জড়ো-হওয়া লোকজন সব খানিকটা দমে গিয়ে যে-যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। লাঠির মহিমা দেখতে এসে শুধু লাঠিখানা ছাড়া আর কিছুই না। দেখতে পেয়ে অনেকেই বেশ হতাশ। তা ছাড়া লাঠিখানার চেহারাতেও তেমন পালিশটালিশ তো নেই। সাধারণ বাঁশের লাঠি। জগাই বলল, “এসব কথা চাউর হওয়াটা ঠিক হয়নি। ওতে মন্তরের জোর কমে যায়। কী বলো মাধাইদা?”
দু’জনে একটু দূরের একখানা দাওয়ায় অন্ধকারে বসা। মাধাই বলল, “গাঁয়ের লোকের তো পেটে কথা থাকে না কিনা!”
জগাই সায় দিয়ে বলে, “ওইটেই তো হয়েছে আমাদের মুশকিল। মাতব্বর লোকেরা কেমন কথার মারপ্যাঁচ জানে দেখেছ! কতটুকু ছাড়তে হবে, কতটুকু চেপে রাখতে হবে, কোন কথা লাটুর মতো ঘোরাতে হবে, কোন কথা ঘুড়ির মতো ওড়াতে হবে তা ভারী ভাল আঁচ করতে পারে। কথার উপরেই দুনিয়াটা চলছে তো! কথায় পুড়িয়ে দিচ্ছে, কথায় জুড়িয়ে দিচ্ছে।”
মাধাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমরা তো কথাই কইতে শিখলুম না। যা মনে আসে বলে ফেলি। এই তো সেদিন বড় বড় বেগুনি ভেজেছি, পরেশবাবু এসে বললেন, ‘কেমন বেগুনি ভাজলি রে?”
আমি বলে ফেললুম, “আজ্ঞে চটিজুতোর সাইজ। শুনে পরেশবাবু খাপ্পা হয়ে এই মারেন কি সেই মারেন, আমি তো কথাটা কয়ে ফেলে ভেবেছিলুম বেশ ভাল একটা কথা কয়েছি।”
“না গো মাধাইদা, কথা কওয়াটা শেখা দরকার। এই পরেশবাবুর কথাই ধরো। প্রায়ই এটা শোঁকেন, সেটা শোঁকেন আর বলেন, ‘এঃ, এটায় বোঁটকা গন্ধ, ওটায় টকচা গন্ধ, সেটায় বাসি গন্ধ। পরেশবাবুর গন্ধের জ্বালায় আর পারি না। তা সেদিন বললুম, পরেশবাবু, আপনার নাক বড় হুশিয়ার, কুকুরকে হার মানায়। শুনেই রেগে লাল হয়ে কষালেন এক থাবড়া। কিন্তু তুমিই বলল, যার যেটা ভাল সেটা তো বলাই উচিত, কুকুরের নাক কি ফ্যালনা জিনিস? কথাটা তলিয়ে দেখলে খারাপও কিছুনয়। কিন্তু কথার দোষে কী দাঁড়াল কে জানে!”
“ওরে জগাই, কুকুরের কথায় খেয়াল হল। কোথায় একটা কুকুরছানা কুঁইকুঁই করছে বল তো!”
“আমিও একটা কুঁইকুই শব্দ পাচ্ছি বটে, তবে ভাবলুম বোধ হয়। চড়াইপাখির ছানা ডাকছে। গাঁ-দেশে ওরকম কত শব্দ হয়।”
“তা বটে। তবে শব্দটা কাছেপিঠেই হচ্ছে কিন্তু।”
“আচ্ছা মাধাইদা, ধৰ্মত ন্যায্যত একটা কথা বলবে?”
“কী কথা রে?” “তোমার কি খিদে পাচ্ছে? আমার সন্দেহ হচ্ছে, কুঁইকুই আওয়াজ আমাদের পেট থেকেই হচ্ছে।”
“বলতে একটু বাধো বাধো ঠেকছে রে, ভারী লজ্জাও হচ্ছে। তবে ধৰ্মত বলতে বললি তো, তাই বলছি। খিদেটা কিন্তু নতুন করে হয়নি। ওটা যেন হয়েই আছে, বরং এক কাজ করি আয়। শব্দটাকে। বেড়ালছানার আওয়াজ বলে ধরে নিয়ে চোখ বুজে একটু হরিনাম করি।”
সন্দিগ্ধ গলায় জগাই বলে, “হরিনাম করলে আবার খিদেটা চৌগুণে উঠবে না তো! ঠাকুর-দেবতার নাম নিলে কী থেকে কী হয় কে জানে বাবা!”
