৫. কালীপ্রসাদ যে আজেবাজে

কালীপ্রসাদ যে আজেবাজে কথা বলার মানুষ নন তা রকি ভালই। জানে। তবে বয়সে মাথার গণ্ডগোল দেখা দিলে অন্য কথা। সাতপাঁচ ভেবে রকি কালীকাকার কথা অমান্য করল না। টেলিফোন পাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্লেনে সিট বুক করল এবং পরদিন বিকেলেই দিল্লি পৌঁছে তার পরদিন সকালের ফ্লাইট ধরে কলকাতায় চলে এল। কালীপুর পৌঁছতে অবশ্য বেলা গড়িয়ে গেল। নৌকো থেকে নেমে যখন ঘাটে উঠছে তখন ঘাটেই কালীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা। নিতাই মাঝির ঝোঁপড়ায় উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন। রকিকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন, “এসেছিস!” বলে কালীকাকা একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আনন্দে।

রকি মৃদু হেসে বলল, “আপনি কি সারাদিন এখানে বসে আছেন নাকি আমার জন্য?”

“বেলা ন’টা থেকে বসে আছি। গতকালও ছিলাম। রাতে ঘুমোতে পারিনি।”

“কিন্তু ব্যাপারটা কী কালীকাকা?”

“আগে বাড়ি চল, তারপর বলব।”

রকি স্নান করে ভাত খাওয়ার পর কালী প্রসাদ তার কাছে প্রায় সবই খুলে বললেন। বাবু মিত্তির যে একসময়ে ডেল্টার হয়ে কাজ করেছেন এবং কিছু-কিছু অত্যন্ত অন্যায় কাজও করেছেন, তাও রেখেঢেকে বললেন।

রকির মুখ শুকিয়ে গেল। সে বলল, “বাবার মুখে তো কখনও এসব শুনিনি। আমেরিকায় যখন ছিলাম তখন ডেল্টার কথা অনেক শুনেছি, খবরের কাগজেও পড়েছি। ওদের ভয়ে সবাই তটস্থ। ওরা যদি বাবার ক্ষতি করতে চায় তা হলে তো ভয়ের কথা।”

“শুধু তোর বাবা তো নয়, এখন তাদের নজর তোর ওপরেও পড়েছে বলে আমার বিশ্বাস। এতদিন ডেল্টা তোর খবর জানত না। কিন্তু বাবু মিত্তিরের কাছে তুই চিঠি লেখার পর তারা সব জেনে গেছে। এখন বাবুকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ডেল্টা আগে তোকে মারবার চেষ্টা করবে।”

রকি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল, “দাঁড়ান, সত্যিই ডেল্টা আমার ওপর অ্যাটেম্পট করেছে কিনা তা এখনই খবর নিচ্ছি।”

রকি তার সুটকেস খুলে একটি অত্যাধুনিক খুদে যন্ত্র বের করল। তারপর কিছুক্ষণের চেষ্টায় আমেদাবাদে নিজের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর সে গম্ভীর মুখে যন্ত্রটা ফের গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “আপনার কথাই ঠিক। আমি যে-ফ্ল্যাটটায় থাকি সেখানে দরজা ভেঙে কারা ঢুকেছিল। ফ্ল্যাট তছনছ করে গেছে। আমার বাড়িওয়ালা পুলিশে আর আমার অফিসে খবর দিয়েছে। ডেল্টার নেটওয়ার্ক তো দেখছি দারুণ ভাল।”

কালী প্রসাদ গম্ভীর মুখে বললেন, “এখন একটাই দুশ্চিন্তা, ওরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে এত দূরেও হানা দেবে কিনা। দিলেই বা আমরা কী করতে পারি।”

রকি মৃদুস্বরে বলে, “কাকা, আমি বক্সার হতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু আমি তো আমার বাবারই ছেলে। অত সহজে ভয় পাই না। আপনি অত দুশ্চিন্তা করবেন না। আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আচ্ছা, বাবা কি ব্যাপারটা পুলিশকে জানিয়েছেন?”

