খাওয়ার সময় সেনসায়েব সবিস্তারে ঘটনাটা বর্ণনা করেছিলেন। তাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সুদেষ্ণার মতে, পাহাড় থেকে পাথর খসে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কদিন বেশ জোরালো বৃষ্টি হয়েছে। ধস ছেড়ে রেললাইন যখন চাপা পড়েছে, তখন এমন ঘটনা রুহা প্রপাত এলাকায় ঘটতেই পারে।
সেনসায়েব বলেছিলেন, যাই হোক। আমি আর ওখানে স্নান করতে যাচ্ছি না!
এদিকে তন্ময় ও সৌমিত্র লাখানপুর থেকে এখনও ফিরছে না। সেনসায়েব সেজন্যও উদ্বিগ্ন। তিনি আমাদের বিশ্রাম করতে বলে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। সুদেষ্ণা ও বনশ্রী তখনও খায়নি। তারা তন্ময়দের জন্য আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে চায়। বেলা দেড়টা বাজে। কর্নেল ও আমি নিজেদের ঘরে ফিরে ভেতরের দরজা আটকে দিলাম। আমার ভাত-ঘুমের অভ্যাস। বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। কর্নেল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চুরুট ধরালেন, এবং অভ্যাসমতো চোখ বুজে ধ্যান হলেন।
সবে আমার চোখের পাতায় ঘুমের টান লেগেছে, কর্নেল ডাকলেন, জয়ন্ত!
ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বললাম, বলুন না। শুনতে পাচ্ছি।
উঠে পড়ো!
কেন?
এখনই বেরুতে হবে।
বেশ তো! বেরিয়ে পড়ুন।
তুমিও বেরুবে।
কী বিপদ।
হ্যাঁ। বিপদের সম্ভাবনা তো আছেই। সেইজন্য তোমাকে সঙ্গে নিতে চাই। ওঠ। কুইক!
অগত্যা উঠতে হলো। বললাম, তার মানে, আমি আপনার বডিগার্ড হয়ে থাকব?
কর্নেল হাসলেন। কতকটা তা-ই। যাই হোক, ঝটপট পোশাক বদলে ফেলো। বলে উনি কিটব্যাগ পিঠের দিকে আটকে নিলেন। বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা বুকের ওপর ঝুলিয়ে দিলেন। তারপর বারান্দায় গেলেন।
পোশাক বদলে বেরিয়ে পড়লাম। বারান্দার দিকের দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। পোর্টিকোর সামনে দিয়ে ঘুরে উত্তরে গেটের কাছে যেতেই সেই পালোয়ান এসে সেলাম ঠুকল। তারপর গেটের তালা খুলে দিল।
রাস্তায় গিয়ে বললাম, সেনসায়েব হঠাৎ যেন বড্ড বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছেন।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু নিজের সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার চেয়ে এই বাড়ি সম্পর্কে উনি বেশি সতর্ক। বারান্দা থেকে দেখছিলাম, রাম সিং যেন পাহারা দেওয়ার ভঙ্গিতে দক্ষিণের পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সেনসায়েব প্রপাত থেকে স্নান করে ফেরার পর এই সতর্কতা। এমন হতে পারে, প্রপাতে স্নান করার পর পাথর খসে পড়া ছাড়াও আর কিছু ঘটেছে। কিন্তু উনি তা বলতে চান না।
আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?
রুহা প্রপাতে।
সে কী!
তোমাকে বিপদের সম্ভাবনার কথা বলেছি। কাজেই সবসময় তৈরি থাকবে।
কীভাবে তৈরি থাকব? এবার তো আমি সঙ্গে আমার ফায়ার-আর্মস আনিনি।
ফায়ার-আর্মস দিয়ে সব সময় বিপদ ঠেকানো যায় না। মোট কথা, চোখ কান খোলা রাখবে। ব্যস!
