৪. রাম কবিরাজ হাবুর সবকিছুই জানেন

রাম কবিরাজ হাবুর সবকিছুই জানেন। এই গঞ্জে তাকে শিশুবেলা থেকে বড় হতে দেখেছেন। দাসু রায়ের বড় আদরের একমাত্র ছেলে ছিল হাবু। বাবা-মার অত্যধিক আদর আর প্রশ্রয় পেয়ে অল্প বয়স থেকে বিগড়ে যায়। ইস্কুল পালিয়ে গোসাঁইবাগানে গিয়ে বখা ছেলেদের সঙ্গে বিড়ি ফুঁকত। তাই দেখে একদিন রামবাবু গিয়ে দাসু রায়কে বলেছিলেন, “ছেলেটার দিকে নজর দাও হে দাসু! বিড়ি ফুঁকতে শিখেছে যে!” দাসু কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধ। খেঁকিয়ে উঠে বলল, “যাও, যাও, নিজের কাজ করো গে যাও। আমার ছেলে তেমন নয় মোটেই। লোকে হিংসে করে যা-তা রটিয়ে বেড়াচ্ছে।”

একমাত্র ছেলে বলে হাবুর কোনো অভাব রাখত না দাসু। মাসে মাসে ওইটুকু ছেলেকে দশ-পনেরো টাকা করে হাতখরচ পর্যন্ত দিত। সেই টাকা পেয়ে হাবু আরো বিগড়োতে থাকে। ঘুড়ি, লাটাই, লাটু, লজেন্স দেদার কিনেও টাকা ফুরোত না। প্রায়ই বখাটে বন্ধুদের সঙ্গে ফিষ্টি করত, যাত্রা-সিনেমা দেখে বেড়াত। খুব ফুর্তিবাজ হয়ে গেল অল্প বয়সেই, ক্লাসের পরীক্ষায় গোল্লা পেয়ে বাসায় ফিরে কাঁদতে বসত। সেটা অবশ্য মায়াকান্না। ছেলের চোখে জল দেখে তার বাবা-মা এসে হাবুকে পারলে কোলে তুলে সান্ত্বনা দেয়। দাসু বলে বেড়াত, “আমার ছেলের মতো বুদ্ধিমান ছেলে দুটো নেই। কিন্তু পড়তে বসলেই তার চোখ ব্যথা করে। ভাবছি চোখের ডাক্তার দেখাব। সামনের বছর হাবু ক্লাসে ফার্স্ট হবে।”

দাসু যে খুব বাড়িয়ে বলত তা নয়, বাস্তবিক হাবু খুবই বুদ্ধিমান ছেলে ছিল। বখাটে হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে স্কুলে ফাস্টও হয়েছে।

যাই হোক, হাবুর যখন মোটে চোদ্দ বছর বয়স, তখন সে বাপের সিন্দুক থেকে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা আর মায়ের গয়না চুরি করে উধাও হয়ে যায়। সেই শোকে দাসু আর বেশি দিন বাঁচল না, হাবুর মাও বছর দুই বাদে চোখে ওল্টায়। তার বেশ

কয়েক বছর পর একদল ষণ্ডা-গুণ্ডা চেহারার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হাবু এসে গোঁসাইবাগানে থানা গাড়ল। তার তখন পেল্লায় চেহারা হয়েছে, চোখদুটো সব সময় রক্তবর্ণ, কাউকে গ্রাহ্য করে না। একে মারে, তাকে ধরে, তারটা কেড়ে নেয়। তারপর গঞ্জে এবং আশপাশের এলাকায় খুব চুরি-ডাকাতি আর খুন-খারাবি শুরু হয়ে গেল। সেই এক দুঃস্বপ্ন। কোনো তোক নিশ্চিন্তে রাস্তায় বেরোতে পারে না। সন্ধের পর রাস্তাঘাট নিঃঝুম হয়ে যায়। বাড়িতে থেকেও লোকের প্রাণ ধুকপুক করত।

হাবু নাকি মেলা মন্ত্রতন্ত্র শিখে এসেছে। গোঁসাইবাগানের কুঠিবাড়িতে সে নানারকম সাধনা করে বলে গুজব রটে গেল। অনেকের মুখে রাম কবিরাজ শুনেছেন যে, সন্ধেবেলা হাবুকে নাকি কখনো কখনো একটা প্রকাণ্ড বাঘের পিঠে চড়ে বেড়াতে দেখা গেছে। একজন বলল, সে স্বচক্ষে হাবুকে উড়ে বেড়াতে দেখেছে।

