৪. হাই বড় ছোঁয়াচে জিনিস

হাই বড় ছোঁয়াচে জিনিস। সামনে বসে যদি কেউ বড় বড় হাঁ করে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড হাই তুলতে থাকে, তা হলে তা দেখে সুমুখের মানুষটারও হাই উঠবেই কি উঠবে। নইলে এই সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় হাই তোলার মানুষ শিবেন নয়। কিন্তু উদ্ধববাবুর নাতি, সাঝঘুমোনি নাতি গোবিন্দকে সন্ধেবেলা পড়াতে এলে শিবেনের এই ফ্যাসাদটা হয়। গোবিন্দ যখন পড়তে বসে, তখনই তার ঢুলুঢুলু অবস্থা। প্রথম অঙ্কটা হয়তো কোনওরকমে কষল, শিবেন সেটা যখন দেখছে, তখনই গোবিন্দ টেবিলে মাথা রেখে ঘুমে তলিয়ে গেছে। তাকে ডেকে-হেঁকে ঝাঁকিয়ে, কাতুকুতু দিয়ে দ্বিতীয় অঙ্কটা করাতে বসালে গোবিন্দ অঙ্কের মাঝখানেই হাই তুলতে-তুলতে বারকয়েক ঢুলে পড়ে। আর তখন শিবেনেরও হাই ওঠে, ঢুলুনি আসে। তিন নম্বর অঙ্কে পৌঁছতে তাই অনেক সময় চলে যায়। গোবিন্দর ঘুম তাড়ানোর জন্য বাড়ির লোকও কম চেষ্টা করেনি। প্রথমে একজন ঢাকিকে আনানো হয়েছিল। কিন্তু ঢাকের বিকট শব্দে পাড়াপ্রতিবেশিরা অতিষ্ঠ হয়ে থানা-পুলিশ করবে বলে জানায়। তা ছাড়া গোবিন্দর ঘুম ঢাকেরও তোয়াক্কা করেনি বলে ঢাকের বদলে লঙ্কা পোড়া দিয়ে পড়ার ঘরে ধোঁয়া দেওয়া হল। তাতে গোবিন্দ যেমন নাকাল, তার চেয়েও বেশি নাকাল হল বাড়ির লোকেরা। সবাই হেঁচে-কেশে অস্থির। তারপর চোখে সর্ষের তেল, ঠান্ডা জলের ঝাঁপটা ইত্যাদি অনেক কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু গোবিন্দর ঘুম তাতে নড়ার নামটিও করেনি। ওই ঘুমের জন্যই গোবিন্দর জনাসাতেক প্রাইভেট টিউটর কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে। তবে শিবেন ধৈর্যশীল মানুষ এবং ডাকাবুকো লোক। ময়নাগড়ে নতুন এসেছে ইশকুলে মাস্টারির চাকরি নিয়ে। তিন মাসেই লোকে জেনে গেছে শিবেনের অঙ্কের মাথা খুব পাকা, তাই তাকে নিয়ে ছাত্তরমহলে কাড়াকাড়ি। উদ্ধববাবু অনেক বেশি টাকা কবুল করে তাকে নিজের অপোগণ্ড নাতি গোবিন্দর জন্য নিয়োগ করেছেন। বলেছেন, বাপু হে, আশি-নব্বই নয়, অঙ্কে তিরিশটি নম্বর জোগাড় হলেই আমি খুশি। দু-মাস হল শিবেন লেগে আছে। গোবিন্দর তেমন কোনও উন্নতি হয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে না। অঙ্কের উন্নতি না হলেও, দিন-দিন যে গোবিন্দর ঘুমের উন্নতি হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।

আজ অবিশ্যি গোবিন্দ পড়তে এসেই হাই তুলে বলল, জানেন মাস্টারমশাই, আজ দাদু ভূত দেখেছে।

শিবেন ভূতে বিশ্বাসী নয়, কৌতূহলও নেই। অঙ্কের বইয়ের পাতা ওলটাতে-ওলটাতে আনমনে শুধু বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ মাস্টারমশাই, লম্বা, ফরসা, ম্যাজিশিয়ান ভূত!

বটে! ভূত আবার ম্যাজিশিয়ানও হয়, কখনও শুনিনি তো!

গোবিন্দ তিন মিনিটের একটা ঢুলুনি সামলে নিয়ে বলল, তাকে পাঁচুও দেখেছে। তার নাম হিজিবিজি।

এতক্ষণ এসব কথায় তেমন গা করেনি শিবেন। এবার হঠাৎ চমকে উঠে বলল, কী নাম বললে?

গোবিন্দ পাক্কা পাঁচ মিনিট অঘোরে ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে বলল, ওঃ হ্যাঁ, তার নাম হিজিবিজি।

শিবেনের মুখটা একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। খানিকক্ষণ গোবিন্দর টেবিলের উপর নোয়ানো মাথাটার দিকে চেয়ে থেকে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলল, তা হলে কি সন্ধান পেয়েছে?

ঠিক এই সময় উদ্ধববাবু ঘরে ঢুকে খুবই উদ্বেগের গলায় বলে উঠলেন, সন্ধান পাবে কী করে হে! সে কি মনিষ্যি, যে সন্ধান পাবে?

শিবেন থমতম খেয়ে কী বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু বলল, যে আজ্ঞে!

উদ্ধববাবু চোখ গোল-গোল করে বললেন, বললে বিশ্বাস হবে না ভায়া, জলজ্যান্ত দিনেদুপুরে ভূত এসে হাজির হয়েছে। কী বিপজ্জনক পরিস্থিতি বলল তো! এরকম চলতে থাকলে তো ময়নাগড় একেবারে ভূতের বৃন্দাবন হয়ে উঠবে!

শিবেন একটু উদ্বেগের গলায় বলল, তাকে আপনি কোথায় দেখেছেন?

সকালবেলায় বাজারে যাওয়ার পথে, তেঁতুলতলায়। কী বলব ভায়া, তার সঙ্গে যে কিছুক্ষণ খোশগল্পও করেছি। ভূত বলে ঘুণাক্ষরেও বোঝা যায়নি। রঙ্গ-রসিকতাও করছিল। দিব্যি সুন্দরপানা লম্বা-চওড়া চেহারা, তার ওপর দিনমানের আলোয় দেখা। ভূত বলে মনে হওয়ার কারণও ছিল না। কথা কইতে কইতে হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়াতেই বুঝলাম যে, সে ভূত।

শিবেন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, গোবিন্দ বলছিল, লোকটা নাকি ম্যাজিশিয়ান!

তা বলছিল বটে! কিন্তু তার কোন কথাটা সত্যি, আর কোন কথাটা মিথ্যে, তা কে বলবে!

ম্যাজিশিয়ানরা অনেক কৌশল জানে। ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া তার একটা কৌশলও হতে পারে।

আহা, ওসব স্টেজে হয়। কিন্তু দিনেদুপুরে একটা লোকের হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!

উন্নততর প্রযুক্তি আর কৌশলে সবই সম্ভব।

উদ্ধববাবু একটা চেয়ার টেনে শিবেনের পাশে বসে গলা নামিয়ে বললেন, বাপু হে, তুমি তো সায়েন্সের লোক, অনেক জানোটানো, তা হলে কি বলতে চাও, লোকটা আমার চোখে ধুলো দিয়েছে?

শিবেন একটু হেসে বলল, সেটাই সম্ভব। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। ভূতপ্রেত মানি না। আপনি যাকে দেখেছেন তাকে ভূত বলে মনে হচ্ছে না। তবে সে কোনওভাবে একটা অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি করেছিল। উন্নততর প্রযুক্তির সাহায্যে সেটা সম্ভব হতেও পারে।

তা হলে কি লোকটা আমাকে ম্যাজিক দেখিয়ে বোকা বানাল?

আমার অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। ছোঁকরা আমাকে কিছু কথা বলেছিল।

শিবেন হঠাৎ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলল, কী কথা?

বলেছিল, তাকে নাকি কিছু লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে সেইজন্য গা-ঢাকা দিয়ে থাকার জায়গার সন্ধানে ময়নাগড়ে এসে হাজির হয়েছে। যারা খুঁজছে জিগ্যেস করায় সে পুলিশ, মিলিটারি আর ইন্টারপোলেরও নাম করেছিল। এখন ভাবছি, ভূত হলে পুলিশটুলিসের তো তাকে খোঁজার কথা নয়।

শিবেন একটু নিভে গিয়ে বলে, যে আজ্ঞে!

তোমার কি মনে হয় বলো তো ভায়া, লোকটা ভূত

উঁচুদরের ধাপ্পাবাজ?

