৪. রুদ্রপ্রসাদের স্নায়ু শিরা

সত্যিই হয়তো তাই।

রুদ্রপ্রসাদের স্নায়ু শিরা সব ইস্পাত দিয়ে গড়া। তাই তারা শোকের হাহাকারে ভেঙে পড়ে না, আগুন হয়ে জ্বলে!

জ্বলে যাচ্ছেন রুদ্রপ্রসাদ। রুদ্রপ্রসাদের জীবনে কখনও এহেন পরাজয় ঘটেনি।

এই পরাভবের গ্লানিটা যতই মেজাজকে রুক্ষ তিক্ত করে তুলছে, ততই সংকল্পে দৃঢ় হচ্ছেন। যেন ওটা না করতে পারা পর্যন্ত তিলার্ধ স্বস্তি নেই রুদ্রপ্রসাদ নামের দম্ভোন্মত্ত মানুষটার।…

মনের মধ্যে অদ্ভুত এক ধারণা।

যেন দীপ্তিপ্রসাদ তার বাপের কাছে কী একটা দুর্লভ খেলনার আবদার করে রেখে কোথায় গিয়ে বসে আছে, রুদ্রপ্রসাদ সেই আবদারটা পূরণ করে উঠতে পারছেন না। নিজের এই অক্ষমতা বরদাস্ত করে উঠতে পারছেন না। কারণ পারছেন না ছেলের কাছে মুখ দেখাতে।

কিন্তু বলতেই হবে লোকটা ভাগ্যবান।

কে জানতো, দুর্লভ বস্তুটা নিজেই এসে ধরা দেবে তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যে।

খবর চাপা থাকল না।

দাহ্য বস্তুকে আগুনের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে আসার ফল যা হয়, তাই হল। চাপা আগুন হু হু করে জ্বলে উঠে চারদিকে জানান দিয়ে বসল।

রুদ্রপ্রসাদের টের পেতে দেরি হল না সেই অবিশ্বাস্য মূঢ়তার খবর। আর পাওয়া মাত্র হঠাৎ বেজায় কৌতুক অনুভব করলেন। তাঁর সেই ইস্পাতে গড়া স্নায়ু শিরার মধ্যে প্রবাহিত রক্তধারায় একটা আহ্লাদের ঢেউ খেলে গেল।

অনেকদিন এমন স্ফুর্তি বোধ করেননি রুদ্রপ্রসাদ। পুরজনকে হতচকিত করে, বৈকালিক স্নান পর্বে বড় দিঘিতে পড়ে সাঁতরে এপার ওপার করলেন। স্নান সেরে সর্বাঙ্গে আতর মাখলেন, উৎকৃষ্ট সাজসজ্জায় সজ্জিত হয়ে আরাম কেদারায় বসে রুপোর আলবোলায় টান দিতে দিতে বোঁচাকে হুকুম দিলেন, আজ তাঁর জন্যে মোগলাই খানার ব্যবস্থা করবার কথা বলতে। আর খানিকক্ষণ একচ্ছন্দে আলবোলায় টান দিতে দিতে, গভীর আত্মস্থ গলায় জানিয়ে দিলেন আজ তাঁর রাত্রের শয়ন ব্যবস্থা যেন দোতলায় অন্দর মহলে হয়।

দীপ্তিপ্রসাদের মৃত্যুর পর আর সেখানে যাননি রুদ্রপ্রসাদ। আজ অনায়াস অবলীলায় সে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।

বোঁচা কখনও হুকুমের কারণ অনুসন্ধান করতে বসে না, বোঁচা যেন যন্ত্র। বোঁচা ভিতর বাড়িতে এসে দাসীদের কাছে হুকুমটা পেশ করে গেল, বিনা মন্তব্যে, বিনা ভূমিকায়।

কিন্তু যেখানে পেশ করল, সেখানের প্রতিক্রিয়া প্রবল। দাসী মহল থেকে পিসি মহল পর্যন্ত এই সুখবরের ঢেউ ছড়ালো। এবং তলে তলে একটি পুলকের স্রোত বইতে লাগল।

যেন একটা কিছু হবে।

 বিচিত্র কোনও আলোড়ন, অভাবিত কোনও নাটক।

অথচ আশ্চর্য কৌশলে ব্যাপারটা সরমার অজ্ঞাত রাখা হল। অলিখিত এই অনুশাসনটি কীভাবে কার কাছ থেকে এল বলা শক্ত। নিঃশঙ্ক সরমা যখন নিত্যদিনের মতো রাত্রে শোয়ার আগে আস্তে কপাট খুলে দীপ্তিপ্রসাদের ঘরে এসে ঢুকলেন, তখন ভয়ানকভাবে চমকে উঠলেন। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কে?

দীপ্তিপ্রসাদের ঘরেও সাজসজ্জার কোনও ত্রুটি ছিল না। সেও বড়দের ভঙ্গিতে আরামকেদারার চওড়া দুটো হাতায় পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে ভালবাসতো।

রুদ্রপ্রসাদ উঠে বসলেন।

একটু বঙ্কিম হাসি হেসে বললেন, চিনতে পারলে না মনে হচ্ছে।

পুত্ৰবিয়োগের পর স্বামী-স্ত্রীর এই প্রথম সাক্ষাৎ!

 সরমা মুহূর্ত কয়েক নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন।

সরমা কি এই ভাবে একটু শান্তি পেতে চেষ্টা করবেন এই দীর্ঘ একমাস কাল পরে আজ ছেলের শূন্য ঘরটার জন্যে মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে রুদ্রপ্রসাদের? তাই নিঃশব্দে চলে এসে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।

কিন্তু কী করে চেষ্টা করবেন?

এই কি পুত্রশোকাতুর পিতার স্মৃতিকাতর মূর্তি? উগ্র আতরের গন্ধে এই নিভৃত শূন্যকক্ষখানির পবিত্রতার পরিমণ্ডলটুকু বিধ্বস্ত করে যে লোকটা শার্দুল হাসি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে ওই ক্রুর প্রশ্নটি করল, তার কাছে স্বাভাবিক মানুষের ব্যবহারের প্রত্যাশা কোথায়?

সরমার বুঝতে বাকি রইল না।

সরমার আবার এখন ছেলেবেলায় দেখা সেই চিড়িয়াখানার দৃশ্যটা মনে পড়ল। সরমা আস্তে নিজেকে ভিতরে ভিতরে শক্ত করে নেবার চেষ্টা করলেন। বললেন, চিনতে না পারলে দোষ দেওয়া যায় না।

ওঃ! তা হলে তো কাছে যেতে হয়।

এগিয়ে এলেন রুদ্রপ্রসাদ নিঃশব্দে। যেমন এগিয়ে যান শিকারের সময় নিঃসঙ্গ বসে থাকা পশুর দিকে।…আরও কাছে।…আরও–আর তারপর বার করে ফেললেন অস্ত্র।

আঃ!

সরমা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন, কী হচ্ছে! খোকনের ঘরে ছাড়িয়ে নিলেন নিজেকে।

আচ্ছা আচ্ছা!

রুদ্রপ্রসাদ ঈষৎ জড়িত কণ্ঠে বললেন, তবে না হয় খোকনের গর্ভধারিণীর ঘরেই যাওয়া যাক। মন্দ প্রস্তাব নয়।

সরমা দৃঢ় গলায় বললেন, না!

না? বল কী হে রানি সরমা দেবী? এখনও কি পরপুরুষ বলে ভ্রম হচ্ছে? সতীত্ব খোয়া যাবার ভয় জাগছে?

সরমা আস্তে পিছু হাঁটছেন।

 সরমা কি এই ঘর বারান্দা পার হয়ে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে দরজায় খিল লাগিয়ে ফেলতে পারবেন?

না, পারবেন না।

শ্বাপদের মতো সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসছে ওই হৃদয়হীন পুরুষ। তবুসরমা চেষ্টা করেন। শান্ত গলায় বলেন, খোকন চলে যাবার দিন থেকে একমাসও হয়নি এখনও

রুদ্রপ্রসাদ সরমার দুই কাঁধের উপর দুই থাবা রেখে নির্লজ্জ বিদ্রুপের হাসি হাসলেন, একমাস! সেটা তো যথেষ্ট! ব্ৰহ্মণের দশ দিন অশৌচ, জানা নেই বুঝি?

সরমা হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। কী নির্মম উক্তি। কেঁদে ফেলা ছাড়া উপায় রইল না। বললেন, আমায় ছেড়ে দিন। আমি পারব না!

রুদ্রপ্রসাদ নামের শ্বাপদটা যেন এক মাতাল কৌতুকের নেশায় মেতেছে। তাই বলে ওঠে, সে কী রানি সাহেবা। কতদিন পরে একটু তেষ্টার জলের আশায় এসে ভিক্ষাপাত্র ধরে দাঁড়ালাম, আর জল আদায় না করে ছেড়ে দেব? চল চল। অনেক নাটক হয়েছে, এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো যা হুকুম করছি পালন করবে চল।

আপনার পায়ে পড়ছি। আমি পারব না।…

নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ছটফট করেন সরমা।

কিন্তু ওই পাথরে গড়া বলিষ্ঠ পুরুষটার শক্তির কাছে ক্ষীণাঙ্গী সরমা?

সে শক্তি তাঁকে আদর নামক কঠিন পীড়নে পেষাই করতে করতে তিক্ত বিদ্রুপের গলায় বলে, ব্যাপারটা তো ভারী তাজ্জব ঠেকছে রানিসাহেবা। পরস্ত্রীর কাছেও তো কখনও এমন দুর্ব্যবহার পাইনি। তারা তো তু করলেই পা চাটতে বসে।

সরমা ঘাড় বাঁকিয়ে কষ্টে বলেন, তাদের কাছেই যান না। আমায় ছেড়ে দিন।

বাঃ। বেড়ে। নিজের বিবাহিতা স্ত্রী, ধর্মপত্নী, তাকে দরকার মতো কাজে লাগাতে পারব না?

