৫. করালী স্যারের অঙ্কের ক্লাস

করালী স্যারের অঙ্কের ক্লাস। ছাত্ররা এখন আর অঙ্ককে অঙ্ক বলে না, বলে ভয়াঙ্ক। ভয় আর অঙ্ক সন্ধি করে এই নতুন শব্দটা তারা বানিয়ে নিয়েছে।

তা ভয়াঙ্কই বটে। ক্লাসে যেসব অঙ্ক করানোর কথা, সেসব তো আছেই, তাছাড়াও করালীবাবু ছাত্রদের অঙ্কে পোক্ত করে তুলবার জন্য বাইরের বই থেকে যত রকম ম্যাথমেটিক্যাল প্রবলেম নিয়ে এসে ছাত্রদের দেন।

আজ করালীবাবু ক্লাসে এসে হাসি-হাসি মুখে বললেন, “মাই লিটল ফ্রেন্ডস, কাল ভোর রাতে আমি স্বপ্নে একটা অঙ্ক পেয়েছি, খুব ইন্টারেস্টিং।”

ছেলেরা নড়ে-চড়ে বসল, করালীবাবু স্বপ্নে অঙ্ক পান, এটা খুব বেশি নতুন কথা নয়। এর আগেও বহুবার তিনি স্বপ্নে অঙ্ক পেয়েছেন। তবে কিনা করালীবাবুর কাছে যেটা সুখ-স্বপ্ন, সেটাই তাঁর ছাত্রদের কাছে দারুণ দুঃস্বপ্ন!

করালীবাবু বললেন, “বুঝলে, ভোররাতে দেখি আমি একটা জুতোর দোকানের কর্মচারী হয়ে কাজ করছি।”

বুরুন লাস্ট বেঞ্চে বসে ছিল। আজকাল সে এখানেই বসে। অঙ্কে ফেল করার পর থেকে সে ভাল ছেলেদের সঙ্গে ফাস্ট বেঞ্চে বসতে লজ্জা পায়। পিছনের বেঞ্চে ছাত্র কম, বুরুনের পাশে আর-একজন মাত্র বসে আছে, সে হল ফটিক। কালীবাবুর কথা শুনে ফটিক বিড়বিড় করে বলল, “খুব ভাল হত তাহলে। বাঁচতুম।”