“তা জানি না। তবে পুলিশকে জানালে তেমন কোনও লাভ হবে বলে তো মনে হয় না।”

“তবু জানিয়ে রাখাটা ভাল।”

কালীপ্রসাদ দৃঃখিত গলায় বললেন, “আমাদের দেশের পুলিশ তো কোন ছার, বাবুর কাছে শুনেছি, সে-দেশের পুলিশই তাদের কিছু করতে পারে না। তার ওপর পুলিশ ডাকলে পুলিশেরই ভেক ধরে তারা বাড়িতে ঢোকার সুযোগ পাবে। অবশ্য সুযোগের অভাব তাদের নেই, রেডিয়ো অ্যাকটিভ ছুঁচ তো দিব্যি অনায়াসে বিছানায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেল।”

রকি দমে গেল। বলল, “তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু এখন কী করা যাবে কাকা?”

“তোকে কিছু করতে হবে না। তুই শুধু চুপচাপ একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকবি। তোর একটা ওয়্যারলেস যন্ত্র আছে দেখছি। আগেই বলে রাখি, ওটা দিয়ে আবার ফস করে তোর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলিস না।”

“না কাকা, আমি আর বোকামি করব না।”

নির্জন কালীপুরে ধীরে ধীরে বিকেল নেমে এল। তারপর সন্ধে হল। কালীমন্দিরে আরতি শুরু হল।

কালীপ্রসাদ তাঁর রান্নার ঠাকুর যোগেন আর কাজের লোক ধানুকে ডাকলেন। ল্যাবরেটরিতে তাদের দুজনকে বসিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব হুঁশিয়ার করে দিয়ে বললেন, “তোমরা দুজন আমার বিশ্বাসী লোক। সাহসীও। যদি ভয় পাও তা হলে তোমরা কিছুদিনের জন্য দেশে চলে যেতে পারো। আর যদি থাকতে চাও তা হলে বিপদের ঝুঁকি নিয়েই থাকতে হবে। এখন যা তোমাদের ইচ্ছা।”

ধানু মূকবধির হলেও কালীপ্রসাদের ঠোঁটের দিকে চেয়ে সব কথা বুঝতে পারে। সে মস্ত জোয়ান মানুষ। যে-কাজে গায়ের জোর লাগে সেকাজে তার খুব আনন্দ। সে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বুকে দুটো থাবড়া মেরে জানিয়ে দিল সে থাকবে।

যোগেন একটু বয়স্ক মৈথিলী ব্রাহ্মণ। খুব শান্ত, ধীর-স্থির। বুদ্ধিও রাখে। সে বলল, “কোনও চিন্তা নেই কালীবাবা। আমিও থাকছি।”

কালীপ্রসাদ জানতেন যে, তাঁর বিশ্বস্ত দুই অনুচর কোনও বিপদেই। তাঁকে ফেলে যাবে না। বললেন, “ঠিক আছে। এখন বাড়িতে কোথা দিয়ে শত্রু ঢুকতে পারে তা একটু খুঁজে দেখ। পিছনের দেওয়াল খানিকটা ভাঙা আছে। ওদিকটায় একটু কাঁটাতার লাগালে ভাল হয়। ফটকটাতেও মরচে ধরেছে।”

যোগেন একটু ইতস্তত করছিল। যেন কিছু একটা বলতে চায়। খুব মৃদু একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “বাড়িতে নিশুত রাতে নানারকম শব্দ হচ্ছে। আগে হত না। তিন-চারদিন ধরে শুনতে পাচ্ছি।”

কালীপ্রসাদ সচকিত হয়ে বলেন, “কীরকম শব্দ?”

“কেউ যেন চলাফেরা করে।”

“আগে বলিসনি কেন?”

