৪. সকালের দিকটায়

সকালের দিকটায় কালীবাড়ির চাতালের একধারে থামের আড়াল দেখে যে লোকটা মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুমোয়, সে হল তারক দুলে। সারা রাত্তির তার বিস্তর মেহনত যায়। রক্তজল করা মেহনতের পরও তারকের তেমন সুবিধে হয়ে উঠছে না। না হল নামডাক,

হল পয়সা। এসব গুহ্য কথা আর কেউ না জানুক ঠাকুরমশাই ব্রজবিহারী ভটচাজ খুব জানেন।

পাঁচবাড়ি নিত্যপূজা সেরে ব্রজবিহারী এসে কালীবাড়ির চাতালে একটু বসলেন। এ সময় চাতালের গায়ে মস্ত বটগাছটার ঝুপসি ছাওয়ায় চাতালটা ভারী ঠান্ডা থাকে। একটু ঝিরঝিরে হাওয়া পুকুরের জল ছুঁয়ে এসে গা জুড়িয়ে দেয়। চারদিকটা ভারী নিরিবিলি আর নির্জন বলে মনটা জুড়োতে পারে। আর এই সময়টায় নানা ভাবনাচিন্তাও এসে পড়ে।

“বুঝলি রে তারক, অনেক ভেবে দেখলুম, ভগবান বোধহয় কানে ভাল শুনতে পান না।”

তারক টক করে উঠে বসে একটানমোঠুকে বলল, “প্রাতঃপেন্নাম হই ঠাকুরমশাই। তা কী যেন বলছিলেন?”

“অবিচারটা দ্যাখ। সেই ছেলেবেলা থেকে বাবার কানমলা আর পণ্ডিতমশাইয়ের বেত খেয়ে খেয়ে শব্দরূপ-ধাতুরূপ, সমাস বিভক্তি মুখস্থ করে করে বড়টি হলুম। কিন্তু শাস্ত্রটাস্ত্র শিখে কোন লবডঙ্কাটা হল বল তো? এই যে রোজ মন্দিরে বল, বাড়ি বাড়ি ঘুরে বল, ঠাকুর-দেবতার এত পুজো-অর্চনা করছি, তাতে কোন হাত পা গজিয়েছে রে বাপু? আজ বাপ বা পণ্ডিতমশাই বেঁচে থাকলে তাঁদের কাছেই জবাবদিহি চাইতুম। এত যে মেরে-বকে সংস্কৃত আর শাস্ত্র শেখালেন, তাতে হল কোন কচুপোড়া? এই যে রোজ সংস্কৃত মন্তর পড়ে ভগবানদের তোষামোদ করে যাচ্ছি, তা তারা কি আর তাতে কান দিচ্ছেন? বদ্ধ কালা না হলে মন কি একটু ভিজত না রে?”

তারক গম্ভীর হয়ে বলল, “আজ্ঞে, শুধু কালা কেন, ভগবানগণ চোখেও ভারী কম দেখেন। এই যে রাতবিরেতে বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে মেহনত করে বেড়াই, খাটুনি তো কম নয় মশাই। খাটুনিটার কি কোনও দাম নেই? চোখ থাকলে কি আর-একটু দয়ামায়া হত না! কলিকাল বলেই চারদিকে যেন অবিচারের মচ্ছব চলছে ঠাকুরমশাই?”

“অবিচারের কথাই যখন বললি বাপ, তখন দুঃখের কথা তোকে খুলেই বলি। ওই যে দুধওলা রামভরোসার মা গিরিজাবুড়ি, শতচ্ছিন্ন একখানা কাপড় পরে ঘুঁটে দিয়ে মরত, হঠাৎ ভগবান যেন তেড়েফুঁড়ে তার ভাল করতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছেন।”

“বটে ঠাকুরমশাই?”

“তবে আর বলছি কী? গোয়ালপাড়ায় পাঁচকাঠা জমি কিনবে বলে বায়না করেছে, ইটভাটায় গিয়ে দশ হাজার ইটের বরাত দিয়ে এসেছে। পাকাবাড়ি উঠল বলে! আজও দেখলুম, বুড়ি সকালে নতুন শাড়ি পরে বসে জিলিপি দিয়ে নাস্তা করছে।”

“লটারি মেরেছে নাকি ঠাকুরমশাই?”