 সরমা রুদ্ধ গলায় বলেন, সে দরকারের জন্যে ধর্মপত্নীর কথা ওঠে না।

ওঠে না মানে?

রুদ্রপ্রসাদ হিংস্র গলায় বলেন, লাহিড়ী বংশ কি নির্বংশ হয়ে যেতে দিতে হবে নাকি?

কী? কী বললেন?

 রুদ্রপ্রসাদ লাহিড়ী কোনও কথা দুবার বলে না।

সরমার স্বরও হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে, এ বংশ নির্বংশ হওয়াই ভাল। পাপের জড় মরে।  

রুদ্রপ্রসাদের হাত দুটো সরমার গলায় ওঠে।

সরমার মুখটা লাল হয়ে ওঠে, চোখ দুটো কঠিন হয়ে আসে। কষ্টে বলেন, তাই কর। তাই কর। গলা। টিপে মেরেই ফেল আমায়।

হাত নামিয়ে নেন রুদ্রপ্রসাদ।

বলেন, রুদ্রপ্রসাদ লাহিড়ী অতো বোকা নয় হে! যাক অনেক ন্যাকামি হয়েছে, ভালয় ভালয় চল।

ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে পৌঁছন সরমার শয়নঘরে। বলেন, পাপের জড়। ওঃ। মনে মনে তা হলে সাধের খোকন সোনার মৃত্যুকামনাই করা হয়েছে?

সরমার গলা ভেঙে যায়।

 ভাঙা হতাশ গলায় বলেন, ওঃ ভগবান। আপনি কী? পিশাচ, না শয়তান?

আমি হচ্ছি রুদ্রপ্রসাদ লাহিড়ী। এটাই শেষ কথা। যতদিন না ফের লাহিড়ী বংশের বংশরক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে, ততদিন তোমায় ছুটি দেওয়া যাবে না রানি সরমা দেবী। পাপের জড়কে তোমার মধ্যেই বাসা দিতে হবে। বুঝতে পেরেছ এবার?

না পারছি না। যা তোক একটা পেয়ে খোকনকে আপনি ভুলতে পারবেন?

চোপ রও! মেজাজ খারাপ করে দেওয়া কথা বলবে না। খবরদার।

সরমার হালকা দেহটাকে অনায়াসে তুলে নিয়ে পালঙ্কে ফেলেন।…পিছন ফিরে দরজায় খিল লাগাতে আসেন।…

সরমা কি চেঁচিয়ে তোক জড়ো করে আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করবেন? সরমার তো সত্যিই মনে হচ্ছে একটা অপরিচিত বর্বর তাঁর দেহটাকে কলুষিত করতে ঝাঁপিয়ে আসছে।

কিন্তু সরমা তো পাগল নয়। তাই চেঁচাবেন?

নিরুপায় সরমা বিদীর্ণ গলায় বলে উঠলেন, ঘরে দাসী রয়েছে। ওকে বেরিয়ে যেতে দিন।

 দাসী! ঘরে দাসী রয়েছে।

রুদ্রপ্রসাদ যেন ধারালো ছুরির আগা দিয়ে কেটে কেটে কথা বলেন, দাসী নিয়ে শোয়ার ব্যায়রাম তো তো তোমার ছিল না লাহিড়ীগিন্নি! কবে থেকে হল এ ব্যায়রাম?

সরমা এ কথার উত্তর দেন না।

শুধু তীব্র তীক্ষ্ণ গলায় বলেন, লক্ষ্মী, তুই বাইরে যা। ওদিকের বারান্দায় শুগে যা।

রুদ্রপ্রসাদ বহু আসবাবমণ্ডিত বিরাট ঘরখানার চারদিকে শ্যেনদৃষ্টি ফেলে ফেলে দেখতে দেখতে বলেন, লক্ষ্মীটি কি বৈকুণ্ঠলোকের? অদৃশ্য বলে মনে হচ্ছে।

সরমা এ কথারও উত্তর না দিয়ে আবার ডাক দিয়ে বলেন, লক্ষ্মী, কোথায় ঢুকে বসে আছিস! বেরিয়ে আয়। ঘর থেকে চলে যা! লক্ষ্মী।

কিন্তু কোথায় লক্ষ্মী!

ন্যায্য কোনও জায়গায় তো নেই যে চট করে বেরিয়ে আসবে। ঘরে বৃহৎ আলমারি, প্রকাণ্ড উঁচু আলনা, দেয়াল জোড়া স্ট্যান্ডের আয়না, একটা শীর্ণ ছোট্ট দেহকে লুকিয়ে ফেলবার মতো জায়গার অভাব ছিল না। কিন্তু আচমকা আত্মরক্ষার্থে যা করে বসে মানুষ, তাই করেছে সে। পালঙ্কের তলায় ঢুকে পড়েছে।

রুদ্রপ্রসাদ গায়ের পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে অলস গলায় বলেন, কই? কোথায় তোমার লক্ষ্মী?

সরমা কঠিন পাথুরে গলায় বলেন, আপনাকে দেখে ভয়ে পালঙ্কের নীচে গিয়ে ঢুকেছে। লক্ষ্মী, বেরিয়ে আয়। বারান্দায় শুগে যা।

তথাপি লক্ষ্মীর সাড়া নেই।

সরমা অবাক হলেন। তবে কি কোনওভাবে পালিয়ে গেছে? কিন্তু কোথা দিয়ে?

রুদ্রপ্রসাদও পাথুরে গলায় বলেন, দেখছি রহস্য ঘোরালো। লক্ষ্মী না নারায়ণ, হে সরমা দেবী? বেওয়ারিশ মহল পেয়ে

আঃ! ছোট কথা উচ্চারণ করে মুখ নষ্ট করবেন না।

সরমা স্থির গলায় ডাকেন, লক্ষ্মী। আমি বলছি, তুই বেরিয়ে আয়। ঘর থেকে বেরিয়ে যা। এ ঘরে রাজাবাবু থাকবেন। না বেরোলে মার খেতে হবে।

এতক্ষণে একটা ঘন নীল শাড়ির একাংশ দেখা যায়। অতঃপর একটা নীল শাড়ির পুঁটুলি। হামা দিয়ে বেরিয়ে আসে পালঙ্কের তলা থাকে।

সরমা বলেন, এত ভয়ের কি আছে? যা চলে যা।

কিন্তু কোথা দিয়ে চলে যাবে?

ততক্ষণে রাজাবাবু তো দরজার উপরদিকের খিল লাগিয়ে দিয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

ওই বৃহৎ দরজার মাথার উপরকার অর্গলে সরমারও হাত যায় না।

 ঠকঠক করে কাঁপছে নীল পুঁটুলিটা।

অবস্থা বোঝবার অবস্থাও হারিয়ে ফেলেছে সে।

 রুদ্রপ্রসাদ সরমার দিকে তাকিয়ে কাটা কাটা গলায় বলেন, বাঃ বেশ বেনে পুতুলটি তো জোগাড় হয়েছে। মহারানির কী কাজ করেন ইনি?

সরমা স্থির গলায় বলেন, দাসী বাঁদীরা মহারানির যা করে। পা টেপে।

বটে বটে! এসব তা হলে শিখেছ এতদিনে? উত্তম। তা আজ না হয় মহারাজই একটু আয়েস করে নিক। এই এদিকে আয়। আমার পা টেপ

কেন, ছেলেমানুষি করছেন? যেতে দিন ওকে। আপনার পায়ে হাত দেবে এত কী সাহস ওর?

আহাহা বাঁদীটাঁদীরা তো রাজরাজড়ার পদসেবা করেই থাকে হে। চাই কি, হাত মোলায়েম হলে বকশিশ-টকশিশও মেলে।…সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন লক্ষ্মীমণি? এসো–মুখখানি দেখি। বলে সহসাই এক হ্যাঁচকা টান মারেন নীল শাড়ির ঘোমটাটা ধরে।

আর তারপর?

হা হা হা!..হা হা হা! হাসি থামতেই চায় না। যা ভেবেছি তাই। লক্ষ্মীর ছদ্মবেশে নারায়ণ। ছি ছি রানিসাহেবা, এই বয়েসে এমন প্রবৃত্তি তোমার? সিংহের বদলে নেংটি ইঁদুরে রুচি! ছিঃ ছিঃ।

ইতর কথা বলে নিজের মুখকে কলুষিত করছেন কেন?

 সরমা মরিয়া গলায় বলেন, চিনতে পারছেন না ওকে?

রাজ্যসুদ্ধ টিকটিকি আরশোলা ইঁদুর ছুঁচোকে চিনে রাখি, এমন ফালতু সময় আমার নেই মহারানি। যাক কোতল করার উপযুক্ত একটা ভাল উপলক্ষই জুটে গেল। পরিবারের শোবায় ঘরে পরপুরুষ। এক্ষেত্রে শুনেছি খুনে ফাঁসি হয় না। যাক বাঁচা গেল বিধবা হবার ভয়টাও রইল না তোমার। সুযোগ পেলেই গিরগিটি কাঠবেড়ালি যা পাবে জুটিয়ে নিয়ে, ভালই থাকবে।

সরমা খাট থেকে নেমে এসেছিলেন, এখন এগিয়ে এসে বলেন, আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি, আমার সেই সম্মানটা রাখুন।

আবদারটা বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে না মহারানি? এই লাহিড়ী বংশেরও একটা সম্মান আছে, সেটা ভুলে গেলে তো চলবে না।

সেটা কোনওদিনই ভুলিনি। ভুলেছেন আপনি নিজেই অবিরত নিজেকে ছোট করে চলেছেন। তাকিয়ে দেখুন দিকি, এই প্রাণীটা কি আপনার প্রতিহিংসা চরিতার্থের যোগ্য?

প্রতিহিংসা?

