৫. ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথচলা

ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথচলা যে কী কঠিন ব্যাপার তা যার অভিজ্ঞতা নেই সে বুঝবে না। দুভাগ্যের বিষয়, অভিজ্ঞতা অভয়েরও নেই। লতাপাতা, কাঁটাঝোঁপ এবং মাঝে-মাঝে দুর্ভেদ্য বাঁশঝাড় এমন শক্ত বেড়ার মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় যে, চলা বন্ধ। হয়ে যায়। সাপখোপ জন্তু-জানোয়ারের ভয় তো আছেই। তবু ঘণ্টা দুই অভয় একটানা হাঁটল। না, ঠিক হাঁটা বলা যায় না। কখনও হামাগুড়ি, কখনও স্রেফ বুক ঘেঁষটে, কখনও ছোটখাটো গাছের ডাল ধরে স্কুল খেয়ে নানা কায়দায় তাকে এগোতে হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়ের কথা, তার যে এত এলেম ছিল এটাই জানত না। অভয়। কাল সারাদিন ওরকম দৌড়ঝাঁপ, তারপর সন্ধেবেলা হাটুরে মার, অনাহার সত্ত্বেও আজ এই কঠিন অভিযান, সে পারছে কী করে? স্বাভাবিক নিয়মে তার তো এখন বিছানায় পড়ে থাকার কথা!

শুধু চলছেই না অভয়, জঙ্গলের সবুজ সৌন্দর্য, নির্জনতা এবং পাখির ডাক সে উপভোগও করছে। এত সবুজ, এত গভীর নির্জনতা যে কোথাও আছে তা তার খেয়ালই হয়নি। ঠিক বটে, নানা পাতা আর ঝোঁপঝাড়ে ঘষা লেগে তার গা চুলকোচ্ছে, মৌমাছির হুলও খেতে হয়েছে কয়েকবার, অল্পের জন্য একটা কাঁকড়া-বিছেকে মাড়িয়ে দেয়নি, কাঁটা লেগে হাত-পা কিছু ছড়ে গেছে, তবু বেশ ভালই লাগছে তার। বনের মধ্যে সে দু জায়গায় দুটো চেনা ফলের গাছ পেয়ে গেল। প্রথমে পেল একটা পেয়ারা গাছ। দিব্যি কাঁচা-পাকা পেয়ারা ধরে আছে। গোটাকয়েক খেয়ে গোটাকয়েক পকেটেও পুরে নিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে পেয়ে গেল একটা পেঁপে গাছ। পাকা পেঁপের মতো জিনিস হয় না।

সে একটা নরম গাছের ডাল ভেঙে আঁকশি বানিয়ে টপাটপ দুটো পেঁপে পেড়ে মহানন্দে খেয়ে নিল। ব্রহ্মদৈত্যের পাঁচনের গুণ এবং হাঁটার ফলে যে ব্যায়াম হচ্ছে তাতে খিদেটা বেশ চাগাড় দিচ্ছে। ফলটল খেয়ে একটা বড় গাছের তলায় বসে জিরোতে-জিরোতে সে খানিকক্ষণ পাখির ডাক শুনে নিল।

জীবনে শিস দেয়নি অভয়, চেষ্টাও করেনি। ওসব তার আসেও না। আজ হঠাৎ পাখির ডাক শুনে তার শিস দিতে ইচ্ছে হল। দেখল, বেশ ভালই শিস দিতে পারে সে। গুনগুন করে একটু গান গাইতে গিয়ে বুঝতে পারল, গলায় তার সুরের খুব একটা অভাব নেই তো! তা হলে সে এতকাল এসবের চর্চা করেনি কেন?

ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ গাঝাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে বসল অভয়। নিজের সম্পর্কে আজ তার নতুনরকমের ধারণা হচ্ছে। অত দৌড়েও সে তেমন জব্দ হয়নি, অত মার খেয়েও সে মরেনি এবং জঙ্গলের দুর্গম রাস্তায় প্রায় টারজানের কায়দায় দিব্যি তো সে এতখানি চলে এল। তা হলে কি নিজেকে সে যতটা অপদার্থ ভাবত ততটা সত্যিই নয়? তা হলে কি অভয় সরকার নামে এই থলথলে, বিদিকিচ্ছিরি লোকটাকে একেবারে বাতিলের দলে না ধরলেও চলে? ইস, জীবনের ছাব্বিশ-সাতাশটা বছর কেবল কুঁড়েমি করে, খেয়ে আর ঘুমিয়ে, তেমন কোনও কাজ না করে সে

তো বরবাদ করে দিয়েছে। বাপের কিছু টাকা আর সম্পত্তি ছিল, সেটাই ভাঙিয়ে কেবল পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছিল। অথচ তার মধ্যে তো জিনিস ছিল!