যে রাস্তা দিয়ে গতকাল আমরা স্টেশন থেকে এসেছিলাম, সেই রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে কর্নেল একটু দাঁড়ালেন। রাস্তাটা এখানে ডান দিকে ঘুরে রেললাইন পেরিয়ে চলে গেছে। দূরে রুহা স্টেশন চোখে পড়ল। কর্নেল বাইনোকুলারে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে জঙ্গলে ভরা একটা টিলা দেখতে দেখতে বললেন, একটা পায়ে চলা পথ দেখতে পাচ্ছি। সেনসায়েব নিশ্চয় এই পথেই প্রপাতে স্নান করতে যান। কারণ এটা ছাড়া আর কোনও পথ নেই।
আপনি লেকের ধারে সেক্রেটারি বার্ড দেখতে গিয়েছিলেন কোন পথে?
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমার পথ আমিই তৈরি করে নিই। চলে এস!
এ ধরনের পথে কর্নেলের সঙ্গে হাঁটাচলার অভ্যাস আছে। চড়াই-উতরাই ক্রমাগত। তবে পথটা নাক বরাবর এগিয়েছে। দুধারে ন্যাড়া পাথর। তার ফাঁকে ঝোপঝাড়। কর্নেল বিপদ কথাটা বলায় অস্বস্তি নিয়ে হাঁটছিলাম। মিনিট দশেক পরে মোটামুটি সমতল একটা জমিতে পথটা দুভাগ হয়েছে। কর্নেল সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন, বাঁ দিকের পথটা গেছে লেকের পশ্চিম পাহাড়ে পার্বতীর মন্দিরে। ডান দিকেরটা রুহা জলপ্রপাতের দিকে।
ডান দিকে আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর জলের শব্দ কানে এল। তারপর কিন্তু প্রপাতটা দেখে হতাশ হলাম। বড়জোর ফুট পঞ্চাশেক ওপর থেকে সংকীর্ণ একটা ধারা নিচে গড়িয়ে পড়ছে। সেখানে খানিকটা জায়গায় পাথরের খাদে স্বচ্ছ জল জমে আছে। দেখতে একটা ডোবার মতো। রুহা নদী পাহাড়ের ফাটল দিয়ে এগিয়ে চলা ক্ষীণ একটা জলধারা মাত্র।
কর্নেল বাইনোকুলারে চারদিক খুঁটিয়ে দেখে বললেন, কোন পাহাড় থেকে পাথর খসে পড়েছিল, বোঝা যাচ্ছে না। এই পাহাড়টা থেকে খসে পড়লে পাথরটার জলে পড়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সেনসায়েব বলছিলেন, ওটা জলে পড়েছিল। এক মিনিট।
কর্নেল ডোবার কিনারা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ঝুঁকে কিছু দেখতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?
খসে-পড়া পাথরটা এখানে আটকে আছে।
কাছে গিয়ে দেখি, জলের ভেতর থেকে মাথাতোলা দুটো প্রকাণ্ড পাথরের মাঝখানে একটা পাথর আটকে আছে। সেটার একপিঠে লালচে মাটির চাবড়া আর কিছু ঘাস দেখা যাচ্ছে। কর্নেল ঘুরে ওপরের দিকটা দেখে নিয়ে বললেন, সেনসায়েব স্নান করার আগে বা পরে এদিকে কেন এসেছিলেন, এটাই প্রশ্ন। হুঁ, এখানে তিনটে সিগারেটের ফিল্টারটিপ পড়ে আছে দেখছি। কেউ তার জন্য এখানে অপেক্ষা করছিল কি? সেনসায়েবকে সিগারেট খেতে তো দেখিনি।
বলে কর্নেল ফিল্টারটিপগুলো কুড়িয়ে জ্যাকেটের ভেতর চালান করলেন। তারপর বললেন, আর এখানে নয়। নিরাপদ জায়গায় চলো।
যে পথে এসেছিলাম, সেই পথে কিছুটা গিয়ে উনি দাঁড়ালেন! এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, ডোবা থেকে আন্দাজ তিরিশ ফুট দূরে যে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমেছে, তার আগাপাছতলা ছোট-বড় নানা আয়তনের পাথর মাথা উঁচু করে আছে।
কর্নেল বাইনোকুলারে দেখে নিয়ে বললেন, ওই পাথরগুলো দৈবাৎ খসে পড়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করছি না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে ওখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল?
