৫. আমাদের হোটেলটা বেশ বড়

॥ ৫ ॥

আমাদের হোটেলটা বেশ বড় আর পরিচ্ছন্ন, অথচ ভাড়া খুব বেশি নয়। ‘ট্র্যাভল এজেন্ট ভালোই চয়েস করেছিল মশাই,’ বললেন লালমোহনবাবু। টিউব থেকে বেরিয়ে শহরের চেহারা দেখে প্রথমে ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছিল না। শেষে বললেন, ‘আচ্ছা মশাই, আমাদেরও লাল ডবল ডেকার, আর এখানেও দেখছি লাল ডবল ডেকার। এগুলো কেমন ছিমছাম, আর আমাদেরগুলো এমন ছিবড়ের মতো চেহারা কেন বলুন ত?’

লাঞ্চ হোটেলে সেরে ফেলুদা বলল, ‘তোরা যদি খুব টায়ার্ড না বোধ করিস তা হলে একবার অক্সফোর্ড স্ট্রীটটা ঘুরে দেখে আয়। ব্যস্ত লন্ডনের এমন চেহারা আর কোথাও পাবি না।’

‘আর তুমি কী করবে?’

‘বলছিলাম না—আমার এক কলেজের বন্ধু—বিকাশ দত্ত—এখানে ডাক্তার। তাকে একবার ফোন করে জানিয়ে দিই আমি এসেছি, আর দেখি যদি ও কোনো ইনফরমেশন দিতে পারে।’

আমরা অবিশ্যি তেমন কিছু ক্লান্ত হইনি, তাই বেরোনই স্থির করলাম।

ফোন করে তার বন্ধুকে পেয়ে গেল ফেলুদা। মিনিটখানেক কথা বলে ফোন রেখে বলল, ‘বিকাশ আমার গলা শুনে একেবারে থ। একটা মামলা যে কোনোদিন আমাকে লন্ডনে এনে ফেলবে সেটা ও ভাবতেই পারেনি। তা ছাড়া ওর কাছ থেকে একটা খবরও পাওয়া গেল।’

‘কী খবর?’

‘লন্ডনে এক বৃদ্ধ বাঙালী ডাক্তার আছেন, তিনি নাকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হবার কিছু পরেই এখানে আসেন ডাক্তারির ছাত্র হয়ে। তারপর লন্ডনে প্র্যাকটিস করেন। নাম নিশানাথ সেন। খুব মিশুকে লোক। বিকাশের ধারণা উনি হয়ত রঞ্জনবাবুর বাবাকে চিনতেন। ওঁর চেম্বারের ঠিকানাটা দিয়ে দিল। আমি একবার ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে আসি।’

ফেলুদা উঠে পড়ল।

‘অন্ধকারে ঢিল যদি ছুঁড়তেই হয়, তা হলে সেটা এখনই আরম্ভ করে দেওয়া ভালো।’

আমরা একসঙ্গেই বেরোলাম। ফেলুদা টিউব স্টেশনের দিকে গেল, আর আমরা ওর কাছ থেকে ডিরেকশন নিয়ে অক্সফোর্ড স্ট্রীটের দিকে হাঁটা দিলাম।

অক্টোবর মাস, তাই বেশ ঠাণ্ডা। আমরা দু’জনেই গলায় মাফলার জড়িয়ে নিয়েছি।

পথে অনবরত ভারতীয় চোখে পড়ছে, তাই বোধ হয় জটায়ু বললেন, ‘বেশ অ্যাট-হোম ফিল করছি ভাই তপেশ। অবিশ্যি রাস্তার মসৃণ চেহারা মোটেই হোমের কথা মনে পড়ায় না।’

অক্সফোর্ড স্ট্রীটে পৌঁছে চোখ টেরিয়ে গেল। শুধু যে দোকানের বাহার তা নয়; এরকম ভিড় আর কোনো রাস্তায় কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

‘জনসমুদ্র! ওশন অফ হিউম্যানিটি, তপেশ, ওশন অফ হিউম্যানিটি।’

এই জনসমুদ্রের সঙ্গে তাল রেখে চলতে হচ্ছে, তাই আস্তে হাঁটার উপায় নেই। সমস্ত রাস্তাটাই যেন একটা অবিরাম ব্যস্ততার ছবি। আর দোকানের কথা কী আর বলব! ঝলমলে লোভ লাগানো চেহারা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল ডিপার্টমেন্ট স্টোর। নামগুলো পড়ছি—ডোবনহ্যাম, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসরস, বুটস, ডি এইচ এভান্‌স…

