৫. ঘুম ভাঙালুম বুঝি

ওমা! ঘুম ভাঙালুম বুঝি?

না ম্যাডাম, ঘুমোইনি। চিন্তা করছি।

আপনাকে আমি যা চিন্তা করতে বলেছি তা করছেন তো?

না ম্যাডাম, তার চেয়েও ইম্পর্ট্যান্ট চিন্তা করতে হচ্ছে।

সে আবার কীসের চিন্তা?

শবরবাবু নতুন দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন মাথায়।

কীরকম দুশ্চিন্তা?

ওঁর ধারণা হয়েছে আমাকে কেউ খুন করবে।

আঁ!

হ্যাঁ ম্যাডাম।

উদ্বিগ্ন নারীকণ্ঠটি থেকে রহস্য খসে পড়ল, একটু আর্তনাদের মতো কণ্ঠস্বরটি বলে উঠল, কেন? কে খুন করতে চাইছে?

তা তো উনি বলেননি। তবে সাবধান থাকতে বলেছেন।

কী আশ্চর্য! আপনার ওপর কার রাগ থাকতে পারে?

তা তো জানি না। তবে আপনাকে তো বলেইছি, আমি লোক ভাল নই। কারও হয়তো খার আছে।

প্লিজ, একটু ডিটেলসে বলুন।

ডিটেলস তো আমিও জানি না ম্যাডাম। তবে পুলিশসাহেব আজ আমার গ্যারাজে হানা দিয়েছিলেন। ঘটনার ক্রম দেখে বা কোনও সূত্রে উনি এরকমই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।

তা হলে আপনি কোথাও চলে যান। কাল সকালেই চলে যান।

না ম্যাডাম, আমি ভিতু হলেও ততটা কাপুরুষ নই।

নারীকণ্ঠ ঝেঁঝে উঠল, যাক, অত বীরত্ব দেখাতে হবে না। এ শহরে ভীষণ বিচ্ছিরিভাবে খুনটুন হয়। দিনে দুপুরে। প্লিজ, অকারণে বেশি সাহস দেখাবেন না।

আপনি কি আমার জন্য উদ্বিগ্ন?

যদি বলি হ্যাঁ।

তা হলে তো বলতে হয় অচেনা একজন মানুষের জন্য আপনার যথেষ্ট সিমপ্যাথি আছে।

দেখুন, এসব সিরিয়াস সিচুয়েশনে ইয়ারকি ভাল লাগছে না। আপনি তো বলেছিলেন দিল্লিতে আপনার দাদা থাকেন।

হ্যাঁ।

তার কাছে চলে যান না।

 তার কাছে গিয়ে তো অনন্তকাল থাকা যাবে না। কলকাতায় বুড়ো মাবাবা, কাজকারবার সব ফেলে চলে গেলেই তো হবে না। আর দাদার সঙ্গে আমার সম্ভাবও নেই।

অন্য কোথাও গিয়ে থাকার মতো টাকা কি আপনার নেই? খুব পারবেন প্লিজ!

ম্যাডাম, গেলেই তো হবে না। একদিন ফিরতেই তো হবে।

সে তখন পরে দেখা যাবে।

আমার এখন অনেক টাকা, জানেন?

কীসের টাকা?

শুনছি অরুণিমা বকশি নাকি মারা যাওয়ার আগে তার বিষয়সম্পত্তি আমার নামে ট্রান্সফার করে গেছে।

সত্যি?

হ্যাঁ।

এত টাকা নিয়ে কী করবেন?

কিছুই করব না ম্যাডাম। একটা পয়সাও ছোঁব না।

কেন?

নেব কেন বলুন তো? কোন অধিকারে?

সত্যি নেবেন না?

প্রশ্নই ওঠে না। শুনে বরং আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল।

ওমা! কেন?

এটা হয়তো ঘুষ, হয়তো করুণা, হয়তো ক্রয়মূল্য। কিন্তু কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই?

থ্যাঙ্ক ইউ।

হঠাৎ থ্যাঙ্ক ইউ দিলেন কেন?

হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

তাই বা কেন?

সে আপনি বুঝবেন না।

আপনি বেশ অদ্ভুত লোক ম্যাডাম।

মোটেই অদ্ভুত নই। মেয়েদের আপনি একটুও চেনেন না।

মেয়েরা কি সব একরকম যে চিনব? এক-একজন এক-একরকম। কে যে কী চায় তা একদম বুঝতে পারি না। তাই নারীচিন্তা করিই না। পারতপক্ষে। হাসলেন নাকি?

হ্যাঁ।

কেন হাসলেন?

আপনার অসহায় অবস্থা দেখে। এত মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করেও মেয়েদের চিনতে পারলেন না?

ম্যাডাম, আপনি আমার প্রকৃত অবস্থাটা জানেন না। মেয়েদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলতাম। আজও চলি। সার্কাসে যখন কাজ করতাম তখনই দেখেছি, কোনও কোনও মেয়ে আমার ওপর ইন্টারেস্ট নিচ্ছে। ঠেকানোর চেষ্টা যে করিনি তা নয়। তবু মেলামেশা হয়ে গেল। ফিজিক্যাল রিলেশন, তার বেশি কিছু নয়। সেই থেকে শুরু আজও শরীর ছাড়া আর কোনও রিলেশন মেয়েদের সঙ্গে আমার হয়নি। বলুন ম্যাডাম, তার জন্য কি আমি দায়ী? আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। অরুণিমা বকশি যে পাগলামি করলেন তারও কোনও গভীরতা নেই কিন্তু। ওঁর মন বলে বস্তুই ছিল না। আমি ছিলাম ওঁর জাস্ট একটা টয়। খেলা ফুরোলেই ফেলে দিলেন।

 বুঝেছি। আপনি ভাল লোক, মেয়েরা খারাপ।

তা বলিনি। বলছি আই ইজিলি অ্যাট্রাক্ট দি ব্যাড পিপল।

 তাই বুঝি?

