লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে গেল কিশোর। বসে পড়ল পড়ে থাকা দেহটার পাশে। প্রথমেই নাড়ি দেখল। তারপর মুসাকে বলল, লিলি!
লিলির ওপর ঝুঁকল মুসা। বেঁচে আছে?
আছে। কাঁধ ধরে ঠেলা দিতে দিতে কিলোর ডাকল, লিলি, শুনতে পাচ্ছেন? এই লিলি?
উ! গোঙাল লিলি। কয়েকবার কেঁপে কেঁপে খুলে গেল চোখের পাতা, আবার বন্ধ হয়ে গেল। কিশোর? শুকনো ঠোঁটের ভেতর দিয়ে কোনমতে ফিসফিস করে বলল সে। আবার চোখ মেলল। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে… হাত চেপে ধরল কপালে।
নড়বেন না, কিশোর বলল। হাড়টাড় কিছু ভেঙে থাকতে পারে।
না, ভাঙেনি। টর্চের আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে ওর চেহারা। ইস্, মনে হচ্ছে গায়ের ওপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। নড়াতে পারছি না। নড়লেই ব্যথা লাগে… চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে।
বাড়িটাড়ি লাগিয়েছেন বোধহয় কোথাও। শুয়ে থাকুন। আমি ডাক্তার কাপলিংকে নিয়ে আসি।
লাগবে না। এই প্রথম যেন অন্ধকার লক্ষ্য করল। অনেকক্ষণ ধরে এখানে আছি মনে হচ্ছে? ধরো, আমাকে, তোলো, তাহলেই হবে।
কিশোর আর মুসার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল লিলি। পা কাঁপছে। ওরা ছেড়ে দিলেই টলে পড়ে যাবে।
যেতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পারব না কেন? কোনমতে উঠে বসতে পারলেই হয় ঘোড়ায়, কাঁপা গলায় বলল লিলি।
ক্যাকটাস শান্ত, তাই ওটার পিঠেই ওকে তুলে দিল মুসা আর কিশোর মিলে। ওরা উঠল জেনারেলের পিঠে। টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে এগোল পাহাড়ী পথ ধরে।
হারিকেন কোথায়? জিজ্ঞেস করল লিলি।
র্যাঞ্চে। একেবারে খেপে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে শান্ত করেছে লুক আর ব্রড।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল লিলি। সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, ইদানীং ঘোড়াগুলো কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। কিছু বুঝতে পারছি না।
কি করছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
অদ্ভুত সব কাণ্ড। গত হপ্তায় খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল হারিকেন। মনে হচ্ছিল, ভয়ে ভয়ে আছে। সাধারণত ওরকম থাকে না। আজকে করল এই কাণ্ড… থেমে গেল লিলি।
আপনার কি হয়েছিল কিছু মনে আছে?
হারিকেনকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম। শুরু থেকেই কেমন নার্ভাস হয়ে ছিল ও, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিল। মনে হল, কোন কারণে লাগাম সহ্য করতে পারছে না। খুলে দিলাম। তারপরই মাঠের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে এল আমাকে এখানে। বনের ভেতরে ঢুকে আরও অস্থির হয়ে গেল। কিছু শুনেছিল বোধহয়, বিপদ-টি পদ আঁচ করেছিল। একটা পাইনের জটলার কাছে গিয়ে লাথি মারতে শুরু করল মাটিতে, পিঠ বাকা করে আমাকে ফেলে দিতে চাইল। শেষে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খাড়া হয়ে উঠল। মাথায় বোধহয় ডালের বাড়িটাড়ি লেগেছিল আমার। তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ মেলে দেখলাম তোমাদেরকে। দুজনের দিকে তাকাল সে। থ্যাঙ্কস।
র্যাঞ্চের আলো চোখে পড়ল। খানিক পরে অনেকগুলো কণ্ঠ শোনা গেল অন্ধকারে। একজন শ্রমিকের চোখে পড়ে গেল লিলি। ফ্লেয়ার জ্বালল লোকটা। হাউই বাজির মত আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেল ফ্লেয়ার, তীব্র নীল আলো। লিলিকে নিয়ে কিশোর আর মুসা চত্বরে ঢুকতে অনেকে এগিয়ে এল স্বাগত জানাতে।
কয়েক মিনিট পরে লিলি যখন ঘোড়া থেকে নামছে, চত্বরে এসে ঢুকল লুকের গাড়ি। দরজা খুলে লাফ দিয়ে নেমে এল সে। লিলিকে দেখে স্বস্তির হাসি হাসল। এসেছ! কি ভয়টাই না পাইয়েছিলে…! সব ঠিক আছে তো?
