ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৫. অভিশপ্ত অঙ্কুশ

৫. অভিশপ্ত অঙ্কুশ

খুব ছোটোবেলায় মোগলিকে বাঁদরদের কবল থেকে যে উদ্ধার করেছিল, কা নামক সেই বিশাল সপর্দানবকে তোমরা নিশ্চয়ই মনে রেখেছ? ওই ঘটনার পর অনেকগুলো বৎসর চলে গেছে, শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ মোগলির সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধুদের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে অজগর কা। প্রতিদিন বিকালে অজগর-বন্ধুর সঙ্গে খেলা করে মোগলি। খেলার ছলে পরস্পরের শক্তিপরীক্ষা করে তারা। কা অবশ্য যে-কোনো সময়ে তার কঠিন আলিঙ্গনে জড়িয়ে মোগলির সর্বাঙ্গ চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে। কিন্তু ছোট্ট বন্ধুটিকে খুবই ভালবাসে কা, ওরকম ভয়ানক ইচ্ছা তার মনে কোনো সময়ই জেগে ওঠে না। তাদের নকল লড়াই সর্বদা একভাবেই শেষ হয় অজগরের মাথাটা বল্লমের ফলার মতো সজোরে আঘাত করে মোগলির দেহে এবং সেই আঘাতের বেগে ছিটকে মাটির উপর পড়ে যায় মোগলি। প্রতিদিনের মতো সেদিন বিকালেও কা-এর ছোবল খেয়ে ধরাশায়ী হওয়ার পর কিছুক্ষণ অজগর-বন্ধুর সঙ্গে সাঁতার কাটল মোগলি, তারপর দুই হাত মাথার পিছনে রেখে চিৎ হয়ে ভেসে রইল জলের উপর। কা-এর মাথাটা জল কেটে এগিয়ে এসে স্থির হয়ে থাকল মোগলির কাঁধে।

ওই সময়ে একটা গোখরো সাপ পাথরের উপর থেকে চট করে নেমে এসে জলপান করল, তারপর জঙ্গলের প্রথা অনুসারে তাদের উত্তম শিকার বলে অভিবাদন জানিয়ে দ্রুত স্থানত্যাগ করল।

কা হঠাৎ মোগলিকে জিজ্ঞাসা করল মানুষের ঘর থেকে জঙ্গলে এসে সে সুখী হয়েছে কি না। উত্তরে মোগলি জানাল জঙ্গল তাকে সব কিছুই দিয়েছে, তার কোনো চাহিদা নেই। জঙ্গলের কাছে।

আচ্ছা। তবে গোখরোটা বলছিল–কা তার বক্তব্য শুরু করল। তাকে বাধা দিয়ে মোগলি বলে উঠল, কোন গোখরো? এইমাত্র যে-সাপটা এখান দিয়ে গেল? ও শিকারের সন্ধানে বেরিয়েছিল, আমাদের ও কিছুই বলেনি।

ও নয়। আর একটা গোখরো।

তুমি বিষাক্ত প্রাণীদের সঙ্গে তাহলে মেলামেশা কর? আমি কিন্তু ওদের এড়িয়ে চলি। ওদের দাঁতে বাস করে সাক্ষাৎ মৃত্যু। যাই হোক- তুমি যে সাপটার কথা উল্লেখ করছ, সে তোমায় কী বলেছে?

মোগলির প্রশ্নের উত্তরে কা যা বলল তা থেকে জানা গেল, শিকারকে তাড়া করে কিছুদিন আগে শীতল গহ্বর নামে পরিত্যক্ত নগরীতে প্রবেশ করেছিল সে। সেইখানে একটি শ্বেতকায় গোক্ষুর সর্পের সঙ্গে তার দেখা হয়। ওই সাদা সাপটি অজগরকে কয়েকটা অদ্ভুত জিনিস। দেখিয়ে বলে, মানুষের কাছে ওই জিনিসগুলো দারুণ মূল্যবান। কা আরও বলল, ওই ধরনের জিনিস সে আগে কখনো দেখেনি। তবে সাদা গোখরো তাকে বলেছে, ওই জিনিসগুলো হস্তগত করার জন্য মানুষ মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তেও নারাজ হবে না।

তাহলে ওগুলো নতুন ধরনের শিকার, মোগলি বলল, বিষাক্ত প্রাণীদের একটা মস্ত দোষ হচ্ছে, সামনে শিকার থাকলেও তারা কখনো আমাদের খবর দেয় না। সেইজন্যই ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সম্ভব হয় না।

না, ওইগুলো শিকার নয়। ওইগুলো যে কী, তা আমি বলতে পারব না।

 আমি তাহলে তোমার সঙ্গে সেই জায়গায় যাব। সাদা সাপ কখনো আমার চোখে পড়েনি। আমি সাপটাকে তো দেখবই, ওই অদ্ভুত জিনিসগুলোর সঙ্গেও আমার চাক্ষুষ পরিচয় ঘটবে। আচ্ছা, সাদা সাপটা কী জিনিসগুলোকে মেরে ফেলেছে?

