৫৩তম অধ্যায়
শরবর্ষণে অর্জ্জুনের দুৰ্য্যোধন-গতিরোধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন রথঘর্ঘরশব্দে দিঙ্মণ্ডল প্ৰতিধ্বনিত করিয়া কৌরবদিগের অসংখ্য সৈন্যগণসমীপে সহসা সমুপস্থিত হইলেন। কৌরবেরা তাঁহার ধ্বজাগ্ৰ সন্দর্শন, গাণ্ডীবধবনি ও রথনির্ঘোষ শ্রবণ করিতে লাগিলেন। তখন দ্রোণাচাৰ্য্য সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “ঐ দেখ, দূরে মহাবীর অর্জ্জুনের ধ্বজাগ্রভাগ শোভা পাইতেছে, রথের ঘর্ঘর রব শ্রবণগোচর হইতেছে, ধ্বজাগ্রাবর্তী বানর উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া সেনাগণের ভয়োৎপাদন করিতেছে এবং ধনঞ্জয় সুসজ্জিত রথে আরোহণপূর্ব্বক মুহুর্মুহুঃ গাণ্ডীব-শরাসনে অশনিনির্ঘোষ [বজ্রধ্বনি] সদৃশ টঙ্কার [বাণধ্বনি] প্রদান করিতেছে। দেখ, এই দুইটি শর সমবেত হইয়া আমার চরণে নিপতিত হইল, অপর দুইটি মদীয় শ্রবণযুগল স্পর্শ করিয়া প্রবল-বেগে অতিক্রান্ত হইল। বোধ হয়, মহাবীর ধনঞ্জয় অরণ্যবাসকালে যে সকল অলৌকিক কর্ম্ম সম্পাদন করিয়াছে, এক্ষণে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া অভিবাদনপূর্ব্বক তাহা আমার কর্ণগোচর করাইল। যাহা হউক, আমরা বহুকালের পর প্রিয়বান্ধব শ্ৰীমান অর্জ্জুনকে অবলোকন করিলাম; এক্ষণে পার্থ শর, শরানন, তূণীর, শঙ্খ, কবচ, কিরীটি ও খড়গ ধারণ করিয়া প্রজ্জ্বলিত হুতাশনের ন্যায় শোভা পাইতেছে।”
অনন্তর অর্জ্জুন কৌরবগণকে রণস্থলে সমবস্থিত নিরীক্ষণ করিয়া রাজকুমার উত্তরকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে সারথে! সেনাদিগের প্রতি বাণপাতকালে তুমি অশ্বের রশ্মি সংযত করিবে, আমি এই সৈন্যমণ্ডলীমধ্যে সেই কুরুকুলাধম দুৰ্য্যোধন কোথায় আছে একবার অনুসন্ধান করিব। এক্ষণে অন্যান্য কৌরবগণের সহিত যুদ্ধ করিবার প্রয়োজন নাই। সেই অভিমানপরতন্ত্র দুৰ্য্যোধন পরাজিত হইলে সকলকেই পরাজয় করা হইবে। ঐ আচাৰ্য্য দ্রোণ, উহার পশ্চাদ্ভাগে অশ্বত্থামা, ভীষ্ম, কৃপ ও কর্ণ অবস্থান করিতেছেন। এ স্থলে দুৰ্য্যোধনকে ত’ দেখিতে পাইলাম না; এক্ষণে বোধ হয়, সে গোধন গ্রহণপূর্ব্বক প্রাণভয়ে দক্ষিণাভিমুখে পলায়ন করিতেছে; নিরর্থক যুদ্ধ করা অনুচিত, অতএব প্রথমে আমরা কৌরবসেনা পরিত্যাগ করিয়া তাহারই অনুসরণ করি, তাহাকে পরাজয় করিলেই অনতিবিলম্বে গোসকল প্রতিনিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইব।
অনন্তর উত্তর পরমযত্ন সহকারে রশ্মি [অশ্ববল্গা] সংযত করিয়া, যে দিকে রাজা দুৰ্য্যোধন গমন করিতেছেন, সেই দিকে অশ্বচালনা করিলেন। তখন কৃপাচাৰ্য্য অর্জ্জুনের অভিপ্ৰায় স্পষ্টরূপে অবগত হইয়া দ্রোণকে কহিলেন, “অর্জ্জুন মহারাজ দুৰ্য্যোধনকে লক্ষ্য করিয়া মহাবেগে গমন করিতেছে; অতএব আইস, আমরা দুৰ্য্যোধনের পার্ষ্ণিগ্রহণ [পার্শ্বদেশরক্ষা] করি। অর্জ্জুন ক্রোধাবিষ্ট হইলে দেবরাজ ইন্দ্র, দেবকীনন্দন মধুসূদন, অশ্বত্থামা ও দ্রোণ ব্যতিরেকে কেহই একাকী যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইবে না। এক্ষণে গোধন বা প্রভূত ধন লইয়া আমাদিগের কি উপকার দর্শিবে? মহারাজ দুৰ্য্যোধন অনতিবিলম্বে নাবিকশূন্য নৌকার ন্যায় অর্জ্জুনজলে নিমগ্ন হইবে, তাহার সন্দেহ নাই।”
অনন্তর অর্জ্জুন তথায় উপস্থিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে আপনার নাম কীর্ত্তন করিলেন এবং কৌরবসেনাগণের প্রতি অনবরত শালভসমূহের ন্যায় শরজাল প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। তখন ভূমণ্ডল ও নভস্তল পার্থশারে সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। কৌরবসেনাসকল নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল; কিন্তু তৎকালে কেহই পলায়ন করিল না, প্রত্যুত মনে মনে মহাবীর অর্জ্জুনের ক্ষিপ্রকারিতার সবিশেষ প্রশংসা করিতে লাগিল ।
ইত্যবসরে ধনঞ্জয় শঙ্খধ্বনি ও গাণ্ডীবটঙ্কার প্রদান করিয়া ধ্বজদণ্ডে ভূতসকল প্রেরণ করিলেন। শঙ্খধ্বনি, রথনিৰ্ঘোষ, গাণ্ডীবাশব্দ ও ধ্বজসন্নিবিষ্ট ধাবমান উৰ্দ্ধপুচ্ছ অমানুষ ভূত সকলেল কলরবে পৃথিবী বিচলিত হইয়া উঠিল। তখন ধেনু-সকল দক্ষিণাভিমুখে প্রতিনিবৃত্ত হইল।