৪. লোকে মন্টুরামের টাকাপয়সা দ্যাখে

লোকে মন্টুরামের টাকাপয়সা দ্যাখে, জমিজিরেত দ্যাখে, মন্টুরামের গাড়ি বাড়ি দ্যাখে। দ্যাখে আর হিংসে করে, আর হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়। তারা পাঁচজনের কাছে মন্টুরামের কুচ্ছো গেয়ে বেড়ায়। মন্টুরামের কোনও বিপদআপদ ঘটলে, মন্টুরাম কোনও ফ্যাসাদে পড়লে লোকে ভারী খুশি হয়। এ সবই মন্টুরাম হাড়ে হাড়ে জানেন। কিন্তু লোকে মন্টুরামের দুঃখ বুঝতে চায় না। মন্টুরাম যে কত দুঃখী, তাঁর ধন-দৌলতের তলা দিয়ে দুঃখের ফয়ু নদী বয়ে যাচ্ছে, এ তো আর লোকের চোখে পড়ে না। বুকের দুঃখ বুকে চেপে রেখেই মন্টুরাম নীরবে বিষয়কৰ্ম করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে এক-আধটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বটে, কিন্তু কর্তব্যকর্মে তিনি সর্বদাই অটল।

পুরনো দুঃখগুলোর সঙ্গে মন্টুরামের একরকম ভাবসাব হয়েই গিয়েছে। দুঃখ নিয়েই যখন থাকতে হবে, দুঃখের সঙ্গেই যখন বসবাস, তখন তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে আর লাভ কী? দুঃখ বলতে তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছে চৈতন্যপুরের পুরনো রাজবাড়িটা কিনে সেখানে একটা প্রাসাদ বানানো। রাজবাড়িতে থাকার কেতাই আলাদা। তা সেটা হয়ে উঠছে না। কারণ, বুড়ো রাজা হরিশ্চন্দ্র এখনও বেঁচেবর্তে আছেন। আর-একটা দুঃখ হচ্ছে তাঁর বউ হরিমতী। হরিমতীর বড় দানধ্যানের হাত। ভিখিরি আসুক, সাধুসন্নিসি আসুক, চাঁদা পার্টি আসুক, হরিমতী কাউকে ফেরান না। এমনকী, প্রায় প্রতিদিনই দু-চারজন গরিব দুঃখীকে পাত পেড়ে বসে খাওয়ান। অনেক চেষ্টা করেও এই অপচয় ঠেকাতে পারছেন না মন্টুরাম। তাঁর তিন নম্বর দুঃখ হল, ইংরেজি। কিছুদিন আগে গাঁয়ের পুরনো মন্দিরের ফোটো তুলতে একজন রাঙামুলো টকটকে সাহেব এসে হাজির। কিন্তু কেউই তার কথা বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে থাকে। তখন চৈতন্যপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হেডস্যার অখিলবাবু এগিয়ে গিয়ে সাহেবের সঙ্গে ফটাফট ইংরেজি বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ওইরকম ইংরেজি বলতে না পারার দুঃখে ভারী কাতর হয়ে রয়েছেন মন্টুরাম। তা ইংরেজি শেখার জন্য অখিলবাবুকে মাইনে দিয়ে বহালও করা আছে। কিন্তু বিষয়কর্মে কোনও ফাঁক নেই বলে ফুরসতই হয়ে উঠল না আজ পর্যন্ত মন্টুরামের। এসব ছাড়াও হিসেব করতে বসলে দুঃখের ঝুড়ি ভরে যাবে।

কিন্তু ইদানীং যে নতুন দুঃখটা এসে হাজির হয়েছে, সেটা হল দু’ নম্বর মন্টুরাম। আর এই দু’নম্বর মন্টুরামের সঙ্গে মন্টুরামের একেবারেই বনিবনা হচ্ছে না। উড়ে এসে জুড়ে বসা এই দু’নম্বর মন্টুরাম যখন-তখন, যেখানে-সেখানে ফস করে উদয় হয়ে মন্টুরামকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছেন।

এই তো সেদিন তিনশো টাকা কিলো দরে সরেস ইলিশ মাছ এনেছিলেন মন্টুরাম। রান্নাটাও হয়েছিল ভাল। সবে ইলিশের বাটি কাছে টেনেছেন, এমন সময় দু’নম্বর মন্টুরাম আড়াল থেকে বলে উঠলেন, “মন্টুরাম, ইলিশ মাছ খাচ্ছ নাকি?”

