পাণ্ডবনিৰ্য্যাতনে দুৰ্য্যোধনের নির্ব্বন্ধ
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “মহারাজ। যাদৃশ দার্বী [হাতা] সূপরস [ব্যঞ্জনাদির যুস-ঝোল] আস্বাদন করিতে পারে না, সেইরূপ যাহার বুদ্ধিবৃত্তি নাই, অথচ শাস্ত্ৰজ্ঞান আছে, সে শাস্ত্রের নিগুঢ় মর্ম্মার্থ কদাচ অনুধাবন করিতে সমর্থ নহে। বৃহন্নৌকাসংযত [বড় নৌকার সহিত আবদ্ধ] ক্ষুদ্র নৌকার ন্যায় সবিশেষ জানিয়াও কেন আমাকে বিমোহিত করিতেছেন? স্বার্থসাধনে আপনার কেন অনবধানতা দেখিতেছি? আর এই বিষয়ে কেনই বা আমাকে বিদ্বেষ করিতেছেন? আপনি যখন শাসনকর্তা হইয়াছেন, তখন আর আমাদিগের জীবনধারণের প্রয়োজন নাই। এক্ষণে ভাবী অর্থের সূচনা ব্যতীত আপনার আর কোন বিষয়ে উৎসাহ দেখিতেছি না। যাহার পথপ্রদর্শক স্বয়ংই অনভিজ্ঞ, সে প্রতিপদেই পথভ্ৰষ্ট হয়, কিন্তু যাহারা স্বয়ংই গমন করিতে পারে, তাহারা কেনই বা ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করিবে?
মহারাজ! আপনি পরিণতপ্ৰজ্ঞ, বৃদ্ধসেবী ও জিতেন্দ্ৰিয় হইয়া পুত্ৰগণের স্বকাৰ্য্যসাধনে ব্যাঘাত জন্মাইতেছেন। বৃহস্পতি লোকব্যাপার ও রাজব্যাপার এই উভয়বিধ ব্যাপারকেই পৃথক বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন, অতএব রাজারা সর্ব্বদা অপ্ৰমত্তচিত্তে স্বাৰ্থচিন্তা করিবে। ক্ষত্ৰিয়দিগের জয়ই প্রধান বৃত্তি, অতএব ইহা ধর্ম্মই হউক আর অধর্ম্মই হউক, আত্মব্যাপারে দোষাদোষের আশঙ্কা কি? যেমন সারথি কশাঘাত দ্বারা সকল দিকেই অশ্বচালনা করে, তদ্রুপ জিগীষু ব্যক্তি পরসম্পত্তি-গ্ৰহণাভিলাষে সর্ব্বদিকে ধাবমান হয়। যে গৃঢ় কিংবা বাহ্য উপায় দ্বারা শত্রুদিগকে সংহার করা যায়, সেই উপায়ই শস্ত্ৰধারীদিগের শস্ত্রস্বরূপ। কে শত্ৰু, কে মিত্র, ইহাকে কোন লেখ্য প্রমাণ নাই; যে যাহাকে সন্তাপ দেয়, সেই তাহার শত্রু। সমৃদ্ধিবৃদ্ধিবিষয়ে অসন্তোষই মূল কারণ, অতএব অসন্তোষবৃদ্ধি বিষয়ে যত্ন করাই যথার্থ নীতি। ঐশ্বর্য বা ধনে কদাচ মমতা করিবে না; কারণ, পূর্ব্বসঞ্চিত ধন অন্যে বলপূর্ব্বক হরণ করিতে পারে, বলপূর্ব্বক হরণ করাই রাজাদিগের ধর্ম্ম। দেবরাজ ইন্দ্র ‘কাহারও অপকার করিব না’ এইরূপ অঙ্গীকার করিয়াও নমুচির শিরশ্ছেদ করিয়াছিলেন, বস্তুতঃ অরাতির প্রতি সেইরূপ সনাতনী বৃত্তিই তাহার অভিমত। যেমন সৰ্প গর্তস্থ জীবজন্তুদিগকে সংহার করে, সেইরূপ ভূমিসম্পত্তি অবিরোধী রাজা ও অপ্রবাসী ব্রাহ্মণকে গ্রাস করিয়া থাকে। জাতি অনুসারে কেহ কাহারও শত্ৰু হইতে পারে না, সমব্যবসায়ী হইলেই শত্রু হইতে পারে। যে ব্যক্তি মোহপরবশ হইয়া অভ্যুদয়কালে শক্রকে উপেক্ষা করে, পরিবর্দ্ধিত ব্যাধির ন্যায়। সেই শক্ৰ তাহার মূলোচ্ছেদ করিয়া থাকে। বৃক্ষমূলজ বাল্মীক যেরূপ আশ্রয়বৃক্ষকে নিপতিত করে, সেই প্রকার শত্রু সামান্য হইলেও বলবীৰ্য্যে পরিবর্দ্ধিত হইয়া প্রতিদ্বন্দ্বীকে সংহার করিতে পারে।
হে। আজমীঢ়বংশাবতংস মহারাজ! বিপক্ষলক্ষ্মী যেন আপনার প্রীতিকর না হয়। আমি যেরূপ কহিলাম, বীৰ্য্যবান্ লোকেরা এইরূপ কাৰ্য্যই করিয়া থাকেন; সর্ব্বত্র নীতির অনুসরণ করিলে কোন বিশিষ্ট ফল-লাভের সম্ভাবনা নাই। যে ব্যক্তি অর্থবৃদ্ধির অভিলাষ করে, সে নিঃসন্দেহে জ্ঞাতিমধ্যে পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে; কারণ, বিক্রম সদ্যই বৃদ্ধি-সম্পাদন করিয়া থাকে। এক্ষণে হয় পাণ্ডবরাজ্যলক্ষ্মী লাভ করিব, নতুবা যুদ্ধে শরীরপাত করিব। হে মহারাজা! আর আমার প্রাণধারণের আবশ্যকতা নাই, পাণ্ডবেরা প্রতিনিয়তই পরিবর্দ্ধিত হইতেছে, আমাদিগের কিছুমাত্র উন্নতি নাই।”