॥ ৪ ॥
‘ইউ. কে!’
লালমোহনবাবুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ফেলুদা ভদ্রলোককে কলকাতার ঘটনা সব বলে দিয়ে তারপর লন্ডনের ব্যাপারটা বলল। ভদ্রলোক এটার জন্য একেবারেই তৈরি ছিলেন না।
‘আপনি গেলে কিন্তু আপনার নিজের খরচে যেতে হবে। আমাদের খরচ মিস্টার মজুমদার দিচ্ছেন।’
‘কুছ পরোয়া নেহি। খরচের ভয় আমাকে দেখাবেন না, মিস্টার হোম্স। আপনার পসার বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো আমার রোজগার আপনার চেয়ে বেশি। শুধু বলে দিন কী করতে হবে।’
‘দিন সাতেকের মতো গরম কাপড় নেবেন। পাসপোর্টটা হারাননি ত?’
‘নো স্যার—কেয়ারফুলি কেপ্ট ইন মাই অ্যালমাইরা।’
‘তা হলে আর আপনার করণীয় কিছু নেই। যাবার তারিখটা যথাসময়ে জানতে পারবেন। যদ্দূর মনে হয়—এখান থেকে বম্বে, বম্বে থেকে লন্ডন।’
‘ওখানে থাকছি কোথায়?’
‘সেটা রঞ্জনবাবুর ট্র্যাভল এজেন্ট ব্যবস্থা করবে। একটা থ্রী-স্টার হোটেল হবে আর কি।’
‘হোয়াই ওনলি থ্রী স্টারস?’
‘তার চেয়ে বেশি চড়তে গেলে মজুমদার মশায়ের পকেট ফাঁক হয়ে যাবে। লন্ডনের খরচ সম্বন্ধে কোনো ধারণা আছে আপনার?’
‘তা অবিশ্যি নেই। তবে একটা কথা বলে রাখি—গড়পারে এক ভদ্রলোক থাকেন, আমার খুব চেনা। চন্দ্রশেখর বোস। ব্যবসাদার। বছরে দু’বার করে বিলেত যান। তাঁর কাছ থেকে কিছু ডলার ম্যানেজ করব—কী বলেন?’
‘ব্যাপারটা কিন্তু বেআইনি। অতএব নীতিবিরুদ্ধ।’
‘আরে মশাই আপনি অত সাধুগিরি করবেন না ত! আজকাল নীতির ডেফিনিশন চেঞ্জ করে গেছে।’
‘ঠিক আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার কারচুপিতে সায় দিচ্ছি।’
আমাদের মঙ্গলবার এয়ার ইন্ডিয়াতে যাওয়া ঠিক হল। প্লেন ছাড়বে রাত তিনটেয়, তারপর বম্বে হয়ে লন্ডন পৌঁছাবে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে এগারটায়। হোটেলের বুকিং-ও হয়ে গেছে—পিকাডিলি সার্কাসে রিজেন্ট প্যালেস। ফেলুদা বলল, ‘খুব ভালো লোকেশন। একেবারে শহরের মাঝখানে।’ ফেলুদা ক’দিন থেকে লন্ডন সংক্রান্ত গাইড বুকে ডুবে আছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহরের ম্যাপ দেখছে।
যাবার আগের দিন মিস্টার মজুমদারকে ফোন করা হল। মিনিট দুয়েক কথা বলে ফোন নামিয়ে রেখে ফেলুদা বলল, ‘জানতে চেয়েছিলাম ওঁর বাবা কোনো হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না। বললেন ওঁর মনে নেই। ওঁরা কোথায় থাকতেন জিজ্ঞেস করাতেও একই উত্তর পেলাম। বললেন ওঁর বাবা ওঁকে বলেছিলেন কিন্তু এখন আর মনে নেই। আমার মনে হয় অ্যাকসিডেন্টটা ওঁর স্মৃতিশক্তিকেই দুর্বল করে দিয়েছে। লন্ডনে আমার কলেজের এক সহপাঠী আছে, সে-ও ডাক্তার। দেখব ওর কাছ থেকে কোনো খবর পাওয়া যায় কি না।’