ওগুলো জ্যান্ত নয়, মড়া। সাপটা আমায় বলেছে, সে ওই জিনিসগুলোর রক্ষক। তাদের ও পাহারা দেয়।

তাহলে চলো। এখনই আমরা ওখানে যাব।

অতঃপর জলাশয় থেকে উঠে শীতল গহ্বর নামে পরিত্যক্ত নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল এক মানব-কিশোর এবং এক অতিকায় অজগর। ওই নগরে একসময়ে বাঁদরদের হাতে বন্দি হয়েছিল মোগলি— কিন্তু এখন আর সে তাদের ভয় পায় না, বরং বাঁদরের দলই তাকে ভয় করে যমের মতো। মোগলি আর কা যখন নগরে প্রবেশ করল তখন বাঁদরের দল ছিল বনের ভিতর- তাই ভাঙাচোরা পাথর আর ইটের স্তূপ নিয়ে পরিত্যক্ত নগরী ছিল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। চাঁদের আলোতে মোগলিকে পথ দেখিয়ে ভগ্নস্তূপের মধ্যে একটা প্রাসাদের সমতল ছাদে এসে উঠল কা এবং ভাঙাচোরা সিঁড়ি আর আবর্জনার ভিতর দিয়ে ঢুকে গেল মাটির তলায়। সর্পজাতিকে বন্ধুত্বের আহ্বান জানাল মোগলি সাপের ভাষায়- তোমার আমার শরীরে রয়েছে একই রক্তধারা–তারপর হামাগুড়ি দিয়ে অনুসরণ করল অজগর-বন্ধুকে। একটা ঢালু পথ বেয়ে অনেক দূর নেমে গেল তারা। পথটা সোজা নয়, অনেক বাঁক আর অনেক পাক ঘুরে ওই পথ বেয়ে মোগলি আর কা এসে যেখানে থামল সেখানে একটা ত্রিশ ফুট উঁচু মস্ত গাছ দেয়াল থেকে নিরেট পাথর খসিয়ে তার শিকড় ঠেলে দিয়েছে। সেই ফাঁক দিয়ে দুজন গুঁড়ি মেরে ঢুকল এবং দেখল অর্ধগোলাকৃতি ছাদের তলায় মস্ত এক ঘরের মধ্যে তারা এসে পড়েছে। ঘরটার ছাদের অবস্থাও শোচনীয়। ছাদ ভেদ করে ঝুলছে। কয়েকটা গাছের শিকড়; আর তার ফলে যে-সব ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, তারই ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চাঁদের ক্ষীণ আলোকধারা অন্ধকার ঘরের মধ্যে।

এটা নিরাপদ আশ্রয়, এতক্ষণ পরে সোজা হয়ে দাঁড়াল মোগলি, কিন্তু প্রতিদিন এতদূরে আসা সম্ভব নয়। আচ্ছা, এখানে দেখার মতো কী আছে?

আমি কি কিছুই নয় ঘরের মধ্যস্থল থেকে ভেসে এল কণ্ঠস্বর। মোগলি দেখল, অন্ধকারের মধ্যে সাদা রং-এর কিছু নড়াচড়া করছে। দেখতে দেখতে সেই বস্তুটি প্রকাণ্ড এক শ্বেত সর্পের আকার নিয়ে ফণা তুলে দাঁড়াল। এত বড়ো গোখরো সাপ এর আগে কোনোদিন মোগলির চোখে পড়েনি। সরীসৃপের শরীরটা প্রায় আট ফুট লম্বা। মাথার উপর চশমার মতো চিহ্নটা হালকা হলুদ, গায়ের রং দুধের মতন সাদা এবং দুই চোখ চুনি পাথরের মতো রক্তিম সব মিলিয়ে দস্তুরমতো একটি দ্রষ্টব্য বটে!

উত্তম শিকার, মোগলি বলল। ভদ্র ব্যবহার করতে কখনোই ভোল না সে, যেমন ছুরিটাকেও সঙ্গে রাখতে কখনো ভুল হয় না তার।

শহরের খবর কি? শ্বেত গোক্ষুর মোগলির অভিবাদনের উত্তর না দিয়ে বলল, পাঁচিল ঘেরা মস্ত শহর– যে-শহরে রয়েছে একশো হাতি, বিশ হাজার ঘোড়া আর অসংখ্য গরু-মোষ- যে-শহরে বাস করেন বিশজন রাজার অধিপতি রাজাধিরাজ। এখানে মাটির তলায় থেকে আমার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, যুদ্ধের বাজনা আর শুনতে পাই না আমি।

এখানে ওসব কিছু নেই; চারদিকে মাথার উপর আছে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল, মোগলি বলল, কিন্তু তুমি কে?

সাদা গোখরো বলল, আমি রাজার ধনরত্নের প্রহরী। কারান রাজা যখন আমার মাথার উপর পাথরের আচ্ছাদন বানিয়েছিল তখন আমার গায়ের চামড়া ছিল কালো। উপর থেকে ধনরত্ন এখানে নামিয়ে দেওয়া হত। আমি ধনরত্নের রক্ষক হওয়ার পর পাঁচবার মাথার উপরের পাথরটা তুলে নেওয়া হয়েছিল আর প্রত্যেকবারই উপর থেকে নেমে এসেছে নতুন নতুন ধনরত্ন। এখানে শুধু জমেছে, কিছু তুলে নেওয়া হয়নি এখান থেকে। এখানে যে ধনরত্ন আছে তার তুলনা নেই- একশো রাজার সম্পদ আছে এই ঘরে। কিন্তু বহুদিন হল উপরের পাথরটা কেউ সরাতে আসেনি। মনে হয়, আমার শহরটাকে সকলে ভুলে গেছে।

এখানে কোনো শহর নেই। উপরে তাকিয়ে দেখ। বিশাল বিশাল গাছের শিকড় নেমে এসেছে পাথর ভেদ করে। গাছ যেখানে গজায়, সেখানে মানুষ থাকে না, কা বলল।

