আমি ওকে কথাটা বলে দিতে চাই।
কেন চাও? এতদিন পর কেন চাইছ?
ইট মাস্ট এন্ড সামহোয়ার। অভিনয় করে যাওয়ার আর কোনও মানে হয় না। সত্যটা প্রকাশিত হোক।
তুমি তো কোনওদিন ওর বাবার ভূমিকায় অভিনয় করোনি। তুমি তো ওকে সারাজীবন বুঝিয়েই দিয়েছ যে, তুমি ওর কেউ নও। আবার নতুন করে কেন তা বোঝাতে যাবে?
ওর আসল বাবা কে তা কি ওর জানা উচিত নয়?
কী দরকার? আমি যা করেছি তার শাস্তি আমি পাব। ওকে কেন? ওর তো কোনও দোষ নেই।
সমাজে ও আমার পরিচয়ে পরিচিত হবে কেন?
শোনো, ও কি আর এখন ওর স্কুলকলেজের সার্টিফিকেটে বাবার নাম বদলাতে পারবে? পারবে না। উপরন্তু ওকে যদি সব বলে দাও তা হলে ও পাগলের মতো হয়ে যাবে। ওর এত ক্ষতি তুমি করবে কেন?
আমি ওকে আমার ইনহেরিটর করতে চাই না রীণা। তোমাকে আগেও বলেছি। দীর্ঘদিন আমার টাকায় ও প্রতিপালিত হয়েছে। এডুকেশন, বোর্ড অ্যান্ড লজিং, একটা পাপের পিছনে আমার গুনোগার কিছু কম দিতে হয়নি। কিন্তু আর নয়।
যদি অজুকে এসব বলার এতই জরুরি দরকার ছিল তোমার তা হলে সেটা বাসুদেব বেঁচে থাকতে বলোনি কেন?
তাতে কী হত?
তাতে ও অন্তত বাসুদেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারত, তাকে প্রশ্ন করতে পারত, বাসুদেবকে বাধ্য করতে পারত ওর ভার নেওয়ার। কেন তা করোনি?
শঙ্কর টক করে প্রশ্নটার জবাব দিতে পারল না।
রীণার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। কান্না জড়ানো গলায় সে বলল, তুমি কি বাসুদেবকে ভয় পেতে?
শঙ্কর দুর্বল গলায় বলল, ভয়! ভয় কেন পাব?
তা হলে বলোনি কেন? তুমি তো বাসুদেবকেও গিয়ে বলতে পারতে, তোমার ছেলের ভার তুমি নাও, আমাকে রেহাই দাও!
বাসুদেবের মুখ দেখতে আমার ঘেন্না হত।
বাসুদেব আর আমি সমান অপরাধী। তুমি আমাকে ঘেন্না করো না?
না।
কেন করো না শঙ্কর?
সেটা তুমিই বলল।
তুমি আমাকে ভালবাসো। এতটাই বাসো যে, আমার সব অপরাধ তুমি মেনে নিয়েছ। এরকম ভালবাসা বোধহয় পৃথিবীতে আর কখনও ঘটেনি। আমি সেজন্য তোমাকে মনে মনে পুজো করি। তোমার জন্যই বেঁচে আছি শঙ্কর। আমাকে আর একবার দয়া করো, অজুকে কিছু বোলো না।
কিন্তু ইনহেরিটেন্স?
শোনো শঙ্কর, ওকে কিছু দিয়ো না তুমি। বাসুদেব ওর জন্য একটা ব্যবস্থা করে গেছে।
শঙ্কর অবাক হয়ে বলে, কী ব্যবস্থা?
বাসুদেব দু’-তিন বছর আগে একবার ফোন করে আমাকে জানিয়েছিল, ওর একটা পাঁচ লাখ টাকার লাইফ ইনশিয়োরেন্স আছে। সেই পলিসির নমিনি অজু।
বেশ তো, তা হলে আর চিন্তা কী? পলিসিটা কোথায়?
