৫১.
নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণ বললেন, হে পুরাণজ্ঞ সুকথক সূত, স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে যে চারটি যুগ ছিল আমরা সেই যুগগুলির উৎপত্তি বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে শুনতে ইচ্ছা করছি।
সুব্রত ধার্মিক সূত বললেন, পৃথিবী সংক্রান্ত আলোচনা প্রসঙ্গে আমি পূর্বে যে যে বিষয়ের উল্লেখ করেছি, এখন সেই সেই বিষয়ের চারটি যুগের কথাই বলব। আপনাদের জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য সর্বতোভাবে এবং বিস্তারিতভাবেই পুরো বিষয়টি আলোচনা করব। প্রথমে আমি যুগ, যুগভেদ, যুগধর্ম, যুগসন্ধি, অংশ ও যুগসন্ধান এই ছয় রকম যুগ সম্বন্ধীয় বিবরণ যথাযথভাবে প্রদান করব। লৌকিক প্রমাণের দ্বারা নির্ণীত যে মনুষ্য অব্দ, সেই অব্দ দ্বারা গণনা করে চতুর্যগ বিষয়েও বলব।
নিমেষ, কাষ্ঠা, কলা ও মুহূর্ত–এই চারভাগে সময়কে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে নিমেষ কালের পরিমাণ হল একটি লঘুঅক্ষর উচ্চারণের সমতুল্য সময়। এরকম পনেরোটি নিমেষে এক কাষ্ঠা, ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা, ত্রিশ কলায় এক মুহূর্ত এবং ত্রিশ মুহূর্তে এক অহোরাত্র নির্ধারণ করা হয়। সূর্যের উদয় অস্তের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের দিন ও রাত্রি বিধান করা হয়। তার মধ্যে দিন হল কর্ম নির্বাহ এবং রাত্রি নিদ্রার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে। মানুষের পরিমাণে এক মাসে পিতৃগণের এক দিনরাত্রি হয়। তার মধ্যে কৃষ্ণপক্ষ হল পিতৃগণের কাছে দিন আর শুক্লপক্ষ হল রাত্রি। ভূর্লোকবাসী মানুষের ত্রিশমাসে পিতৃগণের একমাস এবং মানুষের তেষট্টি মাসে পিতৃগণের এক সংবৎসর হয়ে থাকে। আরও জেনে রাখুন মানুষের শতবর্ষে পিতৃগণের তিন বৎসর চারমাস হয়ে থাকে। লৌকিক মান অনুযায়ী যে মানুষ অব্দ প্রচলিত আছে, এই শাস্ত্রে তাকে দিব্য দিনরাত্রি রূপে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সেই দিব্য দিনরাত্রির একটি সুনির্দিষ্ট বিভাগ আছে। সেটি হল–উত্তরায়ণ হল দিবা এবং দক্ষিণায়ণ হল রাত্রি। মানুষের ত্রিশ বৎসরে এখানে দিব্য এক মাসে গণিত হয়ে থাকে। মানুষের একশত বৎসরে দিব্য তিন মাস দশ দিন হয়। এইবারেই দিব্য বা বলা ভালো দৈব বৎসরাদি গণনা করতে হয়। এরকম আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন মানুষের তিনশত ষাট বৎসরে দিব্য এক বৎসর এবং মানুষের তিন সহস্র ষাট বৎসরে দিব্য এক সপ্তর্ষি বৎসর হয়ে থাকে। মানুষের নয় সহস্র নব্বই বৎসরে এক ক্রৌঞ্চ বৎসর দিব্য এক সহস্র বৎসর হয়ে থাকে। প্রাচীনকালের প্রাজ্ঞ ঋষিরা এইভাবেই অতুল জ্ঞান এবং দিব্য প্রমাণের সাহায্যে যুগসংখ্যা নিরূপণ করে থাকেন।
পণ্ডিতগণ ধারণা অনুসারে এই ভারতবর্ষে চারটি যুগ আছে। সেগুলি হল যথাক্রমে কৃত বা সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপর ও কলিযুগ। সত্যযুগে বিস্তারকাল চার সহস্র বৎসর। সত্যযুগের সন্ধ্যা আছে চার শত বর্ষ আর সন্ধ্যাংশও চার শত বর্ষ। ত্রেতা যুগের পরিমাণ দুই সহস্র বৎসর। দ্বাপর যুগস্থিত সন্ধ্যা হল দুইশত এবং সন্ধ্যাংশও দুইশত। কলিযুগের ব্যাপ্তী এক সহস্র বর্ষ, সন্ধ্যা এক শত বৎসর এবং সন্ধ্যাংশও এক শত বৎসর। অতএব সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি–এই চারটি যুগের মোট পরিমাণ হল বারো সহস্র বৎসর। মানুষের গণনানুসারে এইসব যুগের সাংবৎসর নিরূপণ করা যায়। যেমন–সত্যযুগের পরিমাণ ১৪৪০০০০ বর্ষ। কলিযুগের পরিমাণও প্রায় একইরকম। আবার মানুষের পরিমাণানুসারে যদি সন্ধ্যাংশ ভিন্ন চতুর্যুগের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, তাহলে সংখ্যার হিসাবে তা হবে ৪৩২০০০০ বর্ষ।
একাত্তরটি চতুর্যগে এক মন্বন্তরে অনুষ্ঠিত হয়। মানুষের ত্রিশ কোটি নিরূপিত হয়। যুগের সাথে এভাবেই মন্বন্তরের সাতষট্টি নিযুত কুড়ি সহস্র বৎসরে একটি দিব্য মন্বন্তর হিসাব রক্ষী করা হয়।
এবার আমি অবশিষ্ট ত্রেতা দ্বাপর ও কলিযুগের কথা বলব। একসঙ্গে একটির বেশি যুগের কথা বলা যায় না। তাই ক্রমানুসারে ঋষি বংশের আলোচনা প্রসঙ্গে অবশিষ্ট যুগগুলির ক্রমিক কথা আপনাদের কাছে বলব।
ব্রহ্মা কর্তৃক ত্রেতাযুগের সূচনাতেই মনু সপ্তর্ষি শ্রৌত ধর্ম ও স্মার্তধর্ম প্রবর্তিত হয়েছিল। আমি পূর্বেই বলেছি, দ্বারা, অগ্নিহোত্র, সংযোগ, ঋক, যজুঃ ও সাম প্রভৃতি শ্রোতধর্ম সপ্তর্ষিদের দ্বারা আলোচিত হয়েছে। স্বায়ম্ভুব মনু স্মাৰ্ত্ত ধর্মের পালনীয় আচরণ, লক্ষণ সমূহ ও বর্ণাশ্রমের আচরণীয় ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সত্য ব্রহ্মচর্য, শ্রুতি ও তপস্যা, বিষয়ে ত্রেতাযুগের প্রারম্ভেই তপস্যারত সপ্তর্ষিগণ ও মনুযুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। এইসমস্ত মন্ত্রই কোনোরকম সচেতনতা ও ক্রিয়া প্রচেষ্টা ছাড়াই তারকা প্রভৃতি দর্শনের সাথে সাথে তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। আদিকল্পে উচ্চারিত এই সমস্ত মন্ত্রই দেবতা থেকে সমুদভূত এবং কল্পবিনাশ কালে তাদের সিদ্ধির প্রবর্তন ঘটিয়ে থাকে। অতীতের সহস্র সহস্র কল্পে যাঁদের যা যা মন্ত্র ছিল, প্রতিজ্ঞানের ফলে কল্পনান্তরেও তাঁদের সেইসব মন্ত্র রয়ে গেল। এভাবেই ত্রেতার প্রারম্ভে সপ্তর্ষিগণ ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথর্ব মন্ত্র প্রকাশ করেন। আর মনু প্রকাশ করেন স্মাৰ্ত্ত ধর্ম। মনে রাখবেন, ত্রেতা যুগের শুরুতে কেবল বৈদিক ধর্মই ছিল। কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে আয়ুর পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় দ্বাপর যুগে ধর্ম বিপর্যয় দেখা দেয়। স্বয়ম্ভ ব্রহ্মা ত্রেতাযুগে দেবতাদের, তারপর কলি ও দ্বাপর যুগে তপস্বী ও ঋষিদের উৎপত্তি ও বিনাশরহিত করেছিলেন। সাঙ্গবেদবাণী যুগে যুগে ধর্মযুক্ত এবং সমান অর্থযুক্ত হয়েই প্রবর্তিত হয়ে এসেছে। ক্ষত্রিয়ের উৎসাহ যজ্ঞ বৈশ্যের হবির্যজ্ঞ শূদ্রের পরিচর্যা যজ্ঞ এবং ব্রাহ্মণের জন্য জপযজ্ঞ নির্দিষ্ট হয়ে আছে। ত্রেতাযুগের জতুর্বর্ণই ধর্মপালক, ক্রিয়ানিষ্ঠ, প্রজাহিতৈষী, সমৃদ্ধশালী ও সুখী ছিলেন। সে-সময় ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের, বৈশ্য ক্ষত্রিয়ের এবং শূদ্র বৈশ্যের অনুগমন করতেন। তাদের শুভ প্রবৃত্তি বর্ণাশ্রমের পক্ষে মঙ্গলদায়ী ছিল। ত্রেতাযুগবাসীগণ নিজনিজ মানসিক সংকল্প অনুসারে বা নির্দিষ্ট কর্ম অনুসারে বা বাক্য অনুসারে মে কমই আরম্ভ করুন না কেন, তাতে সিদ্ধিলাভ করতেন। ত্রেতাযুগে সর্ব সাধারণের আয়ু, মেধা, বল, রূপ, আরোগ্য ও ধর্মশীলতা ক্ষেত্রে সমপ্রবণতা লক্ষ্য করা যেত। প্রজাপতি লোকপিতামহ ব্রহ্মা এই যুগের অধিবাসীদের জন্য এমনই এক প্রকারের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোহবশত এঁরা সেই সব ধর্ম পালন করতে পারলেন না। পারস্পরিক বিরোধ শুরু হল। এঁরা একে একে প্রাণত্যাগ করে আবার জন্মগ্রহণ করলেন।
স্বায়ম্ভুব মনু সর্বতোভাবে ন্যায়-অন্যায়ের অনুসারে প্রজাপালন করেন। সেই তিনি শতরূপার গর্ভে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে দুটি পুত্রসন্তান উৎপন্ন করেছিলেন। তাঁরাই হলেন পৃথিবীর প্রথম রাজা। তাদের সময় রাজা বলা হল। পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ আছেন যারা দুর্জয় প্রকৃতির যাঁদের মনের মধ্যে কোনো-না-কোনো পাপমতি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তাদের মধ্যে ধর্মস্থাপনের জন্যেই আমি তপস্যা ও বর্ণবিভাগ বিষয়ে শাস্ত্রের নির্দেশ দিয়ে থাকি। এই ত্রেতাযুগেই ঋষি ও ব্রাহ্মণদের দ্বারা সংহিতা ও মন্ত্ৰাতি উক্ত হয়েছে। দেবতাদের দ্বারা যজ্ঞ প্রবর্তিত হয়েছে। পূর্ববর্তী স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরেই মহাতেজশালী মহেন্দ্রের সাথে যুগ্মভাবে দেবগণ শুক্ল, যাম, সর্বসম্ভার, সংবৃত ও বিশ্ববোজী যজ্ঞ প্রভৃতির প্রবর্তন করেছেন। ত্রেতাযুগের পালনীয় হল সত্য, জপ, তপ ও দান। ত্রেতাযুগে ক্রিয়াধর্মের হ্রাস ও সত্য ধর্মের বৃদ্ধি দেখা যায়। কেবল সেইসব মানুষেরাই ত্রেতাযুগে জন্মলাভ করেন যাঁরা বীর, আয়ুষ্মন, মহাশক্তিধর, দণ্ডধারী, মহাভাগ, যজ্বা ব্রহ্মবাদী, মত্ত মাতঙ্গগামী পদ্মপলাশলোচন, বিশাল বক্ষ, সিংহ, ঘাতক, মহাধনুর্ধর, চক্রবর্তী ও সর্বলক্ষণযুক্ত এঁদের দুই বাহু ন্যগ্রোধের মতো। তাই এঁরা ন্যগ্রোধ পরিমণ্ডল নামেও খ্যাতমান। ন্যগ্রোধ শব্দের পরিচিত অর্থ হল উচ্চ বা বিশাল।
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকালে যত যত ত্রেতা যুগ আছে সেইসব ত্রেতাযুগেই চক্রবর্তীগণ জন্ম নিয়েছেন। অতীত ও অনাগত সমস্ত মন্বন্তরেই চক্রবর্তীগণ বিষ্ণুর অংশে জন্মগ্রহণ করে থাকেন। মোট চোদ্দোটি দিব্যরত্ন চক্রবর্তীদের ক্ষেত্রে সিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়। এর মধ্যে চক্র রথ, মণি, খড়গ, ধনু, রত্ন, কেতু ও নিধি এই সাতটি প্রাণহীন বলে জ্ঞাত, আর অশ্ব, হস্তীশাবক, ভার্যা, পুরোহিত সেনানী, রথকৃৎ মন্ত্রী ও যুবক এই সাতটি প্রাণী রূপে কীর্তিত। এই চোদ্দোটি দিব্যরত্ন সম্পন্ন চক্রবর্তী রাজাদের ক্ষেত্রে চারটি অদ্ভুত মঙ্গল সাধিত হয়ে থাকে। তা হল বল, ধর্ম, সুখ ও ধনু। এঁরা পরস্পরের মধ্যে বিরোধ না ঘটিয়ে সমানভাবে ধর্ম, অর্থ, কাম যশ ও বিজয় লাভ করে থাকেন। এঁরা অনিমাদি ঐশ্বর্য, প্রভুশক্তি ও অন্যান্য তপস্যা দ্বারা ঋষিগণের এবং বলও তপস্যা দ্বারা দেব, দানব ও মানুষদের পরাস্ত করে থাকেন। এঁরা সকলেই কিছু দেহলক্ষণ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে থাকেন। যেমন–এঁদের দন্ত ওষ্ঠদ্বয় উন্নত। এঁদের বাহু অজানুলম্বিত। হস্ত জালিকাকৃতি ও বৃষঙ্কিত। জিহ্বা পরিমার্জিত কিন্তু তাম্প্রভ। ললাটে, ঊর্থনাভসম্মত কেশ। এবং ন্যগ্রোধ বৃক্ষের মতো উন্নত দেহ। এঁরা সুমেহন গজেন্দ্রগতি সিংহস্কন্ধ ও বিশাল হনুযুক্ত। এদের দুই চরণে চক্র ও মৎস্যরেখা ও দুই হস্তে শঙ্খ ও পদ্মরেখা লক্ষিত হয়।
ত্রেতাযুগে এইরকম পঁচাশি হাজার জরাহীন রাজা বর্তমান ছিলেন। অন্তরীক্ষ, সমুদ্র, পাতাল ও পর্বতে এঁদের গতি ছিল অপ্রতিহত। বর্ণাশ্রমের বিভাগ অনুসারে ধর্ম প্রবর্তিত হতে থাকে। ক্রেতা যুগ শেষ হবার আগেই যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও সত্য ত্রেতাযুগের ধর্ম রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মর্যাদা ও ঔচিত্য বোধের সীমানা নির্দেশ করার জন্যই দণ্ডনীতির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই যুগের প্রজারা সকলেই স্বাস্থ্যবান, রোগহীন ও পূর্ণমানস সম্পন্ন ছিলেন। ত্রেতাযুগে এক বেদকে চতুষ্পদ রূপে স্মরণ করা হত। মানুষেরা ন্যূনতম তিনসহস্র বৎসর পর্যন্ত জীবিত থাকতেন এবং অনন্তকালে পুত্রপৌত্রাদির মুখদর্শন করে যথাকালে মৃত্যুমুখে পতিত হতেন। এই হল ত্রেতাযুগের লোকজীবনের বৈশিষ্ট্য ত্রেতাযুগের উল্লিখিত স্বভাব সন্ধ্যাপদে এবং সন্ধ্যার স্বভাব যুগপদে লক্ষিত হয়ে থাকে।
.
৫২.
শাংশয়ান আগ্রহান্বিত চিত্তে বললেন, হে সূত ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে স্বায়ম্ভব সৃষ্টিতে কীভাবে যজ্ঞাদি উপাসনার প্রবর্তন হল? বলুন সত্য যুগের অবসানের সাথে সাথে যখন সন্ধ্যাকাল অন্তর্হিত হল এবং যখন ত্রেতাযুগের প্রবর্তন হল, তখন কীভাবে বর্ণাশ্রমের প্রচলন নির্দিষ্ট হয়েছিল এবং কীভাবেই বা যজ্ঞসম্ভার সংগ্রহ করে যজ্ঞকার্যের প্রবর্তন হয়েছিল, তা বর্ণনা করুন।
এই কথা শুনে সূত বললেন, যজ্ঞের প্রবর্তন বিষয়ে যা কিছু আমি জেনেছি তা বলছি, শুনুন।
পৃথিবীতে বৃষ্টি আরম্ভ হলে ওষধি সমূহের আবির্ভাব ঘটল। গৃহাশ্রম ও সমস্তপুরে বার্তা প্রতিষ্ঠিত হল। তখন দেবরাজ ইন্দ্র বর্ণাশ্রমের ব্যবস্থাকে আরও দৃঢ় করলেন। তিনি মন্ত্র ও সংহিতাকে ঐহিক ও পারত্রিক কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত করলেন। তারপর অন্য অন্য সকল দেবতাদের সাথে মিলিত হয়ে প্রয়োজনীয় যজ্ঞসম্ভার সংগ্রহ করে যজ্ঞ করতে শুরু করলেন। অনন্তর অশ্বমেধ যজ্ঞ বিস্তৃত হল। মহর্ষিরা সমাগত হলেন। তারা সকলে মিলে বেধ্যপশু দ্বারা যাগ করতে লাগলেন। ঋত্বিক মাত্রেই যজ্ঞকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেইসব যজ্ঞকার্যে আগমাদি যথাসম্ভব দ্রুত গীত হতে লাগল। পৃথিবী শ্রেষ্ঠ অযুগণ অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বিভিন্ন যজ্ঞানুষ্ঠান করতে লাগলেন।
এই সময় থেকেই বেধ্যপশুদের বলি দেওয়া শুরু হল। দেবতাদের আহ্বায়ক হোতৃগণ দেবতাদের উদ্দেশে অগ্নিমধ্যে ঘৃতাহুতি প্রদান করলেন। ফলে এক দিকে যেমন যজ্ঞভাগী দেবতারা আহুতি লাভ করলেন, অন্য দিকে তেমনি ইন্দ্রিয়াত্মক যজ্ঞভাগী দেবতারাও পূজিত হয়ে আহুতি লাভ করলেন। কিন্তু যথা কালে সেইসব দীন পশুদের দেখে মহর্ষি অর্ধযুগলের মনে ভাবান্তর হল। তারা ইন্দ্রকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, এ আপনার কেমন যজ্ঞবিধি দেবেন্দ্র? হিংসার মাধ্যমে এই যে ধর্ম লাভের ইচ্ছা এতো প্রবল অধর্ম! হে সুরোত্তম, পবিত্র যজ্ঞানুষ্ঠানে এভাবে পশুবধ কখনও কাম্য নয়। আপনি এভাবে পশুবধের বিধান দিয়ে ধর্মনাশের দিকে উদ্যোগী হয়েছেন। এই অধর্ম আপনি বন্ধ করুন। হিংসা, তা যে-কোনো প্রাণীর প্রতিই প্রদর্শিত হোক না কেন, আমরা তাকে কোনো মতেই ধর্ম বলতে পারি না। হে সুরশ্রেষ্ট; আপনি যদি প্রকৃতই যজ্ঞ করতে ইচ্ছুক হোন তবে এমন যজ্ঞ করুন যা বেদ ও বিধির অনুগত। অথচ যা অক্ষয়ের হেতু এবং যাতে হিংসা নেই। হে ইন্দ্রদেব, স্মরণ করুন সেই মহান ধর্ম যা পূর্বে স্বয়ম্ভ দ্বারা বিহিত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, যা তিন বর্ষকাল ধরে রক্ষিত এবং প্ররোহের অযোগ্য–এমন বীজ দ্বারা যজ্ঞ করলে হিংসার প্রকাশ ঘটে না।
এইভাবে যজ্ঞভোজী বিশ্বভূক ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে তত্ত্বজ্ঞানী ত্রিকালদর্শী মুনিবৃন্দ যজ্ঞের ঔচিত্য বিষয়ে প্রশ্ন তুললেন।
ইন্দ্রের কাছে এই বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য অভিমত ছিল না। মহর্ষিরা তার সঙ্গে বিবাদে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন এই গূঢ় প্রশ্নের সদুত্তর কামনা করে ইন্দ্র ও সেইসব তত্ত্বজ্ঞঋষিবৃন্দ তাকে বললেন, হে মহাপ্রাজ্ঞ মহারাজ, উত্তানপাদকে আপনি যখন যজ্ঞবিধি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তখন উনি আপনার দ্বিধা দূর করার জন্য যা উত্তর দিয়েছিলেন নিঃসংশয়ে আমাদের বলুন। আমাদের এই ধর্মসংকট দূর করুন।
লোকপাল মহারাজা তাদের প্রশ্নের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেন না। তিনি ফলাফল বিচার না করেই বেদূশাস্ত্র সম্মত যজ্ঞতত্ত্ব হুবহু বলে দিলেন। তিনি আরও বললেন, দেবগণ কর্তৃক যে মনু উপদেশ দেওয়া হবে, সেইরকমই যজ্ঞ করবেন। প্রয়োজনে বেধ্যপশু, বীজ কিংবা ফল দ্বারা যজ্ঞ করবেন।
দীর্ঘতপা মহর্ষিগণ ও তারকাদি দর্শনকারীগণ এই হিংসাত্মক সংহিতামন্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন। এবং তাদের সেই বচন-প্রামাণ্য অনুসারেই আমি এসব কথা বলছি।
আপনাদের কাছে আমার আন্তরিক অনুরোধ আপনারা অসন্তুষ্ট হবেন না। হে দ্বিজবৃন্দ, আপনারাই বিবেচনা করুন, যদি সমস্ত মন্ত্রবাক্যই হিংসাময় বলে প্রমাণ হয়, তবে যজ্ঞ আরম্ভ করাই কি উচিত কাজ নয়?
সেই যুক্তাত্মা তপস্বীরা মহারাজার এই কথার প্রত্যুত্তর দিতে পারলেন না। নীচের দিকে বাড়ি দেখে তারা সেই নৃপতিকে বললেন, বাক সংযম করুন রাজন! মিথ্যেবাদী রাজাকে রসাতলে যেতে হয়।
এইকথা বলা মাত্র রাজা রসাতলে গমন করলেন। এভাবে রাজা বসু উধ্বচারী হয়েও রসাতলচারী হলেন। তিনি কেবল মুনিদের বাক্যের সত্যতা রক্ষার জন্যই বসুধাতলবাসী হলেন এবং অধোগতি লাভ করে ধর্মবিষয়ক সংশয়ের ছেদন করলেন।
অতএব হে ধর্মাত্মা দ্বিজবৃন্দ, মনে রাখবেন, কোনো বহুজ্ঞ ব্যক্তিও যেন ধর্মের বিষয়ে নিশ্চয় করে কিছু বলবেন না। ধর্মের একাধিক ধারা আছে। এর গতি অতি সূক্ষ্ম ও দুর্লভ। তাই দেব, ঋষি ও স্বায়ম্ভুব মুনি ভিন্ন কেউ ধর্ম বিষয়ে নিশ্চয় করে কিছু বলতে পারেন না। অতএব সেই মহর্ষিদের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হল যে হিংসা কখনোই ধর্মের দ্বার নয়।
মনে রাখবেন, নিজ নিজ পুণ্যকর্মের প্রভাবে সহস্র কোটি ঋষি স্বর্গে গমন করেছেন। এইজন্য মহান ঋষিরা কখনোই যজ্ঞ বা দানের প্রশংসা করেন না। কেননা সামান্য ফলমূল শাক ও উদকপাত্র দান করে তারা তো ইতিমধ্যেই নিজ প্রভাবে স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অদ্রোহ, অলোভ সর্বভূতে দয়া, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, সত্য; অক্রোধ, ক্ষমা ধৈৰ্য্য–এরা হল সনাতন ধর্মের মূল যা লাভ করা অতীব দুঃসাধ্য। যজ্ঞহল ধর্মমন্ত্রাত্মক কিন্তু তপস্যা হল অনাহরাত্মক। যজ্ঞ করলে দেবত্ব পাওয়া যায়, কিন্তু তপস্যায় বৈরাগ্য মেলে। কর্মসন্ন্যাসে ব্রাহ্মণ্য, বৈরাগ্যে লয় এবং জ্ঞানলাভে কৈবল্য আসে। এইভাবেই এই পঞ্চগতি নির্দিষ্ট আছে। এইভাবে পুরাকালে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে যজ্ঞের প্রবর্তনকে কেন্দ্র করে দেবতা ও ঋষিদের মধ্যে এই বিষয়ে ভয়ানক বিবাদ দেখা দিয়েছিল।
এরপর ধীমান ঋষিগণ রাজা বসুর বাক্যের প্রতি অনাদর প্রকাশ করে যে যে স্থান থেকে এসেছিলেন, সেই সেই স্থানে প্রস্থান করলেন, তাদের সঙ্গে কয়েকজন দেবতাও গিয়েছিলেন এবং যজ্ঞলাভ করেছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র ব্রহ্মক্ষত্রময় নৃপতিগণই তপঃসিদ্ধ হয়েছিলেন বলা হয়ে থাকে। এর ফলে প্রিয়ব্রত, উত্তানপাদ, ধ্রুব, মেধাতিথি বসু, সুমেধা, বিরজাঃ শঙ্খপাদজ, প্রাচীণবৰ্হি, পর্জন্য, হর্বিদ্ধান প্রভৃতি রাজারা এবং আরও অন্য অনেক রাজা সিদ্ধ হয়ে স্বর্গে গমন করেন। তারা সকলেই রাজর্ষি অথবা মহাসত্ত্ব ছিলেন। মহীতে তাদের সকলের কীর্তিই ছিল প্রতিষ্ঠিত। এই রকম বিভিন্ন কারণেই যজ্ঞ অপেক্ষা তপস্যাকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়। এমনকি ব্রহ্মা প্রথমে তপস্যা বলেই এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেন। যজ্ঞে তপস্যাকে অতিক্রম করা যায় না। সুতরাং তপস্যাই হল মূল।
এইবাবে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে প্রথম যজ্ঞ প্রবর্তিত হল। সেই থেকে যুগাদিক্রমে সেই যজ্ঞকার্য অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।
.
৫৩.