দু-বার কী তিনবার মানুষ এখানে এসেছে, সাদা গোখরো হিংস্রভাবে বলল, তারা একবারই চিৎকার করতে পেরেছে, কিন্তু এখান থেকে আর ফিরে যায়নি। এখন তোমরা এসেছ, সাপ আর মানুষ মিলে আমাকে বোঝাতে চাও যে, আমার শহর আর নেই, আমার প্রহরীর কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে– আমি আর রাজার ধনরক্ষক নই। তোমরা মিথ্যাবাদী। আমি এখনও রাজসম্পত্তির রক্ষক। নীচু হয়ে দেখ– খুশিমতো একটা কিছু তুলে নাও। পৃথিবীতে এমন মূল্যবান রত্নসম্পদ আর কোথাও নেই। যে-মানুষটা সাপের ভাষায় কথা বলতে জানে, সে যদি জীবিত অবস্থায় এখান থেকে ফিরে যেতে পারে, তাহলে ছোটোখাটো অনেক রাজা ওর চাকর হয়ে থাকবে।

তুমি নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে, মোগলি ঠাণ্ডা গলায় বলল, ওহে সাদা গোখরো, আমি তো এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার মতন কোনো জিনিসই দেখতে পাচ্ছি না।

এই ছেলেটা দেখছি মরার আগে পাগল হয়ে গেছে, সাদা গোখরো বলল, ওহে ছোকরা, তুমি চিরকালের মতো চোখ বোজার আগে তোমাকে আমি এইটুকু অনুগ্রহ করছি- তাকিয়ে দেখ, মানুষ যা কখনো দেখেনি, তা দেখে নাও।

জঙ্গলে কেউ মোগলিকে অনুগ্রহ করার কথা মুখে আনতেও সাহস পায় না, ছেলেটি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, যা-ই হোক, তুমি যদি খুশি হও, তাহলে আমি জিনিসগুলো দেখব।

ঘরের মেঝে থেকে সে কয়েকটা চকচকে জিনিস তুলে নিল, এই জিনিস দিয়ে মানুষদের আমি খেলতে দেখেছি। তবে সেগুলো ছিল বাদামী আর এগুলো হলুদ। (তামার পয়সা আর সোনার মোহরের তফাৎ জানত না বনের ছেলে মোগলি)।

সে স্বর্ণমুদ্রাগুলি ফেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। ঘরের মেঝে সোনা আর রুপোর তৈরি টাকায় ভর্তি। তারই ফাঁকে ফাঁকে হীরা-জহরত বসানো অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র, রত্নখচিত হাওদা, মহামূল্য মণিমুক্তায় সজ্জিত দেবদেবীর মূর্তি ও অলংকার প্রভৃতি মহার্ঘ বস্তু দেখা যাচ্ছে। বহুকাল ধরে যুদ্ধ, ব্যবসা, রাজস্ব এবং লুণ্ঠন থেকে যে বিপুল ধনরত্নের রাশি সঞ্চিত হয়েছে, একশো রাজার মিলিত ধনভাণ্ডারও তার কাছে তুচ্ছ। তবে শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত বনেজঙ্গলে ঘুরে যে-ছেলেটি বড়ো হয়েছে, সেই মোগলির পক্ষে পূর্বোক্ত ধনরত্নের মূল্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর মেঝের উপর রাশি রাশি মোহরের মধ্যে একটি রত্নখচিত হাওদার সামনে যে-বস্তুটি মোগলির দৃষ্টি আকর্ষণ করল, সেটি হচ্ছে একটি অঙ্কুশ। বহু মূল্যবান রত্ন আর হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি জিনিসটি ভারি চমৎকার।

সাদা গোখরো মোগলিকে অনুসরণ করছিল।

এখন বলো তো এই জিনিসটি কেমন? এমন একটি দর্শনীয় বস্তু দেখার জন্য মৃত্যুকেও বরণ করা যায়, তাই না? গোখরো সাপ বলল, আমার অনুগ্রহেই তুমি এমন সৌভাগ্য অর্জন করলে।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মোগলি বলল, জিনিসটা ঠাণ্ডা আর শক্ত খাদ্য হিসাবেও এটা অচল। তবে

মোগলি অঙ্কুশটাকে তুলে নিল, তবে তুমি যদি এই জিনিসটা আমায় দাও, তাহলে আমি খুশি হব। পরিবর্তে তোমার খাওয়ার জন্য ব্যাং ধরে আনব।

সাদা গোখরোর শরীরটা কঁপতে লাগল হিংস্র পুলকে। নিশ্চয় এটা আমি তোমায় দেব, সে বলল, শুধু এটা নয়, এখানে যা ধনরত্ন রয়েছে, সব কিছুই তোমাকে দেব- অবশ্য তুমি এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে।

কিন্তু আমি তো এখনই চলে যাব এখান থেকে। জায়গাটা ঠাণ্ডা আর অন্ধকার। এই জিনিসটা নিয়ে আমি জঙ্গলে চলে যাব।

তোমার পায়ের দিকে তাকাও। কী পড়ে আছে বল তো?

সাদা আর মসৃণ একটি বস্তু মোগলি তুলে নিল মাটি থেকে, এটা তো দেখছি মানুষের মাথার হাড়, সে শান্তভাবেই বলল, এইরকম আরও দুটো জিনিস পড়ে আছে এখানে।

ওরা এখানে ধনরত্ন চুরি করতে এসেছিল বহু বৎসর আগে। আমি অন্ধকারের মধ্যে ওদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারপর থেকে ওরা এখানে পড়ে আছে।

কিন্তু ধনরত্ন নামে এই জিনিসগুলো নিয়ে আমি কী করব? এই অঙ্কুশটা যদি আমায় দাও, তাহলে আমি উত্তম শিকার বলে তোমায় অভিবাদন জানাব। যদি না দাও, তাহলেও বলব উত্তম শিকার। আমি বিষধর প্রাণীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি না। তোমার জাতভাইদের মধ্যে প্রচলিত আইন আমার জানা আছে।

এখানে আমার কথাই আইন। আমি যা করব, তার উপর কোনো আইনের শাসন চলবে না।

কা জ্বলন্ত চোখে এগিয়ে এল সামনে, কে আমাকে এখানে মানুষটাকে নিয়ে আসতে বলেছিল?