মন্টুরাম হুংকার দিয়ে বললেন, “খাচ্ছিই তো! কার বাবার কী?”

“সে তো বটেই। একটু আগে নোনাপাড়ায় দেখে এলাম ষষ্ঠীর বিধবা মা পান্তাভাত নিয়ে বসেছে, সঙ্গে নুন ছাড়া কিছু নেই। শিকেয় ঝোলানো মেটে হাঁড়িতে এক ছড়া তেঁতুল খুঁজছিল। না পেয়ে কপাল চাপড়ে নুন দিয়েই সাঁটছে। অবশ্য তাতে তোমার কীই বা এল-গেল মন্টুরাম। তুমি খাও।”

খেলেন মন্টুরাম। তবে ইলিশ মাছটা গঙ্গামাটির মতো লাগছিল।

এই তো সেদিন নগেন বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে বিষয়সম্পত্তি ঘটিত মামলায় হাইকোর্টের রায় বেরোল। মন্টুরাম জিতে গিয়েছেন। এখন নগেন বাঁড়ুজ্যের বসতবাটিসহ গোটা সম্পত্তিই মন্টুরামের দখলে। আনন্দের চোটে মন্টুরাম নন্দকিশোরের দোকান থেকে তার বিখ্যাত ক্ষীরকদম এক হাঁড়ি কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ কোথা থেকে দু’নম্বর মন্টুরাম গাড়ির পিছনের সিটে যেন ঠিক তার পাশেই বসে খুব করুণ গলায় বললেন, “মন্টুরাম, মনে পড়ে?”

মন্টুরাম খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “কী মনে পড়বে?”

“সেই যে যখন ছোটটি ছিলে, তখন প্রতি বেস্পতিবার গিয়ে প্রসাদের লোভে নগেনদের বাড়িতে গুটিগুটি হাজির হতে! আর নগেনের মা কলাপাতায় নাড়ু, মোয়া, বাতাসা আর ফলের টুকরো দিতেন হে! মনে নেই?”।

মন্টুরাম ধমক দিয়ে বললেন, “তাতে কী হল? মাথা বিকিয়ে গিয়েছে নাকি?”

“মন্টুরাম, বলছিলাম কী, মামলায় হেরে সর্বস্ব খুইয়ে আজ রাতে যদি নগেন বাঁড়ুজ্যে গলায় দড়ি দেয়, তা হলে ওই ক্ষীরকদম তোমার গলা দিয়ে নামবে তো? ভাল করে ভেবে দ্যাখো বাপু। ক্ষীরকদম ভাল জিনিস বটে, কিন্তু ভাল জিনিস তখনই ভাল, যখন তার আগু-পিছুটাও ভাল হয়।”

মন্টুরাম হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “তা হলে কী করতে হবে?”

“অন্তত বসতবাড়িটা ছেড়ে দাও। নগেনের দাঁড়ানোর জায়গা নেই।”

মন্টুরাম তেড়ে উঠে বললেন, “আর আমার অত টাকা!”