নিজের সম্পর্কে এই আবিষ্কার করে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াল অভয়। আত্মবিশ্বাস আসার সঙ্গে-সঙ্গে তার শরীরেও যেন দুনো বল চলে এল। গা বেশ গরম হয়ে উঠল। মনে চলে এল দুর্জয় একটা সাহসের ভাব। জঙ্গলে শোনার কেউ নেই, তবু অভয় হঠাৎ বেশ জেঁকে বলে উঠল, “আমি কাউকে ভয় খাই না।”

অভয় এত উত্তেজিত হয়ে পড়ল যে, এক্ষুনি একটা বীরত্বের কাজ না করলে যেন তার রক্তের টগবগানিটা থামবে না। সে গিয়ে সামনে যে গাছ পেল তারই একটা ডাল মড়াত করে ভেঙে ফেলল। তারপর বাঁইবাই করে সেটা কিছুক্ষণ লাঠির মতো ঘোরাল। বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না! কাউকে না! কাউকে ভয় খাই না! আয় না ব্যাটারা কে আসবি! আয় না!”

কেউ অবশ্য এগিয়ে এল না, তবে দুটো ঘুঘু পাখি গাছের ডালে বসে বিশ্রাম করছিল, বিরক্ত হয়ে উড়ে গেল।

অভয় লাঠি হাতে এবার সদর্পে জঙ্গল ভেঙে এগোতে লাগল। ঠোঁট ছুঁচোলো করে মাঝে-মাঝে শিস দিচ্ছিল। মাঝে-মাঝে বেশ জোর গলায় গান গাইছিল। আবার মাঝে-মাঝে বাঘা চোখে চারদিকে চেয়ে দেখছিল কেউ তার সঙ্গে লাগতে আসছে কিনা। আর এই দেখতে-দেখতেই হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে সে একটা গর্তের মতো জায়গায় ধপাস করে পড়ে গেল। অবশ্য লাগল না। কারণ গর্ত হলেও লম্বা লম্বা ঘাসে একেবারে নরম গদি হয়ে আছে। গর্ত থেকে উঠতে গিয়ে অভয়ের মাথায় ব্রহ্মদৈত্যের কথাটা চড়াক করে গেল। এই সেই শুখানালা নয়তো! শুকনো নালার থাত!

কাল রাতে গাঁয়ের একটা লোক ভীম সরকারের কথা বলেছিল। আজ ব্ৰহ্মদৈত্যও বলছিলেন। ভীম সরকার কে এবং কেন তাঁকে এদের এত ভয়, তা অভয় জানে না। সরকার পদবি যখন, তখন হয়তো অভয়দের কোনও আত্মীয় হবেন। কিন্তু শুখানালায় তাদের কোনও আত্মীয় আছেন বলে সে শোনেনি। তার দাদুর আমলেই এখানকার বাস উঠে যায়।

অভয় অতশত ভাবল না। বস্তুত ভেবে তার লাভও নেই। সামনে যদি বিপদ থেকে থাকে, পেছনেও বিপদ। বিপদের অভাব যখন নেই তখন বিপদের সঙ্গে ভাব করে ফেলাই ভাল।

লাঠিটা বাগিয়ে বীরদর্পে অভয় সামনে এগোতে লাগল। একটু বাদেই বুঝল, এটা শুখানালাই বটে। কোমরসমান গভীর এবং হাতচারেক মাত্র চওড়া নালাটায় অবশ্য এখন উদ্ভিদ ভরে আছে।

এগোন শক্ত। বেশ বাঁক খেয়ে-খেয়ে খাতটা কোথায় যে গেছে, তা বোঝা যাচ্ছে না।

অভয় বনের শোভা দেখতে-দেখতে আনমনে এগোচ্ছে। কিছু খারাপ লাগছে না তার। হাতের লাঠিগাছ দিয়ে মাঝে-মাঝে সমুখের জঙ্গল ভাঙছে। শীতের রোদ ক্রমে ক্রমে মরে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার নামতে আর দেরি নেই।

হঠাৎ অভয় উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এ কী! সামনে থেকে কলকল করে জলের আওয়াজ আসছে নাকি? না, কোনও ভুল নেই। শুখানালার শুকনো খাতে তীরবেগে এক জলস্রোত ছুটে আসছে যেন! প্রথমে দূরে শোনা যাচ্ছিল। দ্যাখ না-দ্যাখ শব্দটা কাছে চলে এল। প্রলয়ঙ্কর এক জলস্রোত মেল ট্রেনের মতো এসে পড়ল যে!