সূত বলতে লাগলেন–ক্রমানুসারে এবার আমি দ্বাপর যুগের কথা বলব।
ত্রেতাযুগ ক্ষীণ হয়ে গেলে দ্বাপর যুগের প্রবর্তন ঘটে। যদিও যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই যুগের সিদ্ধিরও বিনাশ ঘটে। তবুও দ্বাপরাদি যুগের প্রজাদের সিদ্ধি প্রায় ত্রেতা যুগের অনুরূপ বলেই বোধ হয়। ফলে লোভ, অধৈৰ্য্য, বাণিজ্য, যুদ্ধ যথার্থ তত্ত্বের অনিশ্চয়, চারবর্ণের সাংকৰ্য্য কার্যের অনির্ণয়, যজ্ঞে, ওষধি ও পশুর নিপীড়ন মদ, দম্ভ, অক্ষমা, বলহীনতা প্রভৃতির সাথে সাথে রজোময় ও তমোময় যা কিছু প্রবৃত্তি-সবেরই প্রকাশ ঘটে দ্বাপরে। প্রথমে যে সত্য যুগ সেই যুগে সর্বত্র ধর্ম বিরাজ করত। ত্রেতা যুগের অধিবাসীরা যথাসম্ভব সেই ধর্ম পালন করেছেন। কিন্তু দ্বাপর যুগে সেই প্রচলিত ধর্মক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দেয়। এবং সবশেষে কলিযুগে ধর্মের নাশ ঘটে। একইসঙ্গে কলিযুগে বর্ণাশ্রম প্রথার নাশ ঘটে এও সাংকৰ্য্য দেখা দেয়। শ্রুতি ও স্মৃতিতে দ্বৈভাব জাগরূক হয়। শ্রুতি ও স্মৃতির এই দ্বৈধীভাবের ফলে শাস্ত্র নির্ণয় সম্ভব হয় না। শাস্ত্রবিষয়ক নিশ্চয়তা বোধের অভাবে অচিরেই ধর্মতত্ত্ব বিপন্ন হয়। মানুষে মানুষে মতভেদ দেখা দেয়। এই পারস্পরিক মতভেদ দীর্ঘস্থায়ী হলে মানুষের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটতে থাকে। কোটি ধর্ম, কোটিই বা অধর্ম–সেই বোধ মানুষ হারিয়ে ফেলে। পরম্পরার ক্ষেত্রে যে বৈকল্য দেখা দেয়, কার্যপরম্পরা ক্ষেত্রেও তা সঞ্চারিত হয়। তাই কলি যুগে দেখা গেল, ‘মতভেদ’ অর্থাৎ মত বিষয়ে বৈকল্য থাকার ফলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিল। আর একইসঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রম বিষয়ে আধিক্য ঘটলে সমস্ত শাস্ত্রেরই ধ্বংস ঘটবে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
দ্বাপরাদি যুগে বেদব্যাস মানুষের আয়ুর স্বল্পতাকে প্রত্যক্ষ করে বেদকে চারভাগে বিভক্ত করেন। এর আগে চতুষ্পদে একই বেদ বারবার সংগৃহীত হত। অচিরেই দৃষ্টির পার্থক্যের কারণে ঋষিপুত্রগণ বেদকে আরও নানাভাগে বিভক্ত করেন। মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের বিন্যাস এবং স্বর ও বর্ণের বিপর্যয়ের কারণে বেদজ্ঞ মহর্ষিরা ঋক, সাম, যজুঃ এই তিনটি সংহিতা সংগ্রহ করেন। সামান্য কিছু ভ্রান্তি ও কোথাও কোথাও তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রভেদ ঘটে বলে বেদবিদ ঋষিগণ ব্রাহ্মণ কল্পসূত্র ও মন্ত্রপ্রবচন সমূহেরও সংহিতা প্রণয়ন করেন। অন্য শিষ্যরা তাদের গুরুদের সাথে সেই স্থান ত্যাগ করেন। কেউ কেউ আবার তাদের সাথেই অবস্থান করতে থাকেন।
পূর্বে একমাত্র অধ্বর্থব ছিল, শেষ অবধি তা আবার দুই প্রকার হল। এই ভাবে সামান্য ও বিপরীত অর্থ দিয়ে সমস্ত শাস্ত্র আকুল হল। ক্রমে অধ্বর্থবের বহুল প্রস্তাবে এই আকুলতা বৃদ্ধি পেল। ঠিক একইভাবে ঋক, সাম ও অথর্ব বেদের ক্ষয়হীন বিকল্পের ফলে সমস্ত শাস্ত্রই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। ভিন্ন দৃষ্টির মানুষেরা দ্বাপর যুগে শাস্ত্রের বিভিন্নতা ও ক্ষয়বিহীন বিকল্প কল্পনা করে থাকেন। এর ফলে শাস্ত্রসমূহ দ্বাপরযুগে প্রবর্তিত হয়েও আবার কলিতে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। এইসব কিছু বিপর্যয়ের সূত্রপাত দ্বাপর যুগেই হয়েছিল। সেই জন্যই দ্বাপর যুগে অনাবৃষ্টি, মরণ ও কর্মজনিত দুঃখের ফলে মানুষের মনে নির্বেদ জন্মায়। নির্বেদ থেকে দুঃখমোচনের জন্য বিচার করার ক্ষমতা জন্মায়। বিচার থেকে বৈরাগ্য, বৈরাগ্য থেকে দোষদর্শন, দোষদর্শনের থেকে সেই অভিমানী মানুষদের জ্ঞানোৎপত্তি দেখা দেয়। আবার এই দ্বাপর যুগেই শাস্ত্রের পাপপন্থীদের জন্ম হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, জ্যোতিষ শাস্ত্রের অন্তর্গত অঙ্গ শাস্ত্র, অর্থ শাস্ত্র ও হেতু শাস্ত্রের বিকল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভেদ তাদের পৃথক পৃথক প্রস্থান এবং তাই নিয়ে মানুষদের মধ্যে মতভেদ দ্বাপর যুগেই ঘটতে দেখা যায়। মনু কর্ম ও বাক্যে বাৰ্তা শাস্ত্রের সিদ্ধি হয়। এই যুগে সমস্ত ভূতবর্গের মধ্যে কায়ক্লেশ জন্মায়। এর ফলে লোভ, অধৈর্য, বর্ণিগযুদ্ধ, তত্ত্বসমূহের অনিশ্চয়তা বেদ শাস্ত্রপ্রণয়ন, ধর্মের সাংকৰ্য্য যোগ, শোক, বধ, কাম, দ্বেষ, বর্ণাশ্রম ধ্বংস প্রভৃতি ঘটতে থাকে। দ্বাপর যুগে মানুষের পরমায়ু দ্বিসহস্র বৎসর পূর্ণ করে। যখন মানুষের আয়ুষ্কালের পাদমাত্র অবশিষ্ট থাকে, সেই সময় দ্বাপর যুগের সন্ধ্যাকাল প্রবর্তিত হয়। দ্বাপরযুগীয় ধর্মগুলি যখন গুণহীন অবস্থায় পৌঁছে যায়, তখন সন্ধ্যাকাল প্রবর্তিত হয়। তিষ্য দ্বাপরের বর্ষমানের শেষ অর্ধ্বে কী থাকে, এবার আমি সে বিষয়ে বলব।
দ্বাপরের কিছু অংশ অবশিষ্ট থাকতে থাকতেই কলিযুগের প্রতিপত্তি শুরু হয়ে যায়। দ্রুত পরিবর্তিত এই সময়ে তাই হিংসা, অসূয়া, মিথ্যা, মায়া ও তপস্বী বধ প্রভৃতি নিম্নগামী ঘটনা ঘটতে থাকে। একেই তিষ্য দ্বাপর যুগের বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র বলা যেতে পারে। প্রজাগণ এই চরিত্রের অনুযায়ী কর্ম সাধন করতে থাকেন। সমস্ত ধর্মের স্বরূপ ছিল অন্তঃসারশূন্য। তাতে প্রকৃতপক্ষে ধর্মকেই পরিত্যক্ত হতে দেখা যায়। এই সময় মনু, কর্ম ও স্তুতি সমন্বিত বার্তাশাস্ত্র কখন সিদ্ধ হয়, কখনও হয়না। কলিযুগে প্রচণ্ড ক্ষুধার ভয়, ঘোর অনাবৃষ্টির ভয়, মারক রোগ, বিপরীত দৃষ্টি–এইসব ঘটে থাকে, প্রজাগণ কেউ গর্ভস্থ অবস্থায়, কেউ যৌবন বয়সে, কেউ কৌমার্য কালে, কেউ কেউ বৃদ্ধ বয়সে মারা যায়। তিষ্য দ্বাপর যুগে কোনো স্মৃতির প্রমাণই গ্রাহ্য করা হয় না।
তিষ্য যুগের প্রজাসকল সতত অধার্মিক অনাচারগ্রস্ত মোহ ও কোপের বশীভূত, অল্পতেজ সম্পন্ন ও মিথ্যেবাদী হয়ে থাকেন। বিপদের অঙ্গহীন ও অবিহিত যাগ অবিহিত অধ্যয়ন নিন্দিত আচার দুষ্ট আগম ও নানাবিধ দূষিত কর্মের প্রভাবে প্রজাদের মনে ভয় জন্ম নেয়। ফলে সেইসব সাধারণ প্রজাদের মনে হিংসা, মায়া, ঈর্ষা, ক্রোধ, অসূয়া, অক্ষমতা মিথ্যা, রোগ লোভ–এইসব সদাই হতে থাকে। আর এরই মধ্যে যখন কলিযুগ আসে তখন প্রজাদের মধ্যে বিপুল সংক্ষোভ দেখা দেয়। দ্বিজগণ বেদপাঠে উৎসাহ হারান, যাগযজ্ঞ বন্ধ করে দেন। ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন বিপন্নতার সূত্র ধরে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রাদি অন্ত্যজরা উৎপন্ন হতে থাকেন। কলিযুগে ব্রাহ্মণদের সাথে সহজেই শূদ্রাদি অন্ত্যজদের শয়ন, আসন ও ভোজন সম্পর্ক স্থাপিত হয়, এমনকি তখন রাজাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন শূদ্র। এইসব রাজাদের মাধ্যমে পাষণ্ড ধর্মের প্রবর্তন ঘটে এবং প্রজাদের মধ্যে অবাধে ভূণহত্যা চলতে থাকে। শুধু তাই নয়, কলিযুগবাসী প্রজাগণ আরও নানারকম দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত হন। তাঁদের আয়ু, মেধা, বল, রূপ ও কুল পরিত্যক্ত হয়। বিভিন্ন বর্ণের মানুষ পরস্পরের আচার বিচার সাদরে গ্রহণ করে। শূদ্রকে ব্রাহ্মণদের এবং ব্রাহ্মণকে শূদ্রদের আচরণীয় ধর্ম পালন করতে দেখা যায়। যুগান্ত সমুপস্থিত হলে চোরেরা রাজকার্য করতে থাকে, রাজারা চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করেন, ভৃত্যদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য বিনষ্ট হয়। স্ত্রীলোকদের মধ্যেও লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে। তারা ব্রত আচারহীন ও কপট হয়ে ওঠেন। তারা হয়ে ওঠেন মদ ও আমিষপ্রিয়। কলিযুগে হিংস্র বন্য জন্তুদের স্বভাবেও দেখা দেয় পরিবর্তন।
তারা প্রবল হয়ে ওঠে। গোরুদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কলিযুগে সাধু ব্যক্তির অভাব এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে ভোগীদের কাছে সূক্ষ্ম মহাফল বস্তু দুর্লভ হয়। এদিকে চতুরাশ্রম প্রথার শৈথিল্য হেতু ধর্ম একপ্রকার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে যুগান্তকাল ঘনিয়ে এলে মহীয়সী ভূমিদেবী অল্পফল প্রসব শুরু করেন এবং শূদ্ররা তপস্যায় নিমগ্ন হন। ধর্মের এই যে ক্রম-অবনিত সংখ্যার হিসেবেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সত্যযুগে এক বৎসরের সামান্য বেশি, ত্রেতা যুগে এক বৎসর, দ্বাপর যুগে এক মাস, আর কলিযুগে ধর্ম মাত্র এক দিন স্থায়ী হয়েছিল।
কলিযুগের সব ক্ষেত্রেই অধঃপতন লক্ষ্য করা যায়। রাজারা প্রজাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হন, কিন্তু গ্রহণ চলতে থাকে। সেই যুগান্তকালে অক্ষত্রিয়রা রাজাসনে বসেন, বৈশ্যরা শূদ্রদের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন আর দ্বিজগণ শূদ্রদের অভিবাদন করেন। ফলে দেখা যায়, রাজারা নিজেদের রক্ষা করতে ব্যস্ত। দেশে ও জনপদে সমূহ অশান্তি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। যাঁরা রক্ষক তারা রক্ষকের কাজ না করায় পৃথিবী শাসনবিহীন হয়ে পড়ে। এই কলিযুগে পৃথিবীপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পর্যন্যদেব বিচিত্রবর্ষী হয়ে পড়েন। বর্ষণ করা বা না করা সম্পূর্ণত তার ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ে। বসুমতী নরশূন্য ও শব্দশূন্য হয়। বসুন্ধরা হয় অল্পসম্পন্না ও অল্পফল। এই আদমযুগে সমস্ত বর্ণের মানুষ অর্থের লোভে বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। তারা বহুলভাবে মিথ্যাচার করে পণ্য বিক্রয় শুরু করেন। কুশীল, পাষণ্ড ও বৃথাচিহ্নধারী মানুষে পৃথিবী ভরে যায়। পুরুষদের সংখ্যা হ্রাস পায় এবং অধিক হারে স্ত্রীলোক জন্মাতে থাকেন। পরস্পর যাচকের সংখ্যা বাড়ে। বহু লোক মাংসাশী, ক্রস্বভাবী, সারল্যশূন্য ও অসুয়াপরবশ হয়ে পড়েন, এই সময়ে লোকসংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় অন্যায়ের প্রতিকার অসম্ভব হয়ে পড়ে। এবং পতিতজনের প্রতি কোনোরূপ শঙ্কা থাকে না। এইসব হল প্রকৃত অর্থে যুগান্তকালের লক্ষণ।
এই কলিযুগে অধর্মের ফলে মানুষের মধ্যে কিছু নীচ প্রবৃত্তি দেখা দেয়। মানুষ পরধনহরী পরদারধর্ষী, কামুক, দুরাত্মা ও দুঃসাহসপ্রিয় হয়ে ওঠে, তার মধ্যে জ্ঞানহীনতা প্রকাশ পায়। পুরুষ হয় মুক্তকেশ ও দুর্বল। ষোলো বৎসর অতিক্রম করার আগেই মানুষের মৃত্যু ঘটতে থাকে। কলিযুগে শূদ্রদের ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। শুক্লদন্ত, জিতেন্দ্রিয়, মুণ্ডিত মস্তক, কাষায় বস্ত্র পরিহিত শূদ্ররা ধর্মাচরণ করতে থাকেন। বহু লোক শস্যচোর ও বস্ত্রচোর হয়ে ওঠেন। চোরেরা চোরের, অপহারকেরা অপহারকের ধন পর্যন্ত চুরি করতে থাকেন। জ্ঞান ও কর্মের পূর্ণ নিবৃত্তি ঘটে যায়। প্রত্যেকটি লোক ক্রিয়ানুষ্ঠান রহিত হলে কীট, মূষিক ও সর্প মানুষের বিনাশক রূপে দেখা দেয়। সুভিক্ষ, সুমঙ্গল, আরোগ্য ও সামর্থ্য ক্রমশ দুর্লভ হয়ে ওঠে। পেচকেরা ক্ষুধাতুরা দেশে বাস করতে বাধ্য হয়।
কলিযুগে দুস্পরিপ্লত মানুষের আয়ুষ্কাল লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পায়। বেদসমূহ প্রায়ই দুর্লভ হয়ে ওঠে। যজ্ঞ অধর্মপীড়িত হয়ে উৎপন্ন হয়। কষায় বস্ত্রপরিহিত গ্রন্থবিহীন শূভ্র কাঁপালিকেরা প্রবল হয়ে ওঠেন। এছাড়া কেউ বেদ বিক্রয় করেন, কেউ তীর্থ বিক্রয় করেন, কেউ আবার হয়ে ওঠেন বর্ণাশ্রমপরিপন্থী পাষণ্ড। কলিযুগ সূচিত হবার সময় থেকেই বেদ অধ্যয়ন ক্রমশ কমে আসে। ধর্মার্থ বিষয়ে শূদ্ররাই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ধর্ম ভিন্ন রাজপদে শূদ্রদের একাধিপত্য ঘটে। তারা অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন বন্ধ করে দেন। স্ত্রী বধ ও গোবধ করে প্রজারা নিজেদের অভীষ্ট পূরণ করতে থাকেন। ভূণহত্যাও অধরা থাকে না। দেশে রোগ, মোহ, গ্লানি, অসুখ ও তমোগুণ পরিপূর্ণ হয়। আয়-বল-রূপাদি–সবদিক দিয়েই কলিকাল হীন হয়ে পড়ে।
যুগান্তকালের এই হীনাবস্থার মধ্যে কিছু কিছু ধার্মিক দ্বিজ ধর্মাচরণে ব্রতী থাকেন। মানুষের পক্ষে সিদ্ধিলাভ সহজ হয়ে ওঠে। এই সময়ে যে ব্যক্তি অসূয়াবিহীনভাবে স্মৃতি ও শ্রুতি অনুসারে কর্মানুষ্ঠান করতে সমর্থ হতেন, তিনিই শীঘ্রই সিদ্ধিলাভ করতেন। তাই ত্রেতা যেখানে যুগে এক বৎসর, দ্বাপরে এক মাস সেখানে কলি কালে মাত্র একদিন যথাশক্তি ধর্মাচরণ করলেই সিদ্ধলাভ সম্ভব হয়। সংক্ষিপ্তাকারে এই হল কলিযুগের অবস্থা। এখন আমি সন্ধ্যাংশ কালের বিবরণ দেব, শুনুন।
যুগে যুগে সিদ্ধি সমূহের তিন তিন পদের হানি ঘটে। এইসব সন্ধ্যা স্বভাবতই পাদমাত্র থাকে এবং সন্ধ্যা স্বভাববশত সব সন্ধ্যাংশ পাদ অনুসারে বর্তমান থাকে। এই কালে যুগান্তকালে সন্ধ্যাংশের কাল উপস্থিত হলে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে প্রমিতি নামে এক রাজা মাধবের অংশে জন্ম নেন। এই রাজা চন্দ্রের গোত্রানুসারী। অসাধুদের শাসক এবং ভৃগুবংশীয়দের নিধনের কারণ রূপে তার আবির্ভাব। তিনি দীর্ঘ কুড়ি বৎসর ধরে পৃথিবী পর্যটনের পর যে সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেছিলেন তাতে হস্তী, অশ্ব ইত্যাদির বিশাল সমাবেশ ছিল। এরপর তিনি অস্ত্রধারী শতসহস্র বিপ্রদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে পৃথিবীকে ম্লেচ্ছমুক্ত করলেন।
সর্বত্রগতি সম্পন্ন ও প্রভাবশালী সেই রাজা প্রমিতি সমুদয় শূদ্রযোনিজাত পাষণ্ড রাজাদের নিঃশেষ করলেন। অত্যধিক ধর্মশালী নন এমন সমস্ত শূদ্রযোনিজাত পাষণ্ড রাজা তিনি হত্যা করলেন। পৃথিবী থেকে অধর্ম অসুখ অসূয়া গ্লানি নাশ করার পর সর্বপ্রাণীর অজেয় হয়ে রাজা প্রমিতি পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন। পৃথিবী ভ্রমণের সময়েও তিনি পৃথিবীকে রক্ষা করার কাজে অব্যাহতি দেন নি। উত্তর দিক পার্বতীয় মধ্য পূর্ব ও পশ্চিম দিক, বিন্ধ্য পর্বতের পশ্চিমদিক, দাক্ষিণাত্য, দ্রাবিড়, সিংহল গান্ধার এবং পারদ দেশের মানুষদের তিনি হত্যা করেছিলেন। এছাড়া প্রহ্নব, যবন, তুষার, বর্বর, চীন, শুলিক, দরদ, লম্বাক, মস, কেত, কিরাত, এবং অন্যান্য বহু স্লেচ্ছ জাতির তিনি বিনাশ ঘটান। রাজা প্রমিতি ছিলেন পূর্বজন্মবিধাজ্ঞ, বীর্যবান এবং বিজ্ঞ। জন্মগ্রহণের পর বত্রিশ বছর অতীত হলে তিনি এই বিনাশযজ্ঞ শুরু করেন। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে সহস্র সহস্র দুবৃত্ত মানুষ ও অধর্মী মানুষদের হত্যা করেন। এইভাবে উগ্র কর্ম দ্বারা এই পৃথিবীতে তিনি নিজের বীর্য মাত্র অবশিষ্ট রেখেছিলেন। তিনি প্রায়শই আকস্মিক কোপবশত অধার্মিক শুদ্রদের বিনাশ করতেন এবং অনুগামীদের সাথে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যস্থানে অবস্থান করতেন। সমস্ত ম্লেচ্ছ রাজা ও স্বেচ্ছাচারী ম্লেচ্ছদের বিনাশ করার পর সেই সত্য সৈনিক রাজা যখন বিগত হলেন, তখন যুগান্তকালে সন্ধ্যাংশ কাল উপস্থিত হলে কোথাও অল্প কিছুসংখ্যক ম্লেচ্ছ প্রজা অবশিষ্ট রইলেন।
কালক্রমে এইসব অবশিষ্ট প্রজারা দুর্দমনীয় হয়ে উঠলেন। এঁরা দলে দলে নিন্দিত আচারের বশবর্তী হয়ে পরস্পরের হত্যানেশায় মেতে উঠলেন। শেষে যুগবশে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হলে সেই সমস্ত প্রজারাও ভয়কাতর হয়ে পড়লেন। তারা যুদ্ধ করতে করতে পরিশ্রান্ত ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ব্যাকুল হয়ে গৃহিণী ও গৃহস্থান দুটোই ত্যাগ করলেন। তারা নিজের নিজের প্রাণ রক্ষার বিষয়ে তৎপর হয়ে গৃহপরিবেশ পরিত্যাগ করে দুঃখের সাথে কালযাপন করতে লাগলেন। এভাবে যুগান্তকালে বৈদিক ধর্ম ও সমাতন ধর্ম দুটোই পারস্পরিক আঘাতে নষ্ট হবার উপক্রম হলে প্রজারা আরও বেশি মর্যাদাহীন, অভিমানহীন, স্নেহশূন্য ও লজ্জাবোধহীন হয়ে পড়লেন।
তাদের সুস্থ বুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেল। তারা মাত্র পঁচিশ বৎসর আয়ুর অধিকারী হয়ে রইলেন। ইন্দ্রিয় বিষাদ তাঁদের তীব্র ভাবে অধিকার করল। এরই মাঝে বসুধাতলে দেখা দিল অনাবৃষ্টি প্রজাগণ দুঃখিত মনে অর্থাদি উপার্জনের চিন্তা পরিহার করলেন। গৃহছাড়া প্রজারা এবার নিজের নিজের উৎপাদনটিকেও পরিত্যাগ করলেন এবং জনপদের প্রান্ত সীমায় গিয়ে বসবাস করতে থাকলেন। তারা নদী, সাগর, কুপ ও পর্বতে গিয়ে ফলমুল, মধু, মাংস ইত্যাদি সংগ্রহ করে অতীব দুঃখের সঙ্গে জীবনধারণ করতে লাগলেন। দারা ও পুত্রহীন অবস্থায় জীর্ণবস্ত্র পরিহিত এইসব ভীত দুঃখী প্রজারা বর্ণাশ্রমধন ভ্রষ্ট হয়ে ভয়াবহ এক সংকর জাতির সৃষ্টি করলেন।
এতদ্বারা এইসব অল্পাবিশিষ্ট প্রজারা কষ্টের চরম পরাকণ্ঠায় এলেন। তারা জরা, ব্যাধি ও ক্ষুধাকাতর হয়ে পীড়িত অবস্থায় দুঃখ ভারে নির্বেদ লাভ করলেন। এই নির্বেদ থেকে বিচার, বিচার থেকে সাম্যাবস্থা, সাম্যাবস্থা থেকে সম্বোধ এবং সম্বোধ থেকে ধর্মশীলতা ফিরে এল। সুতরাং কলিযুগে অবসান কালে এইসব অল্পবিশিষ্ট প্রজারা বিচারবুদ্ধি লাভ করলেন। তখন অহোরাত্র ও যুগের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ল। ভবিষ্যৎ বিষয়ে বলবত্তা হেতু তাদের চিত্তে সম্মোহন ঘটিয়ে সপ্তম সত্যযুগ এল।
সত্যযুগের সূচনা হলে কলিযুগের অল্প অবশিষ্ট প্রজারা পূর্বেকার সত্যযুগে উৎপন্ন প্রজাদের মতো হলেন। সেই পূর্ব সত্যযুগে যে সিদ্ধ সম্প্রদায় ছিলেন দেখা গেল সপ্তম সত্যযুগের প্রজারাও তেমন আচরণ করছেন। সেই সময় সেইসব সপ্তর্ষিগণও অবস্থান লাভ করলেন। সত্যযুগের বীজের জন্য যেসব ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রবর্ণজাত মানুষ অবশিষ্ট ছিলেন, কলিকালে উৎপন্ন মানুষদের সাথে তাদের কোনোরকম পার্থক্য রইল না। সপ্তর্ষিগণ এই সকল সুব্রত মানুষদের উদ্দেশে ধর্মোপদেশ বিতরণ করলেন। বৈদিক ও স্মাৰ্ত্ত ধর্মানুসারে বর্ণাশ্রমের আচরণ সম্পন্ন ধর্মও দুই ভাগে বিভক্ত হল। এইভাবে কুত যুগের প্রজারা ক্রিয়াবান হলেন এবং সপ্তর্ষিগণ দ্বারা প্রদর্শিত বৈদিক ও স্মাৰ্ত্ত ধর্ম প্রবর্তিত হল।
প্রজাদের মধ্যে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য এই সপ্তর্ষিমণ্ডল মন্বন্তর অধিকারে যুগক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকলেন। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, প্রখর গ্রীষ্মকালে তৃণসমূহ দাবদগ্ধ হয়ে গেলেও তাদের মূলে যেমন নূতন অঙ্কুরোদগম দেখা যায়, সেই রকম ভাবে একটি যুগ নষ্ট হয়ে গেলেও তা থেকে অপর একটি যুগের উৎপত্তি হয়ে থাকে এবং এই যুগধারা একটি মন্বন্তরের ক্ষয় পর্যন্ত চলতে থাকে। সুখ, আয়ু, বল, রূপ, ধর্ম-অধর্ম, কাম প্রভৃতি যুগপদক্রমে ক্ষীণ হয়ে যায়। যুগ সমূহের সমস্ত ধর্ম সিদ্ধির যুগ–সন্ধ্যাংশকালের সাথে যুগে যুগে ক্ষীণ হয়ে যায়।
হে দ্বিজগণ, এতক্ষণ আমি আপনাদের কাছে প্রতিসন্ধি বিষয়ে বললাম! এবার আমি অনুষঙ্গপাদের বিষয়ে বিস্তারিত বলব, আপনারা শ্রবণ করুন।
সমস্ত যুগেই পূর্বোল্লিখিত ভাবে ক্রিয়া ও ধর্মাদিকর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে। এইসব চতুর্যগ পর্যন্ত হয়ে থাকে। একেই ব্রহ্মার দিবাকাল বলা হয়ে থাকে। ব্রহ্মার রাত্রিও সেই পরিমাণে হয়। ব্রহ্মার যুগক্ষয় না আসা পর্যন্ত জীবদের সরলতা ও জড়তা অক্ষুণ্ণ থাকে। সমস্ত যুগের এটাই হল স্বাভাবিক লক্ষণ। এইভাবে চতুর্থযুগের যে গণনা তা সত্তর সংখ্যক হয়। এরকম একটি সত্তর সংখ্যক যুগ পরিবর্তিত হলেই তাকে এক মন্বন্তর বলা হয়। এই যে নিয়ম প্রতি চতুর্যগেই তেমনটি হয়ে থাকে এবং সেই ক্রমে অপর যুগেও হয়ে থাকে।
প্রতি সৃষ্টিতে মন্বন্তর সমূহের ভেদ হয়। তার পরিমাণ পঞ্চবিংশতি। এর কোনো ন্যূনতা বা আধিক্য হয় না। কল্পযুগের সাথে এদের লক্ষণ সমান। সমস্ত মন্বন্তরের ক্ষেত্রে এই-ই হল সাধারণ লক্ষণ। চিরকাল যুগের ভাবনানুসারেই যুগের পরিবর্তন সাধিত হয়ে এসেছে। আর জন্ম ও মৃত্যুর দ্বারা। জীবলোকের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই পরিবর্তিত অবস্থা সমূহ কখোনই চিরস্থায়ী হয় না। সমস্ত মন্বন্তরে দৃষ্ট অতীত ও অনাগত যুগসমূহের এই লক্ষণগুলির বিষয়ে আমি যা বললাম তা থেকে আপনারা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠুন।
আশা করি, প্রাজ্ঞজন মাত্রেই অতীত ও অনাগত সমস্ত মন্বন্তরেই এই ধরনের লক্ষণ দেখে বুঝে নেবেন। এক মন্বন্তরের ক্ষেত্রে যেমন লক্ষণাদির কথা বললাম, কল্পে কল্পে সকল মন্বন্তরেই তেমন লক্ষণ দেখা দেবে বলে জানবেন। তবে এই মন্বন্তরের সমস্ত অভিমানীরা নাম ও রূপের দ্বারা ভিন্নি ভিন্ন হবেন। ক্রমান্বয়ে আটজন দেবতা এইসব মন্বন্তরগুলির অধীশ্বর হয়ে থাকেন। মন্বন্তর কালে আর্বিভূত ঋষিগণ ও মনুগণের প্রয়োজন পরস্পরতুল্য। এই ভাগে যুগের পর যুগ ধরে বর্ণাশ্রম বিভাগ অপরিবর্তিত হয়ে গেছে। প্রভাবশালী লোকপিতামহ ভগবান ব্রাহ্ম যুগ স্বভাবানুসারে বর্ণাশ্রম ও যুগবিধান করে যাবেন।
অনুষাঙ্গপাদের কথা এখানেই শেষ হল এখন আমি সৃষ্টিসর্গ বিষয়ে বলব। এই পর্যায়ে সমস্ত যুগের বিস্তৃতিরূপে সমস্তই আনুপূর্বিক বর্ণনা করব।
.
৫৪.