দু’নম্বর মন্টুরাম বললেন, “লোকে যে বলে তোমার টাকশাল আছে, সে তো আর এমনি নয়। নগেনের তো চেঁকিশালটাও নেই।”

মন্টুরাম মাথা নাড়া দিয়ে বললেন, “না হে দু’নম্বর মন্টুরাম, এভাবে বিষয়কৰ্ম চলে না। এরকম চলতে থাকলে যে আমি পথে বসব।”

কিন্তু দু’নম্বর মন্টুরাম একা নয়। তার সঙ্গে হরিমতীরও যোগসাজশ আছে। রাত্রিবেলা হরিমতীও কাঁদতে বসলেন। বললেন, “ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করি, তাদেরও তো ভালমন্দ আছে। বামুন মানুষকে ভিটেছাড়া করলে কি আমাদের ভাল হবে ভেবেছ! আমি অতশত জানি না বাপু, তুমি ওদের ভিটেমাটি ফিরিয়ে দাও।”

রাগে ফুসতে ফুসতে দাঁতে দাঁত চেপে তাই করতে হল মন্টুরামকে। দু’নম্বর মন্টুরামকে সামনে পেলে যেন চিবিয়ে খান।

তা এইভাবেই মন্টুরামের সঙ্গে দু’নম্বর মন্টুরামের শত্রুতা বেড়েই চলেছে।

মন্টুরামের বড় ছেলে নন্দরামের বিয়ে ঠিক হল সেদিন। কনেপক্ষ এসেছিল দানসামগ্রী নিয়ে কথা কইতে। এক লাখ টাকা নগদ আর পঞ্চাশ ভরি সোনা। সঙ্গে টিভি, ফ্রিজ, একখানা মোটরবাইক ইত্যাদি। পাটিপত্র সইসাবুদ হতে যাচ্ছে, ঠিক এই সময় দু’নম্বর মন্টুরামের গলা শুনতে পেলেন মন্টুরাম। কানের কাছে ফিসফিস। দু’নম্বর বললেন, “সবই তো হল, কিন্তু একটাই মুশকিল হে মন্টুরাম।”

মন্টুরাম গম্ভীর হয়ে বললেন, “কীসের মুশকিল?”

“নতুন বউ এসে যখন তোমাকে পেন্নাম করবে, তখন কিন্তু মনে মনে সে তোমার কানও মলে দেবে। যতবার তোমার মুখের দিকে চাইবে, ততবার মনে মনে তোমার মুখে থুতু দিতে ইচ্ছে যাবে তার।”

“কান মলবে! থুথু দেবে! বলো কী?”

“শুধু কি তাই! যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ঘেন্না করবে তোমাকে।”

“অ্যাঁ!”

“ভেবে দ্যাখো মন্টুরাম। এক লাখ টাকা, পঞ্চাশ ভরি সোনা আদায় করে সুখ হবে তো? টাকায় মেলা জিনিস কেনা যায় বটে, কিন্তু ছেদ্দা-ভক্তি যে দোকানে বিকোয় না হে। বিকিকিনির বাজারে ও জিনিস পাবে না। ভেবে দ্যাখো।”

পারলে দু’নম্বর মন্টুরামের মুন্ডুটা ছিঁড়েই ফেলতেন মন্টুরাম। কিন্তু সে উপায় নেই। হাত নিশপিশ করে, দাঁত কড়মড় করে, কিন্তু মন্টুরামের দু’ নম্বর মন্টুরামকে ছোঁয়ারও উপায় নেই।

রাত দুটো। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। দূরে শেয়ালের ডাক। ঝিঁঝির শব্দ। মন্টুরাম নিঃশব্দে উঠে তিনতলায় তাঁর স্ট্রং রুমে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর বড় সিন্দুকটা খুলে জাদুকর মদন তপাদারের ছেঁড়াখোঁড়া সুটকেসটা বের করলেন। তারপর ডালাটা খুলে খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। রোজই করেন। একজন পেঁয়ো আর গরিব বাজিকরের যা যা থাকে, সে সবই রয়েছে। বাক্সটায়। এমন কোনও আহামরি বস্তু নেই, যার জন্য বাড়িতে চোর এলে হানা দেবে কিংবা ষণ্ডাগুন্ডারা হন্যে হয়ে উঠবে। মন্টুরাম অবশ্য ঘাবড়াননি। তাঁর লোকবল দারুণ। সুধীর গায়েন হানা দেওয়ার পর তিনি বাড়ি পাহারা দেওয়ার আরও মজবুত ব্যবস্থা করেছেন। নতুন পাইক রাখা হয়েছে। কানাই দারোগা দু’জন সেপাই মোতায়েন রেখেছেন। কিন্তু এত বন্দোবস্ত করা হল যে কারণে, সেই বাক্সের রহস্যই তো বুঝতে পারছেন না মন্টুরাম।