বুরুন জবাব দিল না, আজকাল সব সময়ে তার মন খারাপ থাকে।

করালীস্যার হেসে বললেন, “বুঝলে সবাই! জুতোর দোকানের কর্মচারী। তা আমার বেশ ভালই লাগছিল। দোকানের মালিকটি ভালমানুষ গোছের, হিসেব-টিসেব বোঝে না। লাভ-ক্ষতি বা লেনদেনে হিসেবের গোলমাল বুঝলেই আমাকে ডেকে জিগ্যেস করে, আচ্ছা কালীবাবু, হিসেবটা কী হবে বলে দিন তো! যাই হোক, কাজটা আমার বেশ ভালই লাগছিল। খদ্দের এলে জুতো বের করছি, পরাচ্ছি, পছন্দ হল বা ফিট করল কিনা দেখছি, মাঝে-মাঝে মুখে-মুখে অঙ্ক কষে মালিককে হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছি। বেশ লাগছে। এমন সময়ে এক খদ্দের এলেন। একজোড়া জুতো তাঁর পছন্দ হয়ে গেল। দরদস্তুর করে কুড়ি টাকায় রফা হল। তিনি মালিককে একশো টাকার একটা নোট দিলেন। মালিকের ক্যাশ বাক্সে তখন অত টাকা ছিল না, আমাকে নোটটা দিয়ে বললেন, করালীবাবু পাশের দোকান থেকে টাকাটা ভাঙিয়ে আনুন তো।… লিটল ফ্রেন্ডস, তোমরা খুব মন দিয়ে ট্রানজ্যাকশানগুলো লক্ষ করো। …হ্যাঁ, তারপর আমি তো পাশের দোকানে গিয়ে একশো টাকার নোট ভাঙিয়ে এনে মালিককে দিলাম। মালিক কুড়ি টাকা রেখে খদ্দেরকে আশি টাকা ফেরত দিলেন। খদ্দের জুতোর বাক্স বগলে নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু একটু বাদেই পাশের দোকানের মালিক এসে সেই একশো টাকার নোটটা আমার মালিককে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘মশাই, এ নোর্টটা জাল, এটা বদলে দিন।‘ মালিক নোটটা ভাল করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, ‘তাই তো, বড্ড ঠকিয়ে গেছে দেখছি!’ এই বলে মালিক ক্যাশ বাক্স থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে একশো টাকা নিয়ে দিয়ে দিলেন। পাশের দোকানের লোকটা চলে গেল। তারপর মালিক অনেকক্ষণ অঙ্ক কষে বের করার চেষ্টা করলেন তাঁর কত ক্ষতি হল। কিন্তু লোকটা ভারি বোকাসোকা ভালমানুষ গোছের, তাই কিছুতেই হিসেব মেলে না। একবার উ-হুঁ-হুঁ করে উঠে বলেন, ও বাবা, আমার দুশো টাকা লস হয়েছে। আমি জিগ্যেস করলাম, কি করে? তিনি বললেন, খদ্দেরকে আশি টাকা দিলাম, দোকানদারকে একশ টাকা, আর এক জোড়া জুতো–দুশো দাঁড়াচ্ছে। আবার বলেন, না না, মোট আশি টাকা গচ্চা গেছে দেখছি..ঐ যাঃ, হিসেবের ভুল, একশো টাকা আর কুড়ি টাকার জুতো, মোট একশো কুড়ি টাকা গেল। আবার বলেন, না, না, এক জোড়া জুতো ছাড়া আর তো আমার কিছুই যায়নি…না না, আবার সেই ভুল। দোকানদারকে যে একশো টাকা দিলুম।…যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তিনি আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে বললেন, করালীবাবু, আমার কত দণ্ড গেল তা একটু হিসেব করে বলে দেবেন?…মাই ফ্রেন্ডস, আজকের প্রথম অঙ্ক এটাই। ভেরি সিম্পল অ্যারিথমেটিক। বলতে গেলে ক্লাস টুর অঙ্ক। জলবৎ তরল। তিন মিনিট সময় দিচ্ছি, কষে ফেল।”

সবাই খাতা খুলে খস খস করে কষে ফেলছে।

বুরুনও কষে ফেলল। বেশি সময় লাগেনি তার। মিনিট দেড়েক বড়জোর। খাতা নিয়ে কালীবাবুর কাছে জমা দেবে বলে যখন উঠতে যাচ্ছে, তখন কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলল, “আঃ, যাচ্ছেতাই ভুল করলে যে! করালীবাবুর ডাস্টারের বাড়ি খেতে যাচ্ছ নাকি?”

বুরুন প্রথমে ভেবেছিল, ফটিক কথা বলছে। কিন্তু চেয়ে দেখল, ফটিক বেঞ্চের একেবারে ওই প্রান্তে বসে গোয়েন্দা-গল্পের বই পড়ছে চুরি করে।

তবে কে বলল কথাটা? কানের কাছে কে যেন ফিক করে একটু হেসে বলে ওঠে, “ভয় পেলে নাকি?”

বুরুন তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে নিচু স্বরে বলে, “আমি কাউকে ভয় খাই না।”

না-দেখা লোকটা তখন গলার স্বরটা খুব দুঃখের করে বলল, “তুমি দেখছি খুব উদ্ভট ছেলে। যাকগে, কী আর করা! বরং তোমার একটু উপকার করে দিয়ে যাই। দাও খাতাটা, অঙ্কটা কষে দিই।”

বুরুন একটু ইতস্তত করে বলল, “খাতাটা দিলে করালীবাবু দেখতে পাবেন যে!”

“তাহলে তুমি খাতা খুলে পেনসিল ধরে বসে থাকো, আমি তোমার হাত ধরে ধরে লিখিয়ে দিই।”

তাই হল। দশ সেকেন্ডের মধ্যে অঙ্কটা ঠিকঠাক কষে দিয়ে অদৃশ্য নিধিরাম তাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে, “যাও, সবার আগে গিয়ে দেখিয়ে আনো।”

(অঙ্কের উত্তর এখানে দেওয়া হল না। পাঠক-পাঠিকারা সেটা বের করবে।)

বুরুন গিয়ে করালী স্যারকে খাতা দেখাতেই তিনি তার পিঠ চাপড়ে বললেন, “দারুণ!”

