৫১ম অধ্যায়
ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিবেক–জীবাত্মাপরমাত্ম বোধ
“ব্রহ্মা বলিলেন, “হে তপোধনগণ! আত্মাই ভূতগণের সৃষ্টিসংহারের কারণ; বিবেকজা [বিবেক হইতে জাত জ্ঞান] প্রজ্ঞা আত্মার ঐশ্বর্য্য ব্যক্ত করিয়া দেয়। আত্মাই ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। সারথি যেমন অশ্বগণকে প্রেরণ করে, সেইরূপ মন ইন্দ্রিয়গণকে স্ব স্ব বিষয়ে নিয়োগ করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয়সমুদয়, মনঃ ও বুদ্ধি ইহারা সকলেই আত্মার ভোগের নিমিত্ত স্ব স্ব কার্য্য সম্পাদন করে। দেহাভিমানী জীব ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বসংযুক্ত বুদ্ধিরূপ প্রতোদযুক্ত, মনোরূপ সারথিসম্পন্ন, দেহময় রথে আরোহণ করিয়া সৰ্ব্বত্র ধাবমান হইয়া থাকেন। যখন ঐ ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বসমুদয় মনোরূপ সারথিকর্ত্তৃক বুদ্ধিরূপ প্ৰতোদদ্বারা বশীভূত হয়, তখনই ঐ দেহরূপ রথ জীবের ব্রহ্মময়ত্বনিবন্ধন ব্রহ্মময় বলিয়া প্রতীত হইয়া থাকে। যিনি এইরূপে ব্রহ্মময় রথের বিষয় অবগত হইতে পারেন, তিনি কদাচ মোহপ্রাপ্ত হয়েন না। কি পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ, নক্ষত্র, নদী, পৰ্ব্বত প্রভৃতি স্থূলপদার্থ; কি প্রকৃত্যাদি সূক্ষ্ম পদার্থ, সমুদয় পদার্থই পরব্রহ্মস্বরূপ। ঐ পরমপুরুষ সৰ্ব্বভূতের একমাত্র গতি। জীবাত্মা উহাতেই পরমসুখে বিহার করিতে থাকেন।
‘প্রলয়কালে অগ্রে স্থাবরাদি বাহ্যপদার্থসমুদয় লয়প্রাপ্ত হইলে পশ্চাৎ ভূতকৃত গুণ শব্দাদি সমুদয় বিলীন হইয়া যায় এবং পরিশেষে সূক্ষ্মদেহারম্ভক পঞ্চভূতের’ লয় হয়। দেবতা, মনুষ্য, গন্ধ, পিশাচ ও রাক্ষসগণ ঈশ্বরের ইচ্ছাবশতঃই সৃষ্ট হইয়া থাকেন। যজ্ঞাদি বা ব্রহ্মাদি উহাদিগের সৃষ্টির মূল কারণ নহেন। মরীচি প্রভৃতি ভূস্রষ্টা মহর্ষিগণ মহাভূত হইতে বারংবার উৎপন্ন হইয়া সাগরোত্থিত উৰ্ম্মিমালার ন্যায় যথাসময়ে মহাভূতেই লয়প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। মুক্ত ব্যক্তি সূক্ষ্মভূত হইতেও উৎকৃষ্ট গতি প্রাপ্ত হয়েন। ভগবান প্রজাপতি তপোবলে মনদ্বারা এই স্থাবর জঙ্গমাত্মক বিশ্বের সৃষ্টি করিয়াছেন এবং মহর্ষিগণ তপোবলেই দেবলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন। ফলমূলাশী তপঃসিদ্ধ মহাত্মারা ক্রমশঃ সঙ্কল্পদ্বারা সমাধিযুক্ত হইয়া ত্রৈলোক্য দর্শন করিয়া থাকেন। আরোগ্য, ঔষধ ও বিবিধ বিদ্যা তপঃপ্রভাবেই সিদ্ধ হয়। ফলতঃ সিদ্ধিলাভ তপস্যারই আয়ত্ত। যে বিষয় নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য, দুর্ব্বোধ ও দুর্দ্ধর্ষ, তৎসমুদয়ই তপোবলে সিদ্ধ হইয়া থাকে। তপোবলকে অতিক্রম করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। সুরাপায়ী, ব্রহ্মঘ্ন সুবর্ণচৌয্যনিরত, ভ্রূণঘাতী ও গুরুতল্পগামী পামরেরা তপঃপ্রভাবেই পাপ হইতে মুক্ত হইয়া থাকে। মনুষ্য, পিতৃলোক, দেবতা, পশুপক্ষী ও বৃক্ষ প্রভৃতি স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূতসমুদয় তপঃপরায়ণ হইয়া সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয়। দেবগণ তপোবলেই স্বর্গলাভ করিয়াছেন।