একটা বড় দোকানের কথা আমি আগেই জানতাম—সেল্‌ফ্রিজেস—আর এটাও জানতাম যে সেটা অক্সফোর্ড স্ট্রীটের একেবারে শেষ প্রান্তে। দোকানটা যে এত বড় সেটা আমি ভাবতেই পারিনি। ‘চলুন, একটা জিনিস দেখাই’ বলে লালমোহনবাবুকে হাত ধরে রাস্তা পার করে সেল্‌ফ্রিজেসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তারপর ঘুরপাক খাওয়া দরজা দিয়ে দু’জনে দোকানের ভিতর ঢুকলাম। আমাদের মুখ হাঁ হয়ে গেল। রাজ্যের সবরকম জিনিস এই এক দোকানে পাওয়া যায়, তাই ক্রেতাদের ভিড়ও দেখবার মতো। সেই ভিড়ের চাপে এদিকে ওদিকে টলছি, এক পা এগোচ্ছি ত দু’ পা পেছোচ্ছি। জটায়ু যাতে হারিয়ে না যান তাই তাঁর হাতটা চেপে ধরে আছি।

‘মানুষেরও যে ট্র্যাফিক জ্যাম হয় তা এই প্রথম দেখলাম,’ বললেন ভদ্রলোক।

খানিক দূর এগিয়ে একটা মোটামুটি কম ভিড়ের জায়গায় পৌঁছলাম।

‘এমন জায়গায় এসে কিছু না কিনে ফিরে যাব?’ বললেন লালমোহনবাবু।

‘কী কিনতে চাইছেন আপনি?’

‘চারিদিকে ত দেখছি কলম পেনসিল নোটবুকের সম্ভার। একটা মাঝারি দামের ফাউন্টেন পেনও যদি কিনতে পারতাম। সামনের উপন্যাসটা লন্ডনে কেনা কলমে লিখতে পারলে…’

‘বেশ ত, আপনি দেখে বেছে নিন।’

মিনিট পাঁচেক দেখার পর ভদ্রলোক একটা মনের মতো কলম খুঁজে পেলেন। ‘থ্রী পাউন্ডস থার্টি পেন্স। তার মানে আমাদের দেশের হিসেবে কত হল?’

‘তা প্রায় পঁচাত্তর টাকা।’

‘গুড। এই জিনিসের কলকাতায় দাম হত দুশো।’

‘আর কী—পেমেন্ট করে দিন।’

‘কী বলব বল ত? মানে, প্রথম দিন ত, একটু গাইডেন্স না পেলে…’

‘আপনাকে কিছুই বলতে হবে না। কলমটা নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে দিন আর একটা পাঁচ পাউন্ডের নোট দিন। ওরা চেঞ্জ ফেরত দেবে, আর কলমটা ওদের একটা খামে পুরে দেবে। ব্যস্‌, খতম।’

‘তুমি প্রথম দিন এত কী করে জানলে বল ত?’

‘আমি ত এসে অবধি চতুর্দিকে দেখছি। আপনিও দেখছেন, কিন্তু আপনি অবজার্ভ করছেন না।’

দু’ মিনিটের মধ্যে ভদ্রলোক তার নতুন কেনা কলম নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে এলেন। আমি বললাম, ‘চা খাবেন?’

‘কোথায়?’

‘আমি যত দূর জানি, ওপরে একটা রেস্টোরান্ট আছে।’

‘বেশ ত, চলো যাওয়া যাক।’

চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে চার তলায় খাবার জায়গাটা আবিষ্কার করলাম, আর সেই সঙ্গে ভাগ্যক্রমে একটা খালি টেবিলও পেয়ে গেলাম।

চা খাওয়া শেষ করে আবার অক্সফোর্ড স্ট্রীটের জনসমুদ্র পেরিয়ে যখন হোটেলে ফিরলাম তখন সাড়ে চারটা বেজে গেছে। ঘরে গিয়ে দেখি ফেলুদা হাজির।

‘বিলেত ব্যাপারটা কী তার কিছু আন্দাজ পেলেন?’

লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

‘কেমন লাগল বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘কেন, আপনার বই পড়ে ত মনে হয় আপনার বিশেষণের স্টক অফুরন্ত।’

‘বাংলায় বোঝাতে পারব না। বলতে হয় সুপার-সেনসেশন্যাল। এখনো মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। বিশ্রী দোটানার মধ্যে পড়ে গেছি।’

‘কেন?’

‘লন্ডন দেখব, না আপনার তদন্তের প্রোগ্রেস দেখব।’

‘তদন্ত ত সবে শুরু। তেমন জমে উঠলে আমি নিজে থেকেই বলব। আপাতত লন্ডন দেখে নিন।’

‘সেই ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘হল, তবে কথা প্রায় কিছুই হল না। ভদ্রলোক রুগী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কাল সকালে ওঁর বাড়ি যেতে বলেছেন। রিচমন্ডে থাকেন।’

‘সেটা কোথায়?’

‘পিকাডিলি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে রওনা হয়ে সাউথ কেনসিংটনে চেঞ্জ করে গ্রীন লাইন ধরে সোজা রিচমন্ড। এ ধরনের জায়গাও ত দেখা দরকার। ভদ্রলোক স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন আমাদের জন্য। বেশ অমায়িক লোক। রঞ্জনবাবুর বাবাকে চিনতেন এটুকু জেনেছি।’

হোটেলের ঘরে ঘরে টেলিভিশন, তাই দেখেই সন্ধেটা দিব্যি কেটে গেল। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম, আর বালিশে মাথা রাখতেই চোখ ঘুমে ঢুলে এল।