খাদের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল জেনারেল। নিচে তাকাল কিশোর। খাদটা তেমন গভীর নয় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে ওইটুকু লাফিয়ে পড়েও আহত হতে পারে ইউনিকর্ন। খাদের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে রুপালি সাপের মত চলে গেছে নদী।
জেনারেলের পিঠ থেকে নেমে একটা গাছের সঙ্গে বাঁধল ওকে কিশোর। টর্চ জ্বেলে নামতে লাগল খাদের ঢাল বেয়ে। নদীর পারে এসে ইউনিকর্নের চিহ্ন খুঁজতে লাগল। কিন্তু কিছুই পেল না।
কান পেতে খুরের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। শুনতে পেল না। ইউনিকর্ন কি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? তারপর ভাটি অথবা উজানে গিয়ে উঠে পড়েছে ডাঙায়? ওর পিঠের আরোহী ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে?
দুই দিকেই টর্চের আলো ফেলে দেখল সে। শেষে হতাশ হয়ে উঠে এল। আবার ওপরে। জেনারেলকে খুলে নিয়ে ফিরে চলল র্যাঞ্চে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলোর কথা ভাবছে।
বনের কিনারে যেখানে রেখে এসেছিল লুক বোলানকে, সেখানেই রয়েছে। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে ব্রড় জেসন। কিশোরকে দেখে এগিয়ে এল। যাক, এসেছ। তোমার পিছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ধরতে পারলাম না। ইউনিক কোথায়?
হারিয়ে ফেলেছি। কি করে খাদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে। ইউনিকর্ন, খুলে বলল কিশোর।
হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল লুক। আজ আর কিছু করার নেই। অন্ধকারে পাব না। কাল দিনের বেলা খুঁজতে বেরোতে হবে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল, পরের বার এসব ব্যাপারে তুমি নাক গলাতে আসবে না। আমাদের কাজ আমাদের করতে দেবে।
লিলি আমাকে সাহায্য করতে বলেছে, গম্ভীর গলায় জানিয়ে দিল কিশোর।
বিড়বিড় করে কি সব বলতে বলতে গিয়ে গাড়িতে উঠল লুক। মোটামুটি যা বুঝতে পারল কিশোর তা হলো, এসব অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমস্যা। এদেরকে কিছু বোঝানো যায় না। নিজের ভালমন্দ বোঝে না।
ব্রডের পাশাপাশি র্যাঞ্চে ফিরে চলল কিশোর।
একসময় জিজ্ঞেস করল ব্রঙকে, আপনার সামনেই আস্তাবল থেকে পালিয়েছে ঘোড়াটা?
না।
আমি মনে করলাম…
বাধা দিয়ে ব্রড বলল, লাথি মেরে ফেলে দিল আমাকে। জখমটা দেখার জন্যে ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। আমি ওখানে থাকতেই পালাল ওটা।
তার মানে আপনি পালাতে দেখেননি?
কৌতূহল ফুটল ব্রডের চোখে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, না, তা দেখিনি।
অন্য কেউ দেখেছে?
বলতে পারব না। কেন?
না, ভাবছি, কেউ ওটাকে চালিয়ে নিয়ে গেল কিনা।
ইউনিকর্নকে? হেসে ফেলল ব্রড। অসম্ভব। ওর পিঠে কোন মানুষ চড়তে পারে না।
সে কথা আমিও শুনেছি। আবার ভাবনায় ডুবে গেল কিশোর।
চত্বরে ঢুকে ব্রড় বলল, দাও, জেনারেলকে আমিই রেখে আসি।
লাগবে না, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর। ও এখন আমার দায়িত্বে আছে। আমিই দেখাশোনা করতে পারব। বহুবার বহু র্যাঞ্চে বেড়াতে গেছি। ঘোড়া। আমার অপরিচিত নয়।
শ্রাগ করল ব্রড। বেশ, যা ভাল বোঝে। মেহমানদের কথা আমাদেরকে রাখতেই হয়। তবে লুক যা বলেছে, মনে রেখ… উত্তেজিত ঘোড়ার পদশব্দ শুনে চুপ হয়ে গেল সে। আস্তাবলের দিকে তাকাল। আবার কি হল?