ঠিক এই সময় ঘাড়ে শ্বাস ফেলার মতো কাছ থেকে দু’নম্বর মন্টুরাম বলে উঠলেন, “আছে হে আছে। দেখার চোখ থাকলে ঠিকই দেখতে পেতে।”

মন্টুরাম ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “এতই যদি জানো, তবে বলে দিলেই তো হয়। তোমাকে দিয়ে তো আজ পর্যন্ত কোনও উপকার হল না। কাজে বাগড়া দিতে এসে হাজির হও।”

“বলি সব কিছু খুঁটিয়ে দেখেছ তো?”

“কিছুই বাকি রাখিনি হে। ম্যাজিকের সামগ্রী ছাড়া আর আছে একটা ধুকধুকি। তা সেটা আলাদিনের পিদিম কি না জানি না। নেড়ে-ঘেঁটে, ঘষে-মেজে দেখেছি বাপু, কোনও মহিমা প্রকাশ হয়নি। আর ওই উপরের পকেটে একটা ছোট ছেলের ফোটো আছে। পিছনে নাম লেখা হিরু। তা এই হিরুটা কে অবিশ্যি জানা নেই।”

“হুঁ। বিশ বছর আগেকার ফোটো। হিরুর চোখদুটো দেখেছ? খুব জ্বলজ্বলে কিন্তু। মনে হয় ভবিষ্যতে বেশ কঠিন মানুষ হবে।”

“ওরে বাপু, হিরুর খবরে আমাদের দরকার কী?”

“না, এই বলছিলাম আর কী। হিরু বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে।”

“তা হোক না। কাজের কথায় এসো তো বাপু। এই বাক্সে কি কোনও গুপ্ত পকেট বা ফাঁকফোকর আছে? তাতে কি গুপ্তধনের নিশানা পাওয়া যাবে?”

দু’নম্বর মন্টুরাম হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হেসে বলেন, “তুমি আর গুপ্তধন নিয়ে কী করবে বলো তো মন্টুরাম? তোমার যা আছে তাই তো সাতপুরুষে খেয়ে ফুরোতে পারবে না।”

মন্টুরাম ফুঁসে উঠে বললেন, “বাজে বোকো না তো! টাকা কি কারও বেশি হয় নাকি? আরও টাকা হলে আরও কত কী করা যায়।”

.

রাত আড়াইটে নাগাদ রাজা হরিশ্চন্দ্রের ঘুম ভেঙেছে। আর ঘুম ভাঙলেই যত উদ্ভুটে ঘটনা ঘটতে থাকে। এই তো সেদিন ঘুম ভেঙে দ্যাখেন, রসময় পণ্ডিতমশাই বসে আছেন। বললেন, “ওরে হরি, আজ তোকে সমাস চ্যাপটারের পড়া ধরব। বল তো ‘ভর্তৃহরি’ কী সমাস!” হরিশ্চন্দ্র মহা ফাঁপরে পড়ে আমতা আমতা করছিলেন। এমন সময় ঝড়ের মতো তাঁর তিন পিসি এসে হাজির। কানা পিসি বলল, “ও পণ্ডিত, ওরকম দুধের বাছাকে অমন শক্ত শক্ত প্রশ্ন করতে আছে? সোজা সোজা প্রশ্ন করো তো বাপু। আস্তে আস্তে শিখবে।”

রসময় ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “প্রশ্রয় দিয়ে দিয়েই তো আপনারা ছেলেপিলেগুলোকে নষ্ট করেন,” বলে ভারী রাগ করে উঠে গেলেন রসময়।

