8। সময়-পর্যটন
গত বৃহস্পতিবার আপনাদের কয়েকজনকে টাইম মেশিনের মূলসূত্রগুলি আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। অসমাপ্ত মেশিনটাও ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি। এখনও সেখানেই আছে মেশিনটা–এতটা পথ ঘুরে আসার ফলে একটু ময়লা হয়ে গেছে অবশ্য। তা ছাড়া হাতির দাঁতের একটা রড চিড় খেয়ে গেছে, তামার রেলিংটাও গেছে বেঁকে। বাদবাকি সব ঠিক আছে। ভেবেছিলাম, গত শুক্রবারেই শেষ হয়ে যাবে মেশিনটা, কিন্তু শুক্রবারে কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দেখলাম, একটা নিকেল রড প্রায় ইঞ্চিখানেকের জন্যে ছোট হচ্ছে। কাজেই নতুন করে তৈরি করতে হল রডটা। সেই কারণেই বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। আজ সকালে সম্পূর্ণ হল টাইম মেশিন। আর সকাল দশটার সময়ে শুরু হল তার জীবনযাত্রা। চারদিকে টোকা মেরে স্কুগুলো আর-একবার দেখে নিয়ে কোয়ার্টজ রডে আরও এক ফোঁটা তেল ঢেলে দিলাম। তারপর চেপে বসলাম আসনে। খুলির কাছে পিস্তল ধরে আত্মহত্যা করার আগে মানুষের মনে যে বিচিত্র ভাবের উদয় হয়, আমারও হল তা ই। এক হাতে স্টার্ট দেওয়ার লিভারটা ধরে, অপর হাতে বেশ করে চেপে ধরলাম গতিরোধের লিভারটা। তারপর প্রথমটা ঠেলার পরমুহূর্তেই দ্বিতীয়টাও ঠেলে দিলাম। মনে হল, মাথা ঘুরে গেল আমার। দুঃস্বপ্নের ঘোরে মনে হল যেন তলিয়ে যাচ্ছি অতলে, আর তারপরেই চারপাশে তাকিয়ে দেখি, ঠিক আগের মতো অবস্থাতেই ল্যাবরেটরিতে রয়েছি আমি। কিছুই তো তাহলে হল না! মুহূর্তের জন্য সন্দেহ হল, বুঝি-বা আমার মেধা শেষ পর্যন্ত ছলনা করলে আমায়। পরক্ষণেই আমার চোখ পড়ল ঘড়ির ওপর। এক মুহূর্ত আগেও তো ঘড়ির কাঁটা দাঁড়িয়েছিল দশটা, কি খুব জোর দশটা বেজে এক মিনিটের ঘরে। আর এখন দেখলাম, কাঁটা দুটো ঘুরে এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিনটের ঘরে।
জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দু-হাতে আঁকড়ে ধরলাম স্টার্ট দেওয়ার লিভারটা, আর পরক্ষণেই এক ধাক্কায় ঠেলে দিলাম সামনের দিকে। ধোঁয়ার মতো আবছা হয়ে এল ল্যাবরেটরি, রাশি রাশি আঁধারে ভরে উঠতে লাগল ঘরটা। মিসেস ওয়াচেট ভেতরে এলেন, আমাকে যেন দেখতে পাননি এমনিভাবে এগিয়ে গেলেন বাগানের দরজার দিকে। পথটুকু পেরতে বোধহয় তাঁর মিনিটখানেক লেগেছিল, আমার কিন্তু মনে হল যেন রকেটের মতো সাঁত করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। এবার একেবারে শেষ ঘাঁটিতে ঠেলে দিলাম লিভারটা। ফুঁ দিয়ে প্রদীপ নিবিয়ে দেওয়ায় মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল নিশার তমসা, পরের মুহূর্তেই রাত কেটে গিয়ে ফুটে উঠল ভোরের আলো। অস্পষ্ট আর আবছা হয়ে উঠতে লাগল ল্যাবরেটরি, আরও অস্পষ্ট… আরও… আরও। আবার রাত এল ঘনিয়ে, তারপরে আবার দিন, আবার রাত, আবার দিন–ক্রমশ অস্পষ্ট ভোমরার গুঞ্জনের মতো একটা ধ্বনি আবর্তের পর আবর্ত রচনা করে চলল আমার কর্ণকুহরে, আর-একটা অজানা, বোবা বিমূঢ়তা চেপে বসতে লাগল আমার মনের ওপর।