বললাম, যেই খাক, সে-ও সেনসায়েবের মতো প্রাণে বেঁচে গেছে।
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, সে না বেঁচে গেলে সেনসায়েব–
হঠাৎ উনি থেমে গিয়ে আবার বাইনোকুলারে সেই ঢালু পাহাড়টা দেখে নিলেন। তারপর ডান দিকে ঘুরে ঝোঁপ-জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন। বললাম, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
চুপচাপ আমার পেছন-পেছন এস। চোখ-কান খোলা রাখবে।
আবার অস্বস্তি ফিরে এল। সেই পাহাড়ের উত্তর অংশ এটা। কিন্তু অনেক বেশি ঢালু। কোথাও ঘাস গজিয়ে আছে। কোথাও ঝোপঝাড়। আবার কোথাও রুক্ষ লালচে নগ্ন মাটি। কর্নেল মাঝে মাঝে থেমে বাইনোকুলারে ওপর দিকটা দেখছিলেন। আবার সাবধানে পা ফেলছিলেন। বারবার আমাকে ইশারায় সতর্ক করে দিচ্ছিলেন।
প্রায় আধঘণ্টা পরে পাহাড়টার মাথায় পৌঁছুলাম। সেখানে ঘন জঙ্গল। কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নেওয়ার পর কর্নেল জঙ্গল সরিয়ে উঁকি দিলেন। তারপর আস্তে বললেন, হু। যা ভেবেছিলাম!
কী?
মৃন্ময়ীভবন।
অবাক হয়ে উঁকি মেরে দেখি, পাহাড়ের ওপাশে একই রকম ঢাল এবং পুরোটাই জঙ্গলে ঢাকা। তার নিচে মৃন্ময়ীভবনের পেছনের দিকটা দেখা যাচ্ছে। এদিকের পাঁচিল উঁচু। তবে তার চেয়ে চোখে পড়ার মতো দৃশ্য সেই বিগ্রহহীন শূন্য মন্দিরের পেছনের দেয়ালে দুদিক থেকে পাঁচিল এসে মিশেছে এবং মন্দিরের পেছনে একটা ছোট্ট দরজা। দরজাটা অবশ্য বন্ধ।
বললাম, মৃন্ময়ীভবন এত কাছে!
কাছে তো বটেই। মন্দিরের পেছনের দরজা দিয়ে সোজা এখানে ওঠা যায়। তারপর দক্ষিণে কিছুদূর এগিয়ে গেলে পাহাড়টার সেই বিপজ্জ অংশে পৌঁছনো যায়।
কিন্তু পার্বতীর মন্দিরে যাওয়ার পথটা কোথায়?
তোমাকে চোখ-কান খোলা রাখতে বলেছিলাম। রাখোনি। তা হলে দেখতে পেতে, মন্দিরের পথটা আমরা নিচে ফেলে এসেছি। নেহাত পায়ে চলা পথ। তা ছাড়া ওই পথে লোকচলাচল খুবই কম। কারণ পার্বতীর মন্দির কবে ভেঙেচুরে গেছে। যাই হোক, পার্বতীর মন্দিরে আমাদের যাওয়ার দরকার দেখছি না। চলো। এবার ফেরা যাক। কিন্তু সাবধান!
যেদিক থেকে উঠেছিলাম, সেদিকে নামবার সময় কর্নেল আমাকে পার্বতীর। মন্দিরে যাওয়ার পথটা দেখিয়ে দিলেন। পথটা সহজে চোখে পড়ে না এখানে। দুধারে ঘন ঝোপঝাড় ঝুঁকে আছে এবং কোথাও কোথাও উঁচু ঘাসের তলায় চাপা পড়েছে।
প্রপাতের কাছাকাছি নেমে এসে কর্নেল বললেন, আদিবাসীরা এখন জলপ্রপাতে আর যাতায়াত করে না মনে হচ্ছে। অথচ রুহা গ্রাম এখান থেকে তত বেশি দূরে নয়।
কীভাবে বুঝলেন?
