২১. একটি নূতন সূত্র
মিঃ আলডিন তার নিজের স্যুইটের ড্রয়িংরুমে বসে পোয়ারোর জন্যে অপেক্ষা করছেন। পোয়ারো ফোনে জানিয়েছেন এগারোটায় আসছেন তিনি।
এগারটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মঁসিয়ে পোয়ারো ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করলেন।
মিঃ আলডিন খুশী হয়ে বললেন, আপনি তো খুব পাংচুয়াল দেখছি।
–হ্যাঁ, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করি পাংচুয়ালিটি বজায় রাখতে। আচ্ছা, এবার কাজের কথা শুরু করা যাক।–সোফায় বসলেন পোয়ারো।
-বলুন।
–প্রথমেই আমি মিস ম্যাসন-এর সঙ্গে আর একবার কথা বলতে চাই। সে এখানেই আছে তো?
–হ্যাঁ, আপনার কথামত তাকে এখানেই রেখেছি। এখুনি ডেকে পাঠাচ্ছি।
কলিং বেল টিপে বয়কে বললেন মিস ম্যাসনকে আসতে।
একটু পরেই মিস ম্যাসন ঘরে প্রবেশ করলেন। পোয়ারো বললেন, বসুন মিস ম্যাসন। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
–সেদিন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আপনি যা যা বলেছেন তার সব কথা মনে আছে তো?
–নিশ্চয়ই।
–আপনি বলেছিলেন, মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় যে লোকটিকে দেখেছিলেন তাকে আপনি চেনেন না–তাই না?
–হ্যাঁ, এবং এখনও সেই কথাই বলছি।
–আচ্ছা, মঁসিয়ে ক্যাথারিনকে আপনি চেনেন নিশ্চয়ই?
–চিনি, তাকে আমি দুবার মাত্র দেখেছি।
কাছ থেকে কি কখনও দেখেছেন?
-না, খুব কাছে দেখিনি। একবার কার্জন স্ট্রীটের বাড়িতে আর একবার পার্কে। বাড়িতে যখন এসেছিলেন তখন আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর মিঃ ক্যাথারিন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলেন। কয়েক সেকেণ্ড মাত্র দেখেছিলাম।
–পার্কে তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেছিলেন কি?
-হ্যাঁ, সেদিন আমি তাকে ভালোভাবে দেখেছিলাম, সেদিন তার সঙ্গে একজন বিদেশিনী মহিলা ছিলেন।
–বিদেশিনী?
–হ্যাঁ, মহিলাটি ইংরেজ নন।
–আচ্ছা, এবার একটু ভেবে বলুন তো, সেদিন মাদামের কামরায় যাকে দেখেছিলেন তার চেহারাটা মিঃ ক্যাথারিন-এর মতো কিনা?
এবার মিস ম্যাসন বিস্মিত স্বরে বললেন, একথা আমি চিন্তাও করিনি স্যার। তিনি মানে
–আপনি হয়তো শুনে থাকবেন মিঃ ক্যাথারিন ওই ট্রেনেই ছিলেন। মাদাম ক্যাথারিন যে ঐ ট্রেনেই যাচ্ছিলেন সে কথাও তিনি জানতেন। অতএব সঙ্গত কারণেই ধরে নেওয়া যেতে পারে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
–কিন্তু স্যার, মাদামের কামরায় যে ভদ্রলোককে দেখেছি তিনি ট্রেনের যাত্রী নন।
–একথা কেন বলছেন?
-কারণ, ওঁর গায়ে ওভারকোট আর মাথায় টুপি ছিল। ট্রেনের কোনো যাত্রী হলে নিশ্চয়ই তিনি ওভারকোট আর টুপি পরে কামরায় যেতেন না।
একদিক দিয়ে ঠিকই বলছেন কথাটা। কিন্তু এমন তো হতে পারে, মঁসিয়ে ক্যাথারিন প্ল্যাটফর্মে নামবার জন্য ওভারকোট ও টুপি পরে করিডরে বেরিয়ে হঠাৎ তার মত পরিবর্তন করে মাদামের কামরায় গিয়েছিলেন। হয়তো করিডরে মাদামের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার পর তিনি আর প্ল্যাটফর্মে না নেমে মাদামের কামরায় মাদামের সঙ্গে ঢুকেছিলেন।
মিস ম্যাসন বললেন, একথাটা আগে আমার মনে হয়নি। কিন্তু আপনার কথায় এখন মনে হচ্ছে হয়তো ঠিক। তবে এ ব্যাপারে আমি হলফ করে কিছু বলতে পারবো না।
পোয়ারো পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বার করে মিস ম্যাসনের হাতে দিয়ে বললেন, দেখুন তো এটা মাদাম ক্যাথারিন-এর সিগারেট কেস কি না?
মিস ম্যাসন ভালো করে দেখলেন এক পিঠে K অক্ষরটা সোনালী রঙে এমব্রস করা রয়েছে। এটা কার বলতে পারেন কি?
সঠিক বলতে পারি না, কিন্তু এটা মাদামের নয়। সিগারেট কেসটা পোয়ারোকে ফিরিয়ে দিল।
–এটা তাহলে মিঃ ক্যাথারিন-এর হতে পারে। কারণ, তাঁর নামের আদ্যক্ষরও K।
–হ্যাঁ, স্যার, আপনার কথাই ঠিক মনে হচ্ছে। মাদাম তার স্বামীকে উপহার দেবার জন্যে একটা সিগারেট কেস কিনেছিলেন। এটা নিশ্চয়ই সেটা হবে।
মিস ম্যাসন আলডিন এবং পোয়ারোকে অভিবাদন জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিঃ আলডিন বললেন, আপনি তাহলে বলতে চান ড্রেকই একাজ করেছে? অথচ গতকাল আপনিই বলেছেন পুলিশ কাউন্টকে সন্দেহ করছে।
-ঠিকই বলেছিলাম মঁসিয়ে।
–তাহলে?
–কি তাহলে?
–এখন তো দেখছি আপনি ড্রেককে সন্দেহ করছেন।
-সন্দেহ করাটাই তো আমার পেশা। কিন্তু আমি যে ড্রেককে সন্দেহ করছি, একথা আপনার মনে হলো কেন?
–মিস ম্যাসনকে জেরার ধরন দেখে।
-তাতেই কি ধরে নিতে হবে আমি মিঃ ক্যাথারিনকে সন্দেহ করছি? না আমি কাউকেই করছি না। আমি শুধু ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে প্রকৃত অপরাধীকে বের করতে চেষ্টা করছি।
-কিন্তু আপনি সেদিন বলেছিলেন কাউন্টকে অনুসরণ করে হার্ট অফ ফায়ার উদ্ধার করেছেন। এবং জিনিসটা আমাকে দেখিয়েছেন।
–সেকথা তো অস্বীকার করছি না মিঃ আলডিন।
-আপনার কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তাহলে রুবীটা বাদ দিয়ে এবার আপনি বুনো হাঁসের পিছনে তাড়া করছেন।
–না মঁসিয়ে, বুনো হাঁসের পিছনে তাড়া করা পোয়ারোর কাজ নয়।
–তাহলে সেই রুবীটা!
-ওটা নকল।
পোয়ারোর কথায় মিঃ আলডিন বিস্ময়ে বিহ্বল হলেন। তাঁর বিস্মিত মুখের ভাব দেখে পোয়ারো বললেন, এবার তাহলে বুঝতে পারছেন তো ঘটনার গতি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে এগোচ্ছে। কাউন্টের পেছনে ঘোরা বৃথা পণ্ডশ্রম।
–কাউন্টকে আপনি আগাগোড়াই হত্যাকারী ভাবেননি।
–তা ভাবিনি, এবং সেকথা আপনার কাছে গোপন রাখিনি।
–তা সত্ত্বেও কি ওই রুবীর ব্যাপারে তাঁকে আপনি সন্দেহ করেননি।
করেছিলাম। কারণ কাউন্ট ওই রুবীটা হস্তগত করার জন্যে মাদাম ক্যাথারিনকে চিঠিতে রুবীটা আনার অনুরোধ জানাল। কাউন্ট জানতেন মাদাম রুবীটা আনবে তাই তিনি আগেই নকল হার্ট অফ ফায়ার যোগাড় করে রেখেছিলেন। অর্থাৎ সুযোগ মত আসলটি হাতিয়ে তার জায়গায় নকলটি রেখে দেবেন। তিনি আরও বুঝেছিলেন মাদাম কখনও আসল নকলের প্রভেদ বুঝতে পারবেন না। আর কেলেঙ্কারীর ভয়ে কোনোদিন বুঝতে পারলেও কথাটা চেপে যাবেন।
–আপনি তাহলে কি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলেন কাউন্ট নকল রুবী সংগ্রহ করে রেখেছেন।
-না তা করিনি। এবং সেই জন্যেই সন্দেহ মুক্ত ছিল না। এখন আর তাকে সন্দেহ করি না।
-এখানে কি আর একটা প্রশ্ন আসে না?