 রুদ্রপ্রসাদ সহসা সেই নিষ্ঠুর কৌতুকের ভঙ্গি ত্যাগ করে রূঢ় গলায় বলেন, মানুষ যে মশা-ছারপোকা মারে, তাকে প্রতিহিংসা সাধন বলে?…এই তো মারছি। একটা ছারপোকার বেশি কিছু?

সবলে গোবিন্দর চড়াই পাখির মতো গলাটা টিপে ধরেন রুদ্রপ্রসাদ, সুঠাম সুন্দর হিরের আংটি পরা দশটা আঙুলে।

মুহূর্তে ঠিকরে ওঠে বোকাটে ভীরু চোখ দুটো! ছেড়ে দিন। ছেড়ে দিন।

আমি আপনার পায়ে পড়ছি। আমি আপনাদের কুল-দেবতা মা মহাকালীর দোহাই দিচ্ছি।

ঝাঁপিয়ে পড়েন সরমা, ওর বদলে আমায় শেষ করে দিন…ওকে খুন করলে কি আপনি খোকনের জীবনটা ফিরে পাবেন?

উথাল পাথাল করেন সরমা।

বলেন, জীবনে আপনার কাছে কখনও কিছু চাইনি। আজ হাতজোড় করে ভিক্ষে চাইছি। ওকে ছেড়ে দিন। ও খোকনের খেলুড়ি।

ফের! ফের ওই কথা?

শেষ চাপ পড়ে চড়াই গলাটার উপর।

তারপর ছেড়ে দেন।

অদ্ভুতভাবে কেমন যেন লটকে পড়ে ছেলেটা, হাঁটুটা ভাঁজ করে।

দরজা খুলে দিন।

সরমার কণ্ঠে একটা অমোঘ আদেশের ধ্বনি। বেরিয়ে যেতে দিন আমায়! নইলে চেঁচিয়ে লোক জড় করব।

কিন্তু রুদ্রপ্রসাদের স্নায়ুরা কি এইটুকুতেই বিচলিত হবার?…গুলি খাওয়া চিতা, হায়েনার শেষ আক্রোশে নিরুপায় গর্জনের ধ্বনি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে উল্লাসের রস পায় তারা, গুলি খাওয়া হরিণীর মৃত্যু-যন্ত্রণার দৃশ্য নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখে।

টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে আরামের একটা আঃ শব্দ উচ্চারণ করে ইচ্ছাকৃত জড়িত গলায় বলেন রুদ্রপ্রসাদ, তোমায় তো বেশ বুদ্ধিমতী বলে জানতাম গো রানিসাহেবা, হঠাৎ নির্বোধের মতো কথা কেন? দশজন ছুটে এসে যদি দেখে রানিসাহেবার শয়নকক্ষে গয়লার পোর লাশ, দৃশ্যটা কি ভাল হবে।

ভাল?

সরমার মুখে একটা উগ্র হাসি ফুটে ওঠে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই খেয়াল হয় সরমার, শয়নঘরের বারান্দা সংলগ্ন স্নানের ঘরের দরজাটা তাঁর হাতের মধ্যে।…সহসা টেবিলের উপর থেকে তুলে নেন একটা ভারী পিতলের ফুলদানি। উঁচিয়ে ধরে বলেন, ওঠবার চেষ্টা করবেন না। যেমন আছেন থাকুন।

এ আবার কী! মাথা বিগড়ে গেল নাকি!

 ঠিক এ রকম পরিস্থিতির জন্যে তো প্রস্তুত ছিলেন না রুদ্রপ্রসাদ। আশঙ্কাও করেননি, সরমার মধ্য থেকে এ মূর্তি বেরিয়ে আসবে।

তবু উঠে বসেন।

 খাট থেকে নামতে যান।

কিন্তু সরমার চোখে আগুন, সরমার কণ্ঠস্বরে আগুন, বললাম না উঠতে চেষ্টা করবেন না। ব্যস আর এক পাও নয়।

এতক্ষণে একটু থতমত খান রুদ্রপ্রসাদ, যা দেখছেন, ছুঁড়ে মারতে পারে ও ওই ভারী ফুলদানিটা।

তবু বালির বাঁধ দিতে চেষ্টা করেন, আলগা গলায় বলেন, কী হচ্ছে কী? এ যে পুরোপুরি যাত্রা নাটকের পালা।

সরমা আর কথা বলেন না।

হাতের জিনিসটাকে এইভাবে উঁচিয়ে ধরে আস্তে আস্তে এগোতে এগোতে বেরিয়ে পড়েন ছোট কোনাচে বারান্দাটায়, ঢুকে পড়েন স্নানের ঘরের মধ্যে। ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেন।

মিনিট খানেক দরজায় মাথাটা ঠেকিয়ে হাঁপাতে থাকেন সরমা। তারপর তাকিয়ে দেখেন চিনেমাটির চৌবাচ্চা ভর্তি টলটলে জল। আঃ। ঘটিটা তুলে নিয়ে মাথায় ঢালতে থাকেন ঝপাঝপ …পরপর। যেন সমুদ্র হলেও সবটা শেষ করতেন।

অনেকক্ষণ জল ঢালার পর হঠাৎ খেয়াল হল, এই জলের শব্দটাই বোধ হয় সরমার আপাত রক্ষক।…এটা না পেলে রুদ্রপ্রসাদ পিছু পিছু ছুটে এসে কী করতেন বলা যায় না। হয়তো প্রবল আক্রোশে দরজা ভেঙে ফেলে পলাতকার পথ আটকাতে আসতেন।

আবারও জলের শব্দ করতে লাগলেন সরমা।

মাটিতে জল ঢালতে ঢালতেই গিয়ে হাত বাড়িয়ে দেখলেন পিছনের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ কিনা। নাঃ বন্ধ নয়। আস্তে কপাটটা খুলে ধরতেই এক ঝলক স্নিগ্ধ বাতাস এসে ভিজে শরীরটাকে আরও স্নিগ্ধ করে দিল।

এই দরজাটার সামনেই সিঁড়ি। যে সিঁড়িটা নেমে গেছে বাগানের চাতালের ইঁদারার কাছ বরাবর। যেটা দোতলায় জল সরবরাহের রাস্তা।

সিঁড়িটার মুখেও একটা খিল ছিটকিনি লাগানো দরজা আছে, তবে অপ্রয়োজন বোধে কেউ সেটাকে বন্ধ করার পরিশ্রম করে না। দুহাট করে খোলাই রয়েছে। তার মানে দুহাট করে খোলা রয়েছে সমার মুক্তির দরজা।

ঘটি নাড়ানোর শব্দ বজায় রেখে সরমা আস্তে হাত বাড়িয়ে দেয়ালে পোঁতা আলনা থেকে পেড়ে নিলেন সকালে পরবার জন্যে সাজিয়ে রাখা শাড়ি জ্যাকেট।…

ভেজা কাপড়েই নেমে এলেন সিঁড়ি দিয়ে। আর আসার সময় নিঃশব্দে দরজাটার হুড়কো লাগিয়ে দিলেন বাইরে থেকে।

নেমে এসে চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন যেন। কী আশ্চর্য নিস্তব্ধতা। জনমানবশূন্য এই বৃহৎ নিথর জায়গাটা দেখে কে বিশ্বাস করতে পারবে, দিনের বেলা এই জায়গাটা মানুষের কলকোলাহলে আর সংসারের কর্মচক্রের ঘর্ঘর আলোড়নে কী কুৎসিত ক্লেদাক্ত হয়ে থাকে।…

কত লোক বাড়িতে। কে তারা, ভাল করে জানেনও না সরমা। বৃহৎ প্রাসাদের খাঁজে খোপে কতজন এসে এসে বাসা বেঁধেছে। তাদের ডালপালা বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে দাসদাসীর সংখ্যাও। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে লেগে পড়ছে তারা। রান্নাবাড়িটা তো একটা যজ্ঞশালা।

এই জনারণ্যের মাঝখান থেকে একটা মানুষ কমে গেলে কীই বা এসে যাবে? দীপ্তিপ্রসাদের মৃত্যুর পর থেকে এই বৃহৎ সংসারটা থেকে তো সরমা বিচ্ছিন্নই হয়ে গেছেন। চিরকালীন কর্তব্যগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে।

অতএব এই যাওয়াটা ঝরে পড়া শুকনো পাতার বাতাসে উড়ে যাওয়া।

না পিছনে নেই কোনও বন্ধন। বরং একটা ভয়াল পশুর হাঁ থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ঠেলে দিয়েছে পিছন থেকে। গ্রামের হতভাগ্য মানুষগুলো? সরমার কী করার আছে তাদের জন্যে? অনুভব করলেন তো নিজের ক্ষমতার সীমা!

সরমার অনুমান ভুল হয়নি।

 বিভ্রান্ত হয়েছিলেন রুদ্রপ্রসাদ।

সেই হাসিটার ভাষা হচ্ছে, যাক। মোল্লার দৌড় মসজিদ অবধি। মেয়েমানুষের লম্ফঝম্ফ, খাঁচার শিকে মাথা ঠোকা মাত্র। মাথাটা গরম হয়ে উঠেছিল, তাই নিজেই নিজের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে লেগেছে।…পুরো চৌবাচ্চার জলটাই মাথায় ঢালছে মনে হচ্ছে। ঢালুক। মাথাটা ঠাণ্ডা হওয়া দরকার। দোকানদারের ঘরের মেয়ে বই তো নয়। প্রজা শায়েস্তা চোখে দেখেইনি কখনও।

কিন্তু হাতটায় এমন অস্বস্তি কেন?

