৫. কার পাল্লায় পড়েছেন

কার পাল্লায় পড়েছেন তা আদপেই বুঝতে পারছেন না গবাক্ষবাবু। লোকটা তাকে বগলে চেপে হেঁচড়ে নিয়ে চলেছে। এরকম ভয়ংকর গায়ের জোর যে কোনও মানুষের থাকতে পারে তা গবাক্ষবাবুর জানা ছিল না। অপরাধটা কী করেছেন তাও ভেবে পাচ্ছেন না। মাঝরাতে লোকটা হঠাৎ ঘরে ঢুকে যখন বলল, ছুঁচটা দে–তখন তার ভয়ংকর রক্তাম্বর পরা বিশাল চেহারা আর জ্বলন্ত চোখ দেখে দ্বিরুক্তি না করে ছুঁচটা দিয়ে দেন গবাক্ষবাবু। একটা আহাম্মক লোক হঠাৎ কোথা থেকে ঘরে ঢুকে লোকটার সঙ্গে হাতাহাতি করতে গেল। চোখের পলকে লোকটাকে মেরে রক্তাক্ত করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিল জাম্বুবানটা। সেই সময়ে হঠাৎ হাত পা কেঁপে কেঁপে গবাক্ষবাবুর যখন দাঁতকপাটি লাগার অবস্থা তখনই তাঁর হাতের টর্চটা আচমকা জ্বলে ওঠে। জাম্বুবানটা একটা চিৎকার করে চোখ ঢেকে ফেলল। তারপরই হাত বাড়িয়ে তাকে চেপে ধরে হিঁচড়ে বাইরে এনে বলল, “পথ দেখা। জটেশ্বর জঙ্গলে যাওয়ার পথ দেখা।”

গবাক্ষবাবু ভিরমি খেতে-খেতেও দেখলেন জ্ঞানপাগলা ছুটে আসছে। কিন্তু জাম্বুবানটা তাকেও ডল পুতুলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তীরবেগে এগোতে লাগল আর বলতে লাগল, “পথ দেখা! পথ দেখা!”

চিঁ চিঁ করতে করতে প্রাণভয়ে গবাক্ষবাবু পথ দেখাতেও লাগলেন। কিন্তু ব্যাপারটা কী হচ্ছে, তা বুঝতে পারলেন না। অন্ধকারে তিনিও যে পথ ভাল দেখতে পাচ্ছেন তা নয়। আন্দাজে আন্দাজে বলছেন, “সোজা চলুন। সোজা। মাইলটাক গিয়ে বাঁয়ে কাঁচা রাস্তা। তারপর …”

জটেশ্বরের জঙ্গল অন্তত মাইলতিনেক পথ। কিন্তু জাম্বুবানটা যেন হাওয়ায় ভর করে লহমায় চলে এল। তারপর গাছপালা ভেঙে তছনছ করতে করতে জঙ্গলে ঢুকতে লাগল। লোকটার গায়ে যেমন জোর, তেমনই সহ্যশক্তি। কিন্তু গবাক্ষবাবু তো তা নন। জঙ্গলের ডালপালার খোঁচায় তাঁর শরীর ছড়ে যেতে লাগল, শপাং শপাং করে ডালপালা চাবুকের মতো পড়ছিল সারা গায়ে। গবাক্ষ আধমরা হয়ে গোঁ গোঁ করছিলেন।

একটা সময়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে থামল নোকটা। তাঁকে ছুঁড়ে জলকাদায় ফেলে দিয়ে বলল, “দে, টর্চটা দে।”

টর্চটা যে হাতে আছে তা ভুলেই গিয়েছিলেন গবাক্ষবাবু। কোনওরকমে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এই যে! নিন।”

লোকটা নিতে পারছিল না। অন্ধের মতো শুন্যে হাতড়াচ্ছিল। হঠাৎ বিদ্যুতের মতো মাথায় একটা কথা খেলে গেল তাঁর। লোকটা চোখে দেখতে পাচ্ছে না। এমন সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না।

লোকটা হিংস্র গলায় বলল, “পালানোর মতলব করছিস! পালাবি?”

