আস্তে আস্তে শ্বাস নিচ্ছে মুসা। শান্ত হও, বোঝাল নিজেকে। মাথা ঠাণ্ডা করো। নইলে বিপদ থেকে মুক্তি পাবে না। আসতে যখন পেরেছ এখানে, যেতেও পারবে। কি করে যাবে কেবল সেইটাই ভেবে বের কর এখন।
আবার ঘড়ি দেখল সে। সরে চলে এল এমন একটা জায়গায়, যেখানে বন মোটামুটি পাতলা, গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে আকাশ চোখে পড়ে। এদিকে সরে ওদিকে সরে, এপাশে মাথা কাত করে ওপাশে মাথা কাত করে সূর্যটা দেখল সে। তারপর হিসেব শুরু করল।
তৃণভূমি থেকে রাস্তায় উঠে এসে দক্ষিণ পুবে রওনা হয়েছিল। রোদ পড়ছিল। তখন তার ডান কাঁধে। এখন নেমে গেছে সূর্য। উত্তর-পশ্চিমে যাওয়ার সময় তার বাঁ কাঁধের নিচের দিকে, প্রায় বুকে রোদ পড়ার কথা।
ঘন গাছপালায় ছাওয়া এই তরাই থেকে বেরিয়ে তৃণভূমিটা খুঁজে বের করা খুব মুশকিল। তবু, চেষ্টা তো করতে হবে।
সাবধানে হাঁটতে শুরু করল সে। বার বার মুখ তুলে তাকাচ্ছে সূর্যের দিকে। পাখি ডাকছে, গাছের পাতায় শিরশির কাঁপন তুলে বইছে বাতাস, ঝোপের ভেতর, হুটোপুটি করছে ছোট ছোট জীব। পায়ের কাছ থেকে সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে। কাঠবেড়ালি, ইঁদুর, লাফিয়ে উঠে ছুটে পালাচ্ছে খরগোশ।
এক ঘণ্টা ধরে হাঁটল সে। কোন কিছুই তো চিনতে পারছি না, নিরাশ হয়ে নিজেকে বলল। একটা চিহ্ন, একটা নিশানা দেখছি না যেটা দেখে বোঝা যায় ঠিক পথেই চলেছি।
আরও নেমেছে সূর্য। বড় জোর আর এক ঘণ্টা, তার পরেই ডুবে যাবে। এই সময় বনের ভেতরে আবার শব্দ শুনতে পেল সে। ডেকে উঠতে যাচ্ছিল আবার, সময় মত সামলে নিয়ে চুপ হয়ে গেল। আগের বারও ডাকাডাকি করতে গিয়ে হুঁশিয়ার করেছে লোকটাকে, পালিয়েছে সে।
পা টিপে টিপে শব্দের দিকে এগোল এবার।
উত্তরে এগোচ্ছে সে। বাড়ছে শব্দ। লোকটা প্রথমবার যে রকম শব্দ করেছিল, তার চেয়ে বেশি লাগছে এখন।
থেমে গেল শব্দটা।
পাগল হয়ে গেলে নাকি! নিজেকে ধমক লাগাল মুসা। কোথায় তৃণভূমিটা খুঁজে বের করে নিরাপদ হবে, তা না, আবার এগিয়ে চলেছে শব্দ লক্ষ্য করে আরেকবার পথ হারানর জন্যে।
দ্বিধা করল সে। তবে একটা মুহূর্ত। তারপর আবার এগোল শব্দের দিকে।
হঠাৎ করেই থেমে গেল, যেন ব্রেক কষে।
খাইছে! রবিন! চিৎকার করে উঠল সে।
ফিরে তাকাল রবিন। সে-ও চমকে গিয়েছিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও, মুসা!
হাসতে লাগল মুসা। হো হো করে। পরিচিত একটা মানুষকে সামনে দেখে খুশি আর ধরে রাখতে পারছে না।
কি হয়েছে, মুসা? ওরকম করছ কেন?