–কি প্রশ্ন মঁসিয়ে?
–কাউন্ট নকল রুবীটা পাচার করার জন্যে এত ব্যস্ত হয়েছিলেন কেন?
–কারণ কাউন্ট বুঝতে পেরেছিলেন পুলিশ তার বাড়ি সার্চ করবে আর তখন নকল রুবীটা পেলে তাকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গ্রেপ্তার করবে। তাই নকল রুবীটা সরাবার ব্যস্ততা।
–এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু ও যদি হত্যাকারী না-হয়, তবে কে এই পাষণ্ড?
-যে গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনে মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিল। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, কে সেই লোক?
তবে কি ড্রেকই আমার সর্বনাশ করেছে?
–সঠিক কিছু বলতে পারছি না। এখন আমার একমাত্র কাজ হবে সেই লোকটাকে খুঁজে বের করা।
আশা করি শীগগিরই তাকে পাবো। আজ উঠি।
নেগ্রেসকো থেকে বেরিয়ে আসতেই মিঃ পোয়ারো দেখতে পেলেন মিঃ ক্যাথারিন একটা মোটর গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির আরোহীর সঙ্গে কথা বলছেন। গাড়ির আরোহীকে দেখে চিনতে পারলেন–মিস গ্রে।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদেরকে লক্ষ্য করলেন, কিন্তু ওরা দেখতে পেল না।
মিনিট দুয়েক পরেই গাড়িটা চলে গেল। মিঃ ক্যাথারিন তখনও দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন চলমান গাড়িটাকে।
মেয়েটি চমৎকার, তাই না মঁসিয়ে?
চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালেন মিঃ ক্যাথারিন। পোয়ারো তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
ক্যাথারিন বললেন, আপনি এখানে?
-মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন কি কিছু বলেছেন আপনাকে? আপনাকে দেখে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছে।
–সব কথাই যে আপনাকে বলতে হবে তার কোনো কারণ আছে কি?
-না না, তা থাকবে কেন! মিষ্টি হেসে পোয়ারো আবার বললেন, আপনি হয়তো দেখতেই পাননি…. আপনি যখন কথা বলছিলেন আরেকটা গাড়ি থেকে অপর একজন মহিলা আপনাকে লক্ষ্য করছিলেন। বাঁ দিকে তাকালে তাকে দেখতে পাবেন।
বাঁ দিকে তাকিয়েই দেখল মিরেলি তাকে লক্ষ্য করছে আরেকটা গাড়িতে বসে।
–ও দেখছি এখনও পেছন ছাড়েনি।
–ও নিশ্চয়ই জানে যে আপনি এখন অনেক টাকার মালিক।
–ঠিক বলেছেন। ওর কাজই হলো মক্কেল বধ করা। অনেক মেয়ের সংসর্গে আমি এসেছি কিন্তু ওর মতো মেয়ে আজও দেখেনি। ওর ওই সুন্দর চেহারার আড়ালে আছে কুৎসিত মন।
–মাদমোয়াজেল, ক্যাথারিনও তো খুব সুন্দরী, তাই না।
মিস ক্যাথারিন-এর সঙ্গে ওর তুলনা করবেন না মঁসিয়ে। ক্যাথারিন হলেন স্বর্গের দেবী আর ও হলো নরকের কীট। আপনি হয়তো ভাবছেন মিস গ্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মিরেলিকে ছেড়ে তার পেছনে ঘুরছি আমি, তাই নয় কি?
–না মঁসিয়ে, এটা ঠিক নয়। মিরেলির সঙ্গে কি সত্যিই সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন আপনি?
-হ্যাঁ।
-তাহলে এগিয়ে যান মাসিয়ে। মিস গ্রে-কে স্ত্রীরূপে পাওয়া যে কোনো পুরুষের পক্ষেই ভাগ্যের কথা।
–কিন্তু তার আগে মিরেলির সঙ্গে একবার বোঝাঁপড়া করতে হবে। কেন ও এখনও আমার পেছনে লেগে আছে তার অবসান ঘটাতে চাই।
দ্রুতপদে মিরেলির গাড়ির দিকে সে চলল। আর পোয়ারো তাঁর বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
হোটেলে ফিরে পোশাক ছেড়ে পোয়ারো সবে বিশ্রাম করতে বসেছেন, হঠাৎ তার টেলিফোনটা বেজে উঠল।
রিসিভার তুলে নিলেন পোয়ারো, হ্যাল্লো–এরকুল পোয়ারো বলছি।
অপর প্রান্ত থেকে মিঃ আলডিন–এর প্রাইভেট সেক্রেটারী। স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। দয়া করে লাইনটা ধরুন।
একটু পরেই আলডিন কথা বললেন, মিঃ পোয়ারো বলছেন কি? আমি আলডিন।
–হ্যাঁ, বলুন। আমি কথা বলছি।
-শুনুন মঁসিয়ে, এইমাত্র মিস ম্যাসন ফোন করে বললেন, আপনার কথা শোনার পর এতক্ষণ ধরে তিনি চিন্তা করেছিলেন। এখন তার দৃঢ় বিশ্বাস সেদিন রুথ-এর কামরায় যাকে দেখেছিলেন সে ড্রেক ছাড়া আর কেউ নয়।
-ধন্যবাদ মঁসিয়ে। এটা সত্যিই একটি দামী খবর।
.
২২.
নাগিনীর বিষ নিঃশ্বাস
মিঃ ক্যাথারিন তার হোটেলে ফিরে আসতেই রিসেপশন ক্লার্ক বললেন, এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
-কে? কি নাম?
–নাম বললেন না। শুধু বললেন, আপনার সঙ্গে তার দরকারী কথা আছে। আমি তাকে অপেক্ষা করতে বলেছি।
-কোথায়?
–সেলুনে।
–ঠিক আছে। আমি এখুনি যাচ্ছি।
সেলুনে ঢুকেই দেখলেন বসে আছেন কাউন্ট দ্য লা রোচি। তিক্ত কণ্ঠে বললেন, আমার মনে হয় এখানে আসাটা নিতান্তই পণ্ডশ্রম হয়েছে আপনার।
–আমার তা মনে হয় না। আমার কথাগুলো শুনলে আপনি বুঝবেন কথাগুলি গুরুত্বপূর্ণ।
–বেশ বলুন, কি বলতে চাইছেন।
–প্রথমে আমি আপনার গভীর শোকের বেদনা জানাই।
–আপনি যদি একথা বলার জন্যে এসে থাকেন তাহলে আপনি আসুন। এসব শোনার সময় আমার নেই।
–ইংরেজদের ভদ্রতাবোধ যে কত কম তা আর একবার প্রমাণিত হল। এবার আমার বক্তব্যটা শুনুন। আপনি এখন বেশ মোটা টাকার মালিক, তাই না?
–তাতে আপনার কি এসে যায়?
–আমাকে পুলিশ আপনার স্ত্রীর হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছে।
–তাই নাকি?
–আমি এ ব্যাপারে একেবারেই নিরপরাধ। আমি আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা করে বলছি….
–আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করে লাভ নেই, ওটা আপনি মঁসিয়ে ক্যারেজ-এর কাছে করলে লাভবান হবেন। তিনি মামলার অ্যাজ দ্য ইনস্ট্রাকশন।
–আমার আরও কিছু বক্তব্য আছে মঁসিয়ে।
–সংক্ষেপে সারুন।
–বর্তমানে আমি খুবই আর্থিক অনটনে পড়েছি। আমার কিছু টাকার দরকার। কাউন্টের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ড্রেক আসন ছেড়ে উঠল।
এই কথাটাই আমি শুনতে চাইছিলাম। কিন্তু জেনে রাখ নরপশু, ব্ল্যাকমেলিং করে আমার কাছ থেকে একটি ফ্রাও আদায় করতে পারবে না।
কাউন্ট দেখলেন যে ক্যাথারিন চলে যাচ্ছেন তাই বললেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন মিঃ ক্যাথারিন। আমি আপনাকে ব্ল্যাকমেল করতে আসিনি। আমি বলতে এসেছি, আপনি যে আপনার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন এর নির্ভরযোগ্য প্রমাণ আছে আমার কাছে। আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে কিছু টাকার বিনিময়ে ব্যাপারটা চাপা দিতে চাই। আশা করি বিষয়টার গুরুত্ব বিবেচনা করে আপনার মতামত এখুনি আমায় জানিয়ে দেবেন।
–আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন?
-না, কাউকে ভয় দেখানো আমার পেশা নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, আপনি ইচ্ছে করলে ব্যাপারটাকে চাপা দিতে পারেন। যে মহিলা আপনার অপকর্মের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী, তার মুখ বন্ধ করতে হলে অবশ্যই কিছু অর্থ ব্যয় করতে হবে আপনাকে। তাছাড়া আমারও কিছু চাই…
–কার কথা বলছেন আপনি? মিরেলি?
–হ্যাঁ তিনিই। এক লক্ষ ফ্রা হলেই মুখ বন্ধ করা যাবে।
–এবার তাহলে আমার উত্তরটা শুনবেন কি?