আরো কয়েকজন অঙ্কটা তিন মিনিটের মধ্যে ঠিকঠাক কষেছিল, কালী স্যার সকলের পিঠ চাপড়ে দিলেন। করালীবাবু ওইরকমই, খুব সোজা অঙ্কও কেউ করে দিতে পারলে ভীষণ খুশি হয়ে ওঠেন।

পরের অঙ্কটা একটু কঠিন, একটা কিস্তৃত গাড়ির চারটে চাকা চার রকম, একটার ব্যাস তিন ফুট তিন ইঞ্চি, আর একটার তিন ফুট আট ইঞ্চি, তৃতীয়টার চার ফুট দুই ইঞ্চি, চতুর্থটির ব্যাস দুই ফুট এগারো ইঞ্চি, এই কিম্ভুত গাড়িটা যদি পাঁচ মাইল যায় তবে চারটে চাকার কোষ্টা কতবার সম্পূর্ণ এবং কতখানি আংশিক আবর্তিত হবে? করালীবাবু এটার জন্য দশ মিনিট সময় বরাদ্দ করলেন।

সবাই অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। কিন্তু বুরুনের সে ভাবনা নেই। সে অঙ্কটা খাতায় টোকামাত্র নিধিরাম তার হাত ধরে বিশ সেকেন্ডের মধ্যে অঙ্কটা কষে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, “যাও।”

বুরুনকে খাতা হাতে টেবিলের কাছে আসতে দেখে করালীস্যার হাঁ হয়ে গেলেন। খাতা দেখে আরো তাজ্জব। বললেন, “এটা তোমার আগে থেকে কষা ছিল!”

“আজ্ঞে না স্যার, এই মাত্র করলাম।”

“বটে! তাহলে বলতে হয় তোমার ভাগ্যে স্বর্ণপদক রয়েছে।”

এর পরের অঙ্ক চৌবাচ্চায় জল ঢোকা আর বেরোনো নিয়ে, এটা কষতে বুরুনের লাগল তেরো সেকেন্ডের মতো। করালীবাবু অঙ্কে রাইট দিয়ে বললেন, “তুমি অ্যানুয়েলে অঙ্কে যেন কত পেয়েছিলে! বারো না তেরো কী একটা বোধহয়! না হে, তোমার সেই খাতাটা আবার আমাকে দেখতে হবে।”

করালীস্যারের পর অবনীবাবুর ট্রানস্লেশন ক্লাস। তিনি ইংরিজি করতে দিলেন ‘কুল খাইয়া রমেনের দাঁত টকিয়া গিয়াছে। ভবানী পাঠক তো সোজা পাত্র নয়, সে ভালর ভাল মন্দের যম। এই সেই জনস্থান-মধ্যবর্তী প্রস্রবণ, গিরি, ইহার শিখরদেশ সতত সঞ্চরমাণ জলধরপটল সংযোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় সমাচ্ছন্ন…ইত্যাদি।

সবাই কলম কামড়াচ্ছে।

ঠিক চল্লিশ সেকেন্ড বাদে নিধিরাম বুরুনকে ঠেলে দিয়ে বলল, “যাও, হয়ে গেছে।”

বুরুন গেল। অবনীবাবু খাতা দেখে মাথা চুলকে বললেন, “ইংরিজিতে তুই কাঁচা নোস ঠিকই, কিন্তু এত ভাল ইংরিজি বহুঁকাল কোনো ছাত্রকে লিখতে দেখিনি। বাঃ বাঃ। এরকম চালিয়ে গেলে তুই স্কলারশিপ পাবি যে রে!