রক্ত ফক্ত তো লাগেনি বাবা। ছোঁড়া তো স্রেফ তালপাতার সেপাইয়ের মতো মচকে ভেঙে গড়িয়ে পড়ল।…

হাতটা ধোয়া দরকার।

অপেক্ষা করতে থাকেন সরমার ফিরে আসার। কিন্তু কী করছে এতক্ষণ, ভেজা কাপড়েই স্নানের ঘরে বসে রইল নাকি? স্নানের ঘরে জামাকাপড় মজুত থাকে এটা জানা ছিল না রুদ্রপ্রসাদের। অতএব ও-ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছেন না। ওই বিরক্তিকর নীলশাড়ির পুঁটুলিটা যদি চোখের সামনে পড়ে না থাকতো, এ ঘরটা থেকে হয়তো চলেই যেতেন রুদ্রপ্রসাদ। নিজের মহলেও স্নানের ঘর আছে।… কিন্তু দরজা খুলে চলে যাওয়া যায় না। এ রাত্রে তো কোনও ব্যবস্থা সম্ভব নয়? ভাবলেন, যখন পালঙ্ক থেকে নামব, ওটাকে পা দিয়ে ঠেলে পালঙ্কের তলায় ঢুকিয়ে রাখতে হবে।

শীর্ণ শুষ্ক ওই তুচ্ছ বস্তুটাকে এই রাত্রেও পাচার করা অসম্ভব ছিল না। একবার বোঁচা হারামজাদাকে ডেকে জানিয়ে দিলেই নিঃশব্দে কাজ সমাধা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা যে অন্য। এর সঙ্গে জড়িত আছে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা।

ও লাশকে কবর খুঁড়ে পুঁততে হবে।

দূর! একটা সামান্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন রুদ্রপ্রসাদ? যা ঠিক করা আছে তা হবে।

হঠাৎ প্রায় উচ্চারণ করেই বলে উঠলেন রুদ্রপ্রসাদ, কী হে সরমা দেবী? নিজেকে খুব চালাক ভেবেছিলে তাই না? টেক্কা মারতে এসেছিলে রুদ্র লাহিড়ীর উপর? আচ্ছা এর সমুচিত জবাব পাবে।…বাদশার হত্যাকারীকে তুমি লুকিয়ে রাখতে গেলে রুদ্র লাহিড়ীর হাত থেকে।

দেখলে তো তার পরিণাম?

হুঃ।

নিজের হাতে শত্ৰু নিপাত করতে পেরে বেশ আত্মপ্রসাদই অনুভব করছিলেন রুদ্রপ্রসাদ, কিন্তু হাত দুখানা যেন জ্বালাতন করছে। সেই অবধি কেমন যেন ক্লেদাক্ত মনে হচ্ছে। ওই বিশ্রি জন্তুটার স্পর্শেই বোধ হয়। এত নোংরা ওরা। হাত দুটো ধোয়া দরকার। সাবান ঘষে ঘষে। সরমা বেরিয়ে এলেই

কিন্তু সরমা এত দেরি করছে কেন?

কতক্ষণ লাগছে চুল মুছতে, গা মুছতে?

.

মালদহের যুবক জননেতা চন্দন সান্যাল নতুন কর্মপ্রবাহে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে তার পার্টির অফিসের মধ্যে গোপন মিটিং বসিয়েছিল। ..ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে কর্মপদ্ধতিটাকে ঠিক করে নেওয়া দরকার।

বহুকালীন একটা কদর্য প্রথার অবসানের আইন পাশ হয়েছে বটে কিন্তু কে জানে সে আইন কতদিনে কার্যকরী হয়। আইন পাশের সঙ্গে সেই আইন ব্যবস্থার প্রচলন তো অনেক সময় সময়ের দুস্তর ব্যবধান থেকে যায়।

বিধবা বিবাহের আইন পাশ হয়েছিল কতদিন আগে?

মন প্রস্তুত হতে সময় লাগে।

দেশের, সমাজের, ব্যক্তি মানুষের।

একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নেহাতই অস্থায়ী, এই সত্যটা কেউ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারছিল না। নইলে জমিদারিপ্রথার অবসান ঘটতে চলেছে–এ ঘোষণা তো চলছিলই। তবু কথাটা অলীক মনে হচ্ছিল।

অতএব একপক্ষ সারাক্ষণই ভেবেছে–হুঁ। হলেই হল? সাতপুরুষের চোদ্দপুরুষের মৌরুসিপাট্টা না? দলিল দস্তাবেজ সব রইল অটুট অক্ষত, আর চিরস্থায়ী অধিকারটা হঠাৎ কার একটা কলমের খোঁচায় বেবাক মিথ্যে হয়ে যাবে? এত সোজা নয়।

আর অপর একপক্ষ অবিশ্বাসের ব্যঙ্গ হাসি হেসে ভেবেছে, যা হবে, ওই কাগজে কলমেই। যেমন ছিল তেমনিই থাকবে। ইহজগতে বাপু দুটোই সম্প্রদায়, শোষক আর শোষিত। শাসক আর শাসিত। এর আর ব্যতিক্রম হয় না। আইন কানুন, ধর্মের জিগির, সবই শেষ অবধি মিথ্যে হয়ে যায়। কেউ ধোপে টেকে না।

আবার মজা এই–যারা যথার্থই শোষিত, যারা পুরুষানুক্রমে রোদে জলে মাঠেঘাঠে প্রাণপাত খেটে খেটে অন্নপূর্ণার মূর্তি গড়ে আসছে অথচ চিরদিন নিরন্নই থেকে এসেছে, তারাই আতঙ্কিত প্রশ্নে মুখর হচ্ছে, বাবুরাই যদি উচ্ছেদ হয়, তো মোদের কী হবে গো? চেরডাকাল বাবুরাই মোদের পেলে আসতেছে, মোদের সুক দুকু দেকতেচে, অ্যাকোন কোন মুরুব্বি দেকতে আসব?…স্বরাজ গরমেন্ট তো মোদের খুব উপগার কল্লো দেকচি। মাতার ওপর থে ছাতা কেড়ে নেলো।…বাপ বলতে হইলো না, মা বলতি রইলো না।…

বাবুদের ঘরে বারো মাসে তেরো পানটি ছেলে। ছেলে দোল দুগ্যোচ্ছব রক্কেকালী পুজো আগ্লোকোট, কতো বাহার। পেরজাদের কত পাওয়া মাকা সে সব বজায় রাকবে এ গরমেন্ট?… বলে কিনা চেরকাল ধরে চাষিদের পেড়ন করে এয়েচে বাবুরা, অ্যাকোন তার শোদ হচ্ছে। বলি খাজনা দিতি না পাল্লে করবেনি পেড়ন? দুদ-ভাত খাওয়াবা? তেনারে দিতি হয় না রাজার খাজনা? ম্যায়াদের দিনডি ফুরলো, কি সূয্যাস্ত আইন মাতাচাড়া দেলো, ব্যস লাটে ওটলো জমিদারি? তবে? রাজা তারে মাপ মকুব করে?

আহা বাবুদের ওই ঔরী চৌরী দকিন দৌরী অট্টালিকাকে, সাতপুরুষের ভিটে, সেখেনে মালিককে তাইড়ে দে, নাকি ইস্কুলে বসাবে। হাসপাতাল বসাবে। তার মানে মগের মুলুকটি ফিরে এল আবার। আবার কেউ বলে, তবে যে বলতেচে চাষিদের অক্তেই বাবুদের অ্যাতো নপচপানি, তাদের নোপাট করে দে তাপর চাষিদের নেয্য পাপ্য দেবে।

অপর দল নস্যাৎ করে সে কথা–আরে থামোনা ক্যানে ভাই। চাষির জন্যি মরতিচে! হঃ! জমিনদারের তালুক মুলুক কেড়ে নে সকল খানে কলকারখানা বসাবে। বিলিতি নাঙ্গলের যন্তর আন্যে চাষ আবাদ করবে বুইলে? তবে কও, চাষি, তুমি কোতায় আচো? জমি হাইরে বুড়ো আঙুল চোষো, নচেৎ হাল গোরু বেচে দ্যে, কারখানার কুলি হওগ্যে।…সকল জমিদারবাবুই কিছুওৎপীড়কনয় ভাই। পেরজাদের ভালর জন্যি কত করিচে।…এই যে মোহা মোহা সব মন্দির গড়ে থুয়েচে, বেরোদ বেরোদ দিঘি পুষ্কনি কাইটে রেকেচে, গীরিষ্মে জলছত্তর দেচে, জাড়কালে কম্বল বিইলেচে, সেগুলান কিছুনা?…

মানুষ মারা গেলে যেমন তার প্রতি হৃদয় সদয় হয়ে আসে, অতি পাজি লোকের সম্পর্কেও বলা হয় লোকটা এক হিসেবে বেশ ভালই ছিল হে।.. এবং খুঁজে খুঁজে তার কোনও কোনও বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করে করে প্রশংসা করা হয়, এও অনেকটা তেমনি।

বাবুদের সম্পর্কে কার কতটা ভক্তিপ্রীতি ছিল কে জানে, কিন্তু তাঁদের বিদায় যাত্রার আয়োজনের দৃশ্যে হাহাকার জাগছে, চিরন্তন মানবিকতার নিভৃত কেন্দ্রে।…একটা দীপ্ত ঔজ্জ্বল্যের নিবনি, একটা বিরাট দম্ভের পতন, একটা জমজমাট আসরের অবসান, এটা বড় বেদনাদায়ক।

আবার এর বিপরীতও আছে বইকী!