মনে হয়, জবাব দিল লিলি।
কিশোরের দিকে তাকাল লুক। মনে হচ্ছে তোমার ব্যাপারে ভুল ধারণা করেছিলাম আমি, কিশোর পাশা। বেরিয়ে ভালই করেছ। তবে, এর পরের বার আমি যা বলব, শুনবে। যা করেছ, করেছ, পরের বার আর করবে না। মারাত্মক বিপদে পড়তে পারতে, তখন?
জবাব দিল না কিশোর।
হাঁ হয়ে খুলে গেল রান্নাঘরের দরজা। দুহাতে অ্যাপ্রন তুলে সিঁড়ি বেয়ে। দৌড়ে নেমে এলেন কেরোলিন। পেয়েছে! যাক! লিলিকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তারপর ঠেলে সরিয়ে মুখ দেখতে লাগলেন। ইসসি, এক্কেবারেই তো সাদা হয়ে গেছে! যাও, সোজা ঘরে…আমি ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।… কি ভয়টাই না দেখালে
যার যার ঘোড়ার জিন খুলে ঘোড়াগুলোকে আগের জায়গায় রেখে এল কিশোর আর মুসা। লিভিং রুমে ঢুকে দেখল, পুরানো একটা কাউচে বসে ডক্টর কাপলিঙের মেয়ের সঙ্গে মিউজিক নিয়ে আলোচনা করছে রবিন। ওদেরকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, পেয়েছ?
পেয়েছি। দোতলায় চলে গেছে। ভালই আছে, জানাল কিশোর। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন। চলো। শুনব।
কিশোর আর মুসাকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল সে। কাপে গরম কোকা নিয়ে একটা নিজে নিল, অন্য দুটোর একটা দিল কিশোরকে, একটা মুসাকে। বলো, কোথায় পেলে?
সব শোনার পর জিজ্ঞেস করল, হারিকেন এই শয়তানীটা কেন করল বলো। তো?
জানি না, কোকার কাপে চুমুক দিল কিশোর।
কিশোর এতে রহস্যের গন্ধ পেয়েছে, রবিনকে বলল মুসা।
সে আমি আগেই জানি, রবিন বলল। কাল রাতেই বুঝতে পেরেছি।
শ্রাগ করল কিশোর। দেখো, একটা কথা কি অস্বীকার করতে পারবে, কাল। থেকে কয়েকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে? লিলিও তাই বলছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নিরেক আর পাইকের কথা আগের দিন যা যা শুনেছিল, সব দুই সহকারীকে খুলে বলল সে।
কোকা শেষ করে ওপরতলায় চলল তিন গোয়েন্দা। নিজেদের ঘরে যাওয়ার আগে লিলিকে দেখতে গেল। আস্তে করে ওর ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে পাল্লা ঠেলে খুলল কিশোর। নাইটগাউন পরে বিছানায় বসে আছে লিলি।
ডাক্তার কি বললেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ইঙ্গিতে ওদেরকে চেয়ারে বসতে বলে লিলি বলল, ডাক্তাররা আর কি বলে? রেস্ট নিতে হবে কয়েক দিন। কিছু হলেই এছাড়া আর যেন কিছুই করার থাকে না মানুষের। আমি থাকব বসে? অসম্ভব! রোডিওর জন্যে তৈরি হতে হবে আমাকে। র্যাঞ্চটাকে বাঁচানর এটাই শেষ সুযোগ।
রবিন হেসে বলল, অত ভাবছেন কেন? আপনি যা এক্সপার্ট, কয়েকদিন প্র্যাকটিস করলেই আবার চালু হয়ে যাবেন।
হাসি ফুটল লিলির মুখে। তা পারব।
হারিকেনকে নিয়ে খেলতে গেলে, মুসা বলল, কার এমন ক্ষমতা, আপনাকে হারায়?
চুপ! আস্তে বলল, কৃত্রিম ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল লিলি, বেনি শুনতে পেলে মূৰ্ছা যাবে।
বাইরে মচ করে একটা শব্দ হলো। কাঁধের ওপর দিয়ে দরজার দিকে ঘুরে তাকাল কিশোর। না, কেউ দরজা খুলছে না। আবার লিলির দিকে ফিরল সে। এই সময় বুটের শব্দ কানে এল, হালকা পায়ে হাঁটছে কেউ। কে? আড়ি পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল নাকি কেউ?