–নিশ্চয় শুনবো মঁসিয়ে।
–আপনি এখান থেকে সোজা বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথারিন সেলুন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ড্রেক ক্যাথারিন সেলুন থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন মিরেলির হোটেলে। রিশেপশন অফিসে খবর জানতে পারলেন মিরেলি ঘরেই আছেন। তিনি তার নাম ছাপানো কার্ডখানা রিশেপশন ক্লার্কের হাতে দিলেন। আমি তার সঙ্গে এখুনি দেখা করতে চাই।
বয় কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে মিঃ ক্যাথারিনকে বললেন, আপনি আসুন মঁসিয়ে।
তিনতলায় একটা ঘরের সামনে গিয়ে বলল, এই ঘরেই মাদমোয়াজেল থাকেন। আপনি ভেতরে যান।
ড্রেক ঘরে ঢুকতেই মিরেলি চোখ সরাল। তাহলে শেষ পর্যন্ত তুমি এলে? আমি জানতাম তুমি আসবে। এলেই যখন, বসতে আপত্তি হবে না নিশ্চয়ই।
ড্রেক না বসেই বললেন, কাউন্টকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে কেন?
–সেকি! আমি তাকে পাঠাব কেন?–সারা শরীরে বিস্ময় দেখান মিরেলি।
–ব্ল্যাকমেলিং করে কিছু হাতিয়ে নেবার জন্যে।
ড্রেক-এর কথা শুনে মিরেলি বললেন, কাউন্ট যে তোমাকে ব্ল্যাকমেলিং করতে যাবে তা অনুমান করতে পারিনি। আমি তার কাছে গিয়েছিলাম ঠিকই, এবং তোমার ওপরে অভিমান করে কয়েকটা কথা বলেছিলাম কিন্তু আসলে কিছুই না। ওকথা কেবল তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানে না। ড্রেক ডারলিং, মিছিমিছি আমাকে ভুল বুঝো না।
কাছে এগিয়ে এসে ড্রেকের মুখের সামনে নিজের মুখটি তুলে ধরে আবেশে চোখ বুজলো। ড্রেক তাকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তুমি যদি ভেবে থাক আমার স্ত্রীকে আমিই হত্যা করেছি তাহলে মহা ভুল করবে তুমি। আমি এতটা নিচে নামিনি যে টাকার জন্যে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করব।
এবার মিরেলি বিষধর গোখরো সাপের মতো রাগে মাথা তুলে বলল, তুমি এ ব্যাপারে আমাকে ধাপ্পা দিতে পারবে না ড্রেক। এখনও বলছি তুমি আগুন নিয়ে খেলা করো না। সেদিন তুমি বলেছিলে তোমার স্ত্রীর মতো স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীলোক কেবল অ্যাকসিডেন্টেই মরতে পারেন আর কোনো কারণে তোমার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে তুমি তোমার পাওনাদারদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ড্রেক তুমি যদি এখনও আমার কাছে ফিরে আস তাহলে তোমার কথা কোনো তৃতীয় ব্যক্তির কানে যাবে না।
তুমি আমাকে ভয় দেখিয়ে বশ করতে চাও! কিন্তু তোমার যা খুশি তাই করতে পার, আমি আর তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না।
-বেশ, তাহলে তাই হবে। তোমার অপকর্মের সঙ্গী আমি নিজে। আমি নিজের চোখে দেখছি নয়েনশ স্টেশনে ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে তুমি তোমার স্ত্রীর কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছিলে আর তখন তোমার স্ত্রী আর বেঁচে ছিল না।
মিরেলির কথাগুলো শোনার পর নিঃশব্দে ড্রেক কি চিন্তা করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
২৩.
সাবধান বাণী
লেডী টাম্পলিন ক্যাথারিনকে নিয়ে মণ্টিকালোতে এসেছিল। বাগানে দুজনে বসে যখন কথা বলছে তখন কিংটন আর পোয়ারো এসে হাজির হলেন। কিংটনকে দেখে প্রায় ছুটে গেল লেডী টাম্পলিন। কি অশ্চর্য! আপনাকে যে এখানে দেখব সে কথা ভাবতেও পারিনি।
–আমিও ভাবতে পারিনি। ভারী খুশী হলাম আপনাকে দেখে।
–তাহলে আসুন, বেড়াতে বেড়াতে দু-চারটে কথা বলি। সেই হাসপাতালের দিনগুলোর কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে?
কথা বলতে বলতে কিংটনকে অন্য দিকে নিয়ে চলল লেডী টাম্পলিন। পোয়ারো ক্যাথারিন-এর কাছে এসে হাসিমুখে বললেন, আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভালোই হলো আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার খুব দরকার ছিল। মাদমোয়াজেল, জীবনে এমন কিছু ঘটনা আছে যা ঘটবার আগেই তার আভাস পাওয়া যায়। যেমন সূর্য ওঠবার আগেই আকাশে তার আভাস পাওয়া যায়।
–হেঁয়ালিই করবেন, নাকি–আসল কথাটা বলবেন?
–ঐ আমার দোষ। মাঝে মাঝে হেঁয়ালি করতে আমার ভালো লাগে। ঠিক আছে, তাহলে সোজাসুজিই বলি। মিষ্টি করে হেসে বললেন, মিঃ কিংটনকে কেমন লাগে আপনার? যদিও প্রশ্নটা একান্তই আপনার মনের ব্যাপার।
-কথাবার্তায় আলাপে ব্যবহারে তো ভালো লোক বলেই মনে হয় ওকে। কিন্তু হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করার কারণ কি?
–কারণ আর কিছু নয় আমি আপনাকে জীবনে সুখী দেখতে চাই মাদমোয়াজেল। মাঝে মাঝে এমন কিছু লোকের সঙ্গে আলাপ হয় যাদের সুখী দেখলে আমি নিজেও সুখী হই। আপনি তাদেরই একজন।
ক্যাথারিনের মনে হল এ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক। পোয়ারোর এমন গলার স্বর আর কখনও শোনেনি সে। পোয়ারোর কথার আন্তরিকতা, তার ব্যক্তিত্ব ক্যাথারিনকে মন্ত্রমুগ্ধ করল।
পোয়ারো আবার বললেন, আচ্ছা, এবার বলুন মিঃ ক্যাথারিনকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়?
–তাঁর সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানি না।
–এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না।
–আমার কিন্তু মনে হয় উত্তরটা ঠিকই হয়েছে।
–ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন আমি দুনিয়ার অনেক লোক দেখেছি অনেক কিছু দেখেছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে খারাপ স্ত্রীলোকের সংসর্গে এলে ভালো লোকও অনেক সময় খারাপ হয়ে যায়, আবার একটি ভালো মেয়েকে ভালোবেসে কোনো খারাপ লোক তার সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। তা তার ভালোবাসা যতই খাঁটি হোক না কেন।
–সর্বনাশ বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন?
–আমি কারো নাম বলতে চাই না। শুধু একথা জেনে রাখুন যে, এমন কিছু লোকের চেহারা আকর্ষণীয়। আর সেই আকর্ষণে ধরা দেবার উন্মাদনা আমি আপনার মধ্যে দেখেছি। আমি এরকুল পোয়ারো, আবারও বলছি, আপনার এই উন্মাদনা যেন কোনো আকর্ষণেই ধরা না পড়ে লক্ষ্য রাখবেন মাদমোয়াজেল। মন দিতে গিয়ে যে কোনো হত্যাকারীকে বরণ করে ফেলবেন না। আশা করি আমার কথা মনে রাখবেন মাদমোয়াজেল।
হঠাৎই পোয়ারো চলে গেলেন কোনো কথা না বলে। পোয়ারোর যাওয়া দেখতে দেখতে ক্যাথারিন তার কথাগুলো চিন্তা করতে লাগল। তিনি কেনইবা বললেন এই কথাগুলো। তবে কি….
–কি অত তন্ময় হয়ে ভাবছেন বলুন তো?
ক্যাথারিন চমকে তাকাতেই দেখল মিঃ ক্যাথারিন পাশে দাঁড়িয়ে। সম্বিৎ ফিরে এলো তার, কই কিছু না তো! আপনি হঠাৎ কোথা থেকে?
