৪. শ্ৰীমতী মালহোত্রার কাণ্ড

০৪.

শ্ৰীমতী মালহোত্রার কাণ্ড

 জয়ন্তীর কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এবার শ্রীমতী মালহোত্রার বাড়িটা দিনের আলোয় খুঁটিয়ে দেখছিলুম। আমরা আছি একেবারে দক্ষিণের শেষপ্রান্তে। ফুট পাঁচেক উঁচু পাঁচিলের নীচে ঝোপজঙ্গল এবং তারপর খাড়া নেমে গেছে। পাথরের দেয়াল। বোঝা গেল একটা ছোটখাটো পাহাড়ের মাথা সমতল করে বাড়ি ও সংলগ্ন প্রাঙ্গণটা গড়ে উঠেছিল কবে। পাহাড়টা উত্তরের বড় রাস্তার গা। ঘেঁষে উঠেছিল। ওই দিকটা ছাড়া বাকি তিন দিকেই ঢালু বা খাড়া পাথরের দেয়াল, কোথাও বা ফাটলে ঝোপঝাড় গাছপালা গজিয়ে রয়েছে। মনে হল, এ বেশ চমৎকার একটা দুর্গ!

জয়ন্তী যে বুদ্ধিমতী মেয়ে, তাতে কোন ভুল নেই। সে সরফুর কাছে বাড়িটার ইতিহাস জেনে নিয়েছে। এ এক অপয়া বাড়ি নাকি। মালহোত্রা সায়েবের প্রবল আপত্তি ছিল কিনতে। এ নিয়ে স্বামীস্ত্রীতে খুব ঝগড়াঝাটি হত। শেষ অবধি তিনি যখন গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, তখন মাইজীর কিনে ফেলতে অসুবিধে হল না। এদিকে কলেজেও রিটায়ার করার বয়স হল। তখন সোজা এখানে এসে উঠলেন।

জয়ন্তী এইসব গল্প করার পর বলল–তাহলে দেখুন, আমার বদ্ধমূল ধারণা যে ওই ভদ্রমহিলাই শ্যামলীর মৃত্যুর কারণ! কর্নেলকে এটা কিছুতেই বোঝাতে পারলুম না!

বললুম-কর্নেল বড় একগুঁয়ে মানুষ। কিন্তু ঘড়ি আর ফোনের তার কাটার পর মিসেস মালহোত্রাকে আর সন্দেহ না করে উপায় নেই। তবে কী জানেন? একটা সঙ্গত মোটিভ সব ডেলিবারেট বা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের পিছনে থাকে। শ্যামলীকে হত্যার উদ্দেশ্যটা কী, সেটাই এখন জানা যাচ্ছে না।

জয়ন্তী দৃঢ়কণ্ঠে বলল–আপনি যদি প্রেতশক্তিতে বিশ্বাস করেন, তাহলে হত্যার মোটিভ খোঁজার প্রশ্নই উঠবে না। জীবনে যারা অতৃপ্ত থেকে যায়, মৃত্যুর পর তারা জীবিত মানুষদের ওপর সুযোগ পেলেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। এক্ষেত্রে সুযোগটা করে দিলেন ওই ভদ্রমহিলা। কাজেই শ্যামলীর মৃত্যুর জন্যে উনিই দায়ী।

–কিন্তু ঘড়ি আর ফোনের তার কাটার উদ্দেশ্য কী?

জয়ন্তী তার ধারণার সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে খুব ব্যগ্র হল। বলল–আমি। ব্যাপারটা যেভাবে বুঝেছি, আপনাকে বলি, শুনুন। মিসেস মালহোত্রার সঙ্গে প্রেতশক্তিদের যোগাযোগ আছে। উনি বলছিলেন যে স্বামীর মৃত্যুর পর উনি থিওজফি বা প্রেততত্ত্বের চর্চা শুরু করেন, তা মিথ্যে। সরযূ সব বলেছে। ভূতপ্রেত নিয়ে ওঁর উৎসাহ তার অনেক আগে থেকে। এখনও অনেকে সন্দেহ করে ওঁর স্বামীর জিপ পাহাড়ি খাদে উল্টে যাওয়ার পিছনে ওঁর কারসাজি ছিল। কোন দুষ্ট আত্মাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। যাই হোক, এটা এইসব পাহাড়ী এলাকার লোকেদের চিরাচরিত কুসংস্কার বলা যেত। কিন্তু গতরাত্রে যা ঘটতে দেখেছি, তাতে আমি কনভিন্সড। তর্ক করবেন না। এবার। শুনুন কীভাবে কী ঘটেছে।

হাসি চেপে বললুমবলুন না, শুনে যাচ্ছি।

–সরযূ বলেছে, বোম্বের গায়ক ভদ্রলোক মোহন পারেখকে মাইজি পেটের ছেলের মতো ভালবাসতেন। সরযূর ভয় হত, দুষ্ট আত্মারা তো তাদের স্বভাব অনুযায়ী বেছে বেছে মাইজীর প্রিয়জনদের মারবার তালে থাকবে। এ বেচারার আবার কিছু বিপদ না হয়। সরযূ ভেবেছিল, পারেখজিকে সতর্ক করে দেবে গোপনে। কিন্তু সুযোগ পায়নি। ব্যস, পারেখজিকে ভূতের পাহাড়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল! এখন আমার ধারণা, হোটেলে থাকার সময় এই পারেখ ভদ্রলোক নিশ্চয় শ্যামলীর প্রতি মনে মনে লোভী হয়ে পড়েছিলেন!

–কিন্তু তার প্রমাণ কী?