“তা সে ভয়ও আছে। হরিনামে খিদে হয় বলেই জানি, তা খিদের উপর যদি আরও খিদে হয় তা হলে বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাবে’খন।”
দু’জনে হরিনামই করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বলল, “তোমাদের ভাত বাড়া হয়েছে। মা খেতে ডাকছে।”
ভিতরের দাওয়ায় গিয়ে দু’জনে দেখল, দু’খানা থালায় ভাতের মস্ত দুটো ঢিবি। গিন্নিমা ঘিয়ের বয়াম আর বগি হাতা নিয়ে বসে আছেন। করেন কী, করেন কী’বলতে বলতেই খপাখপ দু’হাতা করে ঘি পড়ল ভাতে। সঙ্গে নুন আর কাঁচালঙ্কা।
“খাও বাবা, তোমরা আমার নবীনের প্রাণরক্ষে করেছ। এ বাড়িতে অতিথি হল নারায়ণ। অতিথিসেবা না হলে বাড়ির বাচ্চাটাও কিছু মুখে দেয় না। তাই তোমাদের একটু আগেভাগে খাইয়ে দিচ্ছি।”
তা খেলও দু’জন। ধুতির কষি আগেই একটু আলগা করে নিয়েছিল। কিন্তু সোনামুগের ডাল পার হতে না-হতেই কষি এঁটে গেল। দুই পদের মাছ আর চাটনির পর যখন জামবাটি-ভরতি নলেন গুড়ের পায়েস টেনে নিল তখন কষি যেন কেটে বসেছে। দমসম অবস্থা। খেয়ে যখন উঠতে যাবে তখন দু’জন মুনিশ এসে দু’দিক থেকে ধরে টেনে তুলল দু’জনকে। নইলে ওঠা মুশকিল ছিল। ভরসার কথা এই যে, দু’জনেই খাওয়ার শেষে হরিপুরের রাক্ষুসে জল একঘটি করে মেরে দিয়েছে।
আঁচিয়ে এসে দু’জনে যখন বারঘরে পাতা বিছানায় শুতে যাবে তখনই শোরগোলটা উঠল, “আগুন! আগুন!”
বেরিয়ে এসে খড়ের গাদায় আগুন দেখে দু’জনেই অবাক। তারা গাঁয়েরই লোক। খড়ের গাদার আগুন তারা খুব চেনে। এ বড় সাঙ্ঘাতিক আগুন।
দু’জনে তিলার্ধ দেরি না করে শাবল দুখানা নিয়ে ছুটে গেল। গাঁ বাঁচাতে গাঁয়ের লোকও ছুটে আসছে।
পেট ঢাঁই হয়ে আছে। তা সত্ত্বেও জগাই খড়ের গাদার মাথায় উঠে পড়ল হাঁচোড়পাঁচোড় করে। বাঁশের খুঁটিতে গাদার বাঁধন খুলে দিতেই গাদার খড় ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। আগুন আর বিশেষ সুবিধে পেল না। মাটিতে ছড়ানো জ্বলন্ত খড় নিভিয়ে ফেলা শক্ত কাজ নয়।
নবীন আর তার বাপ-খুড়োরা এসে খুব বাহবা দিল দু’জনকে। বলল, “তোমাদের যেমন সাহস, তেমনই বুদ্ধি আর তেমনই ভাল মানুষ তোমরা।”
দু’জনে লজ্জায় নতমুখ। মাধাই বলে, “কী যে বলেন বাবুরা, আমরা আবার মনিষ্যি!”
জগাই লাজুক গলায় বলল, “ভাল ভাল কথা শুনতে মন্দ লাগে না বটে কর্তা, তবে কী জানেন, আমরা ঘোটলোক তো, ওসব শুনলে আবার পাপ না হয়ে যায়।”
নবীনের জ্যাঠা পরমেশ্বর সাহা হেসে বলল, “পাপ হবে কেন হে? হক কথাই তো কইছি বাপু। তোমাদের দু’জনকে আমাদের ভারী পছন্দ হয়েছে। হরিপুর থেকে তোমাদের আর যেতে দিচ্ছি না।”
শুনে জগাই-মাধাই দু’জনেরই মুখ শুকনো।
মাধাই আমতা আমতা করে বলল, “আজ্ঞে, প্রস্তাব তো খুবই ভাল, কিন্তু আমাদের এ জায়গা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না যে!”
জটেশ্বর অবাক হয়ে বলে, “বলো কী? দশটা গাঁ ঘুরে এসো, সব জায়গায় হরিপুরের সুখ্যাতি শুনবে। লোকে বলে, লক্ষ্মী গাঁ, এখানকার মাটি ভাল, জলবায়ু ভাল, মানুষ ভাল।”
জগাই কাতর গলায় বলে, “কিন্তু হজমের বড্ড গোলমাল হচ্ছে যে!”
