৫. কুকুরদুটো খুব গম্ভীর

অধ্যায় ৫

“আপনার কুকুরদুটো কিন্তু খুব গম্ভীর মশাই। ঘেউঘেউ করতে শুনলুম না তো!”

“এরা কাজের লোক, বেশি সাড়াশব্দ করতে পছন্দ করে না।”

“কামড়ে-টামড়ে দেয়?”

“না, সহজে কামড়ায় না। তবে দরকার হলে লাফিয়ে উঠে গলার নলি ছিঁড়ে দেয়।”

“ও বাবা! ডেনজারাস কুকুর মশাই! ঘেউঘেউ করে না, লাফিয়ে উঠে গলার নলি ছিঁড়ে দেয়! ও মশাই, এরা সত্যিকারের কুকুর তো! নাকি অন্য কিছু?”

“এরা শিকারি কুকুর।”

“শিকারি কুকুর? বাঘের সঙ্গে পারবে?”

“তা হয়তো পারবে না। কারণ বাঘের গায়ে জোর বেশি। তবে বাঘের সামনে পড়লে পালাবেও না। শেষ অবধি লড়বে।”

কোদণ্ড গজপতি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেননি কেন? ওরকম বিপজ্জনক কুকুরকে বেঁধে রাখাই তো উচিত।”

“ভয় পাবেন না। এই যে আমার চেয়ারের দু’পাশে চুপটি করে বসে আছে, আমি না বললে নড়বেও না।”

“তবু একটু ভয়-ভয় করছে মশাই! যেভাবে তাকাচ্ছে তাতে বুকটা গুড়গুড় করে উঠছে মাঝে-মাঝে।”

“ভয় পাওয়া ভাল। যারা ভয় পায় না তাদের এরা সন্দেহের চোখে দেখে।”

“ও বাবা! তা হলে ওদের বলে দিন যে,আমি ওদের খুব ভয় পাচ্ছি।

“বলতে হবে না। ওরা নিজেরাই বুঝতে পারে। এবার আমার কেসটা কী হল বলুন।”

“হ্যাঁ, সেই কথা বলতেই আসা। আসমানির চর একসময়ে আপনাদেরই সম্পত্তি ছিল বটে। কিন্তু সেটা কুশি নদীর জলে ডুবে যায়। বেশ কয়েক বছর বাদে আবার ভেসে ওঠে বটে, কিন্তু আইনত নতুন চরে আর পুরনো মালিকানা থাকে না।”

“আইন আমি জানি। আসমানির চর এর আগেও বারদুয়েক ডুবেছে এবং ভেসেও উঠেছে। তাতে কোনওবারই আমাদের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। আমরাই বরাবর আসমানির চরের স্বত্বাধিকারী ছিলাম। কেউ জবরদখল করতে সাহস পায়নি। আমাদের পাকা দলিলও আছে। এবারই প্রথম আসমানির চর বেদখল হল। আমার মনে হচ্ছে এটা ইচ্ছে করে শত্রুতাবশেই করা হয়েছে। এবারেও আসমানির চর ভেসে ওঠার পর আমার লোকেরা তার দখল নিতে গেলে গোকুলেশ্বরের দলবল তাদের লাঠিবাজি করে হটিয়ে দেয়। গোকুলেশ্বর যে একজন ডাকাত, সে কথা তো সবাই জানে।”

কোদণ্ড গজপতি একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, “তা তো বটেই। তবে সেটা অতীত। সে সারেন্ডার করায় সরকার বাহাদুর তাকে মাপ করে দিয়েছেন।”

“ওসব আমি জানি। লোকের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য গোকুলেশ্বর আসমানির চরে একটা ডিয়ার স্যাংচুয়ারি বানিয়েছে। কিন্তু তার আড়ালে ওর অন্য খেলা আছে। ওখানে ওর গাঁজা আর আফিঙের চাষ আছে। শুনছি ওখানে সে পোলট্রি আর ফার্মিংও শুরু করল বলে। যত দূর জানি তার কোনও লিগাল ডকুমেন্ট নেই, সবটাই গা-জোয়ারি। আপনি তো তাকে অনেকগুলো চার্জেই অ্যারেস্ট করতে পারেন।”

“গোকুলেশ্বরের মৃগদাবকে গভর্নমেন্ট অ্যাপ্রুভাল দিয়েছে যে! আপনি কমপ্লেন করেছেন যে, গোকুল ওখানে গাঁজা আর আফিঙের চাষ করে, কিন্তু আমরা সার্চ করে তেমন প্রমাণ পাইনি। কোন চার্জে অ্যারেস্ট করা যায় সেটাই ভাবছি। তার উপর চারদিকে রটনা হয়েছে,আপনি আর আপনার শিকারি বন্ধুরা আসমানির চরে গোকুলের মৃগদাবে গিয়ে দুটো হরিণ মেরে এনেছেন।”

“একদম বাজে কথা। গোকুলেশ্বর কি কোনও নালিশ করেছে?”

