৫৫তম অধ্যায়
উতঙ্ক-প্রার্থনায় কৃষ্ণের বিশ্বরূপপ্রদর্শন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, ভগবান্ বাসুদেব এইরূপে অধ্যাত্মবিষয় কীৰ্ত্তন করিলে মহর্ষি উতঙ্ক তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বাসুদেব! তুমি সমুদয় জগতের সৃষ্টিকর্ত্তা। আজ তোমার প্রসাদেই আমি দিব্যজ্ঞান লাভ করিলাম। এক্ষণে তোমাকে শাপপ্রদান করিতে আমার কিছুমাত্র বাসনা নাই। আমার চিত্ত তোমার প্রতি একান্ত অনুরক্ত ও সুপ্রসন্ন হইয়াছে। অতঃপর তুমি অনুগ্রহপূৰ্ব্বক আমাকে স্বীয় বিশ্বরূপ প্রদর্শন করাইয়া চরিতার্থ কর।”
মহাত্মা উতঙ্ক এই কথা কহিলে ভগবান্ বাসুদেব তাঁহার প্রতি প্রীত হইয়া অৰ্জ্জুনের নিকট যে রূপ প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাঁহার নিকটেও সেই রূপ প্রকাশ করিলেন। মহাত্মা উতঙ্ক বাসুদেবের সেই সহস্র সূৰ্য্যের ন্যায়, প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় তেজঃসম্পন্ন সৰ্ব্বব্যাপী বিশ্বরূপদর্শনে নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! তোমাকে নমস্কার। তোমার পদযুগলদ্বারা ভূমণ্ডল, মস্তকদ্বারা নভোমণ্ডল, জঠরদ্বারা পৃথিবী ও দ্যুলোকের মধ্যভাগ এবং ভুজযুগলদ্বারা দিকসমুদয় পরিব্যাপ্ত হইয়াছে। এক্ষণে তুমি এই ভীষণ বিশ্বরূপ সংবরণপূর্ব্বক পূর্ব্বরূপ ধারণ কর।”
মহর্ষি উতঙ্ক এইরূপ বিশ্বরূপ সংবরণ করিতে কহিলে ভগবান বাসুদেব তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আমি আপনার প্রতি নিতান্ত প্রসন্ন হইয়াছি; অতএব আপনি অচিরাৎ স্বীয় অভিলষিত বর প্রার্থনা করুন।”
তখন মহাত্মা উতঙ্ক বাসুদেবকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আমি তোমার বিশ্বরূপ দর্শন করাইয়া চরিতার্থ হইয়াছি; আর আমার অন্য বরে প্রয়োজন নাই।” মহর্ষি উতঙ্ক এইরূপে বরগ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করিলে বাসুদেব পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আমার বিশ্বরূপ দর্শন কদাচ নিষ্ফল হইবার নহে; অতএব আপনি অবিচারিতচিত্তে বর গ্রহণ করুন।”
কৃষ্ণের বরদান—উতঙ্কের কৃষ্ণবিশ্বাসপরীক্ষা
মহাত্মা উতঙ্ক বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মধুসূদন! এই মরুভূমিতে জল লাভ করা নিতান্ত সুকঠিন, অতএব যদি আমাকে বর প্রদান করা তোমার নিতান্তই কর্ত্তব্য হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই বর প্রদান কর, যেন আমি ইচ্ছা করিলেই এই মরুভূমিতে অনায়াসে জললাভ করিতে পারি।”
মহর্ষি উতঙ্ক এইরূপ বর প্রার্থনা করিলে, বাসুদেব তৎক্ষণাৎ বিশ্বরূপ সংবরণপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আপনার সলিলের আবশ্যক হইলেই আপনি আমাকে স্মরণ করিবেন।” বৃষ্ণিবংশাবতংস কেশব এই বলিয়া অবিলম্বে দ্বারকায় প্রস্থান করিলেন।
কিয়দ্দিন পরে একদা মহর্ষি উতঙ্ক নিতান্ত পিপাসার্ত্ত হইয়া সেই মরুভূমিতে পরিভ্রমণ করিতে করিতে জললাভের নিমিত্ত বাসুদেবকে স্মরণ করিলেন। ঐ সময় এক কুক্কুররথপরিবৃত [কুকুরের টানা রথ] শরকার্ম্মুকধারী [ধনুৰ্ব্বাণধারী] ভীষণাকার দিগম্বর চণ্ডাল তাঁহার দৃষ্টিপথে নিপতিত হইল। ঐ চণ্ডাল অনবরত মূত্র পরিত্যাগ করিতেছিল। সে উতঙ্ককে পিপাসার্ত্ত দেখিয়া সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “মহর্ষে! আপনাকে তৃষ্ণার্ত্ত দেখিয়া আমার অতিশয় দয়া উপস্থিত হইয়াছে; অতএব আপনি শীঘ্র আগমন করিয়া আমার এই প্রস্রাব পান করুন।”