জবাবে আরও জোরে হাসতে লাগল মুসা।
আরে কি হলো! পাগল হয়ে গেলে নাকি! ভুরু কুঁচকে বলল রবিন।
না! মাথা নাড়তে লাগল মুসা। আরও কিছু হো-হো-হো। না, পাগল হইনি। তোমাকে দেখে কি যে ভাল লাগছে!
কেন, আমাকে কি নতুন দেখলে নাকি?
নতুন না হলেও পরিচিত তো। ভূত নও যে গায়েব হয়ে যাবে।
এখানে আবার ভুত এল কোত্থেকে? আরও অবাক হয়েছে রবিন।
চলো, যেতে যেতে বলছি। তুমিও যখন এদিকেই আছ, তার মানে পথ ভুল করিনি। ঠিকই এগোচ্ছি। চলো।
হাঁটতে হাঁটতে সব কথা বলল মুসা।
ভূত? ভুল দেখনি তো? রবিন বলল।
না। ঠিকই দেখেছি।
হু! বনের ভূতে পেল শেষ পর্যন্ত তোমাকে, চিন্তিত ভঙ্গিকে বলল রবিন।
তোমার কথা বললে না? তুমি কি করে এলে? বলল রবিন।
ধস! বলো কি? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। পাহাড়ে যেখানে সেখানে। তো এভাবে ধস নামে না! ভাগ্যিস সরে যেতে পেরেছিলে! নইলে ভর্তা হয়ে যেতে!
আলোচনা করতে করতে চলল দুজনে। হঠাৎ হাত তুলে রবিন বলল, দেখো দেখো, কিশোর আমাদের চেয়ে আরামে আছে। কোন রকম বিপদে পড়তে হয়নি। তো। যা ধোয়া করছে, কাছাকাছি কেউ থেকে থাকলে চোখে পড়বেই।
মুসাও দেখতে পাচ্ছে। কালো ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে।
আগুনের কাছ থেকে কিছু দূরে বসে রয়েছে কিশোর। সূর্য ঢলে যেতেই শীত পড়তে আরম্ভ করেছে। জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে সে। চেন টেনে দিয়েছে একেবারে গলা পর্যন্ত। ধোয়া করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নি। রাতে শোয়ার ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। আগুনের কুণ্ড ঘিরে ছয় ফুট জায়গার পচা পাতা, ঘাস আর পড়ে থাকা অন্যান্য জিনিস সাফ করেছে। লতাপাতা জোগাড় করে এনে রেখেছে বিছানা পাতার জন্যে।
কি ব্যাপার? মুসা আর রবিনের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। হাটুরে। কিল খেয়ে এসেছ মনে হয়? মুখ ওরকম কেন?
আমাকে দেখে খুশি হয়েছে মুসা, আরেক দিকে তাকিয়ে জবাব দিল রবিন।
চোখ সরু হয়ে এল কিশোরের। মুসার দিকে দৃষ্টি স্থির। খুশির তো কোন লক্ষণ দেখছি না?
কি করলে লক্ষণটা বোঝা যাবে? রেগে গেল মুসা। দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে হবে?
না, তা বলছিনে। তবে মনে হচ্ছে ভূতের তাড়া খেয়ে এসেছ।
তা অনেকটা ওই রকমই, রবিন বলল।
জ্যাকেট গায়ে দিয়ে এসে আগুনের পাশে বসে পড়ল মুসা আর রবিনও। হাত সেঁকতে সেঁকতে বলতে লাগল কি করে এসেছে। বেশ ভাল ঠাণ্ডা পড়ছে এখন।
চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, বাবা কই?
