চোখে রোদ লাগায় ধড়মড় করে উঠে নড়েচড়ে বসল হরি। তারপর অবাক হয়ে দেখল, বিছানাটা খালি। গোপালের চিহ্নও নেই। তবে বালিশে রক্তের দাগ লেগে আছে। টেবিলের ওপর গোপাল দাসের দুটো ওষুধের শিশি পাশাপাশি ভাইবোনের মতো দাঁড়িয়ে।
তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমটা দেখল হরি। নেই। বারান্দা এবং আশেপাশে বাগানেও খুঁজল। নেই। কিন্তু ওই অবস্থায় গোপালের পক্ষে খুব বেশি দূরেও তো যাওয়া সম্ভব নয়।
দরোয়ান জগুরাম বাড়িতে ছিল না। ঝুমরি ছিল। রোদে ছোট একটা খাঁটিয়ায় একটা বাচ্চাকে শুইয়ে তেল মাখাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করায় কিছুক্ষণ বোবার মতো চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, সে কাউকে দেখেনি।
রাস্তাটাও একটু ঘুরে দেখে এল হরিবন্ধু। কেউ কোথাও নেই।
ঘরে এসে চুপচাপ বসে কিছুক্ষণ স্থির মস্তিষ্কে ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখল সে। কিন্তু সমাধান ভেবে পেল না।
স্কুলের সময় হয়ে এসেছিল বলে অগত্যা উঠতে হল হরিবন্ধুকে। খুবই অন্যমনস্ক ভাবে সে বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে স্নান করল। তেমনি আনমনেই ঝুমরির বেড়ে-আনা এক-পাহাড় ভাত খেয়ে নিল। কিন্তু সারাক্ষণ সে ভাবতে লাগল, কাল রাতে সে কি স্বপ্ন দেখেছিল? যদি স্বপ্ন
হয়ে থাকে তবে গোপালকে কারা এবং কেন মারল? পাগলা-সাহেব বলে একজন কেউ এখানে আছে, যার কথা গোবিন্দদা তাকে বলেছে, গোপালও বলেছে, তবে তার আবার কবর কী করে থাকবে! আর সেই কবর খুঁজছেই বা কারা! পটল দাস লোকটা আসলে কে!
ভাবতে ভাবতে পোশাক পরে বইখাতা নিয়ে সে সাহেবপাড়ার নির্জন রাস্তা দিয়ে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগল। পাশের বাড়ির দিকে অনিবার্যভাবেই তার চোখ চলে গেল। কাল রাতের ঘটনাস্থল। দিনের বেলা ভাল করে দেখল হরি। একসময়ে বিশাল ফুলের বাগান ছিল, পাথরের ফোয়ারা ছিল, পরী ছিল। এখন বাগান জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। পরীর দুটো ডানাই ভাঙা। ফোয়ারা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। বাড়িটাও বিশাল। কিন্তু নোনা ধরে, শ্যাওলা পড়ে, অশ্বথগাছ গজিয়ে বাড়িটার বারোটা বেজে যাচ্ছে। ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল হরি। দেখতে দেখতে হঠাৎ ফটকের গায়ে শ্বেতপাথরে খোদাই করা নামের ফলকটা চোখে পড়ল তার। সাদার ওপর কালো অক্ষরে লেখা, ‘কুসুমকুঞ্জ’।
হরি একটু শিউরে উঠল। গোপাল তাকে কুসুমকৃঞ্জের কথা বলেছিল বটে।
সে আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি স্কুলের দিকে হাঁটা দিল। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
স্কুলে এসে দেখল, গোপালের জায়গাটা ফাঁকা, ফাঁকাই থাকার কথা। তবু মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছেলেটা যে কোথায় গায়েব হল, কে জানে! যারা রাতে গোপালকে মেরেছিল তারাই গুম করে নিয়ে যায়নি তো! আজ ক্লাসে রাজর্ষি বা থ্রি মাক্সেটিয়ার্সকে দেখতে পাওয়া গেল না। তাতে একটু স্বস্তিই বোধ করল হরি।