পথের অবস্থা লক্ষ্য করলে তুমিও বুঝতে পারবে। তা ছাড়া এখনও কোনও আদিবাসী বালককেও দেখতে পাচ্ছি না। আদিবাসী বালকদের অ্যাডভেঞ্চারের প্রবণতা জন্মগত। ওরা যেখানে জন্ম নেয়, তার চারদিকটা তন্নতন্ন করে চিনেজেনে রাখা ওদের স্বভাব।
এলাকার খ্রিস্টান মিশনারিরা ওদের স্বভাব বদলে দিয়েছেন।
কর্নেল হাসলেন। স্বভাব বদলে দিতে পেরেছেন কি না, তা জানার জন্য রুহা গ্রামে যাওয়া দরকার।
সত্যি যাবেন নাকি?
আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। কর্নেল দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, ওই দেখ! রুহা গ্রাম থেকে প্রপাতে আসার পথটা কাঁটাঝোপ দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, কোনও আদিবাসী ফসলের জমিতে বেড়া দেওয়ার জন্য কাঁটাঝোপ কেটে রেখেছে। সময়মতো নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি, কাঁটাঝোপগুলো মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে।
দেখে নিয়ে বললাম, সত্যি তো। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে। চলো।
রুহা গ্রামে গিয়ে কারণটা জেনে আসি। এখনও যথেষ্ট বেলা আছে।
কিন্তু যাবেন কোন পথে?
রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু কেন আদিবাসীরা প্রপাতের দিকে যেতে চায় না, সেটা জানা কি এতই জরুরী?
জরুরী ডার্লিং! কারণটা আমাকে জানতেই হবে। বলে কর্নেল আমার কাঁধে হাত রাখলেন।
অতএব লক্ষ্মী ছেলের মতো ওঁকে অনুসরণ করলাম। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি, স্টেশন তেমনই জনহীন। রেল-সিন্দুকের ওপর কাল যে রেলকর্মীকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম, সে এখন পা ঝুলিয়ে বসে খৈনি ডলছে। আমাদের দেখে সে ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বলল, এখনও। ট্রেন চালু হয়নি সার!
কর্নেল আস্তে আমাকে বললেন, লোকটি আদিবাসী। এর সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক। বলে তার পাশে গিয়ে বসে পড়লেন। তারপর হিন্দিতে বাক্যালাপ। শুরু করলেন। তোমার বাড়ি কোথায়?
সাসানডি।
সেটা কোথায়?
বুরুডির জঙ্গলে যাওয়ার পথে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।
তোমার বউ-কাচ্চাবাচ্চা সাসানডিতে থাকে?
সে হাসল। না সার! রুহায় আমার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুর আমাকে সেখানেই ঘর বানিয়ে দিয়েছে।
তা হলে তো তুমি রুহার লোক হয়ে গেছ।
হা সার।
তোমার গলায় ক্রুশ ঝুলছে। তুমি কি খ্রিস্টান?
সে মাথা নেড়ে খুশি খুশি মুখে বলল, রুহায় গির্জা আছে সার। আমরা যারা খ্রিস্টান, তারা থাকি আলাদা পাড়ায়। আমার ছেলেমেয়েরা ফাদার যোশেফের স্কুলে লেখাপড়া করে। ফাদার যোশেফ অসুখ-বিসুখে আমাদের চিকিৎসা করেন।
বলে সে বুকে কপালে ক্রশ আঁকল। কর্নেল বললেন, রুহা গ্রামের কাছে একটা নদী আছে শুনেছি।
আছে। তবে শীতের সময় নদীতে জল থাকে না।
তখন জল কোথায় পাও?
কেন? গির্জার সামনে ইঁদারা আছে।
যারা খ্রিস্টান নয়, তারা জল কোথায় পায়?
সরকার তাদের জন্য টিউবেল বসিয়েছেন। আমাদের পাড়াতেও শিগগির টিউবেল বসবে। কারণ খরার সময় ইঁদারার জল কমে যায়।
কেন? রুহা নদীর ফলস–ফলস্ বোঝো তো?