ফেরেনি তো, কিশোর জানাল।
অনেক আগেই চলে আসার কথা, উদ্বিগ্ন হলো রবিন। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বাবার কথা ভাবল। কপালের জখমটার কথা ভেবে উঠে দাঁড়াল সে। রওনা হয়ে গেল।
মুসাও উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াও, আমিও আসছি।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। এখানে বসে একজনকে ক্যাম্পের ওপর নজর রাখতেই হবে। নইলে বিপদ হতে পারে। দেখার কেউ না থাকলে অনেক সময় ক্যাম্পে ফায়ার ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের সৃষ্টি করে। মুসা আর রবিনের। সঙ্গে এবার যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছে তার। মিস্টার মিলফোর্ডের জন্যে তারও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বসে থাকতেই হবে।
পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল মুসা। সূর্য ডোবার আর আধ ঘণ্টা বাকি। তার পরে আলো আর বেশিক্ষণ থাকবে না, ঝুপ করে নামবে অন্ধকার, এসব পাহাড়ী এলাকায় যেমন করে নামে।
পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল রবিন। তবে প্রপাতের ধারের পাহাড়ের মত দেয়ালের গায়ে এখানে খোঁচা খোঁচা পাথর বেরিয়ে নেই। পরতের পর পরত এ্যানিট এমন ভাবে পড়েছে, যেন পাহাড়ে চড়ার উপযুক্ত করেই। কোথাও কোথাও খুবই মসৃণ, প্রায় হাত পিছলে যাওয়ার মত, হাজার হাজার বছর আগে। বরফের ধস নামার সময় বরফের ঘষায় এরকম হয়েছে।
চূড়ায় উঠে এল দুজনে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে।
উৎকন্ঠিত হয়ে চারপাশে তাকাল রবিন। কই, গেল কোথায়? দেখছি না।
বসে আছেন হয়ত কোথাও। বিশ্রাম নিচ্ছেন, মুসা বলল।
নিচে শত শত মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে চড়াই উতরাই। ঘন বনে ছাওয়া। ডুবন্ত সূর্যের লম্বা লম্বা ছায়া পড়ছে বনের ওপর, এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। সবুজ বনের মাথায় লাল রোদ, যেখানে রোদ পড়তে পারেনি সেখানে গভীর কালো গর্তের মত লাগছে। পাহাড়ের চূড়াগুলোকে মনে হচ্ছে সোনায় তৈরি। কিন্তু এসব দেখার আগ্রহ নেই এখন দুই গোয়েন্দার। ওরা যা দেখতে এসেছে সেই ফায়ার টাওয়ার কোথাও চোখে পড়ল না।
নজর ফেরাল ওরা। যেখানে রয়েছে পাহাড়ের সেই চূড়াটা দেখতে লাগল। লম্বা, গ্র্যানিটে তৈরি একটা মালভূমি। এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে বড় বড় পাথরের চাঙড়। পাথরের মধ্যেই যেখানে সামান্যতম মাটি পেয়েছে সেখানেই গজিয়ে উঠেছে কাঁটাঝোপ। রুক্ষ পাথরের মাঝে টিকে থাকার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। মালভূমির সবটাই দেখতে প্রায় একই রকম। কোথাও কোন বৈচিত্র নেই। উত্তরে আধ মাইল দূরে ঘন হয়ে জন্মেছে পাইন। আরেকটা জঙ্গল, এই মালভূমির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেছে একটা শৈলশিরার কাছে, দ্বিগন্ত আড়াল করে দিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে আছে যেন শিরাটা। ওই শিরাটারই কোন প্রান্তে রয়েছে ডায়মণ্ড লেক।
মিলফোর্ডকে খোঁজার জন্যে আলাদা হয়ে দুদিকে সরে গেল মুসা আর রবিন। চিৎকার করে ডাকতে লাগল।
বাবা!
আঙ্কেল!
বাবা!
ঠাণ্ডা একঝলক জোরাল হাওয়া বয়ে গেল মালভূমির ওপর দিয়ে। কেঁপে উঠল রবিন। ওর বাবা কোথায়? ওদেরকে কিছু না বলে দূরে কোথাও যাওয়ার কথা। নয়। যাবেন না।
চোখে পড়ল জিনিসটা। তার বাবার নীল ডজারস ক্যাপ।
বাবা! জোরে চিৎকার করে ডাকল আবার রবিন। দৌড়ে এল ক্যাপটার কাছে। পাশেই একটা ম্যানজানিটা ঝাড়। ঝড় তো নয়, যেন ঝাড়ের কঙ্কাল। বাবা! কাছাকাছি কোথাও রয়েছেন তিনি, অনুমান করল সে। কোথায় তুমি?