“না। সে কাউকেই কিছু বলেনি।”

“তা হলে? গাঁয়ের লোকের তো কাজকর্ম নেই, তাই গুজব রটাতে ভালবাসে।”

কোদণ্ড খুব চিন্তিত মুখে বলেন, “বিরুবাবু, এখন কিন্তু শিকার বেআইনি। পশুপাখি মারা নিষেধ। আপনার বন্ধুদের একটু সামলে রাখবেন। না হলে আমি ঝামেলায় পড়ে যাব।”

“শিকার! কই, আমরা তো শিকার-টিকার করি না মশাই! কে যে এসব রটাচ্ছে!”

“তা অবশ্য ঠিক, গাঁয়ের লোকের গুজব রটানোর অভ্যেস আছে।”

“আপনি ওসব কথায় কান দেবেন না। বরং গোকুলেশ্বরের উপর নজর রাখুন।”

“যে আজ্ঞে!” বলে উঠতে যাচ্ছিলেন গজপতি, ফের ধপ করে বসে পড়ে বললেন, “আমি যাওয়ার সময় আপনার কুকুরেরা আবার তাড়া করবে না তো!”

“ওরা ট্রেনিং পাওয়া কুকুর, নেড়ি কুকুর নয় মশাই। নিশ্চিন্তে চলে যান।”

“আপনি কুকুরদুটোকে খুব ভালবাসেন, তাই না?”

“হ্যাঁ, সন্তানের মতো।”

“সেরকমই শোনা যায় বটে।”

ভুসিরাম আজকাল অহংকারে মকমক করে বেড়ায়। অহংকার হওয়ারই কথা কিনা। কুঠিবাড়ির কর্তার বডিগার্ড বলে কথা! হ্যাতান্যাতা লোক তো নয় রে বাবা! আর ‘বডিগার্ড’ কথাটাই তো গেরামভারী, গাঁয়ের লোক শুনলে চোখে ভারী শ্রদ্ধা ফুটে ওঠে। ইংরেজি কথার ওজনই আলাদা। ইংরেজি যদি ফুটকড়াই, তবে বাংলা যেন ন্যাতানো মুড়ি। বডিগার্ড কথাটা যেমন লোককে বুক ফুলিয়ে বলা যায়, বাংলা হলে বলা যেত কি? তার উপর তার খাকি রঙের প্যান্ট আর শার্টও হয়েছে। নতুন নয় অবিশ্যি, তা হোক, খাকি মানেই হলে তুমি পুলিশ বা মিলিটারির মতোই একজন কেওকেটা। গাঁয়ের লোক হিংসের চোখে তাকিয়ে দেখে। একটা দেড়মানুষ সমান লম্বা লাঠি পেয়েছে সে, যার গাঁটগুলো পেতলে বাঁধানো। মাথায় একটা পাগড়ি বা টুপি হলে আরও ভাল হত বটে, কিন্তু সেটা এখনও জোগাড় হয়নি। যা হয়েছে তাও কম কিছু নয়।

বিরুবাবুকেও তার খুবই পছন্দ। পয়লা দিনই তিনি তাঁর দুটো শিকারি কুকুরের সঙ্গে তার ভাব করিয়ে দিলেন। সে দুটো বাঘা কুকুর তার চারদিকে কয়েকবার পাক খেল, তারপর গা শুঁকল, বেশ অনেকক্ষণ ধরে জরিপ-টরিপ করে তারপর ল্যাজ নাড়িয়ে জানান দিল যে, তারা তাকে চিনে রেখেছে। খুব ভোরবেলা কুকুরদুটোকে হাঁটাতেও নিয়ে যায় সে। তারা দিব্যি তার কথা শোনে, অবাধ্যতা করে না।

মুশকিল হল দুনিয়ায় কোনও সুখই নিষ্কণ্টক নয়। আর তার সুখের কাঁটা হল গয়াবুড়ি। সে যেদিন কাজে জয়েন দিল, সেদিন বিরুবাবু তাকে ডেকে বললেন, “ওরে, চারদিকটা ভাল করে দেখে আয়। কুঠিবাড়ি তো বিরাট জায়গা, সবটার একটা আন্দাজ থাকা ভাল।”