শিবেন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ভূত নয় বলেই জানি। তবে ধাপ্পাবাজ কিনা তা জানি না।

আমি বুড়োমানুষ, চোখের ভুল হলেও হতে পারে। কিন্তু পাঁচু তো আর বুড়ো নয়। সেও তো দেখেছে।

পাঁচু কে বলুন তো?

সে তুমি চিনবে না। গাঁয়ের ছেলে, নিষ্কর্মা।

বিশ্বাসবাড়ির বোকাসোকা ছেলেটা নাকি?

হ্যাঁ, সে-ই।

পাঁচু মাঝে-মাঝে আমার কাছে আসে। তাকে চিনি। আপনারা দুজন ছাড়া আর কেউ দেখেছে লোকটাকে?

মাথা নেড়ে উদ্ধববাবু বললেন, দেখলেও কেউ কবুল করেনি। তবে সে যখন এখানে থানা গেড়েছে তখন অনেকেই দেখবে।

শিবেন খুব চিন্তিত হয়ে বলল, হুঁ।

তা হলে ভয়ের কিছু নেই বলছ তো! সায়েন্সের লোকেরা ভরসা দিলে আমরা একটু জোর পাই। এই তো সেদিন নরহরি ঘোষ বলল, সায়েন্সে নাকি বলেছে, শনিপুজোর সিন্নি খেলে নাকি ম্যালেরিয়া সেরে যায়। কারণ, তাতেই শনির তেজস্ক্রিয়তা এসে ঢুকে এমন ভজঘট্ট পাকিয়ে তোলে যে, ম্যালেরিয়া পালানোর পথ পায় না।

বলেছে বুঝি?

নরহরি সায়েন্সের মেলা খবরটবর রাখে। এই গাঁয়ে বিজ্ঞানের সলতেটা ও-ই জ্বালিয়ে রেখেছে কিনা! অ্যাটম বোমা জিনিসটা কী তা নরহরিই তো একদিন জলের মতো বুঝিয়ে দিল আমাদের।

বটে!

তবে আর বলছি কী। বলল, অ্যাটম নাকি পোস্তদানার চেয়ে ছোটও জিনিস। তবে ভারী তেজি, লম্বা মতো একটা নলের মধ্যে ভরে খুব ঠেসে দিতে হয়, তারপর এরোপ্লেনে উঠে পলতেয় আগুন দিয়ে ফেলে দিতে হয়। যখন ফাটে তখন নাকি দেখবার মতো জিনিস। আমাদের কাশেমের চরে নাকি অ্যাটমের খনি আছে। বস্তা-বস্তা অ্যাটম চালান যাচ্ছে বিদেশে। অ্যাটম বেচেই তো কাশেম লাল হয়ে গেল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবেন বলল, নরহরিবাবু খুবই জ্ঞানী লোক দেখছি।

এমনিতে নরহরি লোক সুবিধের নয়, বুঝলে। ভারী ঝগড়ুটে, বিশ্বনিন্দুক, হাড়কেপ্পন। কিন্তু বিজ্ঞানটা জানে ভাল। ইশকুলের সায়েন্সের মাস্টারমশাই বিষ্টুবাবু পর্যন্ত ওর সামনে দাঁড়াতে পারেন না। ইস্কুলে সেদিন মাধ্যাকর্ষণ বোঝাতে গিয়ে নিউটনের সেই গাছ থেকে আপেল পড়ার বৃত্তান্ত বলছিলেন বিষ্টুবাবু। তা নরহরি সেদিন চণ্ডীমণ্ডপে বসে বলছিল, বিষ্টুবাবু অর্ধেকটা জানেন, বাকি অর্ধেকটা জানেন না। আপেলটা পড়েছিল ঠিকই, তবে সেটা পড়েছিল নিউটনের মাথায়। বিলেতের আপেল, সাইজেও এক-একটা তালের মতো। মাথায় পড়াতে নিউটনের ঘিলু চলকে গিয়ে দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়, আর তাইতেই মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করে ফেলেন। তবে নরহরি এ-কথাও বলেছে, মাধ্যাকর্ষণের আসল ব্যাপারটা খুব গুহ্য কথা, এখনও বিজ্ঞানীরা সব চেপেচুপে রেখেছেন। কয়েক বছর পর তা প্রকাশ পাবে।

শিবেন অবাক হয়ে বলে, সে কথাটা কী?

উদ্ধববাবু গলা খাটো করে বললেন, আগে নাকি মাধ্যাকর্ষণ বলে কিছু ছিল না, তখন মানুষ, গরু, কুকুর, ছাগল মায় গাছপালা অবধি গ্যাসবেলুনের মতো ভেসে ভেসে বেড়াত, তারপর উঁচুতে উঠতে-উঠতে স্বর্গে গিয়ে ঠেকত। তাইতে স্বর্গের লোকেরা ভারী জ্বালাতন হয়ে উঠল। স্বর্গে গাদাগুচ্ছের মানুষ, গোরু, ছাগল ঢুকে পড়ায় বিশৃঙ্খল অবস্থা। ওদিকে পৃথিবী ফাঁকা পড়ে আছে। সৃষ্টি রসাতলে যাচ্ছে। তখন নাকি সৃষ্টি বাঁচাতে ব্রহ্মা একটা রাক্ষুসে চুম্বক মাটির নীচে পেতে দিলেন। ব্যাস, সেই থেকে সব আমরা আটকে আছি।

এটাও কি সায়েন্সে বলেছে?

তবে? নরহরির কাছে পুঁথিখানা আছে, খুব গুপ্ত পুঁথি। সাহেবদেরই বই, তবে বাংলায় লেখা। খালাসপুরের হাটে যুধিষ্ঠির দাস নামে যে লোকটা বইপত্র বেচতে আসে, তার কাছ থেকে মেলা ঝোলাঝুলি করে কেনা, দু-টাকার বই দশ টাকায় রফা হয়েছে।

শিবেনের ফের দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সে মিনমিন করে বলল, সাহেবরা বাংলা বই লিখতে যাবে কেন সেটাই বুঝতে পারছি না।

উদ্ধববাবু গলাটা আরও খাটো করে বললেন, আহা, এটা না বোঝার কী আছে হে বাপু! ইংরিজিতে লিখলে অন্য সব সাহেবরা জেনে যাবে যে! বাংলায় লিখলে জিনিসটা লেখাও হয়ে রইল, গোপনও থাকল। বড়-বড় দোকানে ও বই পাবে না, গাঁয়েগঞ্জে খুব গোপনে দু-চারজন বিক্রি করে।

একটু আগে গোবিন্দর হাই তোলা দেখে শিবেনেরও হাই উঠেছিল। ঘুম-ঘুম ভাবটাও বেশ চেপে ধরেছিল তাকে। এখন এসব বৃত্তান্ত শুনে ঘুম পালিয়েছে বটে, কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস পেয়ে বসেছে শিবেনকে। দীর্ঘশ্বাসকে চেপেচুপে ছোট করাতে কিছুতেই পেরে উঠছে না সে। মাথাটাও একটু-একটু ঘুরছে। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, এবার তা হলে আসি উদ্ধববাবু?

আহা, আটটা দশ মিনিট বাজছে যে! এ সময়ে বেরোতে আছে?

অবাক হয়ে শিবেন বলে, আটটা দশ মিনিটে বেরোলে কী হয়?

তুমি যে জমিদারবাড়ির খাজাঞ্চিখানায় থাকো। ওর কাছেই তো পদ্মঝিল। এ সময়ে কলসি-কানাই ঝিল থেকে উঠে তার বউ-বাচ্চাকে দেখতে যায় যে।

শিবেন হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, কলসি-কানাইটা আবার কে?

উদ্ধববাবু খুব বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, তাও জানো তুমি! কলসি-কানাই সম্পর্কে বেশি না বলাই ভালো। নতুন এসেছ এই গাঁয়ে, ভয়টয় পাবে। তবে মোদ্দা কথা হল, রাত আটটা থেকে নটার মধ্যে পদ্মঝিলের দিকটায় না যাওয়াই ভালো, বলা তো যায় না।

শিবেন একটু হেসে বলল, ভূত নাকি? আপনাকে তো বলেইছি, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, ভূতটুত মানি না।

ওরে বাপু, ভূতেরও বিজ্ঞান আছে, নাকি? নইলে ভৌতবিজ্ঞান হল কী করে?

আজ্ঞে, ভৌতবিজ্ঞান অন্য জিনিস। সেটা ভৌতিক বিজ্ঞান নয়।

ওপর-ওপর বোঝা যায় না হে! তলিয়ে পড়লে দেখবে, ওর মধ্যেই ঠারেঠারে ভূতের বৃত্তান্ত গোঁজা আছে।

আজ্ঞে সেটাকেই বোধহয় গোঁজামিল বলে। বিজ্ঞানেই তো বাপু পঞ্চভূতের কথা আছে। শিবেন বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলল, তা বটে! তবে সেই ভূত কিন্তু প্রেতাত্মা নয়।

মিলেমিশে থাকে হে, টক করে বোঝা যায় না। একটোপ্লাজম কী জিনিস জানো?