ব্রডের পিছু পিছু এগোল কিশোর। আস্তাবলে ঢুকল। আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পুরানো বাড়ির ভেতরটা। হারিকেনকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কয়েকজন। শ্রমিক।
কি হয়েছে ওর? জিজ্ঞেস করল ব্রড।
বুঝতে পারছি না, বলল একজন চোয়াড়ে চেহারার ব্র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। মনে হচ্ছে। লুকের কথাই ঠিক। বদ রক্ত বেটাদের শরীরে।
কথাটা মানতে পারল না কিশোর। কিছু বলল না।
এই থাম, থাম, চুপ কর, মোলায়েম গলায় ঘোড়াটাকে বলল ব্রড়। ধীরে ধীরে ঢুকল স্টলের ভেতর।
সেই যে খেপেছে আর থামছে না, জানাল র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড।
এরকম করছে কেন বুঝতে পারছি না! অবাকই হয়েছে ব্রড।
লাথি মেরে মেরে খড় ছিটাচ্ছে হারিকেন।
খারাপ কিছু খেয়ে ফেলেছে বোধহয়, বলল কিশোর। ক্ষতি হয় এরকম কিছু।
ঝট করে তিনজোড়া চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। হতেই পারে না! বলল একজন, ঘোড়াকে খাওয়ানো হয় সব চেয়ে ভাল আর দামি খাবার, ঘোড়ার জন্যে যা পাওয়া যায়। নিজের হাতে খাওয়াই আমরা।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু হারিকেনের এই মেজাজের তো একটা ব্যাখ্যা থাকবে?
আছে, আরেকজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড বলল, বরক্ত। আর কোন কারণ নেই।
রাতারাতি ঘোড়ার স্বভাব বদলে যেতে পারে না।
তা পারে না, ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে ব্রড। তবে। একেবারেই ঘটে না এটা ঠিক নয়।
হয়ত ওর খাবারে কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়েছে, বলল আবার কিশোর।
এই র্যাঞ্চের কেউই কোন ঘোড়ার সামান্যতম ক্ষতি করবে না, জোর দিয়ে কথাটা বলল ব্রড। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, লাথি মেরে থামিয়ে দিল হারিকেন।– ঠিকমত লাগেনি, সামান্য একটু ছুঁয়ে চলে গেল লাথিটা। সরে গেল সে। পরিষ্কার দেখতে পেল এবার কিশোর ঘোড়ার ডান খুরের ওপরে সাদা লোম।
ও যে একেবারে ইউনিকর্নের মত আচরণ করছে! বলল আরেকজন শ্রমিক।
আরে দূর, কি যে বলো, হাত নেড়ে বলল অন্য আরেকজন। ইউনিকর্ন। হ। ইউনিকর্ন যখন শান্ত থাকে তখনই এরকম শয়তানী করে।
এই, অত বকর বকর করো না, ধমক দিয়ে বলল ব্রড। কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের কাজ করতে হবে। লুক তোমাকে বলল না ঘোড়াটোড়া নিয়ে অত মাথা ঘামাবে না? আমাদের কাজ আমাদের করতে দাও।
কথা কানেই তুলল না কিশোর। রহস্যময় ঘটনাই ঘটছে, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই তার।
এর সমাধান করতেই হবে। সোজা এগিয়ে গেল ইউনিকর্নের স্টলের দিকে। ওটা খালি। লাথি মেরে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে খড়। ভেঙে ফেলা হয়েছে একটা স্টলের দরজা। ভাঙা কাঠে লেগে রয়েছে কালো কয়েকটা লোম, ঘোড়ার লোম। নাল পরান খুরের দাগ পড়েছে কয়েক জায়গায়। তবে যে বাক্সটায় খাবার। দেয়া হয় সেটা ঠিকই আছে দেখা যাচ্ছে। খড়, একটা ফিড ব্যাগ, একটা পানির বালতি, আর অর্ধেক খাওয়া একটা আপেল।
সব কিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারল না কিশোর। তাড়াতাড়ি রওনা হলো জেনারেল উইলি কেমন আছে দেখার জন্যে।
দিগন্তের দিকে হেলে পড়ছে চাঁদ। ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে মুখে। অবাক হয়ে ভাবছে, কেন ওরকম খারাপ হয়ে গেল একটা ঘোড়া? কি কারণে হতে পারে? অসুখ-টসুখ করেছে? নাকি কেউ আতঙ্কিত করে দিয়েছে হারিকেনকে।
ভালই আছে জেনারেল। ঘরে চলল কিশোর।
রান্নাঘরের দরজা ঠেলে খুলে দেখল টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে রবিন, মুসা, লিলি আর কেরোলিন। ওকে দেখে হাসল সবাই। রবিন বলল, এতক্ষণে এলে।
লিলিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার তো এখন শুয়ে থাকার কথা?