দেখতে দেখতে যাবার দিন চলে এল। ফেলুদার দৌলতে কত জায়গাই না দেখলাম, কিন্তু লন্ডন যাওয়া হবে এটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। লালমোহনবাবু বললেন, ‘বিলেত আজকাল রাম শ্যাম যদু মধু সকলেই যাচ্ছে, সেই ভেবে মনটাকে একটু ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছিলাম—ও মা, কাল রাত্তিরে দেখি পালস রেট বেড়ে একশো দশে উঠেছে। এমনিতে আশির বেশি কদাচিৎ ওঠে।’
এখানে বলে রাখি, লালমোহনবাবু তাঁর গড়পারের বন্ধুর কাছ থেকে বেশ কিছু ডলার ম্যানেজ করেছেন।
ফেলুদাকে ক’দিন থেকে একটু চুপচাপ দেখছি, যদিও কাজ যা করার সবই করছে। কেসটা যে সহজ নয় সেটাই বোধ হয় ওর মাথার মধ্যে ঘুরছে। আমি ত কল্পনাই করতে পারছি না ও কীভাবে এগোবে। তথ্য এত কম। তার উপরে রঞ্জনবাবুর স্মৃতিলোপ। যে ক’টা বছর ওই ছেলেটির সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব ছিল, সেই ক’টা বছরের কথাই উনি ভুলে বসে আছেন। লালমোহনবাবু সোজাসুজি বললেন, ‘আপনি অনেক রহস্যের সমাধান করেছেন, কিন্তু এটার মতো কঠিন কেস আর কখনো আপনার হাতে এসেছে বলে ত মনে হয় না। আপনি যে কেসটা কেন নিলেন তা বুঝতে পারছি না।’
‘এটা নিলাম বলেই কিন্তু আপনার বিলেত যাওয়া হচ্ছে।’
‘তা বটে, তা বটে।’
যাবার দিন এবং তারপর যাবার সময়ও এসে পড়ল। লালমোহনবাবুর গাড়িতেই এয়ারপোর্ট গেলাম। ভদ্রলোক পুরোদস্তুর সাহেব সেজেছেন। এই টাইটা আগে দেখিনি, বুঝলাম নতুন কিনেছেন।
কাস্টমসের ঝামেলা এখানেই চুকিয়ে দিয়ে বম্বে পৌঁছে লাগেজ জমা দিয়ে লাউঞ্জে কিছুটা সময় অপেক্ষা করে, লাউডস্পীকারের ঘোষণা শুনে আমরা প্লেনে গিয়ে উঠলাম। আশ্চর্য—এখন বিছানায় শুয়ে ঘুমোনর কথা, কিন্তু যাবার উত্তেজনায় একটুও ঘুম পাচ্ছে না। লালমোহনবাবু নাকি দুপুরে এক দফা ঘুমিয়ে নিয়েছেন, তাই বললেন প্লেনে আর ঘুমোনর দরকার হবে না। ভদ্রলোক নিজের জায়গায় বসে বেল্ট বেঁধে বললেন, ‘সেই পঞ্চুলালের গল্পে পড়েছিলাম না—তিমি মাছের পেটে ঢুকেছিল পঞ্চু—এও যেন সেই তিমি মাছের পেট। এত লোক সমেত প্লেনটা মাটি থেকে ওঠে কি করে সেটাই আশ্চর্য।’
সেই আশ্চর্য ঘটনাটাও ঘটে গেল। রানওয়ে দিয়ে যখন প্লেন কান-ফাটানো শব্দ করে ছুটে চলেছে, লালমোহনবাবুর চোখ তখন বন্ধ। ঠোঁটটা একবার নড়ে উঠল, আর বুঝলাম যে উনি বললেন ‘দুগ্গা দুগ্গা,’ আর সেই মুহূর্তে প্লেনটা জমি ছেড়ে আকাশে উঠে পড়ল, জানালা দিয়ে দেখলাম বম্বের আলো দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। তারপর প্লেনটা ক্রমে নাক উঁচু অবস্থা থেকে সোজা হল, শব্দ কমে গেল, আর লাউডস্পীকারে এয়ার হোসটেসকে বলতে শোনা গেল আমরা এখন বেল্ট খুলতে পারি, তবে আলগা করে পরে থাকাই ভালো। তারপর এক দিকে একজন ছেলে আর অন্য দিকে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে লাইফ জ্যাকেট আর অক্সিজেনের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।।
