৫৮তম অধ্যায়
অশ্বত্থামার ধৃষ্টদ্যুম্নবধপ্রতিজ্ঞা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর দুৰ্য্যোধন কর্ণসমীপে সমুপস্থিত হইয়া মদ্ররাজ শল্য ও অন্যান্য মহারথগণকে লক্ষ্য করিয়া সূতপুত্রকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে কর্ণ! আত্মসদৃশ বলবিক্রমশালী ব্যক্তিদিগের সহিত সংগ্রাম ক্ষত্রিয়দিগের প্রার্থনীয়; এক্ষণে তাহা উপস্থিত হইয়াছে। এইরূপ সমর যে ক্ষত্রিয়দিগের সুখজনক, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। এই যুদ্ধ উপস্থিত হওয়াতে উহাদিগের স্বর্গদ্বার স্বেচ্ছাক্রমে উদঘাটিত হইয়াছে, অতএব এক্ষণে শুরগণ হয় সমরে পাণ্ডবগণকে নিপাতিত করিয়া বিশাল পৃথিবী প্রাপ্ত হউন অথবা অরাতিহস্তে নিহত হইয়া বীরলোকে গমন করুন।’
“হে মহারাজ! ক্ষত্রিয়গণ দুর্য্যোধনের সেই বাক্যশ্রবণে আনন্দিত হইয়া সিংহনাদ ও বিবিধ বাদিত্ৰনিঃস্বন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা কৌরবপক্ষীয় যোধগণকে আহ্লাদিত করিয়া কহিলেন, ‘হে ক্ষত্রিয়গণ! আমার পিতা সমুদয় সৈন্যগণের ও তোমাদিগের সমক্ষে শস্ত্রপরিত্যাগপূর্ব্বক ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে নিহত হইয়াছেন। আমি সেই ক্রোধে ও মিত্রের হিতসাধনার্থ তোমাদিগের নিকট যাহা প্রতিজ্ঞা করিতেছি, শ্রবণ কর। আমি ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপাতিত না করিয়া কদাচ বর্ম্ম পরিত্যাগ করিব না।। যদি আমার এ প্রতিজ্ঞা মিথ্যা হয়, তাহা হইলে আমার স্বর্গলাভ হইবে না। অদ্য কি অর্জ্জুন, কি ভীমসেন, যে ব্যক্তি সমরে ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করিবে, আমি শরনিকরে তাহাকেই নিহত করিব।”
“মহাবীর অশ্বত্থামা এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিলে সমুদয় কৌরবসেনা মিলিত হইয়া পাণ্ডবগণের প্রতি ও পাণ্ডবগণ কৌরবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। অনন্তর উভয়পক্ষীয় রথীদিগের মহাপ্রলয়কল্প অতি ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। তখন দেবগণ ও অন্যান্য প্রাণীগণ অপ্সরাদিগের সহিত মিলিত হইয়া সেই নরবীরগণকে দর্শন করিবার নিমিত্ত তথায় আগমন করিতে লাগিলেন। অপ্সরাগণ আহ্লাদিতচিত্তে বিবিধ দিব্যমাল্য, গন্ধ ও রত্নদ্বারা স্বকর্ম্মুনিরত নরবীরগণকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। গন্ধবহ [বায়ু] সেই সুগন্ধ লইয়া সমস্ত যোধগণকে আমোদিত করিতে লাগিল। যোধগণ সুগন্ধি সমীরণ সংস্পর্শে সমাহ্লাদিত হইয়া পরস্পর আঘাত করিয়া ধরণীতলে নিপতিত হইতে লাগিল। ঐ সময় ভূমণ্ডল দিব্যমাল্য, সুবর্ণপুঙ্খ বিচিত্র নিশিত শরনিকর ও যোধগণে সমাকীর্ণ হইয়া তারকাচ্ছন্ন [নক্ষত্রাবৃত] বিচিত্র নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা ধারণ করল। তখন দেব, গন্ধর্ব্বপ্রমুখ অন্তরীক্ষচারিগণ সাধুবাদদ্বারা সেই জ্যানির্ঘোষ, নেমিনিঃস্বন ও সিংহনাদসমাকীর্ণ সংগ্রামস্থলকে অধিকতর সমাকুল করিতে লাগিলেন।”