সেখানে বিরূপ মন্তব্যের লাভা স্রোত।

বেশ হইচে, উচিত হইচে। অ্যাতোকালের পাপের পাচিত্তির হইচে। …সেই যে বলে না, অতি দল্পে হত লঙ্কা, এ তাই।…চেরডা দিন বাবুরা আমাদের গরিবদের মাতায় পা দে হেঁটেচে, মনিষ্যিকে মনিষ্যি গেয়ান করেনি।…চাষিদের পেরাণ পেরাণ না, পেরজাদের ঘরের বউ ঝির ইজ্জত ইজ্জত না।… বান বন্যে অজন্মা…অসুবিধে মানেনি। খাজনা দিতি না পাল্লেই কাঁচারিবাড়িতে ধরে নে গে আকত্যি পরজাদের খুরের বছ কি দু ইজন বন অত্যেচার করচে। ভগগাবান তার শাস্তি দেবে না?…অ্যাকোন সব্বস্ব হাইরে, ফ্যা ফ্যা করি মরগে যা।…

যেখানে সেখানে জটলা।

যেখানে সেখানে উত্তেজিত আলোচনা।

 সর্বত্রই প্রায় একই দৃশ্য।

নবীনে প্রবীণে মতভেদ আছে। থাকবেই। মতভেদ থাকবে নেহাত নিঃস্বদের সঙ্গে কিছুটা সম্পন্নদের। তাই বিপরীত মতবাদের বাদ-প্রতিবাদ চলছেই। যেখানে হয়তো দুপক্ষেই ভ্রান্ত ধারণার শিকার সেখানেও।..

চন্দন সান্যালের কর্মপদ্ধতি প্রতিটি মানুষের মধ্যে সত্য চেতনা জাগিয়ে তোলা। যথার্থ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করা। ….তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় করে তোলা। লাঠি যার মাটি তার আজ আর এ কথা নয়। আজকের কথালাঙল যার, ফসল তার।

যুগ যুগান্তরের শোষিত সমাজ, এদের সংস্কারের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে আছে দাস মনোভাব। সেই বদ্ধমূল সংস্কারকে মূল সমেত উপড়োতে হবে। …এটা না তুলতে পারলে শুধু একটা আইন কিছু করে উঠতে পারে না।

শুধু আইন হয়তো জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটাবে, কিন্তু দীনদুঃখী চাষিবাসী সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে কী? অন্তত চন্দন সান্যালরা তা বিশ্বাস করে না।…তারা মনে করে, এদের জানাতে হবে তোরাও মানুষ।

এই কথাই বোঝাচ্ছিল জননেতা চন্দন সান্যাল, তার শিষ্য সামন্তদের।

এ সব কথা সে নিতান্ত তরুণ বয়েস থেকেই অবিরতই বলে চলেছে, প্রকাশ্য সভায়, উন্মুক্ত কণ্ঠে। জমিদারি প্রথার অবসানের প্রশ্নের আগে থেকেই।…চাষিদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চেয়েছে তার বার্তা, তবু মাঝে মাঝে গোপন বৈঠকেরও দরকার ঘটে।…

বৈঠক চলছিল ঘরে। বাইরে পাহারাদার ছিল দেবু সরকার।

হঠাৎ এক সময় ভিতরে চলে এল দেবু। বললে, চন্দনদা একটি মহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

মহিলা? মহিলা কেন আবার?

চন্দন টেবিলের উপর ছড়ানো কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে বলল, কীরকম মহিলা রে?

দেবু বলল, ইয়ে মানে খুব সুনদো, মানে বেশ বড়ঘরের বলেই মনে হল।

 চন্দন নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল।

একজন বলল, চন্দনদা কে কোন মতলবে আসে। সাবধান আছেন তো।

চন্দন উত্তর দিল না, বেরিয়ে এল।

এসে মুখোমুখি দাঁড়াল সেই দর্শনার্থিনীর সামনে। কয়েক পলক নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ঠিক আন্দাজ করেছিলাম। আয়।

.

অতঃপর দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটে চলেছে। দেশের সমাজের রাষ্ট্রের। চন্দন সান্যালের পার্টিতে সঞ্চারিত হয়েছে এক নতুন জীবনীরস। …দলনেতার উপরের আসনে সসম্মানে সমারোহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নতুন দলনেত্রী। …নারী প্রলয়ঙ্করী। আবার নারীই প্রাণশক্তি। নারীই প্রেরণার উৎস, কর্মের উৎসাহ।

বহু ক্ষেত্রে অবশ্য দেখা যায় সংঘ সমিতির এই প্রেরণাদায়িনীই নেতার অথবা দলের কারও হৃদয়লোকের প্রেরণাদায়িনী হয়ে বসে প্রমাদ ঘটায়, বিপত্তি আনে, দল ধ্বংস করে। …এক্ষেত্রে সে ভয়ের প্রশ্ন নেই।

বড় সম্ভ্রমের আসন পেয়ে গেছেন দলনেত্রী!

এক এক সময় চন্দন আক্ষেপের সুরে বলে, তোর মধ্যে এত শক্তি ছিল দিদি, কী অপচয়ই হয়েছে এতকাল।

দিদি বিষণ্ণ ঔদাস্যের হাসি হেসেছে, হয়তো বা ছিল না শক্তি। এতকাল ধরে আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছে। …অত্যাচারই শক্তির জন্মদাতা, এ কথা তো তোদেরই কথা।

বাবা বেঁচে নেই, মা আছেন, মেয়ের সঙ্গে কথা কইবার প্রবৃত্তি হয় না তাঁর। তাঁর অথবা কালের চিরকালীন সংস্কার, চিরকালীন মূল্যবোধের উপর তীব্র আঘাত হেনে, মেয়ে যা অবিশ্বাস্য আচরণ করেছে, সেটা বরদাস্ত করা তাঁর পক্ষে কঠিন।

.

কিন্তু সেই দেবীপুর মৌজায় কী ঘটছে?

তার কী খবর? সেখানে কি আজও এই পরিবর্তনের ঢেউ এসে ধাক্কা মারেনি? সেখানে কি এখনও একটা বিরাট দম্ভের মূর্তি চুনট করা পঞ্চান্ন ইঞ্চির ধুতি, গিলে করা মিহি আন্দির পাঞ্জাবি, বার্নিশ করা পাম্প শু আর আট আঙুলে আটটা ঝিলিক হানা আংটি পরে মধ্যযুগীয় চেহারাখানি নিয়ে রুপোর আলবোলায় তামাক টানেন, এবং দুপা এগোতে হলেই রুপোর পাতমোড়া শৌখিন পালকিটিতে চড়ে বসেন?

পরিবর্তনের ঢেউকে ঢুকতে দেননি বলে এখনও কি তাঁর কাছারি বাড়িতে বেয়াড়া প্রজাকে শায়েস্তা করতে বটাই পাইক কোঁড়া হাতে বিশেষ একটা সুর করে করে বলতে থাকে, এই এক!… এই দুই এই তিন…বল ব্যাটা এখনও বল…বলবি না? তবে এই নে, এই চার…।

কিন্তু তাই কি?

সব আইন দ্রুত কার্যকরী হয় না বটে, হয়তো কিছু কিছু কোনওকালেও হয়ে ওঠে না, তবে কেড়ে নেওয়ার আইনটা দ্রুতই কার্যকরী হয়। চাষিদের কী হল না হল, গ্রামের কী কী উন্নয়ন হল, সে হিসেব চাইতে গেলে মুশকিল। তবে জমিদারদের জমিদারগিরির বিলোপ সাধন হয়েছে বইকী! হচ্ছে, হয়ে চলেছে।

দেবীপুর মৌজাও তার আওতায় পড়েছে। না পড়ে যাবে কোথায়?

রাজাবাবুদের বৃহৎ প্রাসাদটাকে হাসপাতাল বানাবার পরিকল্পনা রেখেছেন সরকার। দখল নেবার কাজের সূচনায় আজ চলছে নিলামের ডাক।

নিলামদার আমিনবাবু বারবাড়িতে বড় হলের সামনের টেবিলটার উপর কাঠের হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে দ্রুত উচ্চারণ করে যাচ্ছে..এক…দুই…তিন…বড় গালচে চারখানা….দুশো, তিনশো তিনশো….তিনশো– সাড়ে তিনশো, বালুরহাটের আসরফ মিঞা! জোড়া পালঙ্ক ছখানা…দুশো দুশো দুশো….পাঁচশো…পাঁচশো, তাজপুরের কাঠগুদামের মালিক নবীন পাল। ঠক ঠক ঠক আলমারি একলট ছোটয় বড়য় বারোটা…চোদ্দশো পনেরোশো–এক, দুই, তিন…মালদহের বদর আলি।…দেয়ালঘড়ি তিনটে… দেড়শো… দেড়শো… দেড়শো… দুশো, তেজেশচন্দ্র হাই স্কুল। …দর উঠছে না। নামছি!

.

প্রথমদিকে যাওবা পদস্থ দরে যাচ্ছিল, শেষের দিকে জলের।…চলে যাচ্ছে আয়না আলনা বাক্স, সিন্দুক চেয়ার, টেবিল আরামকেদারা, ফুলদানি, পাথরের পুতুল। …আরও কত কী! এক জায়গায় স্তূপাকার ওই মালগুলোকে দেখলে এখন কল্পনা করা শক্ত এতদিন ধরে এরা এই প্রাসাদের শোভা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এসেছে, দিয়েছে চাকচিক্য। আর আড়ম্বরময় আরাম আয়েসের স্বাদ।…

আশ্চর্য। এত তাড়াতাড়ি এমন ধূলিধূসরিত হয়ে গেল কী করে এরা?