বলেই লোকটা খঙ্গের মতো কী একটা জিনিস কোমর থেকে খুলে আনল।

কোপটা যেখানে পড়ল সেখানে গবাক্ষবাবুর পা। তিনি সট করে পা দুটো টেনে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে তফাত হলেন খানিকটা।

“কোথায় তুই?”

গবাক্ষ জবাব দিলেন না। কিন্তু বোধ হয় তাঁর শ্বাসের শব্দে টের পেয়ে লোকটা এগিয়ে আসছিল। কী হল কে জানে, গবাক্ষ টর্চটা তুলে সুইচ টিপে ধরলেন।

কেলোর দোকানের শস্তার টর্চ। কখন জ্বলে, কখন জ্বলে না তার কিছু ঠিক নেই।

কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে টর্চটা ধাঁ করে জ্বলে উঠল। আর সোজা ফোকাসটা গিয়ে পড়ল জাম্বুবানটার চোখে। লোকটা খঙ্গ ফেলে দিয়ে চোখ চেপে ‘আ’ করে একটা আর্তনাদ করল।

গবাক্ষবাবু আরও খানিকটা সরে এলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। ভয়ে মরে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু মনে হল টর্চটা থাকলে বোধ হয় বেঁচে যাবেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, টর্চের মতো গুরুতর জিনিস আর দুনিয়ায় নেই। কলকারখানায় সব জিনিস ফেলে শুধু টর্চ তৈরি করা উচিত।

আচমকাই গবাক্ষ শুনতে পেলেন জঙ্গল ভেঙে বাঁদিক থেকে কারা যেন আসছে। জাম্বুবানটার দলবল নাকি? গবাক্ষবাবু তাড়াতাড়ি ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে সরে গেলেন।

চার-পাঁচটা বিশাল চেহারার লোক এসে জাম্বুবানটাকে ঘিরে দাঁড়াল।

কোন ভাষায় যে তারা কথা কইল একবর্ণও বুঝতে পারলেন না গবাক্ষ। কিন্তু তিনি টর্চটা বাগিয়ে ধরে রইলেন।

অন্ধ জাম্বুবানটা কী যেন বলতেই লোকগুলো চটপট চোখে কী যেন পরে নিল। তারপর সোজা এগিয়ে এল তাঁর দিকে।

পট করে টর্চ জ্বালালেন গবাক্ষ। টর্চ জ্বলল বটে, চোখে আলোও গিয়ে পড়ল, কিন্তু ঠুলির মতো কী একটা বস্তু চোখে পরে নেওয়ার ফলে এদের কিছু হল না।

গবাক্ষ আর দেরি করলেন না। পিছু ফিরে ছুটতে লাগলেন। পেছনে লোকগুলো তেড়ে আসছে।

আচমকাই যেন চোখের জ্যোতি বেড়ে গেল গবাক্ষর। তিনি জঙ্গলটা বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন। দিব্যি গাছের ফাঁকে ফাঁকে আঁকাবাঁকা হয়ে পথ করে নিচ্ছিলেন তিনি।

খানিকক্ষণ ছোটার পর মনে হল, পেছনে কেউ আসছে না তো! তিনি হাঁফাতে হাঁফাতে বেদম হয়ে পড়েছেন। না জিরোলেই নয়। একটা গাছে হেলান দিয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ বাদে একটা গণ্ডগোল, অনেক লোকের কথাবার্তা আর চেঁচামেচি কানে এল তাঁর। না, এরা জাম্বুবান নয় বোধ হয়। চোখ খুলে তিনি দেখলেন, এতক্ষণ তাঁর খেয়ালই হয়নি যে, ভোরের আলো ফুটেছে। সেইজন্যই জঙ্গলটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন একটু আগে।

কে যেন চেঁচিয়ে ডাকছিল, “গবাক্ষবাবু। গবাক্ষবাবু!” গবাক্ষ সজনীবাবুর গলা চিনতে পেরে সোল্লাসে চেঁচিয়ে বললেন, “এই যে আমি!”