নবীনের কাকা হরেশ্বর নাটকটাটক করে। সে রাবণের কায়দায় হাহা করে হেসে বলে, “শোনো কথা! হরিপুরে নাকি হজম হয় না। ওরে বাপু, সকালের জলখাবারের যদি আস্ত একটা হাতিও গিলে ফ্যালো তো দুপুরে এমন খিদে পাবে যে, এক গণ্ডা গন্ডারেও খিদে মিটবে না।”
মাধাই একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, সে কথাটাই তো বলার চেষ্টা করছি। এখানকার জল খুব খারাপ। খাবারদাবার মোটে পেটে তিষ্টোতে পারে না। সেজগিন্নিমাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আধঘণ্টা আগে গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়ে উঠেছি, এখনই পেট যেন হুহু করতে লেগেছে। এরকম হলে তো আমাদের মতো গরিব মনিষ্যির বড়ই বিপদ!”
পরমেশ্বর মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি। তা বাপু, কথাটা মিথ্যেও নয়। হরিপুরে একটু খিদের উৎপাত আছে বটে। তবে ভেবোনা, ওসব সমস্যার সমাধান আমরা করে দেব। আপাতত কিছুদিন আমাদের বাড়িতেই আস্তানা গাড়ো, আমরাও একটু অতিথিসেবা করি। তারপর তোমাদের ব্যবসাপত্তরের ব্যবস্থা হবে।”
ঠিক এই সময়ে নবীন দৌড়ে এসে বলল, “সর্বনাশ হয়ে গেছে। জ্যাঠা! লাঠিটা চুরি হয়ে গেছে!”
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, “সেকী! কে চুরি করল?”
নবীন বলে, “প্যাংলা বলছিল, আগুন লাগার পরেই নাকি ঢ্যাঙা মতো একটা লোককে দেখেছে লাঠিটা নিয়ে দৌড়ে বাগানে ঢুকে গেল। আমার সন্দেহ, এ হল নিমাই রায়ের কাজ। নির্ঘাত বাগান। পেরিয়ে ভুরফুনের মাঠে ঢুকেছে।”
শাবল দুটো তুলে নিয়ে জগাই আর মাধাই বলল, “তা হলে চলুন, ও ব্যাটার কাছ থেকে জিনিসটা কেড়ে নিয়ে আসি।”
বড়জ্যাঠা ফণীশ্বর বলল, “রোসো বাপু, রোসো। ও লাঠির মোকাবিলা করার ক্ষমতা কোথায় তোমাদের? শেষে বিপদে পড়ে যাবে যে!”
জগাই একগাল হেসে বলল, “ভাববেন না জ্যাঠাকর্তা, আমরা দু’জন তো আজ মরতেই বেরিয়ে পড়েছিলুম। তা কাজটা এখনও হয়ে ওঠেনি। এবার যদি মরি তা হলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।”
ফণীশ্বর মাথা নেড়ে বলে, “না না, ওটা কাজের কথা নয়, মরায় কোনও বাহাদুরি নেই। জেনেশুনে ওই কালান্তক লাঠির মোকাবিলা কেউ করে?”
নবীন হতাশ গলায় বলে, “তা বলে লাঠি উদ্ধার হবে না? ওর ভিতরে যে মন্তরের শব্দ হয়! ও লাঠি যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে!”
ফণীশ্বর বলল, “তা হলে আমাদের দলবেঁধে যাওয়া উচিত। হেঁকেডেকে লোক জড়ো করো। তারপর সবাই মিলে যাই চলল।”
ভুরফুনের মাঠ বড় ভুলভুলাইয়া জায়গা। ঝোপঝাড়ের আড়ালে আবডালে জলায়-জঙ্গলে কত যে গোলকধাঁধা তার হিসেব নেই। একবার দিশা হারিয়ে ফেললে ঘুরে-ঘুরে মরতে হয়। তার উপর ঘন ভূতুড়ে কুয়াশায় চারদিকটা এমন আবছায়া যে, পুব-পশ্চিম-উত্তর দক্ষিণ কিছু ঠাহর করার উপায় নেই।
নিমাই অবশ্য তাতে ঘাবড়ায়নি। বরং সে খানিকটা স্বস্তিই বোধ করছে। যদি কেউ পিছু নেওয়ার মতলব আঁটে তবে হয়রান বড় কম হবে না। রাতবিরেতেই তার যতেক কাজকর্ম, কাজেই নিশুত রাতকে সে বন্ধুলোক বলেই ভাবে। রাত যত নিশুত হয়, অন্ধকার যত আঁট হয়ে চেপে বসে ততই কাজের সুবিধে।
তবে আজ ধকলটাও গেছে বড় কম নয়। বিকেলের কচুরি-জিলিপি কখন তল হয়ে গেছে। তার উপর হাঁটাহাঁটি, লাঠালাঠি, ঠেলাগুঁতো, ঝাপড়-লাথিও বড় কম জোটেনি কপালে। মানুষের শরীর তো! চোর উঁচড় বলে তো আর লোহালক্কড় নয়। তাই আবছায়াতে একটা ঢিবির মতো জায়গা দেখে জিরোনোর জন্য বসতে যাচ্ছিল নিমাই।
মৃদু একটা গলাখাঁকারি দিয়ে কে যেন মোলায়েম স্বরে বলে উঠল, “কাজটা কি ঠিক হবে? ওটা যে সাধুবাবার সমাধি।”
নিমাই টক করে দাড়িয়ে বলল, “তাই নাকি?”