আমার কাছে নেই। সেটা বোধহয় আছে শিখার কাছে।
শিখা! বাঃ বাঃ। শিখা সেই পলিসি আদর করে তোমার হাতে তুলে দেবে বুঝি? বাসুদেব স্কাউড্রেল না হলে পলিসিটা তোমার কাছেই গচ্ছিত রাখতে পারত। এটাও হয়তো ওর একট চালাকি।
বাসুদেব খারাপ হলেও ওর বউ শিখা খারাপ নয়। বাসুদেব আমাকে সে কথা অনেকবার বলেছে। শিখা ধার্মিক মহিলা। বাসুদেব শিখাকেই বলে গেছে, সে মারা গেলে যেন পলিসির টাকা অজু পায়।
তা হলে সেটা আদায় করার চেষ্টা করো। নইলে আমাকে অজুর কাছে সবই খুলে বলতে হবে। আমার বয়স হচ্ছে, এখন আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই। ও ছেলেটা এ বাড়িতে থাকলে আমার পক্ষে পিস অব মাইন্ড বজায় রাখা অসম্ভব। ওকে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়।
আমি জানি শঙ্কর। অনেকদিন ধরে তুমি যন্ত্রণাটা আমার মুখ চেয়ে সহ্য করেছ। আর ক’টা দিন সময় দাও। অজু তো নিজেকে তোমার কাছ থেকে সবসময় সরিয়েই রাখে। পারতপক্ষে সামনে আসে না।
তা আসে না, কিন্তু এক ছাদের তলায় তো আমাদের থাকতে হচ্ছে। সেটা আমি আর বরদাস্ত করতে রাজি নই।
হঠাৎ তুমি খেপে উঠলে কেন বলো তো! এতদিন যখন সহ্য করলে তখন আর কয়েকটা দিন পারবে না? তোমাকে বলতে হবে না, অজুকে যা বলার আমিই বুঝিয়ে বলব। আমার সন্দেহ হয়, অজু বোধহয় সব জানেও।
কী করে বুঝলে?
আমি মা। মায়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে।
জেনে থাকলে ভাল কথা। এটাও ওর জানা দরকার যে, আমার বিষয়-সম্পত্তির কিছুই ও পাবে না। কোনও এক্সপেকটেশন থাকলে সেটা এখনই নিবিয়ে দেওয়া ভাল।
ও কিছু এক্সপেক্ট করে না। ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বাসুদেবের পাঁচ লাখ টাকা যদি পায় তা হলে ও এখনই নিজের আলাদা ব্যবস্থা করে নেবে।
শঙ্কর একটু চুপ করে থেকে বলল, তাতেও যে সমস্যা মিটছে তা নয়। আইনের চোখে ও আমারই ছেলে। স্কুলে কলেজে সর্বত্র ওর বাবার নাম শঙ্কর বসু। কাজেই আমি মরলে ও দাবি তুলতে পারে। আমি সেই সম্ভাবনাটাও মেরে দিতে চাই। আমি চাই ওকে লিগ্যালি ডিজওন করতে।
সেটা কীভাবে করবে?
আমার কাছে একটা ডকুমেন্ট আছে।
কীসের ডকুমেন্ট?
তোমাকে লেখা বাসুদেবের একটা চিঠি। অনেকদিন আগে পুনায় একটা অল্পবয়সি ফুটবল টিমের ম্যানেজার হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে তোমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। চিঠিটা আমি তোমাকে দিইনি, লেটার বক্সে চিঠিটা পেয়ে নিজের কাছেই রেখে দিই।
একটু চুপ করে থেকে রীণা ক্ষীণ গলায় বলল, কী আছে সেই চিঠিতে?
প্রেমের কথাটথা আছে। রীতিমতো প্যাশনেট চিঠি। তবে যেটা ভাইট্যাল তা হল, অজুর পিতৃত্ব নিয়ে বড়াই আছে। এমন কথাও লিখেছে, কোকিলছানা কাকের বাসায় বড় হয়, কিন্তু কাক তা টের পায় না। কিন্তু এক্ষেত্রে কাকটা জেনেশুনেই কোকিলছানাকে লালনপালন করছে।
কী বিশ্রী কথা!
বাসুদেবের কাছ থেকে রুচিকর কিছু আশা করাই তো ভুল।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রীণা হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আশ্চর্য!
কীসের আশ্চর্য?
তুমি বাসুদেবকে ঘেন্না করো, অজুকে ঘেন্না করো, কিন্তু আমাকে করো না। কেন বলল তো! আমাকেই তো তোমার সবচেয়ে বেশি ঘেন্না করা উচিত।
আমাদের মধ্যে একথা নিয়ে আলোচনা অনেকবার হয়েছে।
হয়েছে, কিন্তু তবু আমি বুঝতে পারি না। তুমি তো পাথর নও।
আমি ওথেলো হলে তুমি খুশি হতে?