আর একদিন অম্বুরি তামাকের গন্ধে উঠে বসে হরিশ্চন্দ্র দ্যাখেন, তাঁর ঠাকুরদা মহিমচন্দ্র গদিআঁটা চেয়ারটায় বসে গড়গড়া টানছেন। হরিশ্চন্দ্র তাড়াতাড়ি কোমরের ব্যথা, হাঁটুর কটকটি উপেক্ষা করে প্রণাম করে দাঁড়াতেই মহিমচন্দ্র বজ্রনির্ঘোষে বললেন, “ওরে হরি, এসব কী দেখছি? হাতিশালে হাতি নেই, ঘোড়াশালে ঘোড়া নেই, গোশালা ফাঁকা। দাসদাসীগুলো সব উবে গেল নাকি? প্রাসাদের চুড়ো হেলে পড়েছে, পুকুরে ভরতি কচুরিপানা!”

হরিশ্চন্দ্র ভয়ে ভয়ে বললেন, “আজ্ঞে, খাজনাটা আদায় হলেই সব হয়ে যাবে।”

“আরও একটা কথা শুনছি। কোনও বেয়াদব নাকি তোর কাছে রাজবাড়ি কিনে নেবে বলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।”

“আজ্ঞে মহারাজ। মন্টুরাম সিংহ।”

“তার এত সাহস?”

“দশ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল।”

মহিমচন্দ্র চোখ কপালে তুলে বললেন, “দশ লাখ! সে তো অনেক টাকা!”

“আজ্ঞে না। সেই আমলের সঙ্গে তুলনা করলে এখনকার দশ লাখ তখনকার হাজার পাঁচ-ছয়ের বেশি হবে না।”

“পাইক-বরকন্দাজ পাঠিয়ে লোকটাকে বেঁধে এনে বিছুটি দিতে পারিস না?”

হরিশ্চন্দ্র ভালই জানেন মন্টুরামের অনেক টাকা, মেলা পাইক বরকন্দাজ। তাঁকে বেঁধে আনার সাধ্যি হরিশ্চন্দ্রের নেই। তাই মিনমিন করে বললেন, “আজ্ঞে, সে আর বেশি কথা কী! তবে কিনা পুকুরধারের বিছুটি গাছগুলো লোপাট হয়েছে। ইতুপুর থেকে বিছুটি আনিয়ে তবে…।”

“হ্যাঁ, বেশ করে আগাপাশতলা ঝেড়ে দিবি।” হরিশ্চন্দ্র জানেন যে, তিনি ভুলভাল দেখেন, ভুলভাল শোনেন, ভুলভাল বোঝেন এবং ভুলভাল বলেন। কিন্তু সবটাই ভুল কি না সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে। এই পরশু রাত্তিরে তিন পিসি এসে হাজির। কুঁজো পিসি বলল, “হ্যারে হরি, তোর জিব কি অসাড়? আর স্বাদসোয়াদ টের পাস না? রোজ যে দুধটুকু খাস, আমি আজ তার এক ফোঁটা জিবে ঠেকিয়ে দেখলুম, ও তো পিটুলিগোলা! গয়লাটাকে নাগরা জুতো দিয়ে ঘা কতক দিতে পারিস না?”

হরিশ্চন্দ্রের নাগরা জুতোই নেই। হাতের জোরই নেই। চুপ করে রইলেন।

তখন হঠাৎ কানা পিসি দুটো গিনি তাঁর বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “তোর অবস্থাটা ভাল যাচ্ছে না জানি। তা ওটা ভাঙিয়ে একটু ভাল-মন্দ খা তো বাছা।”

খোঁড়া পিসি বলল, “দেখিস বাবা, লোভে পড়ে আবার নাদু মালাকারের কাছে আমাদের বেচে-টেচে দিসনি যেন।”

হরিশ্চন্দ্র শশব্যস্তে বললেন, “না পিসিগণ, নাদুকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি।”