তাই বাড়িটা টহল দিতে বেরিয়েছিল সে। বেশ মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে, তেজস্বিতার সঙ্গেই দাপ দেখিয়ে বাগানের রাস্তায় হাঁটা ধরেছিল। বাড়ির কাজের লোকেরা বেশ সসম্ভ্রমেই তাকে রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছিল। ভুসিরাম বুঝতে পারছিল এতদিনে সে একটা কাজের মতো কাজ পেয়েছে। নইলে এতকাল তো তার গুণের কোনও কদরই হয়নি! এ কাজের ইজ্জতই আলাদা। গোলাপবাগানটা সবে পেরিয়েছে কি পেরোয়নি, কোথা থেকে সাদা শাড়ি পরা এক বুড়ি পট করে সামনের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে চিল চেঁচিয়ে বলে উঠল, “অ্যাই মিনসে, তুই সেই চোর ছোঁড়াটা না?”

ভুসিরামের অহংকারের বেলুনটা ফুস করে হাওয়া ছেড়ে দিয়ে চুপসে গেল। মানসম্মান যায়-যায়। সে একটু থতমত খেয়ে বলল, “না ঠাকুরমা, আমি সে নই।”

“কেন রে, আমার চোখে কি চালসে ধরেছে? নাকি আমার ভীমরতি হয়েছে? ও মা! কী পাজি দেখ, আবার পুলিশের পোশাক পরে চোখে ধুলো দেওয়ার মতলব! এই ছোঁড়া, এই তো সেদিন তোশাখানায় ঢুকতে গিয়ে রাতবিরেতে ধরা পড়লি। বিরুর দয়ার শরীর, তাই কান ধরে ওঠবোস করিয়ে ছেড়ে দিল। কোন লজ্জায় আবার কুঠিবাড়িতে ঢুকেছিস শুনি! বেহায়া কোথাকার, বলি মতলব কী তোর?”

ভুসিরামের তখন ঘাম হতে লেগেছে, কানটান গরম। চেঁচামেচি শুনে বাড়ির লোকেরাও মজা দেখতে এসে জুটে যাচ্ছিল। ভুসিরাম আমতা-আমতা করে বলল, “আমি যে বিরুবাবুর বডিগার্ড গো ঠাকুরমা! আমায় চিনলে না!”

“চোরছ্যাঁচড় আমি খুব চিনি বাছা, ভাবছিস ইংরিজি বলে পার পেয়ে যাবি? এই গয়াদাসী কি ইংরেজিকে ডরায় নাকি? কী ভেবেছিস, ভড়কি দিয়ে পিছলে বেরোবি?”

কাঁচিকলে পড়ে ভুসিরাম কাহিল গলায় বলে, “আহা, বেরোনোর কথাই তো উঠছে না। আমার যে বিরুবাবুকে পাহারা দেওয়ার কাজ!”

“মরণ! বিরুর কি বুদ্ধিনাশ হয়েছে যে, চোরকে পাহারাদার রাখবে! কী মিথ্যুক রে বাবা! ওরে, তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? চোরটাকে জাপটে ধরে কটকটে করে বেঁধে ফেলতে পারছিস না?”

তা গয়াবুড়ির এ কথাটা সকলেরই বেশ পছন্দ হল। ভুসিরাম কিছু বুঝে ওঠার আগেই দশ-বারোজন তাকে ঘিরে সাপটে ধরে ফেলল। বেঁধে ফেলতেও সময় লাগল না। ভুসিরাম তার প্যাঁচপয়জার দেখানোর ফাঁকই পেল না মোটে। বাঁধা পড়ে জব্দ গলায় বলতে লাগল, “কী মুশকিল! এ তো আমার খুব অপমান হয়ে যাচ্ছে! বিরুবাবুর বডিগার্ডের কি কোনও সম্মান নেই? তিনি জানতে পারলে যে খুব রাগ করবেন!”

গয়াবুড়ি ফোঁস করে উঠল, “তোর ভাগ্যি ভাল যে, কুঠিবাড়িতে এখন আর আগের নিয়ম নেই। আগে চোর ধরা পড়লে বাঁশডলা দেওয়া হত, গাছ থেকে হেঁটমুন্ডু করে ঝুলিয়ে রাখা হত, বিলিতি চাবুক দিয়ে আগাপাশতলা চাবকানো হত। আহা, কী ভাল-ভাল সব নিয়ম ছিল। এখন কেবল শুনি ক্ষমা আর ক্ষমা। হাড়পিত্তি জ্বলে যায় বাবা!”