রীণা অন্ধকারে চুপ করে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, না, তা নয়। মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো?
কী মনে হয়?
মনে হয় তুমিও আমাকে ঘেন্না করো, কিন্তু সেটা বুঝতে দাও না।
শঙ্কর পাশ ফিরে শুয়ে বলল, ঘুমোও রীণা। কালকেই পলিসিটা উদ্ধারের চেষ্টা করো। ওটা ভাইট্যালি ইম্পর্ট্যান্ট। অজুকে লিগ্যালি ডিজওন করতে হলে ওই পলিসিটাও কাজে লাগবে।
তুমি সত্যিই অজুর পরিচয় প্রকাশ করে দেবে?
নয় কেন? সত্য পরিচয়েই তো পরিচিত হওয়া ভাল। আমি উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি।
রীণা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অনেক ডিভভার্সি মেয়ে সন্তান নিয়েও তো নতুন স্বামীর ঘর করতে আসে। এই তো নীচের ফোর ডি ফ্ল্যাটের রজত রায়ের বউ বিন্দি।
তুমি কি আমাকে এটাও সেরকম বলে ধরে নিতে বলছ।
তোমাকে বলা আমার অন্যায় হবে। কারণ তুমি তো অনেক করেছ। কিন্তু দেখো, বিন্দির আগের পক্ষের দুটো বাচ্চাকেই তো ওর বর অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে। ড্যাডি বলে ডাকেও।
শঙ্কর একটু ঝাঝালো গলায় বলল, শোনো রীণা, এ ব্যাপারটা ওরকম নয়। বাসুদেব এবং তুমি যা করেছিলে তা আমার কাছে লুকোওনি পর্যন্ত। দিনের পর দিন তোমরা আমাকে তো অপমানই করেছ।
রীণা এবার সামান্য দৃঢ় গলায় বলল, তুমি ভুলে যেয়ো না, আমি ডিভোর্স চেয়েছিলাম। তুমি হাতে পায়ে ধরে সেটা রদ করেছ। করোনি?
শঙ্কর এক ফুৎকারে যেন নিবে গেল। স্তিমিত গলায় বলল, করেছি।
তোমার কাছে কিছুই গোপন ছিল না শঙ্কর, এতকাল তুমি সব মেনেও নিয়েছ। আজ হঠাৎ বিদ্রোহ করছ কেন? বাসুদেব মারা যাওয়ার পরই কেন এই বিদ্রোহ? এতকাল কেন চুপ করে ছিলে তুমি? বাসুদেবকে কি তুমি ভয় পেতে?
অন্ধকারে শঙ্করের গলাটা বিকৃত শোনাল, ভয়! ওকে ভয় পাব? কেন ভয় পাব ওই—
যে শব্দটা জিবে এসে গিয়েছিল তা বস্তিবাসীর মুখের শব্দ, ভদ্রলোকের নয়। শঙ্কর আজ অবধি অত খারাপ কথা মুখে আনেনি। তার রুচিতে বাধে। তাই শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। সে এটা বোঝে, ঘটনাটা নিয়ে একটা বিতর্ক হলে সে হয়তো জিতবে না। বাসুদেব তো রীণাকে বিয়েই করতে চেয়েছিল। শঙ্করকে ডিভোর্স করতে আটকাত না রীণারও। বাধা তো দিয়েছিল শঙ্করই।
আজ একটু হাঁসফাস করছে শঙ্কর।
রীণা তার কপালে হাত রেখে বলল, তোমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি শান্ত হয়ে ঘুমোও। এটা মনে রেখো, তুমি একজন মহৎ মানুষ। আমি তোমাকে খুব শ্রদ্ধা করি। তোমার দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
শঙ্কর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর তার শরীরে চাপা কান্নার থরথরানি টের পেল রীণা। নিজেকে উন্মুক্ত করল সে। তারপর জড়িয়ে ধরল শঙ্করকে। কিছুক্ষণ পর একটা সন্ধিতে এল তারা। স্বামী-স্ত্রী প্রত্যাবর্তনের অযোগ্য পয়েন্ট থেকে মাঝে মাঝে এভাবেও ফিরে আসে পরস্পরের কাছে।
পরদিন সকালে রীণা একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে শিখার কাছে যাবে। যাওয়া ছাড়া তার আর গতি কী?