তখন গঞ্জের দারোগা ছিলেন নিশিকান্ত। নিশি দারোগা এক সময়ে খুব দাপটের লোক ছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর বয়স হয়েছে, রিটায়ার করতে যাচ্ছেন, তাই তিনি আর বেশি ঝুট ঝামেলায় যেতেন না। হাবুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েও লোকে ভয়ে থানায় গিয়ে নালিশ করত না। সে সময়ে রাম কবিরাজই উদ্যোগী হয়ে গিয়ে নিশি দারোগাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে হাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজী করিয়েছিলেন।

দিন দুই-তিন পরে নিশি দারোগা একদিন রামবাবুর দোকানে এসে হ্যাঁট খুলে হাঁপ ছেড়ে বললেন, “ওঃ মশাই, কী লোককেই ধরতে পাঠিয়েছিলেন! নাজেহাল করে ছেড়েছে।”

“কী রকম?” বলে রাম কবিরাজ নড়ে বসলেন। “আর বলবেন না। গোঁসাইবাগানে গিয়ে পুরো বাড়িটা ঘেরাও করে রেইড করেছিলাম। তখন হাবু আর তার দলবল বাড়ির ভিতরেই ছিল। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে দেখলাম সব ভোঁ-ভোঁ, কেউ কোথাও নেই।”

“সে কি?”

“তবে আর বলছি কী? চোখের সামনে অতগুলো লোক একেবারে গায়েব হয়ে গেল মশাই! বাইরে থেকে জানালা দিয়ে স্বচক্ষে দেখেছি, হাবুকে ঘিরে দশ বারোটা লোক বসে গাঁজা টানছে। ভাল করে বাড়িটা ঘিরে বাঁশি ফুকে রিভলবার-বন্দুক বাগিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে চেঁচিয়ে বললাম, হাবু, সারেন্ডার কর শিগগির! কিন্তু কাকে বলা? ঘরে হাবু আর তার স্যাঙাতদের চিহ্নও নেই। গুপ্ত কুঠুরি বা সুড়ঙ্গ আছে কিনা অনেক খুঁজে দেখলাম, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। একেবারে তাজ্জব ব্যাপার।”

শুনে রাম কবিরাজ ঘন-ঘন তামাকের নলে টান দিয়েছিলেন সেদিন। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল।

সেই থেকে হাবু গুণ্ডার নামে সম্ভব-অসম্ভব আরো সব গুজব রটতে লাগল। হাবু নাকি ভূত পোষে, মন্ত্রের জোরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, যে-কোনো মানুষকে চোখের দৃষ্টি দিয়ে হাওয়া করে দিতে পারে। হাবুর ভয়ে তখন সবাই থরহরি কম্প।

রাম কবিরাজ মন্ত্র-তন্ত্র বা ভূতপ্রেত মানেন। কিন্তু এসব বুজরুকিতে তাঁর বিশ্বাস নেই। তিনি জানেন, খারাপ লোক যতই মন্ত্রতন্ত্র জানুক আর যতই ক্ষমতাবান হোক, শুভবোধ এবং মঙ্গলের দ্বারা তাদের পতন ঘটবেই।

সেই থেকে রাম কবিরাজ নানা মতলব ভেঁজেছেন। হাবু অবশ্য রাম কবিরাজের এসব মতলব টের পায়নি। পেলে এসে হামলা করত।

নিশি দারোগা রিটায়ার করে চলে গেলে সে জায়গায় এক অল্পবয়সী এবং খুব তেজী দারোগা এল। তার নাম অয়স্কান্ত। মহা কাজের মানুষ।

সে গঞ্জে পা দিয়েই হাবু গুণ্ডার কথা শুনেছে। হাবু তখন সদ্য হরিহরপুরের জমিদারবাড়ি লুট; একটা ব্যাংক ডাকাতি আর দুটো বড় ধরনের চুরি করেছে। তাছাড়া খুন-জখম তো ছিলই। কিন্তু কেউ তার নামে নালিশ করতে যায় না ভয়ে। তার ওপর হাবুর বদনাম হওয়ার বদলে তার বেশ সুনামই হচ্ছিল। তার অলৌকিক ক্ষমতা, তার সাহস আর তার নামে প্রচলিত গালগল্প শুনে অনেকেই হাবুকে মনে-মনে পুজো করত। বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেরা তখন নিজেদের মধ্যে ‘হাবু-হাবু’ খেলে। একটু বড় বয়সের ছেলে-ছোঁকরারা অনেকেই তখন হাবুর দলে ভিড়বার জন্য গোসাঁইবাগানের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করে।