“সমাধি বলে চেনা যায় না বটে। মাটিতে ঢেকে গেছে তো!”
নিমাই এদিক-ওদিক চেয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বলল, “কথাটা কে বললে হে? কাউকে দেখছি না যে!”
“তাজমহল তো আর নই রে বাপু, দেখার কী আছে?”
দুনিয়াটা বাজে লোকে ভরে গেছে। কার যে কী মতলব তা বোঝা কঠিন, তাই লাঠিটা শক্ত করে বাগিয়ে ধরে ফের চারদিকে। ভাল করে চেয়ে দেখে নেয় নিমাই। তারপর বলে, “মতলবটা কী তোমার ?”
“মতলব কিছু খারাপ দেখলে নাকি?”
“লোকটাই বা তুমি কে?”
“এই এখানেই বহুকাল বসবাস। এই সাধুবাবার সমাধিতে হাওয়াটাওয়া করি, পাহারা দিই।”
“তা তো বুঝলুম, কিন্তু গা-ঢাকা দিয়ে আছ কেন?”
খুক করে হেসে লোকটা বলল, “ঢাকবার মতো গা কোথায় হে! তা সে যাক গে, সাধুবাবার লাঠিটা নিয়ে এসেছ দেখছি! নিবেদন করবে নাকি?”
“লাঠি! না না, এ সাধুবাবার লাঠি নয়। এ আমার লাঠি।”
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল। লোকটা খানিক চুপ করে থেকে বলল, “তাই হবে বোধ হয়। কে যে কীসের মালিক তা আর আজকাল বুঝবার উপায় নেই কিনা। তবে কী জানো, যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে।”
কথাটার মধ্যে একটু যেন ঘোরপ্যাচ আছে! নিমাই সেটা ধরতে পারল না। বলল, “সাধুবাবা কে হে? গুনিনটুনিন ছিলেন নাকি?”
“সাধু মহাত্মাদের কথা কি নাংলা ভাষায় কওয়া যায়? আর কইলেও তুমি বুঝতে পারবে কি?”
পরিস্থিতিটা নিমাইয়ের খুব সুবিধের বলে মনে হচ্ছিল না। সে লাঠিখানা কাধে ফেলে পা বাড়িয়ে বলল, “চলি হে! তুমি বরং তোমার সাধুবাবার সমাধিতে ভাল করে হাওয়া দাও।”
“চললে নাকি?”
“হ্যাঁ বাপু। আমার মেলা কাজ পড়ে আছে।”
“তা যাবে যাও, তবে একটু দেখেশুনে যেও। বনকরমচার জঙ্গলের দিকটায় পায়ের শব্দ পেলুম যেন।”
শুনে প্রথমটায় কুঁকড়ে গিয়েছিল নিমাই। তারপর লাঠিটার কথা মনে পড়তেই সোজা হয়ে দাড়াল। ভয়টা কীসের? বরং লাঠির ক্ষমতা একটু যাচাইও হয়ে যাবে। সে হেসে বলল, “ও শিয়ালটিয়াল হবে। ভয় নেই! লাঠি দেখলেই পালাবে।”
লোকটার গলাটা ভারী মিইয়ে গেল, বলল, “পালালেই ভাল।”
নিমাই বেশ বীরদর্পেই হাঁটা ধরল। কিন্তু কয়েক কদম এগোতেনা-এগোতেই অন্ধকার কুঁড়ে দৈত্যদানবের মতো লাঠিধারী জনাবিশেক লোক বেরিয়ে এল। ফস করে একজনের হাতে একটা মশাল জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে দিল নিমাইয়ের। তবে সেই আলোয় সে হিরু গায়েনের বিশাল কোঁতকা চেহারাটা দেখতে পেল।
হিরু গর্জন করে উঠল, “লাঠি চুরি করে পালাচ্ছিলি রে শিয়াল?”
নিমাই বরাবর মৃদুভাষী। তর্জনগর্জন তার আসেনা। তবে যথাসাধ্য গম্ভীর গলায় নিমাই বলল, “দ্যাখ হিরু, তোর অনেক বেয়াদবি আমি মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আর নয়। যদি ভাল চাস তো দলবল নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মাপ চা। মারধর করা আমি পছন্দ করি না। বশ্যতা স্বীকার করে নিলে ঝামেলা করব না। চাই কী আমার দরোয়ানের চাকরিও করতে পারবি। দু’বেলা খাওয়া, পরা, হাজার টাকা মাইনে। খারাপ কী বল! নে নে, আর দেরি করিস না। রাত হয়ে যাচ্ছে। হাতে আমার মেলা কাজ।”
হিরু এত অবাক হল যে, প্রথমটায় কিছুক্ষণ কথাই কইতে পারল না। তারপর হঠাৎ বিকট জোরে এমন অট্টহাস্য করে উঠল হাহা করে যে, গাছগাছালিতে পাখিরা প্রাণভয়ে চেঁচামেচি করে ওড়াউড়ি শুরু করল পাগলের মতো।
নিমাই কাঁধ থেকে লাঠিটা নামিয়ে দু’হাতে তুলে ধরতে গিয়ে হঠাৎ টের পেল, লাঠিটা যেন ভারী-ভারী লাগছে! আঁ! এত ভারী হওয়ার তো কথা নয়! হঠাৎ লাঠির ওজনটা এত বেড়ে গেল কেন রে বাবা! নিমাই দু’হাতে বেজায় শক্ত করে ধরে লাঠিটা যতই তুলতে চায় ততই যেন লাঠিটা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ওজনটা কি আরও বেড়ে গেল নাকি? ইঃ রে বাবা, এ তো মোটে তোলাই যাচ্ছে না আর! লাঠির উপর যেন হিমালয় পর্বত চেপে বসছে!