আজ্ঞে না।

ভূত হল ওই জিনিস দিয়ে তৈরি, যদুর শুনেছি, এক চামচ ক্ষিতি, দেড়চামচ অপ, এক চিমটি তেজ, এক খাবলা মরুৎ, আর খানিকটা ব্যোম মিশিয়ে তার মধ্যে একটু ফসফরাস ঘষে দিলেই একটোপ্লাজম তৈরি।

শিবেন উঠে হাতজোড় করে বলল, বড্ড রাত হয়ে যাচ্ছে উদ্ধববাবু, আজ আমি আসি গিয়ে। শরীরটা একটু কাহিল লাগছে।

যাবে! তা ঝিলের ধারের রাস্তায় না গিয়ে বাবুপাড়ার রাস্তা দিয়ে যেও।

যে আজ্ঞে! বলে শিবেন বেরিয়ে পড়ল।

সন্ধের পর ময়নাগড় ভারী ভয়ের জায়গা, কারণ শীতকালের দিকটায় আশেপাশে চিতাবাঘের খুব উৎপাত। তা ছাড়া উত্তরের জঙ্গলে যেসব ভালুকের কথা শোনা যায়, তারাও বিশেষ ভালমানুষ নয়। বাগে পেলে লম্বা নখ আর দাঁতে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। মাঝে-মাঝে হাতির পালও বোরোয়। নেকড়ে বাঘ বা বুনো কুকুরের দৌরাত্মের কথাও খুব শোনা যায়। কাজেই সন্ধের পর ময়নাগড় ভারী শুনশান জায়গা। পথে লোকের চলাচল নেই বললেই হয়। সন্ধে সোওয়া আটটায় যেন নিশুতি রাত নেমে এসেছে।

প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও শিবেনের মাথাটা আজ গরম। ভূতপ্রেতে সে বিশ্বাসী নয় ঠিকই, কিন্তু যে, বিপদের আঁচ সে পেয়েছে, তাতেই বুক ধকধক করছে, মনে উদ্বেগ, রাস্তায় পা দিয়ে সে অত্যন্ত দ্রুতবেগে হাঁটছিল। গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তার নগেন সরখেলের চেম্বারে গাঁয়ের প্রবীণদের একটা সান্ধ্য জমায়েত হয়। বাঁদুরে টুপি, সোয়েটার, চাঁদরে জাম্বুবান হয়ে সব বসে আছে। আর ভিতর থেকে হরগোবিন্দ ঘোষাল মুখ বাড়িয়ে হেঁকে বলল, কে হে, শিবেন নাকি?

যে আজ্ঞে।

দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। কখন থেকে বাড়ি যাব বলে একজন সঙ্গী খুঁজছি, তা ওইখানে যাওয়ার কেউ নেই আজ। বুড়োমানুষ, তার উপর পাঁচু খবর দিয়ে গেল বাঁশতলার কাছে, রামহরির বাড়ি থেকে তার বাছুরটাকে আজ সন্ধেবেলায় চিতাবাঘে নিয়ে গেছে।

বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হল শিবেনকে। যদিও মনটা উচাটন, কিন্তু গাঁয়ে থাকতে গেলে সকলের সঙ্গে সমঝোতা থাকা ভালো।

হরগোবিন্দ ঘোষাল সঙ্গ ধরে বলল, ওই উদ্ধবের নাতি গোবিন্দর পিছনে বাপু তুমি বৃথাই আয়ুক্ষয় করছ। গোবিন্দর ঘুম কেউ ভাঙাতে পারবে না। তার চেয়ে তুমি বরং আমার নাতি বলাইকে পড়াও। গত বার্ষিক পরীক্ষাতেও অল্পের জন্য অঙ্কের লেটার মার্ক ফসকে গেছে। তুমি হাতে নিলে একশোতে একশো পাবে।

বলাই অঙ্কে কত পেয়েছিল?

ওই তো বললুম, লেটার মার্কটা পেয়েও পেল না। সরল অঙ্কটা সব ঠিকঠাক করেও উত্তরের জায়গায় শূন্যের বদলে নাকি এক লিখেছিল। আসলে লিখেছিল শূন্যই, কিন্তু তাড়াহুড়োয় কলমের খোঁচা লেগে শূন্যের মাথায় একটা টিকি বসে যায়। তাইতেই দশ-দশটা নম্বর পিছলে গেল। চৌবাচ্চার অঙ্কেও তাই, সব ঠিকঠাক করে শেষ লাইনে কী একটা গণ্ডগোল, গেল দশটা নম্বর। কপালের ফেরে অ্যালজেব্রাতেও এক্স লিখল, মাস্টারমশাই সেটা ওয়াই ভেবে দিলেন ঘ্যাচাং করে নম্বর কেটে। কপালের ফের রে ভাই! জ্যামিতির কথা শুনবে? যতবার ত্রিভুজ আঁকতে যায়, পেনসিলের শিস যায় ভেঙে। ফের পেনসিল কেটে শিস বার করতে করতে ঘণ্টা পড়ে গেল। যাই হোক, লেটার মার্ক ফসকালেও নম্বর খুব একটা খারাপ নয়। আটত্রিশ, একটু ধরিয়ে মকশো করে দিলে, ওই আটত্রিশ অষ্টাশি হতে লহমাও লাগবে না।

আমি যতদূর জানি, বলাই বার্ষিক পরীক্ষায় অঙ্কে তেইশ পেয়েছিল।

আহা, খাতায়-কলমে তেইশ হলেও, যে অঙ্কগুলো ঘণ্টা পড়ে যাওয়ায় করতে পারেনি, সেগুলো ধরলে আটত্রিশ কেন, একটু বেশিই দাঁড়ায়। স্কুলের পরীক্ষায় আর কটা ছেলের ঠিকঠাক অ্যাসেমেন্ট হয় বলো!

তা অবিশ্যি ঠিক।

বলে শিবেন ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

হরগোবিন্দ ঘোষাল গলাটা একটু নামিয়ে বলল, বাপু হে, তুমি যে কেন জমিদারবাড়ির খাজাঞ্চিখানায় পড়ে আছ তা বুঝি না। ও হল হানাবাড়ি, আজ বিশ-পঁচিশ বছর হল ও বাড়িতে কেউ থাকে না। শুধু বুড়ো শ্যামাচরণের তিন কুলে কউ নেই বলে নাচার হয়ে পড়ে আছে। সে অবিশ্যি ওই বাড়িতেই সারাজীবন কাটিয়েছে বলে মায়ার টানও হয়তো একটু আছে। কিন্তু কাজ কী তোমার ওই ভুতুড়ে বাড়িতে পড়ে থেকে? বরং আমার বাড়িতে চলে এসো। বাইরের বাগানের দিকটায় দুই নাতি কানাই আর বলাইয়ের জন্য পড়ার ঘর করেছি। দিব্যি বড়সড় ঘর। তার একধারে চৌকি পেতে দিব্যি থাকবে। দু-বেলা আমাদের সঙ্গেই দুটি খেও। কোনও অসুবিধে হবে না। ওই সঙ্গে কানাই, বলাইকে ঘমেমেজে একটু মানুষ করে দাও।

শিবেন হেসে বলে, আজ্ঞে, আপনার প্রস্তাব তো খুবই ভাল! তবে কিনা আমার খাজাঞ্চিখানায় থাকতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। ভূতের ভয় আমার নেই। জায়গাটা নিরিবিলি বলে আমার লেখাপড়ারও একটু সুবিধে হয়।

হরগোবিন্দ ভারী অবাক হয়ে বলল, লেখাপড়া? মাস্টার হয়ে আবার লেখাপড়া কিসের? বলি, লেখাপড়া শেষ করেই তো লোকে মাস্টার হয়। তারপরও কেউ লেখাপড়া করে নাকি? তা হলে আর জীবনে সুখ কী রইল বলো?

কেন, লেখাপড়ার মধ্যে কি সুখ নেই?