জয়ন্তী এদিকওদিক তাকিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল–আর লুকিয়ে লাভ নেই, আপনাকেই বলছি। শ্যামলীর সঙ্গে পারেখের আলাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার নিষেধ কানে নেয়নি শ্যামলী। ওঁর ঘরে গিয়ে আড্ডা দিয়ে আসত।

বলেন কী!

–হ্যাঁ। শ্যামলীর ওই একটা দুর্বলতা ছিল। ফিল্ম ওয়ার্লডের বিখ্যাত লোকদের প্রতি ওর প্রচণ্ড মোহ ছিল।

–হুঁ, তারপর?

তারপর যা হয়েছে, খুব সোজা। পারেখ খাদে পড়ে মারা গেলেন, কিন্তু মনের অতৃপ্ত বাসনা তো নষ্ট হবার নয়। কাল সন্ধ্যার আগে কতক্ষণ সেই খাদের অত কাছে শ্যামলী দাঁড়িয়ে রইল। পারেখের আত্মা ওকে অমনি বাগে পেয়ে গেল। পিছু নিল। তাই স্বাভাবিক নয়?

জয়ন্তী যেভাবে গাম্ভীর্য ও গুরুত্বসহকারে কথাগুলো বলল, আমার মনে যেন একটা চাপা অস্বস্তি ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। সত্যি কি প্রেতশক্তি বা অতৃপ্ত আত্মা বলে কিছু আছে? প্রকাশ্যে অন্যমনস্কভাবে বললুম, সেটা স্বাভাবিক।

জয়ন্তী দুঃখিত মুখে বলতে থাকল–জানেন? মানুষের মনে যেন কী আছে। যাকে ভালবাসি কিংবা যার জন্যে মনে মনে ভাবি, তার সঙ্গে যেন একটা অদৃশ্য মেন্টাল ওয়েভ বা ভাবতরঙ্গের যোগাযোগ ঘটে। মিসেস মালহোত্রার থিওরি খুবই সত্য। প্যারাসাইকলজির ব্যাপারটা আমিও কিছুটা জেনেছি। একশো মাইল দূরে ধরুন কোন প্রিয়জন আছেন–হঠাৎ এখানে আমার মনে অস্বস্তি জাগল তার সম্পর্কে। পরে খবর এল–তিনি অসুস্থ বা মারা গেছেন–ঠিক ওই একই সময়ে। এরকম ঘটনা তো কত ঘটে আসছে।

–হ্যাঁ, শুনেছি।

–ঠিক এভাবেই মোহন পারেখের মৃত্যুর ব্যাপারটা নিশ্চয় শ্যামলী অবচেতন মনে টের পেয়ে থাকবে। তা না হলে একটা অদ্ভুত স্বপ্নের কথা কেন বলেছিল সে? আসলে স্বপ্ন কথাটা ওর বানানো। ও আমাকে ওর মনের গোপন অস্বস্তির কথাটা বলতে লজ্জা পেয়েছিল। তাই বানিয়ে যা তা একটা বলে অবচেতন প্রক্ষোভ শান্ত করতে চেয়েছিল। এবং শেষ অবধি আর না থাকতে পেরে ভূতের পাহাড়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল। তখন আপনারাও তো গিয়েছিলেন। কেমন অন্যমনস্ক মনে হয়নি ওকে?

–হ্যাঁ। ব্যাপারটা চোখ এড়ায়নি আমার।

–শুধু তাই নয়, ওকে কেমন অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছিল। যেন নিশির ডাকে চলে-আসা মানুষের মতো। কথা বলছিল যেন ঘুমের ঘোরে।

অতটা মনে হয়নি আমার। তবে জয়ন্তীকে সায় দিতে হল। বললুম–ঠিক, ঠিক।

জয়ন্তী সোৎসাহে বলল–আর ফেরার পথেই পড়বি তো পড়, একেবারে। মিসেস মালহোত্রার পাল্লায়! কর্নেল সায়েব একটা উপলক্ষ মাত্র। তার ওপর দেখুন, প্ল্যানচেটের আসরও তখন একেবারে ঠিকঠাক পরিকল্পিত হয়ে রয়েছে। এগুলো সবই কি নিছক আকস্মিক যোগাযোগ বলে উড়িয়ে দেবেন?

–আপনি ঠিকই বলেছেন জয়ন্তীদেবী। কিন্তু ফোন আর ঘড়ির তার..

বাধা দিয়ে জয়ন্তী বলল–প্রথমে ঘড়ির তার কাটার কারণ বলি। মিসেস মালহোত্রা শ্যামলীর মৃত্যুর সময় চিহ্নিত করেছিলেন। প্রেতশক্তির নির্দেশেই করেছিলেন। রাত আটটা পাঁচে—

চমকে উঠে বাধা দিলুম–আপনি তো আজ ওঘরে যাননি। কেমন করে জানলেন ঘড়ির কাটা আটটা পাঁচে থেমে আছে?

জয়ন্তী হাসল একটু। গত রাতে ওঘরে ঢোকার সময় আমার চোখ পড়েছিল ঘড়িটার দিকে। তখন তো মোটে সাতটা প্রায়। তাই ঘড়িতে আটটা পাঁচ দেখে অবাক হয়েছিলুম। কিন্তু প্ল্যানচেটের আসর বসবে সব উত্তেজনা তাই নিয়ে। ফলে কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলুম।

-আশ্চর্য, কেন যে আমি ওদিকে তাকাইনি!