তাদের ভাব-ভালবাসার সময়ে বাসুদেব তাকে বলত, দেখো, আমার সঙ্গে বনিবনা হয় বটে, কিন্তু শিখা খুব ভাল মেয়ে। খুব সৎ, দয়ালু এবং বিশ্বাসযোগ্য।
রীণা প্রশ্ন করত, তোমার সঙ্গে বনিবনা হয় না কেন?
আমি তো একটু আউটরেজিয়াস, বড্ড বেশি লাউড অ্যান্ড অ্যাগ্রেসিভ। আমার সঙ্গে কম লোকেরই বনে। সে কথা নয়। নিরপেক্ষ বিচার করলে শিখা কিন্তু ভাল মেয়েই। তেমন সুন্দরী নয়, ছলাকলা জানে না, স্টিল শি ইজ অ্যাডোরেবল।
যখন টেলিফোনে বাসুদেব তাকে লাইফ ইনশিয়োরের কথা জানিয়েছিল তখন তার একটা বিচ্ছিরি হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। বলেছিল, অজু আমার ছেলে। তার প্রতি আমার কিছু কর্তব্য ছিল, যা আমি করিনি। আমি একটা পলিসি করেছি পাঁচ লাখ টাকার, বোনাসটোনাস নিয়ে ম্যাচুরিটিতে অনেক টাকা দাঁড়াবে। একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল, কতদিন বাঁচব কে জানে। পলিসিটা শিখার কাছে আছে। তাকে সব বলেছি। আমার কিছু হলে শিখার কাছে ওটা চেয়ে নিয়ে।
রীণা একটু অহংকারের সঙ্গে বলেছিল আমি কেন যাব? আমার কী দায়? শোনো রীণা, শিখার কিছু ত্যাগ আছে তোমার আর আমার জন্য। আমি চাই আমি মরে গেলে অন্তত একবার তোমাদের দেখা হোক। না হয় দু’জনে আমার নিন্দেই কোরো। তবু তোমাদের দেখা হোক।
আজ রীণার আর অহংকারটা নেই। অদূর ভবিষ্যৎ ভেবে ওই পাঁচ লাখ টাকা তার উদ্ধার করা দরকার। এই নাটকটা বাসুদেব কেন করতে গেল তা বুঝতে পারছে না রীণা। পলিসিটা অনায়াসে তাকেই পাঠাতে পারত বাসুদেব। না হলে কোনও অ্যাটর্নির কাছে গচ্ছিত রাখা যেত। শিখার কাছে কেন? শিখার সঙ্গে রীণাকে মুখোমুখি দাঁড় করানোরই বা কোন প্রয়োজন? এসব নাটক রীণার সহ্য হয় না। কিন্তু অজুর মুখ চেয়ে এই নাটকটা তাকে করতেও হবে।
সকাল সওয়া আটটায় অফিসে বেরিয়ে গেল শঙ্কর। অজু ফিরল আটটা চল্লিশে। মুখে ঘাম, গায়ের সাদা টি-শার্ট ভিজে সপসপ করছে। লিভিং রুম থেকে হলঘরে অজুকে দেখতে পাচ্ছিল রীণা। ও কি তার পাপের প্রতীক? পাপই বা বলবে কেন রীণা? পাপ কেন? সে একজনকে একসময়ে সত্যিকারের ভালবেসেছিল। ও তো সেই ভালবাসারই সন্তান।
অজু কিছুক্ষণ খালি গায়ে পাখার নীচে বসে থাকল। তারপর বাথরুমে গেল।
ধীর পায়ে খাওয়ার টেবিলে এল রীণা। রামু খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে। মুখোমুখি চেয়ারে সে বসে রইল চুপচাপ।
হাই মাম্মি। আজও নিরামিষ নাকি?
রীণা একটু থতমত খেল। নিরামিষের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। গত তিন দিন অজু নিরামিষ খাচ্ছে। কোনও প্রশ্ন করছে না। ও কি জানে? সন্দেহটা বড় কাটা কাটা লাগছে বুকের মধ্যে, না জানলেও জানবে। পলিসিটা যদি পাওয়া যায় তা হলে অজুকেই ক্লেম দাখিল করতে হবে। অজু তখন কি প্রশ্ন তুলবে না, বাসুদেব সেনগুপ্ত আমার কে?