“আরে না। তার খুঁটে নাকি কে বা কারা ভাল দামে কিনে নিচ্ছে। যার কপাল খোলে তার খুঁটের মধ্যেও ভগবান মোহর গুঁজে দেন কিনা!”

“তা যা বলেছেন ঠাকুরমশাই। এই পতিতপাবনকেই দেখুন না, ভুসিমাল বেচে কেমন খুশিয়াল হাবভাব! তা ঠাকুরমশাই, ঘুঁটে কি আজকাল বিলেত-আমেরিকায় চালান যাচ্ছে নাকি?”

“তা না যাবে কেন? গিরিজাবুড়ির কপাল ফেরাতে হয়তো সাহেবরাও আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছে।”

“এ কিন্তু খুব অন্যায় ঠাকুরমশাই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কত কৌশল করে থানা-পুলিশ থেকে গা বাঁচিয়ে সারারাত জেগে, মাথা খাঁটিয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কী রোজগার হয় বলুন? ওই তো দেখুন না, কাল রাতে তিন বাড়িতে হানা দিয়ে জুটেছে মাত্র বিয়াল্লিশটা টাকা আর একটা রুপোর নথ। না, জীবনের উপর ঘেন্না ধরে গেল।”

“তা তো হবেই রে!”

“তা ঠাকুরমশাই, এই চুরিটুরি ছেড়ে কি ঘুঁটের ব্যাবসাতেই নেমে পড়ব নাকি?”

“দুর পাগল! স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরো ধর্ম ভয়াবহ! কুলধর্ম কি ছাড়তে আছে? তোরা হলি তিন পুরুষের চোর, অন্য কাজে তোর আর্ষই নেই। যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে। এই আমাকে দেখছিস না, সকাল থেকে মন্তর পড়ে পড়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, জুটেছে কয়েকটা মজা কলা, একধামা মোটা আতপচাল, কয়েকটা অখাদ্য কাটা ফল, দশটি টাকা। তা কী আর করা যায়? বাপ-দাদা এই কর্মেই জুতে দিয়ে গিয়েছেন, দিনগত পাপক্ষয় করে যাচ্ছি।”

তারক কিছুক্ষণ চুপ করে বসে খুব গভীর চিন্তায় ডুবে রইল। তারপর বলল, “আচ্ছা ঠাকুরমশাই, খোলও কি আজকাল বিলেত আমেরিকায় চালান যাচ্ছে?”

“কেন রে, হঠাৎ খোলের কথা উঠছে কেন?”

“এই মহিন্দির ঘানিওলার কথাই বলছিলাম। আগে তো তার তেল কেনার তেমন খদ্দেরই ছিল না। ইদানীং শুনছি, সে তেলের বদলে খোল বেচে দেদার রোজগার করছে।”

“বলিস কী?”

“একেবারে নির্যস খবর ঠাকুরমশাই। সামনের শনিবার পরানগঞ্জে গোহাটা থেকে গোরু কিনবে বলে মহিন্দির কোমর বেঁধেছে।”

ঠাকুরমশাই চোখ কপালে তুলে বললেন, “মহিন্দির গোর কিনছে! ও বাবা, তা হলে তো তার ভাসাভাসি অবস্থা।”

“আরও একটা খবর আছে ঠাকুরমশাই।”

“বলে ফেল।”

“পরেশ তোপদারের একখানা সবজির খেত আছে, জানেন তো?”

“তা জানব না কেন? মদনপুর জঙ্গলের দক্ষিণে তার সবজির চাষ।”

“হ্যাঁ, ভারী নিরিবিলি জায়গা, কাছেপিঠে লোকালয় নেই। পরেশ সেখানে একখানা কুঁড়ে বেঁধে চৌপর দিন খেত পাহারা দেয়।”

“ফলায়ও ভাল। ভারী বড় সাইজের মিঠে বেগুন হয় তার খেতে।”

“বেগুন, বেগুনের কথা আর কবেন না। আপনার তো সত্তরের উপর বয়স হল, তাই না? এই সত্তর বছরে কত বড় সাইজের বেগুন দেখেছেন?”