রবিন আর মুসাও শুনেছে শব্দটা। ঠোঁটে আঙুল রেখে ওদেরকে চুপ থাকতে ইশারা করে পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল কিশোর। একটানে খুলে ফেলল পাল্লা। বাইরে উঁকি দিয়ে কাউকে চোখে পড়ল না।
কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল লিলি।
সেটাই তো জানতে চাই আমি, মনে মনে বলল কিশোর। সন্দেহের কথাটা লিলিকে জানাল না। বলল, কিছু না। মনে হলো কেউ এসেছিল। দরজার কাছ থেকে সরছে না কিশোর। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অন্যান্য ঘরে মেহমানদের কথা শোনা যাচ্ছে, চলাফেরার শব্দ হচ্ছে। লিলির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, সব ঘরেই লোক আছে নাকি?
ভাবল লিলি। বেশির ভাগ ঘরেই আছে। কেন?
রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি, রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের চোখে চোখে তাকিয়ে রইল লিলি। তারপর বলল, কেরোলিন তোমাদের কথা সবই বলেছে আমাকে। অনেক জটিল রহস্যের। সমাধান নাকি করেছ তোমরা।
তা করেছি, ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসল কিশোর।
রহস্যের গন্ধ যখন পেয়েই গেছ, সাহায্য করো না আমাকে।
কিভাবে?
এই যে অদ্ভুত কাণ্ডগুলো ঘটল, এগুলোর জবাব চাই আমি।
আমিও চাই। আপনি বলাতে আরও সুবিধে হলো আমাদের। দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিলোর। কি বলো?
একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন আর মুসা।
হয়তো দেখা যাবে কোন রহস্যই নেই, সব কাকতালীয় ঘটনা, লিলি বলল। তবে জানা দরকার, মন থেকে খুঁতখুতানি তো দূর হবে।
তা হবে, মাথা কাত করল কিশোর।
আচ্ছা, র্যাঞ্চটাকে স্যাবটাজ করতে চাইছে না তো কেউ?
অসম্ভব কি? চাইতেই পারে, শত্রু যখন আছে… কথাটা শেষ করল না। কিশোর। তাকাল লিলির দিকে। হারিকেনের কথা বলুন। এরকম আচরণ কেন করল কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?
আবার মচমচ শব্দ হলো। তারপর টোকা পড়ল দরজায়। খুলে গেল পাল্লা। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লুক বোলান। মুখে কাদা লেগে আছে। কাপড় ছেঁড়া। রাগে জ্বলছে চোখ।
কেন ওরকম করছে, আমাকে জিজ্ঞেস করো, আমি জবাব দিচ্ছি, রাগে প্রায় চিৎকার করে বলল লুক, সমস্ত ভদ্রতা দূর হয়ে গেছে কণ্ঠ থেকে, ওটা শয়তান! ভাইয়ের মত! সে জন্যেই করেছে! দুটোই শয়তান! আস্তাবলটাকে তছনছ করে। দিয়েছে! হ্যাঁ, যা বলতে এসেছি। ইউনিক শয়তানটা বেরিয়ে গেছে। ধরতে যাচ্ছি, সে কথাই বলতে এলাম।
লিলি কিছু বলার আগেই দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল সে। বুটের শব্দ ও তুলে চলে যেতে লাগল।
দুই লাফে দরজার কাছে চলে এল কিশোর। পাল্লা খুলে দেখল সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে ফোরম্যান। পেছনে এসে দাঁড়াল রবিন আর মুসা। রবিন জিজ্ঞেস করল, ও ওরকম করল কেন?