হরিরাম গ্যাঁট্টাগোট্টা লোক, খুব আহ্লাদের সঙ্গে বলে উঠল, “তা গয়ামাসি, তোমার অত দুঃখের কী আছে বলো তো! বাঁশডলা না হয় আমরাই দিয়ে দিচ্ছি। আর হেঁটমুন্ডু করে ঝুলিয়েও দেব’খন, সে আর বেশি কথা কী! তবে বিলিতি চাবুকের তো আর জোগাড় নেই, বিছুটির ঝাড় আছে, তা দিয়েই আগাপাশতলা বেশ করে ধুইয়ে দেওয়া যাবে, কী বলো ভাইসব? বিলিতি চাবুকের চেয়ে খুব একটা কম হবে না।”

প্রস্তাবটা সকলেরই বেশ পছন্দ হল। শিবু একগাল হেসে বলল, “চোখে এক খাবলা লঙ্কার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিলে কিন্তু রগড়টা আরও জমবে, কী বলো ভাইসব?”

কার্তিক বলে, “বিছুটির সঙ্গে কয়েকটা কাঁটাগাছও তুলে আনব কি? খুব জমে যাবে কিন্তু।”

ঘটনাটা অবশ্য তত দূর গড়াল না। গড়ালে ভুসিরামের কপালে দুর্গতি ছিল। খবর পেয়ে রাখোহরি এসে তাকে উদ্ধার করে।

সেই থেকে গয়াবুড়িকে খুব সমঝে চলে সে। কুঠিবাড়িতে গয়াবুড়ির দাপট সাংঘাতিক। তার ভয়ে সবাই তটস্থ। এ বাড়িতে দিনদশেক কেটেছে তার, তবু মুখোমুখি পড়লেই গয়াবুড়ি তার দিকে কটমট করে তাকায় আর তাকে শুনিয়েই আপনমনে বলে, “কলির শেষে তো সব উলটোই হওয়ার কথা কিনা, তাই চোর হয়েছে সেপাই। দিনে-দিনে আরও কত দেখব বাবা! এই সেদিন জলজ্যান্ত চোরটা ধরা পড়ল, ও মা! দু’দিন যেতে না-যেতেই সে দেখছি পুলিশ সেজে গ্যাটম্যাট করে বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বশীকরণ না জানলে কি এমন হয়!”

একদিন দুপুরে খেতে বসেছে, খিটখিটে মাঝবয়সি গিরিমাসি আঁশটে মুখ করে বলল, “হ্যাঁরে ছোঁড়া, দু’বেলা তো গান্ডেপিন্ডে গিলছিস আর গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, এ বাড়িতে তোকে কোন কাজে বহাল করা হয়েছে বল তো!”

ভুসিরাম বেশ জাঁক করেই বলল, “গুরুতর কাজ গো মাসি। আমি হলুম বিরুবাবুর বডিগার্ড।”

গিরিমাসি হাঁ। বলল, “কী বললি, আবার বল তো!”

“বডিগার্ড গো মাসি, বিরুবাবুকে পাহারা দেওয়ার কাজ।”

গিরিমাসি অবাক হয়ে বলে, “ও মা! বিরুবাবুর আবার পাহারার কী দরকার হল?”

“তা আমি জানি না গো মাসি, তবে খুব দায়িত্বের কাজ, চারদিকে নজর রাখতে হয়।”

“পোড়া কপাল, নজর রাখা আবার একটা কাজ! সে তো আমার বোনপোটাই রাখতে পারত! কবে থেকে ছেলেটাকে এ বাড়ির কাজে ঢোকাতে চাইছি, কোথা থেকে তুই উড়ে এসে জুড়ে বসলি বল তো! আমার বোনপো কম কীসে? ক্লাস এইট পাশ দিয়েছে, পাড়ায় নাটক করে, সুর করে পাঁচালি পড়তে পারে।”