আমি ব্যাড তো, তাই ব্যাডদেরই আমাকে পছন্দ হয়।

আপনি খুব খারাপ, কিন্তু চিকিৎসার অতীত নন।

 বলছেন?

হ্যাঁ।

তা হলে আমারও আশা আছে?

 খুব আছে। তবে একটা শর্ত।

কী সেটা?

আর কখনও মেয়েদের ওভাবে ব্যবহার করবেন না।

ফিজিক্যালি তো?

হ্যাঁ।

ম্যাডাম, আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? আমি ব্যবহার করি না, ব্যবহৃত হই।

দয়া করে আর ব্যবহৃত হবেন না। কথা দিন।

কথা দেব? কেন ম্যাডাম? আপনি তো আমার কাছে একজন অজ্ঞাতপরিচয় মহিলা মাত্র। আপনাকে এত বড় একটা কথা দেব কেন?

তার মানে ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ানোটাই আপনার পছন্দ?

তা নয়। কিন্তু আপনাকে কথা দেব কেন? যে মহিলা বিশ্বাস করে নিজের নামটাও আজ অবধি আমাকে বলেনি তাকে কথা দেওয়ার কী দায়?

পরিচয় দিয়েই বা কী লাভ বলুন? আপনি তো মেয়েদের একটাই ব্যবহার জানেন। সেটা হল শরীর। আপনি নিজেই বলেছেন মেয়েদের ব্যাপারে কৌতূহলও নেই আপনার।

তা ঠিক। তবে আপনার ব্যাপারে একটা কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে।

আমার ভাগ্যি।

আমি কিন্তু কথা বলতে জানি না। অনেক সময়ে উলটোপালটা বলে ফেলি কিছু মনে করলেন না তো!

না, মনে করার মতো কিছু তো বলেননি। তবে কথা দিলেন না বলে দুঃখ পেলাম।

আগে বলুন, আপনি কে?

জেনে কোনও লাভ নেই আপনার।

আমার কী মনে হয় জানেন?

কী?

আপনি বোধহয় খুব অচেনা নন। বাঃ, তা হলে তো ভালই। মাথা খাটিয়ে বের করুন তো আমি কে?

একটু সময় লাগবে। মাথাটা তো এখন নানা চিন্তায় এনগেজড।

তাড়া নেই। ভাবুন।

নিজে থেকে কিছুতেই বলবেন না তো।

না। একটু কষ্ট করুন। বরাবর তো সব মেয়েদের অনায়াসেই পেয়ে গেছেন।

ভুল বললেন। আমি কোনও মেয়েকেই পাইনি। আমার চেহারাটা ভাল। দুর্ভাগ্য হল, মেয়েরা, অর্থাৎ যারা একটু ফিজিক্যাল তারাই আমার শরীরটাই কেবল চেয়েছে। ওটাকে পাওয়া বলে না।

ওটাকেই তো সবাই পাওয়া বলে মনে করে।

 আমি মনে করি না।

আপনি তা হলে কীভাবে পেতে চান?

সেটা ঠিক বুঝতে পারি না। তবে ফিজিক্যাল পাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

টোটাল সারেন্ডার তো। সব পুরুষই মেয়েদের কাছে তাই চায়।

দেখুন, ভালবাসার মধ্যে সারেন্ডারও কিন্তু একটু থাকে।

আপনিও আসলে ক্রীতদাসী চাইছেন।

দোষ কী? আমিও যদি তার ক্রীতদাস হই?

ছেলেরা কখনও ক্রীতদাস হতে পারে না। তারা নিতে জানে, দিতে নয়।

ছেলেদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা হয়তো সুখকর নয়। ছেলেদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা বেশি নেই, কিন্তু পুরুষদের মোটামুটি বুঝতে পারি।

কিচ্ছু বুঝতে পারেননি। আপনি আমাকে দেখেননি।

কে বললে দেখিনি?

কবে দেখলেন? কোথায় দেখলেন?

 তা বলব কেন?

বাজে কথা, আপমি মোটেই দেখেননি। বলুন তো আমার বাঁ গালে যে আঁচিলটা আছে সেটা লালচে না খয়েরি?

আপনার বাঁ গালে কোনও আঁচিল নেই।

বলুন তো আমার নাকটা থ্যাবড়া না চোখা?

থ্যাবড়া নয়, তবে একটু চাপা। মনে হয় কখনও নাকটা ভেঙে গিয়েছিল।

ঠিক বলেছেন তো! সার্কাসে চাকরি যখন করি তখন প্র্যাকটিসের সময় আমি ট্র্যাপিজ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। নীচে নেট ছিল, আমি নেটের বাইরে ছিটকে গিয়েছিলাম। নাঃ, স্বীকার করতেই হচ্ছে আপনি আমাকে দেখেছেন।

দেখেছি।

ভাবিয়ে তুললেন ম্যাডাম।

কেন ভাবনার কী হল?

এ যে ওয়ান ওয়ে গ্লাস। আপনি দেখেছেন, আমি দেখিনি।

কোনওদিন দেখা হতেও পারে।