পুরাণজ্ঞ সূত বলতে লাগলেন, কোন্ যুগে কোন্ কোন্ গো-রাক্ষস অসুর সর্প পক্ষী যক্ষাদি প্রজা জন্মগ্রহণ করবে এবং সেই নির্দিষ্ট যুগকালে তাদের আয়ুষ্কাল হবে, এবার সেই বিষয়ে বিস্তারিত বলছি, শ্রবণ করুন।
বিভিন্ন যুগের নিজস্ব ধর্মানুসারে সমস্ত স্থাবর পদার্থের সাথে মনুষ্য পশু ও পক্ষীকুলের আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কলিযুগে প্রাণীদের আয়ুষ্কালে অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ ভাবে যুগনির্বিশেষে মানুষের আয়ু শতবর্ষ নির্ধারিত করা হয়েছে। আর পিশাচ, অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও সরীসৃপরা এক যুগ পর্যন্ত জীবিত থাকে। কেউ বধ না করলে এদের মৃত্যু হয় না। শুধু জীবনসীমাই নয় প্রাণীদের দেহ পরিমাণও যুগ অনুযায়ী বর্ধিত বা হ্রাসমান হয়।
দেখা গেছে দেবাসুরদের দেহ পরিমাণ একশো আটান্ন আঙুল। এই পরিমাণের সঙ্গে তুলনা করলে মানুষের দেহ পরিমাণ সাতান্ন আঙুল হ্রস্ব হয়। দেবাসুরদের উচ্চতার পরিমাণ মানুষের উচ্চতার পরিমাণের তুলনায় চুরাশি আঙুল বেশি হয়। এই যে আপাদমস্তক পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় তা নিজের নিজের আঙুলের পরিমাণ অনুসারে করতে হয়। মানুষের এই যে দেহ পরিমাণ এটাও কিন্তু যুগান্তকালে হ্রস্ব হয়ে আসে।
অতীত ও অনাগত সব যুগেই মানুষের দেহ নিজের আঙুলের পরিমাণ অনুসারে অষ্টতাল হয়। যে মানুষের দেহ আপাদমস্তক নবতলে পরিমিত, দুই বাহু আজানুলম্বিত ও সুদৃঢ়, সেই ব্যক্তি ঈশ্বরেরও পূজ্য। শুধু মানুষ নয়, গে, অশ্ব, অজ, মহিষ, গত ও স্থাবর পদার্থসমূহের ক্ষেত্রেও দেহপরিমাণ ও উচ্চতার যুগে যুগে হ্রাস অথবা বৃদ্ধি ঘটে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক যে পরিমাণ সুচি পাওয়া যায় তা হল পশুদের ককুদ ছিয়াত্তর আঙুল, হস্তীদের পরিমাণ একশত আট আঙুল, অশ্ব ও বানরদের উচ্চতা পঞ্চাশ আঙুল পরিমাণ।
যদি তত্ত্বদৃষ্টিতে বিচার করা হয়, তাহলে মানুষের শরীর সন্নিবেশ যেরকম, দেবতাদেরও অনুরূপ শরীর সন্নিবেশ দেখা যায়। তবে দেবতাদের শরীরে অতি বুদ্ধি তুলনায় মানুষের অল্প বুদ্ধি থাকে। মানুষ বা দেবতার বাইরে অন্যান্য যুগপ্রাণী যেমন; পশু, পক্ষী ও স্থাবরদের বিষয়েও আপনারা জানতে চাইবেন নিশ্চয়ই। তবে জেনে রাখুন, গরু, হস্তী, অশ্ব, মহিষ, অজ, পক্ষী ও বৃক্ষসমূহ সকল প্রকার যজ্ঞীয় কার্যকলাপের উপযুক্ত। এরা জীবনান্তে স্বর্গে গিয়েও সেই সেই পূর্বশরীর লাভ করে আর তাকে যথেচ্ছভাবে উপভোগ করে। এরা স্বর্গে গিয়ে দেবতাদের মতো শুভ মূর্তি ধারণ করে থাকে। তাদের মতো কৃতী ব্যক্তিরাও সেই সেই রূপের ও সেই সেই পরিমাণের মনোজ্ঞ স্থাবর ও জঙ্গমাবস্থা লাভ করে।
এবার যাঁরা শিষ্ট, সৎ ও সাধু প্রকৃতির, তাঁদের কথা বলব।
ব্রহ্মার আরেক নাম হল সৎ। যাঁরা তাঁর মতো স্বভাব, ব্রহ্মার তারা তারা সাযুজ্য লাভ করে থাকেন। এইজন্য তাদেরকেও ‘সৎ’ বলে অভিহিত করা হয়। যাঁরা দশপ্রকার ভোগে ও আটপ্রকার কারণে ক্রুদ্ধ হন না, সতত হৃষ্ট থাকেন, তাদের বিজিতাজ্ঞা বলা হয় ধর্ম-বর্ণতর বাইরে এগুলিকে মানুষের সাধারণ গুণ বলে জানবেন।
এই পৃথিবীতে ব্রহ্মা কর্তৃক বিভাজিত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নামে তিনটি প্রধান জাতি আছে। এঁরা সবসময় সামান্য ধর্ম অথবা বিশেষ ধর্মে নিরত থাকেন বলে এঁদের ‘দ্বিজাতি’ বলা হয়। দ্বিজাতি মাত্রই বর্ণাশ্রমে যুক্ত থাকা এবং শ্রৌত ও স্মার্ত ধর্মের জ্ঞান থাকা আবশ্যক। দ্বিজাতিভুক্ত যে কেউ সাধু হতে পারেন। চতুরাশ্রমের যে কোনো পর্যায়েই তা হওয়া সম্ভব। যেমন–যদি কেউ বিদ্যার সাধন করেন, তিনি হবেন বিদ্বান সাধু। যদি কেউ গুরুর হিতসাধন করেন, তাহলে তিনি হবেন ব্রহ্মচারী সাধু। আবার গৃহে থেকেও যদি কেউ নিষ্ঠাভরে ধর্মাদি ক্রিয়া পালন করেন, তাহলে তিনি হবেন গৃহস্থ সাধু। সর্বোপরি কেউ যদি যোগসাধনে সচেষ্ট হন তবে তিনিও সাধু বলেই পরিচিত হবেন। আবার অরণ্যের নির্জনে তপঃ সাধনের রত বৈখানসত্ত সাধু নামের যোগ্য। এইভাবে নিজের নিজের আশ্রম ধর্ম পালন করার মধ্যে দিয়ে গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থ গমনকারী ও ভিক্ষুক অবধি সাধু নামে অভিহিত হতে পারেন।
এই মর্ত্যলোকে ধর্ম ও অধর্ম নামে শব্দ দুই কার্যানুসারেই প্রযুক্ত হয়ে থাকে। প্রধানত কুশল ও অকুশল কর্মই ধর্ম ও অধর্ম নামে পরিবেশিত হয়ে থাকে। ধৃতি অর্থযুক্ত ধাতু থেকে ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। যাঁরা বয়োবৃদ্ধ, নির্লোভ, আত্মসংযমী, অদাম্ভিক, অতি বিনীত ও সরল এই লোকে তারাই আচার্য পদবাচ্য হয়ে যাবেন, এঁরা নিজেরা যা যা আচরণ করেন তা-ই স্থাপন করেন। এঁরা যম ও নিয়মে যুক্ত থেকে শাস্ত্রাৰ্থ চয়ন করেন। এঁদের উপদেশ মতো যা অভীষ্ট দ্রব্যার্থকে লাভ করায় তা-ই হল ধর্ম। অন্যদিকে কারো আচরণে উল্লিখিত ধারণা ও মহত্বের অভাব ঘটলে তাকে অধর্ম আচরণ বলা হয়। দেবগণ, পিতৃগণ, মুনিগণ এবং সংযমাত্মা মানবগণ অভেদ দর্শন করে থাকেন বলে কোনো বিষয়েই এটি ধর্ম বা এটি অধর্ম বলে মত প্রকাশ করেন না। ধর্ম দুই প্রকার শ্ৰেীত ধর্ম ও স্মার্ত ধর্ম।
পূর্বাচার্যদের কাছে থেকে জ্ঞান লাভ করে সপ্তর্ষিগণ সেই অনুসারে শ্রৌত ধর্ম সম্বন্বিত উপদেশ দিয়ে থাকেন। ঋক্ সাম্, যজু, সংহিতা, ব্রাহ্মণ এবং বেদাঙ্গসমূহ থেকে অতীত মন্বন্তরের আচার বিচার স্মরণ করে সপ্তর্ষিগণ এগুলোকেও প্রকাশ করে গেছেন। এই কারণে বর্ণাশ্রম থেকে উৎপন্ন ধর্মকে স্মার্ত ধর্ম বলে। এবার আমি শিষ্টাচার বিষয়ে সংক্ষেপে আপনাদের কাছে কিছু তত্ত্ব প্রদান করব।
শেষ শব্দ থেকে শিষ্ট শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। এই কারণে ‘শেষ আচার’-কে শিষ্টাচার বলা হয়ে থাকে। মন্বন্তরগুলিতে যেসব শিষ্ট ধার্মিকগণ থাকেন, যেমন শিষ্ট মনু এবং সপ্তর্ষিগণ। এঁরা লোকের বিস্তার কল্পে ধর্মের সম্যক আচরণ করে থাকেন। এজন্য তারা যেসব ধর্মতত্ত্ব যথাযথভাবে বলেন, সেসব শিষ্ট মন্ত্রাদির কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ এইসব শিষ্ট মনু ও সপ্তর্ষিগণ যুগে যুগে ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি, যজ্ঞ, বর্ণাশ্রমজনিত আচরণ বারবার করে থাকেন। যেহেতু শিষ্টাচারগুলি পূর্ব পূর্ব ঐতিহ্য অনুসারে চলে আসে, তাই পূর্বাচার্যদের দ্বারা আচরিত শিষ্টাচারকে শ্বাশ্বত বলে মনে করা হয়।
দান, সত্য, তপস্যা, অলোভ, বিদ্যা, যজ্ঞ, সন্তান উৎপাদন এবং দয়া–এই আটটি হল শিষ্টাচারের লক্ষণ। প্রত্যেক মন্বন্তরেই শিষ্ট মনুগণ ও সপ্তর্ষিদের দ্বারা এই ধর্মাচরণ পালিত হয় বলে সমস্ত মন্বন্তরেই এই ধর্ম শিষ্টাচার বলে প্রসিদ্ধি পায়। এগুলি শ্রবণ করা হয় বলে শ্রৌত ও স্মরণ করা হয় বলে স্মার্ত নাম নির্দিষ্ট হয়েছে। যাগযজ্ঞ ও বেদাত্মক আচরণ হল শ্ৰেীত আর বর্ণশ্রমাত্মক ধর্ম হল স্মার্ত।
এবার আমি প্রত্যক্ষ ও ধর্মের লক্ষণ বিষয়ে আপনাদের বলব।
প্রচুর অর্থশালী হওয়া সত্ত্বেও যিনি জিজ্ঞাসিত হলে বিষয় কোপন করেন না, উপরন্তু যথাযথ বর্ণনা দেন তার সকল কথা সত্য। তপস্যার মূল শর্ত ব্রহ্মচর্য। জপ, মৌন ও অনাহার। যিনি এই সমস্ত আচরণ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন তিনিই প্রকৃত তপস্বী, কিন্তু মনে রাখবেন, এগুলি যথার্থভাবে পালন করা অতি-ভয়াবহ ও ক্লেশসাধ্য। পশু, দ্রব্য, হবিঃ, ঋক, সাম, যজুঃ ঋতিকও এসবের একত্র সংযোগ হল যোগ। সর্বভূতে আত্মদৃষ্টি হিতাহিত ব্যতিরেকে সকলকেই সমদৃষ্টিতে দেখাকে দয়া বলা হয়।
কেউ আপনার প্রতি আক্রোশ প্রদর্শন করলেও তার প্রতি আক্রোশ না করা কেউ আঘাত করলেও তাকে পাল্টা আঘাত না করা এবং বাক্য-মনু-কর্ম দ্বারা সর্বান্তকরণে ক্ষমা করার যে গুণ তাকেই তিতিক্ষা বলা হয়।
ধনস্বামী যে ধন রক্ষা করতে না পেরে পরিত্যাগ করছেন, কিংবা যে ধন মালিকানাহীন ভাবে মাটিতে পড়ে আছে–সেইসব পরধন পর্যন্ত গ্রহণ না-করার নাম হল অলোভ। মৈথুন আচরণ, দর্শনচিন্তা এমনকি কল্পনা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার নাম ব্রহ্মচর্য। যিনি এই নিবৃত্তি সার্থকভাবে পালন করেন, তিনিই ব্রহ্মচারী। ব্রহ্মচর্য যখন নির্দোষ হয় তখনই তাকে ‘দম’ বলা হয়।
নিজের জন্যই হোক অথবা পরের জন্যই হোক অকারণে ইন্দ্রিয়ে প্রবৃত্তি না হওয়াই হল শমের লক্ষণ।
যিনি দশ প্রকারের ভোগ্য পদার্থে এবং আট প্রকারের কারণে প্রতিহত হয়েও ক্রুদ্ধ হন না, তাঁকে জিতাত্মা বা বিজিতাত্মা বলা হয়।
নিজের যা যা কিছু ইষ্টতম বস্তু এবং যে যে বস্তু ন্যায্যত সৎপথে উপার্জিত হয়েছে সেইসব আকাঙিক্ষত বস্তুসম্ভার বিনা দ্বিধায় গুণবান পাত্রে দান করাই হল মহান দানের লক্ষণ, এই দান জ্যেষ্ঠ, মধ্যম, কনিষ্ঠ–এই তিনভাগে ভাগ করা হয়। যে দান নিঃস্বার্থ নিশ্চিত মঙ্গলকর তা জেষ্ঠ্য দান। যে দান করুণাবশত সম্পর্কিত প্রাণী ও বন্ধুদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় তা মধ্যম দান। আর সম্পর্নভাবে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যে দান তা হল অধম দান। এই দানকে কনিষ্ঠ দানও বলে। শ্রুতি ও স্মৃতি
অনুমোদিত যে বর্ণাশ্রম ধর্ম এবং শিষ্টাচারের দ্বারা অবরুদ্ধ যে কার্যাবলি তাই-ই হল ধর্ম। কেবলমাত্র সৎ ও সাধু ব্যক্তির সঙ্গে সংসর্গের মাধ্যমেই ধর্ম সুষ্ঠভাবে পালিত হতে পারে।
প্রীতি পরিতাপ ও বিষাদ থেকে নিবৃত্তি লাভ করলেই জীবনে বৈরাগ্য আসে। ইষ্ট পরম ইঙ্গিত নয়, এমন বস্তুতেও যখন বিরক্তি উৎপাদন হবে না আবার ইষ্ট বহু লাভ করেও যখন আনন্দ হবে না তখন চিত্তে বৈরাগ্য জন্মেছে বলে জানতে হবে।
অকৃতকর্মের সঙ্গে সঙ্গে কৃতকর্মের সমর্পণ এবং কুশল-অকুশল সকল প্রকার কর্মের পরিত্যাগ ত্যাগ বলে বিবেচিত হয়।
যে-কোনো বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপত্তি হল জ্ঞান। এই অচেতন জগতে অব্যক্ত অবিশেষের বিকার এবং চেতন থেকে অচেতনের পৃথকীকরণ এই ধরনের বিশেষ জ্ঞান।
পূর্ব পূর্ব স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে ধর্মতত্ত্ব প্রাজ্ঞ ঋষিরা ধর্মের এইসব প্রত্যক্ষের লক্ষণ নিরূপণ করেছেন, এবার আমি বর্তমান মন্বন্তরের পারস্পরিক বর্ণ ও চতুর্বর্ণের বিধি বিষয়ে আপনাদের কাছে ব্যাখ্যা দেব। যেহেতু প্রতি মন্বন্তরেই শ্রুতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, তাই এই আলোচনার বিশেষ প্রয়োজন আছে।
ঋক, সাম যজুঃ–এই তিনটি বেদই প্রলয়কালে প্রতিটি দেবতার সাথে পরিবর্তিত হয়। কেবলমাত্র শতরুদ্রিয় পরিবর্তিত হয় না।
বিধি, হোত্র ও স্তোত্রও পূর্বের মতো মন্বন্তর ভেদে পরিবর্তিত হয়। দ্রব্যস্তোত্র, গুণস্তোত্র, কর্মস্ত্রোত্র ও অভিযোনিক এই চার প্রকারের স্তোত্র আছে। যে যে মন্বন্তরের যে যে দেবতা কর্তৃত্ববান হবেন তারাই এই চার প্রকার ব্রাহ্ম স্তোত্র নির্দিষ্টভাবে প্রবর্তিত করে দেন। এই একই ভাবে মন্ত্র ও গুণের উৎপত্তিও চার প্রকার হয়ে থাকে।
পূর্ব পূর্ব মন্বন্তরের মহাতেজাঃ ঋষিরা যখন উগ্র ও অতিদুশ্চর তপস্যা করেছিলেন, তখন অথর্ব এই তিনটি বেদে ওইসব ঋষিবৃন্দের পরিতোষ, সাম, যজুঃ, দুঃখ, ভয়ভীতি, সুখ, শোক প্রভৃতি থেকে পৃথক পৃথক মন্ত্রের আবির্ভাব ঘটেছিল।
ইচ্ছামতো দর্শন এবং সমগ্র জীবনব্যাপী যে তপস্যা করেন, তারই পুণ্যফলে ঋষিগণ ঋষিত্ব প্রাপ্ত হন। ঋষিত্ব-র লক্ষণ বিষয়ে এখন আমি আপনাদের সচেতন করব।
অতীত ও অনাগত কালসমূহের মধ্যে পাঁচ শ্রেণীর ঋষি আছেন। এখন আমি সেইসব ঋষিদের কথা বলব। আর কীভাবে তাদের উৎপত্তি হয়েছে সেই সম্বন্ধেও বলব।
গুণসাম্যাবস্থায় যখন প্রলয় শুরু হল তখন দেবতাদের ওপর অত্যাচার হতে থাকায় জগৎ তমোময় হয়ে পড়ে। তখন বুদ্ধি না থাকলেও চেতনার জন্য প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটত। সেই অবস্থায় বুদ্ধিলাভের পূর্বেই জগতে চেতনা অধিষ্ঠিত ছিল। জলে যেমন মাছ ও জল দুই-ই থাকে তেমনিভাবে চেতনের দ্বারা অধিষ্ঠিত হয়েই বুদ্ধিতত্ত্ব গুণরূপে প্রবর্তিত হয়।
তারপর থেকেই বিষয়ের বিষয়িত্ব হেতু, অর্থের অথিত্বহেতু ও কার্যের কারণত্বহেতু চেতন প্রবর্তিত হতে থাকে। প্রাপ্তব্য কালের সাহায্যে কারণাত্মক ভেদগুলি সিদ্ধ হতে থাকে। আর তখন থেকেই ক্রমে ক্রমে মহাদদি, ব্যক্ত হতে থাকে। এই মহৎ তত্ত্ব থেকে অহংকার, অহংকার থেকে ভূতপদার্থ এই ভাবে পরপর ক্রমানুসারে সৃষ্টি হতে থাকে কেন না কারণ সংসিদ্ধ হলে কার্য সাথে সাথে প্রবর্তিত হয়। জুলন্ত অঙ্গারের ঊর্ধ্বর্ভাগ স্থলিত হলে তা যেমন এককালে প্রবর্তিত হয়ে থাকে, সেই রকমভাবে ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষ এককালে ও এক ক্রিয়ায় প্রকাশিত হন।
অন্ধকার পরিবেশে জোনাকি পোকা যেমন হঠাৎ আলোর ঝলকানি নিয়ে আসে, সেই রকম জ্যোতিপ্ৰভা সহ অব্যক্ত থেকে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে।
পূর্ব পূর্ব অবস্থায় সেই মহান বিদ্বান সশরীরে যেখানে যেমনভাবে অবস্থান করছিলেন, সেখানে তেমন ভাবেই তিনি দ্বারশালার মুখে অবস্থান করলেন। এ সম্পর্কে শ্রুতিতে বলা হয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যবশতঃ সেই মহান বিদ্বান পুরুষ সেই তমের প্রান্তভাগেই অবস্থান করেন।
সেই বিবর্তমান থেকে জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য ও ধর্ম–এই চার প্রকার বুদ্ধির আবির্ভাব ঘটে।
সেই শরীরধারী মহৎ তত্ত্বের বিবর্তন থেকে সাংসিদ্ধিক ও সুপ্রতীক নামে সিদ্ধির উৎপত্তি ঘটে।
এই শরীর রূপ পুরীতে যিনি শয়ন করেন তার নাম পুরুষ (পুরী-শ) এবং ক্ষেত্ৰজ্ঞান সম্পন্ন বলে তার নাম হয়েছে ক্ষেত্ৰজ্ঞ। এই একই কারণে ক্ষেত্রজ্ঞ ভগবান ‘মতি’ নামে অভিহিত হন। বুদ্ধিপূর্বক শয়ন করেন বলে তাকে ‘বোধাত্মক’ও বলা হয়। সৃষ্টি সংসিদ্ধির জন্য ইনিই একাধারে ব্যক্ত, অব্যক্ত ও অচেতনরূপে পরিণত হয়েছেন।
ক্ষেত্ৰজ্ঞের দ্বারা ক্ষেত্রজ্ঞতা যখন সংগৃহীত হন, তখনই নিবৃত্তি উৎপন্ন হন। প্রাথমিক অবস্থায়। এই নিবৃত্তি বুদ্ধির বিষয় হয়ে থাকে। পরে এই বিষয় যখন ক্ষেত্ৰজ্ঞের দ্বারা পরিজ্ঞাত হয় তখন তা ভোগ্যা হয়ে থাকে।
গমনার্থক ঋষ ধাতু থেকে ঋষি শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। এঁরা বেদ অধ্যয়ন, সত্য ও তপস্যায় সতত নিযুক্ত থাকেন বলে ব্রহ্মা এঁদের ঋষি আখ্যা দিয়েছেন।
নিবৃত্তির সমান কালে ঋষি তার স্বয়ংবুদ্ধিবলে অব্যক্ত স্বরূপ হন, যেহেতু ঋষি পরমব্রহ্মকে লাভ করেন তাই তিনি পরম ঋিষি নামে খ্যাত হন।
গমনাথুক ‘ঋষ’ ধাতুর অর্থ আদি থেকে নিবৃত্তি এবং স্বয়ং উদ্ভূত। এই অর্থজনিত কারণেও আত্মার ঋষিত্ব আছে। কারণ ঈশ্বর স্বয়ং উদ্ভূত আর ব্রহ্মার মানসপুত্র তার মনু থেকে উদ্ভূত।
এই যে ঈশ্বর এবং ব্রহ্মপুত্র–এঁদের সম্মান কখনও নষ্ট হয় না। আবার যেহেতু এঁরা সর্বপ্রকার গুণযুক্ত হয়ে বুদ্ধির পরমতত্ত্বকে আত্মস্থ করেন, তাই এরা পরমর্ষি (পরম-ঋষি) বলে নিরূপিত হয়ে থাকেন।
ঋষিগণ সতত ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র, তারা সর্ববিধ অহংকার ও তমোগুণ পরিহার করে তবেই ঋষিত্ব প্রাপ্ত হন। তাই তাদের হৃদয় অন্তঃস্থল পর্যন্ত আনন্দরসের ধারা সদা প্রবহমান থাকে।
এই যে সদানন্দচিত্ত ঋষিবৃন্দ এঁরা ভূতাদির ভক্তবিষয়ক ঋষি বলে জগদ্বিখ্যাত। ঋষিদের মৈথুনজাত এবং ঋষিপত্নীদের গর্ভসস্তৃত বলে ঋষিপুত্ররা ‘ঋষিক’ নামে খ্যাত।
এই মহাতেজঃ দৃঢ়ঃব্রতা ঋষিগণ বাস্তবিক অর্থেই তন্মাত্র মাত্র ভোগ করে থাকেন বলে এঁরা কোনো মতে ‘সত্যর্ষি সতদানি’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকেন।
ঋষির পুত্ররা ঋষিপুত্রক বা ঋষিক নামে চিহ্নিত হন। তারা বিশেষভাবে এবং তত্ত্বগতভাবে শ্রুতি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন ও পরিদর্শন করেন বলে তাঁরা ‘তর্ষি’ নামেও আখ্যায়িত হন।
তর্ষি ঋষিপুত্রদের অব্যক্ততা, মহাত্মা, অহংকারাত্মা, ভূতাত্মা, ও ইন্দ্রিয়াত্মা বিষয়ে জ্ঞান আছে। নামোল্লেখ সহকারে সেই পাঁচ শ্রেণীর ঋষির কথা এখন আপনাদের কাছে বলব।
ভূগু, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, পুলহ, পুলস্থ্য, মনু, ক্রতু, দক্ষ–এঁরা দশজন হলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র। এঁরা প্রত্যেকেই স্বয়ংসস্তৃত এবং ঐশ্বর্যসম্পন্ন।
ঋষি থেকে মহান বোধের উন্মেষ ঘটে বলে এঁদের মহর্ষি বলা হয়। এই মহর্ষিরাও ঈশ্বরের মানসপুত্র। এবার এঁদের বিষয়ে এখন বলব।
শুক্র, বৃহস্পতি, বামদেব, কশ্যপ, উশনা, উতথ, অপোজ, ঐশিজ, কদম, বিশবা, শক্তি, বালখিল্য ও ধর–এদের ঋষি বলা হয়। কারণ এরা জ্ঞান লাভ করে ঋষিত্ব অর্জন করেছিলেন।
এবার ঋষিপত্নীদের গর্ভজাত ঋষিপুত্রদের বিষয়ে শ্রবণ করুন।
ভরদ্বাজ, অগস্ত্য, বৎসর, নগ্রহ, বৃহদুকথ, শরদ্বান, ঔসিজ, দীর্ঘতপা, শরদ্বত, বাজবা, সুবিত্ত, ঈশ্বর, সুবান্বেষপরায়ণ, দধীচি, শঙ্খমান ও রাজা বৈশ্রবন কেবলমাত্র সত্যের বলে ঋষিত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। মহাত্মা মহাতেজাঃ ঋষিবৃন্দ, ঋষিপুত্রগণ এবং এরকম আরও যাঁরা আছেন, তারা সকলেই মন্ত্রকর্তা। এবার এদের কথা শুনন।
মন্ত্রবাদী মহান ঋষিদের মধ্যে যাদের নাম বিশেষ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয় তারা হলেন–ভৃগু, পৃথ, কাব্য, প্রচেতা, দধীচি, নভঃ, আত্মবান, জমদগ্নি, ঔব, বিদ, সারস্বত, অষ্টিষেন, অকপ, বীতহব্য, সুমেধা, বৈন্য, দিবোদাস, প্রশ্বার, গৃত্তসমান প্রমুখ।
মহর্ষি অঙ্গিরসের তেত্রিশ জন পুত্র ছিলেন। তারা সকলেই ছিলেন মন্ত্রপ্রণেতা তাঁদের নামগুলি হল–অঙ্গিরা, গার্গ, শেনী, পুরুকুৎস, পৌরকুৎস, ঔশিজ, বৃহদুথ, মেধস, ভরদ্বাজ, বাঙ্কলি, অমৃত, . সংহতি, মান্ধাতা, অম্বরীষ, আহার্য, ঋষভ, কন্থ, অজমীঢ়বলি, পৃষাদ, বিরূপ, মুদগল, যুবনাশ্ব, এসদুস্য, দস্যুমান, উতথ, বাজশ্ৰবা, ভরদ্বাজ, আযাপ্য, সুবিত্ত, বামদেব, দীর্ঘতপা, কক্ষীবান প্রমুখ।
এবার কশ্যপপুত্রদের পরিচয় দেব।
কাশ্যপ, বৎসার, বিভ্রম, রৈভ্য, অসিত ও দেবল–এই ছয়জন ব্রহ্মবাদী ঋষি হলেন কশ্যপপুত্র। এঁরা মন্ত্র প্রণয়ণের অধিকারী।
অত্রিপুত্রদের মধ্যে মহর্ষি অত্রি, অর্চিসেন, শ্যামবান, নিষ্ঠুর, বলসূতক, ধীমান ও পূর্বাতিথি সকলেই প্রণম্য মন্ত্রপ্রণেতা।
এঁরা ছাড়া বশিষ্ঠ, শক্তি, পরাশর চতুর্থ ইন্দ্ৰপ্ৰমতি, পঞ্চ্য, ভরদ্বসু, ষষ্ঠ মৈতবরাবরুণ, সপ্তম কুন্তিন, অষ্টম, সুদ্যন্ন, নবম বৃহস্পতি ও দশম ভরদ্বাজ–এঁরা সকলেই মন্ত্রপ্রণেতা ও ব্রাহ্মণ সংকলক রূপে প্রসিদ্ধ।
এঁরা প্রত্যেকেই অজস্র মন্ত্রের কর্তা সকল প্রকার বিধর্মের ধ্বংসকারকও। এঁরা পরম ব্রহ্মের ও সমস্ত বেগ রাখার লক্ষণ প্রকাশ করেছেন।
‘হি’ ধাতু থেকে “ব্রহ্মা” শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। শব্দটি “মঙ্গলের হেতু”, অর্থের বোধক রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে শত্রুদের উত্থান যিনি রোধ করেন অর্থের ব্রহ্ম শব্দের প্রয়োগ করা যেতে পারে। অনেক সময় যা থেকে গতি ও কার্যের প্রাপ্তি ঘটে এমন কিছু বোঝাতেও ব্রহ্ম বা বেদ শব্দের অবতারণা হয়।
বাক্যের অর্থ অবধাবন করার নাম নির্বচন। যাতে বাক্য নিন্দিত হয়। তাকে আচার্যরা নিন্দা বলেন। প্রপূর্বক ‘শংস’ ধাতু থেকে প্রশংসা নামক পদটি নিষ্পন্ন হয়েছে। এর অর্থ ভাল গুণ প্রকাশ।
অনিশ্চয়তা অর্থাৎ যার সাহায্যে কোনো বিষয়ে স্থির প্রত্যয় জন্মাবে না, যা এরকম অথবা অন্যরকম হলেও হতে পারে তার নাম সংশয়।
যে নির্দেশ অনুসারে ‘এটি এই ভাবেই করতে হবে’ গোছের বার্তা প্রেরিত হয়, তার নাম বিধি।– এই বিধি অন্যের দ্বারা উক্ত হলে তাকে পরকৃতি বলে।
প্রাচীনকালেই যে উক্তি প্রচারিত হয়েছে তাকে ‘পুরাকল্প’ বলে। পুরাকালের অতীত ঘটনা বিবৃত করার জন্য পুরাকল্পের কল্পনা করা হয়। মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের মতো শুদ্ধ এবং বিস্তর নিগম থেকে অবধারণ করাকে ব্যবধারণ কল্পনা বলে। এটি যেমন এটিও তেমন, অথবা এটি তো আবার অপরটির মতো–এ ধরনের পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত ঐক্যানৈব্য সূচক যে উপদেশাবলি তা ‘দশম ব্রাহ্মণ’ নামে নির্দিষ্ট।
পূর্বে বধুগণ যে ব্রাহ্মণের লক্ষণ প্রকাশ করেছিলেন, পরে দ্বিজগণের দ্বারা যার ব্যাখ্যান প্রদান করা হয়, তারই নাম বৃত্তি।
বিধিনির্দিষ্ট কর্মেও মন্ত্রের কল্পনা মিশে আছে। ‘মন্ত্রণা’ করে এই অর্থে মন্ত্র এবং ‘ব্রহ্মাকে রক্ষা করে।‘ এই অর্থে ব্রাহ্মণ শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
সূত্রবিদগণ অল্পাক্ষর বিশিষ্ট সারবান, সততঃপ্রসারী, অচঞ্চল, এবং অনবদ্য নিয়মগুলিকে ‘সূত্র’ নামে অভিহিত করে থাকেন।
.