লোকটির মধ্যে আদিবাসীসুলভ সরলতা লক্ষ্য করলাম। সে হাসতে হাসতে বলল, আমি সময় পেলেই ফাদার যোশেফের কাছে ইংলিশ পড়ি। আর স্টেশনমাস্টার গোমসসায়েবও আমাকে সাহায্য করেন।
রুহা ফলসের নিচের খাদে সারা বছর জল জমে থাকে শুনলাম। সেখানে রুহার লোকেরা খাঁটি জল পেতে পারে। তত দূরে তো নয়!
লোকটির মুখের ভাব বদলে গেল। ঝটপট বুকে-কপালে ক্রশচিহ্ন এঁকে বলল, কিছুদিন আগে ওখানে একটা ভয়ঙ্কর চেহারার জানোয়ার দেখা গেছে। জানোয়ারটা মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটে। ফাদার যোশেফ নাকি নিজেও দেখেছেন। তাই ফলসে যাওয়ার রাস্তা কাটা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
ফাদার যোশেফের সঙ্গে এখন দেখা হবে?
না সার। উনি কয়েক দিনের জন্য বাইরে গেছেন। কত জায়গায় উনি ঘুরে বেড়ান।
মোটরগাড়ি আছে ওঁর?
মোটরগাড়ির কী দরকার? ওঁর সাইকেলই যথেষ্ট।
তো সেই ভয়ঙ্কর জানোয়ার সম্পর্কে ফাদারের ধারণা কী জানেনা? উনি তোমাদের বলেননি কিছু?
আদিবাসী রেলকর্মী গম্ভীর মুখে বলল, কোনও আজব জানোয়ারই হবে। খনি এলাকায় অনেক পুরনো পোডড়া খনি আছে, তার মধ্যে জানোয়ারটার ডেরা। মাঝে মাঝে জল খেতে আসে রুহা ফসে।
এতক্ষণে স্টেশনমাস্টারকে প্ল্যাটফর্মের শেষ দিক থেকে আসতে দেখা গেল। ওঁকে দেখে কর্নেল সম্ভাষণ করলেন, গুড ইভনিং মিঃ গোমস্!
স্টেশনমাস্টার তেমনই নির্বিকার মুখে বললেন, ট্রেনের আশা করবেন না। আপনারা কান্দ্রায় বাস পেতে পারতেন।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। বাসেই ফিরব। সৌভাগ্যক্রমে কান্দ্রা রিসর্টে আমার এক বন্ধুর বাড়ি খুঁজে পেয়েছি। সেখানেই আছি, তো একটু বেড়াতে বেরিয়েছি।
স্টেশনমাস্টার স্টেশনঘরে ঢুকে গেলেন। আদিবাসী রেলকর্মী খৈনি মুখে। দিয়ে চোখ টিপে হাসল। তারপর আমরা যখন হাঁটতে শুরু করেছি, সে আমাদের পিছু নিল এবং কাছে এসে চাপাস্বরে বলল, গোমসসায়েবের বউ পালিয়ে গেছে। তাই ওঁর মনমেজাজ খারাপ। পালাবে না, কেন বলুন সার? টাউনের মেয়ে। এমন জায়গায় মন টেকে? মাস্টারসায়েবকে বলেছিলাম, ফাদারকে ধরুন। আমাদের গ্রামের স্কুলে ইংলিশের টিচার করে দেবেন মেম-সায়েবকে। কিন্তু গোমসায়েব নিজেও তো এখানে থাকতে চান না।
কান্দ্রা রিসর্ট এলাকায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, তা হলে বোঝা যাচ্ছে, গত রাতে তন্ময় এবং সৌমিত্র সেই আজব জন্তুটিকেই দেখেছিল।
আদিবাসীদের অনেক অদ্ভুত কুসংস্কার থাকে। ফাদার যোশেফের সেই জন্তুদর্শন চোখের ভুল হতেই পারে। তন্ময় এবং সৌমিত্রেরও ওটা চোখের ভুল।
অদ্ভুত কুসংস্কার অনেক শিক্ষিত মানুষেরও থাকে। এমনকি বিজ্ঞানীদেরও। যাই হোক, তোমাকে আবার বলছি, মুখটি বুজে থাকবে। আমরা গিয়েছিলাম সেক্রেটারি বার্ডের খোঁজে। বুঝলে তো?
বুঝলাম।