আমরা নন-স্মোকিং এরিয়াতে বসেছি। ফেলুদা সিগারেট খায় বটে, কিন্তু দরকার পড়লে অনায়াসে দশ-বারো ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে পারে। ‘সিনেমা দেখাবে না?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, ‘সচরাচর ত দেখায় বলেই শুনেছি।’
সিনেমা দেখাল ঠিকই, সেই সঙ্গে কথা শোনার জন্য একটা করে হেডফোন দিল, কিন্তু এত বাজে ছবি যে আমি দশ মিনিট দেখে হেডফোন খুলে রেখে ঘুম দিলাম।
ঘুমটা যখন ভাঙল তখন জানালা দিয়ে রোদ আসছে। ফেলুদাও বলল ও ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিয়েছে। কেবল লালমোহনবাবুই নাকি একটানা জেগে আছেন। বললেন, ‘হোটেলে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেব।’
বরফে ঢাকা আলপসের উপর দিয়ে প্লেনটা না উড়ে গেলে প্রায় কিছুই দেখার থাকত না। পাহাড়টার নাম জেনে লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা কি মন্ট ব্ল্যাঙ্ক দেখতে পাবো?’ ফেলুদা বলল, ‘তা পাবো, তবে মন্ট ব্ল্যাঙ্ক নয়, লালমোহনবাবু। এখন ইউরোপে এসেছেন, এখানকার দ্রষ্টব্যগুলোর নামের উচ্চারণ ঠিক করে করতে শিখুন। ওটা হল ম ব্লাঁ।’
‘তার মানে অনেকগুলো অক্ষরের কোনো উচ্চারণই নেই?’
‘ফরাসীতে সেটা খুব স্বাভাবিক।’
লালমোহনবাবু বেশ কয়েকবার ম ব্লাঁ ম ব্লাঁ বলে নিলেন।
‘আর আমাদের হোটেল যেখানে,’ বলল ফেলুদা, ‘সেটার বানান দেখে পিকাডিলি বলতে ইচ্ছা করলেও আপনি যদি পিক্লি বলেন তা হলে ওখানকার সাধারণ লোকে বুঝবে আরো সহজে। পিক্লি সার্কাস।’
‘পিক্লি সার্কাস। থ্যাঙ্ক ইউ।’
আধ ঘণ্টা লেটে আমাদের প্লেন লন্ডনের হীথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। ফেলুদা বলল, ‘এখান থেকে সেন্ট্রাল লন্ডন তিনরকমে যাওয়া যায়। এক হল বাস, দুই হল ট্যাক্সি আর তিন টিউব। ট্যাক্সিতে দেদার খরচা, আর বাসের চেয়ে টিউবে কম সময় লাগে। আমার ম্যাপ বলছে একেবারে পিকাডিলি সার্কাস পর্যন্ত টিউব যায়, কাজেই তাতেই যাওয়া ভালো।’
‘টিউবটা কী ব্যাপার মশাই?’ লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
‘টিউব হল কলকাতায় আমরা যাকে মেট্রো বলি, সেই। অর্থাৎ পাতাল রেল। লন্ডনের নিচ দিয়ে কিলবিল করে ছড়ানো রয়েছে এই টিউবের লাইন। একবার বুঝে নিলে টিউবে যাতায়াতের মতো সহজ জিনিস আর নেই। ম্যাপ পাওয়া যায়; একটা আপনাকে এনে দেবো।’