৫৫.
এই দীর্ঘ ভাষণ শোনার পর জ্ঞানলিঙ্গু সেইসব ঋষিগণ সূতকে বললেন–হে মহামতি, পূৰ্ব্ব কল্পে কী এমন কারণ দেখা গিয়েছিল যাতে বেদ পৃথক পৃথক ভাবে বিভক্ত হয়েছিল–অনুগ্রহ করে সেই বিষয়ে আপনি আমাদের কিছু কথা বলুন।
সূত প্রত্যুত্তরে বললেন–হে মহাভাগগণ, স্বায়ম্ভব মন্বন্তরে দ্বাপর যুগ অতিক্রান্ত হলে লোকপিতামহ ব্রহ্মা মনুকে এ বিষয়ে যা যা কিছু বলেছিলেন সে সবই আমি আপনাদের বলব।
হে তাত, জেনে রাখুন সকল দ্বিজাতিই যুগ পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে যথাক্রমে স্বল্পবীর্য হয়ে পড়েছেন। বীর্য, তেজ, বল, বাক্য ইত্যাদি কোনো কিছুই যুগদোষে বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পায়নি, এভাবে নষ্ট হতে হতে সত্যযুগের দশ সহস্র ভাগের মধ্যে এক ভাগ অংশ মাত্র অবশিষ্ট আছে। কিন্তু অচিরেই এসব বিনষ্ট হয়ে যাবে। অতএব অবিলম্বে বেদবিহিত কাজ আরম্ভ হাওয়া উচিত। বেদ যাতে বিধ্বংস না হয় তার ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ বেদ বিনষ্ট হলে তার সাথে সাথে যজ্ঞেরও বিনাশ ঘটবে। আর যদি যজ্ঞের বিনাশ হয়, তাতে দেবতাদেরও বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। ফলত সৃষ্টির সব কিছুরই বিনাশ ঘটবে।
প্রথমে চতুষ্পদ বেদ ছিল একসূত্রে গাঁথা। পরে তা শত সহস্র ভাগে বিভক্ত হয়। ক্রমে ক্রমে তা আবার দশ গুণ বিভক্ত হয়।
এই বেদবিহিত যজ্ঞ যজ্ঞকারীর সমস্ত কামনা পূর্ণ করবে–লোক পিতামহের মুখে এমন কথা শুনে লোকহিতে রত প্রভু মনু ‘তথাস্তু’ বলে সেই চতুষ্পদ বেদকে চারভাগে বিভক্ত করলেন।
হে তাত, বর্তমান যুগে সে-কারণেই আপনারা নানাভাবে বেদের কল্পনা করে থাকেন। যে সাধুবৃন্দ, অতীত মন্বন্তরে সংঘটিত সেই সব বেদকল্পনা আপনাদের পরোক্ষ হলেও আমি এখন তা প্রত্যক্ষভাবে আপনাদের কাছে ব্যক্ত করব।
পরাশরপুত্র এই কলিযুগে ব্যাস দ্বৈপায়ন নামে আখ্যায়িত হয়েছেন, তিনি সাক্ষাৎ বিষ্ণুর ‘অংশরূপে’ কীর্তিত। তিনিই প্রথম ব্রহ্মার প্রেরণায় বেদবিভাগ শুরু করলেন। এই বেদবিভাগের জন্য তিনি চারজন শিষ্য গ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন জৈমিনি, সুমন্ত, বৈশম্পায়ন ও পৈল। এরপর তিনি আর একজনকে পঞ্চম শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি হলেন লোমহর্ষণ।
ব্যাসদেব এঁদের সকলকে বিধিপূর্বক গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঋগবেদের জন্য শ্রাবক দ্বিজ পৈলাকে। যজুর্বেদবক্তা বৈশম্পায়নকে সামবেদার্থ শ্রাবক জৈমিনি, অথর্ব বেদের জন্য সপ্তম সুমন্তকে ভালো ইতিহাস ও পুরাণ বলার জন্য আমাকে অর্থাৎ লোমহর্ষণ সূতকে শিষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
যজুর্বেদও প্রথমে এক ছিল। ব্যাসদেব তাকে চারভাগে বিভক্ত করলেন। তাতে চতুহোত্র হল এবং তা থেকে তিনি যজ্ঞ কল্পনা করলেন।
এইভাবে তিনি যজুর্বেদ দ্বারা আধ্বর্ষব, ঋকবেদ দ্বারা হোত্র, সামবেদ দ্বারা উদগাত্র ও অথর্ব বেদ দ্বারা ব্রহ্মত্ব কল্পনা করলেন। এরপরেই তিনি সমস্ত ঋমন্ত্র উদ্ধৃত করে ঋগ্বেদের কল্পনা করেন, তা থেকেই জগতের পক্ষে হিতকর যজ্ঞবাহক হোতার কল্পনা করা হয়।
ব্যাস দ্বৈপায়ণ সাম মন্ত্র থেকে সাম বেদ ও তা থেকে উদগাত্র রচনা করেন এবং অথর্ব বেদানুসারে তিনি রাজাদের সমস্ত কাজ সম্পন্ন করেন। পুরাণাৰ্থ বিশারদরা আখ্যান, উপাখ্যান, গাথা ও কুলকর্মসমূহের সাথে পুরাণসংহিতা রচনা করেন।
যজুর্বেদের অনেকগুলি পদ উঠিয়ে দেওয়ার ফলে তা বিষম অর্থাৎ ছন্দোহীন হয়ে পড়ে। তখন সেই ছন্দহারা যজুর্বেদমন্ত্রগুলি বেদপারগ ঋত্বিকদের দ্বারা উদ্ধত বীর্য অশ্বমেধ যজ্ঞেও প্রযুক্ত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, সেই অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারাই বেদ মন্ত্র ব্যাবহারিক জীবনে প্রযুক্ত হয়।
এরপর যজুর্বেদে যা অবশিষ্ট ছিল তা দিয়ে যজ্ঞবিধি প্রস্তুত করা হয়, সেইজন্য যজুর্বেদকে যুজ্ঞান বলা হয়। এই-ই হল শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত।
ঋগ্বেদশ্রাবক পৈল ঋষি ঋক মন্ত্রগুলিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। পরে সেগুলোকে আরও দুই ভাগে ভাগ করেন। এবং আবার তা সংযুক্ত করে দুই শিষ্যকে তা সমর্পণ করলেন। এই দুই ভাগের মধ্যে প্রথমটি ইন্দ্ৰপ্ৰমতি নামে শিষ্যকে এবং দ্বিতীয়টি বাস্কল নামে শিষ্যকে অর্পণ করেন। পরবর্তী দ্বিজ শ্রেষ্ঠ বাস্কল চারখানি সংহতি প্রণয়ন করে শুশ্রূষারত হিতাকাঙ্ক্ষী শিষ্যদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। বাস্কল তাঁর অনুগামী এই চারজন শিষ্যের মধ্যে বোধ নামক শিষ্যকে প্রথম শাখা, অগ্নিমাঠর নামক শিষ্যকে দ্বিতীয় শাখা, পরাশরকে তৃতীয় শাখা ও যাজ্ঞবল্ক্য মুনিকে চতুর্থ শাখা পড়িয়েছিলেন।
অনুরূপভাবে পৈলশিষ্য ইন্দ্ৰপ্ৰমতি তার অন্যতম অনুগামী মহাভাগ যশস্বী মার্কণ্ডেয়কে একটি সংহিতা অধ্যয়ন করান। সেই সংহিতা মহাযশাঃ মার্কণ্ডেয় তার জ্যেষ্ঠসূত সত্যবাকে, সত্যবা সত্যহিতকে, সত্যহিত তার নিজ পুত্র সত্যতরকে এবং বিভু সত্যতর মহাত্মা সদাসত্যধর্ম পরায়ণ সত্যশ্রীকে অধ্যয়ন করিয়েছিলেন।
সত্যশ্রীর চারজন মহাতেজশালী বিদ্বান এবং শাস্ত্রজ্ঞ শিষ্য ছিলেন। সত্যশ্রীর মধ্যে শাকল্য ছিলেন প্রধান। অপর তিনজন হলেন রমন্তর, বাঙ্কলি ও ভরদ্বাজ। এঁরা সকলেই কোন-না কোনো শাখার প্রবর্তক ছিলেন। শাকল্য ছিলেন দেবমিত্র। কিন্তু জ্ঞান ও অহংকারে গর্বিত হয়ে পড়লে জনকের অশ্বমেধ যজ্ঞে তাঁর বিনাশ ঘটে।
শংসপায়ন এ পর্যন্ত শুনে আরও বেশি কৌতূহলী হয়ে পড়লেন। তিনি লোমহর্ষণকে জিজ্ঞাসা করলেন-হে মহাভাগ, জ্ঞানগর্বিত সেই মুনির ঠিক কী কারণে বিনাশ হয় সে সম্বন্ধে বিস্তারিত বলুন। এও বলুন যে জনকরাজার অশ্বমেধ যজ্ঞে কেনই বা বিবাদ ঘটল? কার সাথে কোন্ বিষয়কে কেন্দ্র করে এই বিবাদ হয়েছিল? এসব বিষয়ে সকল কথা যথাযথ ভাবে বলুন প্রভু।
ঋষিশ্রেষ্ঠের কথা শুনে সূত বললেন–আপনার অনুমান সঠিক, দ্বিজবর। এ বিষয়ে কোনো কথাই আমার অবিদিত নয়। এ সকলই আপনাদের জ্ঞাতার্থে আমি নিশ্চয়ই বলব।
মহান রাজা জনকের অশ্বমেধ যজ্ঞেও বিরাট জনসমাগম ঘটেছিল, শত-সহস্র ঋষি ও ঋষিশ্য জনকের সেই মহাযজ্ঞ দেখার অভিলাষে সেখানে গিয়েছিলেন। সমাগত এই বিপুল ব্রাহ্মণ সমাবেশ দেখে মহারাজাধিরাজ জনকের সহসা জানতে ইচ্ছা হল যে এঁদের মধ্যে কে হলেন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ? এ বিষয়ে কী ভাবেই বা নিশ্চিত হওয়া যায়? এ সম্পর্কে অনেক ভাবনা-চিন্তা করার পর রাজা জনক মনে মনে একটা উপায় স্থির করলেন।
পরের দিন সকাল হতে না হতেই সহস্র গোধন, প্রচুর স্বর্ণ, অগুন্তি গ্রাম, রত্ন ও দাসদাসী নিয়ে রাজা জনকের সভায় এলেন। তিনি উপস্থিত মুনিদের উদ্দেশে বললেন, হে দ্বিজবৃন্দ, আপনারা সকলেই শ্রেষ্ঠ, সকলকেই আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করছি। হে দ্বিজোত্তমগণ তবু আমার এই কৌতূহল আপনারা প্রশমিত করুন।
আপনাদের মধ্যে কে অধিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী সেকথা আমি জানতে চাই। আজ আমি এই অপরিমেয় ধনরাশি তারই জন্য সভাগৃহে এনেছি। আপনাদের মধ্যে যিনি বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ তার বিদ্যার স্বীকৃতি স্বরূপ এই ধন সম্পদ তাকে আমি উপহার হিসেবে দিয়ে ধন্য হতে চাই।
জনক রাজার মুখে এই কথা শুনে এবং স্তূপীকৃত বনরাজির জৌলুস দেখে সেইসব বেদ বিশেষজ্ঞ মুনিগণ তা গ্রহণ করার জন্য সাতিশয় ইচ্ছুক হয়ে পড়লেন।
বেদজ্ঞানমদে উন্মুক্ত হয়ে তারা পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা প্রদর্শন করতে লাগলেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন ইতিমধ্যেই সেই ধনদৌলত পেয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অহংকার বশে বলে উঠলেন, আমিই শ্রেষ্ঠ। তাই এ ধন আমার পরক্ষণেই তার মত খণ্ডন করতে অন্য কেউ বলে উঠলেন, এ ধন আমার ছাড়া অন্য কারোর হতেই পারে না। তোমাদের মনে অযথা সন্দেহ দেখা দিচ্ছে কেন? এইভাবে সেই সভাস্থলে উপস্থিত ব্রাহ্মণরা ধনলোভে বহু বাদানুবাদ করলেন।
সেই সময় সভাস্থলে অন্য অন্য ব্রহ্মবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মতত্ত্বজ্ঞ মহাতেজাঃ, মহাতপস্বী, বিদ্বান কবি ও ব্রহ্মার অঙ্গজাত যাজ্ঞবল্ক্য মুনি সমুপস্থিত ছিলেন। তিনি সেই তুমুল কোলাহলের মধ্যে নিতান্ত সুমধুর স্বরে নিজ শিষ্যদের উদ্দেশে বললেন, ওহে বৎসগণ! অবিলম্বে এই ধনরাজি আমার আশ্রমে নিয়ে যাবার উদ্যোগ কর। এই ধন-সম্পদ যে আমার সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
এখানে আমার সমকক্ষ আর কেউ উপস্থিত নেই। আমি সকল বেদের প্রবক্তা, আমার সমান আর কেউ-ই-হবেন! অবশ্য কোনো ব্রাহ্মণ যদি আমার ঘোষণায় প্রীত না হয়ে থাকেন, তিনি এখনই বিচারের জন্য আমাকে আহ্বান করতে পারেন, আমি তার সঙ্গে তর্কযুদ্ধ করতে প্রস্তুত।
যাজ্ঞবুল্ক্যের এমন কথায় প্রলয়কালীন সমুদ্রের মতো তুমুল গর্জনে সেই ব্রাহ্মণ সমুদয় ক্রোধে গর্জন করে উঠলেন।
তাঁদের সেই অবস্থা দেখে প্রকৃতিস্থ যাজ্ঞবল্ক্য হাসতে হাসতে তাদের উদ্দেশে বললেন, আপনারা তো নিজেদের বিদ্বান ও সত্যবাদী বলে দাবি করেন। এমন ক্ৰোধী মূর্তি আপনাদের শোভা পায় না। তার চেয়ে আপনারা পরস্পর যা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তা আমায় জিজ্ঞাসা করুন আমি যথাযোগ্য উত্তর দেব।
বেদ প্রবক্তা যাজ্ঞবল্ক্য এবং বেদপরাঙ্গম মুনিগণ কেউ কারোর মত স্বীকার করলেন না। ফলে সেই ধনের জন্য মহাত্মাদের মধ্যে সকলপ্রকার লৌকিক, বৈদিক ও আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে সহস্র সহস্র সূক্ষ্ম। দর্শন সদ্ভূত বিদ্যাগুণে অলংকৃত নানাপ্রকার বাদানুবাদ চলতে লাগল।
একপক্ষে একা যাজ্ঞবল্ক্য ও অপরপক্ষে সমস্ত ঋষিরা মিলিত হয়ে তুমুল বিচার শুরু করলেন। ধীমান যাজ্ঞবল্ক্য সমস্ত মুনিদের এক এক করে প্রশ্ন করলেন। কিন্তু তারা কেউই সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। মুনিরা শ্রেষ্ঠত্বর বিচারে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হলেন। ব্রহ্মাতেজোশালী মহাদ্যুতি যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর দাবির যৌক্তিকতার প্রমাণ দিলেন।
যতক্ষণ মুনিদের সাথে যাজ্ঞবল্ক্য প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছিল বেদকর্তা শাকল্য একটিও প্রশ্ন করেননি। তাই বিজিত হয়ে যাজ্ঞবল্ক্য প্রথমেই শাক্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে শাকল্য আপনি এমন ধ্যানস্থ হয়ে আছেন কেন? আপনার কি কোনোই বক্তব্য নেই? আপনাকে বায়ুপূর্ণ মতো জড় বলে মনে হচ্ছে। আমি আপনাকেও একটি সুযোগ দিতে চাই।
যাজ্ঞবল্কের কথা শুনে মহর্ষি শাকল্য অপমানিত বোধ করলেন। ক্রোধে তাঁর চোখ-মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। অন্যান্য মুনিদের সামনেই তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন, হে যাজ্ঞবল্ক্য আপনি আমাদের এবং এইসব দ্বিজশ্রেষ্ঠদের তৃণের মতো অবজ্ঞা করে বিদ্যার জন্য এই মহোকৃষ্ট ধন কেবল নিজের উদ্দেশ্যেই নিতে চাইছেন।
শাকল্য এই কথা বললে উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, তত্ত্ব ও অর্থ এই দুটোই দর্শনই ব্রাহ্মণদের শক্তি। কাম অর্থের সাথে সম্বন্ধ যুক্ত। তাই এই অর্থ আমি কামনা করছি। কাম হল বিপ্রদের ধন। তাই আমি কাম বিষয়ক প্রশ্নই রাখছি। এই রাজর্ষির পণই এই রকম। তাই আমি ধন গ্রহণ করেছি।
যাজ্ঞবন্ধ্যের এই কথা শুনে মহর্ষি শাকল্য আর নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারলেন না। ক্রোধে অভিভূত হয়ে তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে কামবিষয়ক প্রশ্ন করতে লাগলেন। তিনি দম্ভভরে যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন, বেশ, আমি আপনাকে কামবিষয়ক প্রশ্নই করব, আপনি তার যথার্থ উত্তর দিন।
এইভাবে দুই ব্রহ্মবিদজ্ঞের মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু হল। শাক্য তাকে সহস্র প্রশ্ন করলেন। যাজ্ঞবল্ক্য অকাতরে তার উত্তর দিতে লাগলেন, উপস্থিত অন্যান্য মুনিঋষিরা তাদের তত্ত্বালোচনা নীরবে শুনে যেতে লাগলেন। দেখতে দেখতে শাকল্যের সমস্ত কথা নিঃশেষ হল। তখন যাজ্ঞবল্ক্য তাকে বললেন, শাক্য আমারও কামবিষয়ক এক প্রশ্ন আছে। এবং এই প্রশ্নের পণ হল অভিশাপ। আপনি উত্তর দিতে না পারেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আপনার মৃত্যু ঘটবে।
শাকল্য এই শর্তে সম্মত হলে যাজ্ঞবল্ক্য তাকে কামসংক্রান্ত একটি গুঢ় প্রশ্ন করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রশ্নটির উত্তর শাকল্যের অজানা ছিল। ফলে সাথে সাথে শাকল্যের মৃত্যু ঘটল।
মহর্ষি শাকল্যের এইভাবে বিনাশ ঘটলে ধনার্থী মুনিঋষিরা আবার যাজ্ঞবল্ক্যের সাথে বাদানুবাদে লিপ্ত হলেন। তারা যাজ্ঞবল্ক্যকে পুনরায় সহস্র সহস্র প্রশ্ন করলেন। মহামতি যাজ্ঞবল্ক্য তাদের সেইসব কঠিন প্রশ্নের যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা করে উত্তর দিতে লাগলেন। এইভাবে তিনি নিজের যশ সূচনা করে ধনদৌলত নিয়ে শিষ্য পরিবৃত হয়ে সুস্থ মনে বাড়ি চলে গেলেন।
যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে পরাভব স্বীকার করলেও দেবমিত্র শাকল্য দ্বিজসত্তম ব্রহ্মবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি পাঁচখানি সংহিতাও প্রণয়ন করেছিলেন। যে পাঁচজন তাঁর অন্যতম শিষ্য ছিলেন তাঁরা হলেন– মৃদুগল, গোলক, খালীয়, মৎস্য ও শৈশিরীয়। শাকল্যের মৃত্যু ঘটলে এঁরা সকলেই ব্রহ্মঘাতী হলেন। অত্যন্ত চিন্তান্বিত হয়ে তারা ব্রহ্মার কাছে গেলেন।
ব্রহ্মা মনে মনে এইসব ঘটনা জানতে পেরে তাদের পবনপুরে পাঠিয়ে দিলেন, এবং আশ্বাস দিলেন যে তারা সেখানে গেলে অবিলম্বে তাদের পাপ বিনষ্ট হবে। তিনি বললেন–তোমরা দ্বাদশাক, বালুকেশ্বর একাদশ রুদ্র ও বিশেষত বায়ুপুত্রকে প্রণাম করে চারটি কুণ্ডে স্নান করুন। তাহলেই তোমরা ব্রহ্ম হত্যার পাপ থেকে উত্তরণ করতে পারবে।
ব্রহ্মার আদেশ শুনে শাকল্যের ওই চারজন শিষ্য শীঘ্র সেই পবনপুরে এলেন। নিয়মমতো স্নান করলেন এবং দেবতাদের দর্শন করলেন। এরপর বাড়বদের প্রাসাদে গিয়ে উত্তরেশ্বরকে প্রণাম জানাতেই সকল পাপ হতে মুক্ত হলেন। তারপর সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করলেন। সেই থেকে সেই বায়ু নির্মিত বায়ুপুরী পবিত্র পাপবিনাশক তীর্থরূপে পরিগণিত হতে লাগল। পবনপুত্র অঞ্জনা গর্ভজাত সত্য বিক্রমশালী হনুমান জন্মগ্রহণ করলে সন্তান গর্বে সুখী ব্রহ্মোৎপন্ন বায়ুদেবতা এই তীর্থ নির্মাণ করেন।
পৃথিবীতে চতুরাশ্রম প্রথা প্রচলিত হলে ব্রাহ্মণদের সেবার জন্য যেসব শুদ্র জন্মেছিলেন, জীবিকা নির্বাহের উপায়ে হিসাবে ব্রহ্মযজ্ঞের জন্য তাদের উপর এক ধরনের কর স্থাপিত হয়। এই বিধি দ্বারা সেই সময় ব্রাহ্মণদের মহৎ শাসনকাল স্থাপিত হয়। আরও বলা হয়–পাপী হোক, কৃতঘ্ন হোক, সুরাপায়ী বা গুরুশয্যাগামীই হোক, বাড়াদিত্যকে নতমস্তকে প্রণাম করলে সর্বপাপ থেকে তার মুক্তি ঘটবে।
.
৫৬.