“তা দেখেছি বই কী। ছোটখাটো লাউয়ের সাইজের কাশীর বেগুন খেয়েছি, এখনও মুখে লেগে আছে।”

“পরেশের খেতে যে বেগুন ফলেছে তা দেখলে আপনি মূর্ছা। যাবেন। চার-পাঁচ হাত উঁচু গাছে পাঁচ-সাত সের ওজনের শ’য়ে শ’য়ে বেগুন ঝুলছে দেখে আসুন গে!”

“দুর পাগল! ও নিশ্চয়ই বেগুন নয়!”

“আমারও প্রত্যয় হয়নি ঠাকুরমশাই। আর শুধু বেগুনই বা কেন, এই অসময়েও পরেশের বাগানে গেলে দেখতে পাবেন, রাক্ষুসে ফুলকপি আর দৈত্যের মতো বাঁধাকপি ফলে আছে। দুটো কপিতে একটা ভোজবাড়ির রান্না হয়ে যায়। তা ভাবলুম, রাতবিরেতে পরেশদাদা ঘুমোলে এক-আধটা জিনিস তুলে এনে বউ-বাচ্চাদের দেখাতাম। তা বলব কী মশাই, বাগানের ফটকটাই ডিঙোতে পারলাম না।”

“কেন রে? ফটকটা খুব উঁচু নাকি?”

“দুর দুর, চার ফুটও নয়। কিন্তু যতবার ভিতরে ঢুকতে যাই, কীসে যেন বাধক হয়। দেখলে মনে হয় ফাঁকা, কিন্তু ঢুকতে গেলেই যেন একটা শক্ত জিনিসে ঠেকে যেতে হয়। একবার মনে হয়েছিল পরেশদাদা বুঝি কাঁচ দিয়ে বাগান ঘিরেছে। কিন্তু দেখলুম, সেটা কাঁচও নয়। তাতে হাত দিলে হাত চিনচিন করে।”

“হ্যাঁরে, নেশাভাঙ করিসনি তো?”

“মা কালীর দিব্যি ঠাকুরমশাই, চোর হতে পারি, নেশাখোর নই। তবে পরেশদাদাকে গিয়ে পরদিন বেলাবেলি ধরেছিলুম। জিজ্ঞেস করলুম, “দাদা, এরকম সরেস জিনিস ফলালে কেমন করে? তা পরেশদাদা মিচিক মিচিক হেসে কথাটা পাশ কাটিয়ে গেলেন। শুধু বললেন, “যত্নআত্তি করলে সব জিনিসেরই বোলবোলাও হয়। তারপর রাতের ব্যাপারটাও কবুল করে ফেলে জিজ্ঞেস করলুম, “দাদা, বাগানের চারদিকে কাঁচের দেওয়াল তুললেন নাকি?” পরেশদাদা মৃদু হেসে বললেন, “কাঁচটাচ নয় রে, বাগান মন্তর দিয়ে ঘেরা থাকে। চোর তো দূরের কথা, একটা মাছি অবধি ঢুকতে পারে না।”

“বলিস কী! পরেশের মন্তরের এত জোর? আর আমি যে সারাটা জীবন মুখের ফেকো তুলে বিশুদ্ধ দেবভাষায় এত মন্তর পড়লুম, তাতে তো কোনও কাজই হল না! পরেশ কি আমার চেয়ে বেশি মন্তর জানে?”

“কুপিত হবেন না ঠাকুরমশাই। ব্রাহ্মণের রাগ বড় সাংঘাতিক। প্রলয় হয়ে যাবে।”

“দুর দুর! তোর কথা শুনে তো সন্দেহ হচ্ছে, ব্রহ্মতেজ বলে কি কিছু আছে নাকি? মন্তর ঘেঁটে বুড়ো হয়ে গেলুম, আজ অবধি মন্তরে একটা মশা-মাছিও মারতে পারিনি!”