ঘোড়াদুটোর ওপর ভীষণ খেপে গেছে, কিশোর বলল। শুনলে না, আস্তাবল তছনছ করে দিয়েছে বলল।
কি করবে এখন? মুসার প্রশ্ন।
তোমরা গিয়ে লিলির কাছে বসো, কিশোর বলল, আমি আসছি।
র্যাঞ্চ হাউসের বাইরে চতুরে যেন পাগল হয়ে উঠেছে সবাই। বাঙ্কহাউস, আস্তাবল আর গোলাঘরে ছোটাছুটি করছে শ্রমিকরা।
এগিয়ে গেল কিশোর। একটা পিকআপে উঠতে দেখল লুককে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে গেল গাড়িটা।
কি হয়েছে? একজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ডকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ব্রড। শার্টের একটা হাতা গুটিয়ে ওপরে তুলে রেখেছে। কনুইয়ের কাছে নীল একটা দাগ, ব্যথা পেয়েছে। জায়গাটা ডলছে সে। বিষণ্ণ কণ্ঠে জানাল, ইউনিক পালিয়েছে! মাঠ পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে ঘোড়ার খুরের শব্দ চলে যেতে শুনলাম।
আর শোনার অপেক্ষা করল না জনি আর আরেকজন তরুণ শ্রমিক। লাফ দিয়ে গিয়ে উঠল একটা জীপে। লুকের গাড়ির পিছু নিল। কিশোরও দেরি করল না। ছুটে এসে ঢুকল ট্যাক রুমে। টান দিয়ে একটা জিন নামিয়ে নিয়েই দৌড় দিল বেড়ার দিকে। ওকের জটলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ঘোড়া, গোলমাল শুনে কান খাড়া করে রেখেছে।
চাঁদের আলোয় জেনারেলকে চিনতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না কিশোরের। হাত নেড়ে ডাকল, এই জেনারেল, আয়, আয়। মুখ ফিরিয়ে কিশোরের দিকে তাকাল ঘোড়াটা। তারপর দুলকি চালে এগিয়ে এল। ওটার পিঠে জিন পরাল কিশোর। লাগামটা বেড়ার সঙ্গে বেধে আবার ছুটল ট্যাক রুমে। একটা টর্চ নিয়ে এল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, চলো, জলদি চলো। ওদেরকে ধরা চাই।
মাঠের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছোটাল কিলোর। অনেকটা এগিয়ে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণে ইউনিকর্ন। কিন্তু সে যাচ্ছে কোণাকুণি, পথ বাঁচবে, ধরে ফেলতে পারবে হয়ত ঘোড়াটাকে। দূরত্ব আর জেনারেলের গতির ওপরই নির্ভর করছে এখন সে।
জীপের হেডলাইট দেখতে পাচ্ছে। আরও আগে সামনের অন্ধকারকে চিরে দিয়েছে লুকের পিকআপের আলো।
ছুটে চলেছে জেনারেল। এদিক ওদিক ঘুরছে কিশোরের চঞ্চল দৃষ্টি। হঠাৎ চোখে পড়ল ওটাকে। একটা বিশাল ঘোড়ার অবয়ব, ছুটে চলেছে পাহাড়ের দিকে। চাঁদের আলোয় পাহাড়ের পটভূমিতে কেমন ভূতুড়ে লাগছে ইউনিকর্নের চকচকে কালো শরীর।
চল, জেনারেল, চল, তাড়া দিল কিশোর। আরও জোরে। নইলে ধরতে পারবি না।
তীর বেগে ছুটল জেনারেল।
গাছপালার ভেতরে ঢুকে পড়ল ইউনিকর্ন।
বনের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল লুকের পিকআপ।
জনও ব্রেক কষল।
পেছনে আরও ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ডেকে বলল লুকের খসখসে কণ্ঠ, এই কিশোর, যেও না! আর যেও না! ওদিকে পথ ভাল না! খানাখন্দে ভরা। যেও না…
শুনল না কিশোর। জেনারেলের পিঠে প্রায় শুয়ে পড়ে হাঁটু দিয়ে চাপ দিতে লাগল আরও জোরে ছোটার জন্যে। ঢুকে পড়ল বনের ভেতরে। চাঁদের আলো এখানে ঠিকমত পৌঁছতে পারছে না। গিলে নিল যেন তাকে রাতের অন্ধকার।
টর্চ জ্বেলে ইউনিকর্নকে খুঁজতে শুরু করল সে। পলকের জন্যে দেখতে পেল। ঘোড়াটাকে, মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের আড়ালে। পিছু নিল জেনারেল। এরপর যতবারই ঘোড়াটার ওপর আলো ফেলে কিশোর, ততবারই দেখে মিলিয়ে যাচ্ছে ওটা। কিছুতেই কাছে আর যেতে পারছে না। খুরের ঘায়ে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে রেখে যাচ্ছে ইউনিকর্ন। নাকমুখ দিয়ে সেই ধুলো গলায় ঢুকে আটকে যাচ্ছে। কিশোরের, দম নেয়াটাই অস্বস্তিকর করে তুলেছে।