ফার্স্ট পিরিয়ড শুরু হওয়ার মুখে শেষ বেঞ্চের একটা ছেলে হঠাৎ এসে তার হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেল। হরি কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখল, তাতে লেখা: তুমি যে কাল রাতে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ সেকথা আমি ভুলব না। আমি এখন ভাল আছি। তবে কয়েক দিন স্কুলে যাওয়া হবে না। সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন তুমি ঘুমোচ্ছিলে। আমি তোমাকে ডাকিনি। পাছে আমাকে নিয়ে তুমি ঝামেলায় পড়ো সেই ভয়ে চলে এসেছি। চিন্তা কোরো না। একটা ইটের ঘায়ে কাবু হওয়ার ছেলে গোপাল নয়। দেখা হলে সব বলব। একটা কথা বলে রাখি, কুসুমকুঞ্জের ভিতরে ভুলেও যেও না। তোমার ভালর জন্যই বলছি।
চিঠিটা ভাঁজ করে অঙ্ক বইয়ের মধ্যে রেখে একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলল হরি। গোপালের জন্য তবে চিন্তার তেমন কিছু নেই।
আজও ক্লাসে কেউ তাকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করছিল না। কিন্তু সারাক্ষণই হরি খুব অস্বস্তির সঙ্গে টের পাচ্ছিল, অলক্ষ্যে কে যেন তার দিকে বিষদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সে সকলের চোখের দিকে চেয়ে দেখছিল। কিন্তু কে যে অমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে, তা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তাকানোটা এমনই মারাত্মক যে, আঙুলের স্পর্শের মতো টের পাচ্ছিল সে।
ভালয়-মন্দয় ক্লাসগুলো কেটে গেল। স্কুল থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিতেই মস্ত শিমুলগাছটার আড়াল থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে এসে বলল, “আমি টুলু। গোপাল আমার বন্ধু।”
ছেলেটাকে হরিও চিনল। গোপালের চিঠিটা ওই এনে দিয়েছে তাকে। রোগা, ফর্সা চেহারা। দেখলে মনে হয় নিতান্তই নিরীহ।
হরি উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল, “গোপাল এখন কেমন আছে?”
টুবলু ঠোঁট উলটে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বলল, “গোপাল কত মার খেয়েছে, ওর কিছু হয় না ওতে। দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“তুমি কি ওর বাড়ির কাছে থাকো?”
“হ্যাঁ। আমাদের পাশাপাশি বাড়ি। শোনো, আমি কিন্তু গোপালের মতো সাহসী নই। গোপাল আমাকে বলেছে, যেন তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। কিন্তু আগেই বলে রাখছি, বিপদ-টিপদ হলেই আমি পালাব।”
হরি মৃদু হেসে বলল, “আমাকে পৌঁছে দেওয়ার কোনও দরকার নেই তোমার। বিপদ কিছু হবে না। আর হলেও আমি অত ভয় পাই না। তুমি বাড়ি যাও।”
“পাগল! গোপাল তা হলে কি আমাকে আস্ত রাখবে? তোমাকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে তবে আমার ছুটি।”
হরি বুঝল, গোপালের আদেশ এ-ছেলেটার কাছে গুরুর আদেশের মতো। সেই আদেশ পালন না করে ওর উপায় নেই।
হরি হেসে বলল, “চলো তা হলে, গল্প করতে করতে যাই।”
দু’জনে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগল। বেশির ভাগই স্কুলের কথা, ছেলেদের কথা, নিজেদের কথা।
