হেনকালে উপনীত ব্রহ্মার তনয়।
সভামধ্যে কহেন নারদ মহাশয়।।
আজি হৈতে চতুর্দ্দশ বৎসর সময়।
শ্রীকৃষ্ণ-সহায়ে করিবেক কুরু-ক্ষয়।।
সবাই মরিবে দুর্য্যোধন-অপরাধে।
নিঃক্ষত্রা হইবে ক্ষিতি ভীমার্জ্জুন-ক্রোধে।।
এত বলি মুনিবর হেন অন্তর্দ্ধান।
শুনি কর্ণ দুর্য্যোধন হৈল কম্পমান।।
নারদের কথা শুনি হইল অস্থির।
অকূল সমুদ্রে যেন ডুবিল শরীর।।
উপায় না দেখি ইথে, কি হইতে গতি।
বিচারি শরণ নিল দ্রোণ মহামতি।।
পাণ্ডবের ভয়ে প্রভু কম্পয়ে শরীর।
আপনি অভয় দিলে হয় মন স্থির।।
দ্রোণ বলে, পাণ্ডুপুত্র অবধ্য আমার।
দেব হৈতে জাত পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।।
পাণ্ডব দেবতা, আমি হই যে ব্রাহ্মণ।
ব্রাহ্মণের পূজ্য দেব জানে সর্ব্বজন।।
তথাপি করিব আমি যতেক পারিব।
তোমা সবাকারে আমি ত্যাগ না করিব।।
দুর্জ্জয় পাণ্ডব সব যাইতেছে বন।
চতুর্দ্দশ বৎসরে করিবে আগমন।।
ক্রোধে আসিবেন তাঁরা সবার উপর।
নিশ্চয় দেখি যে ঘোর হইবে সমর।।
শরণ পালন হেতু তোমা সবাকার।
নিশ্চয় কহি যে ভদ্র নাহিক আমার।।
যতেক করিলে সর্ব্ব আমার কারণ।
নিকট হইল দেখি আমার মরণ।।
রাজযজ্ঞে ধৃষ্টদ্যুন্ন হয়েছে উৎপত্তি।
আমার মরণ হেতু, বিখ্যাত সে ক্ষিতি।।
সেই দিন হৈতে ভয় হয়েছে আমায়।
দ্বন্দ্ব হৈলে পাণ্ডবের হইবে মরণ।
বুঝি যাহে শ্রেয়ঃ হয় তাহে দেহ মন।।
যজ্ঞ দান ব্রত সব করহ ত্বরিত।
ধর্ম্ম বিনা সখা নাহি পরকাল-হিত।।
এ সুখ সম্পদ্ যেন তাল-ছায়াবৎ।
ইহা জানি শীঘ্র সবে ধর ধর্ম্মপথ।।
তোমা সবাকার মৃত্যু হৈল সেই কালে।
সভায় যখন কৃষ্ণা ধরিয়া আনিলে।।
পাঞ্চাল-নন্দিনী কৃষ্ণা জন্ম লক্ষ্মী-অংশ।
সদা যাঁরে সখীরূপে রাখে হৃষীকেশ।।
তাঁরে কষ্ট কৃষ্ণ নাহি দিবে কদাচিত।
না ক্ষমিবে পাণ্ডব, দ্রৌপদী প্রবোধিত।।
ত্রয়োদশ বৎসরান্তে রক্ষা নাহি আর।
ভীমার্জ্জুন হাতে হবে সবার সংহার।।
সে কারণে তার সহ কলহ না রুচে।
এখনি করহ প্রীতি, যদি প্রাণ বাঁচে।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র বিদুরে কহিল।
মোর মনে নাহি লয় বিপদ ঘুচিল।।
এইক্ষণে শীঘ্রগতি করহ গমন।
ফিরায়ে আনহ শীঘ্র পাণ্ডু-পুত্রগণ।।
যদি তারা সত্যভঙ্গ করিবারে নারে।
ভাল বেশ করি যাক অরণ্য ভিতরে।।