ঠিক বলেছ, সুর মেলালেন কেরোলিন। ডাক্তার কাপলিং জানলে রেগে। যাবেন।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল লিলি। সবই বুঝি, কিন্তু বিছানায় থাকতে যে ইচ্ছে করে না!ইউনিকর্নকে ছাড়া রেখে কি ঘুম আসে? উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকাল সে। টেবিলে রাখা চায়ের কাপটা তুলল, হাত কাঁপছে। কিশোরকে বলল, এইমাত্র এসেছিল লুক। বলল, তুমি নাকি ইউনিকের। পিছু নিয়ে বনে ঢুকেছিলে। খাদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে গায়েব হয়ে গেছে ও।
সে রকমই মনে হলো, একটা চেয়ার টেনে বসল কিশোর। কি কি করে। এসেছে বলতে লাগল। বলা শেষে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য করল লিলিকে। নিজেও গেল সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে কম্বলে গা ঢেকে লিলি বলল, কি বলে যে ধন্যবাদ দেব। তোমাকে…
শেষ করতে দিল না ওকে কিশোর, কি আর দেবেন? ধন্যবাদ পাওয়ার কাজ এখনও তো করতেই পারলাম না। ইউনিককে হারানো উচিত হয়নি আমার।
ওকে খুঁজে বের করবই আমরা, ফিসফিস করে নিজেকেই যেন বলল লিলি। করতেই হবে।
নিজের ঘরে ফিরে এল কিশোর। অনেকক্ষণ ধরে গরম পানি দিয়ে গোসল করে ক্লান্তি অনেকটা দূর করে এসে ঢুকল রবিন আর মুসার ঘরে।
ওরা তখনও ঘুমায়নি।
কি ব্যাপার? ঘুম আসছে না? জিজ্ঞেস করল রবিন।
তোমরাও তো জেগে আছ।
তা আছি, হাই তুলল মুসা। আর বেশিক্ষণ থাকব না। তা কি ভেবে আবার এলে?,
এলাম। মনে উত্তেজনা থাকলে ঘুম আসতে চায় না তো, তাই…
তা বটে। ও, হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম, রবিন বলল, তুমি যাওয়ার পর ফিলিপ নিরেক ফোন করেছিল। লিলিকে চেয়েছিল। ওকে কি বলল সে জানি না, তবে মুখ কালো হয়ে যেতে দেখলাম লিলির। কি হয়েছে, জিজ্ঞেস করেছি, বলল না। বলল, ও কিছু না। শুধু বলল, আগামী দিন পাইককে নিয়ে নিরেক এখানে আসবে কথা বলতে।
আরও খবর আছে, চোখ নাচিয়ে বলল মুসা।
তার মানে তোমরাও বসে থাকোনি, খুশি হয়ে বলল কিশোর। কি খবর?
কেরোলিনের আন্টির সঙ্গে অনেক কথা বলেছি আমি, রান্নাঘরে, মুসা বলল। ব্রড জেসন নাকি মহিলার বোনের ছেলে।
তাতে কি? রবিনের প্রশ্ন।
গাল চুলকাল মুসা। হয়তো কিছুই না। কিন্তু ডবসি কুপারের ওখানে কাজ করে এসে যদি আবার এখানে ঢোকে, খটকা লাগে না মনে? শুরু থেকেই তো ওর খালা ছিল এখানে, তখন ঢুকল না কেন?
হ্যাঁ, সত্যি খটকা লাগে, মুসার সঙ্গে একমত হয়ে বলল কিশোর।
কেরোলিনের আন্টি আরও বলেছেন, নিজের আঙুলের নখ দেখতে দেখতে বলল মুসা, কিছু দিন ধরেই নাকি অদ্ভুত আচরণ করছে ঘোড়াগুলো।
শুধু ঘোড়াই না, কিছু কিছু শ্রমিকও করছে, হাই তুলল কিশোর। এমন ভাব করছে, বোঝানর চেষ্টা করছে, যেন এক রাতেই নষ্ট হয়ে গেছে হারিকেন। ওদের এই কথা মানতে রাজি নই আমি। এবং ওরা যে ভুল করছে এটা প্রমাণ করে ছাড়ব।
.
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। কোরালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দেখতে লাগল ব্রডের কাজ। একটা ঘোড়ার বাচ্চাকে আরোহী নিতে শেখাচ্ছে। পিঠ বাঁকিয়ে, নেচেকুদে, ঝাড়া দিয়ে অনেক চেষ্টা করছে ঘোড়াটা ওকে পিঠ থেকে ফেলার, পারছে না।
কয়েক বছর আগে ব্রড ব্রংকো রাইডার ছিল, মুসা বলল। কিছু কিছু লোকাল রোডিওতে ফার্স্ট প্রাইজও পেয়েছে। কেরোলিন আন্টি বলেছেন আমাকে।
ছেড়ে এল কেন? জানতে চাইল কিশোর।
বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। জানার চেষ্টা করব নাকি?