জেনারেল ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। একই দিনে তিন তিনবার এভাবে ছুটতে হয়েছে তাকে। ওর ঘামে ভেজা গলা চাপড়ে দিল কিশোর। সামনে অনেকটা ফাঁকা হয়ে এসেছে গাছপালা। আবার খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল ওরা। পাহাড়ের গায়ে এখন কেবল শুকনো ঘাস।
হালকা ছায়া পড়েছে এখানে চাঁদের আলোয়, আশপাশের পাহাড় আর বনের জন্যেই বোধহয় হয়েছে এরকমটা। পাহাড়ী অঞ্চলে নানা রকম অদ্ভুত কাণ্ড করে আলো আর বাতাস, অনেক দেখেছে কিশোর, খোলা জায়গায় যেটা হয় না। সামনে দেখতে পেল এখন ইউনিকর্নকে। থমকে দাঁড়াল একবার ঘোড়াটা। বাতাস। উকে কিছু বোঝার চেষ্টা করল যেন। লাফিয়ে উঠল পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে। আবার ছুটল তীব্র গতিতে।
আগে বাড়ার জন্যে লাফ দিল জেনারেলও। দম আটকে গেল যেন কিশোরের। তার মনে হলো, ইউনিকনের পিঠে চড়ে বসে আছে একজন মানুষ। মানুষটাকে দেখতে পায়নি। আন্দাজ করেছে চাঁদের আলোয় কোন ধাতব জিনিস ঝিক করে উঠতে দেখে। ওই একবারই। আর দেখা গেল না।
আবার মনে পড়ল পাহাড়ী অঞ্চলে আলোর বিচিত্র কারসাজির কথা। চোখের ভুল না তো? ইউনিকনের পিঠে আরোহী? অসম্ভব।
কিশোরের মুখ ছুঁয়ে দামাল বেগে ছুটছে রাতের বাতাস। কোন দিকেই খেয়াল নেই ওর, তাকিয়ে রয়েছে ইউনিকনের পিঠের দিকে। আবার যদি দেখতে পায়। লোকটাকে? শিওর হতে পারবে তাহলে, সত্যিই আছে।
কিন্তু গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটছে ইউনিৰ্কন। হোঁচট খেল জেনারেল। হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল আরেকটু হলেই, অনেক কষ্টে সামলে নিল। শেষ মুহূর্তে জিনের একটা শিং খামচে ধরে উড়ে গিয়ে পড়া থেকে বাঁচল কিশোর। পড়লে আর রক্ষা ছিল না। এত গতিতে এরকম উঁচুনিচু শক্ত জায়গায় পড়লে ঘাড় কিংবা। কোমর ভাঙা থেকে কোন অলৌকিক কারণে রক্ষা পেলেও, হাত-পা বাঁচাতে পারত না। ভয় পেয়ে গেল সে। আর ঝুঁকি নিল না। রাশ টেনে গতি কমাল ঘোড়ার।
পাহাড়ের ঢালের পথ ধরে ছুটছেই ইউনিকর্ন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কিশোর। কোনমতে, শুধু একবার যদি কোন ভাবে দেখতে পেত আরোহীটাকে…
আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ল কিশোরের। আরোহী দেখার জন্যে মনযোগ সেদিকে দিয়ে না রাখলে এটা আরও আগেই চোখে পড়ত। ইউনিকনের কিছুটা সামনে বেশ অন্ধকার, ঘাসে ঢাকা জমি থাকলে যেমন দেখায় তেমন নয়। কেমন একটা শূন্যতা।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝে ফেলল, ওখানে কিছু নেই! হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেছে পাহাড়, তারপরে বিশাল খাদ! এবং সেদিকেই ছুটে চলেছে ইউনিকর্ন!
গলার কাছে হৃৎপিণ্ডটা উঠে চলে এল যেন কিশোরের। জেনারেলের গায়ে। হাঁটু দিয়ে গুতো মারল জলদি ছোটার জন্যে। লাফ দিয়ে ছুটল ঘোড়াটা। চিত্তার করে উঠল কিশোর, থাম! থাম! বাতাসে হারিয়ে গেল তার চিৎকার। কানে ঢুকল না যেন ইউনিকনের।
খাদের কাছে পৌঁছে ব্রেক কষে দাঁড়ানর চেষ্টা করল ঘোড়াটা। পিছলে গেল পা। এত গতি এভাবে থামানো সম্ভব হলো না বোধহয়।
আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখল কিশোর, অন্ধকারে হারিয়ে গেল ইউনিকর্ন।