সাইনবোর্ডে যতই বানান ভুল থাক, মানে মৎসই লিখুক আর পরিক্ষাই চালিয়ে দিক, আসল ব্যাপার হল : এটা চাঁদনির বাজার আর চক্রধর সামন্তের দোকান একেবারে সামনেই রয়েছে। অর্থাৎ কবিতাটার প্রথম দু লাইনের মানে এখানেই পাওয়া যাচ্ছে যে।
হাবুল বললে, টেনিদা, অখন কী করন যাইব?
ক্যাবলা বললে, করবার কাজ তো একটাই রয়েছে। অর্থাৎ এখন সোজা ওখানে গিয়ে চক্রধর সামন্তের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, দেখা করে কী বলবি?
টেনিদা পেছন থেকে আমার মাথায় টুক করে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিলে : চক্রধর সামন্তকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে লুচি-পোলাও খাইয়ে দিবি। দেখা করে কী আবার বলব? পরিষ্কার জানতে চাইব, এই কবিতাটার মানে কী, আর শ্রীমান কম্বল কোথায় আছেন।
ক্যাবলা ছুটে গিয়ে বললে, হুঁ, তাহলেই সব কাজ চমৎকার ভাবে পণ্ড হতে পারবে। কম্বলকে যদি এরাই কোথাও লুকিয়ে রেখে থাকে, সঙ্গে সঙ্গেই হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। হয়তো কম্বলকে আমরা আর কোনওদিন খুঁজেই বের করতে পারব না।
হাবুল বললে, না পাইলেই বা কী হইব। সেই পোলাখান না? সে হইল গিয়া এক। নম্বরের বিচ্ছু। তারে ধইর্যা যদি কেউ চান্দে চালান কইর্যা দেয়, দুই দিনে চান্দের গলা দিয়াও কান্দন বাইরাইব।
টেনিদা ধমকে বললে, তুই থাম। কম্বল যত অখাদ্য ছেলেই হোক, তার কাকার কাছে আমরা তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য, মানে ডিউটি বাউন্ড। তারপর বদ্রীবাবু পিটিয়ে কম্বলের ধুলো ওড়ান কি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েই পড়ন—সে তিনিই বুঝবেন। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ বকবক করব আমরা? কিছু একটা করতে তো হবে।
ক্যাবলা বলল, আলবাত করতে হবে। চলো, আমরা মাছধরার ছিপ-সুতো এই সব খোঁজ করিগে।
আমি চ্যাঁ-চ্যাঁ শব্দে প্রতিবাদ করে বললুম, আমি কিন্তু ছিপ সুতো নিয়ে বাড়ি যাব না। মেজদা তা হলে আমার কান কেটে নেবে।
তোর কান কেটে নেওয়াই উচিত-চশমার ভেতর দিয়ে আমার দিকে কটকটিয়ে তাকাল ক্যাবলা : আরে বোকারাম, ছিপসুতো কিনছে কে? আমরা এটা-ওটা বলে হালচাল বুঝে নেব।
টেনিদা খুব মুরব্বীর মতো বললে, প্যালা আর হাবলাকে নিয়েই মুস্কিল। এ-দুটোর তো মাথা নয়—যেন এক জোড়া খাজা কাঁটাল। কী বলতে কী বলবে আর সব মাটি হয়ে যাবে। শোন, তোরা দুজন একেবারে চুপ করে থাকবি, বুঝেছিস? যা বলবার আমরাই বলব—মানে আমি আর ক্যাবলা। মনে থাকবে?
আমরা গোঁজ হয়ে ঘাড় নাড়লুম। মনে থাকবে বই কি। এদিকে কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছিল টেনিদার ওপর। বলতে ইচ্ছা করছিল, আমাদের মাথা নয় খাজা কাঁটাল, আর তোমার? পণ্ডিত মশাই বলতেন না, বৎস টেনিরাম, ওরফে ভজহরি, জগদীশ্বর কি তোমার স্কন্ধের উপর মস্তকের বদলে একটি গোময়ের হাঁড়ি বসাইয়া দিয়াছেন? রাগ হলেই তাঁর মুখ দিয়ে সাধুভাষা বেরিয়ে আসত।
সে যাই হোক, আমরা তো চক্রধর সামন্তের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে আঠারো-উনিশ বছরের একটা ছেলে খাকী হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা গেঞ্জি পরে একটা শালপাতার ঠোঙা থেকে তেলেভাজা খাচ্ছিল।
আমাদের দেখেই বেগুনি চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলে, কী চাই?