“বললে তো আপনি হেসে উড়িয়ে দেবেন। এ বাড়িতে মানুষ ঢোকে, প্রেতাত্মারাই ঘুরে বেড়ায় হয়তো।”

কালীপ্রসাদ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “সাবধান থাকি, এখন যা।”

রাতে আজ একটু তাড়াতাড়িই খাওয়া সেরে রকি তার ঘরে শুতে চলে গেল। পথশ্রমে ক্লান্ত সে। কালীপ্রসাদ একা নানা ভাবনা-চিন্তা নিয়ে ল্যাবরেটরিতে বসে লেখালেখি করতে লাগলেন। সময়ের জ্ঞান ছিল না। কিন্তু হঠাৎ একটা চেনা বোঁটকা গন্ধ পেয়ে ঘন-ঘন বাতাস শুকলেন। কালীপ্রসাদ সুন্দরবনের মানুষ। সবই তাঁর নখদর্পণে। জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছে। উপরন্তু তিনি নিজেই একসময়ে বাঘ পুষতেন। সেই বাঘের নামই দিয়েছিলেন ‘হালুম। কুকুরের মতোই পোষ মেনে গিয়েছিল। আট বছর বয়সে সে হয়ে উঠেছিল পেল্লায় চেহারার। সেই সময়ে বিষাক্ত সাপের কামড়ে সে মারা যায়। আজও সেই শোক ভুলতে পারেন না কালীপ্রসাদ।

গন্ধটা যে নির্ভুল কোনও বাঘবাবাজির গায়ের গন্ধ, তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু বাঘ এলে জানান পড়ে যায়। কালীপুর সুন্দরবনের প্রত্যন্ত প্রদেশে হলেও বাঘের জঙ্গল এখন দূরে সরে গেছে। এ-অঞ্চলে গত পাঁচ-সাত বছরে বাঘের আনাগোনা নেই। তবে বাঘ এল কোথা থেকে?

কালীপ্রসাদ চুপিসারে উঠলেন। নিঃশব্দে প্রথমে পুবের জানালার কাছে এসে খুব আস্তে পাল্লা ফাঁক করলেন। এদিকে গন্ধটা তেমন তীব্র নয়। জানালা বন্ধ করে উত্তরদিকের জানালায় গিয়েও পরীক্ষা করলেন। এদিকে গন্ধ আরও কম। এবার ধীরে ধীরে গিয়ে দক্ষিণের জানালাটা একটু ফাঁক করতেই ভক করে গন্ধটা যেন নাকে ধাক্কা মারল। বাইরে ঘন কুয়াশা। খুব ঠাণ্ডা। গাছের পাতায় শিশির পড়ার শব্দ হচ্ছে টুপটাপ। অন্ধকারে আর কিছু দেখা গেল না।

কালীপ্রসাদ ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার দক্ষিণের জানালায় এসে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বাইরে চেয়ে রইলেন। অজ পাড়াগাঁয়ে থাকেন বলেই কালীপ্রসাদের চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। চট করে অন্ধকার সয়ে যায়। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে তিনি বাগানের গাছপালা, ঝোঁপঝাড় সবই চিনতে পারছিলেন। কোথাও কোনও নড়াচড়া বা শব্দ নেই। ধৈর্য হারালেন না। বাঘ অতিশয় চতুর জন্তু। চট করে ধরা দেয় না। পনেরো মিনিট থেকে আধঘণ্টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলেন। সামনেই মল্লিকার ঝাড়। পর-পর অনেক গাছ। তারই ভিতর থেকে খুব ধীরে ধীরে একটা মস্ত ছায়ামূর্তির মতো বাঘটা উঠে দাঁড়াল। বেশ আলস্যজড়িত ভাবভঙ্গি। একবার যেন মুখটা ঘোরালো জানালার দিকে, যেখানে কালীপ্রসাদ দাঁড়িয়ে আছে। দৃখানা জ্বলন্ত চোখ অন্ধকারে ধকধক করে উঠল। বুকটা কেঁপে গেল কালীপ্রসাদের। বাঘটা একবারই দৃষ্টিক্ষেপ করে দুলকি চালে ধীর গতিতে আরও দক্ষিণের দিকে চলে গেল।

কালীপ্রসাদ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। গাঁয়ে বাঘ আসাটা খুব সুখের ব্যাপার নয়। সুন্দরবনের সব বাঘই মানুষখেকো। বাঘের খবরটা জানান দেওয়া দরকার। ছাদে উঠে ক্যানেস্তারা পেটালে গাঁয়ের লোক সতর্ক হয়ে যাবে।