গিরিমাসির কথা শুনে একটু দমে গেল ভুসিরাম। এ বাড়ির লোকজন তাকে খুব একটা ভাল চোখে দেখছে না তো! বিরুবাবুর বডিগার্ডের কি আরও একটু খাতির পাওয়ার কথা নয়? কাজটা তো রীতিমতো বীরত্বের কাজ বলেই তার মনে হয়েছিল। অবশ্য কাজটা যে ঠিক কী, তা সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু রাখোহরির কাছে শুনেছে, বিরুবাবুর নাকি খুব বিপদ। কিন্তু কীসের বিপদ, কেন বিপদ, কীরকম বিপদ তা ভেঙে বলেনি। শুধু বলেছে, “চোখ-কান খোলা রাখিস।” তা রাখছেও ভুসিরাম। বিপদ এলে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তেও সে প্রস্তুত। কিন্তু বিপদ ব্যাটাকে বাগে পেলে তো! বিরুবাবু তো দিব্যি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারছেন, খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁর ঘর থেকে মাঝে-মাঝেই হা-হা হো-হো হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে। তা হলে বিপদব্যাটা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে?

“আছে হে, বিপদ আছে!” নিশুত রাতে যখন একতলার কুঠুরিতে শুয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিল তখন তার কানের কাছ ঘেঁষে কে যেন বলে উঠল। তড়াক করে উঠে বসল ভুসিরাম, “কে? কে রে?”

কাউকে অবশ্য দেখা গেল না। মনের ভুলই হবে। দেড়-দুশো বছরের পুরনো বাড়ি তো, নানা রকম শব্দটব্দ হয়।

সেই কথাটাই ফের পরদিন আরও একজনের মুখে শোনা গেল। লোকটা হল গুণেনমিস্তিরি। সারাদিন এ বাড়ির হরেক জিনিস সারাই করে। নিজেই বলে, “আমি সারাতে পারি না এমন কলকবজা এখনও দুনিয়ায় তৈরিই হয়নি।”

দুপুরে পিছন দিককার বারান্দায় বসে একটা পুরনো দেয়ালঘড়ি সারাচ্ছিল। তাকে দেখে বলে উঠল, “এ বাড়িতে কাজ করে সুখ নেই, বুঝলে। দেড়শো কি দুশো বছরের পুরনো ঘড়ির আসল পার্টস কি বাজার ঢুঁড়ে পাওয়া যাবে, তুমিই বলো! কিন্তু বুড়োটাকে সে কথা বোঝায় কার সাধ্যি! সেই তখন থেকে কানের কাছে টিকটিক করে যাচ্ছে,আমি নাকি পুরনো পার্টস চুরি করে ভেজাল মাল ভরে দিচ্ছি। চোখ রাঙাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, বলছে, আমাকে নাকি গ্রামছাড়া করে ছাড়বে, নির্বংশ করে দেবে। এরকম তাড়না করলে কি মন দিয়ে কাজ করা যায়?”

ভুসিরাম অবাক হয়ে বলে, “বুড়োটা কে বলো তো!”

“দু’দিন থাকো, তুমিও চিনবে। এ হল বুড়ো ভঞ্জ। পটল তুলেছে বটে, কিন্তু পরলোকে যাওয়ার নামটি নেই। ঘাঁটি আগলে এখানেই খুঁটি গেড়ে পড়ে আছে। বললুম, ‘বড়কর্তা, দেহ তো ছেড়েছেন, এখনও এইসব তুচ্ছ মায়ায় আটকে আছেন কেন? আপনার কি ঊর্ধ্বগতি হয়নি?’ শুনে যা শাপশাপান্ত করল তা বলার নয়।”

ভুসিরাম চমকে উঠে বলে, “ভূত নাকি?”

“ভূত তো ভূতের মতো থাকলেই হয়। মাঝে-মাঝে দেখা দিয়ে ভয়টয় দেখিয়ে ফের নিজের জায়গায় ফেরত যাবে, এটাই তো নিয়ম। এঁর তো সে বালাইও নেই। চক্ষুলজ্জা থাকলে তো! ইনি তো দিনেদুপুরে উদয় হয়ে হম্বিতম্বি জুড়ে দিচ্ছেন। ভূত বলে যে একটু মান্যিগন্যি করব, তারও উপায় রাখেননি। যখন তখন উদয় হলে কি আর ভূতের মানমর্যাদা থাকে! আমি বলেই জোড়াতাড়া দিয়ে এ ঘড়ি খাড়া করার চেষ্টা করছি। ঘড়ির দোকানে নিয়ে গেলে এ ঘড়ি তারা ছোঁবেও না, পেন্নাম করে বলবে, ‘এঁর গায়ে হাত দেওয়ার সাহসই আমাদের নেই, বাড়ি নিয়ে গিয়ে যত্ন করে রেখে দিন, খোঁচাখুঁচি করবেন না।’ তা কর্তা সেকথা মানতেই চায় না।”

“তা হলে তো বড় মুশকিল হল গুণেনদাদা, একেই তো দেখছি এ বাড়ির কেউ আমাকে তেমন পছন্দ করছে না, তার উপর যদি ভূতের তড়পানি সহ্য করতে হয় তা হলে তো গেলাম।”

“তা তোমার এ বাড়িতে কাজটা কী বলো তো!”