বুরুন খুব লজ্জার ভঙ্গিতে মাথা নত করে থাকে।

বছরের শুরু, ক্লাস এখনো পুরোপুরি হয় না, পঞ্চম ঘণ্টার পর ছুটি হয়ে গেল। গেম টিচার দুই সেট ক্রিকেটের সরঞ্জাম বের করে দিলেন।

ইস্কুলের পাশে পেল্লায় মাঠে হই-হই করে ক্রিকেট নামল। এক দিকে নিচু ক্লাসের ছেলেরা পার্টি করে খেলছে। অন্য ধারের টিমটা কিছু অদ্ভুত। এতে ফেল করা ছাত্রদের সঙ্গে পাশ করা ছাত্রদের ম্যাচ, গেম স্যার টিম ঠিক করে দিয়েছেন।

বুরুন অঙ্কে ফেল করলেও ক্লাসে উঠেছে। তাই সে পাশ-করাদের দলে। কিন্তু পাশ-করা ভাল ছেলেরা খেলাধুলোয় তেমন মজবুত নয়। অন্য দিকে ফেল করা ছেলেরা সব সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক প্লেয়ার। তারা যেমন দুর্দান্ত ব্যাট করে, তেমনি দুর্ধর্ষ বল। তারা ছোটে, লাফায়, গড়াগড়ি খায় অনায়াসে। তাই আজ খেলার মাঠে পাশ করাদের বড় দুর্দিন।

পাশ করারা ব্যাট করতে নামল টসে জিতে। প্রথম ওভারেই দুজন জখম হয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে বসে পড়ল। দুজন বোন্ড আউট হয়ে গেল। দ্বিতীয় ওভারে আরো একজন আউট, তবে তিনটে রান হল। তৃতীয় ওভারে পর-পর দুজন ক্যাচ দিয়ে ফিরে ৫২

গেল, একজন ভয়ে দান ছাড়ল।

বুরুন ব্যাট ভাল করে না, তবে বল সে ভালই করে। কিন্তু আটজন বসে পড়ায় তাকে ব্যাট করতে নামতেই হয়।

যখন মাঠে নামছে বুরুন, তখন কানের কাছে ফের সেই ফিসফিসানি, “কোনো ভয় নেই, আমি আছি।”

বুরুন গম্ভীর হয়ে বলল, “হুঁ।”

“সেঞ্চুরি করিয়ে দেবো। কিন্তু খোকা, মনে রেখো আমার প্রেস্টিজটা তোমাকে রাখতে হবে।”

“দেখা যাবে।”

বুরুন নেমে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখছিল, ফেল করা হুমদো-হুঁমদো ছেলেরা হাসাহাসি করছে। ফাস্ট বোলার ভুতু তাকে উদ্দেশ করে বলে, “নে, আর দেখতে হবে না। যে পথে এসেছিস, সে পথটাই ভাল করে দেখে রাখ। এক্ষুনি ফিরতে হবে তো।”

ভুতুর দুর্দান্ত বলটা এল। বুরুনকে কিছুই করতে হল না। ব্যাটটা কে যেন তার হয়ে চালিয়ে দিল। আর বলটা জেট প্লেনের মতো ছুটে গিয়ে ইস্কুলবাড়ির দোতলার ছাদে পড়ল। ছক্কা।

আনতাবড়ি মার হয়ে গেছে ভেবে কেউ খুব একটা হাততালি দিল না।

কিন্তু পরের বলটা আবার উড়ে গিয়ে মস্ত শিরীষ গাছে একটা পাখির বাসা ভেঙে নিয়ে পড়ল। ছক্কা।

এবার কিছু ক্ষীণ হাততালি, বুরুনদের ক্যাপটেন অনিরুদ্ধ নিজের ঠ্যাঙের ব্যথার জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতে মাঠের বাইরে থেকে চেঁচাল, “বুরুন, চালিয়ে যা।”

তা, চালাল বুরুন। তৃতীয় বলটা এমন হাঁকড়াল যে, সেটা গিয়ে ইস্কুলের পাশে পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়ির নারকোল গাছের

ডগায় গিয়ে একটা ঝুনো নারকোল সমেত নেমে এল। পণ্ডিতমশাইয়ের বুড়ি পিসি বেরিয়ে এসে চেঁচাতে লাগলেন, “কে রে ডানপিটে বদমাশ। গাছে ঢিল মেরে নারকোল পাড়িস দুকুরবেলা? দাঁড়া, হরকে বলে তিন ঘণ্টা নিলডাউন করিয়ে রাখব?”