কুঁজো পিসি বলল, “তাড়িয়ে তো দিয়েছিস বাছা, কিন্তু সে তো প্রাসাদের এখানে-সেখানে এখনও হাঁড়ি নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।”

ব্যাপারটা যদি স্বপ্নই হবে, তা হলে সকালে ঘুম ভেঙে হরিশ্চন্দ্র সত্যি সত্যিই বিছানায় দুটো চকচকে গিনি পেতেন না। রাজবাড়ির পুরনো স্যাকরা নবকৃষ্ণ এসে কষ্টিপাথরে ঘষে বলল, “নাঃ, সোনাটা বড় ভাল। ওজনও কম নয়।”

গতকালই বেশ কয়েক হাজার টাকা পেয়ে হরিশ্চন্দ্রের মনটা আবার আশায়-আশায় আছে। পিসিমাগণ হয়তো সত্যি সত্যিই তাঁদের লুকনো সোনাদানা একটু একটু করে বের করবেন।

আজ রাতে ঘুম ভেঙে হরিশ্চন্দ্র দেখলেন, ট্রাপিজের সেই খেলোয়াড়টি আজ একটা ঝাড়বাতির উঁটিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মুখটা চিন্তিত।

হরিশ্চন্দ্র গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “বাপু হে, আজ যে একটু মনমরা দেখছি।”

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা একটু চিন্তায় আছি বটে মহারাজ।”

“তা ভাল। চিন্তা বহাল থাকলে আমার বুকের উপর দিয়ে তোমার ওই প্রাণঘাতী লাফঝাঁপগুলো অন্তত বন্ধ থাকবে। তা বাপু, তোমার সমস্যাটা কীসের?”

“আচ্ছা রাজামশাই, আপনি কি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর নাম জানেন?”

“রক্ষে করো বাপু, কোটি দূরে থাক, আমি তেত্রিশজনেরও নাম বলতে পারব না।”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “সেইটেই হয়েছে মুশকিল। কেউই পারে না।”

“কেন বাপু, দেবদেবী নিয়ে বখেড়া কীসের?”

“আচ্ছা, অপদেবতাদের কথা কিছু জানা আছে রাজামশাই?”

“না হে, অপদেবতা আছে বলে শুনেছি বটে, কিন্তু তারা যে কারা, তা জানা নেই। রাজপুরোহিত কোকিলেশ্বর ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞেস করা যেত, কিন্তু তাঁর এখন একশো তিন বছর বয়স চলছে। সব কথা মনে করতে পারেন না। আমার মতোই ভুল দ্যাখেন, ভুল শোনেন, ভুল বোঝেন আর ভুল বলেন। তা এইসব উচ্চকোটির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী তোমার?”

লোকটা করুণ মুখে হরিশ্চন্দ্রের দিকে চেয়ে বলল, “বড়ই দরকার পড়েছে রাজামশাই। সবটা না বললে বুঝতে পারবেন না।”

হরিশ্চন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বাপু হে, আগে তো এ বাড়িতে গল্প শোনানোর জন্য মাইনে করা লোক ছিল। তা সেসব দিন কবেই গত হয়েছে। শুনেছি, তারা এমন সব গল্প বলত যে, তা শুনে রাজারাজড়ারা নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। তা আজ তোমার গল্পটাই শুনি, দেখি ঘুম আসে কি না।”