আমি বলেছিলাম, বুড়ো গোখরো বলল, বহুদিন হল আমি মানুষের মুখ দেখিনি। আর এই মানুষটা আমাদের ভাষায় কথা বলে।

কিন্তু ওকে মেরে ফেলার কথা ছিল না। এখন আমি জঙ্গলে গিয়ে কেমন করে বলব যে, ওকে মৃত্যুর মুখে আমিই টেনে এনেছি?

সময় না আসার আগে পর্যন্ত আমি মেরে ফেলার কথা বলিনি। আর তোমার যাওয়া না-যাওয়ার ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে, দেয়ালের গায়ে যে গর্তটা রয়েছে- ওইটি দিয়ে খুব সহজেই তুমি বেরিয়ে যেতে পার। তোমার সঙ্গে আমি লড়াই করতে চাই না। বানরখেকো হোঁৎকা অজগর, আমি যদি তোমার ঘাড়টা একটু ছুঁয়ে দিই, তাহলে জঙ্গলে আর কেউ কোনোদিন তোমায় দেখতে পাবে না। এখানে এসে কোনো মানুষ কোনোদিন ফিরে যায়নি। রাজার শহরে ধনরত্নের আমিই একমাত্র প্রহরী, একমাত্র রক্ষক।

ওহে অন্ধকারের সাদা পোকা, চিৎকার করে উঠল কা, আমি তোমায় আগেও বলেছি, এখনও বলছি, এখানে রাজাও নেই, শহরও নেই আছে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল।

কিন্তু ধনরত্ন এখনও আছে। ওহে অজগর কা– একটু অপেক্ষা কর, এখনই তুমি একটা চমৎকার দৌড়ের প্রতিযোগিতা দেখতে পাবে। এখানে ছুটোছুটি করার মতো যথেষ্ট জায়গা। আছে। ওগো মানুষের ছেলে জীবন বড়ো মূল্যবান, বুঝেছ? এবার ছুটতে শুরু কর, আমি আসছি তোমার পিছনে। দেখ, যদি প্রাণ বাঁচাতে পার।

মোগলি শান্তভাবে কা-এর মাথায় হাত রাখল, তার কণ্ঠস্বরে কিছুমাত্র উত্তেজনার আভাস নেই, ও আমায় জানে না। ও যেসব মানুষের কাছাকাছি এসেছে, তারা কেউ আমার মতন নয়। ও যে-খেলা খেলতে চাইছে, সেই শিকার-খেলা এখনই ও দেখতে পাবে।

অঙ্কুশটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল মোগলি, চোখের পলক ফেলার আগেই সে বস্তুটিকে ছুঁড়ে মারল সাদা গোখরের দিকে। অঙ্কুশটা আড়াআড়িভাবে গোখবোর ফণার পিছনে আঘাত করে তার মাথাটা ঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ বিষধরের চাবুকের মতো ছটফট-করা শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কা- অজগরের বিশাল দেহের ওজন সাদা গোখরোর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত অবশ করে দিল! গোখরোর লাল চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলতে লাগল এবং ছয় ইঞ্চির মতো মাথার যে-অংশটা অজগরের দেহের তলায় চাপা পড়েনি, সেই মাথাটা মাটির উপরেই ডাইনে-বাঁয়ে ছোবল মারতে লাগল ব্যর্থ আক্রোশে!

মোগলির হাত ছুরিটাকে স্পর্শ করল। কা চেঁচিয়ে উঠল, হত্যা কর।

না, ছুরি তুলে এগিয়ে এল মোগলি, শুধুমাত্র খাদ্যসংগ্রহের জন্যই আমি হত্যা করি, অনর্থক রক্তপাতে আমার রুচি নেই। কিন্তু কা– তাকিয়ে দেখ

গোখরোর ফণার পিছনটা চেপে ধরে ছুরির ফলা দিয়ে তার মুখ ফাঁক করে মোগলি দেখিয়ে দিল ওপরের চোয়ালে প্রাণঘাতী দুটি বিষদাঁত শুকিয়ে মাড়ির সঙ্গে মিশে গেছে। সর্পকুলের নির্দিষ্ট আয়ুর সীমানার মধ্যে তাদের বিষও শুকিয়ে যায় কোনো সাপ যদি নির্দিষ্ট সময়ের পরেও বেঁচে থাকে তখন তার বিষও হয়ে যায় অকেজো। সাদা গোখরো তার আয়ুর সীমা পার হয়েও বেঁচে আছে বটে, তবে প্রকৃতির নিয়মেই তার মুখের বিষ হারিয়ে ফেলেছে প্রাণহরণের ক্ষমতা।

মোগলি বলল, ওর বিষদাঁত শুকিয়ে গেছে, দেখেছ কা? অজগরকে ইঙ্গিতে সরে যেতে বলল মোগলি, তারপর অঙ্কুশটা তুলে নিয়ে গোখরোকে মুক্তি দিল।

রাজার ধনরত্ন পাহারা দেওয়ার জন্য নতুন রক্ষক দরকার, মোগলি বলল, তোমার দিন শেষ হয়ে গেছে গোখরো। এইবার ছুটোছুটির খেলাটা শুরু কর তুমি। আমি আসছি তোমার পিছনে ছুরি হাতে।

আমায় যথেষ্ট অপমান করা হয়েছে। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। আমায় তুমি খুন কর! খুন কর! হিস হিস করে উঠল সাদা গোখরো।

