পাণ্ডববিজিগীষায় বৈরোৎপাদনে প্ৰযত্ন -দুর্য্যোধনের আক্রোশ
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে অনঘ! রাজারা যজ্ঞার্থ মহাত্মা পাণ্ডবকে বিপুল ধন প্ৰদান করিয়াছিলেন। যাহারা মেরু ও মন্দরগিরির মধ্যবর্তিনী শৈলোদা নদীর উভয়কূলস্থিত কীচক [বাঁশ] ও বেণুর [স্বল্পস্ফীত দীর্ঘপর্ব্ব বংশ-তলদা বাঁশ] রমণীয় ছায়া সেবা করিয়া থাকেন, সেই সকল মহীপালেরা দ্ৰোণপরিমিত অত্যুৎকৃষ্ট হীরক রাশি প্রদান করিয়াছিলেন। কৃষ্ণ ও শুক্লবৰ্ণ চমর, হিমগিরিসম্ভূত পুষ্পজ সুস্বাদু মধু, উত্তর-কুরুদেশ হইতে আনীত অপূর্ব্ব মাল্য, উত্তরকৈলাস হইতে আহত বলবিধায়িনী ওষধি এবং অন্যান্য পার্ব্বত্য উপহারসকল লইয়া কত শত ব্যক্তি যুধিষ্ঠিরের দ্বারে দণ্ডায়মান ছিলেন। উদয়াচলবাসী রাজগণ, কারূষদেশীয় ভূপালগণ, সমুদ্রান্তনিবাসী ভূপতিবর্গ, ব্ৰহ্মপুত্রের উভয় কুলস্থিত রাজসমূহ এবং ক্রূরকর্ম্ম, ক্রূরশস্ত্ৰ, চর্ম্মবাসন ও ফলমূলোপজীবী কিরাতবৃন্দকে দেখিলাম। তাঁহারা চন্দন ও অগুরুকাষ্ঠের, ভার, চর্ম্ম, রত্ন, সুবর্ণ এবং নানাপ্রকার গন্ধদ্রব্য, অযুত কিরাত দাসী, দূরদেশীয় বিবিধ মৃগ, পক্ষী ও পর্ব্বতীয় হিরণ্য প্রভৃতি নানাবিধ উপহার লইয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান ছিলেন। কৈরাত, দরদ, দর্ব্ব, যমক, ঔদুম্বর, পারদ, বাহ্লীক, কাশ্মীর, হংসকায়ন, শিবি, ত্রিগর্ত, যৌধেয়, মদ্র, কেকয়, অম্বষ্ঠ, কেকুর, তার্ক্ষ্য, পহ্লব, বশাতল, মৌলেয়, ক্ষুদ্রক, মালব, পৌণ্ড্রিক, শক, অঙ্গ, বঙ্গ, পুন্ড্র ও গয় প্রভৃতি ক্ষত্ৰিয়বর্গ শ্রেণীবদ্ধ হইয়া যুধিষ্ঠিরের নিমিত্ত বহুবিধ বিত্ত আনয়ন করিতে লাগিলেন। বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, তাম্রলিপ্ত, সুপুন্ড্রক, দৌবালিক, সাগরক, পত্রোণ, কর্ণ ও প্রাবরণ প্রভৃতি রাজগণ তথায় দণ্ডায়মান হইয়া কালপ্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। রাজার আজ্ঞানুসারে দ্বারপালেরা তাহাদিগকে কহিল, “সময় উপস্থিত হইলে আপনারা দ্বার প্রাপ্ত হইবেন।” তাহারা প্রত্যেকে সুশিক্ষিত, পর্ব্বতপ্রতিম, কবচাবৃত, সহস্ৰ কুঞ্জর প্রদানপূর্ব্বক দ্বারে প্রবিষ্ট হইলেন। এতদ্ভিন্ন চতুর্দিক হইতে সমাগত অন্যান্য জনগণ নানাজাতীয় রত্নোপহার প্রদান করিয়াছিলেন। বাসাবানুচর গন্ধর্ব্বরাজ চিত্ররথ বায়ুর ন্যায় দ্রুতগামী চারিশত ঘোটক এবং তম্বুরু নামে অপর একজন গন্ধর্ব্ব তাম্রবর্ণসুবর্ণালঙ্কৃত একশত অশ্ব প্রদান করিলেন। কৃতী শূকররাজ একশত গজরত্ন প্রদান করিলেন। বিরাটরাজ মৎস্য দুই সহস্ৰ মত্তমাতঙ্গ উপহার দিলেন। রাজা বসুদান ষড়বিংশতি গজ ও মহাজব মহাসত্ত্ব বয়ঃস্থ দুই সহস্ৰ অশ্ব এবং অন্যান্য নানাপ্রকার উপহার পাণ্ডবদিগকে সম্প্রদান করিলেন। রাজা যজ্ঞসেন চতুর্দ্দশ সহস্ৰ দাসী, সদার অযুত দাস, বহুশত গজরত্ন, গজযুক্ত ষড়বিংশতি রথ এবং যজ্ঞার্থ কতকগুলি রাজ্য পাণ্ডবদিগকে প্রদান করিলেন। বাসুদেব অর্জ্জুনের বহুমান পুরঃসর