পোশাক পরে অজু খেতে এল। একটু গোগ্রাসে খায়।
খেতে খেতে বলল, তোমার মুখটা ক’দিন যাবৎ অশোকবনে সীতার মতো হয়ে আছে কেন মা?
শরীর–
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে অজু ধমকে উঠল, ফের শরীর। শরীর নয়, তোমার মন খারাপ।
খারাপ হলেই বা কী করবি? মন খারাপ তো খারাপ।
অজু একটু হাসল, খারাপ মনকে ভাল করে ফেললেই তো হয়। পৃথিবীর কোনও ঘটনাকেই গুরুত্ব দিয়ো না। জাস্ট ইগনোর এভরিথিং।
তা যদি পারতাম!
আমি কিন্তু পারি।
কী পারিস?
ঘটনাবলিকে উপেক্ষা করতে।
তোর আর ঘটনাবলি কীসের? একটুকু তো বয়স!
বয়সটা ফ্যাক্টর নয়। কম বয়সেই অনেকের কত ঘটনা ঘটে থাকে।
অজু, তুই কবে চাকরি পাবি?
পাবই যে এমন গ্যারান্টি নেই। হোটেল ম্যানেজমেন্টেও যা ছাত্রছাত্রীর ভিড়। তা ছাড়া কোর্সও তো শেষ হতে অনেক বাকি। কেন মা?
তুই চাকরি করলে আমার বুকটা হালকা হয়।
আমার মনে হয় আমার বেশ ব্যাবসার মাথা আছে। কিছু টাকা পেলে ব্যাবসা করতাম।
কীসের ব্যাবসা?
একটা হেলথ ক্লিনিক আর মাল্টিপল জিম।
তোর মাথায় ও ছাড়া কিছু আসে না?
যার যে লাইন। ওটা আমি ভাল বুঝি। ঢাকুরিয়া ইজ এ গুড স্পট। ওখানে করা যবে।
ঢাকুরিয়া! হঠাৎ ঢাকুরিয়ায় কেন?
ওখানে আমার একটা ঠেক আছে।
ঠেক! কীসের ঠেক? বন্ধুর বাড়ি নাকি?
হ্যাঁ।
ভাড়া নেবে না?
অজু হাসল, নাও নিতে পারে।
রীণা একটু দ্বিধা করল। তারপর খুব শক্ত হয়ে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলল, শোন অজু, এক জায়গায় তোর কিছু টাকা আছে।
জবাবে অজু কিছুই বলল না। একটু কৌতূহলও প্রকাশ করল না। যেন শুনতেই পায়নি এমন নিস্পৃহভাবে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। আঁচিয়ে সে যথারীতি লিভিং রুমে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে কাগজ দেখল।
চলি মা।
আয়।
একা ফাঁকা বাড়ি। এ সময়টায় খারাপ লাগে তার। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে ততটা লাগে না। মেয়েরও একটি সবসময়ের আয়া আছে। পরমা ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে সামান্য ভাব বিনিময় করে আয়া বাতাসীর সঙ্গে নিজের ঘরে চলে যায়। বাতাসীর সঙ্গেই তার বেশি ভাব।
শিখার সঙ্গে দেখা করার পর্বটা আজই সেরে ফেললে কেমন হয় তাই ভাবছিল রীণা। অপ্রিয় কাজ, কিন্তু অজুর মুখ চেয়ে কাজটা তাকে করতেই হবে। শিখা তাকে অপমান করবে কি? করুক। শিখার অপমানেও হয়তো তার কর্মফল–যদি তেমন কিছু থাকে–ক্ষয় হোক।
রীণা নিজের ঘরে পোশাক পরতে যাবে বলে উঠছিল, এমন সময়ে রামু কর্ডলেসটা এনে তার হাতে দিয়ে বলল, আপনার ফোন।
আবার সেদিনের লোকটা নাকি? ঠিক এরকম সময়েই তো ফোন করেছিল সেদিন।
কে বলছেন?
একটা ভারী কিন্তু ভারী আকর্ষক পুরুষের গলা বলল, আপনি কি মিসেস রীণা বসু?
এ সে নয়। রীণা খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, বলছি। বলুন।
আমি লালবাজার থেকে বলছি। আমার নাম শবর দাশগুপ্ত।
লালবাজার। কী হয়েছে বলুন তো!