বড়ো বেশি খুনোখুনির আলোচনা হয়েছে। আর নয়। আমি এই কাঁটার মতন চোখা আর ধারাল জিনিসটা নিয়ে যাচ্ছি। তোমার অনুমতির প্রয়োজন নেই। কারণ, তোমাকে আমি লড়াইতে হারিয়ে দিয়েছি।

নিয়ে যাও। কিন্তু শুনে যাও, আমার মতো হত্যার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি ওই অঙ্কুশ। জঙ্গলের মানুষ তোমার আয়ু বেশিদিন নেই। ওই জিনিসটা তোমায় হত্যা করবে খুব শীঘ্রই। তোমার হাত থেকে অঙ্কুশ যার হাতে যাবে, তারও মৃত্যু অবধারিত। হাতে হাতে ঘুরবে ওই অভিশপ্ত বস্তু আর পরিবেশন করবে মৃত্যু, মৃত্যু আর মৃত্যু!

মোগলি গর্তের পথে বাইরে এল। ঘরটা ছেড়ে বাইরে আসার পূর্বমুহূর্তে সে দেখেছে সাদা গোখরো তার বিষহীন দাঁতের ছোবল মারছে সোনার তৈরি দেবমূর্তির উপর আর বলছে, মৃত্যু! মৃত্যু! মৃত্যু!

…পরের দিন সকালের আলোয় মণিমুক্তায় সজ্জিত অঙ্কুশটা ঝকঝক করে জ্বলে উঠল মোগলির হাতে।

বাঃ! এটা দেখছি বাঘিরার চোখের চাইতেও উজ্জ্বল, অঙ্কুশের গোড়ার দিকে বসানো লাল পরাগ মণিটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল মোগলি, এটা আমি বাঘিরাকে দেখাব। কিন্তু সাদা গোখরো যে মৃত্যুর কথা বলছিল, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তুমি আমাকে বুঝিয়ে দেবে কা?

কা বলল, আমিও বুঝতে পারিনি সাদা গোখরোর কথা। তবে বয়সের ভারে সাদা হয়ে যাওয়া বুড়ো গোখরোটা তোমার ছুরির স্বাদ পেল না বলে আমি খুবই দুঃখিত। ওকে মেরে ফেলাই উচিত ছিল। শীতল গহবর নামে পরিত্যক্ত শহরে মাটির উপর আর মাটির তলায় লুকিয়ে আছে অমঙ্গলের অভিশাপ। যাক, ওদের কথা ছেড়ে দাও। আমার খিদে পেয়েছে। তুমি কি আমার সঙ্গে শিকারের সন্ধানে যাত্রা করবে?

কা-এর প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়ে মোগলি ছুটল বাঘিরার খোঁজে। অঙ্কুশটা তাকে না দেখিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না মোগলি। কালো চিতাকে যখন সে আবিষ্কার করল তখন সে পেটভরে শিকারের মাংস খেয়ে জলপান করছে। মোগলি তাকে সবিস্তারে পূর্বরাত্রের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিল।

অঙ্কুশ সম্পর্কে সাদা গোখরোর বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে বাঘিরা বলল, উদয়পুরে রাজার খাঁচার ভিতর আমি জন্ম নিয়েছিলাম। তাই মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছুই আমি জানি। এই অঙ্কুশের মাথায় যে লাল পাথরটা আছে, শুধু ওটার জন্যই বহু মানুষ খুন হয়ে যেতে পারে।

 কিন্তু পাথরটার জন্য এই জিনিসটা ভীষণ ভারী হয়ে পড়েছে। এটাকে হাতে রাখতে কষ্ট হয়। এর চাইতে আমার ছুরিটা অনেক ভালো। এটা তো খাওয়ার জিনিসও নয়। তাহলে এই জিনিসটার জন্য মানুষ কেন খুনোখুনি করবে?

মোগলি! এবার তুমি ঘুমাও। তুমি অনেকদিন মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছ এবং–

বাধা দিয়ে মোগলি বলল, সেকথা আমার মনে আছে। মানুষ বিনা কারণে হত্যা করে। বাঘিরা, ঘুমিও না, আগে আমার কথার জবাব দাও। এই ধারালো কাটার মতো জিনিসটা কোন কাজে লাগে?

ঘুমে বুজে-আসা দুই চোখ একটু খুলে বাঘিরা বলল, এই জিনিসটা দিয়ে হাতির মাথায় খোঁচা মেরে রক্ত ঝরানো হয়। উদয়পুরে আমার খাঁচার সামনে আমি মানুষের হাতে এই জিনিস দেখেছি। হাতির মাথায় এই বস্তুটিকে তারা কেমন করে ব্যবহার করে, তা-ও আমি দেখেছি। এই অঙ্কুশটা বহু হাতির রক্তপান করেছে।

কিন্তু এটা দিয়ে ওরা হাতির মাথায় খোঁচা মারে কেন?

মানুষের আইন-কানুন হাতিকে শেখানোর জন্য। আমাদের মতো দাঁত-নখ না থাকায় মানুষ এই সব জিনিস তৈরি করে।

যখনই মানুষের কাছাকাছি আসি তখনই দেখি রক্ত আর রক্ত! এমনকী, মানুষ যে-জিনিস তৈরি করে তার গায়েও লেগে থাকে রক্ত! মোগলি বিরক্তি প্রকাশ করল, আগে জানলে এই জিনিসটাকেও আমি সঙ্গে আনতাম না। প্রথম দেখলাম বাঁধনের দড়িতে মেসুয়ার রক্ত, আর এখন দেখছি এই হতচ্ছাড়া জিনিসটার গায়ে হাতির রক্ত! দূর ছাই- এটাকে আমি কখনোই ব্যবহার করব না- দেখ!