সময়-পর্যটনের সে অদ্ভুত অনুভূতি আপনাদের আমি বোঝাতে পারব না। অত্যন্ত অস্বস্তিকর, অস্বচ্ছন্দ সে-অনুভূতি। অসহায় অবস্থায় তিরের মতো সামনের দিকে উন্মাদ বেগে ছুটে যাওয়ায় যে-অনুভূতি, এ যেন অনেকটা তা-ই। যে-কোনও মুহূর্তে একটা প্রবল সংঘাতের আশঙ্কায় শিউরে উঠল আমার অন্তর। যতই এগিয়ে চললাম, কালো ডানা ঝাঁপটানোর মতো রাত কেটে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগল দিনের আলো। দূর হতে দূরে সরে যেতে লাগল ল্যাবরেটরির ধোঁয়াটে রেখা–দেখলাম, আকাশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে এক-এক লাফে এগিয়ে চলেছে সূর্য, এক-এক লাফে কাটছে এক-একটি মিনিট আর প্রতিটি মিনিট সূচনা করছে এক-একটি দিনের। মনে হল, ল্যাবরেটরি যেন ধ্বংস হয়ে মিলিয়ে গেল শূন্যে–খোলা বাতাসে এসে পড়লাম আমি। ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল গতিবেগ। ধীরগতি শামুকও চোখের পলকে মিলিয়ে যেতে লাগল দৃষ্টিপথের বাইরে। আঁধার আর আলোকের ঘন ঘন আনাগোনা বেজায় যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল আমার চোখে। তারপরেই দেখলাম, সবিরাম আঁধারের মাঝে দ্রুতগতিতে কলা পরিবর্তন করে অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা আর পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যার পথে গড়িয়ে চলেছে চন্দ্র–চারপাশে অস্পষ্টভাবে ঝিকমিক করছে ঘূর্ণমান তারার রাশি। দেখতে দেখতে গতি আরও বেড়ে যেতে দিনরাতের স্পন্দন টানা একটা ধূসর রেখায় মিশে এক হয়ে গেল। আশ্চর্য গাঢ় নীল রঙে ঘন হয়ে উঠল আকাশ, গোধূলির শুরুতে যেমন সুন্দর বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ে, এ যেন তেমনি। সূর্যের ঘন ঘন লাফ মিলিয়ে গিয়ে দেখা গেল শুধু আগুনের একটা টানা রেখা, যেন মহাশূন্যের মাঝে জ্বলজ্বলে এক তির্যক খিলান। আর অস্পষ্টভাবে বাঁকা রেখার মাঝে জ্বলতে-নিবতে লাগল চাঁদ। তারপর আর কোনও তারাই দেখতে পেলাম না, শুধু ঘন নীলের মাঝে একটা জ্বলজ্বলে বৃত্তের দপদপানি জেগে রইল আমার চোখের সামনে। চারপাশে দৃশ্যপটও কুয়াশার মতো অস্পষ্ট হয়ে উঠল। যে-পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে এ বাড়িটা, তার সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি। ধোঁয়ার মতো ধূসর পাথরের রেখা আমার অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিল। দেখলাম, চোখের সামনে বৃদ্ধি পাচ্ছে গাছের সারি। এক এক ফুৎকারে পালটে যাচ্ছে তার আকৃতি। বাদামি থেকে সবুজ, তারপরেই ধূসর। এরপরেই ডালপালা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া হয়ে উঠে কাঁপতে কাঁপতে গেল শুকিয়ে। দেখলাম, বড় বড় প্রাসাদ গড়ে উঠছে, সুন্দর কিন্তু আবছা, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের মতো। সমস্ত ভূতল মনে হল পালটে যাচ্ছে, চোখের ওপর গলে গলে স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। ডায়ালের ওপর গতিনির্দেশক ছোট কাঁটাগুলোর গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠল। ক্ষণ পরেই দেখলাম, কর্কটক্রান্তি থেকে মকরক্রান্তির মধ্যে দুলছে সূর্যবলয় রেখা এক মিনিটেরও অল্প সময়ের মধ্যে, ফলে এক-এক মিনিটে পেরিয়ে যেতে লাগলাম এক-একটি বছর! আর মিনিটে মিনিটে সাদা তুষার-চাদর ঝলসে উঠতে লাগল পৃথিবীর ওপর, আর পলকের মধ্যে তা মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগল সংক্ষিপ্ত বসন্তের ঝকঝকে সবুজাভা।