তেঁতুলতলার কালীবাড়ি ছাড়িয়ে বাঁ দিকে সাহেবপাড়ার মোড়ের কাছবরাবর ইউক্যালিপটাস আর শালগাছে ভরা এক টুকরো জমি আছে। শীতের অপরাহ্নে সেখানে গাঢ় ছায়া জমে আছে। সেই জমিটার পাশ দিয়ে যখন দু’জনে যাচ্ছে তখন আচমকা সাত-আটটা ছেলে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের ঘিরে ফেলল চোখের পলকে। আর তারা কিছু বুঝে ওঠবার আগেই টানতে টানতে জঙ্গলটার মধ্যে নিয়ে গেল।
হরি দেখল, এদের মধ্যে রাজর্ষি আর থ্রি ম্যাক্সেটিয়ার্স তো আছেই, আরও গোটাকতক বেশ বেশি বয়সের কেঁদো-কেঁদো চেহারার অচেনা ছেলে রয়েছে। প্রত্যেকের হাতেই রড বা লাঠি গোছের অস্ত্র। রাজর্ষির হাতে ঝকঝক করছে একটা ড্যাগার।
রাজর্ষি হাত বাড়িয়ে বলল, “গোপালের চিঠিটা দেখি।”
হরি এত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল যে, জবাব দিতে ভুলে গেল। রাজর্ষি চড়াত করে তার গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “কাল তো খুব তেজ দেখিয়ে গিয়েছিলে! ভেবেছিলে আমরা ভেড়ুয়া? এখন তো আর গোপাল নেই যে, সাহস দেখাবে! চিঠিটা ভালয়-ভালয় বের করে দাও।”
হরি অঙ্ক বই খুলে চিঠিটা বিনা বাক্যব্যয়ে বের করে দিল। রাজর্ষি চিঠিটা পড়ে অন্য একটা ছেলের হাতে দিয়ে হরির দিকে চেয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে গোপালের কী কী কথা হয়েছে?”
হরি অবাক হয়ে বলল, “রোজ তোমরা গোপালের কথা জানতে চাও কেন? তার সঙ্গে তো আমার সবে একটু ভাব হয়েছে। এখনও তাকে আমি ভাল করে চিনিও না।”
রাজর্ষি তার দিকে স্থির চোখে চেয়ে বলল, “গোপালকে আমরা চিনি। বিশেষ কারণ না থাকলে সে সহজে কারও সঙ্গে ভাব করে না। তোমার সঙ্গে যখন ভাব করেছে, তখন কারণও একটা নিশ্চয়ই আছে। আমরা সেই কারণটা জানতে চাই।”
হরি অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আমিও কারণটা জানি না। আর কাল রাতে তোমরা যখন কুসুমকুঞ্জে ওকে মেরেছিলে, তখন ও অজ্ঞান হয়ে যায়। অজ্ঞান অবস্থায় কথা বলবে কী করে?”
একথায় সকলেই স্থির হয়ে গেল। রাজর্ষি গলায় একটা বাঘের মতো গর্জন ছেড়ে বলল, “কাল রাতে ওকে আমরা মেরেছি একথা কে বলল?”
“তোমরা ছাড়া আর কে মারবে?”
পটাং করে কার একটা লাঠির ঘা এসে পড়ল হরির বাঁ কাঁধে। যন্ত্রণায় ‘ওফ’ বলে একটা শব্দ করে সে মাটিতে উবু হয়ে বসে পড়ল। টুলুও চেঁচিয়ে উঠল, “মেরে ফেলল! বাঁচাও।”
তারপর কী হল কে জানে! চারদিক থেকে ছেলেগুলো ঠকাঠক লাঠি আর রড চালাতে লাগল। হরির কোমরে একটা জুতোসুদু পায়ের লাথিও এসে লাগল জোরে। সে মাটিতে পড়ে যেতেই দেখল, একটা ছেলে মস্ত রড় তুলেছে তার মাথা লক্ষ্য করে।
ভয়ে চোখ বুজে ফেলল হরি।
আর চোখ বুজেই শুনতে পেল, কোথা থেকে যেন একটা দ্রুতগামী তেজী ঘোড়া দৌড়ে আসছে। মাটিতে টগবগ শব্দ হচ্ছে তার পায়ের। ঝড়ের মতো বনবাদাড় ভেঙে এসে পড়ল কাছে। খুব কাছে।
আর্তস্বরে কারা যেন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল “পাগলা-সাহেব! পাগলা-সাহেব!”
তারপরেই ভোজবাজির মতো কে কোথায় মিলিয়ে গেল কে জানে!