্রতি কোনো আকর্ষণের তারতম্য ছিল না আমার।
মনকে আপনার খুব ভাল করে প্রশ্ন করে দেখুন। এত সহজে জবাব দেবার চেষ্টা করবেন না।
ঠিকই বলছি। মণিকার স্বর দৃঢ়।
আচ্ছা, এদের মধ্যে কেউ কোনোদিন আপনার কাছে কোনো excuse me for my language—মানে propose করেন নি?
এবার একটু থেমে ইতস্তত করে মণিকা জবাব দেয়, করেছিল। তিনজনই।
পরে সংক্ষেপে সংকোচের সঙ্গে মণিকার ঘটনাটা বিবৃত করে।
এছাড়া আর কোনো ঘটনা? অনুগ্রহ করে লজ্জা বা দ্বিধা না করে খুলে বলুন।
মণিকা দিন দুই আগেকার সারনাথের ঘটনাটাও বিবৃত করে।
আর কোনোদিনের কোনো ঘটনা?
সুকান্ত–কথাটা বলতে গিয়েও ইতস্তত করে যেন মণিকা।
বলুন, থামবেন না, বলুন। উদগ্রীব-ব্যাকুল কণ্ঠে মিনতি জানায় কিরীটী মণিকাকে।
গত বছর পুজোর ছুটিতে আমরা দার্জিলিং যাই। সেখানে এক রাত্রে সুকান্ত আমার ঘরে এসে ঢোকে—হঠাৎ–
তারপর?
.
মণিকার দার্জিলিং-বিবৃতি।
দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের স্মৃতি। রাত্রে হোটেলের ঘরে ফায়ারপ্লেসের সামনে চুপচাপ বসে মণিকা। গায়ে একটা কম্বল জড়ানো। পুজো সেবার ছিল অক্টোবরের শেষে। শীতও সেবারে দার্জিলিংয়ে বেশ কড়া পড়েছিল। অতুলের এক প্রফেসর বন্ধুর বাড়ি কার্ট রোডে, তারাও সস্ত্রীক দার্জিলিং এসেছে, নিমন্ত্রণ করেছিল ওদের চারজনকেই কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার মত হওয়ায় মণিকা যেতে পারেনি। সুকান্ত, অতুল ও রণেন গিয়েছে নিমন্ত্রণে।
রাত বোধ করি বারোটা হবে। হঠাৎ দরজার গায়ে মৃদু ন পড়ল।
কে?
আমি। দরজাটা খোল মণি।
মণিকা উঠে দরজাটা খুলে দিল, এ কি! সুকান্ত তুমি একা! ওরা কই?
ওরা তাসের আড্ডায় বসেছে। হয়ত আজ রাত্রে ফিরবেই না। মিঃ ও মিসেস চামেরিয়ার তাসের প্রচণ্ড নেশা। তুমি একা, তাই চলে এলাম।
বেশ করেছ, বস। মণিকা চেয়ারটায় গিয়ে বসল।
গায়ের গ্রেট কোটটা খুলে খাটের বাজুর ওপরে রেখে দিল সুকান্ত। পাশের একটা চেয়ার খালি থাকা সত্ত্বেও কিন্তু সুকান্ত বসছে না।
দেওয়ালের গায়ে অগ্নির রক্তাভ শিখাগুলো যেন আনন্দে নৃত্য করছে। বাইরে আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। সমস্ত দার্জিলিং শহরটা শীতে যেন কুঁকড়ে রয়েছে।
বসো সু। আবার মৃদু আহ্বান জানায় মণিকা।
তথাপি সুকান্ত কিন্তু বসল না। চেয়ারে উপবিষ্ট মণিকার পাশে এসে দাঁড়াল, মণি?
বসো। মণিকা আবার জানায় সুকান্তকে।
মণিকার কাঁধের উপরে ডান হাতটা রাখল সুকান্ত।
কাঁধের ওপরে সুকান্তর হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকাল মণিকা।
চোখের মণি দুটোতে যেন এক অস্বাভাবিক দীপ্তি।
চাপা কণ্ঠে সুকান্ত ডাকে, মণি?