 জিনিসের শেষ নেই। পুরুষানুক্রমে জমিয়ে তোলা প্রয়োজনীয় আর অপ্রয়োজনীয় বস্তুপুঞ্জের বিরাট ভার।

তবু তলে তলে বহু ভার লাঘব করে ফেলেছেন বিদায়ী আশ্রিত আত্মীয়কুল, নানা পর্যায়ের কর্মচারীকুল, চিরস্থায়িত্বের আশাপোষণকারী আর বর্তমানে হতাশ দাসদাসীকুল।

সংখ্যাহীন বাসনপত্র বিছানা কম্বল পোশাক কাপড় শাল দোশালা এ সবের কঙ্কালসার দু-চারটে স্মৃতিচিহ্ন ছাড়া আর সব কিছু দেখা যাচ্ছে চলে যাচ্ছে, আয়না আলনা বাক্স সিন্দুক চেয়ার-টেবিল আরামকেদারা… না। মেলাবেই বা কে? মালিক কোথায়? কে জানত কী ছিল না ছিল এদের।…

জানতেন শুধু মানদা কোম্পানি। তা তাঁরা তো আর এই ধ্বংসযজ্ঞের দর্শক হতে উপস্থিত নেই? কদিন আগে বিদায় নিয়েছেন বুক চাপড়াতে চাপড়াতে। গিয়ে পড়েছেন বড় বোনের বাড়ি জলপাইগুড়িতে। বড় বোনের ছেলে নিজে এসে সযত্নে নিয়ে গেছে তাঁদের, বেশ কয়েকটা গোরুর গাড়ি মহিষের গাড়ি এনে মালপত্র বোঝাই দিয়ে। সারাজীবন ছিলেন এঁরা, একদা রাজকন্যাই ছিলেন, নিজস্ব সম্পত্তি ছিল না তাঁদের?

এইভাবেই তো এক জায়গার জল আর এক জায়গায় গিয়ে জমে। একদা যা ঐশ্বর্যের পরিচয় বহন করে দৃশ্যমান হয়ে থাকে, তা চোরাপথের গলিখুঁজিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। একে অপরকে দোষারোপ করে। কুলদেবীর মন্দিরের সমস্ত ঠাটবাট বাসনপত্র, একপো ঝাড়ের প্রদীপ মকরমুখো চামর, সবই তো ছিল নিখাদ রুপোর, তার চিহ্ন কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে?… কখন কোন ফাঁকে কার হস্তক্ষেপে অন্তর্হিত হয়ে গেছে সে সব কে জানে!

কিছু তামা-পিতলের সাজসজ্জা নিয়ে নিত্য সেবার ঠাটটা অবশ্য বজায় রেখেছেন সেবাইত মশাই। এই পর্যন্ত। জমিদারিত্ব বিলোপ সাধনের সময় সরকার থেকে তাদের ভিটেমাটি কাছারিবাড়ি, বাগানবাড়ি, সব কিছু দখল করে নিলেও, দেব-মন্দিরগুলিতে হস্তক্ষেপ করা হয় না। বিগ্রহরা কিছু নিগ্রহ সহ্য করেও, কর্তৃপক্ষের অনুগ্রহে, নিজ আসনে রয়ে যান।

লাহিড়ীদের কুলদেবীও রয়ে গেছেন।

 চলে যাবার সময় সবাই একবার করে প্রণাম ঠুকে ঠুকে গেছে। নির্দয় নিষ্ঠুর অত্যাচারী উগ্র দাম্ভিক হলেও শেষ লাহিড়ী রুদ্রপ্রসাদ তো ছিলেন বটবৃক্ষের তুল্যই।…সে বৃক্ষ অবশ্য রোপণ তিনি করেননি, কিন্তু কুড়ুলের ঘায়ে উড়িয়েও তো দেননি।..যথেচ্ছ ঝুরি নামতে দিয়েছেন, আর অসংখ্য বিচিত্র পাখিদের বাসা বাঁধতেও দিয়েছেন।

হয়তো স্নেহ সদয়তায় উদারতায় নয়, অগ্রাহ্যে ঔদাসীন্যে অহমিকায়, তবু বাসা তো বেঁধেছিল পাখিরা।… সেই বৃক্ষ উপড়ে পড়ে গেল সমূলে। যাদের বাসা গেল তারা তো বুক চাপড়াবেই। তবুযতটা পেরেছে সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে ভবিষ্যৎ বাসার জন্যে খড়কুটো…

রাজাবাবু আর রানিমার পালঙ্কের বাজুর উপর যে রুপোর পাত মোড়া ছিল, সেগুলো কি রেখে যাবে তারা? রেখে যাবে রুপোর পানের ডাবর, আলবোলা, পিকদানি?… রুপো রুপো… চারদিকেই তো রুপোর ছড়াছড়ি। খাবার বাসন ব্যবহারের দ্রব্য।

ওটাই শখ ছিল শক্তিপ্রসাদের আর তস্য পিতা পিতামহর। রুদ্রপ্রসাদ খুব কিছু বাড়াননি। বাদে নিজের ব্যবহারের পালঙ্কটি।

আচ্ছা সেটাকে কে নিলামে ডেকে নিল?

কেউ না।

সেটা সরকারের খাসে জমা পড়েছে। ভবিষ্যতে কোনও একদিন অন্তর্হিত হবার অপেক্ষায় দিন গুনবে আর কি।… আরও তো কত কীই পড়ছে খসে। সকলেরই ভবিষ্যৎ একই। রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্তরা কতদিন আর টেনে চলবেন সে দায়িত্ব? হয় নিজেরাই ভক্ষণ করে ফেলে কাজ সহজ করে ফেলবেন, নয় নির্লিপ্ত ঔদাস্যে ভক্ষিত হতে দেবেন।

অধিকাংশ ছোটখাটো জিনিস, নামে বেনামে ডেকে নিচ্ছেন কর্মচারীরাই।… একা–আমিনবাবুরই তো চার সম্বন্ধী, পাঁচ বোনাই নটা ভাগ্নে। তা ছাড়া শালাপো শালিপো আরও কত কে। সমাজবদ্ধ মানুষের আত্মীয় সম্পর্কের মাত্রা তো বহু পুষ্পে গাঁথা।

বৃহৎ জমির মালিকরাও তো আইন বাঁচিয়ে বহু নামে বেনামে জমিগুলোকে বজায় রাখছেন।…

ছোটখাটো জিনিসগুলোর প্রতিই আকর্ষণ দেখিয়েছে ক্রেতারা।

কে নিতে যাবে বড় বড় ঝাড়লণ্ঠন?

 বাগানের পাথরের স্ট্যাচু?

বৃহৎ বৃহৎ অয়েল পেন্টিং?

সোনা-রুপো কাঁসা পেতল কাঠ কাপড়-চোপড়ের মানে আছে। ভেঙে কেটে ফেঁড়ে গড়ন বদলে। নিজের মাপে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু কাঁচ? পাথর? কাগজ? ছবি?

ওর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তাই কোনও মানে নেই।

আইন অনুসারে বড় কাছারিতেও হাত পড়েছে।

নিলাম হয়ে গেছে চৌকি, টেবিল, বেঞ্চি, টুল থেকে শুরু করে হাঁড়ি, কড়াই, ডেকচি, গামলা, বালতি, পরাত, শতরঞ্জ, ফরাস, ভারী ভারী কাঁঠাল কাঠের সিঁড়ির বোঝা।… আর গেছে ডজন ডজন মোটাসোঁটা; অ্যাসিটিলিন গ্যাসবাতি, পেট্রোমাক্স, বাতিদান।

কাছারিবাড়িটা তো এক রকম ভাঁড়ার জমিদারবাবুদের। কাজেকর্মে উৎসবে অনুষ্ঠানে এ ভাঁড়ারে হাত পড়ে।

নিলামের পর ভাঙা হচ্ছে বর্তমান দখলদারের মতে অকেজো অংশগুলো। পাকাদালানের সংলগ্ন করোগেট ছাওয়া ছোট ছোট ঘরের সারি। যেখানে আস্তানা ছিল গরিব দুঃখী, পাইক পেয়াদাদের।…তারা চলে গেছে বাস্তুহারা হয়ে।

দমাদ্দম ঘা পড়ছে গাঁইতি শাবল হাতুড়ির।

খুলে খুলে পড়ছে চাল, খসে ধসে পড়ছে দেয়ালের ইট, সুরকি, শালের খুঁটি, লোহাকাঠের ফ্রেম, বরগা!

মালবাহী গোরুমোষের গাড়িগুলোর চলছে পৌষমাস।

সব মাল চলে গেলেও ধেয়ে আসে উঞ্ছবৃত্তিজীবীরা। তারা বস্তা ভরে ভরে নিয়ে যায় তলানি কুড়িয়ে কুড়িয়ে।

অবশেষেও আসে আরও কেউ।

ভুজঙ্গ গোয়ালার অকালবৃদ্ধা বউ টগর আসে। ঝড়তি পড়তি বাঁশ বাখারি কাঠের গরাদে জানলার ফ্রেম ভাঙা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গোয়াল মেরামত করবে বলে। মরা হাজা তিনটে গোরু সার হয়েছে গোয়ালে, তবু তারাই তো পুষছে টগরকে তিনটে ছেলেমেয়ে সমেত।

ছেলেমেয়ে তিনটেও আসে তাদের ভিখিরির অধম চেহারা নিয়ে। মহোল্লাসে কুড়িয়ে নিয়ে যায় কোণে খাঁজে পড়ে থাকা কলঙ্ক ধরা দুটো পয়সা, জড় হয়ে থাকা চারটি জ্বালানি কাঠ, কটা কেরোসিনের কুপি, আরকুলুঙ্গির মধ্যে বসে থাকা সিঁদুর মাখা গণেশখানা।

ওটা নিয়ে যায়নি ব্ৰজেন বাড়রি।

 বলেছে–খুব সিদ্ধি তো করলি বাবুদের, তোকে আর ঘরে নে যেতে চাইনে বেটা। থাক পড়ে।

তবে নিজের তার সিদ্ধির অভাব ঘটেনি। সর্বসিদ্ধিই ঘটেছে।…তার পরিবার তাকে যতই গঞ্জনা দিক, চোর বেইমান মহাপাপী বলে, তাঁর কিছু এসে যায় না। ব্ৰজেন বোঝে না চিরকাল যেখানে জীবনপাত করল সে, সেখানের মালপত্তরে তার কিছু অধিকার থাকবে না, সর্বস্ব গ্রাস করবে উড়ে এসে জুড়ে বসা স্বরাজ গরমেন্ট? এ আবার কী? গোরাদের আমলেও তো এমন অরাজকতা ছিল না। যাক, এই মওকায় কে না আখের গুছোচ্ছে? ব্ৰজেনই বা বোকা বনে বসে থাকবে কেন?