পণ্ডিতমশাইয়ের নাম হরপ্রসাদ। পান থেকে চুন খসলেই ছাত্রদের নিলডাউন করিয়ে রাখেন।

পণ্ডিতমশাইয়ের পিসিমা এক হাতে নারকোল অন্য হাতে বলটা কুড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “ওই দেখ, নারকোলের সঙ্গে একটা বেলও পড়েছে দেখছি, তা এ-বাড়িতে তো বেলগাছ নেই, তবে বেল এল কোত্থেকে?”

হর-স্যারের পিসির হাত থেকে বলটা উদ্ধার করা খুব শক্ত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিলডাউন হওয়ার ভয়ে কেউ এগোতে সাহস পাচ্ছে না। খেলা পণ্ড হওয়ার জোগাড়।

বুরুন ফিসফিস করে বলল, “ও নিধিরাম, যাও না বলটা নিয়ে এসো।”

নিধিরাম বুরুনের কানে কানে বেশ রাগ করে বলে উঠল, “বড় যে নাম ধরে ডাকছ! তোমার চেয়ে বয়সে আমি কত বড় জানো? দুশো বছরের বড়। সেটা খেয়াল রেখো।”

বুরুন ফিক করে হেসে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা। নিধিদা বলে ডাকব তাহলে।”

মুহূর্তের মধ্যে একটা ঘূর্ণি হাওয়া উঠে মাঠ পেরিয়ে হর-পণ্ডিতের বাড়ির দিকে ধেয়ে গেল। স্যারের পিসি কিছু বোঝবার আগেই ঝটকা বাতাসে হাতের বলটা ছিটকে আবার মাঠের মধ্যে চলে এল। স্যারের পিসি চেঁচাতে লাগলেন, “ঐ যাঃ, গেল এমন পাকা বেলটা। কী সুন্দর গন্ধ-ওঠা বেলটা ছিল, ভাবলুম আজ পানা করে হরকে খাওয়াব। বাছার পেটটা ভাল যাচ্ছে না…”

পরের ওভার করতে এল কেষ্ট। তার চেহারা দানবের মতো। বল করে না কামান দাগে তা বোঝা শক্ত। তবে ইস্কুলেরই শুধু নয়, এই জেলার সে-ই সবচেয়ে বিপজ্জনক বোলার। তার বলে হয় স্টাম্প ভাঙে, নয় তো ব্যাটসম্যানের পা, আর এ দুটোতে না লাগলে নিঘাত উইকেটকিপারের পাঁজর ফাটবে। তাই কেষ্ট বল করার সময় সবাই ভারি গম্ভীর হয়ে যায়।

তবে কিনা ইস্কুলের এলেবেলে খেলায় সে ইচ্ছে করেই বেশি জোরে বল করে না। আজও সে প্রথম বলটা বেশ আস্তেই দিল। সেই বলে বুরুনের পার্টনার ব্যাট ছুঁইয়ে একটা রান করল।

কেষ্টর দ্বিতীয় বলটাও বেশ আস্তের ওপর ছিল। তবে কি না তার কাছে আস্তে হলেও বলটা তেমন আস্তে বলে আর কারো মনে হল না। একটা লাল সাপের মতো সেটা ধেয়ে এসেই ছোবল তুলল বুরুনের বুকে।

বুরুনের ব্যাট হেলাভরে ওপরে উঠে এমন লাথি লাগাল সাপটাকে যে, সেটা লেজ গুটিয়ে পাখি হয়ে উড়ে গেল মেঘের দেশে।. তারপর চিৎপাত হয়ে পড়ল পাশের মাঠে, যেখানে বাচ্চা ছেলেরা খেলছে। সে-মাঠেও একটা ছেলে ব্যাট হাঁকড়েছে। তাই বলটা কোন্ দলের তাই নিয়ে একটু গোলযোগ বেধে উঠল।