কর। আস্তাবলের দিকে তাকাল কিশোর। ওখানে ঢুকে তদন্ত করে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন গিয়ে সুবিধে করতে পারবে না। অনেক লোক কাজ করছে ভেতরে বাইরে। ইউনিকনের স্টলে তদন্ত করতে হলে একা একা গিয়ে করতে হবে। কাউকে দেখান চলবে না। লুক আর জন গিয়ে ইউনিককে পেল কিনা কে জানে।
এই সময় দেখল লম্বা পাওয়ালা একটা মাদী ঘোড়ার পিঠে চেপে আসছে বেনি কুপার।
ব্রডের দিকে হাত নেড়ে ঘোড়া থেকে নামল বেনি। লাগামটা বাঁধল বেড়ায়। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?
ঘরে।
গিয়ে ওকে বলা দরকার, ইউনিকর্নকে দেখেছে আব্ব।
কোথায়? একসাথে জিজ্ঞেস করল তিন গোয়েন্দা।
আজ সকালে, আমাদের র্যাঞ্চের পশ্চিম ধারে। পাহাড়ে চলেছিল আব্বা তখন।
ও পালিয়েছে জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ব্রডের দিকে তাকাল বেনি। কিশোরের দিকে ফিরে বলল, লুক বোলান ফোন করেছিল। ইউনিকর্নই কিনা শিওর না আব্বা, তবে ওরকমই, কালো, বিরাট একটা ঘোড়া।
চলো, রবিন আর মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর।
গিয়ে কি করবে? ব্রড বলল, কয়েকজনকে নিয়ে লুক চলে গেছে অনেক আগেই।
আরও কয়েকজন গিয়ে খুঁজলে ক্ষতি হবে না।
কপালের ঘাম মুছল ব্রড। চলো, আমিও যাব।
তুমি থাক না? বেনি অনুরোধ করল।
দ্বিধায় পড়ে গেল ব্রড। ইতস্তত করে বলল, না, যাওয়াই উচিত। হাজার হলেও এই র্যাঞ্চে চাকরি করি আমি, যাওয়াটা আমার দায়িত্ব।
মিনিট বিশেক পরে পশ্চিমে কুপারদের র্যাঞ্চের দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোর, মুসা আর ব্রড। কুপার র্যাঞ্চের পশ্চিমের পাহাড়ে কয়েক ঘন্টা ধরে খুঁজেও পেল না ঘোড়াটাকে। হাল ছেড়ে দিয়ে ব্রড বলল, বুঝতে পারছি না। গেল কোথায়?
সীমাহীন পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। যে দিকেই তাকায়। সেদিকেই ঘন বন। এরকম জায়গায় সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে একটা ঘোড়া। মিস্টার কুপারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ওসব করতে যেও না, তাড়াতাড়ি বলল ব্রড। যা করার লিলিই করবে।
কেন, আমি করলে দোষ কি?
অস্বস্তিতে পড়ে গেছে যেন ব্রড। চোয়াল ডলল। তারপর বলল, কয়েক বছর ধরেই দুটো র্যাঞ্চের সম্পর্ক খারাপ। ডাবল সির কোন মেহমান গিয়ে কথা বলবে, এটা নিশ্চয় ভাল চোখে দেখবেন না মিস্টার কুপার। পারলে লিলি কিংবা লুক গিয়ে বলুকগে, তোমার দরকার নেই।
র্যাঞ্চে ফিরে এল ওরা। লুক ফিরছে। ইউনিকর্নকে আনতে পারেনি। কুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে আগেই, বেনি যা বলেছে মিস্টার কুপারও একই কথা বলেছে।
লুককে বলল ব্রড, কিশোর মিস্টার কুপারের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
শক্ত হয়ে গেল লুকের ঠোঁট। দেখো, কিশোর, তুমি সাহায্য করতে চাইছ বুঝতে পারছি, কিন্তু এটা তোমার কাজ নয়। আমার। কাজেই যা কিছু করার দায়িত্ব আমারই। লিলির আব্বা মরার সময় আমাকে এ-দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আরেকটা কথা, আমি চাই না, এখানে যে গোলমাল হচ্ছে এটা কুপার জেনে ফেলুক।
কেন?