লোকটা বলল, “আমি যখন পেটের দায়ে গায়ে-গঞ্জে হাটে বাজারে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতাম, তখন ফুলপুকুরের বিখ্যাত শিবরাত্রির মেলায় খেলা দেখিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সন্ধে হয়ে আসছিল। বিদ্যেধরীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ সামনে ঘাসের উপর কী একটা জিনিস চকচক করছে দেখে কুড়িয়ে নিলাম। দেখি একটা আয়না। গাঁয়ের হাটে-বাজারে যেমন কাঠের ঢাকনাওয়ালা সস্তা আয়না বিক্রি হয়, তেমনি। আয়নার সঙ্গে একটা লোহার সরু চেনে বাঁধা ধুকধুকিও পড়ে ছিল। তাতে এক পালোয়ানের ছবি খোদাই করা। একবার ভাবলাম, কার না কার জিনিস, ফেলে রেখেই যাই। তারপর ভাবলাম, পড়ে-পাওয়া জিনিস, থাক ঝোলার মধ্যে। তারপর আর দ্রব্য দুটোর কথা মনেই ছিল না। একদিন ঝোলা ঘাঁটতে গিয়ে আয়না আর ধুকধুকিটা বেরিয়ে পড়ল। আয়নাটা বেশ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম, ঢাকনাওলা সস্তা আয়নাই বটে, কিন্তু কাঁচটা বেশ ভাল জাতের। কোনও ঢেউ বা ঢাল নেই। আর ধুকধুকিটা দেখে ভাবলাম, কে জানে বাপু ধুকধুকি তো আসলে কবচ। এতে হয়তো আমার কপাল ফিরে যেতেও পারে। এই ভেবে ধুকধুকিটা গলায় পরে ফেললাম। আর তার পরেই ঘটনাটা ঘটল।”

হরিশ্চন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “কী ঘটল হে?”

“ধুকধুকিটা গলায় পরে আয়নায় তাকাতেই আঁতকে উঠে দেখি, তাতে আমার মুখের বদলে অন্য একটা মুখ ফুটে উঠেছে। কটা রঙের দাড়ি-গোঁফ, বড় বড় গোল গোল রাগী চোখ, ঘন জোড়া ⇒, মাথায় লোহার টুপি, পরনে সোনালি রঙের পোশাক। ভয়ের চোটে আমার হাত থেকে আয়নাটা মেঝেয় পড়ে গেল। কিন্তু ভাঙল না। প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও চোখের ভুল ভেবে আয়নাটা তুলতেই আবার সেই মুখ। আর আশ্চর্যের বিষয়, আয়নার লোকটা আমাকে কী যেন বলছিল।”

হরিশ্চন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, “বলো কী! তা কী বলছিল?”

“জীবনে ওরকম ভাষা শুনিনি। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি বা সংস্কৃত নয়। একেবারে অচেনা ভাষা। এক বর্ণ বুঝতে পারলাম না। ভূত বলে মনে হয়েছিল বটে, কিন্তু ভূতেরও তো কিছু নিয়মকানুন আছে। উদয় হতে তাদের আয়নার দরকার হয় না। একটা মজা হল, ধুকধুকিটা গলা থেকে খুলে ফেললে আয়নার লোকটা উধাও হত। তখন আয়নাটা একদম সাধারণ আয়না হয়ে যেত।”

“তা তুমি করলেটা কী?”

“আয়নার লোকটা দেবদেবীর কেউ কি না, না কি অপদেবতা, আমাকে কী-ই বা বলতে চাইছে, তা বুঝবার জন্য আমি প্রতিদিনই আয়নার লোকটার সঙ্গে আমার ভাষায় কথা বলতাম। লোকটা আমার কথা বুঝবার চেষ্টাও করত। কিন্তু বুঝতে পারত না। একদিন রাতে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, প্রচণ্ড বজ্রপাত। হঠাৎ আয়নার লোকটা একটা ধমক দিয়ে বলে উঠল, ‘রোবোশ! রোবোশ! ব্যস, হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি সব থেমে গেল। কাণ্ড দেখে তো আমি অবাক। সেদিন টের পেলাম, আয়নার মানুষটা সোজা লোক নয়। অনেক ক্ষমতা।”

“দাঁড়াও বাপু, রোবোশ কথাটা টুকে রাখি। কাজে লাগতে পারে।”