মার খেয়ে কেষ্ট রেগে যাচ্ছে। তিন নম্বর বলটা সে খুব জোরে না হলেও বেশ জোরে দিল। পিচের ওপর বিদ্যুৎ খেলিয়ে সেটা ছুঁতে এল বুরুনকে। কিন্তু বুরুনের ব্যাট আজ বজ্ৰাদপি কঠোর। বলটাকে এমন ঘাড়ধাক্কা দিল যে, সেটা কাঁচুমাচু হয়ে ফের বাতাসে সাঁতরে মাঠ পার হয়ে, ইস্কুলের দেয়ালের চুনবালি খসাল খানিক। দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা আফ্রিকার ম্যাপ হয়ে গেল।

পাঁচ মিনিটে বুরুনের ত্রিশ রান। চারদিকে ফটাফট হাততালি পড়ছে।

কেষ্ট আস্তিন গুটোয়, বুক ভরে দম নেয়। তারপর মাঠের শেষপ্রান্তে গিয়ে তার বল করার দৌড় শুরু করে। তার মানে এবার কেষ্ট তার সবচেয়ে জোরালো বল দেবে।

বুরুন নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে থাকে। কেষ্টর বলটা সে অবশ্য ভাল করে দেখতেও পায় না। কিন্তু ব্যাট যখন বলটার গায়ে লাগল, তখন তার মনে হল, ব্যাটটা বুঝি ভেঙেই যাবে।

সারদাচরণবাবু জমিদার। তাঁর বাড়ির মাথায় একটা পাথরের পরী দিব্যি ডানা মেলে একশো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। বজ্জাত বলটা গিয়ে পরীর একটা ডানা ভেঙে তবে থামল।

আবার ছক্কা। কেষ্টর পাঁচ নম্বর বলটা আগেরটার চেয়েও জোর। সেই তেজে বলটা প্রায় অদৃশ্য অবস্থায় কখন যে এসেছে, আর কখন যে ব্যাটটা তাকে বেতিয়েছে তা বুরুন জানে না। তবে এবার সেটা গিয়ে একটা খড়-বোঝাই গরুর গাড়ির খড়ের গাদায় সেঁধিয়ে গেল। বলটা এত মারধর পছন্দ করছিল না বোধ হয়, গা ঢাকা দেওয়ার তালে ছিল।

বহু কষ্টে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে গাড়ি থামিয়ে বলটা উদ্ধার করতে হল। সেই ফাঁকে পাশ-করা ছেলেরা এসে বুরুনকে কাঁধে নিয়ে খানিক ধেই-ধেই করে নেচে নেয়। মাঠের বাইরে গিয়ে তারাই আবার ফেল করা ছাত্রদের বক দেখায়।

বিয়াল্লিশ থেকে একশো দুইয়ে পৌঁছতে লাগল মোটে বারো মিনিট। সর্বসাকুল্যে সাতাশ মিনিটে সে সেঞ্চুরি করেছে এবং এখনো আউট হয়নি। ইতিমধ্যেই তার ব্যাট করার খবর পেয়ে প্রথমে গেম টিচার এবং তারপর হেডস্যার সমেত সব মাস্টারমশাই মাঠের ধারে চলে এসেছেন। শহরের লোজনও খবর পেয়ে চলে আসছে। মাঠের চারধারে তুমুল ভিড় হয়ে গেল দেখতে-না-দেখতে।

বুরুনের একটু লজ্জা লজ্জা করছে বটে। কিন্তু সে করবে কী?

সতেরোটা ওভার বাউন্ডারি মেরে একশো দুইয়ের পরও বুরুনকে আবার ধুন্ধুমার ব্যাটের চমক দেখাতে হল। দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করতে বুরুন সময় নিল পঁচিশ মিনিট, আবার সতেরোটা ছক্কা মেরে। আউট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

খুঁতখুঁতে গেম টিচার পর্যন্ত বললেন, “ব্র্যাডমানেরও এরকম রেকর্ড নেই। এ তো ক্রিকেট ইতিহাস পাল্টে দেবে।”

ভাল ছেলেরা আড়াইশোতে দান ছাড়ার পর ফেল করারা ব্যাট করতে এল। বুরুনের হাতে বল। তার কানে কানে নিধিরাম বলল, “চিন্তা নেই।”