দূর দূর! কী যে বলো ভায়া! লেখাপড়ার মধ্যে আবার সুখের কি দেখলে? শুকনো বই খুলে বসে থাকার কোনও মানে হয়? সময় নষ্ট, আয়ু ক্ষয়, শিরঃপীড়া, চোখে ছানি আসবে, আমার বাড়িতে গেলে দেখবে নাতিউতিদের পড়ার বই ছাড়া বই বলতে আছে শুধু একখানা পঞ্জিকা, একখানা লক্ষ্মী আর একখানা সত্যনারায়ণের পাঁচালি আর একখানা কাশীদাসী মহাভারত। আর বইপত্রের নামগন্ধও নেই। বই পড়া মানে তো সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করা ছাড়া কিছু নয়। এই আমাকেই দ্যাখো না কেন, ইশকুলের গণ্ডিটা ডিঙিয়েই ও পাট চুকিয়ে দিয়েছি। সকালে উঠে একটু হরিনাম নিয়েই গো-সেবায় লেগে পড়ি। তারপর চাট্টি মুড়িটুড়ি খেয়ে বাজারে যাই। দুপুরে চাট্টি খেয়েই লম্বা দিবানিদ্রা। বিকেলে একটু বাগানের কাজ, তারপর আড্ডা। এই এখন বাড়িতে ফিরে খেয়েদেয়ে লেপের তলায় ঢুকে যাব। একঘুমে ভোর, দিব্যি আছি।

শিবেন মাথা নেড়ে বলে, তাই বটে, তবে আমার একটু লেখাপড়ার বাই আছে।

হরগোবিন্দ কৌতূহলী হয়ে বলল, তা কী বই পড়ো তুমি? নাটক, নভেল, নাকি গুপ্তবিদ্যাটিদ্যা কিছু?

আজ্ঞে না। আমি হায়ার ম্যাথমেটিক্স আর বিজ্ঞানের বই পড়ি।

ওরে বাবা! শুনেছি অঙ্কের বই নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে হাঁফানি আর শ্লেষ্মর দোষ হয় আর বিজ্ঞান নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করাও নাকি ভালো কথা নয়। ওতে লোকে নাস্তিক হয়। আর তাতে ঠাকুর-দেবতারা ভারী কুপিত হয়ে ওঠেন।

শিবেন শান্ত গলায় বলে, বইটই না পড়লে জ্ঞান হবে কী করে? জ্ঞানই তো মানুষের মস্ত সম্পদ।

ঘোষাল একটু ভাবিত হয়ে বলল, সেকথাও মিথ্যে নয়। জ্ঞান খুব দামি জিনিসই হবে। তবে কি জানো বাপু, বেশি জ্ঞানই কি ভালো? এই যে আমাদের মন্মথবাবু বিদ্যে একেবারে গুলে খেয়ে বসে আছেন। তা তার কি তাতে শান্তি আছে? পেটে বিদ্যে আছে বলে রাজ্যের লোক তার কাছে দরখাস্ত লেখাতে আসে। নানা জটিল জিনিস সরল করে বুঝতে হাজির হয়। একদিন তো শুনলুম, কোথাকার একটা উটকো লোক এসে তেঁতুলবিচিকে কেন কাইবিচি বলা হয় তাই নিয়ে সকাল থেকে দুপুর অবধি তর্ক করে গেল।

শিবেন হতাশ হয়ে বলল, আপনি দেখছি লেখাপড়া বিশেষ পছন্দ করেন না! তা হলে আর নাতিকে বিদ্বান করতে চাইছেন কেন?

হরগোবিন্দ বলল, আহা, বিদ্যে কি আর খারাপ জিনিস? তা তো আর বলিনি হে বাপু। বলছি কোনও জিনিসের বাড়াবাড়ি কি ভালো? পড়ার বয়সে না হয় একটু পড়লে টড়লে, কিন্তু তারপর পাশটাস করে চাকরিতে ঢুকে গেলে আর ওসবের দরকারটা কী? তা, সে কথা থাক। তুমি তা হলে ওই খাজাঞ্চিখানাতেই থাকবে বলে মনস্থ করেছ তো!

আজ্ঞে হ্যাঁ, জায়গাটা ভারী ভালো। যেমন বড় ঘর, তেমনই ভারী নিরিবিলি।

তা বটে, তবে কিনা ওই খাজাঞ্চিখানাতেই নগেন পোদ্দার গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছিল।

নগেন পোদ্দার কে বলুন তো?

সে অবশ্য চল্লিশ বছর আগেকার কথা। খাজাঞ্চিখানায় খাতা লিখত নগেন পোদ্দার। জমিদার প্রসন্ন রায়ের আমল। নগেন পোদ্দারের মতো অমন হাড়কেপ্পন তোক আর ভূভারতে নেই। চেহারাখানাও হাড়গিলে শকুনের মতো। সর্বদা চারিদিকে শ্যেণদৃষ্টি। এক পয়সা ফাদার-মাদার। কোথাও কাঙালিভোজন হচ্ছে খবর পেলেই সেখানে গিয়ে পেটপুরে খেয়ে আসত। খেয়ে না-খেয়ে এক কলসি টাকা জমিয়েছিল। একদিন সেই টাকা কলসি সমেত চুরি যায়। টাকার শোকে নগেন প্রথমে পাগল হয়ে গেল, তারপর পাথর। চুপচাপ বসে বিড়বিড় করত। তারপর এক রাতে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ল। তার প্রেতাত্মা সেই টাকার কলসি খুঁজে বেড়াত, অনেকেই দেখেছে। তাই বলছিলাম ভায়া, খাজাঞ্চিখানা জায়গাটা এমনিতে মন্দ নয় বটে, তবে কিনা–

আমি তো বলেইছি, আমার ভূতপ্রেতে বিশ্বাস নেই, ভয়ও নেই।

তারপর ধরো, শীতকালটা খারাপ কিছু নয়। কিন্তু গরম পড়লেই দেখবে, আনাচকানাচ থেকে বিষধর সব চক্করওয়ালা লতানে জিনিস বেরিয়ে আসবে। গোখরো, চন্দ্রবোড়া, কালাচ, কেউটে, কী নেই সেখানে। চারধারে কিলবিল করে বেড়াবে।

কই, আমি তো তেমন সাপখোপ দেখতে পাইনি কখনও।

আহা, তার কি আর সময় গেছে! গতবার দ্যাখোনি তো কী হল! এবারেই হয়তো দেখবে। তাই বলছিলাম, কাজ কী তোমার ওই বিপদের মধ্যে থেকে?

শিবেন হেসে বলল, বিপদ ঘটলে তখন দেখা যাবে।

হরগোবিন্দ ঘোষাল নিজের বাড়ির মোড়টায় এসে বলল, চলি হে ভায়া, যা বললুম একটু ভেবে দেখো, আখেরে তোমার লাভই হবে।

শিবেন জবাব না দিয়ে হাঁটা ধরল।

জমিদার বাড়িটা বিশাল বাগান দিয়ে ঘেরা। বাগানের পাঁচিল অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। বাগানে আগাছাও বিস্তর।

ফটক থেকে অনেকটা ভিতর দিকে, অন্ধকারে পুরোনো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদ না হলেও বাড়িখানা পেল্লায় বড়। এখন আর কেউ এখানে থাকে না। বুড়ো শ্যামাচরণই একমাত্র পড়ে আছে, যাওয়ার জায়গা নেই বলে।

ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকে বাঁধারে পুকুরের পুব ধারে ব্যারাকের মতো একটা লম্বা দালানই হচ্ছে খাজাঞ্চিখানা। শিবেন টর্চ জ্বেলে দেখল, তার ঘরের সামনে বারান্দায় শ্যামাচরণ একখানা চাঁদরে মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে আছে।

এ কী শ্যামাদা, তুমি এখানে বসে আছ যে!

আর বোলো না, তোমার ঘরে যে আজ সন্ধেরাতে চোর ঢুকেছিল!

শিবেন চমকে উঠে বলল, চোর! বলো কী!

রোজ সন্ধেবেলা আমি একটু হরিনাম শুনতে বিষ্ণুমন্দিরে যাই, সবাই জানে। আজ একটু শরীরটা রসস্থ হওয়ায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ঠাকুর দালানে পিদিম জ্বেলে দিয়ে ঘরে ফেরার সময় হঠাৎ দেখি দু-দুটো লোক তোমার ঘরের দরজার তালা খোলার চেষ্টা করছে। হাঁক করতেই অবশ্য দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল। কিন্তু লক্ষণটা ভালো ঠেকল না। ময়নাগড়ের সব চোর আমার চেনা। আবছা অন্ধকারে দেখা বটে, কিন্তু এরা এখানকার লোক নয়। এ তল্লাটের চোর এ বাড়িতে হানা দেবে না। বলি, দামি জিনিস-টিনিস কিছু রেখেছ নাকি ঘরে?

শিবেন আমতা-আমতা করে বলে, না, না, দামি জিনিস আর কী থাকবে আমার ঘরে! শুধু বইপত্র আর খাতা কলম।

তালাটা চোরেরা খুলে ফেলেছে, তবে ঘরে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। আমি সেই থেকে বসে তোমার ঘর পাহারা দিচ্ছি। আগে ঘরে ঢুকে হ্যারিকেনটা জ্বেলে দ্যাখো তো কিছু খোয়া গেছে কিনা।

শিবেন দরজার তালাটা পরীক্ষা করে দেখল, সেটা কেউ হ্যাক স দিয়ে কেটে ফেলেছে। মুখটা শুকিয়ে গেল তার। ঘরে ঢুকে কাঁপা হাতে হ্যারিকেন জ্বেলে দেখল, ঘরের জিনিস সব ঠিকঠাকই আছে।

শ্যামাচরণ পিছু পিছু ঘরে ঢুকে বলল, ভালো করে দেখেছ?

