ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

৪. রূপান্তর

৪. রূপান্তর

কুমার ও তার সঙ্গীদের সাহচর্যে দশ মাস অতিবাহিত হল, রাহুল এই দশমাসের মধ্যেই মল্লযুদ্ধ ও বিভিন্ন অস্ত্রচালনায় দক্ষ হয়ে উঠেছে। অবশেষে একদিন তার তিন শিক্ষক সমবেত হয়ে স্থির করল রাহুলের আর শিক্ষালাভের প্রয়োজন নেই, এখন তাকে বিদায় দেওয়াই সমীচীন।

বজ্র ও ক্ষুদ্রকের সম্মুখে রাহুলকে সম্বোধন করে সুবন্ধু বলল, রাহুল! তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। এইবার তোমাকে বিদায় গ্রহণ করতে হবে। তার আগে

বাক্য অসমাপ্ত রেখে একটি কোষবদ্ধ তরবারি তুলে রাহুলের দিকে এগিয়ে দিল সুবন্ধু, এই তরবারি তোমাকে উপহার দিলাম। আশা করি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সর্বদাই এই তরবারির তুমি সদ্ব্যবহার করবে।

রাহুল সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে গুরুর উপহার গ্রহণ করল, তরবারিকে আকষর্ণ করে কোষ হতে অর্ধ-উন্মুক্ত করে আবার সশব্দে কোষবদ্ধ করল, তার দুই চোখ জ্বলে উঠল হিংস্র আক্রোশে, কুমার! এতদিনে– হ্যাঁ, এতদিনে আমার ইচ্ছা পূর্ণ হল। এই অসি নিয়ে ফিরে যাব দ্বিরদরাজ্যে আমার গ্রামে এবং সেইখানেই এই অসির সদ্ব্যহার করব। তোমাকে এবং বজ্র ও ক্ষুদ্রককে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

তোমার গ্রামে ফিরে গিয়ে এই অসির সদ্ব্যবহার করবে? সুবন্ধু সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, তোমার কথার অর্থ বুঝলাম না। তুমি অবশ্য একদিন বলেছিলে দ্বিরদরাজ্যের একটি গ্রাম তোমার জন্মস্থান। কিন্তু তুমি পিতৃমাতৃহীন নিঃসঙ্গ। তোমার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। এখন বলছ গ্রামে ফিরে গিয়ে তুমি এই অসির সদ্ব্যবহার করবে– অর্থাৎ ওই গ্রামের কিছু লোক একসময়ে তোমার শত্রুতা করেছিল, আজ শস্ত্রপাণি হয়ে তুমি তাদের সমুচিত শাস্তি দেবে। কিন্তু তোমার মতন অল্পবয়স্ক কিশোরের উপর এমন কি অত্যাচার হতে পারে, যার ও সিহস্তে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্যোগ করছ?

কুমার! তাহলে তোমাকে সব কথা খুলে বলছি,রাহুল বলল, আমি পিতৃহীন, কিন্তু আমার জননী জীবিত। তিনি ছাড়া আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। আমার পিতা ছিলেন যুদ্ধব্যবসায়ী পেশাদার যোদ্ধা। আমি যখন কয়েকমাসের শিশু, সেইসময় একদিন দূর রাজ্য থেকে আহত অবস্থায় আমার পিতা ফিরে এলেন, তার ঘরে, আমার মায়ের কাছে। জননী যথাসাধ্য শুশ্রূষা করেও তাঁকে বাঁচাতে পারলেন না। মৃত্যুকালে পিতা আমার মাকে বলে যান, আমাকে যেন কখনো অস্ত্রচালনার শিক্ষা না দেওয়া হয়– তার একমাত্র পুত্র যেন তাঁরই মতো পেশাদার সৈনিক হয়ে নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যুবরণ না করে। মাতা মুমুর্ষ স্বামীকে স্পর্শ করে প্রতিশ্রুতি দেন আমাকে তিনি কখনো অস্ত্র স্পর্শ করতে দেবেন না তো বটেই এমন কি মল্লভূমি থেকেও আমাকে দূরে রাখা হবে। মাতা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। আমার জননী প্রতিবেশীদের গৃহে বস্ত্রাদি ধৌত করে আর বিভিন্ন কর্মে সহায়তা করে দুজনের অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করতেন। কিন্তু অন্যান্য বালকের ন্যায় আমাকে রণবিদ্যার প্রাথমিক অনুশলীন করতে দিলেন না। আমি মাঝে মাঝে মাতাকে গৃহকার্যে সাহায্য করতাম এবং তার কাছেই বিদ্যাভ্যাস করতাম। আমি লাঠি, তলোয়ার বা মল্লযুদ্ধের তালিম পেলাম না। কলহপরায়ণ কিছু বালক আমার জীবন দুঃসহ করে তুলল। আমারই সমবয়সী বিকর্ণ নামক এক উদ্ধত কিশোর একদিন সবসমক্ষে আমার প্রহারে জর্জরিত করে যৎপরোনাস্তি অপমান করল। ক্রোধে, অপমানে জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি জননীকে কিছু না বলে গৃহত্যাগ করলাম। স্থির করলাম কোনোদিন যদি রণবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করতে পারি, তবে এ অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করব। আজ আমি আর অসহায় নই, গ্রামে ফিরে প্রথমেই আমি বিকর্ণকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাব। তাকে শাস্তি দিয়ে উদ্ধত কিশোরদের সমুচিত দণ্ডবিধান করব, কেউ নিস্তার পাবে না।