হিরু দাঁত বের করে ধীর কদমে এগিয়ে আসে।
দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, “রাতারাতি বীর হয়ে গেলি নাকি রে নিমাই? আঁ! আবার তুই তোকারি করা হচ্ছে! বুকের এত পাটা হয়েছে যে, আমাকে দরোয়ান রাখতে চাইছিস! সাপের পাঁচ-পা দেখেছিস রে মর্কট ?”
ধাঁ করে হিরুর লাঠির একটা ঘা এসে পড়ল নিমাইয়ের কোমরে। বাপ রে বাপ’ চেঁচিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল নিমাই। তবু সেই অবস্থাতেই লাঠিটা আর একবার তুলবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু লাঠি নড়াতেই পারল না।
পর মুহূর্তেই ঝপাঝপ আরও লাঠি এসে পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। কিছুক্ষণ বাপ রে, মা রে’ বলে চেঁচাল নিমাই। তারপর মাথা ঝিমঝিম আর চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
তার শিথিল হাত থেকে লাঠিটা তুলে নিল হিরু। চমৎকার লাঠি, এ লাঠি চালিয়ে সুখ আছে। তার উপর মন্তরের জোর। এ লাঠি দিয়ে দুনিয়া বশ করা যায়। নিমাইয়ের মতো বেল্লিকের হাতে কি এ জিনিস মানায়?
একটা হাঁকাড় ছেড়ে লাঠিটা দু’হাতে তুলে একটু ঘুরিয়ে দেখল হিরু, বাপ রে, এ যে লাটুর মতো ঘোরে! আশ্চর্য কাণ্ড তো! এ লাঠিতে যে সত্যিই জাদু আছে, হিরু তার এক সাঙাতকে ডেকে বলল, “আয় তো শ্রীনাথ, একটু মহড়া নে তো!”
কিন্তু মহড়া নেবে কী? প্রথম টক্করেই শ্রীনাথের হাতের লাঠিটা উড়ে বিশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল। শ্রীনাথ বেকুবের মতো তাকিয়ে বলল, “একী রে বাবা!”
শ্রীনাথের অবাক হওয়ার কারণ আছে। হিরুর দলে সে-ই সবচেয়ে বড় লেঠেল। হিরুর চেয়েও ভাল, গোটা জেলায় তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কেউ নেই।
শ্রীনাথ গম্ভীর মুখে বলল, “ওস্তাদ, তুমি যা পেয়েছ তার দাম লাখ টাকা।”
হিরু তৃপ্তির হাসি হেসে লাঠিটা কাঁধে তুলে বলল, “চল! দুনিয়া এখন আমার হাতের মুঠোয়।”
হঠাৎ সামনের অন্ধকার কুঁড়ে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল হিরুর মুখে। কে যেন গর্জন করে উঠল, “শাব্বাশ!”
পালটা গর্জন ছেড়ে হিরু বলল, “কে রে? কার এত সাহস যে, আমার মুখে আলো ফেলিস!”
টর্চের পিছন থেকে গ্যানা বলল, “নড়িসনা হিরু, তোর দিকে বন্দুক তাক করা আছে। লাঠিটা সামনে মাটিতে রেখে পিছু সরে যা।”
হিরু ফের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে অট্টহাসি হাসল। বলল, “আমাকে বন্দুক দেখাচ্ছিস রে গ্যানা? বন্দুক! আয় তবে, আমার খেলও একটু দেখে নে!”