কিছু হয়নি। আমি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
কী দরকার?
কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। রিগার্ডিং এ ডেথ।
রীণার বুক কেঁপে উঠল। বলল, ও।
আপনি কি আজ খুব ব্যস্ত আছেন?
আমি একটু বেরোচ্ছিলাম। ঠিক আছে, আসুন।
আপনার ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে আমার বোধহয় কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট লাগবে।
ঠিক আছে।
পঁচিশটা মিনিট রীণার জীবনের যেন মন্থরতম সময়। সে কফি খেল, খবরের কাগজ বারবার ওলটাল। তারপর ঝুম হয়ে বসে রইল।
শবর দাশগুপ্ত খুব লম্বাচওড়া লোক নয়। তেমন সাজগোজও নেই। পুলিশের ইউনিফর্মের বদলে গায়ে সাদামাটা একটা ক্রিমরঙা হাওয়াই শার্ট আর কালো ট্রাউজার। চোখ দুখানা ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ। লোকটাকে দেখলে একটু যেন অস্বস্তি হয়।
শবর প্রথমেই তার আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখাল। তারপর বসল।
চা খাবেন?
খাব। আমি খুব বেশি সময় নিচ্ছি মনে করলে নিঃসংকোচে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন।
মৃদু একটু হাসল রীণা। রামুকে চায়ের কথা বলে এসে সোফায় বসল। বলল, এবার বলুন।
কোথায় যাচ্ছিলেন?
আমার এক বান্ধবীর বাড়ি।
বাধা দিলাম তো!
তাতে কী? পরে যাওয়া যাবে।
ম্যাডাম, আমি একটু সমস্যায় পড়ে এসেছি। আপনার কি মনে পড়ে যে, গত তেরো তারিখে সন্ধের পর আপনি কোথায় ছিলেন?
ও মা, ও আবার কী প্রশ্ন?
বিটকেল শোনাচ্ছে?
তেরো তারিখের কথা আজ কি মনে আছে। ছয় দিন তো হয়ে গেল।
আজ নিয়ে ছয় দিন। দেখুন না মনে পড়ে কি না। প্রশ্নটা অবশ্য রুটিন। তবু বলুন।
কার ডেথ-এর কথা বলছিলেন টেলিফোনে?
সেটা পরে।
হ্যাঁ, তেরো তারিখে আমি সন্ধের পর–না মনে পড়ছে না তো।
রামু চায়ের ট্রে নিয়ে এসে ট্রে-টা নিচু হয়ে সেন্টার টেবিলে রাখছিল। ওই অবস্থাতেই বলল, আপনি ছটায় বেরিয়েছিলেন।
রীণা একটু লাল হয়ে বলে, ও হ্যাঁ। ক্লাবে গিয়েছিলাম।
রামু ফের বলল, ক্লাবে নয়।
তা হলে?
সেদিন আপনার বোনঝির জন্মদিন ছিল। আপনি গিয়েছিলেন সল্টলেক-এ।
ও হ্যাঁ।
শবর হঠাৎ বলল, আপনার স্মৃতিশক্তি কি খুব খারাপ?
না তো। আচমকা জিজ্ঞেস করেছেন বলেই বোধহয় কেমন থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।
কীসে গিয়েছিলেন, গাড়িতে?
না। আমাদের একটাই গাড়ি, সেটা আমার স্বামী ব্যবহার করেন। অফিস থেকে ফিরতে ওঁর রাত হয়। আমি ট্যাক্সিতে গিয়েছিলাম।
ক’টার সময় সল্ট লেকে পৌঁছেছিলেন?
একটু দেরি হয়েছিল। আমার উপহার কেনা ছিল না। সেটা কিনতে একটু সময় লেগেছিল। বোধহয় সাড়ে আটটা হয়ে গিয়েছিল পৌঁছোতে।
আপনার একটি মেয়ে আছে, না?
হ্যাঁ। পরমা।
জন্মদিনের নেমন্তন্নে তাকে নিয়ে যাননি?
ফের একটু থতমত খেল রীণা। তারপর বলল, না। ওর একটা ইম্পর্ট্যান্ট পরীক্ষা ছিল পরদিন। ও পড়ছিল।
আপনার স্বামী বা ছেলে?