মোগলির হাত থেকে সজোরে নিক্ষিপ্ত হয়ে সূর্যালোকে জ্বলতে জ্বলতে অঙ্কুশটা পঞ্চাশ গজ দূরে ছিটকে পড়ল। তার ধারালো চোখা মুখটা মাটি ভেদ করে ঢুকে গেল গভীরভাবে। ভিজে মাটিতে হাত ঘষে মোগলি বলে উঠল, আমার হাত থেকে এখন মৃত্যুর গন্ধ মুছে গেল। সাদা গোখরো বলেছিল মৃত্যু আমাকে অনুসরণ করবে। সাপটা ছিল বদ্ধ পাগল।

সাদা অথবা কালো, মৃত্যু অথবা জীবন, কিছু নিয়েই আমি আর মাথা ঘামাতে রাজি নই, বাঘিরা বলল, ছোট্ট ভাইটি, আমি সারারাত শিকার করব আর সারাদিন চিৎকার করব, সেটা সম্ভব নয়। এখন আমি ঘুমাতে চাই।

বাঘিরা চলে গেল। দু-মাইল দূরে তার আস্তানা। সেটাই তার ঘুমানোর জায়গা। মোগলি একটা মস্ত গাছের উপর লতা দিয়ে দোলনা খাঁটিয়ে ফেলল। মাটি থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে লতার দোলনায় শুয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন তার ঘুম ভাঙল সূর্য তখন পৃথিবীকে বিদায় জানাচ্ছে; গোধূলির আলো খেলা করছে অরণ্যের বুকে।

জিনিসটাকে আরও একবার অন্তত দেখতে চাই, আপনমনেই বলল মোগলি, তারপর নেমে এল গাছ থেকে। কিন্তু অকুস্থলে গিয়ে অঙ্কুশটাকে দেখতে পেল না সে, পরিবর্তে দেখল বাঘিরাকে। কালো চিতা সেখানে দাঁড়িয়ে সশব্দে ঘ্রাণ গ্রহণ করছে, যেন অদৃশ্য কোন প্রাণীর গায়ের গন্ধ শুঁকতে চেষ্টা করছে সেখানকার মাটি আর বাতাস থেকে।

কাটার মতন ধারাল আর চোখা জিনিসটা গেল কোথায়? মোগলি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

একটি মানুষ ওটাকে নিয়ে গেছে। এইখানে রয়েছে তার পায়ের ছাপ।

বেশ। এবার আমরা জানতে পারব সাদা গোখরোর কথা কতটা সত্যি। ধারাল জিনিসটা যদি সত্যিই মৃত্যুকে বহন করে, তাহলে যে-লোকটা জিনিসটাকে তুলে নিয়ে গেছে, সে-ও মারা পড়বে। চলো বাঘিরা, পায়ের ছাপ ধরে লোকটাকে অনুসরণ করি।

প্রথমে শিকার, তারপর অন্য কাজ, বাঘিরা বলল, উদর শূন্য থাকলে চোখের দৃষ্টিও হয় অসাবধান। আমাদের তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। মানুষ তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না। ভিজে জঙ্গলে ওর পায়ের ছাপ সহজেই আমাদের চোখে পড়বে।

শিকার করে তার মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে তিন ঘণ্টা সময় চলে গেল। তারপর পায়ের ছাপ ধরে চলল অনুসন্ধান-পর্ব।

তুমি কি মনে কর কাটার মতো জিনিসটা হঠাৎ ঘুরে মানুষটাকে খুন করবে? মোগলি জানতে চাইল, সাদা গোখরো বলেছিল অঙ্কুশটা মূর্তিমান মৃত্যু।

একটু পরে আমরা যখন লোকটাকে দেখতে পাব, তখনই সব বুঝতে পারব, মাথা নীচু করে এগিয়ে যেতে যেতে বাঘিরা বলল, একটা লোক এইখান দিয়ে গেছে। অঙ্কুশের ওজনে তার পায়ের ছাপ গম্ভীর হয়ে বসে গেছে মাটিতে।

চাঁদের আলোতে নাঙ্গা পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে লাগল শ্বাপদ ও দ্বিপদ..

এইবার লোকটা জোরে ছুটতে শুরু করেছে, মোগলি বলে উঠল, ওর পায়ের আঙুলগুলো মাটির উপর ছড়িয়ে ছাপ ফেলেছে। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর মোগলি বলল, কিন্তু লোকটা পথ চলতে চলতে হঠাৎ একপাশে ঘুরে গেছে কেন?

দাঁড়াও! বলেই এক প্রকাণ্ড লাফ মেরে সামনের দিকে শূন্যপথে অনেকদুর পার হয়ে গেল বাঘিরা। পায়ের ছাপ যখন জটিলতার সৃষ্টি করে তখন অনুসরণকারীর এলোমেলো পায়ের ছাপ সেই জায়গায় আরও বিভ্রাট বাধায়, তাই লম্বা লাফ মেরে দক্ষ শিকারি বাঘিরা সমস্যার সমাধান করল। লাফ দিয়ে যেখানে পড়ল, সেখানেই ঘুরে দাঁড়াল সে, তারপর মোগলির দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে দেখতে পাচ্ছি আর একটি মানুষের পায়ের দাগ। আগন্তুকের পায়ের মাপ ছোটো।

দৌড়ে এগিয়ে এসে ছাপটা দেখে মোগলি বলল, এটা একজন গোল শিকারির পায়ের ছাপ। দেখ, এইখানে ঘাসের উপর দিয়ে শিকারি তার ধনুকটা টেনে নিয়ে গেছে। ওকে দেখেই প্রথম পদচিহ্নের মালিক চটপট একপাশে ঘুরে গেছে। ছোটো পায়ের সামনে থেকে লুকাতে চাইছে বড়ো পা।