বলে হিরু লাঠিটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ বোকা বনে গেল। একী রে বাপ! লাঠি তো বিশমনি পাথরের মতো ভারী! তোলা দূরের কথা, নড়ানোই যাচ্ছে না যে! ধস্তাধস্তিতে কপালে এই শীতেও ঘাম ফুটে উঠল হিরুর। তবু লাঠি নড়ল না। হ্যাঁচকা টান দিয়ে শেষ চেষ্টা করতে গেল হিরু, আর তখনই দুম করে বিকট আওয়াজে গ্যানার বন্দুক থেকে গুলি ছুটল। সোজা এসে বিঁধল তার বাঁ কাঁধে, বাপ রে বলে লাঠি ছেড়ে কাঁধ চেপে বসে পড়ল হিরু। আর সেই সুযোগে গ্যানার। দলবল চড়াও হল হিরুর দলের উপর। মশাল আর টর্চের আবছা আলোয় ধুন্ধুমার চলতে লাগল দুই পক্ষে। মাঝে মাঝে বন্দুকের শব্দ, ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ।
কী যে হল, কে জিতল, কে হারল তা বুঝবার উপায় রইল না কিছুক্ষণ। তারপর দেখা গেল মাঠময় ত্রিশ-চল্লিশজন লোক নিথর হয়ে পড়ে আছে।
আর এই সময়েই নিজের কুখ্যাত বাহিনী নিয়ে অকুস্থলে হাজির হলেন পানুবাবু। এতক্ষণ একটু আবডালে অপেক্ষা করছিলেন, ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার জন্য।
একটু মিচকি হাসি হেসে তিনি পড়ে-থাকা হিরুর দুর্বল মুঠো থেকে আলগোছে লাঠিটা তুলে নিলেন। টর্চের আলোয় ভাল করে নিরীক্ষণ ৮৮
করে তিনি স্বগতোক্তি করলেন, “এই লাঠিখানার জন্য এত পেরামনি গেল তোদের, তবু ভোগে লাগল না রে!”
ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ফুলবাবুটি হলেও পানু ঘোষ একসময়ে যে ওস্তাদ লেঠেল ছিলেন তা সবাই জানে। লাঠিখানা হাতে নিয়ে তিনি পাখসাট মেরে কয়েক মিনিট বিদ্যুতের গতিতে লাঠিখানা চালালেন। তারপর অবাক হয়ে বললেন, “এ তো সাঙ্ঘাতিক জিনিস! এ লাঠি তো চালাতেও হয় না, আপনি চলে!”
পানুবাবুর গুন্ডারা সভয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। পানুবাবু চারদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “চল রে, আমার আবার বেশি রাতে ঘুমোলে পেটে বায়ু হয়।”
“তা হলে চললেন নাকি পানুবাবু!”
পানু ঘোষ দেখল, তিনটি আবছা মূর্তি সামনে পথ জুড়ে দাঁড়ানো। মরা চোখে চেয়ে পানুবাবু সস্নেহে বললেন, “তোরা কারা রে? কী চাস?”
একটু এগিয়ে এসে জগাই হাতজোড় করে বলল, “এই আমরা পানুবাবু। আপনার চাকরবাকরও বলতে পারেন, প্রজাও বলতে পারেন।”
মশালের আলোয় মুখখানা নিরীক্ষণ করে পানুবাবু বললেন, ”মুখখানা চেনা-চেনা লাগছে বটে! গঞ্জে তোদের তেলেভাজার দোকান ছিল না?”
মাধাইয়ের দিকে চেয়ে জগাই গদগদ গলায় বলল, “বলেছিলাম না মাধাইদা, আমাদের পানুবাবুর স্মরণশক্তি খুব পরিষ্কার। গরিবদেরও মনে রাখেন ঠিক। আর রাখবেনই বা না কেন! উনি তো গরিবের মা বাপ।”
মাধাই হাতের শাবলখানায় একটু হাত বুলিয়ে বলল, “ওরে, পানুবাবুর কি গুণের লেখাজোখা আছে! পানুবাবুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে জানিয়ে দে যে, গঞ্জে আমাদের তেলেভাজার একটা দোকান ছিল বটে, তবে পানুবাবু আর তাঁর সাঙাতরা ভারী আদর করে আমাদের তেলেভাজা খেতেন তো, আপনজন মনে করে লজ্জায় দামটা আর সাধতেন না। আমরা অবশ্য তাতে ধন্যই হতুম। তা ধন্য হতে হতে আমাদের তবিল ফাঁক হয়ে গেল কিনা। তা ছাড়া ওঁর নজরানাও তো একটু উঁচু দরেই বাঁধা ছিল। তাই দোকানটা ওঁর দয়ায় উঠে গেছে।”
জগাই ভারী অভিমানের গলায় বলে, “দ্যাখো মাধাইদা, ওইটেই তোমার দোষ। বড় বড় মানুষদের সঙ্গে কথাই কইতে শিখলে না! দেখছ না, বাবু এখন একটা গুরুতর কাজে ব্যস্ত আছেন! এসব ছোটখাটো কথা কয়ে কি ওঁর মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত?”
পানু ঘোষ ভুটা একটু কুঁচকে বললেন, “কী বলতে চাস তোরা বল তো! গঞ্জের বাজারে ব্যবসা করবি আর মানীর সম্মানীদক্ষিণা দিবি না?”