রাম কবিরাজ এবং তাঁর মতো আর যাঁরা সৎ আর স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন, তাঁরা দেখলেন, সমূহ সর্বনাশ! এরপর হাবুর খ্যাতি এত বেড়ে যাবে যে, পুলিসও তাকে ধরতে সাহস করবে না। অধর্মেরই জয় হয়ে যাবে। হাবুরও অহংকার আর বেয়াদপি খুব বেড়ে গেছে। সে রাজা-বাদশার মতো চলাফেরা করে। রাস্তার লোক তাকে দেখলে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়, বাজার-হাটে লোকে তাকে নমস্কার করে, একটু কথা বলতে পারলে বর্তে যায়।

অয়স্কান্তও কিন্তু খুব অহংকারী লোক। সে জানত, মফস্বল শহরে দারোগার ওপর আর কেউ নেই। সবাই বরাবর দারোগাকেই খাতির করে এসেছে। তাই হাবুর এত খাতির অয়স্কান্ত সহ্য করবে কেন? ব্যাপারটা তার সম্মানে খুব ঘা দিল।

তা, অয়স্কান্ত যখন হাবুকে জব্দ করার নানারকম ফন্দিফিকির আঁটছে, তখন একদিন এক অবাক কাণ্ড।

অয়স্কান্ত সন্ধেবেলায় তার কোয়াটারের বারান্দায় একা বসে বসে পূর্ণিমা দেখছে। এমন সময় রাস্তা থেকে ডোরাকাটা একটা প্রকাণ্ড বাঘ হেলতে-দুলতে ফটক পেরিয়ে সোজা উঠে এল। বাঘের পিঠে হাবু।

অয়স্কান্ত যদিও সাহসী লোক, কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে তারও প্রাণ উড়ুউড়।

হাবুর বাঘ দুর্গন্ধ ছাড়তে ছাড়তে এসে নোংরা মুখে অয়স্কান্তর। গা কল, গাল চেটে দিল। গরগর করে আদর জানাল।

হাবু অয়স্কান্তকে বলল, “দ্যাখো দারোগাবাবু, আমার সঙ্গে টক্কর দিতে চাইলে কিন্তু জান কবুল করে কাজে নামতে হবে। এ তো কেবল বাঘ দেখছ, আমার হাতিকে তো এখনো দেখনি! তাছাড়া আর যারা আছে তারা আরো ভয়ের সামগ্রী। কাঁচাখেগো অপদেবতা সব। চাকরি করতে এসেছ, চোখ বুজে চাকরি করে যাবে। মাস-মাইনে পেয়ে খাবে-দাবে ফুর্তি করবে, কেউ কিছু বলবে না। যদি কাজ দেখাতে চাও তবে কিন্তু বিপদের জন্য তৈরি থেকো।”

ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট বাঘের গায়ের ডোরা দেখা যাচ্ছে। বিটকেল গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। শ্বস গায়ে পড়ছে। অয়স্কান্তর নিজের চোখে দেখা, হাত দিয়ে ছোঁয়া ব্যাপার। কোনো ভুল নেই।

অয়স্কান্ত কথা বলতে গেল, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না। নড়তে গিয়ে দেখে হাত পা আড়ষ্ট।

হাবু মুচকি হেসে বাঘটাকে সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমি হলাম এ-তল্লাটের রাজা বলো রাজা, সদার বলো সদার, ভগবান বলো ভগবান। সবাই আমাকে একবাক্যে মানে। এরপর থেকে তুমিও মেনো।”

. সেই রাতেই অয়স্কান্ত উদভ্রান্তের মতো এসে রাম কবিরাজের কাছে হাজির। বলে, “কবিরাজমশাই, হাবু মানুষ নয়!”

সব শুনে রাম কবিরাজ ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেন। তারপর একটা খুব বলকারক পাঁচন অয়স্কান্তকে খাইয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি আগে একটু ধাতস্থ হও, তারপর অন্য কথা হবে?”