সুকান্তর স্বরের অস্বাভাবিকতা অকস্মাৎ মণিকার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে তাকে সচকিত করে তুলল। তখনও তাকিয়ে মণিকা সুকান্তের মুখের দিকে।
সম্মুখের ফায়ার-প্লেসের অগ্নির রক্তাভ আলোর আভায় সুকান্তর গৌর মুখখানা যেন রাঙা টকটক করছে।
কি হয়েছে সু? শরীর অসুস্থ বোধ করছ না তো? উদ্বিগ্ন-ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে মণিকা উঠে দাঁড়ায়।
না। বসো।
কই দেখি কপালটা? আরও একটু এগিয়ে এসে মণি হাতটা দিয়ে সুকান্তর কপাল স্পর্শ করতে উদ্যত হতেই মুহূর্তে দু বাহু দিয়ে সুকান্ত মণিকাকে নিজের বুকের ওপরে টেনে নিয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, মণি! মণি!
এবং পরক্ষণেই সুকান্তর উত্তপ্ত ওষ্ঠ মণিকার কপাল ও কপোলে মুহুর্মুহুঃ চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করে দেয়।
মণিকা ঘটনার আকস্মিকতায় এমন বিহ্বল হয়ে যায় যে বাধা দেবারও প্রথমটায় অবকাশ পায় না।
থরথর করে গভীর উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ কাঁপছে সুকান্তর। দেহের সমস্ত শিরায় শিরায় যেন একটা তরল অগ্নির জ্বালা। রোমকূপে-কূপে একটা উত্তপ্ত কামনার প্রদাহ। ভুয়ো বালির বাঁধ কামনার বন্যাস্রোতে ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। সে আগুনের তাপে মণিকার শরীর যেন ঝলসে যায়।
না! না! না! কোনো বাধাই মানব না! কোনো যুক্তি কোনো নিষেধ শুনব না! তুমি—তুমি আমার! আমার!
জোর করে ছাড়াতে চেষ্টা করে নিজেকে মণিকা সুকান্তর কঠিন বাহুবন্ধন হতে কিন্তু সুকান্ত আরও নিবিড় করে তার দুটি বাহুর বেষ্টনী, না মণি, না!
সুকান্ত! প্রায় একটা ধাক্কা দিয়েই নিজেকে এবারে মুক্ত করে নেয় মণিকা।
শোন মণি, এ নিষ্ঠুর খেলার অবসান হোক। সুকান্ত তখনও কাঁপছে উত্তেজনার আধিক্যে, আজ জানতে চাই তুমি আমার হবে কিনা?
আমি কারও নই। তোমাদের কারোরই হতে পারি না।
কারোরই হতে পার না! এত অহঙ্কার তোমার! তুমি কি ভেবেছ এমনি করে দিনের পর দিন আমাদের তিনজনকে তুমি বাঁদর-নাচ নাচিয়ে বেড়াবে! হিংস্র কামনামত্ত আদিম পশুপুরুষ সভ্যতার খোলস ফেলে নখর বিস্তার করেছে।
কি বলছ তুমি!
ঠিকই বলছি। তুমি জান তিনজনই আমরা তোমায় চাই। আমরা তিনজনই তোমাকে কামনা করি, তাই কি তুমি এইভাবে খেলছ আমাদের নিয়ে?
খেলছি তোমাদের নিয়ে?
হ্যাঁ, খেলছ। কিন্তু এ চলবে না। এতদিন ওদের আমি সুযোগ দিয়েছি। তারা avail যখন করেনি—আমি আর অপেক্ষা করব না। হয় তুমি আমার হবে, না হয় আমাদের সামনে থেকে তোমায় চিরদিনের মত সরে যেতে হবে।
অতুল, রণেন তোমার বন্ধু মণিকার স্বর যেন ভেঙ্গে পড়তে চায়।
বন্ধু! হ্যাঁ, বন্ধু বলেই তো এতদিন চুপ করে ছিলাম। আর যদি তারা আমার পথে দাঁড়ায় জেনো তাদের হত্যা করতেও আমি পশ্চাৎপদ হব না। কতকগুলো ক্লীব জড় পদার্থ! কণ্ঠস্বরে ঘৃণা ও আক্রোশ যেন মূর্ত হয়ে ওঠে।
সুকান্ত তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
পাগল! না হলেও পাগল হতে বেশি দেরি হবে না আর তোমাদের এই আদর্শের ন্যাকামি নিয়ে আর কিছুদিন থাকলে। বন্ধুত্ব! মনে মনে অহোরাত্র কামনার হিংসায় জর্জরিত হয়ে বাইরে বন্ধুত্বের ভান করব আমরা আর তুমি কেবল মিষ্টি হাসি ও দুটো চোখের ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের শান্ত রাখবার চেষ্টা করবে! নিশ্চয়ই তুমি ভাবছ, তোমার ঐ যৌবনের রঙের ঝাপ্টা এই তিনটে বোকার চোখে দিয়ে–
সুকান্তর কথাটা শেষ হল না। মণিকার ডান হাতটা চকিতে একটি চপেটাঘাত করল সুকান্তর গালে।
থমকে থেমে গেল সুকান্ত।
Get out! এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও!