-আর বলবেন না, আমি এতক্ষণ জুয়া খেলছিলাম। খেলতে খেলতে সব টাকা খুইয়ে তবেই ক্যাসিনো থেকে বের হলাম।
–আপনি একজন জুয়াড়ী? –প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল ক্যাথারিনের স্বর।
-আপনি ভীষণ অবাক হচ্ছেন। দেখুন, মানুষের জীবনটাই তো একটা ক্যাসিনো। জন্মালেই মানুষকে ভাগ্যের কাছে জীবনটাকে বাজী রাখতে হয়। তারপর আমৃত্যু চলে সেই বাজী হারা জেতার খেলা। আর আমি খেলি টাকা পয়সা রেখে ক্যাসিনোতে গিয়ে। জুয়া খেলি এই তো?–ঠোঁট বেঁকিয়ে স্পর্ধার হাসি হাসলো ড্রেক; আর পরের ওপর এই যে অনিশ্চয়তার একটা উত্তেজনা। ভালো শিকারী যেমন শিকার দেখলে নিজের প্রাণ বিপন্ন হলেও শিকারের পেছনে ধাওয়া করে, ভালো জুয়াড়ীও তেমনি জুয়ায় সব কিছু হারাতে পারে জেনেও জুয়ার দালাল ধরতে ছুটে যায়।
ক্যাথারিন ড্রেকের এমন বেপরোয়া স্পর্ধিত চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
ড্রেক বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। কে জানে পরে হয়তো কথার সময় হবে না। অনেকের ধারণা আমি নাকি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি। স্রেফ বাজে কথা বুঝলেন, পুলিশের কাছে অবশ্য আমাকে কিছু অল্পস্বল্প বলতে হয়েছে কিন্তু আপনার কাছে কিছু গোপন করব না। আপনাকে পাওয়া মানেই রাজত্বর সঙ্গে রাজকন্যা। সুতরাং আপনাকে নির্ভেজাল সত্যি কথাই আমাকে বলতে হবে। রুথকে বিয়ে করেছিলাম টাকার জন্যে। অবশ্য রুথও আমাকে বিয়ে করেছিল লুকোনবারী হবার জন্যে। কিন্তু ওর টাকা আছে বলে আমি নেপো হয়ে থাকবো আর তিনি কাউন্টের সঙ্গে বৌ বৌ খেলা করবেন। না না, আপনি ভাববেন না আমি অভিযোগ করছি। সে কাহিনী আমার শ্বশুরমশায়ের কাছে ভালোভাবে শুনবেন। অবশ্য একথা সত্যি রুথ-এর মৃত্যুর আগের মুহূর্তে আমার পকেট গড়ের মাঠ ছিল। দেনায় অন্ধকার দেখছিলাম চারদিক আর ঠিক সেই সময় রুথ নিজে মরে আমাকে বাঁচিয়ে গেল।–যেন বড় রকমের একটা জুয়ার বাজী জিতল এমনভাবে হেসে উঠলো ড্রেক।
ক্যাথারিন বুঝি বিরক্ত হলো। কি বিশ্রী? স্ত্রীর মৃত্যুতে কেউ উন্মাদের মতো হো হো করে হেসে স্ফুর্তি দেখায়। অদ্ভুত!
তা লক্ষ্য করেই ড্রেক বলল, বুঝতে পারছি আমার হাসাটা উচিত হয়নি। এবার বলি আমার মনের কথা। সেই যে স্যাভয় হোটেলের বারান্দায় তোমার সঙ্গে ধাক্কা লাগল আমার; সেই ধাক্কার দোলায় এখনও পর্যন্ত হৃদয় দুলছে। বিশ্বাস কর আমার মনে হলো, তোমার মতো মেয়েকেই আমি খুঁজছি। লোকে দুর্নাম দেবে আমার নামে, হা, সত্যি অনেক কথাই তোমাকে হয়তো কোনোদিনই বলা সম্ভব হবে না এমন কুকাজও আমি করেছি। তোমার ভালোবাসা পেলে আমি আবার ভাল হবার চেষ্টা করব। নতুন করে মানুষের মত মানুষ হতে চেষ্টা করব। সে সুযোগ কি আমায় দেবে না ক্যাথারিন? বলতে বলতে ক্যাথারিনের কাঁধে একটা হাত দিয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করল ড্রেক।
ক্যাথারিন খুব ঘাবড়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তবুও অদ্ভুত ব্যাপার ড্রেক-এর আকর্ষণ সে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারল না।
–আমার কথার উত্তর পেলাম না কিন্তু।
–আমি আমি জানি না।
ঠিক এমন সময় দূর থেকে কিংটন আর লেডি টাম্পলিনকে দেখে ক্যাথারিন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
-উনি এতক্ষণ লেডি টাম্পলিনের সঙ্গে প্রেম করছিলেন। কথাটা বলেই ড্রেক সোজা বেরিয়ে গেল।
-মাঝপথ থেকে লেডি টাম্পলিনকে ছেড়ে দিয়ে কিংটন এলো ক্যাথারিনের কাছে। দুজনেই আবার বসল।
কিছুদিন ধরেই আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে সুযোগ খুঁজছিলাম মিস গ্রে। ভালোই হল আপনাকে পেয়ে।
কিংটনও শুরু করল প্রেম নিবেদন, তবে খুব ভদ্র ও বিনয়ের সঙ্গে বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে অবশ্য একটা কথা বলি।
-বলুন।
–কি বলতে চাইছি আশাকরি আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আপনাকে যেদিন প্রথম দেখি আমি মানে–ইতস্ততঃ করতে লাগল কিংটন। আবার অবশ্য এত তাড়াতাড়ি একথা আপনাকে বলা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু কি জানেন, মিঃ আলডিন হয়তো যে কোনোদিন ফিরে যেতে পারেন। তাই বলছি। আমার এই চাকরী ছাড়া ব্যক্তিগত কিছু সম্মতি আছে বটে, অবশ্য খুব বেশি নয়। এই মুহূর্তে আপনার উত্তর না দিলেও হবে। হঠাৎ যদি আমাকে চলে যেতে হয় তাই আপনার মতামতের একটু আভাস পেলে ভালো হয়। আমার কথায় আপনার সম্মানহানি হলে আমায় ক্ষমা করবেন।
কিংটন-এর নম্র ও ভদ্র কথাবার্তা ক্যাথারিনকে আকৃষ্ট করল। তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলেন ক্যাথারিন। লজ্জা নম্র দৃষ্টি একবার কিংটনের মুখের ওপর বুলিয়েই মুখ নিচু করল সে।
কিংটন আলতো করে ক্যাথারিনের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল।
–আর একটা কথা। কোনোদিন কোনো প্রয়োজন হলে বলবেন। যদি কিছু করতে পারি।
সামান্য একটু চাপ দিয়ে একটা ঘামে ভেজা হাতের উত্তাপ নেবার চেষ্টা করল। পর মুহূর্তে হাতটাকে ক্যাথারিন-এর কোলের ওপর নামিয়ে দিয়ে পাশ থেকে উঠে চলে গেল। একবারও পেছনে তাকাল না।
ক্যাথারিন স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ভাবতে লাগল ড্রেক আর কিংটন-এর মধ্যে কত তফাত। ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেছল ক্যাথারিন। কিসের একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে সজাগ করে দিল। ক্যাথারিন-এর মনে হলো, সে যেন একা বসে নেই। হঠাৎ তার মনে হলো পাশেই যেন রুথ এসে দাঁড়িয়েছে। রুথ ক্যাথারিন কি যেন বলতে চাইছে তাকে। রুথ-এর এক ঢাল সোনালী চুলের ভেতর দিয়ে তার করুণ চোখ যেন কিসের এক আকুতিতে ভরে উঠেছে। এক নির্বাক ভাষা যেন ফুটে বেরোতে চাইল রুথ-এর ঠোঁটে।
ক্যাথারিন-এর এতে স্পষ্ট মনে হলো রুথ-এর উপস্থিতি যে সে স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল রুথ শূন্যে। ঘামে ভিজে উঠছে ক্যাথারিন। কিসের আকুতি রুথ-এর চোখে ঠোঁটে ক্যাথারিন দেখল? রুথ কি বলতে চাইছিল তাকে! কি!
.
২৪.
নারীর প্রতিহিংসা ক্যাথারিন-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিংটন পোয়ারোর খোঁজ করতে লাগল। নানান জায়গায় ঘুরে অবশেষে তাকে পাওয়া গেল জুয়ার ঘরে। পোয়ারো তখন মেতে উঠেছে জুয়া খেলায়। একটা জোড় সংখ্যার ওপর অল্প টাকার বাজি ধরে কাটা ঘোরালেন পোয়ারো। কাটা থামল বিজোড় সংখ্যায় এসে।
-ইস! নেহাতই বরাত খারাপ। পাশ থেকে কিংটন আপশোষ জানাল, আবার খেলবেন নাকি?
-না, এখন আর নয়।
–আপনার জুয়া খেলতে ভালো লাগে মঁসিয়ে পোয়ারো? পোয়ারো চোখ তুললেন।
–টেবিলে জুয়া খেলায় ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। ও আমার ভালো লাগে না। আমি জুয়া খেলি বুদ্ধিকে বাজি ধরে।
–আপনি কি এখন ব্যস্ত? আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
–স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। বলেন তো আমরা বাগানে গিয়ে বসি।
–তাই চলুন।
পোয়ারোকে নিয়ে কিংটন বাইরে বেরিয়ে এলো।
-জানেন রিভিয়ারা আমার খুব ভালো লাগে। যেতে যেতে কিংটন বলল, বার বছর আগে একবার এসেছিলাম, অবশ্য আহত সৈনিক হয়ে, আর ভর্তি ছিলাম লেডি টাম্পলিনের সৈনিক হাসপাতালে। সদ্য যুদ্ধক্ষেত্রের পরই রিভিয়ারাকে স্বর্গ বলে মনে হয়েছিল সেদিন।
-মনে হওয়াই স্বাভাবিক।–পোয়ারো সায় দিলেন।
–সে যেন কতদিন আগেকার কথা।–কিংটন যেন স্মৃতিচারণ করতে করতে হাঁটতে লাগলেন।
–আপনার বেশ কিছু কথা বলার আছে আমাকে বুঝতে পারছি।
–ঠিক বলেছেন তো! কেমন করে বুঝলেন?