যাঁহারা অহঙ্কারপরতন্ত্র হইয়া সকামকর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহারা ব্রহ্মলোকে গমন করিয়া থাকেন। যাঁহারা নিরহঙ্কৃত হইয়া বিশুদ্ধ ধ্যানযোগদ্বারা মমতাশূন্য হয়েন, তাঁহারা মহত্তত্ত্ব প্রাপ্ত হয়েন; আর যাঁহারা আত্মজ্ঞানলাভপূর্ব্বক ধ্যানযোগে আত্মপ্রসাদ লাভ করিতে পারেন, তাঁহারাই পূৰ্ণানন্দস্বরূপ পরব্রহ্মে প্রবিষ্ট হয়েন। যাঁহারা ধ্যানযোগে প্রবৃত্ত হইয়া উহার সম্যক অনুষ্ঠান না হইতে হইতেই প্রাণত্যাগ করেন, তাঁহারা প্রকৃতিতে প্রবেশ করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগকে পুনরায় প্রকৃতি হইতে উদ্ভূত হইয়া প্রথমতঃ অজ্ঞান আবৃত হইতে হয়। পরিশেষে উহারা রজঃ ও তমোগুণ হইতে বিমুক্ত হইয়া বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণ অবলম্বনপূৰ্ব্বক সৰ্ব্ববিষয়ে অভিমান পরিত্যাগ করিয়া পরব্রহ্মের স্বরূপত্বলাভ করেন। যিনি সেই পরাৎপর পরব্রহ্মকে জানিতে পারেন, তিনিই যথার্থ বেদবেত্তা। জ্ঞানবান ব্যক্তি চিত্ত হইতে জ্ঞানলাভ করিয়া সংযতভাবে মৌনাবলম্বনপূৰ্ব্বক অবস্থান করিবেন। যাহাকে চিত্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়, তাহারই নাম মন। ইহা পরম রহস্য। প্রকৃতি হইতে পৃথিবী পৰ্য্যন্ত সমুদয়কে জড় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। গুণানুসারে এই সমুদয়ের লক্ষণ অবগত হওয়া যায়। মমতা, মৃত্যু ও নির্ম্মমতা শাশ্বত ব্রহ্ম বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। জ্ঞানবান্ মহাত্মারা কখনই ধর্ম্মের প্রশংসা করেন না; কেবল মন্দবুদ্ধি মূঢ়েরাই কর্ম্মের প্রশংসা করিয়া থাকে। কৰ্ম্ম প্রভাবেই জীবাত্মা পঞ্চভূত ও একাদশ ইন্দ্রিয়াত্মক লিঙ্গশরীরে সমাক্রান্ত হয়েন। বিদ্যাশক্তি ঐ ষোড়শাত্মক লিঙ্গশরীরকে গ্রাস করিলেই তত্ত্বজ্ঞ মহাত্মারা কেবল সেই একমাত্র পুরুষকে দর্শন ও আশ্রয় করিয়া থাকেন। এই নিমিত্ত যথার্থ তত্ত্বদর্শী ব্যক্তিরা কাৰ্য্যের। অনুষ্ঠানে একেবারে বিরত হইয়া থাকেন।
‘পুরুষ বিদ্যাময়। উহাকে কখনই কৰ্ম্মময় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। যে ব্যক্তি জিতচিত্ত হইয়া সেই অক্ষয় সনাতন পুরুষকে পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তিনি মৃত্যুকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন। ফলতঃ ইন্দ্রিয়সংযমাদিদ্বারা অপরাজিত অকৃত্রিম পরাৎপর পরমাত্মাকে পরিজ্ঞাত হইতে পারিলেই মোক্ষলাভে সমর্থ হওয়া যায়। যাঁহারা সৰ্ব্বভূতে মিত্রভাব প্রভৃতি সৎপ্রবৃত্তিসমুদয়কে সুদৃঢ় করিয়া হৃৎপদ্মে নিরোধ করিতে পারেন, তাঁহারাই অলৌকিক পরব্রহ্মকে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়েন। সত্ত্বগুণের উদয় হইলেই মনুষ্য আত্মপ্রসাদ লাভ করিতে পারে। যেমন স্বপ্নে বিবিধ বিষয় ভোগ করিয়া স্বপ্নবসানে তৎসমুদয় অলীক বলিয়া বোধ হয়, তদ্রূপ সত্ত্বগুণের প্রকাশ হইলে জগতের সমুদয় পদার্থই অকিঞ্চিৎকর বলিয়া জ্ঞান হইয়া থাকে। আত্মপ্রসাদই জীবন্মুক্ত মহাত্মাদিগের পরমগতি। যোগিগণ ঐ আত্মপ্রসাদপ্রভাকে অতীত ও অনাগত কৰ্ম্মসমুদয় অনায়াসে দর্শন করিয়া থাকেন। ফলতঃ নিবৃত্তিধৰ্ম্মই বিয়রাগবিহীন জ্ঞানবান মহাত্মাদিগের পরম গতি, পরম ধৰ্ম্ম, পরম লাভ ও যারপরনাই উৎকৃষ্ট কাৰ্য্য।