এমন সময় চাতালের পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “কে বলে যে আপনার মন্তরের জোর নেই? বললেই হল? আর পরেশের সবজির খেতে যেসব কাণ্ডমাণ্ড হচ্ছে তা মোটেই মন্তরের জোরে নয়। ও হচ্ছে ভুতুড়ে কারবার।”

ব্রজবিহারী নবকুমার দিকপতিকে দেখে ভারী খুশি হয়ে বললেন, “আয় নব, বোস এসে। তা ভুতুড়ে কারবার যে সেটাই বা কী করে বুঝলি?”

“পরেশের চোদ্দো পুরুষের কেউ মন্তর-তন্তরের কারবার করেনি। মন্তরের মহিমা ও কী করে বুঝবে? আর আপনার মন্তরের কথা কী বলব ব্রজখুড়ো, আপনি হয়তো মন্তরের জোর টের পান না, কিন্তু আমরা তো দিব্যি পাই। এই যে সেদিন কেষ্ট হাজরার বাড়িতে শেতলা পুজো করছিলেন, ঘরের ভিতর বসে আপনি মন্তর পাঠ করছেন, আর বাইরে সেই মন্তর যেন চারদিকে ঠং ঠং করে হাতুড়ির ঘা দিয়ে বেড়াচ্ছে! মধুদের বাগানে গাছ থেকে দুটো ডাঁশা পেয়ারা খসে পড়ল, হাবুদের কাবলি বিড়ালটা একটা মেঠো ইঁদুরকে তাড়া করতে গিয়েও করল না। পরে দেখলুম, জটা ওদের দাওয়ায় বসে ফাঁস ফাঁস করে কাঁদছে, আর সুদখোর মহাপাপী খগেন সাঁতরা মন্তরের শব্দ শুনে দু’কানে হাতচাপা দিয়ে বাবা রে, মা রে’ করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। স্বচক্ষে দেখা।”

ব্রজবিহারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এই গাঁয়েগঞ্জে কে আর ওসবের মর্ম বোঝে রে, দামই বা দেয় কে?”

“কেন ব্রজখুড়ো, এই তো সেদিন কেষ্ট হাজরাই বলছিল, শেতলা পুজোর পর থেকেই নাকি তার নব্বই বছরের শয্যাশায়ী বুড়ি ঠাকুরমা তেড়েফুঁড়ে উঠে চেঁকি কুটতে লেগেছেন। জ্যাঠামশাইয়ে বাঁ হাঁটুতে বাত ছিল, এখন সেই বাত জ্যাঠার হাঁটু তো ছেড়েছেই, এই গঞ্জ ছেড়েও উধাও হয়েছে। কেষ্টর ছেলে সেভেন থেকে এইটে ওঠার জন্য গত তিন বছর ধরে মেহনত করে যাচ্ছিল। এবার দেখুন, মাত্র তিন বিষয়ে ফেল মেরেছে বলে মাস্টারমশাইরা তার কত প্রশংসা করে সেভেনে তুলে দিলেন। কেষ্টর মেয়ে ফুলির হাতে একজিমা ছিল বলে বিয়ে হচ্ছিল না। শেতলা পুজোর পর সেই একজিমা তাড়াতাড়ি পায়ে নেমে গিয়েছে। ফুলির বিয়েও ঠিক হল বলে।”

তারক এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “আহা, ভূতের বৃত্তান্তটা যে চাপা পড়ে যাচ্ছে মশাই।”

নব দিকপতি বগল থেকে দাবার বোর্ড আর খুঁটির কৌটো নামিয়ে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে বলল, “ও, সেকথা আর বলিস না। পরেশের চাষবাড়িতে শুধু তরকারির চাষই হয় না রে, রীতিমতো ভূতেরও চাষ হয়, এ কথা তল্লাটের সবাই এখন জেনে গিয়েছে। আর হবে না-ই বা কেন? পরেশের ওই চাষবাড়িতেই তো একসময় খেরেস্তানদের কবরখানা ছিল। তো তারাই এখন কবর ছেড়ে তেড়েফুঁড়ে উঠে আস্তিন গুটিয়ে ওইসব অশৈলী কাণ্ড করছে।”

তারক সন্দিহান হয়ে বলল, “নিজের চোখে দেখেছ নবদাদা?”