–আপনার চোখ সারাক্ষণ ছিল শ্যামলীর দিকে।

 হাসি পেল। কে জানে! তা এবার ফোনের তার কাটার উদ্দেশ্য বলুন।

মিসেস মালহোত্রা চাননি যে তক্ষুনি পুলিস এসে হাঙ্গামা বাধাক। মতলব ছিল, ব্যাপারটা যে কোন ভাবে সামলাবেন ততক্ষণে।

বা রে! পায়ে হেঁটে তো থানায় গিয়ে খবর দেওয়া যায়। এক ঘণ্টা দেরি হয় বড়জোর! নাঃ, আপনার এ ধারণাটার কোন যুক্তি নেই জয়ন্তীদেবী। আমি বদ্রীকে নিয়ে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলুমও বটে।

জয়ন্তী একটু ভেবে নিয়ে বলল–ঠিক বোঝাতে পারছি না। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে মিসেস মালহোত্রা সময় চেয়েছিলেন–তা সে যে জন্যেই হোক। এবং পেয়েছিলেনও। প্রায় তিন ঘণ্টা পরে আপনারা পুলিস নিয়ে এলেন!

–কিন্তু কর্নেলের মতো ধুরন্ধর লোক তো সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন। মিসেস মালহোত্রার তেমন কোন উদ্দেশ্য থাকলে তা ব্যর্থ হয়েছে। মিঃ খান্নার চেয়ে কর্নেলের বুদ্ধিচাতুর্য বা অপরাধতত্ত্বের ব্যাপারে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেক বেশি জয়ন্তীদেবী।

জয়ন্তী ফের একটু ভেবে বলল–তাহলে বলব, কর্নেল সম্পর্কে মিসেস মালহোত্রার ধারণা হয়তো স্পষ্ট নয়। ওঁর সঙ্গে পরিচয় কতদিনের জানেন?

–শুনেছি এখানে এসেই আলাপ হয়েছে ওঁদের।

জয়ন্তী লাফিয়ে উঠল–আমার থিওরি কারেক্ট। ভদ্রমহিলা কর্নেলের পরিচয় জানেন না।

–বেশ। কিন্তু কিছুটা সময় কেন দরকার হয়েছিল মিসেস মালহোত্রার, তা ভেবেছেন কি?

জয়ন্তী মাথা দুলিয়ে বলল–সেটাই বুঝতে পারছিনে। ফোনের তার কাটার আর কিছু উদ্দেশ্য মাথা ঢুকছে না।

তাছাড়া, কাটা তার জোড়া দিলেই তো ফোন আবার চালু হয়ে যায়। ধরে নিচ্ছি, তাতেও কিছুটা সময় লাগছে। কিন্তু…..নাঃ, আপনার ব্যাখ্যাটা মানা গেল না।

 জয়ন্তী একটু চুপ করে থেকে বলল–অশরীরী আত্মাদের ব্যাপারে বুঝতে পারে একমাত্র তারাই, যাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। কে বলতে পারে, সরযূ যাকে তার কাটতে দেখেছিল তিনি সতিসত্যি মিসেস মালহোত্রা নন–তাঁর চেহারা ধরেছিল কোন প্রেতশক্তি!

এই সময় লছমন নামে মিসেস মালহোত্রার লোকটা এল। সেলাম করে সবিনয়ে বলল–কর্নেল সাহাব আপনাদের সেলাম দিয়েছেন।

আমরা দুজনে তক্ষুণি এগিয়ে গেলুম। ডাইনিং হলে ঢুকে দেখি, রঘুবীর জয়সোয়াল, অধ্যাপক দ্বিবেদী আর ডঃ পট্টনায়ক কখন এসে পড়েছেন। শ্ৰীমতী, মালহোত্রা ব্যস্তভাবে এদিক-ওদিক করছেন। কর্নেল আমাদের দেখে ঈষৎ হেসে চাপাস্বরে বললেন–এই যে জয়জয়ন্তী!

আড়চোখে দেখলুম, কর্নেলের বেমক্কা রসিকতায় জয়ন্তীর মুখটা লাল হয়ে গেল। বললুমকর্নেল আবার প্ল্যানচেটের আসর নাকি?

কর্নেল তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেলেন–আপাতত চায়ের আসর। তোমরা বসে পড়ো।

একটু পরেই চা এসে গেল। চা খেতে খেতে কর্নেল তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–লেডিজ অ্যান্ড জেনটেমেন! গত রাত্রে মিঃ খান্না যথারীতি প্রত্যেকের কাছে একটা করে বিবৃতি নিয়েছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো অনেক নতুন তথ্য আমরা জেনেছি, যেগুলো সমস্যার সৃষ্টি করেছে। অতএব আবার আপনাদের বিরক্ত করতে আমরা বাধ্য হবো।

অধ্যাপক দ্বিবেদী বলে উঠলেন–অবশ্য, অবশ্য। এই অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের একটা ফয়সালা করার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই কষ্ট স্বীকার করা উচিত।

জয়সোয়াল মাথা নেড়ে বললেন–আই এগ্রি।

কর্নেল বললেন–আপনাদের স্মরণশক্তিকে সাহায্য করা হবে ভেবে আমরা হত্যাকাণ্ডের জায়গাতেই একে একে ডাকব এবং কিছু প্রশ্ন করব।

অধ্যাপক খুশি হয়ে বললেন–ভেরি ওয়েল! তারপর নিশ্চয় আমরা এই নজরবন্দি দশা থেকে মুক্তি পাব!