কিন্তু গলা দিয়ে এমন ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজ বেরোল যে তিনি নিজেই তা শুনতে পেলেন না। তবে তিনি এগিয়ে গেলেন। ছুটতে ছুটতে তিনি জঙ্গলের ধারেই চলে এসেছিলেন কখন যেন। একটু এগোতেই দেখেন সজনীবাবুর পিছু পিছু জ্ঞানপাগলা, নরহরি, অলিন্দ, নৃপেনবাবু, তেজেনবাবু, আরও অনেকে দল বেঁধে হাজির।

সজনীবাবু তাঁকে দু’হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, “বেঁচে আছেন তা হলে! অ্যাঁ। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!”

কাতরকণ্ঠে গবাক্ষবাবু বললেন, “আর কয়েকবার ঝাঁকুনি দিলে বেঁচে থাকব না কিন্তু। জাম্বুবানটা আমাকে আধমরা করে রেখেছে।”

সজনীবাবু তাঁকে আরও দুটো ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে বললেন, “সেই লোকটা কোথায়?”

গবাক্ষবাবু সভয়ে বললেন, “জঙ্গলের মধ্যে।”

ভিড়ের পেছন থেকে ‘জয় কালী’ বলে এগিয়ে এল শ্যামা তান্ত্রিক। পরনে রক্তাম্বর, হাতে শূল। বলল, “কাল মাঝরাতে ব্যাটাকে বাণ মেরে কানা করে দিয়েছিলাম। এবার ব্যাটার মুণ্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলব। বলে কিনা তান্ত্রিক! তন্ত্রের জানে কী ব্যাটা তারা তান্ত্রিক? আসুন আপনারা আমার পিছু পিছু। ব্যাটাকে আমি ঠিক খুঁজে বার করব।”

রোগা চেহারার একটা লোক তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “ও আপনার কর্ম নয় বাবাজি। এ জঙ্গল ঘোর গোলকধাঁধা। পথ আমিই দেখাচ্ছি। দিনমানে তারাবাবা গা-ঢাকা দিয়ে থাকেন। সে জায়গা আমরা কয়েকজন মাত্র চিনি।”

শ্যামা হেঁকে উঠে বলল, “খবর্দার, ওকে বাবা-টাবা বলবি না।”

“যে আজ্ঞে।”

“তুই কে?” লোকটা বলল, “আজ্ঞে প্রিয়ংবদ। কেউ কেউ পঞ্চাও বলে। আসুন।”

পঞ্চা গহিন থেকে গহিনতর জঙ্গলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। গাছ আর লতাপাতার জড়াজড়ির মধ্যেও একটা সংকীর্ণ শুড়িপথ যে আছে তা বোঝা যাচ্ছিল। পেছনে বিস্তর লোক কথা কইছে। পঞ্চা বলল, “কর্তারা কথা কইবেন না। বাবার ধ্যান ভেঙে গেলে কুপিত হবেন।”

শ্যামা ধমক দিল, “ফের বাবা?”

“আজ্ঞে আর হবে না।”

পঞ্চা যেখানে নিয়ে এল সেটা ঘোর জঙ্গলের মধ্যে একটু পরিষ্কার জায়গা। তবে ওপরে বড় বড় গাছের ডালপালায় বেশ অন্ধকার। সামনে নরকরোটি দিয়ে তৈরি একখানা ঘর। অনেকটা তাঁবুর মতো দেখতে। ঢোকার দরজার পাল্লা বন্ধ। পঞ্চা বলল, “ওই হল বাবার সাধনগৃহ।”

শ্যামা তাকে এবার শুলের খোঁচা দিয়ে চাপা গলায় বলল, “ফের বাবা বললে এ-ফোঁড় ওফোড় করে দেব।”

সবাই ঘরটার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

জ্ঞান এগিয়ে এসে হাত তুলে সবাইকে শান্ত থাকতে ইঙ্গিত করল। চাপা গলায় বলল, “এটা আমার লড়াই। আমি নয়নগড়ের যুবরাজ জ্ঞান, বিদ্রোহ দমনের জন্য আমি মহারাজ প্রণন্দের পাঞ্জা নিয়ে এসেছি।”

সবাই অবাক চোখে চেয়ে রইল। ভিড় ছেড়ে কয়েকজন লোক এগিয়ে গিয়ে জ্ঞানের পাশে দাঁড়াল। তারা কিছুই করল না, শুধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে ঘরটার দিকে চেয়ে রইল। তেজেনবাবু মৃদুস্বরে নরহরিকে বললেন, “ওরা বোধ হয় ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করছে।”

