৫১তম অধ্যায়
আত্মকলহনিরাসে ভীষ্মের নীতি
ভীষ্ম কহিলেন, “মহামতি কৃপ ও অশ্বত্থামা অতি উত্তম কহিয়াছেন। কর্ণ ক্ষাত্রধর্ম্মাবলম্বনপূর্ব্বক কেবল যুদ্ধ করিবারই অভিলাষ প্রকাশ করিয়াছেন; আর আচাৰ্য্য যাহা কহিয়াছেন, তদ্বিষয়ে দোষারোপ করা বিজ্ঞব্যক্তির নিতান্ত অনুচিত। এক্ষণে আমার মতে উত্তমরূপে দেশ-কাল পৰ্য্যালোচনা করিয়া যুদ্ধ করাই কর্ত্তব্য। সূৰ্য্যসদৃশ তেজস্বী পাঁচজন শক্রকে অভ্যুদয়শালী অবলোকন করিয়া কোন ব্যক্তি বিমোহিত না হয়? ধর্ম্মজ্ঞ ব্যক্তিরাও স্বার্থচিন্তাসময়ে বিমুগ্ধ হইয়া থাকেন। হে দুৰ্য্যোধন! এক্ষণে এ বিষয়ে আমার যে মত, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। কৰ্ণ যোদ্ধাদিগকে উত্তেজিত করিবার নিমিত্তই সমরবাসনা প্রকাশ করিয়াছেন; অতএব আচাৰ্য্য দ্রোণ, কৃপ ও আচাৰ্য্যপুত্রের এ বিষয়ে ক্ষমা করা কর্ত্তব্য এবং তোমারও ইহাতে সবিশেষ বিবেচনা করা বিধেয়। এক্ষণে মহৎকাৰ্য্য সমুপস্থিত; অর্জ্জুন আগতপ্ৰায়; অতএব আমাদের সকলেরই একত্ৰ হইয়া যুদ্ধ করা উচিত। এক্ষণে পরস্পর বিরোধ করিবার সময় নহে। আপনাদিগের অস্ত্রবিদ্যা সূৰ্য্যপ্রভার ন্যায় এবং ব্ৰহ্মণ্য ও ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ চন্দ্ৰমার স্থিরলক্ষ্মীর ন্যায় সতত অপ্রতিহত রহিয়াছে। ভরতকুলাচাৰ্য্য দ্রোণ, কৃপ এবং দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা ব্যতীত আর কোন ব্যক্তিতেই চারি বেদ ও ক্ষত্ৰ তেজ, এই উভয়ের একত্ৰ সমাবেশ দৃষ্ট হয় না। পুরুষোত্তম দ্রোণাচাৰ্য্য ব্যতীত আর কোন ব্যক্তিতেই ব্ৰহ্মতেজ, ব্ৰহ্মাস্ত্র ও বেদ, এই তিনের সমানাধিকরণ্য [যুগপৎ স্থায়িত্ব—এক কালে এই সকলের একত্ৰ স্থিতি] অবলোকন করি না। বেদান্ত, পুরাণ ও ইতিহাস, এই সমুদয় বিষয়ে পরশুরাম ব্যতীত দ্রোণাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কেহই নাই। পণ্ডিতেরা কাহেন, সৈন্যের যে সমুদয় ব্যসন আছে, তন্মধ্যে ভেদাই মুখ্য; অতএব হে আচাৰ্য্যপুত্র! আপনি ক্ষমা প্রদর্শন করুন; এখন আত্মীয় ভেদের সময় নহে।”
তখন অশ্বথামা কহিলেন, “আমাদিগের এই সময় এরূপ বাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য নহে, কিন্তু পিতা রোষপরবশ হইয়া যাহা কহিয়াছেন, তাহার কারণ এই যে, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা গুণবান। শত্রুর গুণ ও দোষী শত্রুর দোষ-কীর্ত্তনে পরাঙ্মুখ হয়েন না এবং পুত্র ও শিষ্যকে সতত হিতোপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন।”
দুৰ্য্যোধন অশ্বত্থামার বাক্যশ্রবণান্তর দ্রোণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! ক্ষমা প্রদর্শন করুন। আপনি পরিতুষ্ট থাকিলেই আমাদিগের মঙ্গললাভের সম্ভাবনা।” এই বলিয়া তিনি কৰ্ণ, ভীষ্ম ও মহাত্মা কৃপের সমভিব্যাহারে দ্রোণাচাৰ্য্যকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।
তখন দ্রোণ কহিলেন, “শান্তনুনন্দন ভীষ্ম পূর্ব্বে যাহা কহিয়াছেন, আমি তাহাতেই প্ৰসন্ন হইয়াছি।” পরে ভীষ্মকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে গাঙ্গেয়! এক্ষণে পার্থ যাহাতে দুৰ্য্যোধনকে আক্রমণ করিতে না পারে, যাহাতে মহারাজ দুৰ্য্যোধন সাহস বা মোহবশতঃ শত্রুর বশীভূত না হয়েন, তদ্বিষয়িণী নীতি চিন্তা কর। ত্ৰয়োদশ বৎসর অতীত না হইলে অর্জ্জুন কদাচ আত্মপ্রকাশ করিত না। ঐ মহাবীর এক্ষণে গোধন মোচন করিতে আসিয়াছে, কখনই ক্ষমা করিবে না; অতএব যাহাতে অর্জ্জুন মহারাজ দুৰ্য্যোধন ও এই সকল সৈন্যকে পরাজয় করিতে সমর্থ না হয়, এ বিষয়ে নিয়ম নিৰ্দ্ধারণ কর। দুৰ্য্যোধন পূর্ব্বে এইরূপ কহিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা স্মরণ করিয়া যাহাতে শ্ৰেয়োলাভ হয়, ঈদৃশ বাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য।”