কথাটা বলার পর উনি জোরে হাসলেন এবং তা নিশ্চয় শুকনো হাসি। ওঁকে সমর্থন করে জয়সোয়াল বললেন–যত খুশি প্রশ্ন করুন, আপত্তি নেই। এবং আমাকে সন্দেহভাজন মনে না হলে আশা করি আমি যেন আগামীকাল নৈনিতাল পৌঁছে যেতে পারি! সেখানে আমার জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে একটা।

মিঃ খান্না বললেন কার্যত আপনারা স্যার আমাদের হাতে না হলেও প্রকৃতির হাতে এখন বন্দী। বেরোবার কোন রাস্তা নেই।

ব্রিজেশ সিং হেসে বললেন–দ্বীপান্তরিত বলা যায়! কারণ বাণেশ্বরের সঙ্গে এখন বাইরের সব সংযোগ আপাতত কয়েকদিনের জন্যে বিচ্ছিন্ন।

অধ্যাপক, জয়সোয়াল, জয়ন্তী আর আমি একসঙ্গে নড়ে উঠলুম। জয়ন্তী কঁদোকাঁদো স্বরে বলল–তাহলে শ্যামলীর খবর এখনও কদিন পাঠানো যাবে না? কর্নেল যে বললেন, আপনাদের রেডিও সিসটেম আছে…

খান্না বললেন না কোন উপায় নেই। দুঃখের বিষয়, আমাদের যে বেতার। ব্যবস্থা আছে, গত রাত থেকে তাও হঠাৎ বিগড়ে বসেছে। অনেক চেষ্টা করা হল মেরামতের। কিন্তু সব এখন অবধি ব্যর্থ। বাণেশ্বর সামরিক ছাউনি থেকে যে কোন সাহায্য পাব, তারও উপায় নেই। পথ ধসে অতল খাদ সৃষ্টি হয়েছে ওদিকে। এক উপায় হচ্ছে হেলিকপ্টার। কিন্তু তাও আছে সামরিক ছাউনিতে।

জয়সোয়াল বললেন–কেন? সারদা নদী পেরিয়ে নেপালে ঢুকতে পারলে তো ঘুরপথে পৌঁছানো যায়–কোঠাইকুণ্ড হয়ে ঝরকাহাট।

 খান্না হাসলেন। –দেখে আসতে পারেন সারদা নদীর অবস্থা। প্রচণ্ড বন্যা বইছে। তাছাড়া বাণেশ্বরের পূর্ব সীমায় পাহাড় যা ধসেছে, নদী অবধি পৌঁছনোও অসম্ভব। তাও ধরে নিচ্ছি, কোনরকমে নদী পেরোলেন কিন্তু নেপালের ওই বর্ডারটা খাড়া পাহাড়। আস্ত পাথরের দেয়াল উঠেছে তিনচারশো ফুট উঁচু। কীভাবে ঢুকবেন নেপালে?

শ্রীমতী মালহোত্রাকে এতক্ষণ মুখ টিপে হাসতে দেখছিলুম। এবার হাত তুলে বললেন–এক মিনিট। মিঃ খান্না আর কর্নেল সরকারকে প্রশ্ন করছি, এতসব ঘটনা একই সঙ্গে ঘটার মধ্যে কি আপনারা এখনও নিছক আকস্মিকতা আছে বলতে চান?

কর্নেল তাকিয়ে থাকলেন মাত্র। খান্না বললেন–পুলিশশাস্ত্র সম্পূর্ণ নাস্তিকের শাস্ত্র মিসেস মালহোত্রা। এ শাস্ত্র অনুসারে কার্যের পিছনে কারণ থাকবেই।

–তাহলে বলুন, একই সময়ে বেতারযন্ত্র বিগড়ে গেল কেন? যদি বা বিগড়ে গেল, সারানো সম্ভব হল না কেন?

–দেখুন ম্যাডাম, প্রকৃত ব্যাপারটা বর্ণনা করতে হলে আমাকে এখন সরকারের সমালোচনা করতে হয়। যে কোম্পানি ওই যন্ত্র সরবরাহ করেছিল, বাজারে তার প্রচুর বদনাম আছে। কিন্তু বেছে বেছে তাকেই নেওয়া হল, এর কারণ দুর্নীতি ছাড়া কী? বেতারযন্ত্রটা বছরে সাত মাসই বিগড়ে বসে থাকে যখন তখন। কাল রাতে হঠাৎ আবার বিগড়ানোর কারণ সম্ভবত ঘন ঘন বজ্রপাত।

শ্রীমতী মালহোত্রা মাথা দুলিয়ে বললেন–তবু আপনারা ভাঙবেন তো। মচকাবেন না! চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেই বা কী! অলৌকিক শক্তি যে এখনও মানুষের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে, মানুষ অত জেনেও তা মানতে চায় না!

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–আমাদের দেরি করা উচিত নয়। মিঃ খান্না, তাহলে চলুন আমরা মিসেস মালহোত্রার স্টাডিতে যাই। মিঃ খান্না, আপনার স্টেনো ভদ্রলোক কি এসে গেছেন?

ব্রিজেশ সিং উঠে গিয়ে দরজার বাইরে কাকে ডাকলেন–জয়গোপাল! রাজেন্দ্রজীকে পাঠিয়ে দাও।

একটু পরে স্টেনোগ্রাফার ভদ্রলোক এলেন। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সের সুন্দর এক যুবক। মুখে মিষ্টি হাসি। আমার খুব ভাল লাগল ভদ্রলোককে। হয়তো বাঘা-বাঘা বুড়োদের মধ্যে এতক্ষণে একজন তাজা যুবক দেখতে পেলুম তাই।

স্টাডিতে ঢুকে গেলেন কর্নেল, খান্না আর সেই রাজেন্দ্র। দুমিনিট এ ঘরটা স্তব্ধ হয়ে থাকল। তারপর ও ঘরের দরজা খুলে খান্না মুখ বের করে ডাকলেন-মিঃ জয়সোয়াল, প্লিজ!!