এই রবিন, পেলে নাকি কিছু? দৌড়ে আসছে মুসা।
কি পেয়েছে দেখাল রবিন। এই ক্যাপটার ওপর বাবার দুর্বলতা আছে। ফেলে যাওয়ার কথা নয়। নিশ্চয় কিছু হয়েছে। খারাপ কিছু। জখম-টখম হয়ে এমনিতেই শরীর কাহিল, পাহাড়ে উঠে আরও খারাপ হয়েছে। মাথা ঘুরে কোথাও পড়ে আছে হয়ত। কিংবা পথ হারিয়েছে।
দেখি তো। ক্যাপটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল মুসা। কোন দুর্ঘটনায় মাথা থেকে পড়ে গেলে যেমন হয়, ছিঁড়ে যায়, ময়লা কিংবা রক্ত লেগে থাকে, সে রকম কিছুই নেই। ঠিকই তো আছে!
বাবা! আবার ডাকল রবিন।
অযথা ভয় পাচ্ছ। মাথা থেকে খুলে পড়ে গেছে। খেয়াল করেননি।
মাথা নাড়ল রবিন। অসম্ভব! মাথা থেকে ক্যাপ খুলে পড়ে যাবে আর খেয়াল করবে না এটা হতেই পারে না। তাছাড়া এটা তার লাকি ক্যাপ।
একটা পাথর কুড়িয়ে নিল মুসা। বলল, একটা পিরামিড বানাই। টুপিটা কোথায় পেলাম তার চিহ্ন। তুমি খোঁজা চালিয়ে যাও।
মাথা ঝাঁকিয়ে সরে গেল রবিন।
পশ্চিমে তাকাল মুসা। উজ্জ্বল কমলা রঙ হয়ে গেছে সূর্যটার। ডুবে যাচ্ছে। দ্রুত হাত চালাল সে। পাথর দিয়ে পিরামিড তৈরি করে চিহ্ন রাখা বনচারী মানুষ আর অভিযাত্রীদের একটা পুরানো কৌশল। বানাতে দেরি হল না। উঠে সে-ও খুঁজতে শুরু করল আবার। কতটা উদ্বিগ্ন হয়েছে, সেটা রবিনকে জানাতে চায় না। তাহলে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে বেচারার।
মুখের সামনে হাত জড় করে জোরে জোরে মিলফোর্ডকে ডাকতে লাগল দুজনে। চিৎকার বেরোতে না বেরোতেই সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, যেন পছন্দ না হওয়ায় ঝেটিয়ে বিদেয় করতে চাইছে ওই শব্দকে। সব জায়গায় খুঁজতে লাগল ওরা। পাথরের আড়ালে, গাছের ছায়ায়, ভূমিকম্পে ফেটে যাওয়া গ্র্যানিটের খাজের ভেতরে।
অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মুসা বলল, ফিরে যাওয়া দরকার!