লোকটা হেসে বলল, “সে গুড়ে বালি। আমি চেষ্টা করে দেখেছি মহারাজ, কাজ হয় না। ময়নাগড়ে এক বাড়িতে একবার রাতে আমাকে তাদের লকড়িঘরে শুতে দিয়েছিল। মেটে ঘর, ডাঁই করা কাঠকুটো আর বাজে জিনিস। রাতে দেখি, একটা কেউটে সাপ তার দশ-বারোটা ছানাপোনা নিয়ে কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে। তখনও আয়না থেকে ওই লোকটা হঠাৎ চাপা গলায় বলেছিল, ‘পিরো! পিরো!’ সঙ্গে সঙ্গে সাপগুলো পড়ি কি মরি করে পালিয়ে গিয়ে গর্তে ঢুকে পড়ল।

“এ কথাটাও লিখতে বারণ করছ কি?”

“লিখতে পারেন, তবে কাজ হবে না।”

“ওই রোবোশ বা পিরো ওসব কি মন্তর-তন্তর নাকি?”

“তা কে জানে মহারাজ। শুধু জানি, মন্তর হলেও ও মন্তর আমাদের জন্য নয়।”

হরিশ্চন্দ্ৰ হতাশ হয়ে বললেন, “তা হলেই তো মুশকিল।”

“তবে লোকটার সঙ্গে ভাবসাব করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। মনে হয়, মাস দুয়েকের চেষ্টায় একটু-একটু যেন ভাবসাব হয়ে উঠছিল। সেই সময়ে আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম মহারাজ। সোনার গাঁয়ে একটা আড্ডায় কিছু লোক আমার ম্যাজিক নিয়ে খুব ঠাট্টা-তামাশা করছিল। তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য সেদিন আমি ভারী মাথা গরম করে তাদের আয়নাটা দেখাই। দেখে তারা ভড়কে গেল ঠিকই। কিন্তু গুপ্ত রহস্যটা গেল ফাঁস হয়ে। আর লোকগুলোও সেই থেকে আমার পিছনে লাগল। কেউ টাকা সাধল, কেউ ভয় দেখাতে লাগল, আয়নার লোকটাও ভ্রু কুঁচকে আমাকে কীসব যেন বলেছিল। নিশ্চয়ই ভাল কথা নয়।”

“তারপর কী হল?”

“তারপর থেকে আমি একরকম ফেরার হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আজ এখানে, কাল সেখানে। আয়নার লোকটা তখন আমাকে প্রায়ই বলত, টিকিটাক, টিকিটাক।”

হরিশ্চন্দ্র সাগ্রহে বললেন, “ওর মানে কি ‘টিকে থাক’ নাকি?”

“কে জানে মহারাজ, তাও হতে পারে। তবে টিকে আর থাকতে পারলাম কই বলুন!”

“কেন হে বাপু? কী হল?”

“ঘুরতে ঘুরতে চৈতন্যপুরে হাজির হয়েছিলাম মহারাজ। ঠিক করে রেখেছিলাম, একটা সুবিধেমতো জায়গা পেলে আয়নাটা লুকিয়ে রাখব। তা আপনার এই রাজবাড়িটা দেখে মনে হল, এমন ভাল জায়গা আর পাওয়া যাবে না। মেলা গুপ্তঘর আর কুঠুরি, কুলুঙ্গি, তাক, পুরনো বাক্সপ্যাটরার অভাব নেই। তাই সন্ধের মুখে চুপিসারে ঢুকে আয়নাটা কুলুঙ্গিতে হাবিজাবি জিনিসের পিছনে গুঁজে রেখে দিলাম। ধুকধুকিটা আমার কাছে রাখলাম। আয়নাটা কেউ খুঁজে পেলেও ধুকধুকি ছাড়া সেটায় কাজ হবে না।”

হরিশ্চন্দ্র উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসে বললেন, “বলো কী! এই বাড়িতে?”

“যে আজ্ঞে। শুধু শুধু কি আর এ বাড়িতে থানা গেড়ে আছি। মশাই?”

“তা আয়নাটা এখন কোথায়? একবার দেখা যায় না?”

মাথা নেড়ে লোকটা বলল, “নেই। সেটা হাওয়া হয়েছে।”