তা চিন্তা ছিল না ঠিকই। ফেল করা ছেলেরা ছয় রানে অল ডাউন। বুরুন দুই ওভারে মোট দশটা বল করেছিল, দ্বিতীয় ওভারে চারটের বেশি বল করার দরকারই হয়নি তার। প্রতি বলে একটা করে উইকেট পড়েছে। ট্রিপল হ্যাঁট্রিক সমেত তার বোলিংয়ের হিসেব ১.৪ ওভার, ২ মেডেন ০ রান, ১০ উইকেট। তার দুই ওভারের মাঝখানে একজন আনাড়ি ছেলে এক ওভার বল করেছিল, তাইতে ফেল করারা ছয় রান নেয়।

গেম স্যার বললেন, “ওয়ার্লড রেকর্ড।” কিন্তু তাঁর বিস্ময়ের এই সবে শুরু। এ তো গেল ক্রিকেটের বৃত্তান্ত।

.

ঠিক পনেরো দিন পরে স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টস। খুব তোড়াজোড় করে স্পোর্টস হয় স্কুলে। কারণ স্কুল স্পোর্টসের পরই জেলা স্পোর্টসে স্কুল থেকে ছাত্রদের বাছাই করে পাঠানো হয়। এ-স্কুলের পড়াশুনোয় যেমন, খেলাধুলোতেও তেমনই সুনাম।

বুরুন প্রতি বছরই স্পোর্টসে একটি-দুটি প্রাইজ পায়। বলার মতো তেমন কিছু নয় অবশ্য। তার গ্রুপে সে হাইজাম্পে গতবারও থার্ড প্রাইজ পেয়েছিল, আর দুশো গজ দৌড়ে সেকেণ্ডও হয়েছিল। কিন্তু স্কুলের নামকরা ভাল অ্যাথলেটদের তুলনায় সেগুলো কিছুই না।

স্পোর্টসের দিন দশেক আগে হিট হচ্ছে। কতকগুলো বিষয় গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর গোটা দুই-তিন বিষয় আছে, যা সকলের জন্য। বুরুন তার গ্রুপের সব রকম দৌড় আর লাফে নাম দিল। তাছাড়া দশ হাজার মিটার দৌড়, সাইকেল রেস আর লোহার ভারী গোলা ছোঁড়ার যে বিষয়গুলি সকলের জন্য, তাতেও নাম লেখাল। ক্রিকেটে তার এলেম দেখার পর স্পোর্টসে এতগুলো বিষয়ে নাম লেখানোতে কেউ ডু কোঁচকাল না, বুরুনের ভিতর কী আছে তা তো কেউ জানে না।

হিট শুরু হওয়ার দিনই নিধিরাম উৎসাহের চোটে এমন কেলেঙ্কারি করে বসল যে, বুরুন লজ্জায় মরে যায় আর কী!

প্রথম বিষয় ছিল একশো মিটার দৌড়। গেম স্যার স্টপ ওয়াচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট গেম স্যার হুইসিল বাজিয়ে দৌড় শুরুর সংকেত দেওয়ামাত্র বুরুনের মনে হল, একটা ঝড়ের বাতাস তাকে প্রবল বিক্রমে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমন হল যে, বুরুনের পা প্রায় মাটিতেই ঠেকল না।

দৌড়ের শেষে গেম স্যার মাঠে বসে পড়ে নিজের মাথা চেপে ধরে বললেন, “একশো মিটার মাত্র আট সেকেন্ডে! উঃ, আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।”

সত্যিই অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বুরুন গিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে বলল, “না স্যার, আট সেকেন্ডে নিশ্চয়ই নয়। স্টপ ওয়াচটা বোধহয় খারাপ।”

গেম স্যার ভ্যাবলা দুটো চোখে চেয়ে বললেন, “বলছ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার?”

“ঠিক তো?”

“ঠিকই। অত জোরে আমি দৌড়োইনি।”

গেম স্যার উঠে বললেন, “দৌড়োলে মুশকিল হত। কারণ, ওয়ার্ল্ড রেকর্ডও ওর চেয়ে অনেক বেশি কিনা।”

হাই জাম্পের আগে বুরুন আড়ালে গিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “নিধিদা, এসব কী হচ্ছে বলো তো! বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু গোঁসাই-সদারকে গিয়ে বলে দেব।”

নিধিরাম ভয় খেয়ে বলল, “তা ওয়ার্লড রেকর্ড-টেকর্ড কি আর জানা আছে! আগে থেকে বলবে তো?”