যাত্রারম্ভের সে অস্বচ্ছন্দ অনভূতি আর ততটা তীব্র ছিল না। কীরকম জানি মূৰ্ছাবেশের মতো এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে উঠেছিল আমার অন্তর। কী জানি কেন এলোমেলোভাবে দুলছিল মেশিনটা। কিন্তু আমার চিন্তাশক্তি তখন এমনই অসাড় হয়ে উঠেছে যে, দুলুনি থামাবার কোনও প্রচেষ্টা আমি করলাম না। উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া একটা উন্মাদনায় অবশ হয়ে এল আমার সর্ব ইন্দ্রিয়, দুরন্ত বেগে ভবিষ্যতের গর্ভে ধেয়ে চললাম বাধাহীন গতিতে। প্রথমে গতিরোধের কোনও চিন্তাই আসেনি আমার মনে, শুধু ওই বিচিত্র অনুভূতি ছাড়া আর কোনও কিছুই উপলব্ধি করিনি তখনও। কিন্তু অচিরেই নতুন একটা চিন্তাধারা আমার মনে জেগে উঠতে লাগল–বিশেষ একটা ঔৎসুক্য আর সেই সঙ্গে বিশেষ এক আতঙ্ক–শেষে আমার সমস্ত স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ল সেই চিন্তাধারা। চোখের সামনে ধাবমান জগতের ধোঁয়াটে পটপরিবর্তন দেখে ভাবলাম, না জানি মনুষ্যত্বের কী বিচিত্র বিকাশ, আমাদের আদিম সভ্যতার কী চরম অগ্রগতিই দেখব এবার! দেখলাম, বিরাট বিরাট জমকালো স্থাপত্য নিদর্শন, আমাদের এখনকার বাড়ির চাইতে অনেক বিপুল তাদের আকৃতি, আর তবুও যেন ঝিলমিলে কুয়াশা দিয়ে তা গড়া। দেখলাম, পাহাড়ের পাশের জমি উজ্জ্বল সবুজ রঙে ঝলমল করে উঠল, এমনকী শীতের প্রকোপেও অম্লান রইল তাদের ঔজ্জ্বল্য। চেতনার বিহ্বলতা সত্ত্বেও বুঝলাম, বড় সুন্দর হয়ে উঠেছে। পৃথিবী। আর তাই এবার গতিরোধের চিন্তাই প্রবল হয়ে উঠল আমার মনে।
আর তখনই অদ্ভুত একটা ঝুঁকির সম্মুখীন হলাম আমি। যে স্থানটুকু আমি বা আমার মেশিন দখল করে রয়েছে, সেখানে অন্য কোনও বস্তু থাকা খুবই সম্ভব। সময়ের মধ্যে দিয়ে দারুণ বেগে ধেয়ে চলার সময়ে অবশ্য এসব সম্ভাবনার কোনও প্রশ্নই ওঠেনি; কেননা, এককথায় বলতে গেলে আমি সূক্ষ্মরূপে সংকীর্ণ জোড়পথে বাষ্পের মতো পিছলে যাচ্ছিলাম এক বস্তু থেকে আর-এক বস্তুর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু হঠাৎ গতিরুদ্ধ হওয়া মানেই পথে আসা যে কোনও বস্তুর অণুতে অণু গেঁথে যাওয়া, ফলে আমার প্রতিটি পরমাণু বাধার প্রতিটি পরমাণুর সঙ্গে এমন নিবিড় সংস্পর্শে আসবে, যার পরিণামে ঘটবে একটা কল্পনাতীত রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্ভবত দিগন্তবিস্তারী একটা বিস্ফোরণ, আর মেশিন। সমেত রেণু রেণু হয়ে সম্ভাব্য সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে কোনও অজানায় আমার মিলিয়ে যাওয়া। মেশিনটাকে তৈরি করার সময়ে এ সম্ভাবনা বারবার ভেবে দেখেছি আমি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপরিহার্য ঝুঁকি হিসেবে তা আমি প্রসন্ন মনেই মেনে নিয়েছিলাম–বেঁচে থাকতে গেলে যেমন একটা-না-একটা ঝুঁকি মানুষকে নিতে হয়, এ-ও অনেকটা সেইরকম আর কী! কিন্তু সত্যই যখন সে ঝুঁকির মুখোমুখি হলাম, তখন আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। অচেনা-অজানা গতিবেগ, দীর্ঘকাল ধরে পতনের গা-গুলানো অনুভূতি আর মেশিনের অবিরাম ঝাঁকুনি-দুলুনির ফলেই বোধহয় আমার স্নায়ুও আর ধাতস্থ ছিল না। আপন মনে বললাম, না, থামা উচিত হবে না কোনওমতেই; কিন্তু পরমুহূর্তেই স্থির করলাম, থামতেই হবে। ধৈর্যহীন মূর্খের মতো আচমকা ঝুঁকে পড়লাম লিভারের ওপর–তৎক্ষণাৎ পাক খেতে খেতে উলটে পড়ল মেশিনটা, আর শূন্যপথে ছিটকে গেলাম আমি।