আরও পরে! উত্তরের বনের দিকে এগিয়ে চলেছে রবিন।
গিয়ে লাভ হবে না। এতক্ষণে নিশ্চয় ক্যাম্পে ফিরে গেছেন আঙ্কেল। আমাদের দেরি দেখলে রাগ করবেন।
না, যায়নি! রবিনের বিশ্বাস, কাছাকাছিই কোথাও রয়েছেন তার বাবা।
এই, শোনো, পথ হারাব আমরা। তাহলে আরও বেশি রাগ করবেন তিনি।
থেমে গেল রবিন। ঝুলে পড়ল কাধ।
সূর্য ডুবে গেছে দেখছ না, পাশে চলে এল মুসা। এখনও বাইরে ঘোরাফেরা করছেন না নিশ্চয় আঙ্কেল। চলো। গিয়ে দেখব, বসে আছেন। আমাদের জন্যেই দুশ্চিন্তা করছেন।
পশ্চিম আকাশের দিকে তাকাল রবিন। গোধূলীর বিচিত্র রঙে রঙিন হয়ে গেছে আকাশ। মুসার কথায় যুক্তি আছে, যদিও মানতে পারছে না রবিন। তার ধারণা, ফিরে যাননি তার বাবা। গিয়ে দেখবে নেই। তাহলে আবার বেরোতে হবে খুঁজতে। কিন্তু এই রাতের বেলা কি ভাবে কোথায় খুঁজবে? কাল সকালের আগে আর হবে না।
যেতে ইচ্ছে করছে না। নিরাশ হয়ে প্রায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাঁটতে লাগল। সে মুসার সঙ্গে। যেখান দিয়ে চূড়ায় উঠেছিল, চুড়ার সেই ধারটায় এসে থামল। নিচে তাকাল একবার। তারপর নামতে শুরু করল। বেগুনী আকাশ থেকে দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে দিনের আলো। বিশাল একটা চাঁদ উঠছে, পূর্ণিমার বেশি বাকি নেই। আলো যথেষ্টই ছড়াবে, তবে এতটা বেশি নয় যাতে বনের ভেতর খোঁজা যায়।
তৃণভূমিতে নেমে শীতে কাঁপা শুরু করল ওরা। ছুটে চলল ক্যাম্পের দিকে। এতে শরীর গরম হবে, শীতটা একটু কম লাগবে। অন্ধকার হয়ে গেছে। আগুনের দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল ওদের, চারপাশে কিছুদূর পর্যন্ত উষ্ণ একটা চক্র তৈরি করে জ্বলছে যেন আগুন।
মিলফোর্ডকে দেখা গেল না আগুনের পাশে। কিশোর একা।
পেলে না? জিজ্ঞেস করল গোয়েন্দাপ্রধান।
শুধু ক্যাপটা, জবাব দিল মুসা।
ধপ করে একটা পাথরের ওপর বসে পড়ল রবিন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আগুনের দিকে।
মুসার চোখে চোখে তাকাল কিশোর। একটা ভুরু সামান্য উঁচু করল। ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল মুসা। রবিনকে সান্ত্বনা দিতে হবে এখন, ওর মন হালকা করার চেষ্টা করতে হবে।
এই, রবিন, আচমকা কথা বলল মুসা, শুনেছি, হট পিসটন নাকি সাংঘাতিক। যে ট্যালেন্ট এজেন্সিতে কাজ করে রবিন, সেখানকারই একটা নতুন রক গ্রুপ হট পিসটন। রবিনের খুব পছন্দ।
হ্যাঁ, ভালই, দায়সারা জবাব দিল রবিন।
আমিও শুনেছি ভাল, কিশোর বলল। যদিও গানবাজনা তার বিশেষ পছন্দ নয়, রবিনের খাতিরেই বলল। ওদের নতুন মিউজিকটা কি?
আমি জানি, মুসা বলল, লো দা গ্রাউণ্ড। দারুণ! আমার খুবই ভাল লেগেছে…।
শোনো, আমি বলি কি…
বাবার কথাই বলতে যাচ্ছে রবিন, বুঝতে পেরে তাকে থামিয়ে দিয়ে আরেক কথায় চলে গেল মুসা, রবিন, বিশ্বাস করবে না, কি ভয়টাই না তখন পেয়েছি! লোকটা ভূতের মত এল, ভূতের মতই হারিয়ে গেল। বনের মধ্যে আমার মনে হয়েছিল-মনে হয়েছিল…কি জানি মনে হয়েছিল? মাথা চুলকাতে লাগল সে।
তোমার কি মনে হয়েছিল, সেটা কি আমরা জানি নাকি? হেসে ফেলল কিশোর।
দাঁড়াও, কি মনে হয়েছিল মনে করি…
হয়েছে, আর মনে করতে হবে না। আমিই বলে দিচ্ছি। প্যান্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, আর তুমি টের পাচ্ছিলে না…
খাইছে! তুমি জানলে কি করে?