পূর্বকথার সূত্র ধরে সূত বলতে লাগলেন ভরদ্বাজ, যাজ্ঞবল্ক্য, ধীমান শতবলাক, দ্বিজোত্তম নৈগম, গালকি, সালকি, বষ্কালি ও ভরদ্বাজ–এই সব পৃথিবীশ্রেষ্ঠ ঋষিবৃন্দ তিনটি সংহিতা প্রণয়ণ করেছিলেন। রথীতর রচনা করেছিলেন চতুর্থ নিরুক্ত।
এই রথীতর সম্পর্কে জানা যায় তার তিনজন মহৎ গুণবান শিষ্য ছিলেন তাদের নামগুলি হল– ধীমান নন্দায়নীয়, বুদ্ধিমান পন্নগরি ও তৃতীয় আর্য। এঁরা সকলেই ছিলেন মহান তপস্বী, নিষ্ঠাবান ব্রতী, বীতরাগ সম্পন্ন, মহাতেজঃ মণ্ডিত, ও সংহিতাজ্ঞানী। সংহিতা বিষয়ে এঁরা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। সেই কারণে তাদের ‘সংহিতা প্রবর্তক বহুচ’ বলা হয়।
বৈশম্পায়ন গোত্রীয় ঋষিরা যজুর্বেদের ভেদকল্পনা করেন। তারা ছিয়াশিটি শুভ যজুঃসংহিতা প্রণয়ন করেন। তিনি সেইসব সংহিতা শিষ্যদের দান করলে তারাও বিধিমতো সেইসব গ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে কেবল একজন মহাতপা যাজ্ঞবল্ক্য পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই সংহিতাই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
প্রাথমিক এই তিনটি বিভাগ আরও তিনভাগে বিভক্ত হয়ে নয়প্রকার হয়ে ওঠে। উত্তরদেশ, মধ্যদেশ ও পূর্বদেশের বিভিন্ন স্থানে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে যজুর্বেদের অধ্যয়ন করা হয়। এর মধ্যে উত্তর দেশের শ্যামায়নি, মধ্যদেশের আরুণি এবং পূর্বদেশের অলম্বি যজুর্বেদে পাঠের প্রধান পীঠস্থান। বলে পরিগণিত। এইসব সংহিতাবাদী দ্বিজরাই পরবর্তীকালে “চরক” নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।
এ পর্যন্ত বিবরণ শুনে ঋষিদের মনে প্রশ্ন জাগল। তারা সূতকে জিজ্ঞাসা করলেন–কী কারণে চরক অধৈৰ্য্য হলেন। কী কারণে তার এই নাম হল, এসব আপনি যথাযথভাবে বলুন।
তাদের এই অনুরোধ শুনে সূত তাদের কাছে চরকত্ব বিষয়ে বলতে সম্মত হলেন। তিনি বললেন, হে দ্বিজবরগণ, ঋষিদের কিছু করণীয় কর্তব্য ছিল। তাই তারা সকলে মিলে মেরুপৃষ্ঠে গিয়ে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। আলোচনার মাধ্যমে তারা স্থির করলেন যে, আমাদের মধ্যে যিনি সপ্তরাত্রির মধ্যে এখানে ফিরে আসতে পারবেন না, তিনি ব্রহ্মরধ্যাব্রতের অনুষ্ঠান করবেন। এই-ই হল সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। এই নিয়ম আমাদের সকলকে পালন করতে হবে।
বৈশম্পায়ন ব্যতীত সকল মহর্ষি সশিষ্য সপ্তরাত্রির মধ্যে সেই স্থানে চলে এলেন। ফলে ব্রাহ্মণদের বচন অনুসারে বৈশম্পায়ন ব্রহ্মরধ্যা ব্রতের আয়োজন ভার গ্রহণ করলেন। তিনি তার শিষ্যদের ডেকে বললেন, তোমরা আমার জন্য সত্বর ব্রহ্মরধ্যা ব্রতের অনুষ্ঠান করো। এ বিষয়ে যা আমার পক্ষে হিতকর বলে মনে হবে তা আমাকে বলুন।
বৈশম্পায়ন তার সকল শিষ্যকে এই আদেশ দিলেন। কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, আপনার অন্যান্য মুনিশিষ্যদের প্রয়োজন হবে না। আমি একাই এই ব্রতের আয়োজন করতে পারব। এতে আমার বল বিষয়ে আপনিও নিঃসন্দেহে হতে পারবেন।
ব্রহ্মবিদদের মধ্যে অন্যতম যাজ্ঞবন্ধ্যের মুখে এহেন গর্বিত বচন শুনে গুরুদেব বৈশম্পায়ন অতি ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি যাজ্ঞবল্ক্যকে আদেশ করলেন, তুমি আমার কাছে এযাবৎ যা কিছু অধ্যয়ন করেছ, এখনই তা প্রত্যার্পণ কর।
গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে যাজ্ঞবল্ক্য সমস্ত যজুর্বেদ রক্তাক্ত অবস্থায় বমন করে গুরুকে প্রত্যার্পণ করলেন। ক্ষুণ্ণ মনে যাজ্ঞবল্ক্য সেই স্থান পরিত্যাগ করলেন। তার এতদিনের অধীত বিদ্যা হারিয়ে তিনি মনে মনে খুবই দুর্বল হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি সূর্যের ধ্যানে মগ্ন হলেন। তিনি জানতেন সূর্যরূপ বেদ পৃথিবী থেকে উঠে আকাশলোক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার সাথে সাথে সমস্ত যজুর্বেদ ঊর্ধ্বগমন করে আদিত্যমণ্ডলে অবস্থান করছে। একমাত্র সূর্যদেব সন্তুষ্ট হলেই হৃত যজুর্বেদজ্ঞান ফিরে পাওয়া সম্ভব।
যাজ্ঞবন্দ্যের কঠোর তপস্যায় সূর্যদেব সন্তুষ্ট হলেন। তিনি বর হিসেবে হৃত সমস্ত যজুর্বেদ অশ্বরূপধারী যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রদান করলেন। অশ্বরূপধারী যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রদান করা হয়েছিল বলে যে– কেউ যজুর্বেদ অধ্যয়ন করেন তারাই ‘বাজী’ নামে প্রসিদ্ধ হন। বিপরীতক্রমে যাঁরাই ব্রহ্মরধ্যা ব্ৰত্যানুষ্ঠান করেন তারাই “চরক” নামে পরিচিত হন। সেই জন্য যাজ্ঞবল্ক্য ব্যতীত বৈশম্পায়নের অন্যান্য শিষ্যগণ ‘চরক’ নামে খ্যাত।
এই চরকদের বিষয়ে আমার বক্তব্য বললাম। এবার বাজীদের বিষয়ে বলছি, শুনুন।
কম্ব, বৈধেয়, শালী, মধ্যন্দিন, শাপেয়ী, বিদিগ্ধ, চাপ্য, উদ্দল, তাম্ৰায়ণ, বাংস্য, গালব, শৈশিরি, আটবী, পণী, বীরণী ও পরায়ণ–এই পনেরোজন যাজ্ঞবল্ক্য শিষ্য “বাজী” আখ্যা লাভ করেছিলেন। এইভাবে ক্রমশ একশো জন্য ব্রহ্মবিদ মুণি যজুর্বেদের বিভাগকর্তা হয়েছেন।
জেমিনি তার নিজ পুত্র সুমন্তকে, সুমন্ত তাঁর পুত্র সুত্বাকে, সুত্ব তাঁর পুত্র সুকর্মাকে বেদ গ্রন্থ অধ্যয়ন করান। সুকর্মা সকল সংহিতা অতি-শীঘ্র অধ্যয়ন করে অধ্যাপনা করতে শুরু করলেন। সুকর্মা যথার্থই সহস্র সু-কর্মের হোতা এবং সুর্যতেজের অধিকারী ছিলেন। সে সময় একটা নিয়ম ছিল অনধ্যায় দিনে অর্থাৎ যেদিন অধ্যয়ন হয় না, সেই সময় যাঁরা অধ্যয়ন করেন ইন্দ্র তাদের বিনাশ করেন। এরকম নীতিহীন নিয়মের বিরুদ্ধে সুকর্মা তাঁর শিষ্যদের জন্য প্রয়োপবেশন ব্রত শুরু করলেন। তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন বুঝে ইন্দ্র তাকে বরদান করে বললেন–হে মহাভাগ, আপনার মহাবীর্যবান এই দুই শিষ্য সহস্র সংহিতা অধ্যয়ন করে মহাপ্রাজ্ঞ ও অগ্নিতেজা হবেন। অতএব হে দ্বিজবর, আপনি আর ক্রোধিত হবেন না। ইন্দ্রের এই আশীর্বাদ লাভ করে সুকর্মার ক্রোধের উপশম ঘটল।
হে দ্বিজগণ যে দুজন শিষ্যের হিতার্থ কামনায় সুকর্মা এমনু কঠিন ব্রত পালন করেছিলেন, তাঁদের নাম হল ধীমান ও পৌষ্যঞ্জী। পৌষঞ্জীর হিরণ্যাভ ও কৌশিক নামে দুজন শিষ্য ছিলেন। পৌষ্যঞ্জী পাঁচশত সংহিতা অধ্যয়ন করিয়েছিলেন। তাই তাঁর শিষ্যরা মঙ্গলকর ‘উদীচ্য সমান হয়েছিলেন। আর হিরণ্যাভের শিষ্যরা ‘প্রাচ্য সমগ’ নামে প্রসিদ্ধ হন। পৌষঞ্জীর প্রিয় শিষ্য বীর্যবান কৌশিক্য পাঁচশত সংহিতা প্রণয়ন করেছিলেন।
কৌশিক ও হিরণ্যাভ ছাড়া পৌষঞ্জীর অন্য চারজন শিষ্য হলেন– লোকাক্ষী, কুথুমি, কুশীতী, লাঙ্গলি। এবার এদের ভেদের বিষয়ে শুনুন।
লোকাক্ষীর শিষ্যরা হলেন–তণ্ডিপুত্র রানায়নীয়, সুবিদ্বান মূলাচারী, সকেতিপুত্র, সহসাত্যপুত্র, তণ্ডিপুত্র রানায়নীয়ও সৌমিত্র ছিলেন সমবেদবিশারদ।
শৌরিদ্য ও শৃঙ্গিপুত্র এঁরা দুজন ব্রতচারণ করেন।
মহাতপাঃ শৃঙ্গিপুত্র তিনখানি সংহিতা প্রণয়ন করেন।
পৌষাঞ্জীশিষ্য কুথুমির ঔরস, রসপিশর ও তেজস্বী ভাগবিত্তি নামে তিনজন পুত্র ছিলেন। এঁরা কৌথুম নামে জগতে খ্যাতি হয়ে আছেন।
কৌথুম পরাশৰ্য, বেদপরায়ণ ও পৃদ্ধপরায়ণ অসুরায়ণ বৈশাখী এবং চৈল, প্রাচীন যোগ ও সুরাল প্রমুখ দ্বিজোত্তমসন ছয়খানি করে সংহিতা প্রণয়ন করেন।
প্রাচীন যোগের পুত্র হলেন বুদ্ধিমান পতঞ্জলি।
অন্যদিকে লাঙ্গলী ও শালিহোত্র দুজনেই ছয়টি করে সংহিতা প্রণয়ন করেন। লাঙ্গলির অনুগামী শিষ্যবৃন্দ “লাঙ্গল” বলে প্রসিদ্ধ। তারা হলেন–ভালুকি, কামহানি, জৈমিনি, লোমগায়নি বণ্ড ও বোহল।
হিরণ্যাভের শিষ্য মানবশ্রেষ্ঠ নূপাত্মজ চব্বিশটি সংহিতা প্রণয়ণ করেন। তিনি অন্য যেসব শিষ্যদের শিষ্যা দান করেছিলেন তাঁরা হলেন–তালক, পাণ্ডক, কলিক, রাজিব, গৌতম, জবন্ত, সোমরাজ, আপতস্তুত, পৃষ্ঠঘব, পরিকৃষ্ট, উলুলদ, যবীয়স, বৈশাল, অঙ্গুলীয়, কৌশিক, সালিমঞ্জরী, সত্য, কাপীয়, কানিক, ধর্মাত্মা পরাশর প্রমুখ। এঁরা সবাই “ক্রান্তদর্শী সমগ্র” নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
সমস্ত সংহিতার প্রভেদকর্তা সামগ্রদের মধ্যে কৃতি এবং পৌষ্যগ্ধী, এঁরা দুজনেই বিশে কীর্তিত ছিলেন।
হে দ্বিজগণ, আরও শুনন, জৈমিনিপুত্র সুমন্ত অর্থবেদকে দুইভাগে ভাগ করে কবন্ধকে দান করেন। কবন্ধও যথারীতি অথর্ববেদ বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেছিলেন। পরে তিনি আবার তাকে দু-ভাগে ভাগ করে এক ভাগ পথ্যকে ও দ্বিতীয় ভাগ বৈদস্পর্শকে দান করলেন। বেদস্পর্শের চারজন দৃঢ়ব্রতা শিষ্য ছিলেন। তাঁরা হলেন ব্রহ্মপরায়ণ মোদ, পিম্পলাদ, ধর্মজ্ঞ, শৌক্কায়নি এবং তপন।
বেদস্পর্শ এই চার শিষ্যের মধ্যে অথর্ববেদকে চারভাগে ভাগ করে বিতরণ করলেন। পথ্যও অনুরূপভাবে তার নিজের ভাগের অথর্ববেদকে তিনভাগে ভাগ করে জাজলি, কুমুদাদি ও শৌনককে দান করলেন। শৌনক এদের মধ্যে আবার নিজের ভাগের বেদজ্ঞান দু-ভাগে বিভক্ত করে একভাগ ব্রভুকে ও অপরভাগ ধীমান সৈন্ধবয়নকে দিয়েছেন। সৈন্ধব নিজের বেদাংশ দিলেন মঞ্জুকেশকে।
মঞ্জুকেশ যতটুকু পরিমাণ বেভাগ লাভ করেছিলেন তাকে তিনি ছয় ভাগে বিভক্ত করলেন। এর মধ্যে নক্ষত্রকল্প, বৈতান, তৃতীয় সংহিতা, বিধি, চতুর্থ অঙ্গিরস কল্প এবং পঞ্চম শান্তিকল্প বিখ্যাত হল। অথর্ববেদের ভাগকর্তাদের মধ্যে এই ঋষিকেই প্রধান বলে জানবেন।
হে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ ঋষিবৃন্দ, ইতিপূর্বে আমি ছয়ভাগে ভাগ করে পুরাণ ব্যাখ্যা করেছি। আত্রেয়, ভরদ্বাজ, সুমতি, ধীমান, কশ্যপ, অকৃতব্রণ, অগ্নিচর্চা, বশিষ্ঠ, মিত্রয়ু, আবর্নি, সোমদত্তি, সুশর্ম, শাংশপায়ন প্রমুখ হলেন পুরাণ বিষয়ে আর দৃঢ়ব্রত শিষ্য।
পুরাণ বিষয়ে সর্বমোট সাতাশটি সংহিতা প্রণীত হয়েছে। কশ্যপ, সাবণি ও শাংশপায়ন তিনটি করে সংহিতা প্রণয়ন করেন। আর সীমীকা নামে যে চতুর্থ সংহিতা রয়েছে, তা পূর্বেই প্রমীত হয়েছিল। এইসব সংহিতার প্রত্যেকটিরই চারটি করে পাদ আছে।
হে দ্বিজবৃন্দ, এই যে এত বিভাজন, তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি সংহিতার অর্থেই কিন্তু এক। পাঠান্তরের ফলে এইসব সংহিতা পৃথক পৃথক হয়ে পড়ে। এবং ফলশ্রুতি স্বরূপ বিভিন্ন বেদশাখার উদ্ভব ঘটে। শাংশপায়ন ভিন্ন অন্য প্রণেতাদের সংহিতাতে চার হাজার মন্ত্র বা শ্লোক আছে, যা দ্বিগুণ হয়ে সংখ্যায় আট হাজার হয়ে গেছে।
যজুবাক্যার্থে পণ্ডিত লোম হর্ষণিকা প্রথম দ্বিতীয় হলেন কশ্যপিকা এবং তৃতীয় সাবর্ণিকা।
এছাড়া অন্যান্য যেসব শাংশপায়নিকা আছে তাদের অংখ্যা আট হাজার ছয়শো। এই ছাড়া বালখিল্য সমপ্রৈখ্য ও সাবর্ণ সংহিতা প্রসিদ্ধ।
আটহাজার এবং তার সাথে আরও চোদ্দহাজার সামন্ত্র এবং সোহোম আরণ্যক মন্ত্র আছে। সামগ ব্রাহ্মণরা এইসব মন্ত্রীসংগীত উচ্চারণ করে থাকেন।
ব্যাস দ্বৈপায়ণ বেদ ও ব্রহ্মণের গামারণ্যক ও মন্ত্রকরণের সাথে সাথে বারোহাজার আধবর্যব ও বেদের বিভাগ করেন।
ঋক্ ব্রাহ্মণ ও যজুর তিনটি গ্রামারণ্যও সমগ্র ভেদে দুই প্রকার। আর হারিদ্রবীয়রা খিল ও উপখিল নামে দু-ভাগে বিভক্ত। এই ভাবে তৈত্তিরীয়দের পরেও এই সব ক্ষুদ্র বেদ কল্পিত হয়। বাজসনেয় সংহিতায় এক হাজার নয়শো পাদ আছে। আয়তনের দিক থেকে ঋক সংহিতার চারগুণ হল ব্রাহ্মণ।
যাজ্ঞবল্ক্য প্রণীত অবশিষ্ট যজুর্বেদের সংহিতাগুলিতে ও শুক্র প্রণীত ঋকবেদীয় সংহিতাগুলিতে আট হাজার এবং অষ্টআশির বেশি পাদ পরিমাণ আছে।
এবার চরণবিদ্যা সমূহের সংহিতা ও প্রমাণ বিষয়ে বলছি, শুনুন। ঋক সমূহের পরিমাণ ছয় হাজার। এরপর ঋকসমূহ ছাব্বিশ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যজুর্বেদের পাদ পরিমাণ ঋকবেদের পাদ পরিমাণ অপেক্ষা অধিক, যজুঃ সমূহের পদ সংখ্যা এগারো হাজার কুড়ি।
ঋক বিষয়ে মহর্ষি ভৃগু বিস্তারিত তথ্য দিয়ে বলেছেন যে ঋকের মন্ত্র সংখ্যা দশ হাজার তিনশো আশি। ঋকের পরিমাণ এক হাজার। এছাড়া আর্থবিক আরও অনেক আছে। ঋকসমূহেরও অথর্বসমূহের মধ্যে মোট পাঁচ হাজার চরণ আছে। অন্যগুলিতে এই সংখ্যা কুড়ি হাজারের কম। অন্যান্য বলতে মহর্ষি অঙ্গিরা আরণ্যকের কথা উল্লেখ করেছেন।
এইভাবে আমি বিভিন্ন সংখ্যক শাখাভেদের কথা যথা সম্ভব বিস্তারিত ভাবে আপনাদের কাছে। বললাম। শাখা সমুহের কর্তার কথা ও শাখা ভেদের হেতুর কথাও যথাসম্ভব বিস্তৃতবাবে আলোচনা করলাম। হে দ্বিজোসত্তমগন, সব মন্বন্তরেই শাখাভেদ সমান বলে মনে জানবেন।
একমাত্র প্রজাপত্য শ্রুতি নিত্য। আর সকলই তার বিকল্প মাত্র। দেবতাদের অনিত্যতা হেতু বারবার এ ধরনের মন্দ্রোৎপত্তি ঘটে থাকে। তবে একটি কথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে মন্বন্তরের আদিতে দেবতাদের নাম অবশ্যই থাকে। পরে দ্বাপর যুগে উপনীত হয়ে আবার এই সব ভেদকল্পনা শুরু হয়।
সুতরাং ঋষিসত্তম ভগবান ব্যাস দ্বৈপয়াণই বেদবিভাগ করে শিষ্যদের মধ্যে দান করেন। অতঃপর আবার তপস্যা করার জন্য বনে গমন করলেন, তারই শিষ্য ও উপশিষ্যরা এই সব শাখাভেদ করেছেন।
চারটি বেদ। ছয় বেদাঙ্গ। মীমাংসা, ন্যায়, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ মিলে চোদ্দটি বিদ্যা এবং আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ব বিদ্যা, ও অর্থশাস্ত্র মিলে মোট আঠারো রকম বিদ্যার অস্তিত্ব আছে।
প্রথমে ব্রহ্মর্ষিগণ, ব্রহ্মর্ষিগণ থেকে দেবর্ষিগণ, তাদের থেকে রাজর্ষিগণ-ঋষিদের এই যে তিন ক্রমপর্যায় এঁরা সকলেই ব্ৰতাবলম্বী বলে পরিচিত এই ঋষিদের প্রকৃতিগণ বলে জ্ঞাত।
কশ্যপ, বশিষ্ঠ, ভৃগু, অঙ্গিরা ও অত্রি নামক পাঁচটি গোত্রে সমস্ত ব্রহ্মবাদী ঋষিরা জন্ম নিয়েছেন এঁরা ব্রহ্মার কাছে সমন করেন বলে এঁদের ব্রহ্মর্ষি বলা হয়।
পুলস্ত্য, পুলহ, ধর্ম, ক্রতু, প্রত্যুষ, প্রভাস ও কশ্যপেরক পুত্রগণ দেবর্ষি নামে পরিচিত হন। এবার সেইসব দেবর্ষিদের নাম বলছি শুনুন। দেবর্ষি নর ও নারায়ণ হলেন ধর্মপুত্র। দেবর্ষি বালখিল্য ক্রতুর পুত্র। অচল প্রত্যুষপুত্র। পর্বত ও নারদ কশ্যপের পুত্র। কর্দম পুলহের পুত্র এবং কুবের হলেন পুলস্ত্যের পুত্র। এঁরা দেবতাদের কাছে গমন করেন বলে এঁরা দেবর্ষি নামের অধিকারী।
সবশেষে, মানব, বৈষয় ও ঐড়বংশে জাত নৃপতিগণ, ঈক্ষাবাকুগণ ও নাভাদি পর্বতগণ রাজর্ষি নামে নামাঙ্কিত হয়েছেন। প্রজানুরঞ্জনের জন্য এরা প্রজাদের কাছে গমন করেন বলে এঁদের এই নামে অভিহিত করা হয়।
জন্ম, তপস্যা ও মন্ত্র ব্যবহারের বিভিন্নতার কারণে ব্রহ্মর্ষি, দিব্য রাজর্ষি ও দেবর্ষি হয়ে থাকেন। ব্রহ্মর্ষিরা ব্রহ্মলোকে, দেবর্ষিরা দেবলোকে ও রাজর্ষিরা ইন্দ্রলোকে প্রতিষ্ঠিত হন।
হে দৃঢ়ব্রতা ব্রাহ্মণগণ, এবার এঁদের লক্ষণ বিষয়ে বলছি। শুনুন–ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান এই তিন কালের সবল জ্ঞান ও সত্যবাদিতা সহযোগে যারা স্বয়ং বোধি সম্পন্ন, যাঁরা তপস্যার জন্য প্রসিদ্ধ, যারা গর্ভাবস্থায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করেন, যাঁরা মন্ত্র প্রবক্তা, যাঁরা ঐশ্বর্যবশত সর্বত্রগামী–সেই সব দেবতা, দ্বিজ ও রাজাগণ ‘ঋষি’ বলে জগতে বিখ্যাত হয়ে আছেন। সপ্ত ঋষি সপ্ত জ্ঞানে গরিমান্বিত হয়ে সপ্তর্ষি অভিধায় খ্যাতনামা হয়েছেন।
এঁরা স্বভাবতই দীর্ঘায়ু, মন্ত্রকারী ঈশ্বর, দিব্যচক্ষু, বোধিসম্পন্ন, প্রত্যক্ষধর্মা, গোত্র প্রবর্তক; যজনাদি ছয় প্রকার কর্মে রত। নিত্যশালী, গৃহমেধী হন। এর কর্মবশে অদৃষ্টানুসারে তুল্য ব্যবহার করে থাকেন। এরা স্বয়ং প্রস্তুত আগ্রাম্যরসে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এঁদের এমন অনেকে সমৃদ্ধিবান কুটুম্ব আছেন, যাঁরা দেশের বাইরে ও ভেতরে বাস করেন।
সত্যযুগে এঁরাই প্রথম বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা প্রচলন করেন। যাঁরা সর্বতোভাবে বর্ণাশ্রম ধর্ম প্রবর্তিত করেন। তাদের বংশেই বারবার বীরগণের জন্ম হয়।
পিতা পুত্র বা পুত্র পিতাতে অনেক সময়েই জন্মগ্রহণ করে যাবেন। এইভাবে জন্ম লাভের অবিচ্ছিন্নতা হেতু তারা যুগক্ষয় কাল পর্যন্ত বর্তমান থাকেন।
গৃহশ্রমীরা সংখ্যায় অষ্টআশি হাজার হয়ে থাকেন। এদের আবার দুটি ভাগ–দ্বারহোত্রী এবং অগ্নিহোত্রী। যারা অমার দক্ষিণে পিতৃযান আশ্রয় করে থাকেন, তারা দারহোত্রী, আর যারা প্রজাহেতুর মূল তারা হলেন অগ্নিহোত্রী।
এই যে অষ্টআশি হাজার দারপরিগ্রহকারী যাঁরা শ্মশানে আশ্রয় করেন, তারা সকলেই কিন্তু উত্তরায়ণকালে বিনষ্ট হয়ে যান। যে ঊর্ধ্বরেতাঃ ঋষিগণ স্বর্গগমন করেছেন বলে শোনা যায় যুগান্তকালে তারা পুনরায় মন্ত্র ও ব্রাহ্মণবর্তা রূপে জন্ম লাভ করেন। এই ভাবে দ্বাপর যুগে তাঁদের গমনাগমন বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। তারপর যুগক্ষয় হলে তারা কল্পবিদ্যা, ভাষাবিদ্যা ও নানা শাস্ত্র প্রণয়ন করে থাকেন।
পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে ভবিষ্য দ্বাপরে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা তার কাল অতীত হলে মহাতপাঃ সুব্রত দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস হবেন। সমস্ত ভবিষ্য দ্বাপর যুগ ধরে বেদগ্রন্থের একাধিক শাখা প্রণীত হবে। তাই বেদরূপ ব্ৰহ্ম থেকে ব্রহ্ম এবং তপস্যা দ্বারা অব্যয় পদ লাভ সম্ভব হবে।
তাই সেইসব ঊর্ধরেতা ঋষিগণ ক্রমে তপস্যা দ্বারা কর্ম, কর্ম দ্বারা যশ, যশ দ্বারা সত্য, সত্য দ্বারা অব্যয়, অব্যয় দ্বারা অমৃত এবং অমৃতে সর্বশুক্র লাভ করে থাকেন।
‘ওঁ’ এই একাক্ষর ব্রহ্মা আত্মাতেই বিরাজিত। বৃহত্ব হেতু তিনিই ব্রহ্মরূপে অভিহিত হন।
ব্ৰহ্ম প্রণবে অবস্থিত। তাই-ই আবার ভূঃ ভূবঃ সরঃ নামে অভিহিত। ঋক, সাম, যজুঃ অথর্বরূপী সেই পরম ব্রহ্মকে আমার প্রণাম জানাই।
যিনি অগাধ, যিনি অদ্বিতীয় ও অক্ষয়, যিনি জগৎ সম্মেলনের প্রধান আশ্রয়, যিনি প্রকাশ ও প্রবৃত্তি বলে পুরুষার্থ সাধক, যিনি সাংখ্যজ্ঞানীদের নিষ্ঠাস্বরূপ, যিনি শম-দমের গতি, যিনি অব্যক্ত অমৃত প্রকৃতি ও শ্বাশত ব্রহ্ম, যিনি প্রধান আত্মযোনি গুহ্য ও সত্ত্ব শব্দের দ্বারা পরিচিত, যিনি অবিভাজ্য শুক্র অক্ষর প্রভৃতি শব্দবাচ্য সেই পরমপূজ্য ব্রহ্মকে আমি নিত্য নমস্কার জানাই।
সত্যযুগে ক্রিয়া নেই। তাই অকৃতক্রিয়াও সম্ভব নয়। যা লোকে কৃত এ অকৃতরূপে ব্যবহৃত। তা একবারই করা হয়েছে।
যা কিছু ত্রুত বা শ্রোতব্য, যা কিছু অসাধুতা ও সাধুতা, যা কিছু জ্ঞাতব্য, মন্তব্য, প্রস্যব্য, ভোজ্য, দ্রষ্টব্য, শ্রোতব্য এবং যা কিছু দেবতাদের জ্ঞানরূপে গণ্য সে-সবই ব্রহ্মই প্রদর্শন করেছেন।
কোনো ব্যক্তি যখন যা কিছু করছে, সেই সবই তিনি জানতে পেরে যান! ইনি পূর্বে যা যা কিছু করেছেন, বহুকাল পরে অন্য সে বিষয়ে ভাবতে পারে।
কোনো ব্যক্তি যদি কোথাও কোনো শাস্ত্র প্রণয়ন করেন তাহলেও সেটা যেন তিনিই পূর্ব থেকে স্থির করে রেখেছেন বলে প্রতিভাত হয়।
জ্ঞান ও অজ্ঞান, প্রিয় ও অপ্রিয়, ধর্ম ও অধর্ম, বিরাগ ও অবিরাগ, সুখ ও দুঃখ, মৃত্যু ও মুক্তি, ঊর্ধ্ব অধঃ ও তির্যক–এই তিন প্রকার গতি এবং অদৃষ্ট–পরম ব্রহ্মই এ সব কিছুর মূল কারণ।
সমস্ত ত্রেতা যুগ ধরে জ্যেষ্ঠ স্বায়ম্ভব পরমশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার বারে বারে এক বিদ্যা হয়। পরে সমস্ত দ্বাপর যুগ ধরে সেই একই বিদ্যা বারে বারে বিভক্ত হয়।
বৈবস্বত মন্বন্তরের আদিকালে স্বয়ং ব্রহ্মা এইসব কথা বলে গেছেন। সমস্ত দ্বাপর যুগ বেদবিভাগকারী ঋষিগণ সংহিতা প্রণয়ন করেন। তাদের গোত্র পরম্পরাতেই সেইসব বেদশাখা বারে বারে প্রবর্তিত হয়। আর সেই গোত্রীয় ঋষিগণ যুগক্ষয়ের পরেও সেই সেই শাখা বিভাগ করে থাকেন। বেদ প্রণয়নকারী এইসব ঋষিদের সংখ্যা অষ্টআশি হাজার।
তাদের প্রণীত সংহিতাই যুগে যুগে আবর্তিত হতে থাকে। এদের সম্পর্কে আর সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে সূর্যের দক্ষিণাপথ অবলম্বন করে যারা শ্মশানে আশ্রয় করেন, তারাই যুগে যুগে বারবার এইরূপ শাখা বিভাগ করে থাকেন।