ঠিক বলেছ, বাঘিরা বলল, এখন আমরা দুজনে যদি একসঙ্গে দুটি মানুষের পদচিহ্নের পিছনে ঘোরাঘুরি করি, তাহলে নিজেদের পায়ের ছাপগুলোর মধ্যে আসল ছাপগুলোকে আমরা হারিয়ে ফেলব। তার চাইতে ভালো হয় যদি আমরা দুজন আলাদা হয়ে যে-যার মতো দুটি ছাপ বেছে নিয়ে অনুসরণ করি। এখন থেকে আমি হলাম বড়ো পা। আর ছোট্ট ভাইটি, তুমি হলে ছোটো পা। অর্থাৎ গোল শিকারিকে অনুসরণ করবে তুমি।

বাঘিরা লাফ দিয়ে আবার ফিরে গেল প্রথম পদচিহ্নের পশ্চাদ্ভাবন করতে। মোগলি তখন নীচু হয়ে বুনো মানুষটার ছোটো ছোটো পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করছে।

এইবার, বাঘিরা পায়ের ছাপ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি বড়ো পা, এখানে ঘুরে গেলাম। তারপর একটি পাথরের আড়ালে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাছে পোন্দ শিকারির চোখে ধরা পড়ে যাই, তাই আমি নড়াচড়া করতেও সাহস পাচ্ছি না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছি। ছোট্ট ভাইটি, এবার তোমার কথা বল।

এখন, আমি ছোটো পা, পাথরটার কাছে এলাম, তার জন্য নির্দিষ্ট পদচিহ্নের পিছনে ছুটে এসে মোগলি বলতে লাগল, তারপর পাথরের তলায় বসে ডান হাতের উপর ভর রাখলাম। আমার ধনুকটা তখন পায়ের আঙুলে ধরা ছিল। আমি অনেকক্ষণ এখানে অপেক্ষা করেছি। তাই আমার পায়ের ছাপ মাটির উপর গম্ভীর হয়ে বসে গেছে।

মস্ত পাথরের চাইটার পিছনে আত্মগোপন করে বাঘিরা তার ধারাবিবরণী পেশ করল, আমি বড়ো পা, এখানে আমিও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। কাটার মতো ছোটো জিনিসটা একটা ছোটো পাথরের উপর রেখেছিলাম। ওটা একবার ফসকে পড়ে গিয়েছিল পাথরের উপর, তাই ধারালো কাটার আঁচড় পড়েছে। ছোট্ট ভাইটি, এবার তোমার পালা।

দুটি ছোটো ছোটো, আর একটি বড়ো গাছের ডাল এখানে ভেঙে ফেলা হয়েছে, মোগলি হঠাৎ গলার স্বর নামাল, আরে! এটাকে আমি কী বলব? …হাঃ! আমি ছোটো পা গাছপালা ভাঙতে ভাঙতে আর ধুপধাপ শব্দ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছি, যাতে বড়ো পা আমার চলার শব্দ পায়। পাথরটা থেকে সরে এলে মোগলি, জঙ্গলে সারি দিয়ে দাঁড়ানো গাছগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল… অনেক দূরে একটা জলপ্রপাতের কাছ থেকে ভেসে আসতে লাগল তার তীব্র কণ্ঠস্বর, আমি বড়ো পা চলে যাচ্ছি- দুরে– জলপ্রপাতের শব্দ– ঢেকে ফেলবে আমার চলাচলের শব্দকে এবং এইখানে আমি অপেক্ষা করছি। বাঘিরা, এবার তোমার কথা বল।

আমি পাথরটার পিছন থেকে বেরিয়ে এলাম ঘটতে ভর করে, কাটার মতো জিনিসটাকে টানতে টানতে। সামনে কেউ নেই দেখে আমি ছুটতে শুরু করলাম। আমি বড়ো পা খুব দ্রুত ছুটলাম। পায়ের ছাপ এখন স্পষ্ট। এবার যে-যার পায়ের ছাপ অনুসরণ কর। আমি এখন ছুটলাম।

বাঘিরা তার জন্য নির্দিষ্ট পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে ছুটে চলল। গোন্দ শিকারির পদচিহ্নের পিছু নিল মোগলি। কিছুক্ষণের জন্যে নিস্তব্ধ হয়ে রইল অরণ্য..

তুমি কোথায় ছোট্ট ভাইটি? চেঁচিয়ে জানতে চাইল বাঘিরা। তার ডান দিকে পঞ্চাশ গজেরও কম দূরত্ব থেকে ভেসে এল মোগলির কণ্ঠস্বর।

উমম! গভীর স্বরে কালো চিতা বলল, ওরা এখন পাশাপাশি ছুটছে। ওদের দূরত্ব কমে আসছে।

আরও আধঘণ্টা পদচিহ্নের পিছনে দৌড়ানোর পর প্রথম পদচিহ্নের মালিক অর্থাৎ বড়ো পায়ের মৃতদেহ আবিষ্কার করল বাঘিরা। অনেকগুলো নুড়ি-পাথরের উপর স্থানীয় এক গ্রামবাসীর প্রাণহীন শরীরটা পড়েছিল তার বুক আর পিঠ ভেদ করে অবস্থান করছে গোন্দ শিকারির পালক-বসানো তীর!