রাম কবিরাজ এমন সব আশ্চর্য পাঁচন তৈরি করতে পারেন, যা খেলে মানুষ-কে-মানুষ পর্যন্ত পাল্টে যায়। রাম কবিরাজের সেই পাঁচন খেয়ে অয়স্কান্তর ডোম্বল-ডোম্বল ভাবটা ঘন্টাখানেক পর কেটে গেল। তবু সে বলতে লাগল, “না কবিরাজমশাই, মিরাকলের সঙ্গে লাগতে যাওয়া ঠিক নয়। মানুষ যত পাজি বদমাশ হোক, তাকে ঢিট করতে ভয় পাই না। কিন্তু হাবু তো ঠিক মানুষ নয়।”

তা, তা-ই হল। অয়স্কান্ত বদলি নিয়ে চলে গেল। এল আর-এক তেজী দারোগা গদাধর।

গদাধর খুবই মজবুত চেহারার মানুষ। এক সময়ে নামকরা কুস্তিগীর ছিল। বয়সও বেশি নয়। তার আবার একটা বিশাল জামান শেফার্ড কুকুর ছিল।

গদাধর আসবার পরই গঞ্জের লোক বলাবলি করতে লাগল, হাবুর বাঘের জন্য নতুন পাঁঠার আমদানি হয়েছে! ছেলেরা ছড়া কাটতে লাগল, “গদাই দারোগা, হয়ে যাবে রোগা।”

গদাধরের কানে সবই গেল। হাবুর গুণকীর্তির কথাও সে এখানে আসবার আগেই শুনে এসেছে। গঞ্জে পা দিয়ে সে খুব বেশি কেরানি দেখানোর চেষ্টা করল না।

রাম কবিরাজের কাছে একদিন গভীর রাতে চুপি-চুপি এসে গদাই দারোগা বলল, “আমি আপনার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা জানতে চাই।”

রামবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “জেনে লাভ কী? কেউ কিছু করতে পারবে না। অনেকেই গঞ্জের বাস উঠিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে।”

তখন গঞ্জে আবার নতুন নিয়ম চালু করেছে হাবু। তার বাঘের খোরাকি বাবদ প্রতিদিন একজন করে গৃহস্থকে পাঁঠা, ছাগল বা কুকুর দিতে হয়। বাঘেরা নাকি কুকুরের মাংস খেতে খুব ভালবাসে। সেজন্য গঞ্জে যত রাস্তার কুকুর ছিল সব লোপাট হয়ে গেছে প্রায়! ওদিকে গোঁসাইবাগানে মিস্তিরি লাগিয়ে হাবুর জন্য প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ হাবুর তখন ভরভরন্ত অবস্থা।

গদাই দারোগা বলে, “আমি যে খুব কাজের লোক, তা বলছি না। তবে সাবধানী লোক। সব শুনেটুনে তারপর যদি কিছু করা যায় তা দেখব। আমাকে স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠানো হয়েছে এখানে।”

রাম কবিরাজ খুব আশ্বস্ত হলেন না। তবু সবই খোলসা করে বললেন। আর সাবধান করে দিলেন এই বলে, “দেখুন, এখানকার লোকজন কিন্তু সবাই হাবুর পক্ষে, কাজেই বিপদে পড়লে তারা আপনাকে সাহায্য করবে না।”

গদাই হেসে বলল, “বেশি লোকের সাহায্য চাই না। আপনার মতো দু-একটা পাকা মাথার তোক সাহায্য করলেই আমার হবে।”

রাম কবিরাজ বুঝলেন, গদাই দারোগা কুস্তিগীর ছিল বটে, কিন্তু তাতে বুদ্ধিটা নষ্ট হয়নি।

যাই হোক, দু-একদিনের মধ্যে হাবু গদাই দাবোগার পিছনে লাগল। একদিন সকালে দেখা গেল, গদাইয়ের অতি আদরের কুকুরটা লোপাট। খোঁজ খোঁজ! অবশেষে কুকুরটার মখমলের মতো গায়ের চামড়াটা পাওয়া গেল গোঁসাইবাগানের কাছে একটা জামগাছের তলায়।

গদাই দিন-তিনেক ভাল করে খেল না, ঘুমোল না। রাম কবিরাজ তাঁকেও একটা ভাল পাঁচন তৈরি করে পাঠিয়ে দিলেন।