ক্যাবলা বললে, আমরা ছিপ কিনব।
ওই তো রয়েছে, পছন্দ করুন না বলে সে আবার একটা আলুর চপে কামড় বসাল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, ছিপ বিক্রি করার চাইতে তেলেভাজাতেই মনোযোগ তার বেশি।
আপনিই বুঝি চক্রধরবাবু?—টেনিদা ভারি নরমনরম গলায় ভাব করবার মতো করে জানতে চাইল।
আমি চক্রধরবাবু হতে যাব কেন?—আলুর চপের ভেতরে একটা লঙ্কা চিবিয়ে ফেলে বিচ্ছিরি মুখ করল ছেলেটা :
তিনি তো আমার মামা।
ক্যাবলা বললে, ঠিক-ঠিক। তাই চক্রধরবাবুর মুখের সঙ্গে আপনার মুখের মিল আছে! ভাগনে বলেই।
ভাগনে এবার চটে উঠল, শুনে আলুর চপের মতো ঘোরালো হয়ে উঠল তার মুখ। খ্যাঁকখ্যাঁক করে বললে, কীকার মুখের সঙ্গে মিল আছে বললেন? চক্ৰধরের? সে সাত পুরুষে আমার মামা হতে যাবে কেন? গাঁয়ের লোকে তাকে মামা বলে—আমিও বলি। আমার মুখ তার মতো ভীমরুলের চাকের মতো? আমার কপালে তার মতো আব আছে? আমার রং তার মতো কটকটে কালো? আমার নাকের তলায় একটা ঝোল্লা গোঁফ দেখতে পাচ্ছেন?
ক্যাবলার মতো চটপটে ছেলেও কী রকম ঘাবড়ে গেল এবার। বার দুই বিষম খেলে।
মানে—এই ইয়ে—
ইয়ে-টিয়ে নেই। ছিপ কিনতে এসেছেন কিনুন, নইলে ঝাঁ করে সরে পড়ুন এখান থেকে। খামকা যা তা বলে মেজাজ খারাপ করে দেবেন না স্যার।
সে তো বটেই, সে বটেই।—টেনিদা মাথা নাড়ল : ওর কথা ছেড়ে দিন মশাই, ওটা কী বলে ইয়ে মানে নেহাত নাবালক। আপনার মুখখানা—মানে—ঠিক চাঁদের মতো—অর্থাৎ কিনা চন্দ্রকান্ত বাবুও বলা যায় আপনাকে।
আমার নাম হলধর জানা।–বলেই সে হঠাৎ কী রকম চমকে উঠল : কী নাম বললেন? চন্দ্রকান্ত?
টেনিদা ফস করে বলে বসল : নিশ্চয় চন্দ্রকান্ত। এমন কি আপনার টিকোলো নাক দেখে নাকেশ্বর বলতেও ইচ্ছে করছে।
কী বললেন? নাকেশ্বর? চন্দ্রকান্ত-নাকেশ্বর?—হলধর জানা তেলেভাজার ঠোঙাটা মুড়ে ফেলে দিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : আপনারা যান। ছিপ বিক্রি হবে না। দোকান বন্ধ।
ক্যাবলা বললে, দোকান বন্ধ।
হ্যাঁ, বন্ধ। হলধর কী রকম বিড়বিড় করতে লাগল : আজকে বিষুব্বর না? বিষুদবারে আমাদের দোকান বন্ধ থাকে।
মোটেই না, আজকে মঙ্গলবার—আমি প্রতিবাদ করলুম।
হোক মঙ্গলবার—হলধর কাঁচা উচ্ছে চিবুনোর মতো মুখ করে বললে, আমরা মঙ্গলবারেও দোকান বন্ধ করে রাখি। বলেই সে ঘটাং ঘটাং করে আমাদের নাকের সামনেই ঝাঁপ বন্ধ করে দিলে। তারপর একটা ফুটোর ভেতর দিয়ে নাক বের করে বললে, অন্য দোকানে গিয়ে ছিপ কিনুন, এখানে সুবিধে হবে না।
ব্যাস, হলধরের সঙ্গে আলাপ এখানেই খতম। হলধর জানাকে আর জানা হল না—তার আগেই ঝাঁপের আড়ালে সে ভ্যানিসড।
সে তো ভ্যানিসড কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরে একেবারে চক্কর লাগিয়ে দিলে যাকে বলে। পচা চীনেবাদাম চিবুলে যেরকম লাগে, ঠিক সেই রকম বোকাবোকা হয়ে আমরা এ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলুম।
টেনিদা মাথা চুলকে বললে, ক্যাবলা—এবার?