প্রজ্বলিত অগ্নির মধ্যে একটা জলের ঝাপটা দিলে যেমন সহসা সেটা নিস্তেজ হয়ে যায়, সুকান্তরও মণিকার একটিমাত্র চপেটাঘাতের চকিত বিহ্বলতায় তার ক্ষণপূর্বের সমস্ত প্রদাহ ও কামনার জ্বালা দপ্ করেই নিভে যায়।
নিঃশব্দে সুকান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং শুধু ঘর থেকেই নয়, ঘণ্টাখানেক বাদে নিজের ঘর হতে সুটকেসটা নিয়ে একেবারে হোটেল ছেড়েই চলে গেল।
বাকি রাতটুকু পথে পথে কাটিয়ে পরের দিনই সে দার্জিলিং ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে গেল।
পরের দিন সকালে রণেন ও অতুল ফিরে এল। সুকান্তের খোঁজ করতে মণিকা বললে, সে তোকই ফেরেনি রাত্রে!
দুই বন্ধু আশ্চর্য হয়ে তখুনি খোঁজাখুঁজি শুরু করে। কিন্তু সারাটা শহরেও তার দেখা মিলল না। সকলে তখন ব্যাকুল উৎকণ্ঠায় গিয়ে পুলিসে সংবাদ দেয়।
চতুর্থ দিনে অতুল সুকান্তর একটা টেলিগ্রাম পায়, আমি হঠাৎ কলকাতায় চলে এসেছি। ভালই আছি।
বুঝতে ঠিক পারে না অতুল আর রণেন, সুকান্তর ঐ ধরনের বিচিত্র ব্যাপারটা। তবে ওরা জানত সুকান্ত বরাবরই একটু বেশীমাত্রায় খেয়ালী, কারণে অকারণে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে।
পরে বন্ধুদের সঙ্গে সুকান্তর যখন দেখা হল, বলেছিল হাসতে হাসতে, হঠাৎ কি খেয়াল হল চলে এলাম। হঠাৎ যেন মধ্যরাত্রে সেদিন হোটেলে ফেরবার পথে মনে হল ফগে ভর্তি দার্জিলিং শহরটা বিশ্রী। যত শীঘ্র সম্ভব শহরটা পরিবর্জন করাই ভাল। অতএব কালবিলম্ব আরনা করে কাউকে কিছু না বলে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে রাত্রে বের হয়ে পড়লাম।
***
কিন্তু দিল্লীতে ফিরে মণিকা কয়েকদিন পরে একখানা চিঠি পেল সুকান্তর।
মণি,
জানি না সে রাত্রের আমার পশুবৎ আচরণকে তুমি এ জীবনে ক্ষমা করতে পারবে কিনা। তবু জেনো সে রাত্রের যে সুকান্তকে তুমি দেখেছিলে তার সন্ধান আর তুমি কোনো দিনও পাবে না। এবং আমার সেদিনকার আচরণের জন্য দায়ী তোমার প্রতি আমার তিল তিল করে গড়ে ওঠা সুতীব্র আকাঙক্ষাই। আমার সে আকাঙক্ষাকে তুমি ঘৃণা করো না। প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যেই থাকে চিরন্তন আদিম একটা বৃত্তি যাকে এ যুগের লোকেরা বলবে কু, আর থাকে আজকের দিনের তথাকথিত সভ্যতার আচরণে ক্লিষ্ট ভীরু একটা বৃত্তি যাকে তোমরা সগৌরবে বলে থাক সু। কিন্তু জান, এই কু বা সু কোনোটাই মিথ্যা নয় বরং প্রথমটাই আমার মতে নির্ভেজাল সত্য পরিচয়, যুগে যুগে মানুষে আজও যা নিঃশেষ করে ফেলতে পারিনি আমরা সভ্যতা ও তথাকথিত শিক্ষার কষ্টিপাথরে ঘষেও। সে যা চায় তা প্রাণ খুলে অতি বড় দুঃসাহসের সঙ্গেই চায়। চাইতে গিয়ে সরমে পিছিয়ে আসে না। কিন্তু যাক সে কথা। কারণ এ যুগে কুকেও কেউ ক্ষমার চক্ষে দেখবে না। সত্য ও নির্ভীক হলেও তার মনুষ্যসমাজে মর্যাদা নেই। মনে মনে যাই আমি স্বীকার করি না কেন, আমিও বোধ হয় সু-এরই বশ। সেই বৃত্তিতেই ক্ষমা চাইছি। আশা করি সে রাত্রের স্মৃতিকে তুমি মনে মনে পোষণ করে রাখবে না অন্তজ্বালায় ও ঘৃণায়।