“তা আর দেখিনি? জানিস তো, রোজই আমি সকালে বাজারে গিয়ে কালীস্যাকরার সঙ্গে এক পাট্টি দাবা খেলে আসি।”

“তা আর জানি না!”

“তা সেদিন গিয়ে দেখি, কালী ম্যালেরিয়া জ্বরে কোঁ কোঁ করছে। তা মনটা খারাপ হয়ে গেল। দাবার নেশা বড় সব্বোনেশে নেশা। তাই ভাবলুম, এ গাঁয়ে তো আর পাতে দেওয়ার মতো দাবাড়ু নেই। তা যাই, গিয়ে পরেশের সঙ্গেই এক পাট্টি দাবা খেলে আসি। দিনে এক পাট্টি দাবা না খেলতে পারলে আমার খিদে হতে চায় না, পেটে বায়ু হয়, মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু পরেশের ওখানে গিয়ে বাইরে থেকে অনেক ডাকাডাকি করেও তার সাড়া না পেয়ে চলে আসব ভাবছি, ঠিক এমন সময় বেগুনখেতের আড়াল থেকে একটা সবুজ রঙের লম্বা লিকলিকে ভূত বেরিয়ে এসে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে রইল। দেখে তো আমার আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে উড়ে যায় আর কী!”

তারক অবাক হয়ে বলল, “দিনেদুপুরে?”

“তবে আর বলছি কী? আজকাল ভূতেদের যা আস্পদ্দা হয়েছে, বলার নয়। আর শুধু কি কটমট করে চাউনি? একটা লম্বা আঙুল তুলে আমার বগলের দাবার বোর্ডটা দেখিয়ে কী যেন বলল।”

“কী বলল গো নবদা?”

“সে ভাষা বুঝবার কি সাধ্যি আছে আমাদের? ভাষাও নয়, অনেকটা ঝিঝিপোকার ডাকের মতো একটা শব্দ। আমি তো অবাক। ভূত কি দাবাও খেলতে চায় নাকি রে বাবা! আমার তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু হাতে-পায়ে এমন খিল ধরে গিয়েছে যে, পালানোরও উপায় নেই।”

ব্রজবিহারী বললেন, “ভূতের গা থেকে বোটকা গন্ধ পাসনি?”

“তা আর পাইনি! খড়বিচালি আর শুকনো ঘাসপাতা থেকে যেমন গন্ধ আসে, অনেকটা তেমনি।”

তারক বলল, “তা কী করলে নবদা?”

একটা বেগুনগাছের ছায়ায় অগত্যা দাবার ছক বিছিয়ে বসতেই হল। নইলে কে জানে বাবা, ভূতের অসাধ্যি তো কিছু নেই! গলাটলা টিপে ধরে যদি? কিন্তু দাবা খেলতে বসলে আমার আবার বাহ্যজ্ঞান থাকে না। ভয়ডরও উধাও হল। আশ্চয্যির ব্যাপার হল কী জানিস? ভূতটা আমাকে গো হারান হারিয়ে দিল।”

“বলো কী?”

ব্রজবিহারী বললেন, “হবে না? ও হল সাহেবভূত। সাহেবদের সঙ্গে কি আমরা এঁটে উঠতে পারি?”

তারক মাথা নেড়ে বলল, “না না, সাহেব হতে যাবে কেন? শুনছেন না গায়ের রং সবুজ। এ নিশ্চয়ই কাফ্রির ভূত।”

নব বলল, “তো হতে পারে। সাহেবদের তো মেলা কাফ্রি কাজের লোক ছিল বলে শুনেছি। তবে যাই বলিস, দাবা যেন গুলে খেয়েছে। দেড় ঘণ্টার মধ্যে তিন পাট্টি খেলা শেষ। প্রতিবার বারো চোদ্দো চালের পরই বুঝতে পারছিলাম, হারা ছাড়া উপায় নেই।”

“তারপর কী হল?”