জয়সোয়ল সায়েব রাশভারী মূর্তি নিয়ে উঠে গেলেন। আমি সিগারেট ধরালুম। তারপর দেখি, জয়ন্তী উঠে গেল শ্রীমতী মালহোত্রার কাছে। উনি বসেছিলেন কোণের দিকে একটা চেয়ারে–সামান্য দূরে। জয়ন্তীকে উনি সস্নেহে জড়িয়ে ধরে জানলার কাছে গেলেন। তারপর দুজনের মধ্যে অস্ফুটস্বরে কথাবার্তা চলতে থাকল। মনে মনে হাসলুম। শ্ৰীমতীর চেলা হবার উপযুক্ত মেয়ে জয়ন্তী। নির্ঘাত এখন প্রেতশক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে দুজনের মধ্যে। বিশেষ করে পুলিসের বেতারযন্ত্র বিগড়ানো ওঁদের তপ্ত কড়াইয়ে আরেকটি বিস্ফোরণ সৃষ্টি করেছে নিঃসন্দেহে।

অধ্যাপক দ্বিবেদী মনমরা হয়ে বসে ছিলেন। আমি ওর পাশে উঠে গেলুম। উনি খুশি হয়ে বললেন–আসুন, আসুন মিঃ চাউড্রি। দেখুন তো, এসব কী গড়বড় কাণ্ড হল! আগামী পরশু দিল্লীতে আমার এক বড় অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবার কথা আছে। ভেবেছিলুম, রওনা দেব! অথচ আটকে গেলুম। কবে যে রাস্তা খুলবে, তাও তো বলতে পারছে না কেউ।

লোকটিকে গত সন্ধ্যা থেকেই খুব নিরীহ মনে হয়েছিল। উনি যে আমাদের গ্রিন ভিউ হোটেলেই নীচের স্যুইটে উঠেছেন, কর্নেলের কাছে শুনেছিলুম। বললুম–আপনি নিশ্চয় আমাদের আসার আগেই এসেছেন এখানে?

–আমি এসেছি তেসরা জুন। প্রতিবছরই ছুটির দু-একটা সপ্তাহ এখানেই কাটিয়ে যাই। এবার অবশ্য নানা প্রোগ্রামে দিন পাঁচেকের বেশি থাকা যেত না। তার মানে, আজ আটই জুন–আজই রওনা হতুম। তাছাড়া…….একটু হাসলেন অধ্যাপক। তাছাড়া এবার হোটেলের চার্জও প্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে। অত বেশি টাকা কোথায়, বলুন?

–মিসেস মালহোত্রার সঙ্গে আলাপ কি এখানেই হয়েছে?

–আবার কোথায় হবে? ……অধ্যাপক একটু বিরক্ত হয়েই বললেন–গ্রিন ভিউতে গিয়ে প্রতি সিজনে ভদ্রমহিলা যেচে পড়ে সবার সঙ্গে আলাপ করে আসেন। বড্ড খামখেয়ালী!

পরক্ষণে জিভ কাটলেন। শ্ৰীমতী মালহোত্রা শুনলেন না তো? জয়ন্তী দেবীকে নিয়ে উনি মেতে উঠেছেন। অধ্যাপক এবার গলার স্বর চাপা করলেন। –ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছে গত বছর জুনে। সেবারও এমনি প্ল্যানচেটের আসর বসিয়েছিল। তবে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আর আমিও অবশ্য সেই আসরে যোগ দিতে পারিনি। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলুম ওইদিন।

–মিঃ জয়সোয়ালও কি বরাবর আসেন এখানে?

না, এই প্রথম। বলছিলেন তো তাই-ই! কে জানে কেন, ভদ্রলোককে আমার কেমন রহস্যময় মনে হয়। আপনার হয় না?

-যা বলেছেন! কেমন যেন চাপা চালচলন।

–তার ওপর ওঁর মধ্যে একটা পুলিসি ঢঙের সবজান্তা ভাব আছে লক্ষ্য করেছেন? ওটা আমার দুচক্ষের বিষ। ও নাকি রিটায়ার্ড পুলিস সুপার। হুঁ!

আবার সায় দিলুম–একটুও বেঠিক বলেননি স্যার!

স্যার শুনে অধ্যাপক আরো নরম হয়ে বললেন–আপনি একজন মডার্ন ইয়ংম্যান। আপনি ঠিক বুঝবেন, এইসব পুলিসটুলিসের মানেটা কী? স্রেফ মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার অর্থাৎ জন্মগত স্বাধীনতার দাবিকে দমন করার জন্যেই তো রাষ্ট্র এদের পুষে রেখেছে। তাই না? ডঃ হেন্ডাটরলভ গেটাসকিনটিকভের থিওরির কথা নিশ্চয় জানেন। রাষ্ট্র মানেই ব্যক্তির হাতের হাতকড়া। হাতকড়া-তত্ত্বের তিন নম্বর অধ্যায়ে তিনি বলেছেন–

আমার মহাসৌভাগ্য, অধ্যাপকের হাত থেকে বাঁচাতে জয়সোয়াল বেরিয়ে এলেন তারপর মুণ্ডু বাড়িয়ে খান্না ডাকলেন–অধ্যাপক দ্বিবেদী প্লিজ!

অধ্যাপক মুহূর্তে স্পিঙের মতো গুটিয়ে সুড়সুড় করে চলে গেলেন। ওঁর মুখ দেখে মায়া জাগছিল। জয়সোয়াল এসে আমার পাশে গম্ভীর মুখে বসে পড়লেন। বললুম–আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল, স্যার!