সাদা গোখরো কি খুব বুড়ো হয়ে গেছে? তার কথা কি পাগলের প্রলাপ বলে এখনো মনে হচ্ছে তোমার? বাঘিরার কণ্ঠস্বর শান্ত, অন্তত একটা মানুষের মৃত্যু আমরা দেখতে পাচ্ছি।

এগিয়ে চল। গোল শিকারির পিছু নেব আমরা। কিন্তু হাতির রক্তপান করে যে লাল-চোখো কাটা- সেটা কোথায়?

খুব সম্ভব ছোটো পা ওটা নিয়ে গেছে। দুজনের বদলে এখন একটি মাত্র লোকের পিছু নেব আমরা।

আবার ছুটল মোগলি আর বাঘিরা গোন্দ শিকারির পিছনে। বেশি দূর যাওয়ার দরকার হল না। একটা খাদের ভিতর একরাশ ছাই-এর উপর পা ছড়িয়ে শুয়েছিল গোন্দ শিকারি তার দেহে প্রাণ ছিল না।

বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে লোকটাকে মারা হয়েছে, মোগলি বলল, আমি যখন মানুষের ঘরে ছিলাম, তখন মোষের পালের উপর ওই জিনিসটা মাঝে মাঝে ব্যবহার করেছি, সাদা গোখয়রাকে আমি ঠাট্টা করেছিলাম তার কথা বিশ্বাস করিনি, সেইজন্য আমি অনুতপ্ত। মানুষ জাতটাকে ভালো করেই চিনেছিল ওই বৃদ্ধ সর্প। মানুষরা বিনা কারণে হত্যা করে, একথা আমি আগেই বলেছি–বলিনি?

ওরা খুন করেছে আর খুন হয়েছে অঙ্কুশের গায়ে বসানো লাল-নীল পাথরগুলোর জন্য, বাঘিরা বলল, মনে রেখো, আমিও একসময় উদয়পুর রাজ্যে ছিলাম। মানুষ জাতটাকে আমিও চিনি ভালোভাবে।

এক, দুই, তিন, চার… চারটি মানুষের পায়ের ছাপ, ছাই-এর উপর ঝুঁকে পড়ে দেখছিল মোগলি, চারজনের পায়েই জুতো ছিল। ছোটোখাটো জংলি মানুষটা ওদের কী ক্ষতি করেছিল? খুনটা হওয়ার আগে ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছে– পায়ের দাগগুলো দেখলেই সেকথা বোঝা যায়। বাঘিরা, চলো ফিরে যাই। আমার দারুণ অস্বস্তি হচ্ছে। পেটের ভিতর গুলিয়ে উঠছে।

ভালো শিকারি কোনো কাজ শুরু করলে সেটা শেষ করে, বাঘিরা বলল, চলো, ওদের অনুসরণ করি। জুতো-পরা মানুষগুলো খুব বেশিদূর যেতে পারেনি।

একঘণ্টার মধ্যে তারা কেউ কথা কইল না, চারটি হন্তারকের অনুসরণ করতে লাগল নিঃশব্দে, জুতো-পরা পায়ের ছাপ ধরে…।

দিনের আলো ক্রমশঃ প্রখর হয়ে উঠছে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে উত্তাপ। হঠাৎ বাঘিরা বলে উঠল, আমি ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি।

অর্থাৎ রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছে, মোগলি বলল, ছুটোছুটি করার চাইতে খাওয়ার ব্যাপারেই মানুষের উৎসাহ বেশি।

একটা নতুন অপরিচিত জঙ্গলে ঢুকে ঘন নীচু ঝোপঝাড়ের ভিতর তারা তখন অনুসন্ধান করছিল। বাঘিরা হঠাৎ মোগলির বাঁদিকে একটা জায়গা থেকে হাঁক দিল, সেই বিচিত্র ও বিহ্বল কণ্ঠস্বরের বর্ণনা করা যায় না

এখানে একজন রয়েছে, যে আর কোনোদিন খেতে চাইবে না!

মোগলি এগিয়ে গিয়ে দেখল, ঝোপের তলায় পড়ে আছে আর একটি মানুষের মৃতদেহ। তার পাশে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু আটার গুঁড়ো।

একেও খুন করা হয়েছে বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, মোগলি বলল, এই সাদা গুঁড়োগুলো মানুষের খাদ্য। এই লোকটা সঙ্গীদের খাদ্য বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তার সঙ্গীরা তাকে চিলের খাদ্যে পরিণত করে সরে পড়েছে।

এটা হচ্ছে তিন নম্বর খুন, বাঘিরা বলল।

আমি এখনই বড়ো বড়ো ব্যাং ধরে সাদা গোখরোকে খাওয়াব, মোগলি বলল, হাতির রক্তপায়ী জিনিসটা দেখছি মৃত্যুর অগ্রদূত। তবু আমি ব্যাপারটা এখনও ভালোভাবে বুঝতে পারছি না।

অনুসরণ করো! বাঘিরা বলল।

আধমাইল পথও তারা অতিক্রম করেনি, হঠাৎ তাদের কানে ভেসে এল কো নামক কাকের কণ্ঠস্বর মহা উল্লাসে সে গাইছে মৃত্যুর জয়গান। যে-গাছের উপর থেকে পাখিটার উল্লসিত সংগীত ভেসে আসছিল, সেই গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে তিনটি মানুষ তাদের কারো দেহেই প্রাণের অস্তিত্ব নেই! সেইখানে নিবে-আসা আগুনের উপর বসানো আছে একটা লোহার থালা। থালার উপর পড়েছিল দলা-পাকানো আটার তাল– আগুনে ঝলসে সেগুলো কালো হয়ে গেছে। প্রায়-নির্বাপিত অগ্নিকুণ্ডের খুব কাছেই সূর্যের আলোতে ঝকঝক জ্বলছিল মণিমুক্তাখচিত অভিশপ্ত অঙ্কুশ!