অতীত ও ভবিষ্যৎ মন্বন্তরে বেদপারগ ঋষিগণ এইভাবে বেদশাকার বিভাজন করতে থাকেন।
অতীত ও বর্তমান মন্বন্তর ধরে অতীত শামা এবং অনাগত মন্বন্তরে অনাগত অর্থাৎ ভবিষ্যৎ শাখাসমূহের প্রবর্তন হস্ত।
পূর্বের সাথে পশ্চিমের এবং বর্তমানের সাথে পূর্ব-পশ্চিম উভয়ের প্রবর্তন ঘটে। এইভাবে ক্রমানুসারে মন্বন্তর নিশ্চয় হয়ে থাকে।
দেবগণ, পিতৃগণ, ঋষিগণ ও মনুগণ–এরা বেদমন্ত্রের সাথে উধ্বগমন করেন এবং বেদমন্ত্রের সাথেই আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
দেবতাদের পশুকল্প জনলোক থেকে উপযুক্ত সময়ে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁরা অবশ্যম্ভাবী ভাবে অদৃষ্টকালের সাথে যুক্ত হন এবং অনুরাগ ভরে দোষমুক্ত জন্ম প্রত্যক্ষ করেন। তারপর তারা জনলোক থেকে চিরকালের জন্য তপোলোকে গমন করেন।
এইভাবেই সহস্র সহস্র দেবযুগ অতিবাহিত হয়ে যায়। যেহেতু কাল অনাদি এবং অসংখ্যেয় তাই দেবগণ মুনিগণের সাথে ব্রহ্মালোকে চলে গেলেন ইত্যাদি দিব্য বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আনুপূর্বিক বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়।
কালক্রম অনুসরণ করেই প্রতিটি সৃষ্টি ও যুগসমূহের নিবৃত্তি ঘটে থাকে। এইভাবেই ক্রম অনুসরণ করেই যাবতীয় প্রজাদের সাথে শত শত ও সহস্র সহস্র কল্প ও মন্বন্তর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে।
দিব্য সংখ্যায় যা আট শত সহস্র, অন্য অন্য হিসেবে তা বাহান্ন সহস্রেরও বেশি পরিমাণ মন্বন্তর হয়ে থাকে।
এর চোদ্দগুণে এক প্রলয়কাল হয় এক পূর্ণ সহস্র যুগে ব্রহ্মার একদিন উদ্যাপিত হয়।
দেবতা ও ঋষিদেব সাথে মনুর স্থিতিকাল বিষয়ে একটি বর্ণনার কথা শোনা যায় তা হল–
সূর্যরশ্মিতে সমস্ত জীবজগৎ দগ্ধ হতে থাকলে দেব ঋষি ও দানবেরা ব্রহ্মাকে আগে রেখে দেবাদিদেব মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন। তিনি দেবতাদের সহায় হলে সৃষ্টি রক্ষা পেল। এইভাবে কল্পসমূহের আদিতে দেবদেব মহাদেব নিখিল ভূতের স্রষ্টা হন।
এবার সমস্ত মন্বন্তরের প্রতিসন্ধিকাল সম্বন্ধে শুনুন—
হে দ্বিজসত্তমগণ, আমি পূর্বেই আপনাদের কাছে যে যুগের বিষয়ে বলছি, তা সত্য ক্রেতাদিযুক্ত হয়ে চতুর্যগ নামে চিহ্নিত হয়েছে। একে একাত্তর দিয়ে গুণ করলে যত পরিমিত সময় হয় তাই-ই মনুর অধিকার কাল বলে মনে করতে হবে। কারণ স্বয়ং ভগবান প্রভু ব্রহ্মা এই রূপ নির্দেশ দিয়েছেন, সমস্ত অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎই মন্বন্তরে এরূপ লক্ষণ দৃষ্ট হয়।
এইভাবে আমি স্বায়ম্ভুব মনুর সৃষ্টিকথা বর্ণনা করলাম। এবার অন্য মনুর প্রতিসন্ধি বিষয়ে যথাতত্ত্ব বলব।
এক্ষেত্রেও পূর্ব পূর্ব কল্পের মতো ঋষি ও দেবতাদের সাথে এবং অবশ্যম্ভাবী মন্বন্তরের সাথে মন্বন্তরের নিবৃত্তি ঘটে।
পূর্বে এইসব মন্বন্তরে যে সকল সপ্তর্ষি, দেবপিতৃ ও মনু এই ত্রিলোকে অধীশ্বর ছিলেন মন্বন্তরের সময় পূর্ণ হলে তাদের অধিকার ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে তখন তারা নিজের নিজের পর্যায় উপলব্ধি করে মহর্লোকের প্রতি উন্মুখ পুষেণ গমন করতে থাকেন। ফলে সেই বিশেষ মন্বন্তরে দেবতারা ক্ষীণ হয়ে যান। তখন সম্পূর্ণ স্থিতিকালে একমাত্র সত্য যুগ কালই বলবৎ থাকে। তারপর ভবিষ্যৎ মন্বন্তরের সূত্রপাত ঘটলে অধীশ্বর দেবতাগন পিতৃগণ, ঋষিগণ ও মনু আবার জন্ম নিয়ে থাকেন।
মন্বন্তর কালে কলিযুগ যখন সম্পূর্ণ হয়, তখন যা কিছু অবশিষ্ট থাকে তাতেই সত্যযুগ সম্পন্ন হয়। যেমনভাবে কলিযুগবাসী প্রজা সত্যযুগের প্রথম প্রজা বলে অভিহিত হন, তেমনভাবেই মন্বন্তর সমূহের অন্তিম ভাগের প্রজা অন্য মন্বন্তরের আদিম প্রজা বলে বিবেচিত হয়।
পূর্বের মন্বন্তর যখন ক্ষীণ হয়ে আসে এবং নতুন মন্বন্তরের সূচনা হয়, তখন সত্যযুগের আদিতে অবশিষ্ট সপ্তর্ষিরা মনুর কাল অপেক্ষা করেন অর্থাৎ অপর মন্বন্তরের জন্য প্রতীক্ষা করে থাকেন।
মন্বন্তরের ব্যবস্থার জন্য এবার প্রজাদের উৎপত্তি তারা অর্থাৎ সপ্তর্ষিরা পূর্ব পূর্ব যুগের মতো ত্রিলোকের হিতসাধনে প্রবৃত্ত হন। তারপর পূর্বের মতো ওষধি জন্মাতে আরম্ভ করলে প্রজারাও : কোথাও কোথাও গৃহাদি নির্মাণ করে বসবাস করতে থাকেন।
এই নবীন মন্বন্তরেও যখন ঋষিদের পূর্ব ভাবনা অনুসারে সৎ ধর্ম ও বার্তা শাস্ত্র প্রবৃত্ত হয়, তখন চরাচর বিনষ্ট হয়ে যায়। বর্ণাশ্রমবর্জিত গ্রাম ও নগরগুলি নিরানন্দ হয়ে পড়ে। সেই সময় পূর্ব মন্বন্তর অবশিষ্ট থাকলে সেখানে যে সকল ধার্মিক সপ্তষি ও বেদবিদ মনু সন্তানের জন্য অতি দুশ্চর তপস্যা করেছিলেন তারাই সবকিছুর নিধনের মধ্যে পুনরায় উৎপন্ন হয়ে থাকেন।
এই ভাবে দেবতা অসুর, পিতৃগণ, মুনিগণ, পিশাচগণ, সর্পগণ, ভূতগণ, গন্ধর্ব, যক্ষ ও রাক্ষসগণ ক্রমে উৎপন্ন হন।
মন্বন্তরের আদিতে প্রথমেই ত্রেতা যুগের শুরুতে দেবতা তারপর সপ্তর্ষি, মনু ও মনুষ্যগণ সকলেই ধর্মপথে অবস্থান করতেন। এইভাবে ব্রহ্মচর্য ঋষিদের, সন্তান উৎপাদনে পিতৃদেব ও যজ্ঞেও দেবতাদের ঋণ পরিশোধ হয়ে থাকে। এঁদের মধ্যে যাঁরা আবার শিষ্ট প্রকৃতির তারা কেবল শিষ্টচারের কথাই বলতে থাকেন।
মন্বন্তরের আদিতে সপ্তর্ষিগণ মনু ও মনুষ্যগণ দেবতাদের সাথে কর্ম সম্পাদন করতে থাকেন।
তারা শত-সহস্র বর্ষ ধরে একই বর্ণ ধর্মে অবস্থান করেন এবং ত্রয়ী বার্তা, দণ্ডনীতি ধর্ম ও বর্ণাশ্রম স্থাপনান্তে স্বর্গ গমন করবেন বলে মনঃস্থির করেন।
পূর্বে সেইসব দেবতারাই স্বর্গের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলে প্রথমে দেবতারা, তারপর অন্যরা সামগ্রিকভাবে ধর্ম অবলম্বন করে সেখানেই অবস্থান করতে লাগলেন। পরে যখন মন্বন্তরের পরিবর্তন হল, তখন তারা সর্বভাবে পূর্ব অনুসৃত স্থান পরিত্যাগ করে মন্ত্র উচ্চারণের সাথে সাথে ঊর্ধ্বগমন করেন এবং অনাময় মহর্লোকে স্থান লাভ করেন। তখন তাদের সকল প্রকার মানসিক বিকার বিনষ্ট হয়ে যায়। তারা সংযম পালন করে প্রলয়কাল পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন।
তারপর এসময় এঁরা সকলেও যখন অতীত হলেন, তখন ত্রৈলোক্যের সেইসব দেবস্থান পুনরায় শূন্য হয়ে পড়লে, তখন মনে হতে লাগল যেন অন্যান্য স্বর্গবাসী দেবতারা আবার এখানেই এসে উপস্থিত হয়েছেন।
তখন দেখা যায় তারা আবার তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, সত্যপালন ও বেদ অধ্যয়ন সমন্বিত হয়ে নিজ নিজ স্থান পূরণ করে চলেছেন।
ইহলোকে সপ্তর্ষি মনু ও দেবতাগণ পিতৃগণের সাথে নিধন আদিকালেও যেখন সংঘটিত হয়েছিল, তেমনি ভবিষ্যতেও হবে।
ইহলোক মন্বন্তরের ক্ষয় ঘটলেও তাদের চিরবিচ্ছেদ ঘটে। এইভাবে ক্রমানুসারে সমস্ত মন্বন্তরের প্রলয় কাল পর্যন্ত তাঁদের স্থিতাবস্থা লক্ষ্য করা যায়।
স্বায়ম্ভব বর্ণিত অতীত ও অনাগত মন্বন্তর সমূহের প্রতিসন্ধানের লক্ষণসমূহের এই হল আনুপূর্বিক বিবরণ।
সমুদয় মন্বন্তর অতীত হলে প্রলয়কাল পর্যন্ত তাদের আত্যন্তিক বিচ্ছেদ ঘটে।
মন্বন্তর সমূহের সেইসব পরিবর্তনগুলি প্রথমে একান্তভাবে মহর্লোকে দৃষ্ট হয়। ক্রমে ক্রমে তা মর্ত্যলোক থেকে জনতোক, তপোলোক ও সত্যলোকে গমন করে।
কোনো মন্বন্তরে যে যে বস্তুরাশির উদ্ভব ঘটে বা জন্মায় সেই সেই সময়ে ওইসব লোকসমূহে ওইসব বস্তু দেখতে পাওয়া যায়। এখন ওইসব বস্তুর নানা বিধত্ব দেখা যায় এবং সেই অনুসারে প্রত্যয়ত্ত হয়ে থাকে। প্রতিটি সৃষ্টিকালের বিকারপ্রাপ্তি ঘটলে সেইসব কিছু ইহলোকে সত্যে অবস্থান করে, অপরান্তে মন্বন্তরের পরিবর্তন সমূহ সত্যকে পরিত্যাগ করে তারপর অভিযোগবশতঃ বিষমমূর্তি দেবনারায়ণে প্রবেশ করে।
বিধিবশে মন্বন্তরের পরিবর্তনসমূহ যখন বিলম্বে শুরু হল, তখন ক্ষয় ও উদয়ের দ্বারা নিয়মিত হয়ে জীবনোক ক্ষণকালের জন্য হলে আনন্দে অবস্থান করে।
এইভাবে ঋষিস্তত ধর্মাত্মা দিব্যদৃষ্টি মনসমূহের বায়ু প্ৰণিত সমগ্র উত্তরভাগই ব্যষ্টি ও সমষ্টিরূপে। দৃষ্ট হয়ে থাকে।
রাজর্ষি, মহর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, দেবতা, উরগ, সুরেশ, সপ্তর্ষি পিতৃগণ ও রাজগণ সকলের ক্ষেত্রেই মন্বন্তর সমূহের পরিবর্তনকালে উত্তম পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
যে সকল দেবতারা উদারমনা, বংশাভিজাত্যে দীপ্ত, প্রকৃষ্ট মেধাযুক্ত, কীর্তিমান ও খ্যাতি যুক্ত তাঁদের গুণকীর্তন সব সময় পুণ্যপ্রদ। তাদের কীর্তি কীর্তন করলে স্বর্গসুখ। পবিত্র শান্তি, পুত্রের মতো প্রিয় অনন্ত রহস্যময় পর্বে জপযোগ্য ও মহান দুঃস্বপ্নে স্বস্তি ও পরমায়ু বৃদ্ধি ঘটে।
এই আমি জন্মরহিত প্রজা-ঈশ্বর, দেবর্ষি মনু প্রধানদের সুখশ্রাব্য বংশচরিতাবলি অতিশয় সংযমের সাথে কীর্তন করলাম। এই বর্ণনা শ্রবণ করে আপনারা মহেশতত্ত্ব জ্ঞানে সিদ্ধিলাভ করুন।
স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সকল কিছুই আনুপূর্বিকভাবে বর্ণনা করলাম। এরপর আর কোন্ বিষয়ে জানতে চান বলুন?
.
৫৭.
মহর্ষি শাংশপায়ন বললেন, হে পুরাণতজ্ঞ এ পর্যন্ত যতগুলি মন্বন্তর আছে এবং সেই সেই মন্বন্তরে যে যে বরেণ্যে দেবতা আছেন তাদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে যথাযথভাবে জানতে ইচ্ছা করছি।
লোমহর্ষণ বললেন, যথা ইচ্ছা। অতীত ও ভবিষ্যৎ মন্বন্তর সমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও প্রয়োজনে বিস্তারিত বর্ণনা করছি, শুনুন।
প্রথমে আমি অতীত মন্বন্তর বিষয়ে বলব।
অতীতে যে ছয়জন মনু ছিলেন তারা হলেন–স্বায়ম্ভব, স্বারোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত ও চাক্ষুষ। প্রথমেই স্বায়ম্ভুব মন্বন্তর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বায়ম্ভুব মন্বন্তর বিষয়ে আমি পূর্বেই আলোচনা করছি। তাই এবার দ্বিতীয় মনু যথাত্মা স্বারোচিষের প্রজাসৃষ্টি দিয়েই কথোপকথন শুরু করব।
স্বরোচিষ মন্বন্তরে তুষিত নামে দেবতাসমূহ এবং পারাকত ও বিদ্বান নামে দুই সন ছিলেন। তুষিতার গর্ভে স্বারোচিষ মনুর পুত্র পারাবত ও শিষ্ট জন্মলাভ করেন। এঁরা প্রত্যেকেই বারোজন দেবতা নিয়ে এক একটি গণ গঠন করেন। ছন্দজগণের মধ্যেও চব্বিশজন দেবতা ছিলেন।
ক্রুতাপুত্র বিবস্বান, তোপ, দেবসাধ্য যুগ, অজ, ভগবান, দেব, দুরোণ, মহাবল, আপ, মহাবাহু, মহৌজঃ বীর্যবান, চিকিত্বান, নিভৃত, অংশ প্রমুখ সকলেই ছিলেন সোমপয়ী।
স্বরোচিষ মন্বন্তরের দেবতা ছিলেন সেইসব পরাক্রান্ত পারাবত হোতা ও যস্বা, তারা হলেন প্রচেতা নামক দেবতা বিশ্বদেবগণ, সমঞ্জ, বিশ্রুত, অজিহম, অরিমৰ্জন, অজিহমান, মহীয়ান বিদ্যাবান, মহাভাগ দুই অজোয়া ও মহাবল যবীয়।
সেই সময় সোমপায়ী ও লোক বিশ্রুত চব্বিশ জন দেবতাই ছিলেন।
সপ্তর্ষি ছিলেন বষিষ্ঠপুত্র উজ্জ, স্বব্ব, কাশ্যপ, ভার্গব, দ্রোণ, ঋষভ, অঙ্গিরস, পৌলস্ত্য, দত্ত অত্রি আত্রেয়, নিশ্চল, পৌলহ ও আধ্ববীর প্রমুখ।
স্বারোচিষ মনুর বংশধরদের সময়টি পুরাণে দ্বিতীয় মন্বন্তর বলে খ্যাত। তারা হলেন চৈত্র, কবিরুত, কৃতান্ত, বিভূতি, রবি, বৃহদগুহ ও নব।
সপ্তর্ষিগণ, মনু, দেবগণ ও পিতৃগণ–এই চারজন হলেন মন্বন্তরের মূল ভিত্তি শক্তি। এঁদের মধ্যে প্রজারা বাস করে থাকেন। শাস্ত্রবিদিত সিদ্ধান্ত অনুসারে ঋষিদেব পুত্র দেবগণ দেবগণের পুত্র পিতৃগণ এবং দেবগণের পুত্র ঋষিগণ হলেন সেই মন্বন্তরের প্রজাবৃন্দ। এছাড়াও মনুর পুত্র হলেন ক্ষত্র ও বৈশ্যগণ এবং দ্বিজগণ হলেন সপ্তর্ষিদের পুত্র।
এইভাবে আমি স্বারোচিষ মন্বন্তরের বিষয়ে সংক্ষেপে প্রাথমিক ধারণা প্রদান করলাম। তবে স্বায়ম্ভব স্বয়ং স্বারোচিষ মন্বন্তরের বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে গেছেন। প্রজাদের বিভিন্ন কুলে তার বিবরণীর বহু পুনরুত্তি হয় বলে শত বৎসরেরও এর বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়।
তৃতীয় পর্যায় আসে উত্তম মনুর মন্বন্তর। এই মন্বন্তরে পাঁচটি সন আছে। এবার আমি তাদের বিষয়ে বলব।
উত্তম মন্বন্তরের গণগুলি হল–সুধামাগণ। অন্যান্য বংশরক্ষক দেবগণ। প্রতদনগণ, শিবগণ ও সত্যগণ। বারোজন দেবতাকে নিয়ে একটি গণ গঠিত হয়েছে।
ঈর্ষ, উর্ষ, উজ্জ, ক্ষণ, ক্ষাম, জ্যেষ্ঠ, দম, দান্ত, ধুতি, বপুস্মান ও সত্য–এই দশজনকে নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠা।
অর, জ্যোতি, বৃহদবসু, বিশ্বাত্মা, বিশ্বধা, বিশ্বকর্মা, বিভাব্য, বিরাট যশা, মনস্বন্ত, সহস্রধারক ও শমিতা হলেন বংশরক্ষক দেবগণের বারোজন বন্দিত দেবতা, সুবিও।
অন্য অনাবাধিত, ক্রতু, কেতুমান, দেব, দিক, বসুধিষ্ণু, বিভাবসু, সুধর্মী, যশসী প্রমুখ। প্রতদনগনের দেবতা।
অহিহা, জন্তবাহ, বসুদান, বিষ, প্রতর্দন, যশস্কর, যতি, সুত্তি, সুনয়, সুদান, সুমঞ্জস ও হংসর– এই বারোজন হলেন উত্তম মন্বন্তরের সত্যগণ দেবতা।
মহাত্মা উত্তমের তেরোজন পুত্র ছিলেন। তাঁরা হলেন–অজ, অপ্রতিম, ঔশিজ, দিব্য, দিব্যৌষধি, দেবানুজ, নয়, পরশু, বিনীত মহোৎসাহ, সুকেতু, সুমিত্র, সুবল ও শুচি। এরা হলেন ক্ষত্রদের নেতা এবং তৃতীয় মন্বন্তরের দেবতা।
স্বারোচিষ মনু এই উত্তম মন্বন্তরে তামস মন্বন্তরের সৃষ্টির বিষয়ে বলে গেছেন।
তামস মন্বন্তর চতুর্থ পর্যায়ে কথিত হয়েছে। এই মন্বন্তরে সত্য, স্বরূপ, সুধা ও হরি–এই চারটি গণ বিদ্যমান।
তামস মন্বন্তরে পুলস্ত্যের পুত্রদের মধ্যে পঁচিশ জনকে নিয়ে এক-একটি গণ নির্ধারিত হয়েছে।
মুনিগণ বলে থাকেন, ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা একশত। এর মধ্যে সত্যপ্ৰাণগণ হলেন প্রধান। তামস মন্বন্তরে এইসব ইন্দ্রিয়গণ দেবতা হন এবং সমস্ত দেবতাদের প্রভু প্রতাপবান শিবি সেই সময়ে ইন্দ্র হয়েছিলেন।
তামস মন্বন্তরে সততম সপ্তর্ষি ও অন্যান্য পুণ্যবান ঋষিগণ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এঁরা হলেন ভৃগু বংশীয় হর্ষ, কশ্যপবংশীয় পৃথু, আত্রিবংশীয় অগ্নি, জ্যোতিধামা, ভার্গব, জনুখণ্ড, বনপীঠ, পৌলহ, বশিষ্ঠগোত্র, চৈত্র ও পৌলস্ত।
অবিক্ষ, ঋত, ঋতবন্ধু, খ্যাতি, জনুখণ্ড, দৃদ্রেদ্যত, নর, পৃষ্ঠলোঢ়, প্রিয়ভৃত্য, ভয়, শান্তি প্রমুখ হলেন তামস মনুর দৃঢ়ব্রতা পুক্রান।
চারিষ্ণব মন্বন্তরের পঞ্জব পর্যায়ে দেবতাদের মধ্যে যে বিখ্যাত গণগুলির সমাবেশ ঘটে যায়। এবার সে সম্বন্ধে কিছু কথা শুনুন। এতে ছিলেন অমৃতাভ; ভূতরজা, বৈকুণ্ঠ ও সুমেধা–এই চার দেবতা। আর ছিলেন চরিষি প্রজাপতি বশিষ্ঠের পুত্রগণ এবং চোদ্দোজনকে নিয়ে গঠিত চারটি ভাস্করগণ।
অগ্নি, অমৃত, প্রাত্যতিষ্ঠ, প্রবিরাশী, বাঁচিনোদ, বাদ, প্রাণ, বিপ্র, বারিরার, ভাস সত্র ও সুবা– চারিষব মন্বন্তরে এই চোদ্দটি অমিতাভ গণ ছিল। আর এঁরাই ছিলেন সেই মন্বন্তরের দেবতা।
চারিষ্ণব মন্বন্তরের আরতি ঋত, জেতা, দ্যুতিমান, বিনয় বিরতি বিষ্ণু, যতি, মদ বস, সুমতি, সহ প্রমুখরা আভূত রজোগণ নামে নির্দিষ্ট।
অজেয় কৃশ, গৌর, জয়, দান্ত, নাথ, ধ্রুব, বৃষভেত্তা, বিদ্বান, ভীম, শুচি, যশোদম হলে চারিষ্ণব মন্বন্তবের বৈকুণ্ঠগণ।
অল্পমেধা, অশ্বমেধা, দীপ্তিমেধা, প্রতিমেধা, পৃশ্বি মেধা, ভূয়োমেধা, মেধাতিমি, সত্যমেধা, সর্বমেধাঃ, স্থিরমেধা, যশোমেধা এরা হলেন সুমেধা গণের দেবতা। তাদের সকলেরই ইন্দ্র ছিলেন প্রবল পরাক্রান্ত পুরুষ, বিক্রান্ত পৌরুষ বিভু।
বৈরত মন্বন্তরের ঋষিগণ হলেন অঙ্গিরস, আত্রেয়। ঊর্ধ্বীবাহু, কাশ্যপ, পর্জন্য, পৌলহ, বেদশ্রী, বশিষ্ট, সত্যনেত্র, যজুঃ ও হিরণ্যরামা।
মহাপুরাণ সম্ভাব্য, প্রত্যঙ্গপরহা, বলবন্ধু নিরামিত্র, শুচি, কেতুভৃঙ্গ, দৃঢ় ব্রত–এরা সকলেই হলেন চরিষ্ণব মনুর পুত্র। এবং এই-ই হল পঞ্চম মন্বন্তর।
স্বারোচিষ, উত্তম, তামস ও বৈরত–এরা চারজনেই হলেন প্রিয়ব্রত-র বংশসস্তৃত।
চাক্ষুষ মন্বন্তরের ষষ্ঠ পর্যায়ে যে পাঁচজন দেবগণ রূপে স্মরণীয়, তারা হলেন আদ্য, ভাব্য, প্রসুত, পৃথক মহানুভব ও লেখ। মাতৃনামেরা এদের দেবসৃষ্টি বলে অভিহিত করেন।
অত্রিপুত্র আরণ্য প্রজাপতির পৌত্রেরা দেবগন এঁদের আটজন করে পৌত্রকে নিয়ে এক-একটি গণ হয়।
যারা আদ্য গণ রূপে খ্যাত তারা হলেন অন্তরিক্ষ, অতিথি, প্রিয়ব্রত, বসু, সুমন্তা, শ্রোতা, মন্তা ও জয়।
পদ্মনেত্র, পশ্য, দ্যুতি, মহাসত্ত্ব, মহাফল, সুবেশা, সুমনা, সুপ্রচেতন ও শ্যেনভদ্র হলেন প্রসূতগণ। অর্থপতি, উদ্যান, বিজ্ঞান, বিজয়, মন, সুজয়, সুপরি, সুমতি হলেন ভাবগণ।
অজিস্ট, মহাভাগ, অজিত, দেব, বিজয়, বানপৃষ্ঠ, বিষ্ণু, শাক্যন ও শংকর হলেন পৃথকুগণ। এবার আমি লেখকগণের কথা বলছি শুনুন।
মনোজেব, ধ্রুবক্ষিতি, প্রচেতাঃ, বৃহস্পতি, প্রখাশ, বীর্যবান, অবন, অদ্ভুত ও বাত লেখকগণ রূপে কীর্তিত হয়ে থাকেন। এই দেবগণের ইন্দ্র রূপে ছিলেন মহাবীর্য মনোজেব ।
চাক্ষুষ মন্বন্তরের সপ্তর্ষি হিসেবে ছিলেন অঙ্গিরার পুত্র হবিস্মান অত্রি বংশীয়, মধু কশ্যপবংশীয়, সুধামা পুলস্ত্যবংশীয়, অতিমান পুলহবংশীয়, সহিষ্ণু বশিষ্ঠবংশীয়, বীরজল্প এবং ভৃগু মুনির বংশধর উন্নত।
চাক্ষুষ মনুর পুত্রগণ হলেন অগ্নিৎ, অতিরাত্র, ঊরু, কৃতি, তপস্বী, পরু, সত্যবাক, সুদ্যুম্ন এবং শতদ্যুম্ন এঁরা নয় জন ছাড়াও নডলি মনুর পুত্র অভিমুন্য হলেন চাক্ষুষ মনুর দশতম পুত্র।
বৈবস্বত মনু সেইসব মহাত্মাদের সৃষ্টিকথা বিবৃত করেছিলেন, হে দ্বিজগণ, আমি আনুপূর্বিকভাবে এবং বিস্তারিত ভাবে মনু কথিত সকল কথাই ব্যক্ত করলাম।
শাংশপায়ন সহ অন্যান্য ঋষিরা অনুরোধপূর্বক বললেন–মনুর নিকটাত্মীয়রা কশ্যপ বংশে জন্ম নিয়েছিলেন। তারা ছাড়াও চাক্ষুষ মনুর বংশে অন্য যেসব মহাত্মা জন্মেছিলেন, তাদের বিষয়ে আমাদের যথাযত তত্ত্ব প্রদান করুন।
সূত বললেন, চাক্ষুষ মন্বন্তরের সৃষ্টি রহস্য আমি সংক্ষেপে বলব, শুনুন।
চাক্ষুষ মনুর বংশে বেনপুত্র প্রতাপবান পৃথু, অন্যান্য প্রজাপতিরা, দক্ষ এবং তেসরা জন্মলাভ করেছিলেন। এদের মধ্যে প্রজাপতি দক্ষের পুত্র রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। কারণ স্বায়ম্ভুব মনু অত্রির জন্য তাকে দান করেছিলেন তাই প্রজাপতি অত্রি উত্তানপাদকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন।
হে সংযতাত্মা দ্বিজগণ, সম্প্রতি ভবিষ্যৎ ষষ্ঠ চক্ষুষ মন্বন্তর অবলম্বন করে ভূমিকাসহ আপনাদের কাছে বর্ণনা করব।
উত্তানপাদের সহধর্মিণী হলেন সুনৃতা, ধর্মপত্নী লক্ষীর গর্ভে শুচিস্মিতা শুভবুদ্ধিসম্পন্না এই কন্যা জন্মেছিলেন। তিনিই পরে ধ্রুবের জননীরূপে জগতে বিখ্যাত হন। এ ছাড়াও ধ্রুব উত্তানপদের ঔরসে মহারানি সুনৃতার গর্ভে কীর্তিমান, অরস্নান ও বসু নামে তিন পুত্র ও মনস্বিনী এবং স্বরা নামে দুই কন্যা জন্মান। এই ধ্রুবু ছিলেন স্বায়ম্ভুব মনুর পৌত্র, ত্রেতা যুগের প্রথম দিকে সুমহৎ যশ প্রার্থনা করে তিনি যোগমার্গে আত্মসংযম পালন করেন এবং কঠোর তপস্যা করতে থাকেন।
ধ্রুব ছিলেন মহাত্মা পুরুষ। তিনি প্রায় দিব্য দশ সহস্র বৎসর নিরাহারী থেকে তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় প্রীত হয়ে লোকাধিপতি ব্রহ্মা তাকে প্রলয়কাল পর্যন্ত জ্যোতিষ্কদের মধ্যে উদয়াস্তবিহীন এক মনোরম স্থান প্রদান করেন। দৈত্যাসুর আচার্য শুক্র ধ্রুবের অতিরিক্ত সমৃদ্ধি ও মহিমা দেখে এই শ্লোক গান করেছিলেন “আহো!” ধ্রুবের তপস্যার বীর্য, শাস্ত্রজ্ঞান ও যজ্ঞানুষ্ঠান কত না আশ্চর্যকর! কারণ সপ্তর্ষিরা পর্যন্ত ধ্রুবকে তাদের স্থান দিয়েছেন।
সেই স্বর্গপতি লোকাধিপতী ঈশ্বর ও ধ্রুবের এই দুই পুত্র আকর্ষণ বোধ করেছেন।