“আমি হলুম বিরুবাবুর বডিগার্ড।”

“বডিগার্ড! আরে দূর-দূর, তুমিও যেমন!”

ভুসিরাম অবাক হয়ে বলে, “তার মানে?”

“বেশি ভেঙে বলতে চাই না, তবে মনে হয় এর পিছনে অন্য মতলব আছে। একটু সাবধানে থেকো।”

“তার মানে কি আমি বিরুবাবুর বডিগার্ড নই?”

“বিরুবাবুর কি বডিগার্ডের অভাব পড়েছে যে, তোমাকে বহাল করবে? ওই যে চারটে শিকারিকে পুষছে, তা কি এমনি? বিরুবাবুর আসল বডিগার্ড হল ওরা। চোখের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলেই বুঝবে, ওরা কেউ তেমন সুবিধের লোক নয়। ওদের প্রত্যেকের পিছনে লম্বা লেজ আছে। নানা কুকর্মের লেজ।”

ভুসিরাম একটু মুষড়ে পড়ে বলল, “তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী বলো তো!”

“তা জানি না, তবে সাবধানের মার নেই।”

ভুসিরাম শুকনো মুখে বলে, “শুনেছিলাম আমাকে রাখা হয়েছে, কারণ বিরুবাবুর নাকি খুব বিপদ।”

“সে কথা সত্যি। বিপদ বলে বিপদ! যাকে ঘাঁটিয়েছেন, সে তো সোজা পাত্র নয়। যে শত্রু তড়পায় বা হুমকিধামকি দেয়, তাকে তত ভয় নেই। কিন্তু যে শত্রু টুঁ শব্দটি করে না, সে বড় ভয়ংকর। গোকুলেশ্বরকে যারা জানে তারাই জানে, সে ভাল থাকলে গঙ্গাজল, খেপলে মুচির কুকুর। তুমি বাহাদুর ছেলে হতে পারো, কিন্তু গোকুলেশ্বরের কাছে তুমিও নস্যি। বুঝলে?”

“তাই তো! তা হলে আমার অবস্থাটা কী দাঁড়াচ্ছে? শুধু দুটো কুকুরকে চান করানো, খেতে দেওয়া, আর হাঁটাতে নিয়ে যাওয়া?”

“আহা, সেটাই বা খারাপ কী বলো। দিব্যি চাকরি, কোনও ঝঞ্ঝাট নেই। যাই বলো, মানুষের চেয়ে বরং কুকুরকে আমার ভাল বলে মনে হয়। ভেবে দেখলে বিরুবাবুর বডিগার্ড হওয়ার চেয়ে কুকুরের বডিগার্ড হওয়া অনেক ভাল।”

“দূর! শেষ অবধি কুকুর সামলাতে হবে জানলে এ চাকরি নিতুম নাকি?”

“তা অবিশ্যি ঠিক। লোকে বলবে কুকুরের চাকর। আমিও কানাঘুষো শুনেছি যে, তুমি এলেমদার ছেলে। কিন্তু আজকাল গুণের কে আর কদর করছে বলো। এই আমার কথাই যদি ধরো, কোনও ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে কি আমি কম? শুধু পাশটা করিনি, তাই লোকে নাক সিঁটকে বলে ‘মিস্তিরি’। কেউ আমার দামও দিল না, মর্মও বুঝল না।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে ফিরে এল ভুসিরাম।