কিছু চুরি যায়নি বলেই মনে হচ্ছে।

বিপদ কী জানেনা, সন্ধেবেলাটায় তুমি পড়াতে যাও, আমি যাই হরিকীর্তনে। বাড়িটা ফাঁকা থাকে। চোর যদি আবার আসে, তবে ঠেকাবে কে?

শিবেন বিপন্ন গলায় বলে, তাই তো ভাবছি।

তুমি মাস্টার মানুষ, ছেলে পড়িয়ে খাও, শেঠিয়া লোক তো নও। তবে তোমার উপর চোরের নজর পড়ল কেন বলো তো! রাত-বিরেতে যদি দলবল জুটিয়ে আসে তখন

তো আরও বিপদ। আমি বুড়ো মানুষ, আর তুমি জোয়ান হলেও পালোয়ান তো নও। ঠেকাবে কী করে?

শিবেন দুশ্চিন্তায় পড়ে বলল, হুঁ।

শ্যামাচরণ দুঃখের গলায় বলল, ময়নাগড় বড় শান্তির জায়গা ছিল হে। কিন্তু দিনগুলো পালটে যাচ্ছে। লোক দুটো দেখতে কেমন বলতে পার?

অন্ধকারে কী করে বুঝব? দুটো কালো কালো মানুষের আকার দেখেছি। তার বেশি কিছু বলতে পারব না।

আচ্ছা শ্যামাদা, রাজবাড়িতে গুপ্তকুঠুরি কিছু আছে? শ্যামাচরণ সন্দিহান হয়ে বলল, কেন বলো তো!

ভাবছিলাম, কিছু কাগজপত্র যদি লুকিয়ে রাখা যায়? শ্যামাচরণ অবাক হয়ে বলে, শোনো কথা? বলি কাগজপত্র কি লুকোনোর জিনিস? চোর কি কাগজপত্র চুরি করতে আসবে? বলি, সোনাদানা কিছু আছে?

শিবেন মিনমিন করে বলে, না, সোনাদানা কোথা থেকে। আসবে?

ভালো করে ভেবে দ্যাখ দিকিনি। চোরে কি আর এমনি হানা দেয়? কিছু একটা গন্ধ পেয়েই এসেছিল। সত্তর বছর আগে এ-বাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল, মনে আছে। তখন আমি ছোট। জমিদারের পাইকরা খুব লড়েছিল ডাকাতের সঙ্গে। তবে যে-সে ডাকাত তো নয়, কেলোডাকাত বলে কথা! পাইকরা তাদের লাঠি সড়কির সামনে দাঁড়াতে পারল না। সব লুটেপুটে নিয়ে গেল। তার পর থেকে আজ অবধি আর এ-বাড়িতে চোর-ডাকাত আসেনি। আর আসবেই বা কেন! বাবুদের অবস্থা পড়ে গেল। তারপর তো সব যে যার পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলল। থাকার মধ্যে এই আমি পড়ে আছি। যে বাড়ির এত জাঁকজমক ছিল, তাতে এখন ইঁদুর, বাদুর, চামচিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়ে আছে শুধু কয়েকখানা ভাঙা খাট-পালঙ্ক। তা এত বছর বাদে ফের চোরের আনাগোনা কেন শুরু হল সেটা ভাববার কথা।

শিবেন বিনয়ের সঙ্গেই বলল, চোরের নেওয়ার মতো তো কিছু নেই শ্যামাদা। তবে টাকাপয়সা বা সোনাদানা না থাকলেও আমার কিছু রিসার্চ-ওয়ার্ক আছে। সেগুলো বেহাত হলে আমার ক্ষতি।

দূর! দূর! তুমিও যেমন! কাগজপত্র নিতে আসবে কোন আহাম্মক? তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

শ্যামাচরণ কথাটা উড়িয়ে দিলেও শিবেনের দুশ্চিন্তা গেল। আসল কথা হল, কলেজে পড়ার সময় থেকেই ভজহরি নামে একটা ছেলের সঙ্গে তার রেষারেষি। ভজহরি যেমন শিবেনকে দেখতে পারে না, শিবেনও তেমনি ভজহরিকে। ভজহরি আড়ালে সবাইকে বলে বেড়ায়, শিবেন! ও তো টুকে পাশ করেছে। অথচ শিবেন ভালোই জানে, টুকে পাশ করেছে ভজহরিই, এবং টুকেছে শিবেনেরই খাতা থেকে। যাই হোক, রেষারেষি করেই তারা এম এসসি অবধি পাশ করেছে। দুজনেই ডক্টরেটের জন্য রিসার্চ করছে। কে কার আগে থিসিস জমা দেবে তাই নিয়ে চলছে মর্যাদার লড়াই এবং স্নায়ুযুদ্ধ। বাইরের লোক বুঝতেও পারবে না, এটা কী সাঙ্ঘাতিক প্রেস্টিজের ব্যাপার। শিবেনের ঘোর সন্দেহ, ভজহরি যেনতেন প্রকারে তার রিসার্চ ভণ্ডুল করার চেষ্টা করবে। শিবেন যে ভজহরিকে ভয় পায় তার কারণ হল, ভজহরি অনেক তুকতাক জানে। কলেজে পড়ার সময়ই সে বেশ নামকরা একজন ম্যাজিশিয়ান ছিল। তা ছাড়া কুংফু, ক্যারাটে এসবও শিখেছিল। কাজেই ময়নাগড়ে যে রহস্যময় আগন্তুকের কথা শোনা যাচ্ছে, তা যে ভজহরিই, তাতে সন্দেহ নেই। ভজহরি ছাড়া আর কে শিবেনের ঘরে হানা দেবে?

দুশ্চিন্তায় শিবেনের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার রিসার্চের কাজ প্রায় শেষ। জমা দিলেই ডক্টরেট। কিন্তু তীরে এসে তরী না ডোবে! ভজহরির ভয়েই সে ময়নাগড়ের মতো অজ্ঞাত পাড়াগাঁয়ে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু দুর্দম, ডাকাবুকো ভজহরিকে ঠেকাতে পারল কি?

রাতে বারোখানা রুটি খায় শিবেন। আজ উদ্বেগে উকণ্টায় ছখানার বেশি পারল না। রোজ বালিশে মাথা রাখতে না-রাখতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। আজ ঘুম তার ধারেকাছেই ঘেঁষল না। শেয়ালের ডাক, পাচার রহস্যময় কণ্ঠস্বর, গাছের ডালে বাতাসের খটখট শব্দ, কুকুরের চিৎকার, যা শুনছে তাইতেই বারবার চমকে-চমকে উঠছে সে। কেবলই ধুকধুক করছে বুক, ওই বুঝি ভজহরি এল! আর এলেও কি তাকে চিনতে পারবে শিবেন? ভজহরি বরাবর স্কুল আর কলেজের স্পোর্টসে গো অ্যাজ ইউ লাইক-এ ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে এসেছে। ছদ্মবেশ পরতে অমন সিদ্ধহস্ত মানুষ আর আছে কিনা সন্দেহ। স্কুলে তাদের হেডমাস্টার ছিলেন উপেনবাবু, সাঙ্ঘাতিক রাশভারী আর রাগী লোক। তা সেবার হল কী, স্পোর্টসের শেষে যখন গো অ্যাজ ইউ লাইক হচ্ছে তখন ভারী একটা শোরগোল উঠল। দেখা গেল, আরও একজন উপেনবাবু আসরে ঢুকে পড়ে বেত হাতে ছাত্রদের সামলাচ্ছেন। সবাই হতভম্ভ, ভ্যাবাচ্যাকা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেক্রেটারি ভারী অবাক হয়ে বললেন, উপেনবাবু, আপনার কি জমজ ভাই আছে?

উপেনবাবু হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, না তো!

সেক্রেটারি অবিশ্বাসের গলায় বললেন, তা কী করে হয়? একইরকম হাইট, এক মুখ, এক চোখ, এক মাঝখানে। সিঁথি, এমনকী দুলকি চালের হাঁটা অবধি। ভাল করে ভেবে দেখুন, আপনার কোনও যমজ ভাই জন্মের পর মিসিং হয়েছিল কিনা। এরকম তো কতই হয়।

উপেনবাবু এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে, কথাই বলতে পারছিলেন না। যাই হোক, শেষ অবধি পণ্ডিতমশাই দ্বিতীয় উপেনের বাঁ-হাতের কবজির কাটা দাগটা দেখে চিনতে পেরে বলে উঠলেন, এ যে বদমাশ ভজহরি!