হঠাৎ একটা করোটি ঘরের মাথা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল। তারপর আরও একটা। আরও একটা। তারপর হঠাৎ হুড়মুড় করে গোটা ঘরটাই ধসে পড়ে গেল। করোটি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। আর সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে পাঁচটা বিশাল চেহারার ভয়ংকর লোক উঠে দাঁড়াল।

“কে! কে তোরা! এত সাহস! ধ্যান ভাঙলি।”

জ্ঞান অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, “বিদ্রোহী মাজুম, রাজা প্রণন্দের নামে আমি তোমাকে ও তোমার সঙ্গীদের নির্বাসন দণ্ড ঘোষণা করছি।”

সঙ্গে সঙ্গে মাজুমের মুখ যেন রাগে ফুলে দুনো হয়ে গেল। সে হিসহিস করে বলল, “ওঃ তুমি! তুমি যুবরাজ জ্ঞান! আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছ কাপুরুষ!”

বলেই জ্ঞানের গলার শব্দের নিশানা তাক করে সে তেড়ে এল। হাতে খঙ্গ। জ্ঞান সরে গেল বিদ্যুৎগতিতে। তারপর আর হিতাহিতজ্ঞান রইল না মাজুম আর তার স্যাঙাতদের। তারা চারদিকে অন্ধের মতো খঙ্গ চালাতে লাগল। খচাং খচাং করে চারদিকে গাছের ডালপালা কেটে পড়তে লাগল। সভয়ে লোকেরা দূরে সরে গাছগাছালির আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখতে লাগল।

যুদ্ধ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না। হঠাৎ একটা মোটা গাছের আড়াল থেকে সজনীবাবু বেরিয়ে এসে হাতের মোটা বেতের লাঠির বাঁকানো হাতলটা মাজুমের পায়ে ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টান মারতেই সে পাহাড়ের মতো পড়ে গেল মাটিতে। জ্ঞান বিদ্যুৎগতিতে গিয়ে তার কোমরে হাত দিয়ে দুটো কাঁচের শিশি বের করে নিল।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মাজুম। বলল, “কুমার, এটা অন্যায় হচ্ছে। আমার জান ফিরিয়ে দাও। কাপুরুষের মতো কাজ কোরো না।”

“এটা তোমার কাপুরুষতার জবাব। মাজুম, শান্ত হও। মাথা পেতে দণ্ডাজ্ঞা গ্রহণ করো। নয়নগড়ে তোমাদের আর স্থান নেই। খঙ্গ ফেলে দাও মাজুম, শান্ত হও। তোমাদের এই পৃথিবীতেই বাস করতে হবে। বন্ধুভাবে।”

জ্ঞান সজনীবাবুর দিকে ফিরে বলল, “আপনি সাহসী। অনেক ধন্যবাদ। এবার আমরা চলে যাব।”

জ্ঞান ও তার সঙ্গীরা পাশাপাশি দাঁড়াল। স্থির। জ্ঞান একটা শিশি শূন্যে তুলে কিছুক্ষণ ধরে রইল। তারপর হাতটা সরিয়ে নিল ম্যাজিশিয়ানের মতো। আশ্চর্য! শিশিটা পড়ল না। শুন্যে একটা ঘড়ির কাঁটার মতো ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগল। ঠিক এক মিনিটের মাথায় ধীরে ধীরে আবছা হতে লাগল তারা। জ্ঞান হাত তুলে বলল, “বিদায়।” পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। সবাই থ’ হয়ে দৃশ্যটা দেখল।

মাজুম ও তার সঙ্গীরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সজনীবাবু হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বললেন, “ওহে মাজুম, নবাবগঞ্জে থাকতে চাও? তা শত্রু হিসেবে, না বন্ধু হিসেবে?”

মাজুম খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে খড়গটা ফেলে দিল। তারপর দু’হাত ওপরে তুলে স্খলিত কণ্ঠে বলল, “বন্ধু! বন্ধু!”

শ্যামা তান্ত্রিক একগাল হেসে সজনীবাবুকে বলল, “ভাববেন না। ব্যাটাদের আমি আমার চেলা করে নেব’খন।”