–আপনার মুখই বলে দিচ্ছে সেকথা।
–আমার মুখ দেখে যে আমার মনের কথা বোঝা যায় এ ধারণা আমার ছিল না। আমি তাহলে জলের মতই স্বচ্ছ বলুন?
-ভুলে যাবেন না, মুখের ভাষা পড়াই আমার প্রধান কাজ।
–আচ্ছা। মিরেলি নামে কোনো পেশাদার নাচিয়েকে চেনেন নাকি মঁসিয়ে।
–মঁসিয়ে ক্যাথারিন-এর প্রেমিকার কথা বলছেন তো? হ্যাঁ চিনি।
–আপনি হয়তো এও জানেন আমার বস মিঃ আলডিন দুচক্ষে দেখতে পারেন না ওকে। মিরেলি আগে একবার চিঠি লিখে মিঃ আলডিনের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আজ একদম আমাদের হোটেলে এসে উপস্থিত। দেখা করবেই, নাছোড়বান্দা।
–বেশ তারপর?
–আর বলবেন না। এদিকে মিঃ আলডিন তো রেগে আগুন। আমাকে ভাগিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। আমার কেবলই মনে হলো মিরেলির যেন খুব প্রয়োজনীয় কিছু বলার আছে। কারণ মিরেলিও সেদিন ব্ল ট্রেনে ছিল, হয়তো কিছু দেখেও থাকতে পারে। আপনি কি বলেন মঁসিয়ে?
-মিরেলিকে প্রত্যাখ্যান করে মিঃ আলডিন বোকামি করেছিলেন।
–বলুন তো, বোকামি করেননি বস্?-উৎসাহিত হলো কিংটন। তারপর শুনুন। আমি মিঃ আলডিনের নিষেধ অমান্য করে ওয়েটিংরুমে মিরেলির সঙ্গে দেখা করে বললাম, উনি তো খুব ব্যস্ত; প্রয়োজনীয় কথা থাকলে আমাকে বলতে পারেন। মিরেলি তাতে রাজী হলো না। আমার বিশ্বাস ওর কাছে কিছু খবর পাওয়া যাবেই।
-মিরেলির ঠিকানা জানেন?
–জানি।
–তাহলে চলুন। এখুনি আমরা তার সঙ্গে দেখা করব।
–কিন্তু মিঃ আলডিন? তাকে কি বলব?
–সে আমি বুঝব। বরং মিরেলিকে গিয়ে বলতে হবে মিঃ আলডিনই আমাদের পাঠিয়েছেন।
কিংটন তখনও ইতস্তত করতে লাগল। তবুও যেতেই হলো পোয়ারোর সঙ্গে কিংটনকে।
–মঁসিয়ে আলডিন-এর নির্দেশে আমরা আপনার কাছে এসেছি মাদমোয়াজেল।
–তিনি নিজে না এসে আপনাদের পাঠালেন কেন?
–তিনি নিজেই আসতেন কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় আমাদের পাঠালেন। উনি তার প্রাইভেট সেক্রেটারী। আর আমি তোর মেয়ের হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারী ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারো।
-আপনিই মঁসিয়ে পোয়ারো। বেশ, তাহলে আর কোনো আপত্তি নেই। আপনারা বসুন, আমি সব কথাই বলব, আমাকে অপমান করা, ও ভেবেছে যে কেউ ওকে দেখতে পায়নি…
–কার কথা বলছেন মাদমোয়াজেল? বললেন পোয়ারো।
–কার কথা আবার। যে লম্পট নিজের বউকে খুন করেছে। হা ড্রেক ক্যাথারিন-এর কথাই বলছি। জানেন সে কি করেছে?
–না তো।
–তা জানবেন কেন? খুনীকে ছেড়ে বুনো হাঁসের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আমি তাকে রেহাই দেব না।
–আপনি একটু স্থির হয়ে বসে সব কথা খুলে বলুন মাদমোয়াজেল। আমি বুঝতে পারছি মিঃ ক্যাথারিন আপনাকে অপমান করায় আপনি এত রেগে গেছেন যে, সব কথা গুছিয়ে বলতে পারছেন না। তাই আপনাকে একটু স্থির হয়ে বসতে বলছি।
পোয়ারোর কথায় তার অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ সে টেবিলের ফুলদানিটা তুলে ছুঁড়ে মারল দেয়ালের গায়ে। ঝনঝন শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেল পোর্সেলিনের সুন্দর ফুলদানিটা; এইভাবে আমিও ড্রেককে খান খান করব ভেঙে….
মিরেলির কথাবার্তা আর চালচলন মোটেই ভালো লাগছিল না কিংটন-এর। পোয়ারো কিন্তু খুশী। তার মনে হচ্ছিল যে, মিরেলির এই উত্তেজনাটা বেশিক্ষণ থাকাই ভাল, সবকথা বেরিয়ে আসবে। আর হলোও তাই।
একখানা চেয়ার টেনে পোয়ারোর মুখোমুখি বসে বলল, স্ত্রীকে খুন করার মতলব আগেই জানিয়েছিল আমাকে।
-বলেন কি!
–ঠিকই বলছি। তাছাড়া আমি নিজে তাকে ক্যাথারিন-এর কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি।
–কখন?
–ট্রেনটা নয়েন স্টেশনে পৌঁছবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে।
–আপনি কি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একথা বলতে রাজী আছেন? মনে রাখবেন, আপনার একথার গুরুত্ব কতখানি। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ ক্যাথারিনকে গ্রেপ্তার কুরআমি এদরি নয়। চা যেন এখানে খাবে না।
-হ্যাঁ, আমি এসব কথা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বলতে রাজী আছি মিঃ পোয়ারো।
–তাহলে আর দেরি নয়। আপনি এখুনি আমার সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চলুন।
–এখুনি।–মিরেলির কণ্ঠস্বরটা যেন একটু দ্বিধাগ্রস্ত।
-হ্যাঁ, এখুনি যেতে হবে। মিঃ ক্যাথারিন এখানে থাকতে থাকতেই তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তিনি ইংলণ্ডে চলে গেলে সহজে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
–বেশ, তাহলে চলুন আমি প্রস্তুত।
আধঘণ্টার মধ্যেই মিরেলি আর কিংটনকে নিয়ে পোয়ারো ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে গেলেন। কমিশনার অব পুলিশও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। ম্যাজিস্ট্রেট কিছুটা আশ্চর্য হলেন ওদের দেখে।
–কি ব্যাপার, মঁসিয়ে পোয়ারো? ইনি কে?
–ইনি হলেন সুবিখ্যাত নৃত্য শিল্পী মাদমোয়াজেল মিরেলি। ইনি আপনার কাছে এসেছেন মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্যে।
ম্যাজিস্ট্রেট তখন মিরেলিকে বললেন, আপনি বসুন মাদমোয়াজেল, আমি এখুনি আপনার বক্তব্য লিখে নেবার ব্যবস্থা করছি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাগজ কলম নিয়ে তৈরি হলেন ম্যাজিস্ট্রেট। এবার আপনার বক্তব্য বলুন, মাদমোয়াজেল।
মিরেলি, সুস্পষ্ট কণ্ঠে তার বক্তব্য শুরু করল। মিরেলির কথা শেষ হলে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আপনার কথাগুলো সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটা ব্যাপার, আপনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলছেন এ ব্যাপারে।
সে কি। আমি কিভাবে জড়িত হচ্ছি?–আপনি বলেছেন, ড্রেক ক্যাথারিন যে তার স্ত্রীকে হত্যা করবে সেকথা আগেই আপনাকে বলেছিল। এই রকম একটা গুরুতর কথা শুনেও আপনি পুলিশকে জানাননি কেন?
-আমার মনে হয়েছিল যে কথাটা তামাশাছলে বলছে।
–তাই যদি হয় আপনিও তার সঙ্গে একই ট্রেনের যাত্রী হলেন কেন?
এই প্রশ্নে মিরেলি যেন বিচলিত হলো কিছুটা; সে বলল, এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবুও আমি বলছি, আমি ড্রেককে ভালোবাসতাম। মানে খুবই। আমি তাই ওর সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম।
এই সময় পোয়ারো চোখ তুললেন, আপনি মিঃ ক্যাথারিন-এর ইচ্ছে অনুসারেই তার সঙ্গিনী হয়েছিলেন?