বস্ত্র-আভরণ পরি রথ-আরোহণে।
সংহতি লইয়া যাক্ দাস-দাসীগণে।।
সঞ্জয় এতেক শুনি বলিল তখন।
সর্ব্ব পৃথ্বী পেলে রাজা কি হেতু শোচন।।
ধৃতরাষ্ট বলে, মম চিত্ত না নহে স্থির।
বহুমত করি, ধৈর্য্য না ধরে শরীর।।
সঞ্জয় বলিল, শান্ত এখন নহিবে।
যখন এ সব রাজা নির্ম্মূল হইবে।।
তখন হইবে শান্ত, শুনহ রাজন।
কত মত তোমারে না বুঝানু তখন।।
ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদি কহিল বিস্তর।
তবু পাশা খেলাইলে অনর্থের ঘর।।
হেন বিপর্য্যর কভু নাহি শুনি কাণে।
কুলবধূ-চুলে ধরি সভামধ্যে আনে।।
তখন কি আপনি সভায় নাহি ছিলে।
আপনার বংশ তুমি আপনি নাশিলে।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, কিছু মম সাধ্য নয়।
দৈবে যাহা করে, তাহা শান্ত কিসে হয়।।
যখন যেমন হয়, বিধি তাহা করে।
কুবুদ্ধি কুপথী কুরি দুঃখ দেয় তারে।।
অধর্ম্ম যে কর্ম্ম, তাহা বুঝে যেন ধর্ম্ম।
অর্থ করি বুঝে নর অনর্থের কর্ম্ম।।
কর্ম্মহীনে কাল যায় বুঝিবারে নারে।
কুবুদ্ধি করিয়া নরে কালবুদ্ধি ধরে।।
সেইমত কুবুদ্ধি আমারে দিল কালে।
আগু পাছু বিচার না করিলাম হেলে।।
অযোনিসম্ভবা জন্ম কমলা-অংশেতে।
তারে হেন অপমান সভার মধ্যেতে।।
সাধুপুত্র পাণ্ডবের দিল বনবাস।
এই চারি দুষ্ট হৈতে হৈল সর্ব্বনাশ।।
অশক্ত না হয় বলে পঞ্চ সহোদর।
মুহূর্ত্তেকে জিনিবারে পারে চরাচর।।
ধর্ম্ম পাশে বন্দী হৈয়া মোরে বড় মানে।
সে কারণে না মারিল এই দুষ্টগণে।।
ভৃত্যরূপে বসি ছিল সভার ভিতর।
এই দুষ্টগণ কত করে কটূত্তর।।
রজঃস্বলা দ্রৌপদী, পিন্ধন একবাসে।
সভামধ্যে আনিলেক ধরি তার কেশে।।
যদি ক্রোধ করি কৃষ্ণা চাহিতে নয়নে।
তখনই হৈত ভস্ম এই দুষ্টগণে।।
সে ক্ষমিল, ক্ষমিবেন নাহি হৃষীকেশ।
নিশ্চয় সঞ্জয় মোর বংশ হৈল শেষ।।
গান্ধারী সহিত মোর পুত্রবধূগণ।
দ্রৌপদীর দুঃখ শুনি করিল ক্রন্দন।।
অগ্নিহোত্র গৃহে ছিল যতেক ব্রাহ্মণ।
কৃষ্ণার ধরিল কেশ করিয়া শ্রবণ।।
ক্রোধ করি লৌহদণ্ড অগ্নিতে ফেলিল।
ধৃতরাষ্ট্র সর্ব্বনাশ হউক বলিল।।
ঘরে ঘরে আচম্বিতে উঠিল আগুনি।
চতুর্দ্দিকে শব্দ কৈল শকুনি গৃধিনী।।
হাহাকার শব্দ কৈল যত বৃদ্ধগণ।
বিদুর কহিল মোরে সব বিবরণ।।
ধিক্ ধিক্ দুর্য্যোধনে, ধিক্ শকুনিরে।
কপট পাশায় দুঃখ দিল পাণ্ডবেরে।।