ক্যাবলা বললে,। এখন চলো, কোথাও গিয়ে একটু চা খাই। সেখানে বসে প্ল্যান ঠিক করা যাবে।
কাছেই চায়ের দোকান ছিল একটা, নিরিবিলি কেবিনও পাওয়া গেল। ক্যাবলাই চা আর কেক আনতে বলে দিলে। এসব ব্যাপারে চিরকাল পয়সা-টয়সা ও-ই দেয়, আমাদের ভাববার কিছু ছিল না।
টেনিদা নাক চুলকে বললে, ব্যাপারটা খুব মেফিস্টোফিলিস বলে মনে হচ্ছে। মানে সাংঘাতিক। এত সাংঘাতিক যে পুঁদিচ্চেরিও বলা যেতে পারে।
হাবুল এতক্ষণ পরে মুখ খুলল :হ, সৈত্য কইছ।
চন্দ্রকান্ত আর নাকের শুনেই হলধর কী রকম লাফিয়ে উঠল দেখেছ?—আমি বললুম, তা হলে ছড়াটার দ্বিতীয় লাইনেরও একটা মানে আছে।
সব কিছুরই মানে আছে—বেশ গভীর মানে।–ক্যাবলা চায়ে চুমুক দিয়ে বললে, এখন তো দেখছি ছড়াটার মানে বুঝতে পারলেই কম্বলেরও হদিস পাওয়া যাবে।
টেনিদা এক কামড়েই নিজের কেকটাকে প্রায় শেষ করে ফলল। আমিও চট করে আমারটা আধখানা মুখে পুরে দিলুম, পাছে ওপাশ থেকে আমার প্লেটেও হাত বাড়ায়। টেনিদা আড় চোখে সেটা দেখল, তারপর ব্যাজার হয়ে বললে, কিন্তু পটলডাঙার কম্বল কী করে যে চাঁদনির বাজারে এল আর চক্রধরের সঙ্গে জুটলই বা কী ভাবে, সেইটেই বোঝা যাচ্ছে না।
সেটা বুঝলে তো সবই বোঝা যেত।—ক্যাবলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল :
ভেবেছিলুম, কম্বলের পালানোটা কিছুই নয়—এখন দেখছি বদ্রীবাবুই ঠিক বলেছিলেন। কম্বল চাঁদে হয়তো যায়নি, কিন্তু যে রহস্যময় চাঁদোয়ার তলায় সে ঘাপটি মেরে বসে আছে সে-ও খুব সোজা জায়গা নয়। ওয়েল, টেনিদা।
ইয়েস ক্যাবলা।
চলো, আমরা চারজনে চারিদিক থেকে চক্রধরের দোকানের ওপর নজর রাখি। আমাদের তাড়াবার জন্যেই হলধর দোকান বন্ধ করছিল, আবার নিশ্চয় ঝাঁপ খুলবে। দেখতে হবে ঝোল্লা গোঁফ আর কপালে আব নিয়ে কটকটে কালো চক্রধর আসে কি না কিংবা লম্বা নাক নিয়ে চন্দ্রকান্ত দেখা দেয় কি না। কিন্তু টেক কেয়ার—সব্বাইকেই একটু গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে—হলধর যাতে কাউকে দেখতে না পায়।
আমরা সবাই রাজি হয়ে গেলুম।
ক্যাবলা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পাওয়াতে ওর বাবা ওকে একটা হাতঘড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সেটার দিকে তাকিয়ে ক্যাবলা বললে, এখন সাড়ে চারটে। পড়াশুনোর সময় নষ্ট না করেও আমরা আরও দেড় ঘণ্টা থাকতে পারি এখানে। কে জানে, হয়তো আজকেই কোনও একটা কু পেয়ে যেতে পারি কম্বলের। ফ্রেন্ডসনাউ টু অ্যাঁকশান—এবার কাজে লাগা যেতে পারে।
চাঁদনির বাজারে এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকা কিছু শক্ত কাজ নয়। আমরাও পাকা গোয়েন্দার মতো চারিদিকে চারটে জায়গা বেছে নিয়ে চক্রধরের দোকানের দিকে ঠায় চেয়ে রইলুম। টেনিদা আর ক্যাবলাকে দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ঠিক আমার মুখোমুখি একটা লোহার দোকানের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে কচ্ছপের মতো গলা বের করছিল হাবুল।
দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি, চক্রধরের দোকানের ঝাঁপ আর খোলে না। চোখ টনটন করতে লাগল, পা ব্যথা হয়ে গেল। এমন সময়, হঠাৎ পেছন থেকে আমার কাঁধে কে যেন টুক টুক করে দুটো টোকা মারল।
চমকে তাকিয়েই দেখি, ছিটের শার্ট গায়ে, ঢ্যাঙা তালগাছের মতো চেহারা, নাকের নীচে মাছিমাকা গোঁফ, বেশ ওস্তাদ চেহারার লোক একজন। মিটমিট করে হেসে বললে, ছল ছল খালের জল—তাই না?
আমি এত অবাক হয়ে গেলুম যে মুখ দিয়ে কথাই বেরুল না।
লোকটা বলল, তা হলে হলধরকে নিয়ে আর সময় নষ্ট করা কেন? কাল বেলা তিনটের সময় তেরো নম্বর শেয়ালপুকুর রোডে গেলেই তো হয়।
বলে আমার পিঠে টকটক করে আবার গোটা দুই টোকা দিয়ে, টুক করে কোনদিকে সরে পড়ল যে।