জয়সোয়াল পকেট থেকে পাইপ বের করে বললেন–আপনার আবার কী ঝামেলা চাউড্রি? ইয়ংম্যান–তার ওপর ধুরন্ধর প্রাইভেট গোয়েন্দার সঙ্গী মজাটা উপভোগ করে যান না চুপচাপ।

ওঁর কথার ভঙ্গিতে মনে মনে খাপ্পা হলুম। তবে সেই ভাবটা লুকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললুম–যা বলেছেন। তবে মুশকিল কী জানেন, গোয়েন্দার পাল্লায় পড়ে আবার প্রাণে মারা না যাই এবার!

জয়সোয়াল ভুরু কুঁচকে বললেন–তেমন কি কোন লক্ষণ দেখছেন?

–লক্ষণ কি আপনিও দেখতে পাচ্ছেন না?

না তো!

–হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যেকেই কি ক্রমশ বেশি করে জড়িয়ে পড়ছি না?

–কী বলতে চান আপনি?

ওরে বাবা! এ যে ভারি কড়া ধাতের লোক। হবে নাই বা কেন? জাঁদরেল পুলিস সুপার ছিল একসময়। আমতা আমতা করে বললুমকতদিন আটক পড়ে থাকব আমরা, কোন ঠিক নেই। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি, যতদিন থাকব–তত বেশি করে আমাদের প্রত্যেককে জেরা করা হবে। প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রশ্ন গজাবে ওঁদের মাথায়, আর এমনি করে ডাকা হবে। জবাব দিতে হবে। হরিব!

কথাটা বুঝলেন যেন জয়সোয়াল। পাইপের তামাকে আগুন জ্বেলে বললেন ঠিক, তা ঠিক। আই এগ্রি।

–আপনি তো স্যার জয়পুরে থাকেন?

–হ্যাঁ। কেন?

–জয়পুরের আবহাওয়া এখন কীরকম বলুন তো?

 –প্রচণ্ড গরম। বাঙালিবাবুরা কল্পনাও করতে পারবেন না।

–তাহলে তো স্যার, আপনার এখানে পুরো গ্রীষ্মকালটা কাটিয়ে যেতে আপত্তি থাকার কথা নয়। রাস্তায় ধস ছাড়লেই কী!

–হোটেল ভাড়াটা দেবে কে? আপনার কর্নেল সায়েব দিতে রাজি থাকলে তো ভালই।

বুঝলুম, লোকটার সঙ্গে জমবে না। এ বড় বদমেজাজী গোঁয়ার প্রকৃতির লোক। তাই চুপচাপ বসে থাকলুম। একটু পরে জয়সোয়ল নিজের মনে বলে উঠলেন–হুঁ! গোয়েন্দাগিরি ফলানো হচ্ছে আমার ওপর! কেন যে এসব প্রাইভেট হ্যান্ডকে খান্না পাত্তা দেয়, বুঝি না! আমি বলব কর্তৃপক্ষকে। নিশ্চয় বলব, দেখবেন!

সবিনয়ে বললুম-আমাকে কি কিছু বলছেন স্যার?

জয়সোয়াল এতক্ষণে ফেটে পড়লেন। বলছি! আপনার ওই নির্বোধ সঙ্গীটিকে বলবেন বলেই বলছি। বলবেন, ডিটেকশান অত সহজ নয়। আরে! ভিকটিম মেয়েটির পাশের চেয়ারে ছিলুম বলেই আমি ওকে অন্ধকারে দিব্যাস্ত্র। প্রয়োগ করে মেরে ফেললুম? বলে কী নির্বোধের মতো! চেনা নেই, জানা নেই–কোথায় কলকাতার এক বাঙালি! সামান্য এক লেড়কি! আর আমি হলুম রাজস্থানের রিটায়ার্ড পুলিস সুপার মিঃ রঘুবীর জয়সোয়াল–যার দাপটে একসময় পাগলা হাতিরও মগজের অসুখ সেরে যেত! খান্নাটা ওর পাল্লায় পড়ে নির্ঘাত মরবে।

বলেই জয়সোয়াল সায়েব উঠলেন। গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় ব্রিজেশ সিং ওঁর পাশে পাশে এগিয়ে বলে এলেন–হোটেল ছেড়ে কোথাও গেলে আমাদের লোককে বলে যাবেন, স্যার। জাস্ট এ রুটিন ইন্সট্রাকশান। জয়সোয়াল আচ্ছা বলে জোর ধমক দিয়ে পর্দা তুলে অদৃশ্য হলেন। লন থেকে ওঁর জুতোর শব্দ ভেরে আসতে থাকল।

ব্রিজেশ সিং চাপা হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন-মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল কেন জয়সোয়ালজির? নিশ্চয় কর্নেল সায়েব কোথাও জোর ঘা দিয়েছেন বুঝলেন মিঃ, চাউড্রি?

বললুম–তাই তো মনে হচ্ছে। আচ্ছা মিঃ সিং, ওঁকে কি এই প্রথম দেখলেন আপনি? নাকি আগে পরিচয় ছিল?

–এই প্রথম। তবে পুলিস বিভাগে ওঁর প্রচণ্ড নাম আছে শুনেছি।

–উনি আমাদের হোটেলেই উঠেছেন, জানতুম না। তাহলে তো আগেই আলাপ করে ফেলতুম।

খবর্দার, খবর্দার! বড় বদরাগী মানুষ। কক্ষনো ঘাঁটাতে যাবেন না কিন্তু।

ব্রিজেশ সিং একটু দাঁড়িয়ে থেকে লনের দিকে বেরোলেন। তারপর। অধ্যাপককে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। উনি মেজাজ খারাপ করে বেরোচ্ছেন না, তা ওঁর মুখের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। খান্না যথারীতি ডাকলেন– মিসেস মালহোত্রা প্লিজ!