না সহিবে পাণ্ডব এ সব অপমান।
পাপবুদ্ধে বংশ মোর হৈবে অবসান।।
কৃষ্ণ যার অনুকূল, কিসের আপদ।
ভীমার্জ্জুন মাদ্রীসুত কৈকেয় দ্রুপদ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সাত্যকি শিখণ্ডী আদি করি।
থাকুক অন্যেয় কার্য্য ইন্দ্র যারে ডরি।।
এ সব সহিত কেবা যুঝিবে সমরে।
কে আছে সহায় মোর, নিবেদিব কারে।।
একা পার্থ স্বয়ন্বরে নৃপগণে জিনে।
একা ভীম হিড়েম্বে বধিল অস্ত্র বিনে।।
একা পার্থ ইন্দ্রে জিনি দহিল খাণ্ডবে।
এ হেন দুর্জ্জয় দুর্ব্বার বীর পাণ্ডবে।।
কেবা আছে বীর যুঝে সম্মুখ সমরে।
কে আছে সহায় মোর নিবারিবে তারে।।
চিত্তেতে বুঝিনু সব নিয়তির লীলা।
কুরুকুল ধ্বংস হেতু এই দ্যূত খেলা।।
অনুক্ষণ অন্ধরাজ ভাবনে অন্তরে।
এ শোক সাগরে দুষ্ট ডুবাইল মোরে।।
দ্রৌপদীরে বর দিয়া করিনু সন্তোষ।
যুধিষ্টিরে প্রবোধিয়া ক্ষমাইনু দোষ।।
পুনরপি পাশা কৈলা আপনার বধে।
বশ নহে, দৈববশ, আনিল বিপদে।।
পাণ্ডবের হস্তে আর নাহিক নিস্তার।
নিজ কর্ম্মদোষে তোরা হইলি সংহার।।
জরাসন্ধ বধ ভীম কৈল অবহেলে।
কুরুবংশ রক্ষ নাই, ভীম ফিরে এলে।।
এইরূপে ধৃতরাষ্ট্র করে মহাশোকে।
সভা ভঙ্গে নিজস্থানে যায় সর্ব্বলোক।।
বনে দিল অন্ধরাজ ন্যায়ান্ধ হইয়া।
অনুতাপ করে শেষে বিহ্বল হইয়া।।
বনবাসে চলিলা দ্রৌপদী পঞ্চ জনা।
কাশী কহে, কুরুকুল নাশের সূচনা।।
শ্রীকৃষ্ণ সহায় যাঁহাদের সর্ব্বক্ষণ।
তাঁহাদের দুঃখ নাহি কোথাও কখন।।
যেখানে থাকুর কৃষ্ণা পঞ্চ সহোদর।
শ্রীকৃষ্ণের দৃষ্টি থাকে তাঁদের উপর।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাহার শকতি তাহা বর্ণিবারে পারি।।
যাহা আছে কাব্য সুধা বিশ্বের মাঝারে।
সকলি আছে মহাভারতের ভাণ্ডারে।।
ইথে যাহা নাই, তাহা নাই এ ভুবনে।
অপূর্ব্ব গাথা এই শাস্ত্রবেদ মন্থনে।।
মহাঋষি মহাযোগে মথি বেদার্ণব।
জগৎ জনের হিত করিতে সম্ভব।।
ব্যাসদেব রচিলেন ভারত চন্দ্রিমা।
ত্রৈলোক্যে নাহিক যার সমান মহিমা।।
সে জন সাত্ত্বিক দান করে বহুশ্রমে।
বেদ বিদ্যা বিতরণ করে পুণ্যক্রমে।।
তাহার অধিক ফল ভারত শ্রবণে।
মহাভারতের তুল্য নাহি ত্রিভুবনে।।
কাশীরাম দাস কহে, শুন সর্ব্বজন।
সভাপর্ব্ব সমাপ্ত, পাণ্ডব গেল বন।।
সভাপর্ব্ব সমাপ্ত।