এতে জানাজানির আর কি আছে? ভূত দেখলেই তো তুমি প্রথমে ওই একটি কাজ করে ফেলো…
হাসল মুসা।
রবিনের ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল।
সুযোগটা কাজে লাগাল কিশোর, বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের গান, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনী…
ওই গান থেকে যে কখন ওয়েস্টার্ন বাফেলো গালসে (গার্ল) চলে গেল। খেয়ালই রইল না। যখন খেয়াল হলো, দেখল তিনজনে গলা মেলাচ্ছে। বন্য রাতের আকাশ যেন ভরে দিল তিনটে কণ্ঠ, একেকটা একেক রকম। তিনজনের মাঝে রবিনের গলাই কেবল ভাল। মুসারটা খসখসে, আর কিশোরেরটা শুনলেই লেজ গুটিয়ে পালাবে নেড়ি কুকুর। একটা বাদ্যযন্ত্র হলে ভাল হয়। আর কিছু না পেয়ে দুটো ডাল তুলে নিয়ে ভুটানিদের মত একটার সঙ্গে আরেকটা পিটিয়ে শব্দ করতে লাগল মুসা। ওকে আর রবিনকে অবাক করে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। কোমর দুলিয়ে নাচতে শুরু করল। গলা যেমন বেসুরো, পা-ও তেমনি বেতাল। বাজনা বাজানো আর হল না মুসার। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। রবিনও না হেসে পারল না। মনে দুর্ভাবনা না থাকলে তারও মুসার দশাই হত। তবে কিছুক্ষণ আগের মত আর ভার হয়ে নেই মন, অনেক হালকা হয়েছে।
মুসা গাইল, আর কয়েক রকমের নাচ নাচল কিশোর। ভুটানি, বাংলাদেশী খেমটা, আফ্রিকান আদিবাসীদের উন্মাদ নৃত্য, আর রক স্টারদের দাপাদাপি, কোনটাই বাদ রাখল না। শেষে ক্লান্ত হয়ে আগুনের ধারে বসে প্রায় জিভ বের করে। হাঁপাতে লাগল।
নাচের শেষ পর্যায়ে তার সঙ্গে মুসা আর রবিনও যোগ দিয়েছে।
রাত হয়েছে। এবার শোয়া দরকার। সেই ব্যবস্থাই করতে লাগল তিনজনে।
মুসা বলল, গায়ের শার্ট খুলে নাও। ঘামে ভিজে গেছে। রাতে কষ্ট পাবে। খুলে শুকনো শার্ট যতগুলো আছে সব পরে নাও।
খুলতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। কিন্তু জানে, মুসা ঠিকই বলেছে। রাতে তাপমাত্রা আরও কমে যাবে, আর ওরা ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে যদি আগুন নিভে যায় তাহলে তো সাংঘাতিক অবস্থা হবে গায়ে কাপড় বেশি না থাকলে।
দ্রুত শার্ট বদলে নিল ওরা। তার ওপরে চড়াল জ্যাকেট। চেন টেনে দিয়ে মুসা বলল, মোজাও খোলো। ভেজা মোজা শরীরের তাপ শুষে নেয়।
জুতো খুলে মোজায় টান দিতেই দুর্গন্ধ বেরেতে শুরু করল। নাক কুঁচকে ফেলল তিনজনেই। মোজা বদলে জিনসের প্যান্টের নিচটা মোজার ভেতরে গুঁজে দিল। শার্ট জল প্যান্টের ভেতরে। মোটকথা বাতাস ঢোকার কোন পথই রাখল না।
রাতের জন্যে রাখা খাবার ভাগ করে দিল কিশোর। খুব সামান্য খাবার। কিছু পপকর্ন আর ক্যাণ্ডি। ধীরে ধীরে খেল ওরা। তারপর ডালপাতা বিছিয়ে পুরু করে ম্যাট্রেস তৈরি করল।