চণ্ডাল এই কথা কহিলে, মহাত্মা উতঙ্ক তাহার মূত্রপান করিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক হইয়া বরপ্রদ বাসুদেবকে বিবিধরূপে নিন্দা করিতে লাগিলেন। ঐ সময় চণ্ডালও তাঁহাকে বারংবার মূত্র পান করিতে অনুরোধ করিতে লাগিল; কিন্তু মহর্ষি উতঙ্ক কিছুতেই তাহাতে সম্মত না হইয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। তখন চণ্ডাল মহর্ষিকে মূত্রপানে নিতান্ত অসম্মত বিবেচনা করিয়া তাঁহার সমক্ষেই কুক্কুরগণের সহিত অন্তর্হিত হইল। মহাত্মা উতঙ্ক তদ্দর্শনে ভগবান্ তাঁহাকে বঞ্চনা করিয়াছেন বুঝিতে পারিয়া নিতান্ত লজ্জিত হইলেন। চণ্ডাল প্রস্থান করিবার অব্যবহিত পরেই শঙ্খচক্রগদাধারী ভগবান্ বাসুদেব মহাত্মা উতঙ্কের নিকট সমুপস্থিত হইলেন।
তখন মহর্ষি উতঙ্ক তাঁহাকে সমাগত দেখিয়া দুঃখিতচিত্তে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! তৃষ্ণার্ত্ত ব্রাহ্মণকে চণ্ডালের মূত্র প্রদান করা তোমার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য।” মহর্ষি উতঙ্ক এইরূপ আক্ষেপ করিলে মহামতি বাসুদেব তাঁহাকে মধুরবাক্যে সান্ত্বনা দান করিয়া কহিলেন, “মহর্ষে! মনুষ্যকে প্রকাশ্যভাবে অমৃত প্রদান করা কর্ত্তব্য নহে। এই নিমিত্ত আমি চণ্ডালরূপী ইন্দ্রদ্বারা প্রচ্ছন্নভাবে তোমার নিকট অমৃত প্রেরণ করিয়াছিলাম। কিন্তু তুমি তাহা বুঝিতে পার নাই। আমি তোমার প্রিয়চিকীষু হইয়া তোমাকে অমৃত প্রদান করিবার নিমিত্ত দেবরাজ ইন্দ্রকে অনুরোধ করাতে তিনি প্রথমতঃ তদ্বিষয়ে অসম্মত হইয়া কহিয়াছিলেন, ‘বাসুদেব! মনুষ্যকে অমরত্ব প্রদান করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য; অতএব তুমি তাঁহাকে অন্য বর প্রদান কর।’ দেবরাজ এইরূপে অসম্মতি প্রকাশ করিলে আমি তাহাকে পুনরায় ঐ বিষয়ে অনুরোধ করিলাম। তখন তিনি আমাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘কেশব! যদি মহর্ষি উতঙ্ককে অমৃত প্রদান করা তোমার নিতান্তই কৰ্ত্তব্য হইয়া থাকে, তবে আমাকে অগত্যা ঐ বিষয়ে স্বীকার করিতে হইল। কিন্তু আমি চণ্ডালরূপী হইয়া অমৃত প্রদান করিবার নিমিত্ত উতঙ্কের নিকট সমুপস্থিত হইব। যদি তিনি অমৃতগ্রহণে অভিলাষী হয়েন, তাহা হইলে আমি অবশ্যই তাঁহাকে উহা প্রদান করিব। আর যদি তিনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই অমৃতলাভে বঞ্চিত হইবেন।’
“দেবরাজ আমার সহিত এইরূপ নিয়ম করিয়া চণ্ডালবেশে আপনাকে অমৃত প্রদান করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছিলেন। আপনি তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিয়া নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য করিয়াছেন। যাহা হউক, এক্ষণে আমি আপনার পিপাসাশান্তির নিমিত্ত পুনৰ্ব্বার আপনাকে বর প্রদান করিতেছি যে, আপনি সলিললাভের বাসনা করিলেই মরুভূমিতে সজল জলধর সমুদিত হইয়া আপনাকে সুস্বাদু জল প্রদান করিবে। ভূমণ্ডলে ঐ মেঘের নাম উতঙ্কমেঘ বলিয়া বিখ্যাত হইবে।” ভগবান্ হৃষীকেশ এইরূপ বর প্রদান করিলে মহাত্মা উতঙ্ক যারপরনাই প্রীত হইয়া তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। অদ্যাপি উতঙ্কমেঘ সেই মরুভূমিতে বারিবর্ষণ করিয়া থাকে।