অভয় আর দেরি না করে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে পাড়ে উঠে পড়ল। তারপর সম্পূর্ণ বোকা বনে চেয়ে দেখল, এক ফোঁটাও জল নেই, কিন্তু জলের স্রোতের শব্দ ভীমবেগে বয়ে যাচ্ছে। সে চোখ কচলাল, ভাল করে দেখল। না, কোথায় জল? কিন্তু শব্দটায় কোনও ভুল নেই।

মিনিট পাঁচেক পর শব্দটা বন্ধ হয়ে বনভূমি আবার নির্জন হয়ে গেল। ভয় পাবে কিনা তা বুঝতে পারছিল না অভয়। ভয় পাওয়াই বোধ হয় উচিত।

তবে কিনা দুদিন ধরে সে এত ভয়ের মধ্যে আছে যে, নতুন করে আরও ভয় পাওয়া একটু কঠিন। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের লাঠিটা কয়েকবার নীরবে আস্ফালন করে খাতের ধার ধরে ধরে হাঁটতে লাগল।

আচমকাই ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে ফের তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। কারা ওরকম হুঙ্কারে তেড়ে আসছে ঘোড়ায় চেপে? কয়েকশো ঘোড়ার ছুটন্ত খুরের আওয়াজ আর সেইসঙ্গে মানুষের রণং দেহি চিৎকার দূর থেকে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে তারই দিকে। হাতের লাঠিটার দিকে কাতরভাবে একবার তাকাল অভয়। একটু আগেই সে “কে আসবি আয়” বলে খুব বীরত্ব দেখিয়েছিল। এখন সেটা বেবাক ভুলে গিয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইল বোকার মতো। কারা আসছে তা এখনও দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু এল বলে। অভয় লাঠি ফেলে সভয়ে পাশের একটা ঝুপসি গাছে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে পড়ল। জীবনে গাছে ওঠেনি সে, গাছ বাইতে জানেও না। কিন্তু প্রাণের দায়ে যতটা পারে ওপরদিকে উঠে একটা বেশ লতাপাতার আড়াল দেখে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসল। ওদিকে সৈন্য-সামন্তরা তেড়ে আসছে। ঘোড়ার ডাক, রণহুঙ্কার এবং অস্ত্রের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে ঘোড়ার পায়ের খটাখট শব্দ।

অভয় চোখ পলকহীন করে চেয়ে রইল নীচের দিকে। ঘোড়ার লেজটুকু বা মানুষের একটা মাথাও তার নজরে পড়ল না। অথচ বনভূমি প্রকম্পিত করে তার গাছের তলা দিয়ে এবং আশপাশ দিয়ে ওই ভয়ঙ্কর শব্দ বয়ে গেল খানিকক্ষণ ধরে। তারপর আবার সব চুপচাপ। নির্জন। শান্ত।

অভয় টপ করে নামল না। বুদ্ধিটা কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। চোখেও কি কম দেখছে আজকাল? খানিকক্ষণ বসে দম নিয়ে সে আবার ধীরেসুস্থে গাছ থেকে নেমে তার লাঠিগাছ কুড়িয়ে নিল।

জঙ্গলের মধ্যে এখন অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। একটু বাদেই ঘুটঘুটি হয়ে যাবে। অভয় আর এগোবে কিনা ভাবতে-ভাবতে এগনোই সাব্যস্ত করল। পিছিয়ে লাভ নেই। তার খোঁজে খুনিরা এসে পড়েছে। পেছনে জানা বিপদ, সামনে অজানা বিপদ। এগনোই ভাল।

দুপাও ভাল করে এগোয়নি অভয়, অমনই হঠাৎ তাকে আপাদমস্তক শিউরে দিয়ে সামনেই ধাঁধাঁ করে একটা আগুনের শিখা মাটি থেকে উঠে খাড়া হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেল। এরকম সোজা আর লম্বা আগুন জীবনে দেখেনি অভয়। অন্তত বিশ হাত উঁচু হয়ে লকলক করছে। চারদিক সেই আগুনের হলকায় একেবারে রাঙা হয়ে গেল। অভয়ের অবশ্য হাত থেকে লাঠিটা খসে পড়ে গেল মাটিতে। মুখটা এমন হাঁ হয়ে গেল তার যে, একটা ছোটখাটো এরোপ্লেন ঢুকে যেতে পারে।