তাহলে পেয়ে বসবে। আমাদের এখানে গোলমাল আছে শুনলে ঘাবড়ে যাবে মেহমানরা, থাকতে চাইবে না। কুপারের র্যাঞ্চে গিয়ে উঠবে। এটা হতে দিতে পারি না আমরা।
কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে বাঙ্কহাউসের দিকে রওনা হয়ে গেল লুক।
.
সেদিন বিকেলে ডাক্তারের আদেশ অমান্য করে নিচে নেমে এল লিলি। ঠিকমত পা ফেলতে পারে না, শক্ত হয়ে গেছে যেন জোড়াগুলো। ক্লান্তি আর উল্কণ্ঠায় চেহারা ফেকাসে। তবে আগের রাতের তুলনায় ভালই মনে হচ্ছে তাকে।
চলো, বারান্দায় বসে লেমোনেড খাই, তিন গোয়েন্দাকে প্রস্তাব দিল সে। বিছানায় আর যেতে পারব না।
বারান্দায় চেয়ার পেতে বসল চারজনে। গ্লাসে কয়েকবার চুমুক দিয়ে মুখ ফেরাল লিলি। বলল, শেরিফকে ফোন করে ইউনিকের কথা বলতে হবে। কারও চোখে পড়লেই তাহলে খোঁজ পেয়ে যাব আমরা।
যদি সেই লোকটা গিয়ে শেরিফকে বলে, কিশোর বলল। ডবসি কুপারের সঙ্গে কথা বলেছেন?
বলেছি। তবে আমার মনে হয় না ইউনিককে দেখেছ। কিশোরের চোখ দেখেই যেন তার মনের কথা পড়ে ফেলল লিলি, মাথা নেড়ে বলল, না না, যা ভাবছ তা নয়। মিথ্যে বলেনি। তবে যেটাকে দেখেছে সেটা ইউনিক নয়, হয়তো কোন বুনো মাসট্যাংকে দেখেছে।
নাহ, কোন আলো দেখতে পাচ্ছি না, বিড়বিড় করে বলল রবিন। ইঞ্জিনের শব্দ শুনে তাকাল রাস্তার দিকে। ওইযে আসছে, আরও গোলমাল!
লম্বা সাদা একটা গাড়িকে আসতে দেখা গেল। ছুটে এসে বারান্দার কয়েক ফুট দূরে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। গাড়িটা দেখেই লিলির চেহারা আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
দরজা খুলে নামল ফিলিপ নিরেক আর হারনি পাইক। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল একজনের পেছনে আরেকজন।
লিলির সঙ্গে কথা বলার আগে কিশোরদের দিকে তাকিয়ে নিল একবার নিরেক, সুস্থ হয়ে গেছ নাকি।
অনেকটা, লিলি বলল।
নিরেকের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাইক। স্টেটসন হ্যাঁটের কানাটা যেন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর তার বন্ধুদের দিকে, চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি। কত হলে জায়গাটা কিনতে পারব, শোনা যাক, জ্যাকেটের পকেট থেকে চেক বই বের করল সে। একলা কোথাও কথা বলা যাবে?
লিলিকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে সে, বুঝতে পারল লিলি। বলল, দরকার হবে না। আমার কোন আগ্রহ নেই।
কঠিন হয়ে গেল পাইকের চোয়াল। কিন্তু দামটা এখনও শোনইনি।
শুনতে চাইও না, চাঁছাছোলা জবাব দিল লিলি। এটা আমার বাপ-দাদার জায়গা, কোন কিছুর বিনিময়েই কারও কাছে বেচব না, যত দামই দিক না কেন।
কাজটা কিন্তু ঠিক করছ না, হুমকি দেয়ার ভঙ্গিতে বলল নিরেক।
উঠে দাঁড়াল লিলি। আপনাকে আমি বলেছি, ব্যাংকের ধার আমি শোধ করে দেব। সময় শেষ হয়নি, এখনই চাপাচাপি করছেন কেন? যান, জুলাইর পাঁচ তারিখে দিয়ে দেব।
কি করে দেবে? ঘোড়ায় চড়ার অবস্থা আছে নাকি তোমার?
আজ নেই, তবে যেদিন দরকার সেদিন ঠিকই থাকবে, সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, রেগে গেল লিলি। চোখ থাকলেই দেখতে পাবেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে। কঠোর কণ্ঠে নিতান্ত অভদ্র ভাবেই বলল, যান, বেরিয়ে যান আমার বাড়ি থেকে! এক্ষুণি!