তখন হেডস্যার ভজহরির আস্পদ্দা দেখে তেড়ে গিয়ে এই মারেন কি সেই মারেন। তবে শেষ অবধি আশ্চর্য ছদ্মবেশের জন্য ভজহরি বিপুল প্রশংসা আর প্রাইজ পেয়েছিল। পরের বছর ভজহরি আরও সাংঘাতিক কাণ্ড করল। গো অ্যাজ ইউ লাইক যখন চলছে, তখন মাঠের মধ্যে একটি গোরু ঢুকে শান্তভাবে ঘাস খেয়ে যাচ্ছিল, কোনও দিকে ভূক্ষেপ নেই। যখন হেডস্যার রেজাল্ট ঘোষণা করতে উঠেছেন, তখন গরুটা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে পরিষ্কার মানুষের গলায় বলল, দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান। আরও একজন কম্পিটিটার আছে যে! সবাই হতভম্ভ। মানুষ যে এখন নিখুঁত গরু সাজতে পারে, এ যে সুদূর কল্পনাতেও আসে না। ফের প্রাইজ আর ভূয়সী প্রশংসা।

শিবেনের তাই ঘুম আসছে না। কারণ ভজহরি যে কোন রূপে দেখা দেবে তা কে জানে! এই শেয়ালটা হয়তো শেয়াল নয়, ভজহরি। ওই প্যাঁচাও হয়তো প্যাঁচা নয়, ভজহরি। যে বালিশে সে মাথা রেখে শুয়ে আছে, সেটাই যে ভজহরি নয় তার ঠিক কী?

নাঃ, আর শুয়ে থাকতে পারল না শিবেন। উঠে পড়ল। বালিশের পাশেই ফাঁইলবন্দি তার থিসিস। এটা খুব গুপ্ত জায়গায় লুকিয়ে না রাখলে ভজহরি এসে গাপ করবে বলেই তার স্থির বিশ্বাস।

গায়ে একটা আলোয়ান জড়িয়ে থিসিস বগলে নিয়ে সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরোল শিবেন। রাজবাড়ি তার চেনা এলাকা। সঙ্গে টর্চ থাকলেও সে তা জ্বালাল না। খুব নিঃশব্দে সে গাছপালার ভিতর দিয়ে আত্মগোপন করে রাজবাড়ির দিকে এগোতে লাগল।

আকাশে ক্ষয়টে একটু চাঁদ আছে বটে, কিন্তু কুয়াশার জন্য আলোটা বড়ই ঘোলাটে। তবে শিবেনের অসুবিধে নেই, রাজবাড়ির চৌহদ্দি তার চেনা জায়গা। সে গাছপালার ভিতর দিয়ে সাবধানে এগোচ্ছিল। বুকটা বড় ধুকপুক করছে। রাজবাড়ির ভিতরে মেলা পুরোনো আসবাবপত্র, আলমারি, দেরাজ, কুলুঙ্গি রয়েছে। গুপ্তকুঠুরি যদি না-ও পাওয়া যায়, তা হলে অন্তত লুকিয়ে রাখার মতো একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবেই।

বেশ এগোচ্ছিল শিবেন, কোথাও সন্দেহজনক কিছু দেখাও যাচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ কে যেন তার আলোয়ান ধরে একটা হ্যাচকা টান মারল। শিবেন সঙ্গে-সঙ্গে ফাঁইলখানা চেপে ধরে ককিয়ে উঠল, না ভাই ভজহরি, এরকম করাটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। এ আমার অনেক পরিশ্রমের ফসল…! বলে একটু বেকুব বনে গেল শিবেন। ভজহরি নয়, একটা গাছের ডালে তার চাঁদরটা আটকে গেছে। তবে গাছকেই বা বিশ্বাস কী? ওটাই যে ভজহরি নয় তাই বা কে জোর দিয়ে বলতে পারে?

চাঁদরটা ছাড়িয়ে নিয়ে শিবেন ফের এগোল। গাছপালার সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে রাজবাড়ি অবধি খানিকটা ফাঁকা জায়গা। শিবেন এদিকওদিক দেখে নিয়ে আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে জায়গাটা পেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক ওই সময় বাঁ-দিক থেকে কে যেন প্রায় নিঃশব্দে বিদ্যুতের গতিতে ছুটে এসে তার উপর লাফিয়ে পড়ল। শিবেন আত্মরক্ষার কোনও সুযোগই পেল না। বাপ রে! বলে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। কী হয়েছে তা বিভ্রান্ত মাথায় বুঝতেই পারল না সে। কয়েক সেকেন্ড বাদে সম্বিৎ পেয়ে সে দেখল তার বুকের উপর দুটো ভারী থাবা রেখে বিরাট একটা কেঁদো বাঘ তার মুখের উপর শ্বাস ফেলছে, আর জ্বলজ্বলে চোখে দেখছে তাকে।

শিবেন অত্যন্ত ব্যথিত গলায় বলল, ভজহরি, এ তোমার কেমন ব্যবহার ভাই? এভাবে লোককে হেনস্থা করা কি তোমার ঠিক হচ্ছে? যতই শত্রুতা থাক, আমরা তো ছেলেবেলায় বন্ধুই ছিলাম, সেকথা কী ভুলে গেলে? সজ্ঞানে তোমার কোনও ক্ষতি করেছি, বলো! হ্যাঁ, তোমার রবার লাগানো হলুদ পেনসিলটা চুরি করেছিলাম বটে, তবে সেটা করেছি তুমি আমার কাছ থেকে জোর করে যখেন ধন বইটা কেড়ে নিয়েছিলে বলে। ক্লাস সিক্সে তোমাকে একটা চিমটি দিয়েছিলাম, কারণ, ক্লাস ফাঁইভে তুমি আমাকে খেলার মাঠে ঘুসি মেরেছিলে। যাই হোক ভাই, পুরোনো শত্রুতা ভুলে যাও। বাঘের ছদ্মবেশে এসেছ বলে যে তোমাকে চিনতে পারব না, আমাকে তেমন বোকা পাওনি। থিসিসটা কেড়ে নিও না ভাই, আমার রক্ত-জল করা কাজ…।

বাঘটা বেশ মন দিয়েই তার কথা শুনছে বলে শিবেনের মনে হল। তার কাকুতি মিনতিতে কাজও শুরু হল। বাঘ ওরফে ভজহরি লম্বা লকলকে জিভটা দিয়ে ঠোঁট দুটো একবার ভালো করে চেটে নিয়ে চারদিকে একবার অলস চোখে তাকাল। তারপর প্রকাণ্ড একটা হাই তুলে ধীরেসুস্থে শিবেনের বুক থেকে পা দুটো নামিয়ে দুলকি চালে ডান ধারে চলে গেল।

শিবেনেরও হঠাৎ যেন সন্দেহ হচ্ছিল, বাঘটা নির্যস বাঘই, ভজহরি নয়। ভজহরি হলে বিপদ ছিল। শিবেন একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে উঠে পড়ল।

রাজবাড়িটাকে শ্যামাচরণ বুকে আগলে রাখে। কুটোগাছিও নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। প্রতি সপ্তাহে সে ঘরদোর পরিষ্কার করে, জিনিসপত্র যা আছে, সব যত্ন করে সাজিয়ে রাখে। সব জানলা-দরজার পাল্লা সেঁটে বন্ধ করে দিয়ে সদর দরজায় সেকেলে মজবুত বিরাট তালা ঝুলিয়ে দেয়। আপাতদৃষ্টিতে রাজবাড়িকে দুর্ভেদ্য মনে হলেও, শিবেন জানে, পিছন দিকে কর্তাদের তামাক সাজবার জন্য হুঁকোবরদারের একখানা ঘর আছে। সেই ঘরে জানলার একটা পাল্লার কঞ্জা ভাঙা। সেটা ঠেকনা দিয়ে লাগানো থাকে। যে খবর রাখে তার পক্ষে সেই জানলার পাল্লা সরিয়ে ভিতরে ঢোকা শক্ত ব্যাপার নয়।..

কাজটা শিবেনের পক্ষেও শক্ত হল না। জানলার পাল্লা সরিয়ে সে চৌকাঠে ঘোড়ায় চাপার মতো করে উঠে পড়ল। তারপর পাল্লাটা ফের জায়গামতো বসিয়ে অন্ধকার ঘরটা পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত একটা বড় ঘুরে ঢুকে পড়ল। এটা ছিল কর্তাদের খাসচাকরের ঘর। অন্ধকারে শিবেনকে আন্দাজ করে এগোতে হচ্ছে। বাইরে যা-ও একটু আলো ছিল, ঘরে একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। তার পকেটে একটা খুদে টর্চ আছে বটে, কিন্তু তার ব্যাটারি ফুরিয়ে এসেছে। নিতান্ত বিশেষ প্রয়োজনেই সেটা জ্বালাতে হবে।

সামনে দরবারঘরের আগে রানি-দরবার। এ ঘর থেকে রানিমা এবং রাজবাড়ির অন্যান্য বউ-ঝিরা দরবারের কাজকর্ম দেখত চিকের ফাঁক দিয়ে। এখনও কিছু ছেঁড়া চিক ঝুলে আছে।

শিবেন দরবার ঘরে পা দিতেই সামনের অন্ধকার থেকে কে যেন বেশ আহ্লাদের গলায় বলে উঠল, শিবেন যে!