সেই ভূমি ধ্রুবের ঔরসে দুটি পুত্র সন্তান উৎপাদন করেন। পুষ্টি ও ভব নামে প্রবের এই দুই পুত্র পরবর্তীকালে রাজা হয়েছিলেন। পুষ্টি তার নিজের ছায়াকেই পত্নী হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সত্যবাদী বিভু পুষ্টি এই বাক্য উচ্চারণ করামাত্র দিব্যকৃতি দিব্যাভরণ ভাষিতা সেই ছায়া সাথে সাথে তার সহধর্মিণী হলেন। এই পুষ্টি ছায়ার গর্ভের পাপশূন্য পুত্র উৎপাদন করেন। তাদের নামগুলি হল–প্রাচীনগর্ভ, বৃষক, বৃক, বৃকল ও ধূতি। প্রাচীন গর্ভের ঔরসে তার পত্নী সুর্বচার গর্ভে উদারধী নামে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। এই উদারধী সম্পর্কে জানা যায় ইনি পূর্বজন্মে ইন্দ্র ছিলেন। তিনি সহস্র বৎসর পরে পরে একবার মাত্র আহার করতেন। এই জন্যই উদারধী কালে তিনি ইন্দ্রত্ব লাভ করেন। উদারধী এই জন্মেও পরবর্তীকালে রাজা হয়েছিলেন।
উদারধীর পত্নী হলেন ভদ্রা, ভদ্রার গর্ভের উদারধীন নামে এক পুত্রসন্তান জন্মায়। দিব্যঞ্জয় নামে সেই পুত্র বহু দিব্য গুণের অধিকারী ছিলেন। বরাঙ্গী নামে সুলক্ষনা কন্যা দিব্যঞ্জয়ের ঔরসে রিপু নামে একটা পুত্রসন্তান প্রসব করেন। রিপুর ঔরসে বৃহতীর গর্ভের গুণবান সর্বতেজার চাক্ষুষ জন্মগ্রহণ করেন। মহাত্মা চাক্ষুষ অরণ্য প্রজাপতির কন্যা বারুণীকে পত্নীরূপে বরণ করেন।
এই বারুণী পুষ্করিণীতে মনু নামে এক পুত্রের জন্ম দেন। মনুর পত্নী হলেন মহাভাগ বৈরাত প্রজাপতির কন্যা নাঙ্কালা। নাষ্কালার গর্ভে মহাত্মা সংযতাত্মা মনুর দশ-দশটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। এই মনু পুত্ররা হলেন–ঊরু, পুরু, শতদ্যুম্ন, তপস্বী, সত্যবাক, কবি, অগ্নিষ্ঠুৎ অতিরাত্র, সুদ্যুম্ন ও অভিমন্যু। উরুর ঔরসে আত্রেয়ীর গর্ভে অঙ্গ, অঙ্গ রস, ক্রতু, সুমনা, স্বাতী ও শিব নামে ছয়টি মহাপ্রভাবশালী পুত্র জন্মায়। অঙ্গেয় ঔরসে সুনীথার গর্ভে বেণ নামে এক মহাতেজাঃ পুত্র জন্মায় তবে তিনি ছিলেন অত্যাচারী।
তাঁর দুনিবার দুর্ব্যবহারে রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ দেখা দেয়। তখন বেণ-এর অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবার উপায় হিসেবে ঋষিগণ বেণের সন্তান লাভের কামনায় তার দক্ষিণ বাহু মন্থন করেন। বেণের দক্ষিণ বাহু মথিত হলে তা থেকে বৈণ্য নামে এক সন্তান জন্ম নিলেন। ইনি পরবর্তীকালে রাজা হয়েছিলেন। রাজা হিসাবে ‘ইনি পৃথ’ নামে পরিকীর্তিত হন।
জন্মকালে মহারাজা পৃথু, ধনুক ও কবচ ধারণ করেই স্বতেজে প্রজ্বলতি হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম সর্বলোক রক্ষা করেছিলেন। এছাড়াও সেই বেণপুত্র রাজাধিরাজ পৃথু রাজসূয় যজ্ঞে অভিষিক্ত। রাজাদের মধ্যেও আদি তার স্তবের জন্য স্তোত্রনিপুণ সুত ও মাগধ জাতি উৎপন্ন হয়।
সেই ধীমান মহারাজ বেণপুত্র বৈন্যস্বীয় প্রজাদের ভরণ-পোষণের জন্য গোরূপধারিণী বসুন্ধরা থেকে শস্যদুগ্ধ দোহন করেছিলেন। এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন দেবগণ, ঋষিগণ, পিতৃগণ, দানব, গন্ধর্ব, অস্পরা, লতা, পর্বত এবং অন্যান্য পুন্যাত্মা ব্যক্তিবর্গ। তাদের অভীষ্ট সেই সেই পাত্রে পৃথিবীকে দোহন করা হয়। এইভাবে রাজা পৃথু ইচ্ছামতো প্রজাদের দুগ্ধ করলেন এবং এতে সকলের জীবিকা নির্বাহ হয়।
এতদূর পর্যন্ত শ্রবণ করে উপস্থিত ঋষিগন বলে উঠলেন, হে মহামতি পৃথুর জন্মবৃত্তান্ত আপনি বিস্তারিত বলুন। কীভাবেই বা সেই মহাত্মা প্রবলপুরুষ বসুমতিকে দোহন করেছিলেন সে কথাও বলুন। পূর্বকালে এই কাজে কোন্ কোন্ পাত্র ব্যবহার করা হয়েছিল দোহনকর্তা কে ছিলেন? কোন বস্তু ক্ষীর হয়েছিল? কারা হয়েছিল বৎস? হে সূত এই সব বিষয়ে জানতে আমরা আগ্রহ বোধ করছি। আপনি সব কথা বিস্তারিত ভাবে বলুন। আরও বলুন ঠিক কী কারণে মহর্ষিগণ ক্রুদ্ধ হয়ে বেণের বাহু মন্থন করেছিলেন।
লোমহর্ষণ সূত বললেন, হে দ্বিজোত্তমবৃন্দ বেণের পুত্ররূপে পৃথুর জন্ম অতি রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়। আমি সেই উৎপত্তি-রহস্য আপনাদের কাছে ব্যক্ত করছি। আপনারা একাগ্র চিত্তে সংযতভাবে সব কথা শ্রবণ করুন।
হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ, জেনে রাখুন সকলে এই বৃত্তান্ত শোনার অধিকার অর্জন করতে পারেন না। যাঁরা অশুচি, পাপমতি, অশিষ্ট্য, অহিতকারী ও প্রতহীন, তাঁরা এই পুণ্যকথা শোনার যোগ্য নন, এ অতি পবিত্র পাপহর গাথা। যে ব্যক্তি সাভিনিকেশ সহকারে অসূয়াহীন মনে ঋষিকথিত এই স্বর্গপ্রদ, যশস্কর আয়স্কর পুণ্য ও বেদসম্মত কাহিনী শ্রবণ করেন এবং মর্ত্যলোকবাসী ব্রাহ্মণদের নমস্কার করে বেণপুত্র পৃথুর জন্ম ইতিহাস শ্রবণ করেন তাকে কোনোদিন তার কৃত কাজ ও অকাজের জন্য শোক করতে হয় না।
অত্রিবংশে অঙ্গ নামে এক প্রজাপতির জন্ম হয়েছিল, বেণ হলেন তারই পুত্র। বেণের মতো অতি ধার্মিক সমসাময়িক পৃথিবীতে আর কেউ ছিলেন না। প্রজাপতি অহগ মৃত্যুর কন্যা সুনীথাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন, প্রজাপতির ঔরসে এই সুনীথার গর্ভেই বেণ জন্মগ্রহণ করেন। রাজা বেণ তাঁর মাতামহের দোষে ধর্মকে অবগত করতে শুরু করেন। নিজের হীন কামনা চরিতার্থ করার জন্য তিনি লোভানলে জড়িয়ে পড়েন। ফলে অচিরেই ধর্মবিচ্যুত হয়ে অধর্মকে তার রাজ্যে স্থাপন করেন।
এইভাবে অঙ্গপুত্র বেণ বেদশাস্ত্রসম্মত নিয়মনীতি অতিক্রম করে অধর্ম কাজে রত হলেন। তার শাসনকালে প্রজারা বেদ অধ্যয়ন, কষ্টকারযুক্ত যাগযজ্ঞাদি সব পরিত্যাগ করেছিল। ফলে সেই সময় দেবতারা যাগযজ্ঞে আহুত সোম পান করতে পারতেন না।
এই ধরনের অধার্মিক কাজের ফলে বেণের বিনাশ কাল ঘনিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত অহংকার আর ক্ষমতার গর্বে রাজা বেণ একটি ক্রুর প্রতিজ্ঞা করলেন। তিনি বললেন, আজ হতে আমি আর কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞ বা হোম করব না। আমার প্রজারাও করবে না। বরং দ্বিজগণ সমস্ত যজ্ঞে আমারই যজন করবে, আমারই পূজা করবে। এই রাজ্যে কেবল আমারই উদ্দেশ্যে যজ্ঞ হবে। কেবল আমারই উদ্দেশ্যে হোম হবে।
রাজা এই অনুচিত কার্যে প্রবৃত্ত হলেন, মরীচি প্রমুখ বেদবিদ মহর্ষিরা তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারা বললেন–আপনি যা অনাচার প্রবর্তন করতে চাইছেন, তা সনাতন ধর্ম নয়। আপনি নিঃসংশয়ে নিজের নিধনের পথ প্রশস্ত করছেন।
ব্রহ্মজ্ঞাণী ঋষিদের এই সদুপদেশ বেণ তাচ্ছিল্যবাগীশ রাজা, উপরন্তু তাদের বললেন, আমিই হলাম ধর্মের সৃষ্টিকর্তা। আমি আর অন্য কারো কথাই শুনব না। এই পৃথিবীতে আমার মতো বেদশাস্ত্রজ্ঞ, তপোসম্পন্ন বীর্যবাণ ও সত্যবান পুরুষ আর কেউ নেই। আপনারা সর্বান্তকরণে আমাকেই মহাত্মা তথা সর্বলোকের উৎস বলে জানিবেন।
আমি ইচ্ছামাত্র পৃথিবীকে দগ্ধ করতে পারি, আমি ইচ্ছামত পৃথিবীকে জলপ্লাবিত করতে পারি, চাইলে সৃষ্টি করতে পারি, অথবা প্রলয়ও ঘটাতে পারি। আপনারা আমার ক্ষমতার প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ রাখবেন না।
অভিমানে অতিমানে বেণের মতিভ্রম দেখা দিল, ঋষিগণ বারংবার সংশোধনের পথে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। একসময় তারাও রাজা বেণের আচরণে ক্রুদ্ধ হলেন। তারা ক্রোধবশত অগ্নির মতো বিস্ফারিত হলেন, এবং সেই মহাবলশালী মহাবাহুকে নিগৃহীত করতে লাগলেন। তারা রাজা বেণের বাম বাহুকে মন্থন করতে লাগলেন।
রাজা বেণের বাম বাহুর মন্থন চলাকালে পূর্বেকার যজ্ঞে প্রতিশ্রুত এক অতিহ্রস্ব কৃষ্ণবর্ণের পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। এই অনন্তবিক্রম লোকটিই নিষাদবংশের পূর্বপুরুষ।
আর্বিভূত হওয়ার পর সেই খর্বাকৃতি মানুষটি ভীত ত্রস্ত ও ইন্দ্রিয়াকুল হয়ে ইতস্তত অঞ্জলিবদ্ধভাবে অবস্থান করতে লাগলেন। ঋষিগণ তার আত্মবিহ্বল দশা দেখে তাকে বললেন, নিষাদ অর্থাৎ উপবেশন করো।
উপবিষ্ট হয়ে সেই অমিততেজাঃ ব্যক্তি বেণের পাপ-উৎপন্ন ধীবরদের সৃষ্টি করলেন। বেণকৃত পাপ থেকে আরও যারা উৎপন্ন হল, তারা হল অধর্ম, রুচি, বিন্ধ্যনিবাসী তুম্বুর, তবুর এবং খস।
বেণের প্রতি ক্রুদ্ধ সেইসব মহর্ষিরা তখন আবার বেণের দক্ষিণ বাহু অরণির মতো মন্থন করতে লাগলেন। সেই মথিত দক্ষিণ বাহুর তেজোরাশি থেকেই পৃথু জন্মগ্রহণ করলেন। স্কুল করতল হতে জন্ম নিয়েছিলেন বলে তার নাম হয় পৃথু।
জন্মের সময় পৃথুর শরীর আগুনের মতো প্রজ্বলিত হয়ে দীপ্তি পেতে থাকে। তিনি প্রজাগণকে রক্ষার জন্য প্রথমেই মহারবকারী “আজগব” নামে ধনুঃ, বৃহশ্বর এবং মহাপ্রভাজ্জ্বল কবচ ধারণ করলেন।
পৃথুর জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বেণরাজ স্বর্গে গমন করলেন। জগতের সকল প্রাণী আনন্দিত হল। তিনি সৎপুত্রের জন্মদানের মাধ্যমে “পুত” নামক নরক থেকেও পরিত্রাণ লাভ করলেন।
বেণপুত্র আদিরাজ প্রতাপবান মহারাজ পৃথু অঙ্গিরাপুত্র দেবতাদের দ্বারা অভিষিক্ত হলেন। নদী ও সমুদ্ররা বহু ধনসম্পদ এনে তাকে ভূষিত করলেন। মর্তবাসী ধন্য হল।
পিতা বেণ প্রজানুরঞ্জনে সমর্থ হননি। পৃথু কিন্তু প্রজাবর্গের অনুরঞ্জন করতে লাগলেন তাই প্রজারাও অনুরাগবশত তাকে “রাজা” উপাধি প্রদান করলেন।
পৃথু ছিলেন সকলেরই প্রিয়। তিনি যখন সমুদ্রে যেতেন, তখন জলরাশি স্তম্ভিত হত। যখন পর্বতে যেতেন পর্বত বিদীর্ণ হত। তিনি চিন্তা করামাত্র অন্ন পাওয়া যেত। তাঁর সমস্ত ধেনুই ছিল কামধেনু। প্রতিপটপুটে পাওয়া যেত সুমিষ্ট মধু।
তার আমলে অনুষ্ঠিত মহাযজ্ঞে সৌত্যদিনে যজ্ঞের অভিষবভূমিতে মহামতি সূত ও প্রাজ্ঞ মাগধ নামে দুই জাতি জন্ম নিয়েছিল।
ইন্দ্রের হবির সাথে বৃহস্পতির হবিঃ মিশ্রি করে দেবপ্রধান ইন্দ্রের উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হয়। তার থেকেই জন্ম লাভ করে সূত জাতি। আর দেবগুরু বৃহস্পতির হবিঃ ও শিষ্যশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রের হবির মিশ্রণে প্রদত্ত আহুতিতে উত্তম ও অধমের সংযোগে বিকৃত বর্ণ মাগধ জাতির উদ্ভব ঘটল। এই সময় থেকেই যাগদিকর্মে প্রসাদনিমিত্ত প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা চালু হয়।
এইভাবে হীনযোনি ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণীতে ‘সূত’ জাতি উৎপন্ন হল। পূর্ব পূর্ব জাতির নিজ নিজ ধর্মানুসারে এই নবসৃষ্ট সূত জাতির ধর্ম নিরূপিত হল।
তদনুসারে রথ, হস্তী, অশ্বশিক্ষা, এক ক্ষত্রিয় ধর্মমতে জীবিকা নির্বাহ করা সূত, জাতির পক্ষে মধ্যম ধর্ম এবং চিকিৎসা কার্যসমূহ অধম ধর্ম রূপে স্বীকৃত হল।
দেবর্ষিরা নবোদ্ভূত সূত ও মাগধ জাতিকে আহ্বান করে তাদেরকে পৃথুর স্তব করার নির্দেশ দিলেন। তারা বললেন, ইনি সংশয়াতীতভাবে স্তবের যোগ্য। তোমরা এঁর স্তব করো।
সূত ও মাগধ প্রত্যুত্তরে ঋষিদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, আমরা দেবতা ও ঋষিদের শ্রেষ্ঠ কর্মাবলি জানি, সেই সেই কর্মের স্তুতি করে আমরা তাদের প্রতিবর্ধন করতে পারি। কিন্তু হে দ্বিজসত্তমগণ, আমরা যে এই তেজস্বী রাজার কর্ম, লক্ষণ, যশ, কোনো কিছুই জানি না। তবে কী প্রকারে আমরা তার স্তুতি করব?
ঋষিরা তাদের দুজনকে ভবিষ্যৎ কর্ম দ্বারা পৃথুর স্তব করার নির্দেশ দিলেন।
মহারাজাধিরাজ পৃথু প্রকৃত অর্থেই সত্যবান, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানশীল, বদান্য ও সংগ্রামে অপরাজিত ছিলেন। তিনি নিয়তই দানকর্মে নিরত থাকতেন। মহাবল পৃথু যে যে কর্ম করতেন, সূত ও মাগধ সেই সেই অনুসারে তার স্তবগান করতেন। যেহেতু সেইসব কর্মাবলি ছিল পৃথুর স্বাভাবসিদ্ধ, তাই সূত ও মাগধের কীর্তিত স্তুতিও নিরন্তর হয়ে উঠল। প্রজানাথ পৃথু তাদের স্তরে সন্তুষ্ট হয়ে সূতকে অনুপদেশ এবং মাগধকে মগধদেশ দান করলেন।
সেই থেকে সূত ও মাগধবাসীরা রাজাদের স্তব করে চলেছেন এবং সূত ও মাগধ বন্দিদের আশীর্বাদমূলক গানে রাজাদের জাগরণ ঘটে চলেছে।
বেণপুত্র পৃথুর কার্যাবলি প্রত্যক্ষ করে পরমপ্রীত প্রজাদের প্রতি সেইসব মহর্ষিরা বললেন, এই নরাধিপ হলেন বেণের পুত্র। ইনিই তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থা করবেন।
মহর্ষিদের আশিষ বচন শুনে আহ্লাদিত প্রজাগণ তাদের অন্নজীবিকা সংস্থান কল্পে মহারাজ বৈণ্যের দিকে ধাবিত হলেন।
প্রজারা নিজেদের হিতকামনায় মহারাজের উদ্দেশে ছুটে গেলে সেই বলশালী রাজা বৈণ্য ও প্রজা সকলের মঙ্গলকামনায় ধনুর্বান ধারণ করে পৃথিবীকে প্রহার করতে লাগলেন। পৃথিবী সেই তীব্র প্রহার সহ্য করতে না পেরে গো-রূপ ধারণ করে বেগে পলায়ন করলেন। পৃথুও তার পশ্চাদধাবন করলেন। পৃথুর পরাক্রান্ত পৌরুষের হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায় সেই পৃথিবী ব্রহ্মালোকাদি নানা লোকে গমন করলেন। কিন্তু সর্বত্রই বেণুপুত্র বৈণ্যকে উদ্যত ধর্নধারণ করে সামনে উপস্থিত দেখলেন।
প্রজ্জ্বলিত শিখাযুক্ত অসংখ্য শরে দীপ্ততেজাঃ অচ্যুত মহাযোগী মহাত্মা এবং দেবতাদেরও দুর্ধর্ষ সেই বৈণ্য পৃথুকে দেখে ত্রাণহীনা পৃথিবী উপায়ান্তর না দেখে সেই পৃথুরই শরণাপন্ন হলেন। ত্রিলোকপূজিতা সেই পৃথিবী কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন–হে রাজন, এক্ষণে স্ত্রীবধে আপনি কি কোনোই অধর্ম দেখছেন না! আমাকে ছাড়া আপনি কিভাবেই বা প্রজারক্ষা করবেন? পুরাণ/১৩
হে রাজাধিরাজ, আমাতেই লোকসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত। আমিই বিপুলা এই জগৎ ধারণ করে আছি, আমি না থাকলে প্রজারা বিনাশপ্রাপ্ত হবে।
হে রাজসত্তম, আপনি যদি সত্যই প্রজাদের মঙ্গল করতে চান, তাহলে আমাকে বধ করা আপনার উচিত হবে না। আপনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হন। আপনি নিশ্চয়ই অবহিত আছেন যে উপায়কে অনুসরণ করে যদি সমস্ত কাজ আরম্ভ করা যায় তবে সেইসব কাজ অবশ্যই সিদ্ধ হয়। প্রজাপালন বিষয়ে আমি হলাম এমনই এক উপায়। আমাকে বধ করলে আপনি কোনো অবস্থাতেই প্রজাহিত সাধনে সফল হবেন না।
হে দ্যুতিমনি মহাত্মা, আপনি আমার সহায় হলে আমি প্রজাদের অন্নস্বরূপ হব। আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন।
হে রাজন, তির্যগযোনিদের মধ্যেও যাঁরা স্ত্রীজাতি, তারা সকলের অবধ্য। এই কথা বিবেচনা করেও অন্তত আপনি ধর্ম ত্যাগ করবেন না।
সেই মহাভাগ ধর্মাত্মা রাজা পৃথিবীর কাছ থেকে এইরকম বহুবিধ কথা শুনলেন। তাঁর ক্রোধ সংবরণ হল। তিনি বললেন, হে দেবী, নিজ অথবা পর একজন মাত্র ব্যক্তির জন্য বহুসংখ্যক প্রাণ। হত্যা করা নিঃসন্দেহে মহাপাতক। কিন্তু একজন অভদ্রের অর্থাৎ ক্ষতিকারকের নিধনে যদি বহু লোকের সুখ হয়, তাহলে তাকে বধ করলেও পাতক বা উপপাতক কোনো পাপই হয় না।
হে বসুন্ধরে, একথা বলার তাৎপর্য এই যে, আপনি যদি আমার ইচ্ছা অনুসারে জগৎ তথা প্রজাবর্গের মঙ্গল না করেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ প্রজামঙ্গল সাধনের নিমিত্ত আমি অবশ্যই আপনাকে বধ করব।
হে ত্রিলোকের পূজিতা দেবী, আপনি যদি আমার আদেশ পালনে স্বীকৃত না হন, তাহলেও আমি এখনই আপনাকে বাণ নিক্ষেপ করে বধ করব। এবং এইভাবে নিজেকে সুবিস্তৃত করে প্রজাদেরও করব।
এরপর সেই মহাবলী পৃথু আদেশ দিলেন, হে ধার্মিকশ্রেষ্ঠা, আপনি এই মুহূর্তে আমার আদেশ শিরোধার্য করে প্রজাদের সঞ্জীবিত করুন, এই ব্যাপারে আপনি যে কতখানি পারদর্শী তা আমার অবগত আছে।
হে ঘোরদর্শনে আপনি আমার কন্যাত্ব গ্রহণ করুন। আপনার দিক থেকে এটিই যথার্থ হবে। আমি আজ হতেই আপনাকে ধর্মের কাজে নিযুক্ত করলাম।
বেদশাস্ত্রজ্ঞ বৈণ্যের মুখে ওই সংকল্পের কথা শুনে সতী পৃথিবী উত্তরে বললেন, রাজন্ আপনি নিশ্চিন্ত হোন। আমি এই কাজ করব।
হে ধার্মিকশ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে বৎস দান করুন। এর ফলে আমি সন্তানবৎসলা হয়ে দুগ্ধদান করতে পারব। আপনি এখন ব্যবস্থা করুন যাতে আমি সর্বত্র সমানভাবে দুগ্ধক্ষরণ করতে পারি।
দেবী পৃথিবীর এই কথা শুনে রাজা পৃথু ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে উখিত শিলারাশি অপসারিত করেন। তাতে শৈলর শির উপরিভাগ মসৃণ হয়ে ওঠে। এর আগে মন্বন্তরগুলি অতীত অতীত হলে বসুন্ধরা স্বভাবতই বন্ধুর হয়ে পড়েছিল। এতদিনে সেইসব স্থান সমতা লাভ করল।
পূর্বে সৃষ্টির আদিকালে সেই বন্ধুর পৃথিবীতে নগর, গ্রামাদির বিভাগ শস্য, গোরক্ষা, কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি কিছুই ছিল না। এবার বৈবস্বত মন্বন্তরে এসে সেই সব কিছুর নবভাবে উৎপত্তি হল। অবশ্য চাক্ষুষ মন্বন্তরে এসবের মস্তিত্ব ছিল।
বৈবস্বত মন্বন্তরে রাজা পৃথুর ধণুৰ্চালনোর ফলে অসমতল ধরিত্রী যেখানে সেখানে সমতল হল, সেখানে সেখানেই এই যুগের প্রজারা বাসস্থান গড়ে তুললেন।
এই মর্ত্যলোকে বেণুপুত্রের সময় থেকেই প্রজাদের হিতার্থে ফলমূলাদি উৎপন্ন হতে থাকে।
পূর্বে ওষধিসমূহ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই রাজা পৃথু চাক্ষুষ মনুকে স্মরণ করে তাকে বৎসরূপে কল্পনা করলেন। এইভাবে বহু কষ্টে তিনি পৃথিবী থেকে শস্য দোহন করে প্রজাদের পালন করলেন। একই সঙ্গে তিনি বসুন্ধরা থেকে ভূমিপাত্র শস্যদুগ্ধ দোহন করলেন। তখন তার রাজ্যবাসী পূজারা সেই অন্ন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন।
এরপর ঋষি সত্তমদের সমবেত স্তব-স্তোত্র পাঠে আবার বসুন্ধরার দোহন শুরু হল। এইবার দোগ্ধা, হলেন বৃহস্পতি, বৎস হলেন চন্দ্র, পাত্র হলো গায়ত্র্যাদি বেদ, আর দুগ্ধ হল শাশ্বত তপোব্রহ্ম।
এরপর ইন্দ্র সহ অন্যান্য দেবগণ আবার স্তবপাঠে বৃত হলেন। তারা সুবর্ণময় পাত্রে অমৃতরূপ দুগ্ধ দোহন করলেন। আর তা থেকেই ইন্দ্র প্রমুখ দেবগণের জীবিকা নির্বাহ হল।
নাগগণও স্তব দ্বারা পৃথিবীর ভূমিভাগ থেকে বিষদুগ্ধ দোহন করলেন। নাগগণের ক্ষেত্রে বাসুকি হলেন দোগ্ধা। কপুত্রগণ সেই দুগ্ধ পান করে মহাতেজঃ সম্পন্ন হয়ে উঠলেন। নাগ একা সমগ্র সর্পকুল ওই দুগ্ধ পান করে জীবনধারণ করলেন। এর ফলে অচিরেই তারা উগ্র মহাকায় ও ভয়ংকর হয়ে ওঠেন।
হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ ওই বিষদুগ্ধকেই নাগ ও সর্পকুলের আহার, আচার, বীর্য ও আশ্রয় বলে জানবেন।
যক্ষগণও পৃথিবী দোহনে অংশ নিলেন। তারা বৈশ্রবণ কুবেরকে বৎস কল্পনা করে তাম্রপাত্রে অন্তর্ধান দুগ্ধ পৃথিবী থেকে দোহন করেন। এই কাজে মুনিবরের পিতৃদেব জহুনাভ হয়েছিলেন দোগ্ধা, এই দোগ্ধা ছিলেন যক্ষপুত্র, মহাতেজশালী বশী ও মহাবল। এইভাবেই যক্ষরা জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন।
তারপর রাক্ষস ও পিশাচগণও বসুধা দোহন শুরু করেন। তাদের ক্ষেত্রে ব্রহ্মোপেত হলেন দোগ্ধা, কুবেরক হলেন বৎস ও রক্ত হল দুগ্ধ। রাক্ষসদের দোহনকালে বলবান সুমালী দোগ্ধা হলেন যে রক্ত দুগ্ধ হয়েছিল, তাই দিয়েই রাক্ষসরা জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন।
গন্ধর্বগণ ও অপ্সররা চিত্ররথকে বৎস কল্পনা করে পদ্মপাত্রে শুচিগন্ধ দুগ্ধ দোহন করেন। তাদের মধ্যে বিশ্বাবসু ছিলেন দোগ্ধা। সে-সময়ে গন্ধর্বরাজ বিশ্বাবসুর মতো অতিবল মহাত্মা ও সূর্যতুল্য তেজের অধিকারী আর কেউ ছিলেন না।
এরপর আবার শলরা স্তব দ্বারা সন্তুষ্ট করে দেবী বসুন্ধরাকে দোহন করেন। এই দোহনের ফলে মূর্তিমতী ওষধি ও বিবিধ রত্ন লাভ হয়। এক্ষেত্রে শৈলরাজ হিমালয় হয়েছিলেন বৎস, মহাগিরি মেরু হয়েছিলেন। দোগ্ধা, শৈল হন পাত্র। দোহনের পরে সেইভাবেই শৈলসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়।
বৃক্ষলতারা যখন দোহন করতে এলেন, তখন কামপ্রদ পুষ্পিত শৈল হয়েছিলেন বৎস, পলাশ হল পাত্র, ছিন্ন প্ররোহণ হয় দুগ্ধ। এছাড়া ভূতভাবিনী যশস্বিনী সর্বকামপ্রদ পৃথিবী স্বয়ং ধেণু হয়েছিলেন।
সূতমুখে এই বিশাল বৃত্তান্তে আনুপূর্বিক বিবরণ শুনে হৃষ্টচিত্ত ঋষিগণ বললেন, হে পুরাণজ্ঞ সূত, আমরা শুনেছি, এই বসুন্ধরাই ধাত্রী ও বিধাত্রী হয়ে সর্বলোক ধারণ করেন। মহারাজ বেণপুত্র পৃথু লোকহিতার্থে পৃথিবীকে দোহন করেন, যার ফলে লোকচরাচরের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল, একথা কি যথার্থ?
.
৫৮.