আর একটু হলেই জান-মান সবই তো চলে যাচ্ছিল।

 ভগবানের কারসাজিতে চাকা উলটে গেল।

কাছারি বাড়ির সব জঞ্জালই উদ্ধার হচ্ছে।

দ্রুতই হচ্ছে। কিন্তু সেই হাতিটার কী হল? সেই বুড়ো হাতিটা? সেটাও জঞ্জালের শামিল হয়ে কাছারি বাড়ির পিছনে মালখানার জায়গা জোড়া করে বসে থাকত! ব্রজেন নাম দিয়েছিল জরদগব!

অপচয় নিবারণকল্পে রুদ্র লাহিড়ী নামের নিষ্ঠুর অহংকারটা, যাকে গুলি করে শেষ করে ফেলবার সংকল্প করেছিল। সেই জরদাবটা কি এখনও অপচয়ের ইতিহাস রচনা করে চলেছে? না কি কেউ তাকে নিলামে ডেকে নিয়েছে?

নিলামেই ডেকে নিয়েছে একজন।… চড়া দরই দিয়েছে বলতে হবে। সেই দরটা থেকেই তো– শক্তিপ্রসাদের আদরের ঐরাবতের সম্ভম বজায় থাকল। কেউ তাকে চিরকালের বাসস্থান থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে অবমাননার আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে পারল না। হঠাৎ একদিন দেখা গেল ঐরাবতের মুখের চারধারে মাছি উড়ছে। তার একমাত্র যে কাজ ল্যাতপেতে দুখানা কান নেড়ে মাছি ওড়ানো, সে কাজেও ইস্তফা দিয়েছে সে। বিরাট একটা যুগের অবসান সংকেতের শেষ ঘণ্টাধ্বনিতে হাত লাগিয়ে গেল ঐরাবত। দিয়ে গেল সমাপ্তি সংগীতের সুরে ঠেকা।

হাসপাতাল থেকে আর ফেরেনি ভুজঙ্গ। সেখানেই মরেছে। তার জমজমাটি গোয়ালটা প্রায় শূন্য হয়ে এসেছে। গোয়ালের চালা খসে পড়েছে।… তবে তার কাকা বিহঙ্গর এখন খুব বোলবোলাও। ছেলেরা ঘি মাখনের ব্যবসা করে কেঁপে উঠেছে। উঠবে না কেন? এখন তো আর লুকিয়ে চুরিয়ে মানে ভেজাল মিশাতে হয় না। এখন ভেজালের ঢালাও কারবার।

দালদা বনস্পতি বলে যা একখানা মাল উঠেছে বাজারে। প্রথম প্রথম লোকে তার নিন্দামন্দ করেছে। এখন আর সে প্রশ্ন ওঠে না। নতুন গরমেন্টের আমলে ঘোষণা হয়েছে ওই জিনিসটিতে চোখের জ্যোতি বাড়ে, হার্টের অসুখ সারে, পেটের পিলে উবে যায়, জীর্ণ লিভার চাঙ্গা হয়। তবে? আবার ভয়-টা কী?

ব্যবসা ব্যবসা করে ছেলে দুটো অকালে বুড়ো হয়ে গেছে। তাদের মার অবস্থাও তথৈবচ। হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেছে নন্দরানি।

পয়সার মুখ দেখা মাত্র দুটো ছেলেরই বিয়ে দিয়ে বসল বিহঙ্গ, আর কে জানে কোন রহস্যে বউ দুটো এসেই কেমন গিন্নি হয়ে উঠল। হয়তো দলভারী হওয়ায়। চিরদিনের দাপুটে নন্দরানি যেন কোণঠাসা হয়ে গেল।

এখন নন্দরানির যদি সংসার থেকে কাউকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে, তো বউদের চোখ আড়াল করে লুকিয়ে চুরিয়ে দিতে হয়।… দেখতে পেলেই তো লক্ষ্মীছাড়িরা স্বামী শ্বশুরের কানে তুলবে শাউড়ি সব্বস্ব দান খয়রাত করছে।

দেবার ইচ্ছে আর কাকে কী? মন পোড়ে ওই ভুজঙ্গর ছেলেমেয়ে তিনটের জন্যে, আর টগর বউটার জন্যে। সুযোগ পেলেই রাঁধা ভাত, কাঁচা চাল ডাল, অড়র কলাই গুড় ছোলা, মায় পান্তো আমানি যা পারে বয়ে নিয়ে টগরকে ধরে দিয়ে, তার গোবর ল্যাপা উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে, আপন দুঃখের গাথা গায় নন্দরানি আর গলা নামিয়ে বউদের গাল পাড়ে। টগর বুঝ দেয়।

একদা যে টগরের সঙ্গেই হাড়াই ডোমাই ঝগড়া করেছে, সে কথা আর দুজনের কারুরই মনে থাকে না।

হঠাৎ হঠাৎ কোনও সময় এমন বাক্যও উচ্চারণ করে বসে নন্দরানি, ব্যাটার বউ ঘরে আনা আর স্বেচ্ছায় খাল কেটে কুমির আনা সোমান, বুজলি রে টগরবউ।

টগর খুড়শাশুড়ির মাথার উকুন বাছতে বাছতে মলিন গলায় বলে, তাও ভাল খুড়ি। ব্যাটা বাঁচবে, জোয়ান লায়েক হয়ে উটবে, তবে তো বউ ঘরে আসা।

নন্দরানি তখন মনে মনে ছেলেদের নামে ষাট ষাট করে নিশ্বাস ফেলে বলে, সে তো নিয্যস। অ্যাকোন ভাবি হতভাগাডারে যদি তোর ঘরে পেইটে না দে খড়ের গাদার উপরই থুয়ে আকতুম। তাঁলে অ্যাসেন বেগোরে পেরাণডা যেতনি। বাগের ঘরে ঘোগ নুকোতে গেলি তুই।

টগর নীরবে কপালে হাত ঠেকায়।

আবার কোনও এক সময় ভুজঙ্গর প্রসঙ্গ ওঠে, টগর বলে, কাঁচারি বাড়িডায় যদি কেউ আগুন ধইর্যে দেতো, তো বুকের জুলুনি কমতো।…ওরে মা রে আঁদা ভাত কড়া নে সবে বসেছিলো। নায়েবের নোক নড়া ধরি তুলি নে গ্যালো। আর বাড়ি ফেরলনি মানুষ!

খুড়শাশুড়ি সান্ত্বনা দিতে বলে, বলচে নাকি কাঁচারিতে ইস্কুল পাটশালা বসাবে। তো পাপ কাটবে ইট কাট গুলানের।

টগর এ কথার উত্তর দেয় না। কী হবে ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে? অত পাপ, অত সামান্যয় কাটে?

তবে এ কথা নিয়ে মাথা ঘামায় পাড়ার বুড়োরা। ছিরু মণ্ডল বিড়ি টানতে টানতে ধিক্কারের গলায় বলে, থানায় থানায় ইস্কুল বসাবে গরমেন্ট। রাজা করি দিবে আমাদের। ছাওয়াল পোয়ালগুলা নেকাপড়া শিকে জজ মেজিস্টেট হইয়ে বাপদাদার দুকু ঘোচাবে! হুঃ. নেকাপড়া শিকে, পেন্ট্রল পরতি শিকবে, বাডসাই ফুকতি শিকবে, নেংটি পরা বাপজেটাকে ঘিন্না করতি শিকবে। ব্যাস!..।

বনমালী পাঠক হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে বলে, শুনচি নাকি ইর পর বাপ মায়ের আর বাপ মা ডাকবেনি, ছোঁড়ারা বলবি ফাদারমাদার।… পাটির বাবুরা তো আবার মনসার ঠাঁই ধুনোর ধোঁয়া দেচ্চে।…সিদিনকে দেখি জেবন পালের নাতিডা হাটে মোড়ে উচ্চ গলায় বলতেছে–চেরডাকাল চাষিবাসীরাই বা বড়মানুষের গোড়ের তলায় থাকবি ক্যানো? তারা মনিষ্যি না? তারা এই পিথিমীর কেউ না?…বেশ হইচে বাবুদের পতন হইচে। এই লাইডীবাবুডারও উচিত সাজা হইচে। চেরডাকাল পেরজাদের ঘানির বলদের তুল্যি ঘুইরে ঘুইরে তেল আদায় করিচো। অ্যাকোন নিজেই ঘানি ঘোরা।… মুকি য্যানো খই ফুটতিচে চ্যাঙড়াডার!