শিবেনের হৃৎপিণ্ডটা একখানা বড় লাফ মেরেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। শিবেন শক্ত হয়ে, ঠান্ডা হয়ে, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!

গলাটা ফের আহ্বাদের সঙ্গে বলে উঠল, আহা, ভয় পেয়ে গেলে নাকি হে শিবেন?

শিবেন কাঁদো-কাদো হয়ে বলে উঠল, এটা কি ভালো হচ্ছে ভজহরি?

গলাটা একটু যেন বিস্মিত হয়ে বলল, ভজহরি! আচ্ছা বেশ, তাই সই! না হয় ভজহরিই হলাম। কিন্তু তাতে ভয়ের কী আছে হে শিবেন? ভজহরি কি তোমাকে কামড়ে দেবে?

না ভজহরি, তুমি আঁচড়ে দাও, কামড়ে দাও, তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু তুমি তো আর সেইজন্য আসোনি। তুমি এসেছ আমার চার বছরের হাড়ভাঙা খাটুনিটা নষ্ট করে দিতে। তোমার অনেক গুণ ভজহরি, তা বলে আমার সঙ্গে এই শত্রুটা করাটা কি তোমার ঠিক হচ্ছে?

তাই তো হে শিবেন, এ কথাটা তো ভেবে দেখতে হবে।

তাই তো বলছি ভজহরি, একটু তলিয়ে ভেবে দ্যাখো! তোমার ভয়ে আমি এই ধাঁধাড়া ময়নাগড়ে চাকরি নিয়ে পালিয়ে এসেছি, তবু তুমি আমার পিছু ছাড়োনি! পায়ে পড়ি ভাই, আমার আর যা ক্ষতি করো কিছু মনে করব না। কিন্তু আমার এই সাধনা, এই অধ্যবসায়কে নষ্ট করে দিও না।

আহা তোমার কথা শুনে যে আমারই কান্না পাচ্ছে হে শিবেন! কিন্তু আমি তো তোমার উপকার করতেই এসেছি।

তা তোমার বগলে ওটা কী বস্তু বলো তো!

শিবেন তার থিসিসের ফাঁইলটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল, না, না ভজহরি, এটার দিকে নজর দিও না। আমি কিন্তু কিছুতেই এটা তোমাকে কেড়ে নিতে দেব না! দরকার হলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব, চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব, চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে দেব, গুলি চালাব, বিপ্লব করব…

গলাটা খুবই সমবেদনার সঙ্গে বলল, আহা, প্রথমেই অতটা করার দরকার কী শিবেন? সব কি একসঙ্গে পেরে। উঠবে হে? বলি, রক্তগঙ্গা যে বওয়াবে, তা অত রক্ত পাবে কোথায়? আমি নিতান্ত রোগাভোগা মানুষ। আমার শরীরে তিন-চার ছটাকের বেশি রক্তই নেই। চেঁচিয়ে যে লোক জড়ো করবে, তা লোকই বা আসবে কোত্থেকে? ধারেকাছে তো একমাত্র বুড়ো, শুটকো শ্যামাচরণ ছাড়া জনমনিষ্যিই নেই। আর আগুন যে জ্বালাবে, তোমার পকেটে তো দেশলাইও নেই হে! গুলি চালানোর কথা ভাবছ, বেশ ভালো কথা! কিন্তু বন্দুক, পিস্তল কি আর ভালো জিনিস হে! বেমক্কা ফেটেফুটে গিয়ে বিপত্তি বাধিয়ে বসবে। জোগাড় করাও ভারী শক্ত। এই যে দ্যাখো না, আমার পকেটে একখানা আছে! নেহাত মেহনত করে জোগাড় করতে হয়েছে ভায়া, এক কাড়ি টাকা দণ্ড দিয়ে।

কাঁপা গলায় শিবেন বলে, তোমার পিস্তল আছে ভজহরি! ছিঃ, ভাই ছিঃ, বন্ধু হয়ে তুমি বন্ধুর কাছে পিস্তল নিয়ে এসেছ! শেষ অবধি তোমার হাতেই আমাকে প্রাণ দিতে হবে নাকি? তা না হয় দিলুম, কিন্তু তোমার যে খুব পাপ হয়ে যাবে ভজহরি!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কণ্ঠস্বরটি বলল, সেটাই তো চিন্তার কথা হে শিবেন। পাপ জিনিসটাকে আমি বড় ভয় পাই। পাপটাপ করতে আমার মোটেই ইচ্ছে হয় না। তাই তো আমি লোককে বলি, যা করো তা করো ভাই, কিন্তু আমাকে দিয়ে কোনও পাপ কাজ করিও না। তবে তুমি যেন বিপ্লবের কথাও বলছিলে!

হ্যাঁ ভাই ভজহরি, আমি বিপ্লবের কথাও বলেছি। ঘাট হয়েছে ভাই, রাগের বশে বলে ফেলেছি, মাপ করে দাও।

তা নয় করছি। কিন্তু তা বলে বিপ্লব তেমন খারাপ জিনিস নয়। বিপ্লবটিপ্লব করলে বেশ গা গরম হয় শুনেছি। তবে বস্তুটা কী, তা আমি অবশ্য জানি না।

আমিও জানি না ভজহরি। ওসব কথা মনে করে কষ্ট পেও না। তুমি তো জানোই ভাই, তোমার মতো ক্ষমতা আমার নেই। তোমার গায়ের জোর বেশি, অনেক কায়দাকানুন জানো। ছদ্মবেশ ধরতে পার। তার উপর তোমার পকেটে পিস্তল আছে। তোমার সঙ্গে কি আমি এঁটে উঠব ভাই! দোহাই তোমার, এই অসহায় বন্ধুর কাছ থেকে তার শেষ সম্বল এই থিসিসটা কেড়ে নিও না।

আহা, উত্তেজিত হচ্ছ কেন শিবেন? একটু ভাবতে দাও, তোমার কথা শুনে তোমার জন্য আমার বেশ মায়া হচ্ছে। ওরেবাপু, আমি তো আর পাষণ্ড নই।

সেটা আমিও জানি ভজহরি। তুমি বেশ ভাল লোক। তাই বলছি, এমন কাজ কোরো না। করলে তোমাকে লোকে খারাপ বলবে। আর লোকে তোমাকে খারাপ বললে, আমি যে মনে বড় ব্যথা পাব ভাই।

আহা, তোমার কথা শুনলে প্রাণ জুড়িয়ে যায় হে শিবেন। তা হলে থিসিসটা তুমি হাতছাড়া করতে চাও না,

এই তো?

হ্যাঁ ভজহরি।

তা হলে যে আমার একটু উপকার করতে হবে শিবেন?

কী উপকার ভজহরি? দরকার হলে আমি তোমার পা টিপে দিতে পারি, মাথার উকুন বেছে দিতে পারি, কুয়ো থেকে তোমার স্নানের জল তুলে দিতে পারি, তোমার এঁটো বাসন মাজতে পারি, পঞ্চাশ টাকা ধার দিতে পারি।

অতটা না করলেও চলবে শিবেন। আপাতত তুমি একটা সহজ কাজই বরং করো।

কী করতে হবে ভজহরি?

এই রাজবাড়িতে পানিঘর বলে একটা ঘর আছে, জানো?

না তো!

আছে। মাটির নীচে একটা অন্ধকার ঠান্ডামতো ঘর, যেখানে মস্ত বড়-বড় জালায় গরমকালে রাজবাড়ির লোকেদের জন্য খাবার জল রাখা হত। আমি অনেক খুঁজেও ঘরটার সন্ধান পাচ্ছি না। তোমাকে সেই ঘরটা খুঁজে বের করে দিতে হবে।

কেন ভজহরি, তোমার কি খুব তেষ্টা পেয়েছে ভাই? যদি পেয়ে থাকে তো বলল, আমি তোমাকে জল এনে দিচ্ছি। টাটকা জল ছেড়ে পানিঘরের পুরোনো পচা জল খাওয়ার দরকার কী তোমার? শেষে পেটটেট খারাপ করবে! এই শীতে কি বেশি ঠান্ডা খাওয়া ভালো?