কালীপ্রসাদ উঠতে যাচ্ছিলেন। টেবিলে রাখা ট্রানজিস্টার রেডিয়োতে স্ট্যাটিকের মৃদু শব্দ পেয়ে থামলেন। রেডিয়োর খবর শোনাটা তাঁর নেশার মতো। গানটানও শোনেন। রেডিয়োটা খুলে রেখেই কাজ করছিলেন। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন বলে বন্ধ করতে ভুলে গেছেন। রেডিয়োটা বন্ধ করতে নবের দিকে হাত বাড়াতেই শুনতে পেলেন, “দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো… ওহে কালীপ্রসাদ, ক্যানেস্তারা পেটানোর দরকার নেই।”

ভয়ে হিম হয়ে গেলেন কালীপ্রসাদ। রেডিয়ো থেকে এ কার গলা শুনছেন তিনি? এ কি তারাপ্রসাদ নাকি?

রেডিয়ো আর কিছু বলল না। নব ঘোরাতে গিয়ে বুঝলেন, রেডিয়ো বন্ধই ছিল।

সভয়ে কালীপ্রসাদ তারাপ্রসাদের উদ্দেশে হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “তাই হবে।”

কালীপ্রসাদ দোতলায় নিজের ঘরে এসে চটপট শুয়ে পড়লেন। শরীর শীতে আর ভয়ে কাঁপছিল। তবে ঘুমিয়ে পড়তেও দেরি হল না।

সকালবেলায় উঠে একগাছা মজবুত পাকা বাঁশের লাঠি হাতে বাগানটা তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখলেন কালীপ্রসাদ। কোথাও বাঘের চিহ্নমাত্র নেই। যোগেনকে গাঁয়ে পাঠালেন বাঘ কোনও মানুষ বা গোরু-ছাগল নিয়ে গেছে কি না। যোগেন এসে বলল, “কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে বুড়ো তারিণীখুড়ো বাঘের গন্ধ পেয়েছেন। শাকিলের গোয়ালে গোরুরা খুব দাপাদাপি করেছে রাতে। তার বেশি কিছু নয়।”

তারপর পায়রা-দৃত মারফত একটা খবর পাঠালেন বাবু মিত্তিরকে, “চিন্তা করিস না। বিপদে পড়লে কালীপুরে চলে আসিস। মরলে সবাই একসঙ্গে মরব। কালীপুর অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গা। অচেনা লোক এলে জানাজানি হয়ে যায়। কলকাতায় তো সেই সুবিধেই নেই।”

কালীপ্রসাদের খুব ইচ্ছে, পুত্র-বিরহে কাতর বাবু মিত্তিরের সঙ্গে রকির দেখা-সাক্ষাৎটা এখানেই হোক, তাঁর চোখের সামনে।

এর পর রকিকে খুঁজতে গিয়ে কালীপ্রসাদ দেখেন, সে ঘরে নেই। বিছানা পরিপাটি করে তোলা। বাথরুমে নেই। কোথাও নেই। কালীপ্রসাদ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। রকি গেল কোথায়?

যোগেনকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে যোগেন বলল, “দাদাবাবু তো হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে খুব ভোরবেলা দৌড়তে বেরোলেন।”

কালীপ্রসাদের দুশ্চিন্তা তবু রয়ে গেল। রকির বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম। হুট করে বেরিয়ে পড়েছে, বিপদের কথাটা মাথায় না রেখেই। কালীপ্রসাদ উদ্বেগে বেরিয়ে পড়লেন। হাটখোলা, কালীমন্দির, মালোপাড়া ঘুরে কোথাও পেলেন না রকিকে। দু-চারজনকে জিজ্ঞেস করলেন। কেউ দেখেনি তাকে। হতাশ কালীপ্রসাদ ঘাটের কাছে চারদিক দেখলেন। কোথাও নেই। খোঁজ নিয়ে জানলেন, নৌকো করেও ওরকম কেউ আজ কোথাও যায়নি।