কিন্তু অভয় ভয় পেতে-পেতে ভয় থেকেই খানিক শিক্ষা নিয়েছে। কাজেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে হাঁ বুজিয়ে ফেলতে পারল এবং লাঠিটাও কুড়িয়ে নিল। সামনে আগুনের শিখা তখন কোমর দুলিয়ে-দুলিয়ে নাচছে। বেশ একটা হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে সরু শিখার সর্বাঙ্গে। অভয় চোখ চেয়ে আগুনের নাচ কিছুক্ষণ দেখল। তারপর হঠাৎ সে এক দুঃসাহসী কাণ্ড করে বসল। হাততালি দিয়ে বেশ হেঁকে বলে উঠল, “বাঃ, সুন্দর নাচ নেচেছ তো বাপু!”

অমনই দপ করে আগুনের শিখা মিলিয়ে গেল। চারদিকে নেমে এল ঘুটঘুটি অন্ধকার। জোনাকি পোকা জ্বলতে লাগল। ঝিঝি ডাকতে লাগল। গাছে-গাছে পাখিদের তীব্র ঝগড়া, কাজিয়া চলতে লাগল। শেয়াল ডাকল দূরে। একটা অট্টহাসির মতো শব্দও শোনা গেল। বোধ হয় সেটা হায়েনার ডাক।

কাণ্ডগুলো যে ভুতুড়ে, তাতে অভয়ের সন্দেহ নেই। তবে ভয়ের ব্যাপারে মানুষ আর ভূত দুই-ই তার কাছে একাকার। ভূতে মারলেও মারবে, মানুষে মারলেও মারবে। সমুদ্রে শয়ান যার, শিশিরে কী ভয় তার? বরং তার মনে হল এখন ভূতটুতকে ভয় খাওয়া তার পক্ষে এক বাবুগিরি বা শৌখিনতার জিনিস। ওসব যারা সুখে আছে তাদেরই মানায়। তার মতো প্রাণ-হাতে করা মানুষের কি ভূতের ভয় খেয়ে থেমে থাকলে চলে?

অভয় সুতরাং খানিকটা ভয়ে এবং খানিকটা অকুতোভয়ে এগোতে লাগল। সামনে যম-অন্ধকার, জঙ্গল, আঘাটা, কিন্তু হাতে লাঠি বাগিয়ে অভয় দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়েই যেতে থাকল। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না, আমি কাউকে ভয় খাই না। আয় না ব্যাটা কে আসবি! আয় না!”

হঠাৎ ফের উৎকর্ণ হতে হল অভয়কে। বহুদূরে কে একজন যেন বলে উঠল, “গায়।”

শোনার ভুলই হবে। এ জঙ্গলে কে কার গানের কথা বলবে? কিন্তু ফের কে যেন বলে উঠল, “খায়।”

খায়! অভয় মাথা নাড়ল, এ তো হতে পারে না। কে খায়? কী খায়? খাওয়ার কথা ওঠে কেন?

আবার আবছা সেই স্বরটা শোনা গেল, “যায়।” যায়? উঁহু, এটারও তো কোনও অর্থ হচ্ছে না। এর মানে की १

অভয় দ্রুত হাঁটতে লাগল। পায়ের নীচে এখন ঘাস ছাড়া আর বিশেষ কোনও বাধা নেই। ঝোঁপঝাড়ও যেন কম। আর নালার

পাশে বড় গাছও বিশেষ নেই যে, ধাক্কা খাবে।

খানিকটা এগনোর পর হঠাৎ এবার গলার স্বরটা বেশ স্পষ্টই শুনতে পায় অভয়। গায়, খায় বা যায় নয়। তবে কি হয়? না, তাও নয়। বহুদূর থেকে কে যেন করুণ স্বরে ধীরে-ধীরে ডাকছে, “আয়… আয়… আয়… আয়…”

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল অভয়ের। শরীরে একটা শীতল শিহরন বয়ে গেল। এরকম করুশ, কান্নায় ভরা, অপার্থিব কণ্ঠস্বর সে কখনও শোনেনি। তার মনে হল, এ স্বর বহুঁকাল ধরে ক্রমান্বয়ে কাউকে যেন ডেকে চলেছে, ডেকেই চলেছে, “আয়… আয়… আয়… আয়…”