কথাটা মন্দ বলোনি শিবেন! খুব যুক্তিযুক্ত কথাই। তবে আমার তেষ্টাটাও খুব বেয়াদব তেষ্টা। সাধারণ জলে ও তেষ্টা মেটার নয়। পানিঘরের পুরোনো জলের সন্ধানেই আসা কিনা! ঘরটার সন্ধান যে আমার চাই।

শিবেন মিইয়ে গিয়ে বলল, রাজবাড়ির ভিতরকার সুলুকসন্ধান যে আমি জানি না ভজহরি, জানে শ্যামাদা। কিন্তু সে বড্ড তেরিয়া লোক। রাজবাড়ির ভিতরকার খবর তার কাছ থেকে বের করা খুব শক্ত। বাড়িখানা সে যমের মতো আগলে রাখে। আমাকে অবধি ঢুকতে দেয় না।

তা হলে তো বড় মুশকিল হল শিবেন। পানিঘরের সন্ধান না পেলে যে অনিচ্ছের সঙ্গেই তোমার থিসিসটা আমাকে কেড়ে নিতে হবে।

আঁতকে উঠে শিবেন বলে, না, ভাই না। কী করতে হবে বলো, করছি।

শোনো শিবেন, গরুর বাটে যে দুধ থাকে তা কি সে এমনিতে দেয়? গরুর বাঁটের নীচে বালতি পেতে রাখো, সাধ্যসাধনা করো, দুধ দেওয়ার পাত্রীই সে নয়। কিন্তু বাঁট ধরে চাপ দাও, দেখবে দুধের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই যে সবাই জানে, ধানের ভিতরে চাল থাকে, কিন্তু ধান কি চালকে ছাড়তে চায় সহজে? কেঁকিতে ফেলে ধানের উপর চাপ সৃষ্টি করো, দেখবে, কেমন হাসতে-হাসতে চাল বেরিয়ে পড়েছে। এই ধরো না কেন, টিউবের মধ্যে যে টুথপেস্ট থাকে, এমনিতে বেরোয় কি? টিউবের ঘাড় ধরে চেপে দাও, দেখবে, সড়াক করে পেস্ট বেরিয়ে পড়বে।

শিবেন একমত হয়ে বলল, সে তো ঠিক কথাই হে। ভজহরি। চারদিকে তো চাপেরই জয়জয়কার দেখছি। গরম ইস্তিরি দিয়ে চেপে ধরলে কোচকানো কাপড় যেমন সটান হয়ে যায়, ফেঁড়া টনটন করছে তো চেপে ধরো, পুচ করে পুঁজ বেরিয়ে ব্যথার আরাম হয়ে যাবে। এই তো সেদিন একটা কাকড়াবিছে চটি দিয়ে চেপে ধরলুম, ব্যাটা চ্যাপটা হয়ে গেল। না হে ভজহরি, যে যত চেপে ধরতে পারে তারই তত সুবিধে।

হ্যাঁ শিবেন, চাপ দিতে জানলে সব কাজ হয়। তাই বলছিলাম, তুমিও যদি শ্যামাচরণের উপর একটু চাপ সৃষ্টি করতে পার, তা হলে পানিঘরের কথা সে লক্ষ্মীছেলের মতো বলে দেবে।

কিন্তু কীরকমভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে ভজহরি? তার বুকের উপর হাঁটু গেড়ে বসতে হবে কি?

হুঁ, সে প্রস্তাবও মন্দ নয় বটে। তবে কী জানো? শ্যামাচরণ বুড়ো মানুষ। তার উপর রোগাভোগা। তোমার মতো একটা দশাসই লোক বুকে চেপে বসলে হিতে বিপরীত হতে পারে তো! শ্যামাচরণ পটল তুললে পানিঘরের হদিশ দেবে কে?

তাই তো ভজহরি, আমার ওজন যে দু-মন দশ সের, সেই কথাটা মনে ছিল না। তা হলে কি গাঁ থেকে একটু হাল্কা দেখে কাউকে ডেকে আনব ভজহরি?

তুমি খুবই বুদ্ধিমান হে শিবেন। তবে কিনা অন্য কেউ শ্যামাচরণের উপর চাপ সৃষ্টি করতে না-ও চাইতে পারে। যাই হোক, এ-ব্যাপারে অন্য কাউকে চাপাচাপি করার দরকার নেই। তুমি বরং একটা কাজ করো, আমার পিস্তলটা নিয়ে যাও। চাপ সৃষ্টি করার পক্ষে এটা খুবই ভালো জিনিস।

কিন্তু ভাই, পিস্তল দিয়ে আমি যে কোনওদিন চাপ সৃষ্টি করিনি। কী করে করতে হয় তাও জানি না।

তোমাকে কিছুই করতে হবে না শিবেন। পিস্তল নিজেই চাপ সৃষ্টি করবে। তুমি শুধু জুতমতো বাগিয়ে ধরে কঠিন গলায় বলবে, পানিঘরের সন্ধান যদি না দাও, তা হলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।

বাঃ, এ তো সোজা কাজ! কিন্তু পিস্তলটা আবার ফুটেটুটে যাবে না তো! একটু আগে তুমিই যেন বলছিলে, বন্দুক, পিস্তল অনেক সময় ফুটে যায়।

সব কাজেরই বিপদের দিক থাকে হে শিবেন। ভয় পেও! পিস্তলের উপর চাপ সৃষ্টি না করলে সে কিছু করবে।

কথাটা যেন কী বলতে হবে?

পানিঘরের সন্ধান যদি না দাও তা হলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। অবশ্য প্রথমেই কথাটা বলার দরকার নেই। আগে একটু আদুরে গলায় আদর করার মতো পানিঘরের সন্ধান চাইবে। তারপর একটু অভিমান করে ঠোঁট ফোলাবে। তাতেও কাজ না হলে গৃহত্যাগ করার হুমকি দেবে। তারপর চোখ রাঙাবে। তারপর ভয় দেখাবে। শেষ অবধি কাজ না হলে পিস্তল বাগিয়ে ওই কথাটা বলবে। পারবে না শিবেন? না পারলে তোমার থিসিস…

খুব পারব, খুব পারব, বলে শিবেন রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, দাও ভাই ভজহরি, তোমার পিস্তলটা আমাকে দাও। এক্ষুনি গিয়ে শ্যামাচরণের উপর চাপ সৃষ্টি করে পানিঘরের হদিশ জেনে আসছি। শুধু কথা দাও, পানিঘরের হদিশ দিলে তুমি আমার থিসিসটার দিকে হাত বাড়াবে না।

পাগল নাকি! শত হলেও আমি তোমার ছেলেবেলার বন্ধু। কথার খেলাপ হবে না ভাই। পানিঘরের খবর দিতে পারলে তোমার কোনও ভয় নেই।

ছায়ামূর্তি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে শিবেনের হাতে যে জিনিসটা দিল, সেটা ছোট হলেও বেশ ভারী। পিস্তল সম্পর্কে শিবেনের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। সে শঙ্কিত গলায় বলল, ভাই ভজহরি, এ তো তে-কোনা একটা বিচ্ছিরি চেহারার জিনিস। এটার কোন মুখ দিয়ে গুলি বেরোয় তা তো জানি না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছায়ামূর্তি বলল, হাতলটা ধরে নলটা তাক করতে হয়। উলটোপালটা করে ফেললে কিন্তু তোমার পিস্তলের গুলি তোমাকেও ছেড়ে কথা বলবে না।

ওরে বাবা, এ তো খুব বিপদের জিনিস ভাই ভজহরি! ছায়ামূর্তি একটু দূরে সরে গিয়ে আড়া থেকে বলল, খুব বিপজ্জনক। প্রাণ হাতে করেই কাজ হাসিল করতে হবে। থিসিসটার জন্য এটুকু বিপদ কি খুব বেশি হল হে শিবেন?

কিছু না, কিছু না। থিসিসের জন্য আমি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।

বাঃ, এই তো বীরের মতো কথা! শিবেন এক হাতে পিস্তল, অন্য হাতে থিসিসের ফাঁইলটা শক্ত করে ধরে অন্ধকারে সাবধানে ঘর পেরিয়ে জানলা গলে বেরিয়ে এল। ভজহরির খপ্পর থেকে থিসিসটাকে বাঁচাতে হলে তাকে কিছু বিপদের ঝুঁকি নিতেই হবে, অন্য উপায় নেই।

বাগান পার হয়ে খাজাঞ্চিখানায় পৌঁছে সে সোজা শ্যামাচরণের দরজায় ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখল, শ্যামাচরণের দরজা হাট করে খোলা। ভিতরে কেউ নেই। নিবু নিবু টর্চের আলোয় সে ঘরখানা ভালো করে দেখে নিয়ে বাইরে এসে চারদিকটা খুঁজল। লোকটা গেল কোথায়?