গদাই দারোগার কুকুরটাকে মেরে হাবু চালে ভুল করেছিল। কুকুরটা ছিল গদাইয়ের প্রাণ। সেই কুকুরের মৃত্যুতে গদাই দারোগা হয়ে উঠল ‘গদাই বিভীষিকা’।

অবশ্য কয়েকজন জানে, গদাই দারোগার সেই মারমুখো মেজাজের পিছনে কবিরাজমশাইয়ের আশ্চর্য পাঁচনের কাজও আছে। রাম কবিরাজ এমন এক দুর্লভ গাছ-গাছড়ার পাঁচন তৈরি করে গদাধরকে খাইয়েছিলেন যে, তাতে মানুষের শরীরে যেমন দুনো বল হয়, তেমনি তার মেজাজও হয়ে ওঠে টংকার। আবার গায়ের জোর আর বদমেজাজ হলেই হয় না, ঠাণ্ডা মাথার কূটবুদ্ধিও খেলাতে হয়, নইলে হাবুর মতো ধুরন্ধরকে জব্দ করা সোজা নয়। তাই কবিরাজ মশাই আবার পাঁচনে এমন জিনিসও দিয়েছিলেন যে তাতে মাথা ঠাণ্ডা থাকে, বুদ্ধির হাওয়া-বাতাস খেলে।

কাণ্ডটা কী হয়েছিল কেউ ভাল জানে না, তবে হঠাৎ একদিন শোনা গেল যে, হাবুর পোষা বাঘটাকে পাওয়া যাচ্ছে না, চারদিকে খোঁজ খোঁজ। অবশেষে একদিন দেখা গেল থানার হাতায় গদাই দারোগার কোয়ার্টারের বাগানের বেড়ায় বাঘের চামড়াটা রোদে শুকোচ্ছে।

এই ঘটনায় গঞ্জে হৈ-চৈ পড়ে গেল। সবাই ভেবে নিল, হাবুর বাঘ যখন মরেছে, তখন গদাইয়ের আর রক্ষে নেই। তার মুণ্ডু কেটে নিয়ে শিগগিরই হাবু গেণ্ডুয়া খেলবে।

বাঘ গুম হওয়ার সময়ে হাবু গঞ্জে ছিল না। বাইরে কোথাও ডাকাতি বা লুটপাট করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে সব শুনে দু’দিন গুম হয়ে রইল।

তারপর একদিন সোজা গিয়ে গদাইয়ের বাসায় হানা দিয়ে গদাইকে বলল, “তুমি মরলে কে কে কাঁদবে বলো তো?”

গদাই বিনীতভাবে বলে, “কেউ কাঁদবে না। কারণ, আমি মরব।”

“বটে!” বলে হাবু খানিক অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলল, “মরবে না কেন বল তো! তোমার কি কর্ণের মতো কবচ-কুণ্ডল আছে নাকি?”

“আমার নেই। তবে শুনেছি নাকি আপনার আছে। লোকে বলে আপনি নাকি মেলা ম্যাজিক জানেন।”

হাবু একটা শ্বাস ফেলে বলল, “বাপু, তোমার ভালর জন্যই বলছিলাম, যদি আত্মীয়স্বজন থেকে থাকে–তবে বরং ছুটি নিয়ে গিয়ে তাদের দেখে এসো গে। শেষ দেখা।”

“তার দরকার নেই।”

হাবু হেসে বলল, “দারোগা, তোমার বড় বাড় হয়েছে হে। সে যাকগে, বাঘটা মারলে কি করে বল তো?”

গদাই হাই তুলে বলল, “বাঘ আমি অনেক মেরেছি। তবে আপনার বাঘকে আমি মেরেছি একথা কে বলল?”

“মারোনি?”

“তা বলছি না। বলছি, আমিই যে মেরেছি তার প্রমাণ কী?”

“তবে কি বলতে চাও আমার বাঘটা জঙ্গলে পালিয়ে গেছে? আর যাওয়ার সময় তোমাকে ভালবেসে নিজের চামড়াটা খুলে দিয়ে গেছে?”

গদাই উদাসভাবে বলল, “তাও হতে পারে!”