কিন্তু খই ফুটলেও, খইটা মিথ্যে নয়। অভিসম্পাতেরও নয়। ..সত্যিই এখন ঘানি ঘুরিয়ে চলেছেন রুদ্রপ্রসাদ লাহিড়ী। খোয়া ভাঙছেন, নারকেল ছোবড়ায় দড়ি পাকাচ্ছেন।

দীর্ঘমেয়াদী সশ্রম কারাদণ্ড! যার ডাকনাম যাবজ্জীবন।

ভাগ্যের বোলবোলাও দাতা শুভ গ্রহরা বিদায় নেবার প্রাক্কালে কিনা দুদুটো খুনের আসামি হয়ে গেল লোকটা। …একটা কেস কাছারিবাড়ির অত্যাচারজনিত নিহত ভুজঙ্গ গোয়ালা, আর অপরটা তার দশ বছরের ছেলে গোবিন্দ। যাকে স্বয়ং খুন করেছেন রুদ্রপ্রসাদ হাতে করে।

ভুজঙ্গরটা অবশ্য ঠিক খুন বলে গণ্য হল না।…হাসপাতাল থেকে মন্তব্য করেছেল ক্ষতজনিত মৃত্যু। কাজেই ওটা নাকচ। তখনও সেই মন্তব্যই করেছিল। কারণ তখনও রুদ্রপ্রসাদ লাহিড়ী হাজতে ঢোকেনি। তখনও ভয় রয়েছে মনের কোনায় কোনায়। তা ছাড়া–ওই অত্যাচারটা তাঁর আদেশফল মাত্র, প্রত্যক্ষগোচর নয়।…ওটা টিকল না। কিন্তু তার ছেলে গোবিন্দ? যাকে নিজের হাতে গলা টিপে হত্যা করেছেন রুদ্রপ্রসাদ? আট আঙুলে আটটা হিরের আংটি পরা শুভ্র সুন্দর সুঠাম হাত?…সেটাকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না? প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী যে স্বয়ং রানি সরমাদেবী লাহিড়ী।

নালিশ তো তিনি এনেছিলেন। তিনিই পেশ করেছিলেন চোর সন্দেহে আকস্মিক ক্রোধের খুন নয়, পরিকল্পিত খুন। খুন করার জন্যে খুঁজে বেড়িয়েছেন ওকে মাসখানেক ধরে, হাজার টাকা বকশিশ ঘোষণা করেছেন গ্রাম জুড়ে। সাক্ষী আছে অনেক।…জুটেছিল সাক্ষী। আর ভয় কী? হাতি তো হাবড়ে পড়ে ধুকছে। ফিরে এসে কোনওদিন আর প্রতিফল দিতে বসবে না তো!

ধূপগুড়ির অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিকও স্বীকার পেল, গোবিন্দ নামের ছেলেটার খোঁজে দেবীপুর মৌজা থেকে লোক এসেছিল বটে। তবে তখন তো সন্দেহের কিছু ছিল না, বলেছিল অন্য কথা।…

.

দীপ্তিপ্রসাদের সহিস বুড়ো কাসেম আলিকেও সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। সে বলেছিল– হ্যাঁ–গোবিন্দর কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল খোকা রাজাবাবুর উপর। তবে এও হলফ করে বলেছে সে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোবিন্দর ইশারায় নয়, খোকাবাবুর চাবুক খেয়ে। গোবিন্দ তো তখন হাওয়া।…

রানি সরমাদেবী নিজে এসে দেখা করে বলেছিলেন, বুড়ো বয়েসে ধর্ম খুইয়ো না কাসেম। যা বলবেধর্ম আর সত্যের মুখ চেয়ে বলবে।

কাসেম একবার তাদের রানিমার অনবগুষ্ঠিত নিরাবরণ মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, তাতে কি গয়লার পোর প্রাণ ফিরে আসবে মা?

সরমা শান্ত গলায় বলেছিলেন, এ বললে তো পৃথিবীতে কখনও খুনের বিচার হয় না বাবা।

আচ্ছা মা।

তা ছাড়াও পরে তো আরও গুরুতর দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী জুটে গিয়েছিল।… ছিল মালদহের বিখ্যাত ব্যক্তি চন্দন সান্যাল, ছিল জনা তিনেক পুলিশ। আর সরমা লাহিড়ী তো ছিলেনই।…

.

নিঃশঙ্ক রুদ্রপ্রসাদ স্থির করেছিলেন, সরমা ওই ভীতিকর দৃশ্যের সামনে এসে পড়ার আতঙ্কে আর নিজের ঘরে ফিরে আসেননি, আশ্রয় নিয়েছেন গিয়ে নীচের তলার অন্দর মহলে, পিসিদের কাছে।… আর স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলেন–ওই শুকনো লাশটাকে, তাঁর বাদশার রক্তে রঞ্জিত ভূমিতে পুঁতেই ছাড়বেন।… তাই নীল শাড়ি জড়ানো পুঁটলিটা আগের মধ্যরাত থেকে পরের দিন মধ্যরাত পর্যন্ত থেকেছিল সরমার পালঙ্কের তলায়।

অতঃপর গভীর রাতের অন্ধকারে উপযুক্ত বাহক জোগাড় করে স্নানের ঘরের পিছন সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে আমবাগানে লাশ শুইয়ে রেখে কবর খোঁড়াচ্ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ তার জন্যে।

সেই মহামুহূর্তে সেই কবর ক্ষেত্রে এসে হাজির হয়েছিলেন রানি সরমা দেবী। আর পুলিশ, সঙ্গে চন্দন সান্যাল।

লাশ? খুঁজতে হয়নি।

সে তো পচে উঠে নিজেই নিজেকে ঘোষণা করছিল।

 রানি সরমা স্থির গলায় বলেছিলেন, এই সেই গোবিন্দ। ওকে ওদের রাজাবাবুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে দাসী সাজিয়ে নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলাম। পারিনি বাঁচাতে।

.

আদালতে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর চরিত্রে কটাক্ষপাত করে হত্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ, উকিলের ধমকে টেকেনি।…পূর্ব ইতিহাস তাঁর বিরুদ্ধে। আর লাশ টার বয়েস এবং চেহারা, দুই-ই তাঁর ওই নির্লজ্জ উক্তির গায়ে ধুলো দেবার মতো।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসানের মুখে, এক অত্যাচারী জমিদারের এই অত্যাচারের উদঘাটন প্রবল তোলপাড় তুলল, সমগ্র অঞ্চল জুড়ে। সেই তোলপাড়ে বহু লোক ছিছিক্কার করল রানি সরমা লাহিড়ীকে। আবার কিছু লোক তাঁর সাহস আর সত্যবোধকে সাধুবাদ জানাল।

বহু লোকের ব্যাপকতা বেশি।

সরমা চন্দনের মা, বললেন, ও মেয়ের মুখ আর দেখব না আমি। আঠারো বছর ঘরকরা স্বামীকে যে মেয়ে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে লড়ালড়ি করতে পারে, সে মেয়েকে নিজের সন্তান বলে ভাবতে ঘৃণা আসছে তাঁর।… হোক–যতবড় অধার্মিক, তবু সে তোর স্বামী! আর তুই হিন্দু নারী।

.

অতএব বাপের বাড়িতে বাসা জোটেনি সরমার।

সে যাক। …মামলাটা–

তুমুল তোলপাড় জাগিয়ে বিরাট আলোড়ন তুলে ফাঁসির হুকুম হয় হয় করে, শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়ে শান্ত হল। পূর্বতন বহু অত্যাচারের আর খুনের নজির তোলা হলেও প্রত্যক্ষগোচর তো নয় সেসব।… আর যদিও খুন বলেই প্রমাণিত হল, তবু আসামির স্ট্যাটাস আর নিহতের মূল্য বিবেচনা করে ফাঁসিটা রদ হল।

চন্দন সান্যাল আর তার পার্টি বলল, আদালত তো বড়লোকের গায়ে সহজে হাত দিতে যায় না। ফাঁসি হওয়াই উচিত ছিল ওর।

সরমা অদ্ভুত একটু হেসে বলল, তা সত্যি, শুধু তো ওই একটা খুনই নয়। সারাজীবন ধরে কত খুনের হুকুম দিয়েছে। লাশ পাচার করিয়েছে, তার তত হিসেব নেই। তবু–ফাঁসির হুকুম হয়নি দেখে খুশিই হয়েছি রে চন্দন।

অন্যরা কিছু বলল না।

শুধু চন্দন কড়া গলায় বলল, তা তো হবিই। যতই সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখাস, আসলে তো সেই হিন্দুনারী! সেই পতি পরম গুরু।

সরমা আর একটু হাসল।

বলল, তা ঠিক নয় রে! ফাঁসি হলে তো ফুরিয়েই গেল। প্রতি ক্ষণ প্রতি মুহূর্তে সেই হতভাগা খুন হয়ে যাওয়াগুলো তো তা হলে ওর সামনে এসে এসে দাঁড়াবার উপায় পাবে না আর?… বুঝিয়ে দিতে আসতে পারবে না জীবনের কত দাম। আমার তো চিরকালই মনে হয় ফাঁসিটা ভুল চিকিৎসা।

ভুল চিকিৎসা? আর তারপর? যখন পনেরো বিশ বছর পরে, আবার গারদ থেকে বেরিয়ে আসবে? তখন তো তার সর্বপ্রথম কাজ হবে–আর একটা খুন করার?…আবারও স্রেফ গলা টিপে। তাই নয়?

সরমা হেসে বললেন, তখন তো তুই রইলি উচিত চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্যে।

শুনে সুখী হলাম। তা সেই অনুতাপানলে দগ্ধ বন্দি পশুরাজকে দেখতে যেতে চাস তো বল! কালকে আমরা বহরমপুর যাচ্ছি।

বহরমপুর জেলেই বন্দি আছেন রুদ্রপ্রসাদ।

 সরমা ওর রাগে হাসেন।

আর তারপর বলেন, না। বরং মাঝে মাঝে একবার দেবীপুরেই গেলে হয়।

দেবীপুরে?

হঠাৎ চুপ করে যায় চন্দন।

চন্দন জানে, কেন এখনও দেবীপুরে যেতে চায় দিদি। আমবাগানের ধারে দীপ্তিপ্রসাদের রক্তস্মৃতিজড়িত সেই রেলিং ঘেরা জায়গাটায়, যেখানে গোবিন্দর জন্যে কবর খোঁড়া হচ্ছিল, সেখানে সরমা একটা গাছ পুঁতে এসেছেন। অমর বৃক্ষ বকুল ফুলের গাছ।…সরমা দেখতে যান গাছটায় ফুল ফুটল কিনা। …দীপ্তিপ্রসাদের জন্যে এর থেকে আর কী ভাল উপহার রচনা করা যেত?

ঝরা বকুলের নম্র নিঃশব্দ মেহস্পর্শ ছাড়া?

যা মায়ের স্নেহস্পর্শের মতো শান্তির স্নিগ্ধতা বয়ে এনে দেবে সেই ভ্রান্ত শিক্ষার শিকার এক শিশু আত্মাকে।