তাহাকে চতুর্দশ সহস্র উৎকৃষ্ট হন্তী প্রদান করিলেন। কৃষ্ণ অর্জ্জুনের আত্মা এবং অর্জ্জুন কৃষ্ণের আত্মা। ধনঞ্জয় কৃষ্ণকে যে কাৰ্য্য করিতে বলেন, কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদন করেন, তিনি ধনঞ্জয়ের নিমিত্ত সুরলোকও পরিত্যাগ করিতে পারেন এবং পার্থও সেইরূপ কৃষ্ণের নিমিত্ত প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে পরাঙ্মুখি হয়েন না। হেমকুম্ভসমাস্থিত সুরভি চন্দনরস, মলয় এবং দর্দ্দুরাচলসম্ভূত চন্দন ও অগুরুরাশি, দীপ্তিমান মণিরত্ন ও সূক্ষ্ম কাঞ্চনবস্ত্ৰ লইয়া চোল এবং পাণ্ড্য উপস্থিত হইলেন, কিন্তু দ্বার প্রাপ্ত হইলেন না। সিংহলদ্বীপের লোকেরা সমুদ্রের সারভূত বৈদূৰ্য্যমণি, মুক্তাকলাপ ও বিচিত্র আভরণ উপহার প্রদান করিয়াছে। রাজার প্রিয়কাৰ্য্য করিবার নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণ, নির্জিত ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য এবং শুশ্রূষাপর শূদ্রেরা প্রীতি ও বহুমানপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের নিকট উপনীত হইয়াছিলেন। সর্ব্বপ্রকার স্লেচ্ছজাতি এবং নানাদেশীয় উৎকৃষ্ট, অপকৃষ্ট ও মধ্যম লোক একত্র সমবেত হওয়াতে বোধ হইল, যেন পৃথিবীস্থ সমস্ত লোক তথায় উপস্থিত হইয়াছে। হে রাজন! রাজগণ কর্তৃক প্রদত্ত নানাপ্রকার উপহার ও শত্রুদিগের ঐশ্বৰ্য্য সন্দর্শন করিয়া দুঃখে আমার মুমূর্ষ উপস্থিত হইল। মহারাজ! এক্ষণে পাণ্ডবদিগের ভৃত্যবর্গের বিষয় আপনাকে নিবেদন করিতেছি। রাজা যুধিষ্ঠির সকল ভূত্যেরই ভরণপোষণ করিয়া থাকেন। তাঁহার এক অযুত তিন পদ্মা গজারোহী ও অশ্বারোহী সৈন্য, অর্বুদ রথ এবং অসংখ্য পদাতি। কোন স্থানে দ্রব্য-সামগ্রীর পরিমাণ হইতেছে; কোন স্থানে পাচকেরা অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত করিতেছে; কোন স্থানে দান করিতেছে এবং কোথাও স্বস্ত্যয়ননিযুক্ত ব্ৰাহ্মণগণের পুণ্যাহ-ধ্বনি হইতেছে। যুধিষ্ঠিরের গৃহে অভুক্ত, তৃষ্ণাতুর, অনলাঙ্কৃত ও অসৎকৃত ব্যক্তি দৃষ্টিগোচর হয় না। তথায় অষ্টাশীতিসহস্ৰ গৃহমেধী স্নাতক রহিয়াছেন, তাহাদিগের পরিচর্য্যার নিমিত্ত প্রত্যেকের নিকট ত্ৰিশজন করিয়া দাসী নিযুক্ত আছে। রাজা যুধিষ্ঠির তাহাদিগের সকলেরই ভরণপোষণ করেন এবং তাহারাও প্রীত হইয়া সন্তুষ্টচিত্তে যুধিষ্ঠিরের শত্রুক্ষয় কামনা করিতেছেন। যুধিষ্ঠিরালয়ে পরিবেশকেরা প্রত্যহ সুবৰ্ণপাত্রে অন্নব্যঞ্জন লইয়া দশ সহস্ৰ যতিকে ভোজন করাইতেছেন। মহারাজ ! যাজ্ঞসেনী প্ৰতিদিন আপনি ভোজন না করিয়া অগ্ৰে কুজ, বামন প্রভৃতির মধ্যে কাহারও ভোজন হইল কি না, তাহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়া সকলকে পরিতৃপ্ত দেখিয়া ভোজন করিয়া থাকেন। পাঞ্চালাদিগের সহিত বিশেষ সম্বন্ধ আছে এবং অন্ধক বৃষ্ণিবংশীয়েরা যুদ্ধে আনুকূল্য করেন এ নিমিত্ত কেবল তাঁহারাই কুন্তিপুত্রকে কর প্রদান করেন না, নতুবা আর সকল রাজারাই করদ ।