নিদারুণ ক্রোধে রাহুলের দুই চক্ষু জ্বলতে লাগল হিংস্র শ্বাপদের মতো। কুমার এবং তার দুই সঙ্গী তাদের প্রিয় শিষ্যের ভাবান্তর দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হল, কিছুক্ষণ কেউ কথা বলতে পারল না। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করল কুমার, রাহুল! আজ তুমি অস্ত্রচালনায় অতিশয় দক্ষ। নিয়মিত অনুশীলন তোমার দেহকে ইস্পাত কঠিন স্নায়ু ও বলিষ্ঠ পেশিতে সমৃদ্ধ করেছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সঞ্চালিত করেছে বিদ্যুতের গতি- শিক্ষিত সৈনিকের পক্ষেও তোমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কষ্টকর, কয়েকটি গ্রাম্য কিশোর সমবেত চেষ্টাতেও তোমায় পরাস্ত করতে পারবে না। হয়তো তোমার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তারা মারাত্মকভাবে আহত হবে, এমন কি নিহত হওয়াও অসম্ভব নয়। রাহুল! আমি তোমায় অনুরোধ করছি, গ্রামবাসী কিশোরদের ক্ষমা করো, তারা তোমার ক্রোধের অযোগ্য। তোমার তরবারি যেন অত্যাচারীকে শাস্তি দিয়ে অসহায় মানুষকে রক্ষা করে।

কুমার! তোমার অনুরোধ রক্ষা করতে আমি অসমর্থ, রাহুল দৃঢ়স্বরে জানাল, আমি দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছি। দিবারাত্র কঠিন অনুশীলনে নিজেকে তৈরি করেছি। আজ আমার সকল পরিশ্রম সার্থক। যারা একদিন আমায় অপমান করেছে, আজ তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার। সময় এসেছে… চললাম।

রাহুল অন্তর্ধান করল। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে সুবন্ধু বলল, একজন দুধর্ষযোদ্ধা জন্মগ্রহণ করল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই রণবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে রাহুল। অস্ত্রচালনা ও মল্লযুদ্ধে তার অসাধারণ নৈপুণ্য এবং গ্রামবাসী কিশোরদের প্রতি তার বিধ্বংসী ক্রোধ নিদারুণ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

বজ্র বলল, কুমার! তোমার কথা সত্য। আমিও রাহুলের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। আশঙ্কা হচ্ছে, কিছু মানুষের অপঘাত মৃত্যুর জন্য আমরাই প্রকারান্তরে দায়ী হব। রাহুলের প্রচণ্ড ক্রোধ অপমানকারীদের রক্তদর্শন না করে ক্ষান্ত হবে না।

গতস্য শোচনা নাস্তি, ক্ষুদ্রক মতপ্রকাশ করল, এখন মধ্যাহ্নআহারাদির কি ব্যবস্থা হবে?

কিছু তণ্ডুল আছে। বিদভরাজ্যের রাজার থেকে কয়েকদিন পুর্বে কিছু বার্তাকু সংগৃহীত হয়েছে, সুবন্ধু বলল, আপাততঃ তাই দিয়েই ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করব। তোমরা ইচ্ছা করলে কিছু ফলমূল সংগ্রহ করতে পারো। বার্তাকু ও তণ্ডুলের সঙ্গে অধিকন্তু হিসাবে ফলাহার নিতান্ত মন্দ হবে না। আমার মন খারাপ, যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকব, খাদ্যের জন্য শরীরকে ব্যস্ত করব না।

আমারও সেই কথা, বজ্র বলল, বন্ধুবর ক্ষুদ্রক যদি কিছু সুস্বাদু ফল সংগ্রহ করতে পারে তো উত্তম, নচেৎ বার্তকু ও তণ্ডুল সহযোগে ক্ষুধাকে শান্ত করার চেষ্টা করব। আমারও মন খারাপ। রাহুলকে শিক্ষাদান ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এক প্রতিশোধকামী উন্মত্ত দানবের জন্ম দিয়েছি।

যা ঘটে গেছে, যার প্রতিকার করা সম্ভব নয়, তেমন ঘটনা নিয়ে আমি অনর্থক চিন্তা করি না, ক্ষুদ্রক বলল। তণ্ডুল ও বার্তাকু আহারে আমার রুচি নেই। ফলাহারেও আমি তৃপ্ত হব না। অরণ্যে হরিণ ও বন্যবরাহের অভাব নেই, আমি এখনই কিছু মাংস সংগ্রহ করে ফিরব। তোমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।

ক্ষিপ্র পদক্ষেপে অরণ্যের ভিতর প্রবেশ করল ক্ষুদ্রক এবং সঙ্গীদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালে অদৃশ্য হল।