“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার সাবধান।” হাই জাম্পে বুরুন চটপট কাঠি পার হতে লাগল বটে, তবে খুব একটা বাড়াবাড়ি করল না। তাতেও অবশ্য কম কিছু হল না, গেম স্যার মেপে দেখলেন, বুরুন শেষ লাফে ছ’ ফুট ডিঙিয়েছে এক চান্সে। গেম স্যারকে খুবই গম্ভীর দেখাচ্ছিল।

লং জাম্পে বুরুন আরো সাবধান হল। মাত্র বাইশ ফুট লাফিয়ে আর লাফাল না।

গেম স্যার তাকে আড়ালে ডেকে খুব উত্তেজিতভাবে বললেন, “শোনো বুরুন, তোমার ভিতর যে কী সাঙ্ঘাতিক ক্ষমতা ভগবান দিয়েছেন, তা তুমি হয়তো টের পাচ্ছ না! আমি বলে দিচ্ছি, তুমি অলিম্পিক থেকে একাই অন্তত এক ডজন সোনার মেডেল নিয়ে আসবে। এখন থেকে তৈরি হও।”

বুরুন খুব লজ্জার হাসি হাসল। সারা মাঠে তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাকে দেখবার জন্য ছেলেরা ভিড় করছে। শহরের লোকেও চলে আসছে কাণ্ড কারখানা দেখতে।

স্পোর্টসের দিন দুপুরে মাঠ ভেঙে পড়েছে ভিড়ে। শুধু এ। গঞ্জই নয়, আশেপাশের এলাকা থেকে, এমন কী, জেলা-শহর থেকেও গাড়ি করে লোক এসেছে। সবাই কানাঘুষো শুনেছে, গঞ্জে নাকি এক সাঙ্ঘাতিক স্পোর্টসম্যানের আবির্ভাব হয়েছে।

বুরুনের কাণ্ড শুনে দাদুও অবাক। নাতির এত এলেম তাঁরও জানা ছিল না। তিনি নাতির শক্তিবৃদ্ধির জন্য একটা ভাল পাঁচন তৈরি করে খাইয়ে দিয়েছেন। তাতে বুরুনের গায়ে যথেষ্ট জোর এসে গেছে।

এক দিকে দাদুর বলকারক পাঁচন, অন্য দিকে নিধিরাম। দুইয়ে মিলে সে এক যাচ্ছেতাই কাণ্ড হয়ে গেল স্পোর্টসে।

পোলভল্টে বাঁশে ভর করে আকাশের দিকে উঠে গেল বুরুন, আড় হয়ে থাকা বার-এর অন্তত দশ ফুট উঁচু দিয়ে। মাপজোক করলে বাইশ-তেইশ ফুট দাঁড়াবে। মাঠ ফেটে পড়েছে চিকারে আর উত্তেজনায়।

একশো মিটার, দুশো মিটার, আটশো মিটার দৌড়, হার্ডল রেস, হাই জাম্প, লং জাম্প, লোহার বল ছোঁড়া–কোটায় বুরুন সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড না করল? শেষে অন্য সব কম্পিটিটাররা মাঠ থেকে পালাতে লাগল চুপিসাড়ে। লোকে বলাবলি করতে লাগল—“এ তো দেখছি সেই হাবু ওস্তাদের ভুতুড়ে কাণ্ড সব। নইলে ঐটুকু পুঁচকে ছেলে অত জোরে দৌড়তে বা অত উঁচুতে-দূরে লাফাতে পারে নাকি?”

স্পোর্টসের পর বুরুন বাড়ি ফিরল ছেলেদের কাঁধে চড়ে, সঙ্গে প্রাইজের বোঝা। দাদু সব দেখেশুনে বললেন–”হবে না! এ পাঁচন যে আমার নিজের আবিষ্কার! ভেলুদের ডাক্তারী শাস্ত্র ঘেঁটে মরলেও এসব নিদান পাবে না।”