ফিরে আসছেন, হঠাৎ অদৃশ্য জায়গা থেকে কেউ ডাকল, “কালীকাকা!”।

কালীপ্রসাদ চারদিকে চেয়ে দেখলেন। প্রথমটায় কাউকে দেখতে পেলেন না। খালের ধারে একটু উত্তর দিকে পাণ্ডুরাজার বিশাল ঢিবি। জঙ্গলে একেবারে দুর্গম হয়ে আছে। পাণ্ডুরাজার ঢিবি নামটা গ্রামবাসীদেরই দেওয়া। এখানে কখনও ও-নামে কেউ রাজত্ব করেছিল বলে জানা নেই তাঁর। তবে ঢিবির মধ্যে কোনও ধ্বংসাবশেষ থাকলেও থাকতে পারে। ডাকটা, মনে হল, ওদিক থেকেই এল। কালীপ্রসাদ

একটু এগিয়ে গিয়ে অনুচ্চ গলায় ডাকলেন, “রকি নাকি রে?”

ঢিবির ওপরে ঝাঁকড়াঝাঁকড়া ঝোঁপঝাড়। তার ভেতর থেকে টুপি মাথায় একটা মূর্তি উঁকি দিল। মুখে একগাল হাসি। রকি।

কালীপ্রসাদ আর্তনাদ করে উঠলেন, “ওখানে কী করছিস? সাপখোপের আস্তানা, বিছুটি গাছ, ভীমরুলের চাক, কী নেই ওখানে?”

রকি তার গলায় ঝোলানো একটা বাইনোকুলার তুলে দেখিয়ে বলল, “ওয়াচ করছি।”

“ওয়াচ করতে হবে না। নেমে আয়। ওটা বিপজ্জনক জায়গা।”

“শীতকালে সাপ বেরোয় না কাকা। ভয় নেই। চিন্তা করছিলেন নাকি?”

“চিন্তা করব না? সাত সকালে কোথায় বেরিয়ে গেছিস!”

“সকালে রোজ দৌড়ই। অভ্যাস। দৌড় শেষ করে ঘাটের দিকে নজর রাখতে এখানে এসে থানা গেড়েছি। এ-জায়গাটা কিন্তু ওয়াচ করার পক্ষে চমৎকার জায়গা।”

বলতে বলতে রকি নেমে এল। কালীপ্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু সন্দেহজনক দেখলি নাকি?”

“না। গাঁয়ের লোকই আসছে-যাচ্ছে। ডেল্টার লোক বলে কাউকে মনে হল না।”

“তা বলে ডেল্টা বসে নেই। আজ হোক কাল হোক তারা হানা দেবেই।”

“ডেল্টা সম্পর্কে আপনি এত জানলেন কী করে কাকা?”

“তোর বাবার কাছ থেকেই সব শুনেছিলাম একসময়ে। আমার কাছে বাবু তো কিছুই গোপন করত না।”

রকি চিন্তিত মুখে বলে, “আমেরিকায় থাকতে আমিও অনেক কিছু। শুনেছি।”

“কী শুনেছিস?”

“পল নামে একটা লোক গোটা অগানাইজেশনকে চালায়। লোকটা ভয়ঙ্কর অহঙ্কারী, নিষ্ঠুর, আত্মকেন্দ্রিক আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

“সে তো হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি।”

“আমেরিকার বিখ্যাত একটা খবরের কাগজে পল সম্পর্কে একটা বিরাট লেখা বেরিয়েছিল। তাতে একটা কথা ছিল। ডেল্টা অগানাইজেশন হিসেবে খুব পাওয়ারফুল বটে, কিন্তু সেটাকে চালায় একটাই লোক। মুশকিল হল, সেই লোকটা না থাকলে গোটা অর্গানাইজেশন ভেঙে ছয়-ছত্রখান হয়ে যাবে। কিন্তু পল এতই আত্মকেন্দ্রিক যে, ডেল্টার নেতৃত্ব আর কাউকে দেবে না। যাকে সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বলে, পলের সেরকমও কেউ নেই।”

“বটে! তা হলে পল মরলেই সব ফরসা?”