একটু ইতস্তত করে বলল, এধরণের কাজে আমি আমার ইচ্ছামতই চলি।
যদিও মিরেলির উত্তরটা সন্তোষজনক নয় তবুও পোয়ারো অন্য প্রশ্ন করলেন। মিঃ ক্যাথারিন যে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন, এটা আপনি কখন বুঝতে পারেন?
–নয়েন স্টেশনে পৌঁছবার একটু আগে। ও যখন রুথ ক্যাথারিন-এর কামরা থেকে বেরিয়ে আসছিল, সেইসময় ওর মুখটা কেমন যেন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। ওর চোখের চাউনিও ছিল অস্বাভাবিক। ওর সেই সময়কার চেহারা কোনোদিন ভুলতে পারব না।
-তারপর?
–তারপর ট্রেনটা ছেড়ে যেতেই আমি বুঝতে পারি যে, মাদাম ক্যাথারিন মারা গেছে। মানে, হত্যা করা হয়েছে।
কমিশনার বললেন, একথা জেনেও আপনি পুলিশকে বলেননি কেন?
–যাকে আমি এত ভালোবাসি তাকে কিনা বিপদে ফেলব? না না, এ আপনি কি বলছেন?
–কিন্তু এখন তো তাই চাইছেন?
–এখনকার কথা আলাদা।–মিরেলির দুচোখ রাগে জ্বলে উঠলো। ড্রেক আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাকে অপমান করেছে। এখন আর তার ওপরে আমার কোনো মায়াদয়া নেই।
পোয়ারো বললেন, আর একটা কথা মাদমোয়াজেল। মাদাম ক্যাথারিন যে নিহত হয়েছেন একথা আপনি জানলেন কি করে?
এবার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, কথাটা যাত্রীদের কাছ থেকে শুনেছিলাম। অনেকেই তখন ঐ কথা নিয়ে আলোচনা করছিল। তবে, কার কাছে শুনেছিলাম ঠিক স্মরণ করতে পারছি না।
পোয়ালরা বুঝতে পারলেন মিরেলি মিথ্যে কথা বলছে কিন্তু তিনি বললেন, তা না পারাটা স্বাভাবিক। আচ্ছা, হার্ট অব ফায়ার সম্বন্ধে কিছু জানেন কি?
–হার্ট অব ফায়ার?
–হ্যাঁ, ইতিহাস প্রসিদ্ধ রুবী হার্ট অব ফায়ার। ওটা তখন মাদাম ক্যাথারিন-এর কাছেই ছিল।
না। ও সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। যাক এবার আমি চলি কি বলেন?–ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে। ম্যাজিস্ট্রেট পোয়ারোকে বললেন, আপনার কিছু জিজ্ঞাসা আছে কি?
-না। আমারও কিছু জিজ্ঞাসা নেই।
এরপর কমিশনারকে বললেন ম্যাজিস্ট্রেট, আপনার? মঁসিয়ে কক্স?
-না। আমারও কিছু জিজ্ঞাসা নেই।
–হ্যাঁ, এবার আপনি যেতে পারেন।
–ম্যাজিস্ট্রেট মিরেলিকে যাবার অনুমতি দিলেন। পোয়ারো বলেলেন, আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে হবে কি?
না তার দরকার হবে না।
অফিস থেকে মিরেলি বেরিয়ে গেল।
-আমার সন্দেহ ও আদৌ সত্যি কথা বলল কিনা।–সন্দেহে ভুরু কোচকালেন কমিশনার।
–পুরোপুরি না হলেও বেশির ভাগই সত্যি।
পোয়ারো বললেন, ওর বক্তব্যের সমর্থনে অন্য প্রমাণও আছে। মাদমোয়াজেল ক্যাথারিনও আমকে বলেছেন। মিঃ ক্যাথারিনকে তিনি তার স্ত্রীর কামরায় দেখেছেন।
-কখন।
–নয়েন স্টেশনে পৌঁছবার একটু আগে।
–তাহলে তো দেখছি ঘটনার গতি অন্যদিকে মোড় নিল।-কমিশনার বললেন, আমি ভেবেছিলাম কাউন্টকে এবার হাতে পেয়েছি। কিন্তু পিছলে গেল সে।
ম্যাজিস্ট্রেট বেশ চিন্তিত হলেন। আমাদের এবার খুব সাবধানে এগোতে হবে। মঁসিয়ে ক্যাথারিন অভিজাত বংশের ছেলে। স্ত্রী হত্যার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করলে লণ্ডনের খবরের কাগজে হৈ চৈ পড়ে যাবে। তাই তাকে গ্রেপ্তার করার আগে আমাদের খুব ভালো করে বিচার বিবেচনা করে চিন্তা করতে হবে। কারণ আমাদের ভুল হলে খুবই অপদস্থ হতে হবে সকলের কাছে।
–তা ঠিক। কমিশনার কক্স বললেন, কারণ আমরা এখনও রুবীগুলো সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারিনি। ও ব্যাপারে মিরেলি একেবারে মুখ খোলেনি।
–আর মিঃ ক্যাথারিন যদি রুবীগুলো নিয়েই থাকেন তো নিশ্চয়ই সেগুলোকে বিক্রি করার চেষ্টা করবেন।চশমাটা খুলে ম্যাজিস্ট্রেট টেবিলের ওপর রাখলেন। কিন্তু ওরকম ইতিহাসখ্যাত রুবী খুব সহজে বিক্রি করাও সম্ভব নয়।
–এ সম্বন্ধে আমার একটা নিজস্ব অনুমান আছে। হাসলেন পোয়ারো, তার আগে বলতে পারেন মার্কুইস বলে কোনো লোককে চেনেন কিনা?
–মার্কুইস?–উত্তেজিত হলেন কমিশনার; মার্কুইস-এর কথা জিজ্ঞেস কছেন কেন? আপনার কি মনে হয় সে এর সঙ্গে জড়িত আছে?
-আমি শুধু জানতে চাই আপনি মার্কুইস সম্বন্ধে জানেন কি?
–বিশেষ কিছু জানি না। যতটুকু জানি সে নিজে একজন রীতিমত অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। নিজে হাতে বড় একটা কাজ করে না। তার আজ্ঞাবহদের দিয়েই কাজ সারে সে। এবং যথার্থই সৎ বংশজাত এইটুকুই জানি।
-সে কি একজন ফরাসী?
-হ্যাঁ, সেই রকমই মনে হয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না? কারণ মার্কুইস ফরাসী ইংরেজী এবং আরও কয়েকটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, আর কখনও একজায়গায় থাকে না সে। এই তো গত বছরই সুইজারল্যাণ্ডে একটা মস্তবড় ডাকাতি মার্কুইস-এর কাজ বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু আপনি এসব জানতে চাইছেন কেন?
–এখন নয়।–গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। হয়তো কোনো খবর ইতিমধ্যেই আমার হোটেলে এসে থাকতে পারে।
–কিন্তু মার্কুইস যদি এ ব্যাপারে জড়িত থাকে….ম্যাজিস্ট্রেট বেশ নিরাশই হলেন।
–সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।-কমিশনার মাথা চুলকোতে লাগলেন।
–আমার কিন্তু বেশ সহজ বলেই মনে হচ্ছে।–পোয়ারো দৃষ্টি উজ্জ্বল করলেন। যদি কোনো দরকারী খবর পাই সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের জানিয়ে দেব। চলি।
পোয়ারো খুব চিন্তিত মুখে হোটেলে ফিরলেন। ভৃত্য জর্জ এসে তার হাতে একটা টেলিগ্রাম দিল। টেলিগ্রামখানা দুবার পড়ে সেটাকে পকেটে রেখে আরামকেদারায় বসতে বসতে বললেন, জর্জ, এক কাপ চকোলেট খাওয়াতে পার? বড় ক্লান্ত লাগছে।
যথা সময়ে জর্জ এক কাপ গরম চকোলেট নিয়ে এসে পোয়ারোর সামনে ধরল।
–আচ্ছা জর্জ, আমার এখানে কাজ করার আগে তুমি তো অনেক অভিজাত বংশে কাজ করেছ।-কাপটা হাতে নিতে নিতে বললেন পোয়ারো, মনে হয় ইংরেজদের আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে তোমার বেশ ভাল ধারণাই আছে। তাই না?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।
–আচ্ছা, অপরাধী কি শুধু ছোটোজাত থেকেই আসে বলে তোমার ধারণা?
