।। ৫ ।।
বাড়িতে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে একটু রিল্যাক্স করার জন্যেই অমিয় চক্রবর্তীর একটা কবিতার বই নিয়ে বসলাম। একেনবাবু দেখলাম বিল ক্রসের কাছ থেকে আনা ছবিটা মগ্ন হয়ে দেখছেন। সেটা দেখতে দেখতেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী পড়ছেন স্যার?”
“অমিয় চক্রবর্তীর একটা কবিতা। শুনবেন?”
“পড়ুন স্যার, আমি অবশ্য এগুলো বুঝি না।”
আমি ‘সংগতি’ কবিতাটা পড়লাম। যখন পড়লাম,
‘তোমার সৃষ্টি, আমার সৃষ্টি, তাঁর সৃষ্টির মাঝে
যত কিছু সুর, যা-কিছু বেসুর বাজে
মেলাবেন।’
মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “এটা কিন্তু কবি মোক্ষম লিখেছেন স্যার।” বলে চেয়ার থেকে উঠে এসে বিড়বিড় করে নিজেই লাইন তিনটে কয়েকবার পড়লেন। তারপর বোঁ করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। টিপিক্যাল একেনবাবু।
খানিকবাদে কান চুলকোতে চুলকোতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “এক কাপ কফি চলবে নাকি স্যার?”
এমন সময় একটা ফোন। অন্যপ্রান্তে অধ্যাপক গেরহার্ট। একটা ভীষণ দুঃসংবাদ, দীপা আত্মহত্যা করেছেন। ওঁর ডেডবডি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে।
আমরা সবাই ছুটলাম। গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও সেখানে। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নিউজ ট্র্যাভেল ফাস্ট।”
একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার স্যার, সুইসাইড?”
“তাইতো মনে হচ্ছে।”
একটা সুইসাইড নোট রেখে গিয়েছেন। সুইসাইডে নোটের বয়ানটাও শুনলাম
‘আমার জীবনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। শুভ, তোকে আশীর্বাদ করে যাচ্ছি, তুই সুখে থাক।
মা’
ডেডবডি অটোন্সি না করে ছাড়া হবে না। শুভ দেখলাম লাল চোখে এক কোণে দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। কাউকেই আমি চিনি না, নিশ্চয় ওঁর বন্ধুবান্ধব। চেনাজানার মধ্যে একমাত্র ভৈরববাবু। ভৈরববাবুই বললেন, “সোনাবৌদি হেভি ডোজে কোডিন খেয়েছেন, সম্ভবতঃ শুভ কাজে চলে যাবার পরপরই। ফিরে এসে দেখে সোনাবৌদি আর বেঁচে নেই”
কোডিন ব্যথা কমানোর ওষুধ বলে জানতাম, কিন্তু এটা খেলে যে এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু হতে পারে সেটা জানা ছিল না।
প্রমথ দেখলাম জানে। বলল, “কোডিন, মরফিন বা যে কোনও ওপিয়েট নাকি বেশি খেলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম অ্যাফেক্ট করে। ফলে কোমাতে চলে গিয়ে রেস্পিরেটরি বা সাকুলেটরি ফেইলিওর হয়।”
একেনবাবু দেখলাম একটু গম্ভীর হয়ে গেছেন। এদিক ওদিক কিছুক্ষণ উশখুশ করলেন। তারপর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে গিয়ে কী জানি বললেন।
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট মনে হল শেষে সম্মতি জানালেন। তারপর দুজনে গিয়ে শুভকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে গেলেন। আমি আর প্রমথও পিছু পিছু গেলাম।
একেনবাবু শুভর হাতটা ধরে বললেন, “আমি জানি না স্যার, এই দুঃখে আপনাকে আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব। কিন্তু এই চরম দুঃখের সময়েও আমি দুয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করব।”
শুভকে এর আগেও নিশ্চয় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের লোকজন অনেক প্রশ্নই করেছে। বিষণ্ণ মুখে শুভ একেনবাবুকে বললেন, “বলুন।”
“মাস কয়েক আগে আরিফ বলে একটি লোক আপনার বাবার একটি স্যুটকেস আপনাদের বাড়িতে দিয়ে এসেছিলেন, আপনি সেটা জানেন?”
প্রশ্নের আকস্মিকতায় শুভ দেখলাম হতভম্ব এবং বিরক্ত। “এই প্রশ্ন এখন আমায় কেন। করছেন?”
“দরকার আছে স্যার, প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
“হ্যাঁ, জানি। মা ফোন করে জানিয়েছিলেন।”
“কী বলেছিলেন আপনাকে?”
“মা খুবই আপসেট ছিলেন। ঠিক কী বলেছিলেন আমার স্পষ্ট মনে নেই।”
“আপনি মাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি স্যার, মা এত আপসেট কেন হয়েছেন?”
“করেছিলাম।”
“আপনার মা কী বলেছিলেন?”
“মা বারবার বলছিলেন, তুই বুঝবি না, তোকে বোঝানো যাবে না।”
“আপনি সিওর এই কথাটা মা আপনাকে বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ, আমার পরিষ্কার মনে আছে।”
“আপনার মা কি এরকম আপসেট মাঝে মাঝে হতেন?”
“না, মা খুবই ধীর-স্থির ছিলেন, চট করে বিচলিত হতেন না। তাই আমি একটু চিন্তিতই হই, আর সেইজন্যই মা-কে চলে আসতে বলি।”
“আই সি। শেষ প্রশ্ন স্যার, আপনি কি দশ বারো দিনের মধ্যে নিউ ইয়র্কের বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন?”
“না, গত দুসপ্তাহ আমাকে প্রতিদিন কাজে যেতে হয়েছে, এমন কি শনি-রবিবারেও। মা নায়াগ্রা দেখতে চেয়েছিল। গত উইক-এণ্ডে নায়াগ্রা নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কাজের জন্য পারিনি। কোনোদিন আর পারবও না।” গলাটা বুজে এল শুভর।
“আই অ্যাম সরি স্যার, কিন্তু থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।”