“কী আর হবে? তিন পাট্টির পর ভূতটা উঠে বেগুনখেতের মধ্যে ঢুকে গায়েব হয়ে গেল।”

ব্ৰজবিহারী বললেন, “খুব বেঁচে গিয়েছিস। ঘাড় যে মটকে দেয়নি সেই ঢের!”

নবকুমার গম্ভীর হয়ে বলল, “বাঁচলুম আর কোথায় ব্ৰজখুড়ো! সেই থেকে যে নেশা ধরে গেল? ফের পরদিন গেলুম। ফের তিন পাট্টি খেলা। ফের গোহারান হার। তারপর থেকে রোজই যাচ্ছি।”

“বলিস কী?”

“এই তো সেখান থেকেই আসছি, আজ্ঞে! আজও হেরেছি বটে, তবে ক’দিন হল ভূতটার চালগুলো লক্ষ করে খানিক খানিক শিখেও নিয়েছি কিনা! তাই আগের মতো সহজে হারছি না। আজ তো ওর মন্ত্রীও খেয়ে নিয়েছিলুম। তবে এমন চালাক যে, দুটো নৌকো দিয়ে অ্যাইসান চেপে খেলল যে, পথই পেলুম না।”

ব্রজবিহারী গম্ভীর হয়ে বললেন, “ভূতের সঙ্গে দাবা খেলছিস, একটা প্ৰাশ্চিত্তির করে নিস বাবা। সংহিতা দেখে আমি বিধান বলে দেবখন।”

“আহা, সে না হয় পরে হবে। আগে জুত করে কয়েকদিন ভূতটার সঙ্গে একটু খেলে নিই ব্রজখুড়ো। ভূতটা যে মাপের দাবাড়ু তাতে বিশ্বনাথন আনন্দ, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, টোপালভ, ক্রামনিক সবাইকেই বলে বলে হারিয়ে দেবে।”

ভ্রূ কুঁচকে ব্রজবিহারী বললেন, “এরা সব কারা রে?”

“দুনিয়ার নামজাদা সব দাবাড়ু ব্ৰজখুড়ো!”

“বলিস কী? দাবা খেলেও নাম হয় নাকি? ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি তাস-দাবা-পাশা, এ তিন কর্মনাশা।”

“সেসব দিন আর নেই খুড়ো। এখন দাবা খেলে নাম হয়, লাখো লাখো টাকা হয়।”

“দ্যাখো কাণ্ড! আগে জানলে তো পুরুতগিরি না করে দাবা নিয়েই লড়ে যেতুম রে। বাবা যে কখনও ওসব ছুঁতেও দেননি! না,

জীবনে কত সুযোগ যে ফসকে গেল!”

তারকও বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “যা বলেছেন ঠাকুরমশাই, বসে বসে দাবা-বোড়ে টিপে যদি আয়-পয় হত, তা হলে রাত জেগে মেহনত করতে যেত কে? তা নবদাদা, ভূতবাবাজির সঙ্গে তো তা হলে এখন তোমার খুব ভাবসাব!”

“তা একরকম বলতে পারিস। তবে কথাটথা তো আর হয় না। কেবল ঝিঝিপোকার মতো একটা শব্দ করে যায়। তা থেকে কিছু বুঝবার উপায় নেই কিনা!”

“তা হলে পরেশদাদার বাগানে যা হচ্ছে তা ভূতুড়ে কাণ্ডই বলছ তো?”

“তা ছাড়া আর কী! পরেশ অবশ্য স্বীকার করতে চায় না। কেবল মিচকি মিচকি হাসে আর পাশ কাটিয়ে যায়।”

ব্রজবিহারী একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে বললেন, “খবরটা দিয়ে বাঁচালি বাপ৷ পরেশ মন্তরের জোরে অশৈলী কাণ্ড ঘটাচ্ছে শুনে নিজের উপর ঘেন্না এসে গিয়েছিল। পরেশের মন্তরের যদি ওরকম জোর হয়, তবে কোন ঘোড়ার ঘাস কাটলুম?”

“আরে রামো, মন্তরতন্তর নয় খুড়ো, ভূত!”