ইতি
অনুতপ্ত সুকান্ত
চিঠিটা পেয়ে সেদিন মণি তোমার মনে কি ভাব হয়েছিল ভোলনি নিশ্চয়ই! কারণ মুখে, তুমি যতই বড়াই করো না কেন সুকান্তর সে রাত্রের অকুণ্ঠ সতেজ পুরুষ-আহ্বান তোমারও দেহে কামনার তীব্র দাহন জ্বেলেছিল। তুমি কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে গিয়েছিলে:
সু—আমার সুকান্ত
ভুল আমারই। স্বীকার করতে আজ আর আমার কোনো লজ্জা নেই। আমার এ নারীমন আমার অজ্ঞাতে যে একটিমাত্র বিশেষ পুরুষের জন্য লালায়িত হয়ে উঠেছিল তাকে তুমিই সবল বাহুতে নাড়া দিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও জাগিয়ে তুলেছিলে। সে রাত্রের আমার প্রত্যাখ্যানকে অস্বীকার করে জোর করে যদি তুমি আমায় অধিকার করতে, সাধ্য ছিল না আমার তোমাকে না ধরা দিই। কেন নিলে না জোর করে কেন?
কিন্তু না! না—এসব কি লিখেছে মণিকা! তাড়াতাড়ি চিঠির কাগজ ছিঁড়ে ফেলে কুটিকুটি করে সেটা উড়িয়ে দেয়। তারপর লেখে :
সুকান্ত,
ভুল দোষ ত্রুটি নিয়েই মানুষ। যা হয়ে গেছে তার জন্য মনে কিছু করো না। আমরা পরস্পরের বন্ধু। এর মধ্যে কাউকে কারও ক্ষমার প্রশ্ন আসতেই পারে না। সে সব কথা আমি ভুলে গিয়েছি। ভালবাসা নিও–
তোমাদের মণি।
সংক্ষেপে মণিকা কিরীটীকে নিজেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের সুকান্ত-কাহিনী বলে যায়। কিন্তু আসল কথাটি চাতুর্যের সঙ্গে কাহিনীর মধ্যে গোপন করে গেলেও মণিকার গলার স্বরে এবং বিবৃতির সময় তার চোখমুখের ভাবে কিরীটীর তীক্ষ্ণ সজাগ অনুভূতির অগোচর কিছুই থাকে না।
এতক্ষণে যেন অন্ধকারে ক্ষীণ :স্টা আলোকের রশ্মি দেখতে পায় কিরীটী। বুঝতে পারে এখন সুস্পষ্ট ভাবেই যেটা এখানে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে ক্ষীণ কুয়াশার মতই অস্পষ্ট ছিল, তার চিরাচরিত অনুমানের ভিত্তির ওপরে রণেন চৌধূরীর মুখে অতুলের মৃত্যুসসংবাদ পেয়ে সেটা একেবারে মিথ্যা নয় এবং এই মৃত্যু-রহস্যের মূলে হয়ত তার অনেকখানি ছড়িয়ে আছে।
ডাক পড়ল মণিকা দেবীর পর প্রথমে দিদিমার।
দিদিমা পেটের গোলমালের জন্য কয়েক বৎসর ধরে আফিম খান। তিনি অতুলের মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষ কোনো আলোকসম্পাতই করতে পারলেন না। তাছাড়া দিদিমা কানেও একটু খাটো। তাঁকে প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, এরকমটি যে হবে তা আমি জানতাম দারোগাবাবু। তিনটে পুরুষ আর ও এক মেয়ে।
কিরীটী সচকিত হয়ে ওঠে, কেন দিদিমা? আপনি কি ওদের মধ্যে তেমন কিছু কখনও দেখেছেন?
তেমন পাত্রীই আমার নাতনী নয়। মেয়ে আমার খুব ভাল। আর ওরা তিনজনও বড় ভাল, কিন্তু কথায় বলে বয়েসের মেয়ে-পুরুষ! ঘি আর আগুন! যত সাবধানেই রাখ অনর্থ ঘটতে কতক্ষণ!
কিরীটী বোঝে দিদিমাকে আর বেশী ঘাঁটিয়ে লাভ হবে না।
কিরীটীর ইঙ্গিতে শিউশরণ দিদিমাকে বিদায় দেয়।