ছেলে কোথাও যায় না। খুব লাজুক। তা ছাড়া ওরও কীসব কাজটাজ ছিল। তবে আমার হাজব্যান্ড অফিস থেকেই গিয়েছিলেন।
কত রাতে?
উনি বোধহয় আমি পৌঁছোনোর দশ-পনেরো মিনিট পরে পৌঁছোন।
উপহারটা কোথা থেকে কিনেছিলেন?
উপহার। ওঃ হ্যাঁ। গড়িয়াহাট।
কোন দোকান মনে আছে?
ফ্যান্সি স্টোর্স।
সেখান থেকেই কি আপনি সবসময়ে কেনাকাটা করেন?
ঠিক নেই। ওখানেও করি, অন্য দোকান থেকেও করি।
যতক্ষণ কেনাকাটা করছিলেন ততক্ষণ কি ট্যাক্সিটা ওয়েটিং-এ ছিল?
না। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রেজেন্টেশন কেনার পর আবার গড়িয়াহাট থেকে ট্যাক্সি নিই।
তখন ক’টা?
ঠিক খেয়াল নেই। সাড়ে সাতটা হবে হয়তো।
আপনার চাকরটির নাম কী?
ওঃ, ওর নাম, রামু।
এখন যে কথাটা বলব সেটা ওর শোনা উচিত হবে না। আমরা কি আপনার ওই লিভিং রুমে গিয়ে বসতে পারি?
নিশ্চয়ই।
জুতো খুলে যেতে হবে নাকি?
না না, আসুন।
লিভিং রুমে আজও সকালের রোদ্দুর ঝা ঝা করছে। দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে প্রাক-শরৎ ঋতুর চমৎকার একটা হাওয়া আসছে ঘরে।
আপনার একটি ছেলে আছে।
হ্যাঁ। অজাতশত্রু। রীণা চোখদুটো নত করল। এর পরের প্রশ্ন কোনদিকে যেতে পারে তা ভেবে তার বুক কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল।
আপনি অভয় দিলে বলি, ছেলেটির জন্মবৃত্তান্ত আমি জানি। আপনার অহেতুক সংকোচের কারণ নেই।
বলুন।
ছেলেটি যে বাসুদেব সেনগুপ্তর সেটা কি আপনার হাজব্যান্ড জানেন?
নতমুখে রীণা বলল, জানেন।
তার সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক কীরকম?
ভালই।
নরম্যাল বলছেন। বাপ আর ছেলের মতোই সম্পর্ক?
হ্যাঁ।
স্কুলকলেজে ছেলের বাবার পরিচয় কি আপনার হাজব্যান্ডের নামেই?
হ্যাঁ।
কিন্তু ইনহেরিটেন্সের ব্যাপারটা? উনি কি আপনার ছেলেকে বিষয়-সম্পত্তির ভাগও দেবেন?
সেটা নিয়ে কথা হয়নি।
কখনও নয়?
না।
বাসুদেব সেনগুপ্ত কি কখনও আপনাকে জানিয়েছিলেন যে, ওঁর একটা মোটা টাকার লাইফ পলিসির নমিনি আপনার ছেলে?
হ্যাঁ।
পলিসিটা বা প্রিমিয়ামের রসিদ বোধহয় আপনার কাছে নেই?
না। ওঁর স্ত্রীর কাছে আছে।
আপনার ছেলে কি খবরটা জানে?
না তো!
ঢাকুরিয়ায় বাসুদেববাবুর একটা পুরনো বাড়ি ছিল, জানেন? মস্ত বাড়ি, অনেকটা জমি নিয়ে।
জানি।
সেই বাড়িটা ভেঙে প্রমোটার ফ্ল্যাট তুলছে, জানেন কি?
শুনেছিলাম।
সেই বাড়ির দোতলায় একটা তেরোশো স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাট অজাতশত্রু বসু নামে কাউকে অ্যালট করা আছে। জানতেন?
রীণা অবাক হয়ে মুখ তুলে বলে, জানতাম না তো!
অজাতশত্ৰু বসু এখন বেশ সচ্ছল একটি যুবক। অবশ্য যদি এলআইসির টাকাটা আদৌ সে পায়।
রীণা উদ্বিগ্ন গলায় বলে, পাবে না কেন?