অধ্যাপক আপনমনে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন পর্দা তুলে। আমাদের দিকে ঘুরেও তাকালেন না। শ্ৰীমতী মালহোত্রা স্টাডিতে গিয়ে ঢুকলে জয়ন্তী আমার কাছে এসে বসল। বললুম-খুব প্রেতচর্চা করা হচ্ছিল যেন?

 জয়ন্তী একটু হাসল–হ্যাঁ। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি যে আপনাকেও এখানে বসে ডাকের অপেক্ষা করতে হচ্ছে কেন? ভেবেছিলুম কর্নেলের অন্তরঙ্গ সঙ্গী আপনি, নিশ্চয় ওঁদের টেবিলে থাকবেন ওঁদের সঙ্গে।

–অবাক আমি একটুও হইনি, তা বলব না। তবে আমার বৃদ্ধ বন্ধুটির অনেক কাজই রহস্যময়।

তার মানে আপনাকেও নিশ্চয় সন্দেহের আওতায় রাখা হয়েছে?

–সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

—তাহলে আমাকেও তাই রাখা হয়েছে?

বললুম তো, সেটাই নিয়ম এসব ক্ষেত্রে।

–কিন্তু শ্যামলীকে আমি…বলেই ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন প্রচণ্ড অভিমানে থেমে গেল জয়ন্তী।

ডাকলুম–জয়ন্তী!

বলুন।

মিসেস মালহোত্রার সঙ্গে কথা বলতে আপনার ভয় হচ্ছিল না তো?

–কেন? কিসের ভয়?…বলেই জয়ন্তী যেন সামলে নিল। পরক্ষণে একটু হেসে ফের বলল–আপনারা তো কাছাকাছি ছিলেন! আসলে কী জানেন, ভদ্রমহিলা খুব অমায়িক সাদাসিধে মানুষ। শুধু একটুআধটু পাগলামিই যা করেন মাঝেমধ্যে। কথা বলে আরো বুঝলুম, উনি অনেকসময় অবসেসনের ঘোরে অনেক কিছু করেন, পরে জ্ঞান হলে খুব পস্তান।

–অবসেসনের রুগী? বলেন কী!

–হ্যাঁ। আমি তো সোজা ফোন আর ঘড়ির তার কাটার কথা জিগ্যেস করে বসলুম। তখন উনি…

বাধা দিয়ে বললুম–সর্বনাশ! আপনি ওঁকে বলে দিলেন?

ক্ষতি কী? জয়ন্তী বেপরোয়া হয়ে জবাব দিল। তা উনি কী বললেন জানেন? হ্যাঁ–আমার হাত দিয়েই পরলোকের বাসিন্দারা এ কাজটি করিয়েছে। তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল আমি জানি না। যাই হোক, পরে যখন সব মনে পড়ল, তখন বেশ ভয় পেয়ে গেলুম। তবে এবার নিজের মুখেই স্বীকার করব। আমি বললুম, হ্যাঁ, তাই করুন। তখন উনি বললেন–শুধু এটাই নয়, এমন অনেক কাজ উনি সময়-সময় করে ফেলেন, যার কোন মাথামুণ্ডু নেই। একবার নাকি বাগানে রাত্তিরবেলা নিজের শাড়ি পুঁতে রেখে এসছিলেন। সরযূ সেটা পরে আবিষ্কার করে। সরযূও এ কথাটা আমাকে বলেছিল। তখন আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলুম।

–অবসেসনের রুগীরা এ কাজ করে বটে।

তাহলে জয়ন্তবাবু, অবসেসনে থাকা অবস্থায় উনি কাকেও মেরে ফেলতেও তো পারেন?

–খুব পারেন। কর্নেল একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। তাতে এক অবসেসনের রুগী নিজের স্ত্রীর গলা টিপে খুন করেছিল। পরে তার আর কিছু মনে ছিল না।

জয়ন্তী আঁতকে উঠল। –সর্বনাশ! তাহলে তো এ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ।

হেসে বললুম–আপনি তো পাহাড়ে-চড়া খেলোয়াড় মেয়ে! আপনার গায়ের জোরে বৃদ্ধা পারবেন না–নিশ্চিন্ত থাকুন।

এইসময় শ্রীমতী মালহোত্রা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন। এত শিগগির! খান্না ডাকলেন-জয়ন্তবাবু আসুন!

কর্নেলের সঙ্গে অনেকবার অনেক হত্যাকাণ্ডের তদন্তে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু কখনও আমাকে বাইরের লোকের মতো প্রশ্ন করা হয়নি–কিংবা বাইরে বসে থাকতেও হয়নি। এবার এমন কাণ্ডের অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলুম না। একটু অভিমানও হয়েছিল। তবু সেটুকু চেপে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে স্টাডিতে ঢুকলুম।

খান্না বললেন বসুন। আপনার নাম ঠিকানা পেশা ইত্যাদি বলুন।

বললুম। স্টেনো ভদ্রলোক লিখে নিলেন। টেবিলের অন্য পাশে কর্নেল গম্ভীরমুখে বসে রয়েছেন। আমার দিকে তিনি তাকাচ্ছেন না।

খান্না বললেন, আপনাকে শুধু একটিমাত্র প্রশ্ন করব, জয়ন্তবাবু।

–বেশ তো। করুন না।

–গতরাত্রের ভূতের আসরে যখন আলো একেবারে নিভিয়ে দেওয়া হয়, তারপর থেকে আবার আলো জ্বলে ওঠার মধ্যে অর্থাৎ যতক্ষণ ঘরটা অন্ধকার ছিল, আপনি কি আপনার চেয়ার ছেড়ে একমুহূর্তের জন্যেও উঠেছিলেন?