মাধাই ভারী অবাক হয়ে বলল, “এই দ্যাখো, তাই কি বললুম? আপনার ইচ্ছেতেই তো চন্দ্র-সূর্য আজও উঠছে! আমরা না দিলে আপনার চলবেই বা কীসে? প্রজারা খাজনা দিলে তবে তো রাজাগজাদের বারফট্টাই! এই ধরুন গিলে করা পাঞ্জাবি, কাঁচি ধুতি, দামি শাল, এসব তো আকাশ থেকে পড়বে না। তা পানুবাবু, আপনার সেই রুপো বাঁধানো ছড়িখানা কোথায় গেল বলুন তো! সেটা ছেড়ে। এমন একখানা কী বিচ্ছিরি বাঁশের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন যে বড়! ও কি আপনাকে মানায়? দিন, দিন, ওসব লাঠি এই আমাদের মত ছোটলোকের হাতেই খাপ খায়।”
পানুবাবু হঠাৎ ‘খবরদার’ বলে একটা বিকট চিৎকার করলেন। তারপর তাঁর সাঙাতদের দিকে ফিরে বললেন, “দে তো ধরে দু-চার ঘা। বড় বাড় বেড়েছে দেখছি!”
নবীন একটু পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার এগিয়ে এসে বলল, “পানুকাকা, ও লাঠিটা আমাদের বাড়ি থেকে চুরি গেছে একটু আগে। আমরা ওটা ফেরত নিতে এসেছি। খামকা এ দু’জন নিরীহ লোককে মারধর করবেন কেন? এরা তো কোনও অন্যায় করেনি। লাঠিটা ফেরত পেলেই আমরা চুপচাপ চলে যাব।”
পানুবাবু ধাতস্থ হয়ে মৃদু হেসে মোলায়েম গলায় বললেন, “ওরে বাপু, লাঠির গায়ে তো কারও নাম লেখা নেই! তুমি ভুল করছ বাপু। এ লাঠি আমার ঠাকুরদার আমলের। একটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই যত্ন করে রেখেছিলুম। আজ হরিপুরে যাত্রা শুনতে আসার সময় ভাবলুম, ভুরফুনের মাঠ তো ভাল জায়গা নয়, গুন্ডা বদমাশদের আখড়া। তাই ছড়িটা রেখে লাঠিটা নিয়ে গিয়েছিলুম। এ তোমাদের লাঠি নয় হে।”
নবীন দৃঢ়স্বরে বলে, “না, ও লাঠি আপনার নয়।”
“তবে কি আমি মিথ্যে কথা কইছি হে?”
জগাই বলল, “মাধাইদা, পানুবাবু জানতে চাইছেন উনি মিছে কথা কইছেন কিনা। বড় কঠিন প্রশ্ন। ভেবেচিন্তে জবাব দাও তো!”
মাধাই আঙুল দিয়ে কান চুলকে খানিক ভেবে বলল, “বড় মুশকিলে ফেললি রে জগাই। হঁ্যা বললে পানুবাবুর যে বড্ড মন খারাপ হবে। সেটা কি ভাল হবে রে?”
জগাই মাথা নেড়ে বলল, “সেটাও তো গুরুতর কথা। পানুবাবুর মন খারাপ হলে মাথার ঠিক থাকে না কিনা, হয়তো কেঁদেই ফেলবেন। ভাল লোকদের নিয়ে ওই তো বিপদ।”
পানুবাবু হঠাৎ তবে রে’ বলে লাঠি বাগিয়ে ধরে বললেন, “অনেকক্ষণ ধরে বেয়াদবি সহ্য করেছি। আর নয়!”
কিন্তু লাঠিটা তুলতে গিয়ে পানুবাবুর চোখ ইয়া বড় বড় হয়ে গেল। ভারী অবাক হয়ে বললেন, “একী!”
পানুবাবুর গুন্ডার দল অবশ্য সটান এসে চড়াও হল জগাই আর মাধাইয়ের উপর। শাবল তুলে দু’জনে বিদ্যুতের গতিতে চালাতে লাগল। ঠকঠক ঠনঠন শব্দে কান ঝালাপালা।
নবীন নিঃশব্দে গিয়ে হতবাক পানুবাবুর হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে নিল। তারপর শুরু হল লাঠির খেল। সুদর্শন চক্রের মতো নবীনের লাঠি চারদিকে ঘুরতে লাগল। বনবন! বনবন! চোখের পলকে গুন্ডাদের হাতের অস্ত্রশস্ত্র ছিটকে উড়ে যেতে লাগল চারদিকে। ‘বাপ রে মা রে’ চিৎকার করতে করতে কেউ ঠ্যাং ভেঙে, কেউ মাথায় চোট পেয়ে, কেউ হাত ভেঙে ধরাশায়ী হতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই লড়াই শেষ। শুধু পানুবাবু ভারী হতবাক আর স্তম্ভিত হয়ে সেই যে দাড়িয়ে পড়েছিলেন আর নড়েননি।
“এ কী রে জগাই, পানুবাবু এখনও দাড়িয়ে যে!”