পাবে না বলিনি। তবে পাওয়ার ব্যাপারে বাধা আছে। বাসুদেব সেনগুপ্তের ছেলেরা তো ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখছে না। তা ছাড়া পলিসির আসল নমিনি শিখাদেবী, অজাতশত্রু প্রাপক, যদি শিখা তাকে দেন।
রীণা হঠাৎ খুব করুণ গলায় বলল, দেখুন, আমার তো কলঙ্কিত জীবন, সবাই জানে। আজ আমার লুকোবারও কিছুই নেই। আমার জন্য অজু কেন বঞ্চিত হবে?
বঞ্চনার কথা কেন বলছেন? অজাতশত্রু তো সুখেই আছে এখানে।
রীণা চোখের জল লুকোনোর চেষ্টা করল না। মাথা নেড়ে বলল, নেই, নেই, সুখে নেই।
কেন বলুন তো!
শঙ্কর ওকে দু’চোখে দেখতে পারে না। শঙ্কর পরিষ্কার বলে দিয়েছে ওর একটা পয়সাও অজু কখনও পাবে না। অজুকে শঙ্কর ডিজওন করতে চায়।
শবর কিছুক্ষণ রীণার আবেগ প্রশমিত হতে দিল। তারপর বলল, আপনার ছেলে কি জানে?
কী জানার কথা বলছেন?
ও যে বাসুদেব সেনগুপ্তর ছেলে!
না। আমি ওকে কখনও বলিনি।
আপনি না বললেও বলার লোকের তো অভাব ছিল না।
আমি জানি না ও জানে কি না।
ও কি বাসুদেব সেনগুপ্তর পলিসি বা ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটের কথা জানে?
না তো। ফ্ল্যাটের কথা আমিও এই প্রথম শুনলাম।
আপনার ছেলে কখন বাড়িতে থাকে?
একটু আগেই তো বেরোল। সকালে বেরোয়, রাতে ফেরে।
ক’টার সময় ফেরে?
ন’টা-দশটা।
আপনার স্বামী?
উনি খুবই ব্যস্ত মানুষ। উনি আরও সকালে বেরোন, আরও রাতে ফেরেন।
ছুটির দিনে?
ছুটির দিনেও আমার স্বামীর আউটিং থাকে।
আপনার ছেলে?
ওরও আউটিং থাকে। আচ্ছা, একটা কথা বলবেন? আপনি এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? কী হয়েছে?
বাসুদেব সেনগুপ্তর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় বলে ওঁর আত্মীয়রা সন্দেহ করেছেন। একটা অফিশিয়াল এনকোয়ারি লোকাল থানা থেকে হচ্ছে। আমি কাজটা আন অফিশিয়ালি একটু এগিয়ে রাখছি।
রীণা শবরের দিকে শুকনো মুখ করে চেয়ে রইল। তার বুকের ভিতরে ঘনিয়ে উঠছে ভয় আর ভয়। গলাটা তার খুবই শুকিয়ে গেছে। একটু গলা খাকারি দিয়ে সে স্তিমিত গলায় বলল, কয়েকদিন আগে–বাসুদেব যেদিন মারা যায় তার পরদিন সকালের দিকে একজন আমাকে ফোন করে এ কথাটাই বলেছিল। সে তার নাম বলেনি।
অ্যাননিমাস কল?
হ্যাঁ।
লোকটা একজাক্টলি কী বলেছিল মনে আছে?
একটু ইয়ারকির ভাব ছিল। বলছিল বাসুদেব নরম্যালি মারা যায়নি। তাকে খুন করা হয়েছে।
লোকটা হয়তো সত্যি কথাই বলেছে।
রীণা চোখ বুজল। তারপর ধরা গলায় বলল, আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?
সন্দেহই আমাদের ধর্ম ম্যাডাম।
কাকে সন্দেহ করছেন?
সবাইকেই। কনসার্নড কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। তেরো তারিখে আপনি সল্টলেক থেকে আপনার স্বামীর গাড়িতেই তো ফিরে আসেন?
হ্যাঁ।
গাড়ি কে চালাচ্ছিল, ড্রাইভার?
না। সেদিন ড্রাইভার ছিল না। শঙ্কর গাড়ি চালাচ্ছিল।
উনি কি স্টেডি ছিলেন?
কেন থাকবেন না?
শবর একটু হাসল, চলি ম্যাডাম। আবার দেখা হতে পারে।