পপকর্নের খালি প্যাকেটগুলো নিয়ে গিয়ে বিমানের ভেতরে রেখে এল মুসা। বলল, এসব ছড়িয়ে ফেলে রাখলে গন্ধে গন্ধে এসে হাজির হবে বুনো জানোয়ার। আর কিছু না পেয়ে শেষে আমাদেরকেই ধরে খাবে।
মাইলার স্পেস ব্লাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে আগুনের পাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। ওরা। আগুনের নিচের অংশটা নীল, ওপরের কমলা রঙের শিখা যেন লকলক করে বেড়ে উঠে লাফ দিয়ে দিয়ে কালো তারাজ্বলা আকাশ ছুঁতে চাইছে।
চোখ মুদল ওরা। বিশ্রাম দরকার, আগামী দিনের পরিশ্রমের জন্যে। মিস্টার মিলফোর্ডকে খুঁজে বের করতে হবে।
হঠাৎ করেই কথাটা মনে এল কিশোরের। ঘুমজড়িত গলায় জিজ্ঞেস করল, রবিন, তোমার কন্ট্যাক্ট লেন্সের কি খবর? কবে খুলতে হবে?
কি একটা অসুবিধে দেখা দিয়েছে রবিনের চোখে। কন্ট্যাক্ট লেন্স পরার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার।
আরও হপ্তাখানেক পরে থাকতে হবে।
ও। তাহলে সময় আছে। এখান থেকে বেরিয়ে যেতে সাতদিনের বেশি লাগবে না আমাদের। অসুবিধেয় পড়তে হবে না তোমাকে। সময় মতই গিয়ে খুলতে পারবে।
রবিন চুপ করে রইল। তিক্ত হাসি হাসল মুসা। নিঃশব্দে। আদৌ কোন দিন। এই দুর্গোম বুনো এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে কি-না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার।
ঘুমিয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমিয়েছে, ফলে গাঢ় হচ্ছে না ঘুম। রবিন ঘুমাতেই পারল না। চোখ খোলা। তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। তারা দেখছে। ওই যে বিগ ডিপার, ওটা উরসা মেজর, আর ওটা বাবা, কোথায় তুমি! প্রায় নিঃশব্দে ককিয়ে উঠল সে। ভেব না, বাবা, কোনমতে রাতটা কাটাও। কাল তোমাকে খুঁজে বের করবই আমরা!
চোখ মুদল অবশেষে রবিন। একটা পেঁচা কিরর কিরর করল। হউউ হউউ করল কোট। বনের ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগল একটা বড় জানোয়ার। বহুদূরে পাহাড়ী পথে ট্রাকের ভারি ইঞ্জিনের শব্দ মৃদুভাবে কানে এল বলে মনে হল তার। রাতের বেলা শব্দ অনেক দূরে ভেসে যায়, আর অনেক সময় নীরবতার মাঝে থেকে নানা রকম অদ্ভুত কল্পনাও করতে থাকে মানুষ, ভুল শোনে…
ভারি হয়ে এল রবিনের নিঃশ্বাস। জেগে থেকে এখন রাবার কোন উপকারই। করতে পারবে না, বুঝতে পারছে। নিজের শরীরেই ক্ষতি করবে। তাতে পরোক্ষভাবে তার বাবার ক্ষতিই হবে, যদি কাল খুঁজতে বেরোতে না পারে সে। ধীরে ধীরে ঢিলে করে দিল শরীর। স্নায়ু ঢিল করতেই চেপে ধরল এসে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি। ঘুমিয়ে পড়ল। মুসা আর কিশোরের মতই তার ঘুমও গাঢ় হতে পারছে না। ঘুমের মধ্যেই অবচেতন মনে একটা প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে, কোথায় রয়েছে সে?