–আজ্ঞে না। অনেক বড় ঘরেও অপরাধ প্রবণতা দেখা যায়। একটা ঘটনা বলি। এখন যিনি ডেভিজের ডিউক, তোর ছোট ছেলে নানা ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ করেছিল। পুলিশকে পর্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছিল। শেষে ডিউক তাকে অষ্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দেন আর সেখানেও আরেক নামে অপরাধ করে ধরা পড়ে সে। অথচ এমনিতে ছেলেটি কিন্তু অত্যন্ত চালাক এবং মিষ্টভাষী।
–হুঁম্।–বিড় বিড় করলে পোয়ারো। অপরাধের উত্তেজনাটিকে ভালোবাসে বোধ হয়। আবার ভাবতে অবাক লাগছে।
–কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল তার। পকেট থেকে টেলিগ্রামখানা বের করে আবার পড়তে লাগলেন।
–আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, অপরাধ করার মধ্যে সবসময়ই একটা উত্তেজনা থাকে। সহজ সরল জীবনের চেয়ে অন্ধকারের জটিলতাই ওদের বেশি পছন্দ। এতেই ওদের উত্তেজনা।
কিছুক্ষণ চুপ করে কি ভেবে পোয়ারো বললেন, জর্জ মঁসিয়ে পপোপুলাস-এর মেয়ে জিয়াকে ফোন করেছিলে।
-আজ্ঞে হ্যাঁ। আজ রাতে ওদের সঙ্গে আপনার নৈশভোজের নেমন্তন্ন।
-আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তোমার কথা ভাবি।–স্নেহের চোখে তাকালেন পোয়ারো, ইচ্ছে করলেই তুমি কোনো লর্ড বা ডিউকের কাছে ভালো মাইনের কাজ করতে পারতে। কিন্তু সামান্য ডিটেকটিভের কাছে পড়ে আছ কেন?
–আপনাকে আমি সামান্য লোক মনে করি না স্যার। সারা ইউরোপে আপনার নাম কে জানে। আমি একথাও শুনেছি ইংলণ্ডের রাজাও আপনার প্রশংসা করে থাকেন। আপনি আশ্চর্য তদন্ত ধারায় জটিল কেসগুলো ফয়সালা করেন। জানতে ইচ্ছে হতো আপনার কর্মধারা তাই আপনার কাছে চাকরী করার লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও আমি আপনাকে কোনো-রকম সাহায্য করতে পারছি না।
–এজন্য তোমার সংকোচ বোধ করবার কারণ নেই। তুমি শুধু আমার কাজকর্ম লক্ষ্য করে যেও তাহলেই ধীরে ধীরে তদন্তের কাজ শিখে একজন পাকা ডিটেকটিভ হয়ে উঠবে। কাঠবিড়াল যেমন একটা একটা করে বাদাম সংগ্রহ করে ভবিষ্যতে কাজে লাগায়। আমিও তেমনি টুকরো টুকরো খবর সংগ্রহ করে জমা করি এবং পরে সেগুলোকে একত্রে কাজে লাগাই। এ ব্যাপারে পশুজগতের কাজকর্ম আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সময় সময় আমি বিড়ালের মত ইঁদুরের গর্তের দিকে লক্ষ্য রাখি। আবার কখনও বা কুকুরের মতো গন্ধ খুঁকে এগিয়ে যাই শিকারের সন্ধানে। তবে আমি এই কেসে কাঠবিড়ালের পদ্ধতিই অনুসরণ করছি। এবং আমার আশা শীগগিরই আমি কৃতকার্য হব।
.
২৫.
কাঠবিড়ালের স্বভাব
সন্ধ্যার পরে বের হলেন পোয়ারো। মঁসিয়ে পপোপুলাস-এর সঙ্গে তার ডিনার খাওয়ার কথা রাত আটটার সময়, মণ্টিকালোতে। তিনি একখানা ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে গেলেন মার্গারেট ভিলায়, ক্যাথারিন-এর সঙ্গে একবার দেখা করতে চান তিনি। মার্গারেট ভিলায় হাজির হতেই লেনক্স-এর সঙ্গে দেখা হলো তার।
-মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন বাড়িতে আছেন কি?–জিজ্ঞেস করলেন পোয়ারো।
–হ্যাঁ আছে। আপনি বসুন, উনি এখন নিচে নামবেন।
–না, এখন আর বসব না। আমি এসেছিলাম তাকে একটা খবর জানাবার জন্যে।
–খবরটা আমাকে বলতে আপত্তি আছে কি?
–না, আপত্তি থাকবে কেন। মিঃ ক্যাথারিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
–বলেন কি!
–ঠিকই বলছি। মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকারী সন্দেহে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। আচ্ছা, আমি চলি। খবরটা মিস গ্রেকে জানিয়ে দেবেন।
ওদের কথা হচ্ছিল বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে। পোয়ারো ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই লেনক্স বলল, কিছু যদি মনে না করেন, আমি আপনার সঙ্গে দু চারটে কথা বলতে চাই।
তাহলে আসুন ঐ বেঞ্চটাতে বসা যাক।
–সেই ভালো। ওখানেই বসা যাক।
–কি বলতে চাইছি, আপনি কি ড্রেককে হত্যাকারী বলে মনে করেন?
–এ কথা জিজ্ঞেস করবার কোনো কারণ আছে কি?
–কারণ আছে বৈকি, মঁসিয়ে পোয়ারো। মাদাম ক্যাথারিন আর মঁসিয়ে ক্যাথারিন একই ট্রেনে সেদিন এসেছিলেন। ক্যাথারিন তাকে মাদামের কামরায় দেখতে পেয়েছিল। দেনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন মিঃ ক্যাথারিন এবং মাদামের মৃত্যুতে তিনি আর্থিক দিক থেকে লাভবান হয়েছেন–এই সব মিলিয়ে যে কোনো লোকেরই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তিনিই হত্যাকারী কিন্তু….
–কিন্তু কি মাদমোয়াজেল?
-কিন্তু তিনি যদি মাদাম ক্যাথারিন কে হত্যা করে তাহলে হার্ট অব ফায়ার রুবীটাও তিনি অপহরণ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবর সংগ্রহ করতে পেরেছেন কি?
লেনক্স-এর এই রকম বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে পোয়ারো খুশী হলেন, কথাগুলো ঠিক বলেছেন মাদমোয়াজেল, কিন্তু মিঃ ক্যাথারিন-এর নির্দোষিতা প্রমাণ হাতে না আসা পর্যন্ত কিছুই করণীয় নেই। ঘটনা পরম্পরা তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
-হা স্থূলভাবে বিচার করলে সেই রকমই মনে হয় বটে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে, তিনি মাদামের কামরা থেকে বেরিয়ে এলে অন্য কেউ মাদামের কামরায় ঢুকে তাকে হত্যা করেছে এবং রুবীটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
-আপনি তাহলে বলতে চাইছেন ট্রেনের অন্য যাত্রী মাদামকে খুন করেছে?
-না। আমি বলতে চাইছি ট্রেনটা যখন নয়েন স্টেশনে এসে থেমেছিল, সেই সময় বাইরে থেকে কোনো লোক ট্রেনে উঠে মাদামের কামরায় ঢুকে তাকে হত্যা করেছে এবং রুবীটা নিয়ে সরে পড়েছে। আমার বিশ্বাস কয়েক মিনিটের মধ্যেই অর্থাৎ ট্রেনটা যখন নয়েন স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়েই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
আশ্চর্য আপনার বিশ্লেষণ ক্ষমতা মাদমোয়াজেল। ঠিকই অন্ধকারে আমি হাতড়াচ্ছিলাম, আপনি আলো দেখালেন।–মাথা নাড়তে লাগলেন পোয়ারো, ইস, এই ব্যাপারটি আমি একদম লক্ষ্য করিনি আগে। আচ্ছা, চলি এখন।
লেনক্স-এর কাছে বিদায় নিয়ে পোয়ারো চলে গেলেন।
মন্টিকালোতে পৌঁছতে পোয়ারোর সামান্য দেরি হয়ে গেল। মঁসিয়ে পপোপুলাস ও তার মেয়ে জিয়া আগেই এসে গেছেন। পোয়ারো আসতেই তারা হাসি ঠাট্টা শুরু করলেন। পোয়ারোও তাদের রসিকতায় যোগ দিলেন।
ডিনার খেতে খেতে পপোপুলাস বললেন, আমি যে টিপষ্টা দিয়েছিলাম সেটা কাজে লাগিয়েছেন কি?
–না। এখনও ঠিকমত কাজে লাগাতে পারিনি। এ ব্যাপারে বুকির কাছে আরও কিছু খবর আশা করছি।
–ঘোড়াটা ভালো বলেই শুনেছি। বেশ নাম আছে ওর।
–দুর্নামও বলতে পারেন। অনেকে ওকে ব্ল্যাক হর্স বলে থাকেন।
ডিনার শেষ হলে তিনজনেই গেলেন জুয়ার ঘরে। সেখানে পোয়ারো জুয়া খেলায় মেতে উঠেছেন এই সুযোগে পপোপুলাস সরে পড়লেন। পোয়ারো যে লক্ষ্য করেছেন এটা তিনি বুঝতেই দিলেন না।
কিন্তু খেলার দিকে তার মন ছিল না। তার কেবলই মনে হতে লাগলো নিশ্চয়ই পপোপুলাস কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
এদিকে কয়েকটা দান খেলেই জিয়া দুহাজার ঐ জিতে ফেলল। সে বলল, আমি আর খেলব না।
–চমৎকার! পোয়ারো হেসে বললেন, একেই বলে বাপ কি বেটি। কখন শুরু করতে হয় আর কখন শেষ করতে হয় ভালোই জানেন দেখছি। কিন্তু মিঃ পপোপুলাস কোথায় গেলেন, তাকে দেখছি না তো।
হয়তো বাগানে গেছেন।
–তাহলে চলুন। আমরা বরং সেখানেই যাই, কেমন?