এ তো বড় অদ্ভুত প্রশ্ন! আমি ঘাবড়ে গেলুম। খান্না আমার তাকানো দেখে কিছু টের পেয়ে আবার বললেন–দয়া করে জবাব দিন।

দৃঢ়কণ্ঠে বললুম–না।

এবার কর্নেল বললেন–জয়ন্ত! সত্যি কথাটা বলো!

 বললুম–আমার উঠতে ইচ্ছে করছিল। কারণ শ্যামলীর কণ্ঠস্বরে আমার সন্দেহ জেগেছিল।

–কিন্তু তুমি ওঠনি?

না।

–কেন?

–এখন বলা কঠিন। হয়তো ভেবেছিলুম, যদি সত্যি ভূতপ্রেত হয়, আমার ক্ষতি করতে পারে কিংবা উঠতে গেলে চেয়ারে শব্দ হবে, কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগতেও পারে!

–তাহলে শ্যামলীর গলার স্বর শুনে তোমার সন্দেহ হয়েছিল?

–হ্যাঁ, মনে হচ্ছিল, অন্য কেউ কথা বলছে।

কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। তারপর খান্নার দিকে তাকালেন। খান্না বললেন একটা মূল্যবান সূত্র দেওয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ জয়ন্তবাবু। ঠিক আছে, চলুন–আপনাকে পৌঁছে দিই!

বেরিয়ে দেখি পাশাপাশি বসে জয়ন্তী আর মিসেস মালহোত্রা গল্প করছেন। খান্না জয়ন্তীকে ডাকলেন। জয়ন্তী ভীতু মুখে চলে গেল।

আমি শ্ৰীমতী মালহোত্রার পাশে গিয়ে বসলুম। উনি সস্নেহে বললেন– আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপই হয়নি। বসুন, বসুন! মা ও ছেলের কিছুক্ষণ আলোচনা করা যাক। বাণেশ্বরে বুঝি এই প্রথম আসা হল?

-হ্যাঁ, প্রথমই। কিন্তু এসেই পড়ে গেলুম ঝামেলায়!

না, না! সব ঝামেলা মিটে যাবে। কিছু ভাববেন না! কেউ তো টের পাচ্ছে না আসল ব্যাপারটা কী! পেলেও মানতে চায় না। দেখবেন, এর ফলে কী হয়! এই তো সবে শুরু। কমিউনিকেশন বন্ধ, বেতার বিগড়েছে, মানুষ মরল–এরপর আরো সাংঘাতিক ব্যাপার হবে। আমি দিব্যচক্ষে সব দেখতে পাচ্ছি! সব-সব…..।

বলতে বলতে হঠাৎ তিনি করলেন কী, নিজের শাড়ির আঁচলটা ফরফর করে ফেড়ে ফেললেন। বাধা দেবার ফুরসতই পেলুম না। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলুম। অস্বাভাবিক দৃষ্টি। ঠোঁট কাঁপছে। তারপর উনি ছাইদানি আর টেবিলটা উল্টে দিলেন। আমি বাধা দিতে গিয়েই টের পেলুম, হাত দুটো একেবারে ইস্পাতের তৈরি! এক ধাক্কায় ছিটকে পড়লুম মেঝেয়। জোর চোট লাগল।

শ্ৰীমতী মালহোত্রা এবার কোনার দিকে শান্তভাবে এগোচ্ছেন। মেঝে থেকে উঠেই চেঁচিয়ে ডাকলুম-মিঃ সিং! সরযূ! লছমন!

ব্রিজেশ সিং বাইরে থেকে দৌড়ে এলেন। লছমন আর সরযূও এসে গেল। শ্ৰীমতী মালহোত্রা তখন কোণের একটা সুন্দর পুতুল তুলে আছাড় দিতে যাচ্ছেন। ব্রিজেশ সিং ধরে ফেললেন। কিন্তু ওর গায়ে অসুরের শক্তি। ব্রিজেশও পড়ে গেলেন মেঝেয়। তিনি তখন বিড়বিড় করে কী বলছেন। পুতুলটা হাতে ধরা। এবার সরযূ দৌড়ে ভিতরে কোথাও গেল। তারপর একটা তাতানো লাল লোহা এনে সামনে ধরে চেঁচিয়ে বলল–মাইজি! হোঁশমে আইয়ে! অমনি বৃদ্ধা চোখ বের করে পড়ে গেলেন। এবার আমরা জানতে পারলুম, ভদ্রমহিলার সম্ভবত উকট হিস্টিরিয়া রোগ আছে এবং বরাবর তার প্রকোপ সামলাতে সরযূদের প্রাণান্ত হয়। লছমন, ব্রিজেশ সিং আর আমাকে সেইসব কথা ইনিয়ে বিনিয়ে শোনাতে শুরু করল। সরযূ তখন মাইজিকে সামলাচ্ছে।

লছমন বলল–দো সাল আগে মালহোত্রাজি অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকেই মাইজির এই আজব রোগ হয়েছে। দাওয়াইপানি করার কথা বললে মাইজি তেড়ে মারতে আসবেন। লেকিন, আসলি বাত হচ্ছে–মাইজির পেটের মধ্যে কীভাবে বাণেশ্বরের ভূতটা ঢুকে গেছে।…