প্রত্যুত্তরে সূত বললেন–পণ্ডিতদের মুখে এমন কথাও শোনা যায়, এই পৃথিবী সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এই পুণ্যপ্রদ ভূমিভাগ বসু অর্থাৎ ধন ধারণ করেন বলে এর নাম রাখা হয়েছে বসুধা, এছাড়া এই পৃথিবীতল মেদিনী নামেও পরিচিত। বলা হয়, পূর্বমধু ও কৈটভ নামে দুই দানবের মেদে পৃথিবী সমুদ্র পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। তাই সন্নিহিত ভূ-ভাগ হল “মেদিনী”, পরে ধীমান ধেন্য অর্থাৎ রাজা পৃথুর দুহিতৃত্ব স্বীকার করেছিলেন বলে তার নাম হয় পৃথিবী।
মহারাজা পৃথু এই পৃথিবীকে কন্যারূপে গ্রহণ করে তাকে মানব কল্যাণের কাজে নিযুক্ত করলেন। তিনি বসুন্ধরার আয়তনের বৃদ্ধি ঘটালেন। তার শোভা বর্ধন করলেন। বসুন্ধরা হয়ে উঠলেন শস্যের ও নগরাদির আকর। রাজা পৃথু চতুবর্ণযুক্ত পৃথিবীর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করলেন।
প্রজাকল্যাণের নিমিত্ত সদা তৎপর থাকতেন রাজা পৃথু। তিনি ছিলেন সমস্ত প্রাণীর নমস্য ও পূজ্য। যতভাবে বললাম তার চেয়েও বুঝি শতগুণে প্রভাবশালী ছিলেন রাজা বৈণ্য। যথার্থই তিনি ছিলেন নৃপসত্তম।
অতএব, বেদবেদাঙ্গপারগ মহাভাগ ব্রাহ্মণদের অবশ্য কর্তব্য হল ব্রহ্মযোনি সনাতন পৃথুকে নমস্কার কর।
যে সমস্ত মহাভাগ রাজাগণ মহৎ যশ প্রার্থনা করেন, তাদেরও কর্তব্য আদিরাজ প্রদাপবান বৈণ্যকে নমস্কার করা।
যে সমস্ত রণকুশল যোদ্ধা সংগ্রামে সতত জয় প্রার্থনা করেন, সেইসব যোদ্ধাদেরও মানুষের আদিকর্তা পৃথুকে নমস্কার করা উচিত।
বলা হয়, যে যোদ্ধা পৃথুর নাম স্মরণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করেন, তিনি ঘোর সংগ্রামে কতুশলী ও কীর্তিমান হয়ে থাকেন।
মহান বৃত্তিদাতা মহাযশাঃ রাজা বৈণ্য, সকল বৈশ্যবৃত্তি অবলম্বনকারীদের কাছেও নমস্কার্য ছিলেন।
আমি ক্রমে ক্রমে বৎসপিশষের কথা, দেগ্ধোগণের কথা, দুগ্ধের কথা, পাত্রের কথা, সকলই বললাম।
পুরাকালে মহাত্মা ব্রহ্মা সর্বপ্রথম পৃথিবীকে দোহন করতে শুরু করেন। তিনি একাজে বসুকে বৎস কল্পনা করে পৃথিবী থেকে বহুপ্রকার বীজরূপ দুগ্ধ দোহন করেন।
তারপর আবার স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে পৃথিবীকে দোহন করা হয়। এবার বৈণপুত্র পৃথু স্বায়ম্ভুব মনুকেই বৎস কল্পনা করে পৃথিবীকে দোহন করেন।
তারপর স্বারোচিষ মন্বন্তরে পুরাকালে স্বারেচিষ মনুকে বৎস কল্পনা করে ধীমান চৈত্র পৃথিবী থেকে শস্য দোহন করতে উদ্যোগী হন।
উত্তম মন্বন্তরে সর্বত্তম দেবভূজ মনুকে বৎসরূপে কল্পনা করে ধীমান সর্বোত্তম পৃথিবী থেকে সর্ব শস্য দোহন করেন।
পঞ্চম তামস মন্বন্তরে বলবন্ধু তামসকে বৎস করে পুরাণ পৃথিবী দোহন করেন। তারপর চাক্ষুস মন্বন্তর উপস্থিত হলে একইভাবে পুরাণ প্রজাপতি চাক্ষুষকে বৎস কল্পনা করে পৃথিবী দোহন করেন।
চাক্ষুষ মন্বন্তর-অন্তে এবার বৈবস্বত মন্বন্তর ফিরে এল। এবার বৈণপুত্র পৃথু পৃথিবীকে সর্বপ্রকারে দোহন করেন। পৃথু কর্তৃক পৃথিবী দোহন পর্ব আমি আগেই বর্ণনা করেছি।
পুরাকালে সমস্ত অতীত মন্বন্তরে এইভাবেই দেবতা, মানুষ ও প্রাণীরা বারে বারে পৃথিবীকে দোহন করেছিলেন।
এইভাবে সমস্ত অতীত ও অনাগত মন্বন্তরের দেবতাদের কথা বলা সম্পূর্ণ হল। এবার সেই মহান রাজা পৃথুর বংশধরদের বিষয়ে কিছু শুনুন।
পৃথুর ঔরসে শিখণ্ডিনীর গর্ভে অন্তর্ধি ও পালী নামে দুই বিক্রমশীল পুত্র জন্মলাভ করে। এছাড়া অন্তর্ধানের গর্ভে হবির্ধান নামে এক পুত্র জন্ম নেন।
অগ্নিকন্যার গর্ভে হবিধানের ঔরসে বিষণা প্রাচীন বৰ্হি ইত্যাদি ছয়টি পুত্র উৎপন্ন হয়।
প্রাচীনবৰ্হি ছিলেন মহান ভগবান প্রজাপতি। সমগ্র, পৃথিবীতে বল, শ্রুতি ও তপোবীর্যে তার তুলনীয় আর কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সমসাময়িক পৃথিবীর একছত্র সম্রাট। যে সমস্ত কুশের অগ্রপ্রান্ত অতি প্রাচীন, সেই সমস্ত কুশ তিনি সংগ্রহ করতেন। সেই কারণেই তার নাম হয়েছে। প্রাচীনবৰ্হি।
প্রাচীনবৰ্হি এক সমুদ্র তনয়াকে বিবাহ করেন। তার নাম ছিল সবর্ণা। বিবাহের পরে মহততম কাল অতিক্রান্ত হলে প্রজাপতি প্রাচীনবৰ্হির ঔরসে সবর্ণার গর্ভে দশটি সন্তান জন্ম লাভ করে। মহীতে তাদের সকল সন্তান “প্রচেতা” নামে পরিচিত হন। এঁরা সকলেই ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
প্রাচীনবৰ্হি-সবর্ণার সন্তান এই দশজন প্রচেতা সবসময় একসঙ্গে ধর্মাচরণ করতেন। তারা দশসহস্র বৎসর ধরে সমুদ্রতরে নিমজ্জিত থেকে এক কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। তাদের এই ঘোর তপস্যার পরে পৃথিবী অরক্ষিত হয়ে পড়ল। আর তাকে রক্ষা করার মত কেউ রইল না। বহু বৃক্ষ ভূমিভাগকে আচ্ছন্ন করল। ফলে দ্রুত প্রজাক্ষয় হতে লাগল।
চাক্ষুষ মন্বন্তরের বাতাস ও তাঁদের তপশ্চর্চার তীব্র বল সহ্য করতে পারল না। বিশাল আকাশের সুনীলতা বৃক্ষরাজিতে আচ্ছন্ন হল। এতসব দুর্বিপাকের মধ্যে প্রজারা দশ সহস্র বৎসর ধরে কোনো রকমের কাজই করতে পারলেন না।
প্রচেতাগণ যখন এই সংবাদ জানতে পারলেন, তারা অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে উঠলেন। তারা মুখ থেকে বায়ু ও অগ্নি সৃষ্টি করলেন।
দেববল উৎপন্ন এই বায়ু পৃথিবী আচ্ছন্নকারী বৃক্ষরাজিকে সমূলে উৎপাটিত করার ব্যবস্থা করল। সেই তীব্র বায়ুস্রোতে বৃক্ষগুলো উন্মল হয়ে শুষ্ক হয়ে পড়ল। আর যোর অগ্নি সেই শুষ্ক বৃক্ষগুলোকে দগ্ধ করে নিঃশেষ করে দিল। বায়ু ও অগ্নির দাপটে পৃথিবীর বুকে উৎপন্ন অধিকাংশ বৃক্ষ বিনষ্ট হল। যে স্বল্পসংখ্যক বৃক্ষ অবশিষ্ট ছিল রাজা সোম অর্থাৎ তাদেরকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হলেন। তিনি স্বয়ং প্রচেতাদের কাছে গিয়ে বললেন, যে প্রাচীনবহিপুত্র প্রচেতাগণ, পৃথিবীতে লোক বিস্তারের জন্য এই অবশিষ্ট বৃক্ষরাজির প্রয়োজন আছে। আপনারা নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করুন। পৃথিবীকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই এদের রক্ষা করুন।
তিনি আরো বললেন–হে মহাভাগ প্রচেতাগণ, ইতিমধ্যেই পৃথিবী প্রায় বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। এই ভীষণ অগ্নি ও বায়ু প্রশমিত থেকে চেয়ে দেখুন, এই রত্নবিভূষিতা বরবর্ণিনী নারী হলেন বৃক্ষকন্যা।
ভবিষ্যৎ জানার বৃথা গর্বে আমি একে অসংখ্য বৃক্ষে নির্মাণ করেছি। এঁর নাম মারিষা। আমার কিরণ বর্ধিতা মারিষাকে আপনি ভার্যারূপে গ্রহণ করুন। আমি আশীর্বাদ করছি আপনার তেজের অর্ধেক ও আমার তেজের অর্ধেক দিয়ে এঁর গর্ভে দক্ষ নামে এক বিদ্বান ধর্মপ্রাণ মহাত্মা প্রজাপতি উৎপন্ন হবেন। আপনাদের সকলের তেজোময় অগ্নিচ্ছটায় সেই অগ্নিসম প্রজাপতি দক্ষ এইসব অতি দগ্ধ, বৃক্ষদেরও বৃদ্ধি ঘটিয়ে পুনর্বার প্রজাবৃদ্ধি করবেন।
রাজা সোমের এই সুমধুর বচন শুনে তপস্যারত প্রচেতারা তাদের ক্রোধ সংবরণ করলেন। তারা মহিষা ধর্মমতানুসারে পত্নীরূপে গ্রহণ করলেন।
প্রচেতাগণ মনে মনে মারিষার গর্ভাধান করলেন। সেইমতো দশজন প্রচেতা ও সোমের অংশ সহযোগে মারিষার গর্ভে অত্যন্ত তেজস্বী বীর্যবান পুত্ররূপে দক্ষ জন্মলাভ করলেন।
এইভাবে বিনা মৈথুনে মনে মনে প্রজা সৃষ্টি করার পর অচর, চরু, দ্বিপদ, চতুষ্পদ বহু কন্যা সৃষ্টি করলেন। এই সমস্ত মানসী কন্যাদের মধ্যে ধর্মকে দশটি, কশ্যপকে তেরোটি, কালনিয়ন্ত্রণে নিযুক্তা নক্ষরূপা সাতাশটি কন্যাকে চন্দ্রের উদ্দেশ্যে দান করলেন, এছাড়াও তারা অরিষ্টমেমিকে তিন কন্যা, বাহু পুত্রকে দুইটি কন্যা, অঙ্গিরাকে একটি কন্যা এবং কৃশাশ্বকেও একটি করে কন্যা দান করলেন। এবার তাদের সন্তানদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা বিষয়ে শুনুন।
এই সময় চাক্ষুষ মনুর ষষ্ঠ মন্বন্তরের অবসান হলে প্রজাপতি মনুর সপ্তম মন্বন্তর সূচিত হল।
পূর্বে মারিষার গর্ভজাত যত সংখ্যক কন্যার কথা বলেছি সেইসব কন্যাদের গর্ভে দেবতা, দৈত্য, দানব, গন্ধর্ব, পক্ষী, নাভা, অপ্সরা এবং অন্যান্য বহুজাতির জন্ম হল।
সেই ঘটনার পর থেকেই এই পৃথিবীতে সকল প্রজা মৈথুনের ফলে জন্মগ্রহণ করে থাকে। এর পূর্বাবস্থায় সংকল্প, দর্শন ও স্পর্শে প্রজা সৃষ্টি হত।
ঋষিরা বললেন, হে মহাভাগ আপনার মুখ থেকে দেবতা, দানব, দেবর্ষি ও মহাত্মা দক্ষের উৎপত্তি বিষয়ে বিস্তারিত জানলাম। আমরা ধন্য।
আপনি পূর্বে বলেছিলেন যে প্রাণ হতেই প্রজাপতি দক্ষের জন্ম হয়। তাহলে কীভাবে সেই মহাত্মা প্রাচেত সত্ব লাভ করলেন? প্রাচেতাদের পুত্ররূপে তার এই আবির্ভাব কিভাবে সম্ভব হল?
হে সূত এর আগে আপনার মুখেই শুনেছি দক্ষ হলেই সোমের দৌহিত্র, সেই তিনি আবার কীভাবে তার শ্বশুর হয়ে উঠলেন? এতে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। আপনি এর যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিন।
সূত উত্তরে বললেন, হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠগণ, প্রাণীদের উৎপত্তি ও লয় নিত্যই হয়ে থাকে। তার দ্বারা বিদ্বান ঋষিগণ কখনোই মোহিত হন না।
হে দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ, পূর্বে জ্যেষ্ঠত্ব বা কনিষ্ঠত্ব বলে কিছুই ছিল না। তপস্যাই ছিল প্রধান এবং প্রভাবই ছিল এধরনের বিষয়ের একমাত্র কারণ।
যে ব্যক্তি চাক্ষুষ মন্বন্তরের এই চরাচর সৃষ্টি বিষয়ে জানিতে পারেন, তিনি সাধারণ প্রজাদের তুলনায় সঠিক আয়ু লাভ করেন এবং মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে গমন করে পূজিত হন।
এই হল চাক্ষুষ মনুর সংক্ষিপ্ত সৃষ্টি তত্ত্ব।
হে দ্বিজসত্তমগণ, এইভাবে আজ পর্যন্ত স্বায়ম্ভুবাদি চাক্ষুষ পর্যন্ত ছয়টি মন্বন্তর সৃষ্টি অতীত হয়েছে। এইসব সৃষ্টি বৃত্তান্ত আমি আমার জ্ঞানানুসারে বললাম।
এবার বৈবস্বত মনুর সৃষ্টি বিষয়ে জানতে হবে। প্রথমেই জানা দরকার–বৈবস্বতের সৃষ্টিগুলি অনন্ত বা অতিরিক্ত কিছুই না। যে ব্যক্তি অসয়াবিহীন হয়ে এইসব পাঠ করেন, তিনি ধর্ম, অর্থ, কাম, আরোগ্য, আয়ু এইসব পেয়ে থাকেন। তিনি জীবন ধরে অতিশুভ ফল লাভ করে স্বর্গে গিয়েও পূজিত হয়ে থাকে।
এবার আমি সেই মহান বৈবস্বত মনুর সৃষ্টি বিষয়ে তত্ত্বালোচনা করব। শ্রবণ করুন।
.
৫৯.
বৈবস্বত মনুর সৃষ্টি রহস্য বর্ণনা প্রসঙ্গে সূত বললেন, বৈরিণীর গর্ভ সস্তৃতা সতী দক্ষের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষের অপরাপর কন্যাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও বিশিষ্টা ছিলেন। তদুপরি সতী ছিলেন আদ্যন্ত ব্রহ্মপরায়না।
একদিন দক্ষ সতাঁকে নিয়ে বৈরাজ ব্রহ্মার সন্দর্শনে গেলেন। ব্রহ্মালোকে পৌঁছে তিনি দেখতে পেলেন ধর্ম ও ভব (শিব) ব্রহ্মার উপাসনায় মগ্ন। তখন ভব ও ধর্মের দেখাদেখি দক্ষ ও তার সুরক্ষণা নন্দিনী সতীও ব্রহ্মার চরণ বন্দনা করতে লাগলেন। পিতা-পুত্রী নিৰ্ণিমেষ ব্রহ্মার তেজোময় রূপ দেখতে লাগলেন।
ব্রহ্মা প্রীত হলেন। ভব ও ধর্মের উপস্থিতিতেই তিনি দক্ষের উদ্দেশ্যে বললেন, দক্ষ আপনারা এই সুব্রতা কন্যা চারিটি পুত্র প্রসব করবে। পুত্ররা সকলেই প্রভাব সম্পন্ন ও চতুবর্ণের কারণ হবেন।
ব্রহ্মার আশীর্বাদ বচন শুনে দক্ষ, ধর্ম, ভব ও ব্রহ্মা–এঁরা চারজনেই পুত্রলাভের আশায় মনে মনে সেই কন্যার কাছে গমন করলেন। দক্ষ, ব্রহ্ম, ধর্ম ও ভবের দ্বারা অচিরেই সতীর গর্ভে সন্তান এল। এই ব্যাপারটি তাদেরও অবগত হল। যেহেতু তারা চারজনেই ছিলেন সত্যবাদী, তাই তাদের সৎ সংকল্প অনুসারে তাদের চারটি কুমার জন্মলাভ করলেন।
সতীর গর্ভে উল্লিখিত চার মহাত্মার ঔরসে যে শিশুরা জন্ম নিলেন তারা সকলেই ছিলেন সিদ্ধেন্দ্রিয়, শ্রীমণ্ডিত উপভোগক্ষম ও শরীরধারী’ সেই সদ্যোজাত পুত্রদের দেখামাত্র দক্ষ, ব্রহ্মা, ধর্ম ও ভব–এঁরা চারজন ‘এ আমার পুত্র’ বলে তাদের আকর্ষণ করতে লাগলেন। প্রথমে নিজেদের ইচ্ছামত কোনো একজন পুত্রকে “এ আমারই অভিধ্যানে জন্মেছে।” এরূপ ধারণা করে শেষে অতি তেজ সম্পন্ন দুই মনু জন্মলাভ করেন।
পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন।
এরপর যে পুত্র যাঁর দেহের অনুরূপ অর্থাৎ রূপ ও বর্ণানুসারে যিনি যার সবর্ণ তিনিই তাকে সৃষ্টি করেছেন বলে নির্ণিত হল।
এইভাবে পুত্র সর্বদা উৎপাদক পিতার অনুরূপ হয় বলে পুত্রকে পিতা-মাতার আত্মা বলে চিহ্নিত করা হয়।
শেষে অতি তেজসম্পন্না দুই মনু জন্মলাভ করেন।
বৈবস্বত মন্বন্তরে বৈবস্বতের দুই মনু পুত্র রূপে জন্মলাভ করেন।
প্রজাপতি রুচির পুত্র রৌচ্য মনু নামে জ্ঞাত হলেন।
আর কবির পুত্র যে মনু ভূমিতে জন্মগ্রহণ করলেন তিনি ভূম্য মনু নামে খ্যাত হলেন।
বৈবস্বত মনু ও সাবর্ণ মনু নামে যে দুজন বিখ্যাত মনু আছেন, তাদের মধ্যে পাঁচজন হলেন সাবর্ণ মনু এবং চারজন মহর্ষিজাত মনু।
এদের মধ্যে সাবর্ণ ও বৈবস্বত মনুর জ্যেষ্ঠ পুত্র রূপে যে জন্মগ্রহণ করলেন, তার নামও মনু।
বৈবস্বত মনুন্তরে এঁদের শুভউৎপত্তি বিষয়ে আমি বিস্তারিত এবং আনুপূর্বিক বর্ণনা দেব। বেদ স্মৃতি এবং পূরাণসমূহে কীর্তিবর্ধক অশেষ প্রভাব সম্পন্ন যে চোদ্দজন মনুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা সকলেই নিজের নিজের কালে সর্বর্ণের স্রষ্টা ও প্রজাসকলের প্রতি ছিলেন। তাদের সেই সময়ে সাগরান্ত নগরময় এই পৃথিবী ব্যাপ্ত করেছিলেন।
স্বায়ম্ভরাদি চোদ্দোটি সৃষ্টি পূর্ণ সহস্র যুগ ধরে চলেছিল বলে জ্ঞাত হয়ে থাকে।
আমি যথাকালে এই প্রজাপতিদের তপস্যাদি বিষয়ে সবিস্তারে বলব। অব্যন্তর অধিকার অর্থাৎ নিজ নিজ মন্বন্তরকালে তারা যে কীর্তিমান ছিলেন, সে বিষয়েও বলব।
অধিকার লোপ পাওয়ার পর প্রজাপতিরা সকলেই মহালোকে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তাঁদের সংখ্যা ছিল ছিয়াশি ও অবশিষ্টরা সর্ব মোট সাতজন ছিলেন।
পূর্বতনদের মধ্যে বৈবস্বত মনুর স্থান সপ্তম তিনি পৃথিবী শাসন করে থাকেন।
এবার অবশিষ্ট দেবতা, সপ্তর্ষি মানবদের বিবরণ দিচ্ছি শুনুন।
পূজাযুক্ত সৃষ্টি দ্বারা তাদের বিস্তৃত বিবরণ জানতে হবে। মনে রাখবেন, সৃষ্টিগুলি পরস্পর অতিরিক্তও নয়, আবার অসম্পূর্ণ নয়।
অতীত ও ভবিষ্যৎ মন্বন্তরে অনেক কিছুরই বহুত্ব হেতু পুনরুক্তি ঘটেছে। বিভিন্ন মন্বন্তরের বিভাগ অনুসারে বিভিন্ন সৃষ্টির কথা আপনাদের অনুপুঙ্খ জানতে হবে।
.
৬০.
পুরাণজ্ঞ ব্রহ্মবিদ সূত্র বললেন, বৈবস্বত মন্বন্তরে সপ্তম পর্যায়ে মারীচ কশ্যপ থেকে দেবগণ ও মহর্ষিরা জন্মগ্রহণ করেন।
এই দেবগণ হল আটটি। যথা–আদিত্যগণ, বসুগণ, রুদ্রগণ, সাধ্যগণ, বিশ্বদেবগণ, মরুৎগণ, ভার্গবগণ ও অঙ্গিরাগণ।
এঁদের মধ্যে আদিত্যগণ, মরুৎগণ ও রুদ্রগণ হলেন কশ্যপের পুত্র এবং সাধ্যগণ বসুগণ ও বিশ্বদেবগণ এঁরা তিনজন হলেন ধর্মপুত্র।
ভার্গবগণ হলেন ভৃগুর পুত্র, অঙ্গিরণগণ হলেন অঙ্গিরার পুত্র, বৈবস্বত মন্বন্তরে এঁরা ছন্দজ দেবতা রূপে খ্যাত হয়ে আছেন।
সম্প্রতি এই যে সৃষ্টি চলছে, এটি মারীচের সৃষ্টিকলি। তাদের মধ্যে অন্যতম তেজস্বী মহাবল হলেন ইন্দ্র।
কালেই মন্বন্তর ঘটে যাবে হত্যাক্ষ। তারা পুরন্দকভাবে
অতীত, অনাগত ও বর্তমান–এইসব কালেই মন্বন্তর ঘটে যাবে।
ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কালের নাথ ইন্দ্রগণরা সকলেই সহস্রাক্ষ। তারা পুরন্দর অর্থাৎ শত্রুনগরভেদী, মখবা অর্থাৎ পূজা, এঁরা শৃঙ্গী ও বজ্ৰপানি। এঁরা সকলেই পৃথক পৃথক ভাবে শতগুণান্বিত একশত যজ্ঞ করেছিলেন।
ত্রিলোকে যত সত্ত্ব, যত গতিমান, যত ধ্রুব দেখা যায়, তারা ধর্ম ও অর্থের কারণেই এখানে অবস্থান করে। এগুলি জীবদের পূর্ণমাত্রায় অভিভূত করে।
সত্ত্ব, গতিমান আর ধ্রুব–এঁদের যেরকম প্রভাব এঁরা যেভাবে নিজ নিজ তেজ, তপস্যা, বুদ্ধি, বল শ্রুতি ও পরাক্রম বলে অতীত, বর্তমান এমনকি ভবিষ্যৎ কালের পর্যন্ত প্রভু হয়েছিলেন, সম্প্রতি আমি সে-কথাই বলব, আপনারা হৃষ্টচিত্তে শ্রবণ করুন।
ভূত, ভবিষ্যৎ ও ভব্য (বর্তমান)–ত্রিলোককে এই তিনভাগে ভাগ করা হয়। এই ভূমি ভূর্লোক অন্তরীক্ষ হল ভুবর্লোক আর ভব্য হল দিবলোক। এবার এদের সাধনের বিষয়ে বলছি, শুনুন।
পূর্বকালে প্রজাপতি ব্রহ্মা পুত্রকামনায় ধ্যানস্থ হন। ধ্যান করতে করতে তার মুখ দিয়ে “পূঃ” এই শব্দটি উচ্চারিত হয়। সেইহেতু তখন তা ভূর্লোক হয়।
“ভূ” ধাতুর অর্থ হল সত্তা। লোকদর্শনে ভূতত্ত্ব ও দর্শনতত্ত্ব হেতু একে ভূর্লোক বলা হয়।
লোকসমূহের মধ্যে এই লোকের স্থান প্রথম। আর সেই কারণেই দ্বিজশ্রেষ্ঠগণ এর নাম রেখেছেন ভূর্লোক অর্থাৎ প্রথম লোক।
দ্বিতীয়বার ব্রহ্ম “এই ভূতে হোক” কথা ক-টি উচ্চারণ করলেন। “ভবতি” অর্থাৎ উৎপাদিত হচ্ছে এই অর্থে “কাল” শব্দ প্রযুক্ত হয়। “ভবন” অর্থাৎ কাল উৎপন্ন হয় বলে অধিধানজ্ঞ প্রাচীন পণ্ডিতগণ একে ভূর্লোক বলেন।
অন্তরীক্ষ হল ভুবর্লোক। একে দ্বিতীয় লোকও বলা হয়ে থাকে।
ভুবর্লোক উৎপন্ন হবার পর ব্রহ্মা তৃতীয়বার “ভবৎ” এই কথা বলায় ভব্য লোকের উদ্ভব ঘটে।
“ভবৎ” শব্দটি অনাগত বা ভবিষ্যৎ বোঝাতে প্রয়োগ করা হয়। সেই কারণে ভব্যলোকের আরেক নাম দিবলোক।
এই সময় ব্রহ্মা আবার “স্বর” শব্দটি উচ্চারণ করেন। এর ফলেই ভাব্যলোকের উৎপত্তি হয়। “ভাব” শব্দের ধাতুমূলক অর্থ হল ভাবৎকাল।
এইভাবে ব্রহ্মার মুখ থেকে তিনবার তিনটি শব্দ উচ্চারিত হয়। “ভূ” শব্দে ভূমি, “ভুবঃ” শব্দে অন্তরীক্ষ এবং “স্বর’ শব্দে ভাব্য বা দিবলোক নির্দেশিত হয়ে থাকে।
ধাতুজ্ঞদের মতে “নাথ” শব্দের অর্থ হল পালন। সেই কারণে ভূ, ভব ও ভব্য এই লোকত্রয়ের যে প্রভুগণ এরা ইন্দ্ররূপে কীর্তিত হয়ে থাকেন। দ্বিজগণ এরকম অভিমতই পোষণ করেন।
দেবেন্দ্র হলেন সকলের প্রধান ও সর্বগুণে গুণান্বিত। সমস্ত মন্বন্তরেই তিনি দেবগণের যজ্ঞভাগ পেয়ে থাকেন। তিনি স্বর্গে বাস করেন।
যক্ষ, রাক্ষস, উরগ বা সর্প, গন্ধর্ব এবং দানবেরা–এঁরা সকলেই দেবতাদের মহিমা স্বরূপ।”
দেবেন্দ্রগণ গুরু, নাথ, রাজা, পিতা এইসব বিশেষণে ভূষিত হয়ে থাকেন। তারা ধর্মানুসারে প্রজাদের রক্ষা করে থাকেন।
সংক্ষেপে এই হল দেবেন্দ্রদের লক্ষণসমূহ।
এবার আমি সপ্তর্ষিদের বিষয়ে বলব।
বর্তমান বৈবস্বত মন্বন্তরে আটজন ঋষি বর্তমান আছেন। তারা হলেন–অত্রি (শ্বয়ম্ভর পুত্র) ঔ তথ্য (বৃহস্পতি পুত্র), প্রতাপবাণ জমদগ্নি, বৎসার (লোকবিশ্রুত বসুমান কশ্যব বংশীয়), বিশ্বামিত্র (কুশিবংশীয় গাধিরাজ পুত্র মহাতপা ধর্মাত্মা), মহাতপস্বী ভরদ্বাজ, ভার্গব (ঊরুবংশজাত) এবং শরদ্বান (ইনি গৌতমবংশীয় বিদ্বান ও পরম ধার্মিক)।
এর বাইরে আমরা বৈবস্বত মনুর নয়জন পুত্রের কথাও জানতে পারি, তারা হলেন কর, ইক্ষবাকু, ধৃষ্ট, নাভাগ, নাভনেদিষ্ট, নীরষ্যন্ত, পৃষ, বসুমান এবং শর্যাতি।
হে দ্বিজসত্তমগণ এই আমি সপ্তম মন্বন্তরের বিবরণ এবং দ্বিতীয় অনুষঙ্গ পদের বিস্তারিত ও আনুপূর্বিক বর্ণনা কীর্তিত করলাম।