জগাই কাছে গিয়ে পানুবাবুর মুখখানা ভাল করে দেখে বলল, “তাই তো! এ তো পানুবাবুই মনে হচ্ছে মাধাইদা! নাঃ, পানুবাবুর সাহস আছে। এত কাণ্ড দেখেও পালাননি কিন্তু।”
“ওরে ভাল করে দ্যাখ, মূছা গেছে কিনা!”
জগাই মাথা চুলকে বলল, “কিছু একটা হয়েছে। যঁা, মাধাইদা, পানুবাবুকে তুমি মারোনি তো!”
জিভ কেটে মাধাই বলে, “ছিঃ ছিঃ, অত বড় মানী লোকের গায়ে হাত তুলতে আছে? একটু ঠেলা দিয়ে দ্যাখ তো।”
“সেটা কি ভাল হবে মাধাইদা? পড়েটড়ে গেলে যে জামাকাপড় নোংরা হবে।”
“কিন্তু সবাই যেখানে শুয়েটুয়ে আছে সেখানে পানুবাবুর এই একা খাড়া দাড়িয়ে থাকা কি ভাল দেখাচ্ছে?”
“বলছ! তা হলে ঠেলব?”।
একটু ঠেলতেই পানুবাবু ধড়াস করে চিতপাত হয়ে পড়ে গেলেন।
“আহা, ভদ্রলোকদের কি ওভাবে ঠেলতে আছে রে জগাই! মেরে ফেলিসনি তো!”
জগাই পানুবাবুর নাকের সামনে হাত দিয়ে বলল, “না গো মাধাইদা, দিব্যি খাস চলছে।”
তিনজন পাশাপাশি দাড়িয়ে রণক্ষেত্রের করুণ চেহারাটা খানিকক্ষণ দেখে যখন ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়াল, তখনই মৃদু গলাখাঁকারির একটা শব্দ পাওয়া গেল।
এদিক-ওদিক চেয়ে কাউকে দেখা গেল না অবশ্য। জগাই সোৎসাহে বলে উঠল, “কণ্ঠদাদা নাকি?”
“আজ্ঞে না।”
মাধাই বলল, “তা হলে নির্ঘাত কুঁড়োরামদাদা।”
“আজ্ঞে না, আমি কুঁড়োরাম নই।”
নবীন অবাক হয়ে বলে, “তবে আপনি কে?”
“আমি সাধুবাবার এক সেবাইত। তার সমাধিতে হাওয়াটাওয়া করি, পাহারা দিই।”
“আপনাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?”
“আমি কি আছি, যে দেখবেন?”
“নেই! তা হলে কথা শুনতে পাচ্ছি যে!”
“আমি আপনাদের মতো নেই, আমার মতো আছি।”
নবীন বলল, “বুঝেছি, আমাদের কিছু বলবেন?”
“সাধুবাবা তাঁর লাঠিখানার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছেন।”
নবীন লাঠিখানা তুলে ধরে বলল, “এটাই কি সাধুবাবার লাঠি?”
“হ্যাঁ।”
নবীন বলল, “ওঁর লাঠি উনিই নেবেন। আমাদের আপত্তি নেই।”
একটা বড় শ্বাস ফেলার মতো আওয়াজ শোনা গেল। গলার স্বর বলল, “আজ আমার বুকটা ঠান্ডা হল। ওই বাঁ দিকে দশ কদম এগোলেই যে মাটির ঢিবি দেখতে পাবেন, সেটাই সাধুবাবার সমাধি।”
তারা ধীর পায়ে দশ কদম এগিয়ে গেল। লম্বাটে ঢিবিটার সামনে দাড়াল।
“এবার কী করব?”
“দক্ষিণ শিয়রে লাঠিটা খাড়া করে রাখুন।”
“পড়ে যাবে যে!”
“না, পড়বে না।” নবীন সমাধির দক্ষিণের শিয়রে লাঠিটা দাড় করিয়ে রেখে হাত সরিয়ে নিল। আশ্চর্য! লাঠিটা দিব্যি দাঁড়িয়ে রইল।
.
সেবাইতের কণ্ঠস্বর বলল, “আর দু-চার দিনের মধ্যেই ওই লাঠির গায়ে পাতা গজাবে। ডালপালা বেরোবে … লাঠিটা গাছ হয়ে যাবে। … তারপর কুঁড়ি আসবে … ফুল ফুটবে। সাদা সুগন্ধি ফুল। গাছ কেঁপে ফুল ফুটবে … আর সাধুবাবার সমাধির উপর টুপটাপ করে সারাদিন সারারাত ধরে ঝরে পড়বে সাদা সুগন্ধি ফুল। … আর সাধুবাবা সমাধিতে বড় শান্তিতে ঘুমোবেন তখন … বড় শান্তি …”
তিনজনেই সমাধির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে নবীন বলল, “তবে তাই হোক। তবে তাই হোক।”
জগাই আর মাধাইও ফিসফিস করে বলল, “তাই হোক, তাই হোক।”