রাশি রাশি বাজের দামামা বেজে ওঠে আমার কানের পরদায়। মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম আমি। চারপাশে শুনলাম শুধু শিলাবৃষ্টির হিসহিসে শব্দ আর দেখলাম, উলটে-পড়া মেশিনের সামনেই নরম ঘাসজমির ওপর বসে রয়েছি আমি। তখনও সবকিছু ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে লাগছিল–কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের ঘোর কেটে গেল। চারপাশে ভালো করে তাকালাম। বাগানের মধ্যে ছোটখাটো একটা লনের ওপর বসে ছিলাম আমি, চারপাশে রডোডেনড্রনের ঝোঁপ; আরও দেখলাম, বরফের অবিরাম আঘাতে রডোডেনড্রনের ঘন বেগুনি আর টুকটুকে লাল রঙের মুকুলগুলি ঝরে ঝরে পড়ছে মাটির ওপর। মেশিনটাকে মেঘের মতো ঘিরে ধরে নেচে নেচে উঠছিল শিলার টুকরোগুলো, ঠিকরে গিয়ে ধোঁয়ার মতো গড়িয়ে পড়ছিল মাটির ওপর। দেখতে দেখতে ভিজে সপসপে হয়ে উঠল আমার সর্বাঙ্গ। আপ্যায়নের চমৎকার নমুনা। আপন মনেই বলি, অসংখ্য বছর পেরিয়ে যে তোমায় এল দেখতে, সে মানুষটার কী হালই করলে তুমি।
তারপরেই ভাবলাম, বোকার মতো বসে বসে ভেজার কোনও মানে হয় না। উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালাম। রডোডেনড্রনকুঞ্জের ওপারে অস্পষ্ট শিলাবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দেখলাম, সাদা পাথরে খোদাই প্রকাণ্ড একটা আবছা মূর্তি। এ ছাড়া জগতের সবকিছু রইল অদৃশ্য।
আমার তখনকার অনুভূতি বর্ণনা করা সত্যই কঠিন। শিলাবৃষ্টি যতই পাতলা হয়ে আসতে লাগল, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল সাদা মূর্তিটা। বেজায় উঁচু মূর্তি, একটা সিলভার বা গাছ তো কাঁধের কাছে গিয়ে ঠেকেছিল। আগাগোড়া সাদা মর্মরে তৈরি তার দেহ, আকারে অনেকটা ডানাওয়ালা স্ফিংক্স-এর মতো, কিন্তু ডানা দুটো খাড়াইভাবে নিচে নেমে এসে শুন্যে মেলা রয়েছে, যেন উড়তে গিয়ে হঠাৎ স্থাণু হয়ে গেছে। বেদিটা মনে হল ব্রোঞ্জের তৈরি, ওপরে পুরু হয়ে জমে রয়েছে সবুজ কলঙ্ক। মুখটা ফেরানো ছিল আমার দিকেই, দৃষ্টিহীন চোখ দুটো যেন আমাকেই লক্ষ করছিল, ঠোঁটের কোণ ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছিল হাসির ছায়া। রোদে-জলে ক্ষয়ে এসেছে মূর্তিটা, দেখলে জরাগ্রস্ত বলে মনে হয়। বেশ কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম–আধ মিনিট কি আধ ঘণ্টা তা জানি না। মূর্তির সামনে আছড়ে-পড়া শিলাবৃষ্টির চাদর কখনও গাঢ়, কখনও ফিকে– আর সেই সঙ্গে মূর্তিটাও যেন কখনও যাচ্ছে পিছিয়ে, কখনও আসছে এগিয়ে। শেষকালে ক্ষণেকের জন্যে জোর করে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, শিলাবৃষ্টির ঘন পরদা দ্রুত ফিকে হয়ে যাচ্ছে, সূর্যের স্বাক্ষর বুকে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে নীল আকাশ।
চোখ ফিরিয়ে আবার তাকালাম গুঁড়ি মেরে বসা সাদা মূর্তিটার দিকে। হঠাৎ আমার এই অভিযানের গোঁয়ারতুমি সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলাম। অস্পষ্ট ওই পরদা একেবারেই মিলিয়ে যাওয়ার পর না জানি কী দৃশ্য দেখব আমি। মানুষ আজ কী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে? নিষ্ঠুরতাই কি তাদের সহজ প্রকৃতি? এই সুদীর্ঘকাল পরে মানুষ যে তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে একটা অমানবিক নির্মম আর কল্পনাতীত শক্তিমান প্রাণীর পর্যায়ে নেমে যায়নি, তা কে বলতে পারে? হয়তো তাদের চোখে আমি আদিম বিদঘুটে আকারের ভয়ানকদর্শন বর্বর জানোয়ার ছাড়া আর কিছু না, যাকে দেখামাত্র নিধন করতে তৎপর হয়ে উঠবে তারা।
ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা বিপুল আকার দেখতে পেলাম। কমে-আসা ঝড়ের বুক চিরে অস্পষ্টভাবে চোখের সামনে ফুটে উঠল সারি সারি মস্ত বড় বাড়ি, চওড়া আলশে, উঁচু থাম আর পাহাড়ের পাশে বনভূমি। হঠাৎ নিঃসীম আতঙ্কে আমি যেন উন্মাদ হয়ে গেলাম। পাগলের মতো টাইম মেশিনের দিকে ছুটে গিয়ে তাড়াতাড়ি কলকবজাগুলো ঠিক করতে শুরু করে দিলাম। দেখতে দেখতে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে উঁকি দিল অরুণদেবের সোনার মুকুট। ধূসর শিলাবৃষ্টি আরও দূরে সরে গেল, তারপর আবছা ভৌতিক ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল কোথায়। মাথার ওপর ফিকে বাদামি রঙের পেঁজা তুলোর মতো মেঘের রাশি গাঢ় নীল আকাশের পটে আলপনা আঁকায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারপাশে উন্নত মাথায় দাঁড়িয়ে রইল উঁচু বাড়িগুলো, জলে ভিজে চিকমিক করতে লাগল তাদের অলংকরণ, এখানে-সেখানে স্তূপাকার হয়ে পড়ে রইল অগণিত অগলিত সাদা শিলাখণ্ড। এক অজানা জগতের মাঝে একা দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। খোলা বাতাসে উড়তে উড়তে মাথার ওপর ছোঁ মারতে উদ্যত বাজপাখি দেখে পায়রার মনে যে ভাবের উদয় হয়, সেইভাবেই শিউরে উঠল আমার তনুমন। আমার আতঙ্ক আর কোনও শাসনই মানলে না। বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে একসঙ্গে কবজি আর হাঁটু দিয়ে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাম লিভারটা! মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু একটা প্রবল ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে উলটে গেল মেশিনটা। চিবুকে দারুণ লেগেছিল। এক হাত আসনের ওপর আর এক হাত লিভারের ওপর রেখে আর-একবার উঠে বসবার চেষ্টায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেদম হাঁপাতে লাগলাম আমি।
চিবুকের ওপর জোরালো ওই আঘাতে কেন জানি হঠাৎ আমার লুপ্ত সাহস আবার ফিরে পেলাম। সুদূর ভবিষ্যতের আশ্চর্য জগতের দিকে নিঃশঙ্ক সোৎসুক চোখে তাকালাম। কাছের একটা বাড়ির উঁচু দেওয়ালের অনেক ওপরে একটা গোলাকার জানালায় দেখলাম, মূল্যবান গরম পোশাক-পরা কয়েকটি মূর্তি। আমাকেও দেখেছিল ওরা, আমার দিকেই ওরা মুখ ফিরিয়ে ছিল।
তারপরই শুনলাম, কতকগুলো স্বর এগিয়ে আসছে আমার দিকে। সাদা স্ফিংক্স-এর পাশ দিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটন্ত মানুষের কাঁধ আর হাত নজরে এল। এদের মধ্যে একজন যে লনের ওপর মেশিন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, ছুটে এল সেইদিকে। ছোটখাটো একটা মানুষ, ফুট চারেক উঁচু হবে। পরনে টুকটুকে লাল রঙের টিউনিক, কোমরে চামড়ার বন্ধনী, পায়ে স্যান্ডাল বা বুশকিনের মতো একরকম জুতো। হাঁটু পর্যন্ত নগ্ন, মাথাতেও কোনও টুপি নেই। তা-ই দেখেই সেই প্রথম লক্ষ করলাম, কী গরম সেখানকার বাতাস।
খুদে মানুষটাকে দেখতে কিন্তু ভারী সুন্দর। দেহে-মুখে গরিমা মাখানো, কিন্তু বর্ণনা করা যায় না এমনি শীর্ণ। ক্ষয়িষ্ণু সৌন্দর্য বলে একটা কথা প্রায় শুনে থাকি আমরা, তার আরক্ত মুখ দেখে সেই কথাই মনে পড়ল আমার। ওকে দেখেই হঠাৎ আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। হাত তুলে নিলাম মেশিনের ওপর থেকে।