হাবু তখন গম্ভীর হয়ে বলে, “তাহলে খুব ভাল কথা। আমি আমার সেই চামড়া ছাড়ানো বাঘকে আবার জঙ্গল থেকে ধরে আনব। আর এলে তার গায়ে তোমার শরীরের চামড়াটা খুলে নিয়ে পরিয়ে দেব। তৈরি থেকো।”

গঞ্জের সকলেরই বিশ্বাস : হাবু যা বলে তাই করে। সুতরাং শিগগিরই গদাই দারোগার চামড়া পরানো বাঘকে এই অঞ্চলে দেখা যাবে এই আশায় সবাই চোখ-কান খোলা রেখে অপেক্ষা করতে লাগল।

এক রাতে বিকট শব্দ শোনা গেল–ঘ্যা-ডু-ডু-ডু-ম! সেই শব্দে মাটি কেঁপে ওঠে, বাড়িঘরের দরজা-জানালা নড়ে যায়, আর মানুষের প্রাণপাখি ধুকপুক করতে থাকে। এরকম বিকট বাঘের ডাক কেউ কখনো শোনেনি। তবে কি সত্যিই হাবুর চামড়া-ছাড়ানো বাঘটা ফিরে এল নাকি?

ওদিকে গোঁসাইবাগানের পোড়ো বাড়িতে হাবু আর তার স্যাঙাতরাও চমকে উঠে বসেছে। কান পেতে শুনছে সবাই। বাঘটা খুব কাছ থেকে ডাকল যেন!

প্রথম রাতে বাঘটা সেই একবারই ডেকেছিল।

তারপর ডাকল আর এক রাতে। হাবু সেদিন ময়নাগুড়ির তামাকের কারবারী ঘনশ্যাম বাজোরিয়ার গদিতে চিঠি দিয়ে এসেছিল, একশটি গিনি আর নগদ বিশ হাজার টাকা গোঁসাইবাগানের তেঁতুলতলায় রাত বারোটার পর পৌঁছে দিতে হবে। এ ব্যাপারে কেউ কোনো আপত্তি করে না। অনেকে তো খুশি হয়েই হাবু যা চায় তা দিয়ে দেয়। কারো কারো ধারণা, হাবুকে দিলে পুণ্য হয়। ঘনশ্যামজী অবশ্য সেই দলের লোক নন। একশ গিনি আর বিশ হাজার টাকা তো কম নয়! তবু উপায়ান্তর নেই বলে তিনি রাত বারোটা নাগাদ একটা পুরনো গাড়িতে চড়ে, ড্রাইভার আর একটা চাকরসহ তেঁতুলতলায় এসে অন্ধকারে অপেক্ষা করছেন। প্রচণ্ড শীত, মশা, আর ভয়।

রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটের সময় গহিন অন্ধকার থেকে একটা কালো মূর্তি এগিয়ে এল। ঘনশ্যামজী কাঁপতে কাঁপতে মূর্তির হাতে গিনি আর টাকার বাক্স তুলে দিলেন। ঠিক সেই সময়ে খুব কাছ থেকে সেই বিকট বাঘের ডাক শোনা গেল–ঘ্যা-ডু-ডু-ডু-ড়া-ম্!

ঘনশ্যামজী মূর্ছা গেলেন। চার আর ড্রাইভার পালাল। আর অন্ধকারের মধ্যে হাবু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ভিতু মানুষ নয়, তার ওপর অনেক ক্ষমতাও সে রাখে। তবু একেবারে কানের কাছে এ বুক কাঁপানো ডাক শুনে কয়েক মুহূর্ত বুঝি তার ধন্দ লেগেছিল।

তারপরই টর্চ জ্বেলে সে অবাক হয়ে দেখে, একটা কাঁটাঝোঁপের আড়ালে প্রকাণ্ড একটা বাঘের ডোরা দেখা যাচ্ছে। আর সেই বাঘের পিঠে একটা মানুষ না? কী আশ্চর্য! বাঘের পিঠে বসে আছে স্বয়ং গদাধর দারোগা!

বাঘটা আর একবার ডেকে উঠল সেই সময়ে। অবাক ও বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাবুর হাত থেকে টর্চবাতি পড়ে গেল। সেই অন্ধকারে বাঘের পিঠে চেপে গদাধর যে কোনদিকে চলে গেল তা আর ঠাহর পেল না হাবু।

সেই থেকে হাবুর হাঁকডাক যেন একটু কমল। আর আগের মতো বুক চিতিয়ে চলল না কয়েকদিন। সেই রাতের ঘটনার দুই দিন পর এক সকালে গদাইয়ের আস্তানায় গিয়ে হাজির হয়ে বলল, “কায়দা-টায়দা সবই শিখে গেছ দেখছি!”

