৫৬তম অধ্যায়
অশ্বত্থামার সহিত যুদ্ধে পাণ্ডবপরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর অশ্বত্থামা যুধিষ্ঠিরকে সাত্যকি ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্ৰকৰ্তৃক পরিরক্ষিত দেখিয়া ক্ষিপ্রহস্তে শরনিকর বর্ষণ ও বিবিধ শিক্ষাকৌশল প্রদর্শনপূর্ব্বক প্রহৃষ্টমনে তাঁহার সন্নিধানে গমন করিলেন এবং ধর্ম্মরাজকে দিব্যমন্ত্রপূত অস্ত্রজালে পরিবৃত করিয়া নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন আর কোন বস্তুই অনুভূত হইল না; সেই অতি বিস্তীর্ণ রণস্থল কেবল শরময় হইল। স্বর্ণজালজড়িত শরনিকর গগনতল সমাচ্ছন্ন করিয়া চন্দ্রাতপের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তৎকালে নভোমণ্ডল শরনিকরে পরিবৃত হওয়াতে রণস্থল যেন মেঘের ছায়ায় সমাচ্ছন্ন হইল। তখন অন্তরীক্ষচারী কোন প্রাণী আর উড্ডীন হইতে সমর্থ হইল না। তদ্দর্শনে আমরা সকলেই চমৎকৃত হইলাম। ঐ সময় সমরলালস [যুদ্ধে একান্ত আগ্রহান্বিত] শিনিপ্রবীর সাত্যকি, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য সৈনিকগণ দ্রোণপুত্রের হস্তলাঘবসন্দর্শনে সাতিশয় বিস্মিত হইয়া কোনক্রমেই পরাক্রম প্ৰকাশপূর্ব্বক তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বিতাচরণ করিতে সমর্থ হইলেন না; মহারথ ভূপালগণও সেই প্রখর দিবাকরের ন্যায় তেজস্বী দ্রোণাত্মজকে নিরীক্ষণ করিতে পারিলেন না।
“অনন্তর সাত্যকি, যুধিষ্ঠির, পাঞ্চাল ও দ্রৌপদীর তনয়গণ অশ্বত্থামার শরনিকরে স্বীয় সৈন্যদিগকে বধ্যমান দেখিয়া মৃত্যুভয় পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি সপ্তবিংশতিশরে অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সুবর্ণখচিত সাতনারাচে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তৎপরে ধর্ম্মরাজ ত্রিসপ্ততি, প্রতিবিন্ধ্য সাত শ্রুতকর্ম্মা তিন, শ্রুতকীৰ্ত্তি সাত, সুতসোম নয়, শতানীক সাত এবং অন্যান্য বীরগণ অসংখ্য শরে চতুর্দ্দিক হইতে অশ্বত্থামাকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দ্রোণপুত্র তাঁহাদের শরাঘাতে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া সাত্যকিকে পঞ্চবিংশতি, শ্রুতকীৰ্ত্তিকে নয়, সূতসোমকে পাঁচ, শ্রুতকর্ম্মকে আট, প্রতিবিন্ধ্যকে তিন, শতানীককে নয়, ধর্ম্মপুত্রকে পাঁচ ও অন্যান্য বীরগণকে দুই দুই শরে নিপীড়নপূর্ব্বক নিশিতশরনিকরে শ্রুতকীৰ্ত্তির শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর শ্রুতকীর্তি অন্য কার্ম্মুক গ্রহণপূর্ব্বক অশ্বত্থামাকে প্রথমতঃ তিনশরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় নিশিতশরজালে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন দ্রোণতনয় শরবর্ষণপূর্ব্বক পাণ্ডবসৈন্যগণকে সমাচ্ছন্ন করিয়া হাস্যমুখে ধর্ম্মরাজের কার্ম্মুক ছেদনপূর্ব্বক তিনবাণে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সত্বর অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক সপ্ততিশরে অশ্বত্থামার বাহুযুগল ও বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন, সাত্যকিও ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সুতীক্ষ্ণ অর্দ্ধচন্দ্রবাণে অশ্বত্থামার কার্ম্মুক ছেদনপূর্ব্বক ঘোরতর সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন দ্রোণাত্মজ সত্বর শক্তিদ্বারা সাত্যকির সারথিকে রথ হইতে নিপাতিত করিয়া অনতিবিলম্বেই অন্য এক শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক শরনিকরে যুযুধানকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। সাত্যকির অশ্বগণ সারথিবিহীন হইয়া স্বেচ্ছানুসারে ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। তখন যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ বীরগণ সেই শস্ত্রধরাগ্রগণ্য দ্রোণাত্মজের উপর মহাবেগে অনবরত নিশিত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন; মহাবীর অশ্বত্থামাও সেই মহাবেগে সমাগত শরসমুদয় হাস্যমুখে হস্তদ্বারা গ্রহণ করিলেন। তৎপরে হুতাশন যেমন তৃণরাশি, ভস্মসাৎ করিয়া ফেলে, তদ্রূপ তিনি শরানলে পাণ্ডবসৈন্যগণকে দগ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন এবং তিনি যেমন নদীমুখ ক্ষুভিত করে, তদ্রূপ সেই পাণ্ডবসৈন্যগণকে আলোড়িত করিয়া সাতিশয় সন্তপ্ত করিতে লাগিলেন। তখন তত্ৰত্য সকলেই দ্রোণপুত্রের পরাক্রম নিরীক্ষণ করিয়া পাণ্ডবগণকে নিহত বলিয়া অবধারণ করিল।
অশ্বত্থামার প্রতি যুধিষ্ঠিরের কৃত্রিম বীরদর্প
“অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির রোষাবিষ্ট হইয়া অবিলম্বে দ্রোণাত্মজকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে গুরুপুত্র! আজ তুমি যখন আমাকে সংহার করিতে অভিলাষী হইয়াছ, তখন বোধ হইতেছে, তোমার অন্তঃকরণে প্রীতি ও কৃতজ্ঞতার লেশমাত্র নাই। দেখ—তপানুষ্ঠান, দান, অধ্যয়নই ব্রাহ্মণের কাৰ্য্য, আর ধনুর্ধারণ করা ক্ষত্রিয়েরই কর্ত্তব্য; অতএব তুমি যখন ব্রাহ্মণের কুলে উৎপন্ন হইয়া ধনুর্ধারণ করিতেছ, তখন তুমি নামমাত্র ব্রাহ্মণ, সন্দেহ নাই। যাহা হউক, হে ব্রাহ্মণাধম! অদ্য আমি তোমার সমক্ষেই কৌরবদিগকে পরাজিত করিব, তুমি এক্ষণে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও।
“হে মহারাজ! মহাবীর অশ্বত্থামা ধর্ম্মরাজের বাক্যশ্রবণে হাস্যমুখে প্রকৃত তত্ত্ব অনুধাবনপূর্ব্বক কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান না।করিয়া, প্রজাসংহারে প্রবৃত্ত অন্তকের ন্যায় ক্রোধাবিষ্টচিত্তে তাঁহাকে অনবরত নিক্ষিপ্ত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ দ্রোণপুত্রনির্ম্মুক্ত শরজালে সমাচ্ছাদিত হইয়া সেই বহুল বল পরিত্যাগপূর্ব্বক সত্বর তথা হইতে কৌরবসৈন্যসংহারার্থ প্রস্থান করিলেন। দ্রোণাত্মজ অশ্বত্থামাও যুধিষ্ঠিরকে প্রতিনিবৃত্ত দেখিয়া তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিলেন।”