“তাই অবস্থা ছিল। কিন্তু পল সম্প্রতি ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে এবং নিজের পুরনো সিদ্ধান্ত পালটে অর্গানাইজেশনটাকে ডিসেন্ট্রালাইজড বা বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করছে! ফলে দলে প্রাধান্য এবং পদ পাওয়ার জন্য কিছু গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। দু-চারটে খুন-জখমও হয় দলের মধ্যে। একটা গোষ্ঠী বেরিয়ে গিয়ে পালটা অর্গানাইজেশন করে। তবে যতদূর পড়েছি, ডেল্টা সেইসব গণ্ডগোল কাটিয়ে উঠেছে।”

কালীপ্রসাদ সতর্ক গলায় বললেন, “পলের ছেলেপুলে নেই বুঝি?”

“ছিল একটা ছেলে। কিন্তু মেক্সিকো না কোথায় যেন পলেরই বিশ্বস্ত এক অনুচর তাকে এক পার্টির মধ্যে খুন করে পালিয়ে যায়।”

অনুচরটি কে, তা কালীপ্রসাদ জানেন। কিন্তু রকি বোধ হয় জানে না। কাগজে অত কথা নিশ্চয়ই লেখেনি। ভয় আর প্রশ্ন না করে কালীপ্রসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, “বাড়ি চল।”

রকি আনমনে নদীর দিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ সচকিত হয়ে বলল, “দাঁড়ান! একটা নৌকো বা ভটভটি আসছে। এটাকে একটু দেখে নিই।”

রকি দক্ষ হাতে-পায়ে পাণ্ডুরাজার ঢিবির ওপর চোখের পলকে উঠে গিয়ে ঝোঁপঝাড়ে অদৃশ্য হল। কালী প্রসাদ একটু আড়ালে সরে দাঁড়ালেন।

একটু বাদে রকির চাপা স্বর পাওয়া গেল, “কালীকাকা, ভটভটি করে পনেরো-বিশজন লোক আসছে। সঙ্গে মুভি ক্যামেরা এবং আরও সব সরঞ্জাম। মনে হচ্ছে সিনেমার শুটিং করতে আসছে। উঠে আসুন না, দেখবেন।”

কালীপ্রসাদ একটু কষ্ট করেই খাড়া ঢিবিটার ওপর উঠে এলেন। রকি বাইনোকুলারটা এগিয়ে দিল। খুবই শক্তিশালী আধুনিক জিনিস। অন্তত মাইলটাক উজানে ভটভটিটাকে দেখা গেল। সত্যিই অনেক লোক এবং সরঞ্জাম। কালীপ্রসাদ অস্ফুট স্বরে বললেন, “মনে হচ্ছে এরাই। শুটিং নয় রে বাবা, ওটা ওদের মুখোশ।”

কালীপ্রসাদ তাড়াতাড়ি নেমে এসে বুড়ো নিতাই মাঝির ঝোঁপড়ার দজ্জায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

“মাঝি, আছ নাকি?”

“আছি কর্তা। বলুন।”

“সিনেমাওলাদের আসার কথা আছে নাকি এ-গাঁয়ে?”

“আজ্ঞে না।”

“একটা ভটভটি আসছে। তাতে মেলা লোক। কোথায় আসছে বলতে পারো?”

“কত তোক তো কত দিকে যায়।”

ভটভটিটার জন্য কালীপ্রসাদ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন গা-ঢাকা দিয়ে। কিন্তু শেষ অবধি এল না।

রকি নেমে এসে বলল, “ওরা এর আগে আর-একটা খালে বাঁ দিকে। ঢুকে গেল।”

রকিকে নিয়ে কালীপ্রসাদ বাড়ি ফিরে এলেন। পুরনো বন্দুকটা বের করে সারা সকাল সেটাকে সাফ করলেন। ভারী ছ্যাঁচা ইস্পাতে তৈরি। আজও চমৎকার কণ্ডিশনে আছে। গুলিগুলোও বহু পুরনো। রং চটে বিবর্ণ হয়ে গেছে। মোট পঞ্চাশটার মতো কার্টরিজ রোদে দিয়ে দিলেন। ড্যাম্প ভাবটা চলে যাবে।

রকি কাণ্ড দেখে হেসে বলল, “কাকা, এ বন্দুক তুলে তাক করতে করতে ওরা অটোম্যাটিক রাইফেলে ঝাঁঝরা করে দেবে। আমাদের।”