‘যে ব্যক্তি সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী ও নিস্পৃহ হইতে পারেন, তিনিই ঐ সনাতন ধর্ম্ম লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। হে মহর্ষিগণ! এই আমি তোমাদিগের নিকট নিবৃত্তিধৰ্ম্ম সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে তোমরা এই সনাতন ধর্ম্ম আশ্রয় কর, তাহা হইলে অনায়াসে সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হইবে।’
“উপাধ্যায় এইরূপে শিষ্যের নিকট ব্রহ্মার সহিত ঋষিগণের কথোপকথন কীৰ্ত্তন করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘বৎস! সৰ্ব্বলোক। পিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা মহর্ষিগণকে এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে তপোধনগণ উপদেশানুসারে ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া পরিশেষে অভীষ্টলোক লাভ করিয়াছিলেন। অতএব তুমিও তাঁহাদিগের ন্যায় ধর্ম্মপরায়ণ হও। নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হইবে।’ উপাধ্যায় এইরূপ আদেশ করিলে মেধাবী শিষ্য তাঁহার বাক্যানুরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক অচিরাৎ মোক্ষলাভ করিলেন।”
মহাত্মা ধনঞ্জয় এইরূপে বাসুদেবের মুখে গুরু-শিষ্যসংবাদ শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “সখে! তুমি যে গুরু-শিষ্যের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলে, উহারা কে, তাহা পরিজ্ঞাত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে; অতএব তুমি আমার নিকট উহা কীৰ্ত্তন কর।”
তখন বাসুদেব কহিলেন, “বয়স্য! আমি গুরু এবং আমার মনই শিষ্য। এক্ষণে আমি কেবল তোমার প্রীতির নিমিত্ত এই রহস্যবিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। আমি যুদ্ধকালেও তোমাকে এইরূপ বিবিধ উপদেশ প্রদান করিয়াছিলাম, এক্ষণে যদি আমার প্রতি তোমার প্রীতি থাকে, তাহা হইলে আমার এই উপদেশানুসারে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান কর। অচিরাৎ সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া মোক্ষ লাভ করিতে পারিবে। যাহা হউক, বহুদিন হইল, আমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করা হয় নাই; অতএব যদি তোমার মত হয়, তাহা হইলে এক্ষণে দ্বারকায় প্রস্থান করি।”
মহাত্মা বাসুদেব এই কথা কহিলে, অর্জ্জুন তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “সখে! চল, আজ আমরা হস্তিনায় গমন করি, তথায় তুমি ধৰ্ম্মপরায়ণ মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের অনুজ্ঞা গ্রহণ করিয়া দ্বারকায় প্রস্থান করিবে।”