—তা মন্দ না। তাই চলুন।
–আচ্ছা, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি ক্লোকরুম থেকে ওভার কোট আর টুপিটা নিয়ে আসি।
–চলুন, আমাকেও সেখানে যেতে হবে ওভারকোট নিতে।
–আপনি বরং বাগানেতেই যান। আমি যাবার সময় আপনার ওভারকোটটা নিয়ে যাব। পোয়ারো এগিয়ে গেলেন।
পোয়ারো কিন্তু এগিয়ে গেলেন হলঘরে যেখানে অনেক নরনারীর ভীড়। সেই ভীড়ের মধ্যে মিশে পপোপুলাসকে খুঁজতেই দেখতে পেলেন যে কোণের দিকে একটা নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে মিরেলির সঙ্গে কথা বলছেন তিনি।
পোয়ারো একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনলেন। মিরেলি বলছিল, আমাকে আরও কিছুদিন সময় দিতে হবে। কয়েকটা দিন সময় পেলেই আমি টাকা যোগাড় করতে পারব। পপোপুলাস বললেন, না, আর আমি অপেক্ষা করব না।
–আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতেই হবে আপনাকে, আমি কথা দিচ্ছি, দশদিনের মধ্যেই কাজ শেষ করব।
পপোপুলাস কি যেন বলতে যাচ্ছিল তখনই পোয়ারো এসে হাজির হলেন সেখানে। তার সরল মুখ দেখে কেউ বুঝতেই পারল না যে উনি এতক্ষণ তাদের লক্ষ্য করেছেন।
–এই যে মিঃ পপোপুলাস। আপনাকেই খুঁজছিলাম। আমরা মানে আমি আর মিস জিয়া বাগানে গিয়ে বসি। ওখানেই আমাদের পাবেন।
তারপর পাশে মিরেলির দিকে নজর ফেরালেন, কি আশ্চর্য! আপনি এখানে? এতক্ষণ আপনাকে লক্ষ্যই করিনি। মনে কিছু করবেন না আমার এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য। চলি।
ওঁদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে পোয়ারো ক্লোক রুম থেকে দুটো ওভারকোট নিয়ে জিয়ার কাছে চলে এলেন।
–এই জন্যেই পুরুষগুলো মরে! হেসে চোখ তুলল জিয়া; মিছিমিছি কত খাটাতে গেলেন বলুন তো?
-লোকে তো তাই বলে। দেখুন মাদমোয়াজেল, ভালো খাওয়া ভালো থাকা আর মনের মতো সঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের কথা। যারা পয়সা না থাকার অজুহাত দেখিয়ে এসব আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত রাখে, হয় তারা নেহাতই হতভাগ্য, আর নয়ত হৃদয়ের দহন সহ্য করবার মতো ক্ষমতা তাদের নেই।
পোয়ারোর রসিকতায় হেসে উঠল জিয়া।
-না না, কারো রোমান্স আপনি হেসে উড়িয়ে দেবেন না মাদমোয়াজেল।–একটু ঝুঁকে এলেন; আপনি যে রীতিমতো সুন্দরী।
সুন্দরী না ছাই! তেত্রিশ বছর চলছে জানেন? নেহাতই ছেলেমানুষ সেজে থাকি তাই বোঝা যায় না। বরং সেই সতেরো বছর আগে যখন দেখেছিলেন তখন আপনার কথা খাটতো।
-কিন্তু সত্যি আপনাকে দেখলে আরও কম মনে হয়। আমার তো মনে হয় আপনি একই রকম আছেন, শুধু একটু শুকনো। সামান্য নিষ্প্রভ আর গম্ভীর হয়েছেন।
-সতেরো বছর আগে, মানে ষোল বছর বয়সে কেমন বোকা আর সরল ছিলাম না?
–সত্যি আপনি খুব সরল ও বোকা ছিলেন। যে যা বলত, তাই বিশ্বাস করতেন। যার জন্যে অতবড় ব্যাপারটাই ঘটে গেল সেবার। অবশ্য আপনার বাবা আসল ভেতরের খবর কিছুই জানেন না।
-সে কি! বাবা জনেন না আপনি ঠিক জানেন?
–আমাকে আপনার বাবা যখন ব্যাপারটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, হারানো জিনিস ফেরত পেয়েছেন আর কিছু জানতে চাইবেন না–আপনার পক্ষে অপ্রীতিকর হবে। জানেন কেন বলেছিলাম এ কথা?
-না, কেন?–আড়ষ্ট হল জিয়া।
-সতেরো বছর আগের সেই কিশোরীটির মুখ চেয়ে আমার নিজের মুখ বন্ধ করতে হয়েছিল।
–আপনি কি সব বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
–বুঝতে পারছেন না? অ্যান্টনিও পিরেজিও-আপনার বাবার দোকানের সেই যুবক কর্মচারীটিকে কি আপনার মনে পড়ছে না? যে আগে থেকেই চুরির মতলব নিয়ে ঢুকেছিল আর যার জন্য তাকে আপনার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে হয়েছিল? যাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে সেই কিশোরীটি তার বাবার মহামূল্যবান রত্ন রাখার গুপ্তস্থান পর্যন্ত বলে দিয়েছিল? তাকে ভুলে গেলেন মাদমোয়াজেল? ওঃ সেদিনের সেই কিশোরীটির চেহারা আজও আমার চোখের ওপর ভাসছে। বেচারা সব বুঝতে পারছে অথচ কিছু বলতে পারছে না। কি বলবে! আর কে বিশ্বাস করবে। যাক, এরকুল পোয়ারোর তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধিকে অনেক ধন্যবাদ যে কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই চোরাই মাল উদ্ধার করে আসল মালিককে দিতে পেরেছিলেন।
–কে আপনাকে অ্যান্টনিওর কথা বলেছিল?–রেগে লাল হলো জিয়া।
-কেউ না। আমার নির্ভুল অনুমান আর আপনার মুখের নির্বাক ভাষা। দেখুন মাদমোয়াজেল, যদি আপনাদের মুখের না বলা ভাষা আমি না পড়তে পারলাম তাহলে কিসের এরকুল পোয়ারো?
-তা এতদিন পরে একথা বলছেন কেন? বাবাকে বলবেন নাকি?
ছি ছি, এ কি বলা যায়?
তার বদলে আমার কাছে কিছু আশা করেন নিশ্চয়ই।
–আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী মাদমোয়াজেল।
–আপনাকে সাহায্য করব একথা ভাবলেন কি করে?
–ভাবিনি। শুধু আশা করেছিলাম মাত্র।
–যদি না করি তাহলে বাবাকে বলে দেবেন তো?
–মাদমোয়াজেল, আমি অনুরোধ করছি আপনার ঐ ধারণাটা বদলান। আমি ব্ল্যাকমেলার নই।–একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন পোয়ারো। যদি না চান তো না-ই করলেন। আমার করার কিছুই নেই।
–কিন্তু বাবা তো আপনাকে একটা আভাস দিয়েছেন।
–তার জন্যে পোয়ারো তার কাছে কৃতজ্ঞ।
-কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু আপনাকে…. আচ্ছা-না, আপনাকে বলব, নিশ্চয়ই বলব। সেদিন আপনি ঠিকই ধরেছেন কেন আমরা নিস-এ এসেছি। রুবীগুলো এখানেই হস্তান্তর করা হয়েছে। ওগুলো এখন বাবার কাছেই আছে। আর কে এই মক্কেল সে তো বাবা ঘোড়ার নামে টিপস্ দিয়ে আভাস দিয়েছে।
-মার্কুইস।
–হ্যাঁ, মার্কুইস।
–আচ্ছা মাদমোয়াজেল, মাকুইসকে আপনি কি কখনও দেখেছেন?
–একবার মাত্র। তাও চাবি লাগবার গর্ত দিয়ে। মুখে প্ল্যাস্টিক-এর হুবহু মানুষের অনুকরণে একটা মুখোশ ছিল। মাথার চুল ধবধবে সাদা।
–যুবক না বয়োজ্যেষ্ঠ?
–গলার স্বর এবং চলা দেখে বয়স্ক বলে মনে হয় না।
–আবার তার গলার স্বর শুনলে চিনতে পারবেন?
–হয়তো পারব। কিন্তু এর চেয়েও প্রয়োজনীয় কথা আপনাকে বলছি।
–বলুন। সজাগ হলেন পোয়ারো।
–আমি আপনাকে আগেই বলেছি রুবীগুলো এই নিস শহরেই হাত বদল হয়েছে। এবং যে এটা করেছে সে….
-সে একজন….
–সে একজন নারী।