ভাল জাতের কুকুরদের একটা লক্ষণ হল, তারা সহজে বিচলিত হয় না। নেড়িকুকুর যেমন কাকপক্ষী বা বেলুনওয়ালা বা বহুরূপী দেখলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে, তেমনই এরা আবার সেসব মোটেই গ্রাহ্য করে না। কদাচিৎ এদের গলা শোনা যায়। কিন্তু যখন ডাকে, তখন মনে হয় মেঘ ডাকছে। কয়েকদিনেই কুকুরগুলোকে বুঝে নিয়েছে ভুসিরাম। খুব ভোরে, আলো ফোটার আগেই ভুসিরাম কুকুরদুটোকে নিয়ে রাস্তায় দৌড়োচ্ছিল। তার বাঁ পাশে রিম আর ডান পাশে ঝিম। চামড়ার লম্বা ফিতে দিয়ে দু’জনেই তার কোমরের সঙ্গে বাঁধা। সে কুকুরের বডিগার্ড হতে রাজি নয় বটে, কিন্তু রিম আর ঝিমের সঙ্গে মেলামেশা করতে তার খারাপ লাগে না। রিম আর ঝিম সোজা সরল মানুষ, কোনও বায়নাক্কাও নেই, চক্করও নেই। চুরিচামারি করে না, মিছে কথা কয় না, কাউকে হিংসে করে না, পরনিন্দা নেই, গালাগাল দেয় না, আর কী চাই? দুটোরই চেহারা বিশাল, ভুসিরামের কোমরের সমান উঁচু, ছুঁচোলো লম্বা মুখ, সরু পা, লকলকে তেজালো বাদামি রঙের শরীর, সরু পেট। দেখলেই মালুম হয় খানদানি জীব। এদের দেখলেই আশপাশের পাড়ার নেড়ি কুকুরেরা প্রবল চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, তবে কাছে ভিড়তে সাহস পায় না। রিম আর ঝিম অবশ্য নেড়িদের গেরাহ্যের মধ্যেই আনে না।

রোজই কুলতলির মাঠে নিয়ে গিয়ে বল বা পাবড়া ছুড়ে রিম-ঝিমকে দৌড় করায় ভুসিরাম। কুলতলির মাঠের দিকে মোড় ঘুরতেই হঠাৎ কোথা থেকে একটা লোক উদয় হয়ে তার পাশাপাশি দৌড়পায়ে সঙ্গ নিল। লোকটা বেঁটেমতো, গোলপানা মুখ, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটে বোকা-বোকা একটা হাসি ঝুল খেয়ে আছে। সঙ্গ ধরে ভারী আহ্লাদের গলায় বলল, “বাহ বাহ, তোমার ছাগলদুটি তো বেড়ে! কোথা থেকে জোগাড় হল বলো তো!”

পাগল-টাগলই হবে বোধহয়। ভুসিরাম বিরক্ত হয়ে বলে, “খুড়ো, চোখের চিকিৎসা করাও গিয়ে। দুটো বাঘা কুকুরকে কি তোমার ছাগল বলে মনে হচ্ছে?”

লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলে, “বলো কী! এ দু’টি ছাগল নয়? আমি হলুম গে গন্ধেশ্বর, তিন পুরুষের ছাগলের ব্যাপারি, আমার তো ভুল হওয়ার কথাই নয়। তোমাকে কেউ কুকুর বলে ছাগল গছিয়ে দেয়নি তো! আমি তো কই কুকুরের নামগন্ধও দেখতে পাচ্ছি না। এ তো নিকষ্যি দিশি ছাগল, তবে হ্যাঁ, গায়েগতরে বেশ পুরুষ্টু আছে বটে!”

“বুঝলে খুড়ো, তোমার ভালর জন্যই বলছি, শুধু চোখ নয়, তোমার মাথারও চিকিৎসা দরকার। এ দুটো শুধু কুকুর নয়, শিকারি কুকুর। বুঝলে? ছাগল ভেবে যদি গায়ে হাত দিতে যাও তা হলে টুঁটি ছিঁড়ে ফেলবে।”

গন্ধেশ্বর ভারী অবাক হয়ে ঘ্যাসঘ্যাস করে মাথা চুলকে বলে, “তাই তো! তুমি বলছ কুকুর, কিন্তু আমি যে দেখছি ছাগল! এ তো বড় তাজ্জব ঘটনা হে! বুঝলে,আমরা হলুম তিন পুরুষের ছাগলের কারবারি। ছাগল ঘেঁটে চুল পাকিয়ে ফেললুম, সেই আমারই কিনা এত বড় ভুল হচ্ছে!”

“আহা, ভুল মানুষের তো কতই হয়। কথায় বলে, রজ্জুতে সর্পভ্রম।”

লোকটা তবু তার সঙ্গ ছাড়ল না, পাশাপাশি দৌড়পায়ে ছুটতে-ছুটতেই বলল, “তবু বলি কী, বরং আরও একবার ভেবে দেখো, কুকুর বলে তোমাকে কেউ ছাগল গছিয়ে দিয়েছে কি না। ঠগ-জোচ্চোরে তো দেশ ভরে গিয়েছে ভাইপো!”