গদাই গম্ভীর স্বরে বলল, “আপনিই শিখিয়েছেন।”

হাবু তেমন কিছু বলল না। কেবল ‘আচ্ছা দেখা যাবে’ গোছের কী একটু অস্পষ্ট স্বরে বলে কেটে পড়ল। সে আর গদাই দারোগার চামড়া ছাড়ানোর কথা বলত না।

এদিকে গদাই রোজ রাম কবিরাজের কাছে যায়। কবিরাজ মশাই তাকে নিয়ম করে নানা অনুপান দিয়ে হরেকরকম পাঁচন খাওয়ান। তাতে গদাইয়ের জোর বাড়ে, বুদ্ধি বাড়ে, মাথা ঠাণ্ডা হয়, সাহস আসে। একদিন রাম কবিরাজ বলেই ফেললেন, “বুঝলে বাবা গদাই, হাবু মনে হয় এবার এ-জায়গা ছেড়ে শটকাবার তালে আছে। যদি শটকে পড়ে, তাহলে কিন্তু ওকে আর শিক্ষা দিতে পারবে না। এইবার মোক্ষম ঘা দাও।”

কথাটা মিথ্যে নয়। কদিন হল হাবুর মনে হচ্ছে, এ জায়গায় যথেষ্ট রোজগার করা হয়েছে। তাছাড়া গদাই দারোগা লোকটাও তেমন সুবিধের ঠেকছে না। অন্য পাঁচটা দারোগা যেমন ভয় পেত, এ তেমন পায় না। নতুন জায়গায় গেলে রোজগারেরও সুবিধে, আর ভাবনাচিন্তাও কম করতে হবে। এই ভেবে সে স্যাঙাতদের তৈরি থাকতে হুকুম দিল। বলল, “এ জায়গাটা বড় গরম আর শুকনো হয়ে গেছে রে। তৈরি থাকিস সব, হুট করে একদিন গাঁটরি বাঁধতে হবে।”

চলে যাওয়ার আগে হাবু সবচেয়ে মোটা দাঁও মেরে যাওয়ার লোভে সতেরোটা চা বাগানের মালিক টমসন সাহেবের বাচ্চা ছেলেকে চুরি করে লুকিয়ে রাখল। সাহেবকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিল, “এক লক্ষ টাকা আগামী অমাবস্যার রাতে আপনার বাড়ির পিছন দিকের বাগানে ঝুমকো জবাগাছের নীচে একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেবেন। নয়তো রাত ভোর হওয়ার আগেই মা কালীর সামনে বলি হিসেবে আপনার ছেলেকে উৎসর্গ করা হবে।”

সাহেবরা সহজে ভয় খায় না বটে, কিন্তু টমসন সাহেবের ব্যাপারটা অন্যরকম। মাত্র এক বছর আগে তাঁর বউ মারা গেছে। মা-হারা তিনটি সন্তানের জন্য তাঁর গভীর মায়া ছিল। তাই ছেলে চুরি যাওয়ার পর রেগে আগুন হয়েও তিনি খুব শক্ত হতে পারলেন না।

কী হয়েছিল তা সবাই সঠিক জানে না। তবে টমসন সাহেবের বাগানে জবাগাছের নীচে এক লক্ষ টাকা রাখা ছিল এবং যথাসময়ে হাবুর কোনো চেলা এসে সেটা নিয়েও যায়।

লোকে আবার অন্য কথাও বলে। বলে যে, হাবুর চেলা এসেছিল ঠিকই, তবে সে আর ফিরে যায়নি, গদাই তকে হাত-পা বেঁধে চালান করে দিয়ে, নিজেই সেই চেলা সেজে হাবুর আস্তানায় গিয়ে ঢুকেছিল।

তারপর এক তুলকালাম কাণ্ড। মুহুর্মুহু বাঘের ডাক, বন্দুকের আওয়াজ, চিৎকার। সব লোক জেগে শুনছে।

পরদিন চাউর হয়ে গেল, হাবু বমাল ধরা পড়েছে। ধরা পড়ার আগে সে নাকি খুব এক হাত লড়েছিল গদাইয়ের সঙ্গে। হয়তো বা অন্য সময় হলে সে গদাইকে গদার মতো ঘুরিয়ে আছাড় দিত। কিন্তু রাম কবিরাজের পাঁচন খেয়ে-খেয়ে তখন গদাইয়ের তেজই আলাদা।