অভয় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পায়ে যেন পাথর বাঁধা, বুকটা ধকধক করছে। আর এগনো কি ঠিক হবে! তার মনে হচ্ছে সে যেন এক মহাভয়, মহাসর্বনাশ, মহাশোকের সমুদ্রের খুব কাছাকাছি এসে গেছে। ওই শোক-সমুদ্রের ঢেউই যেন অনাদিকালের বিরহ বুকে নিয়ে ক্রমান্বয়ে নিরবধি ডেকে চলেছে, “আয়… আয়… আয়.. আয়…”

অভয় হাতের লাঠিটা বড় জোরে চেপে ধরেছিল নিজের অজান্তেই। আঙুলগুলো টনটন করে ওঠায় তার খেয়াল হল। মুঠোটা একটু আলগা করল সে। শরীরটাও আড়ষ্ট, শক্ত হয়ে গিয়েছিল। শরীরও এবার সহজ হল। অভয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকভরে শ্বাস নিল। তারপর লাঠিটা মাটিতে কয়েকবার ঠুকে নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “কাউকে না, আমি কাউকে ভয় খাই না। আয় না ব্যাটা কে আসবি।” এই বলে সে এগোতে লাগল। বুক কাঁপছে, পা কাঁপছে। তবু অভয় থামল না।

টেনে-টেনে দীর্ঘ করুণ স্বরে কে যেন কাকে ডেকেই চলেছে, “আয়… আয়… আয় আয়।” বিরামহীন। বিরক্তিহীন।

অভয় হাঁটতে লাগল। হাঁটতেই লাগল। রাত গাঢ় হল। গাছে-গাছে পাখিদের ঝগড়া থেমে গেছে অনেকক্ষণ। চারদিক বড় নিঝুম। ঝিঝির ডাক, নিজের পায়ের শব্দ আর সামনে ওই ক্ষীণ “আয়… আয়…” ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

হঠাৎ বনে মর্মরধ্বনি তুলে এই শীতের কুয়াশামাখা রহস্যময় রাতে একটা দমকা বাতাস বয়ে গেল। শুকনো পাতা গড়িয়ে গেল বনময়। কোনও জঙ্গুলে ফুলের মোহময় গন্ধ ছড়াল হঠাৎ। আর তারপরেই অভয় একটা পেল্লায় হোঁচট খেয়ে পড়তে-পড়তে সামলে গেল।

অন্ধকারেও সে টের পেল, তার সামনে একটা বাধা।

হাতড়ে-হাতড়ে সে বুঝতে পারল, একটা পাথর বা সিমেন্টের থাম বা ওই জাতীয় কিছু। সেটা ডিঙিয়ে অভয় যেখানে পা দিল সেটা আগাছায় ভরা বটে, কিন্তু পায়ের তলায় ইট-সুরকি, পাথরের টুকরো, লোহার বিম, কাঠের বরগা ইত্যাদির একটা বিরাট ধ্বংসস্তূপ। টিলার মতো উঁচু সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে লাগল অভয়। এখন সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল, মাটির গভীর থেকে কে যেন ডাকছে, “আয়… আয়… আয়… আয়…”

অভয় ধীরে-ধীরে ধ্বংসস্তূপের ওপরে উঠে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সেই “আয় আয়…” শব্দটা স্তব্ধ হয়ে গেল। আর তারপরেই চারদিকে যেন মৃদু একটা ঘূর্ণিঝড় উঠল। তার সঙ্গে উঠল গাছে-গাছে মরধ্বনি। পাখিরা ঘুম ভেঙে ডেকে উঠল। তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। পায়ের নীচে মাটিটা কি একটু দুলে উঠল? কে জানে! কিন্তু এটা স্পষ্ট টের পেল অভয়, ধ্বংসস্তূপে এতকাল যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা ছিল। সে এসে দাঁড়ানোর পর হঠাৎ সেই চাপা দীর্ঘশ্বাসটা বহুঁকাল পরে মুক্তি পেয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

অন্ধকারে চারদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবু অভয়ের স্পষ্ট মনে হল, এই তার পূর্বপুরুষের ভিটে। শুখানালার সরকারবাড়ি। মন্ত বাড়ি ছিল একসময়ে, পাইকবরকন্দাজ ছিল, মস্ত আস্তাবল ছিল, অনেক কিছু ছিল। সেই বাড়িতে বহুঁকাল পর একজন বংশধর ফিরে এসেছে। অভয় শীতে অন্ধকারে অনিশ্চিত অবস্থায় দাঁড়িয়েও আপনমনে একটু হাসল, তারপর মাটিতে লাঠিটা ঠুকে বলল, “এটা আমার বাড়ি। বুঝলে সবাই? এটা আমার বাড়ি।”

একথা শুনে একটা তক্ষক ডেকে উঠল, “ঠিক ঠিক।”