“ভাবাভাবির কিছু নেই খুড়ো, তাতে কুকুরকে তো আর ছাগল বানানো যাবে না।”

“দুনিয়ায় কত কী হয় হে বাপু, তার কি কোনও ঠিক আছে!”

জবাবে ভুসিরাম একটু রাগ করেই কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আর ফুরসতই হল না। হঠাৎ ঘাড়ের কাছটায় একটা ছুঁচ ফোটার মতো কিছু টের পেল সে। তারপরই চোখ অন্ধকার। কুলতলির মাঠে ঢুকবার মুখে যে শিশু গাছটা আছে তার তলায় ধপাস করে পড়ে অচেতন হয়ে গেল ভুসিরাম।

যখন জ্ঞান ফিরল তখন ভুসিরাম হাঁ। তার কোমরের সঙ্গে লম্বা চামড়ার ফিতেয় বাঁধা দূটো ছাগলই তো বটে! সে দু’চোখ কচলে আবার ভাল করে ঠাহর করল। ভুল নেই। দুটো ছাগলই, আর তারা নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে বটে তবু রোদের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল যে, খুব বেশিক্ষণ সে অজ্ঞান হয়ে ছিল না। বড় জোর পাঁচ-দশ মিনিট। আর তার মধ্যেই তার দু’-দুটো বাঘা শিকারি কুকুর ছাগল হয়ে গিয়েছে। মাথায় হাত চেপে খানিকক্ষণ বসে রইল সে। ঘটনাটা বুঝে উঠতে চেষ্টা করল। একটু-একটু বুঝতেও পারল যেন। দুনিয়ায় তার চেয়ে ঢের-ঢের চালাক লোক যে অনেক আছে, তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু তাকে যে এত সহজে বোকা বানানো যায়, এটা বুঝতে পেরে তার নিজের জন্যই আজ বড় দুঃখ হল।

আধঘণ্টা বাদে ভুসিরাম যখন বিরুবাবুর বৈঠকখানায় তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন তার মাথা হেঁট। বিরুবাবুর দু’পাশের চেয়ারে আজও তাঁর চার শিকারি বন্ধু বসা। পাশে দাঁড়িয়ে রাখোহরি। চুপ করে বসে ঘটনাটা শুনলেন বিরুবাবু। মুখখানা লাল টকটকে হয়ে উঠল। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছেন। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর রাখোহরির দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “আমার রাইফেল! এক্ষুনি!”

শুঁটকো উপেন হাজরা অবাক হয়ে বলেন, “কী করতে চাইছেন বিরুবাবু?”

“আমি এখনই আসমানির চরে যাব। গোকুল আমার রিম-ঝিমকে না হলে মেরে ফেলবে।”

“মাথা ঠান্ডা করুন মশাই। তৈরি না হয়ে ওরকম লোকের পাল্লা নিতে গেলে যে মারা পড়বেন! গোকুল তো আর মশা-মাছি নয়!”

“আমি ওর দুটো হরিণ মেরেছি, তার বদলে ও নিশ্চয়ই আমার রিম-ঝিমকে মেরে শোধ নেবে।”

“এ সময়ে ঝোঁকের বশে কিছু করতে যাওয়াটা অবিমৃশ্যকারিতা হবে যে! আগে ঠান্ডা মাথায় ভেবে একটা প্ল্যান করে তবেই এগোনো উচিত।”

“কিন্তু আমার রিম-ঝিমকে যদি মেরে ফেলে?”

“সেই ভয় তো আছেই। তবু আগে একটু ভাবুন, আর পুলিশকেও জানিয়ে রাখুন।”

খগেন মাল ভ্রূকুটিকুটিল মুখে কিছু একটা ভাবছিল। বলল, “মোক্ষম চাল মশাই! আপনার সবচেয়ে দুর্বল জায়গাতেই খোঁচাটা দিয়েছে। উপেনদা ঠিকই বলেছেন, ওরকম লোকের সঙ্গে টক্কর দিতে হলে কোমর বেঁধেই নামতে হবে। নইলে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে আমাদের।”

বিরুবাবু ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর দু’হাতে মুখটা চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

গুঁফো বলাই জানা কানে একটু খাটো, ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগছিল। হঠাৎ বলল, “ওর ছাগলদুটোকে আজই কেটে খেয়ে ফেললেই তো হয়।”

রাখোহরি ধমকের সুরে বলে, “খবরদার ওই ভুল করবেন না। আমার বিশ্বাস গোকুলের চরেরা সব কিছু নজরে রাখছে।”