৪. রাত দশটার ট্রেনটা

রাত দশটার ট্রেনটা আজ স্টেশনে ঢোকার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর হুইল মারতে লাগল কুককুক কুউক, কুক-কুক কুউক। ভজনলাল বিরক্ত হল। কেউ চেন টেনে ট্রেন থামিয়েছে। ওদিকে ঘরে তার ডাল-রুটি আর তাড়সের তরকারি ঠাণ্ডা হচ্ছে। খিদেও পেয়েছে খুব। ট্রেনটা পাস না করিয়ে ঘরে যায় কী করে ভজনলাল?

সুতরাং ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল ভজনলালকে। চেন টানলে অনেক বখেরা। গার্ডসাহেব নামবেন, প্রত্যেকটা কামরার ছাদের কাছে ফিট করা অ্যালার্ম সিগন্যালের ডাঁটিটা বেরিয়ে আছে কিনা দেখবেন, সম্ভব হলে অপরাধীকে ধরে ফাইন করবেন, তারপর ডাঁটিটাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলে তবে ট্রেন চলবে। খিদের মুখে দেরিটা সহ্য হচ্ছিল না ভজনলালের। কিন্তু কী আর করা! সে একটা বেঞ্চে বসে দেহাতি গান গাইতে লাগল, ‘রামভজন করো জ্ঞানী, রামভজন করো ধ্যানী, রামভজন করো প্রাণী, দো দিন কা জিন্দগানি…’

হুইল মেরে ট্রেনটা অবশেষে চলল এবং বিস্তর কাঁচকোঁচ শব্দ করে এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল। ড্রাইভার রামসেবক তেওয়ারি বন্ধু লোক। লাইন ক্লিয়ারটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভজনলাল জিজ্ঞেস করল, “ক্যা ভৈল হে রামভাই?”

রামসেবক জবাব দিল, “দশবারা বদমাশ উঠা থা টিরেন মে। চেন খিচকে জঙ্গলমে উতার গয়া। ডাকু-উকু মালুম হোতা।”

ভজনলাল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “আরে রামভাই, ইয়ে তো খতরনাক জায়গা ভৈল বা। কাল ভি এক বদমাশ আয়া থা। আজ বারা বদমাশ?”

নাঃ, ভজনলালকে ভাবিত হতেই হচ্ছে। ট্রেনটা পাস করিয়ে সে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে রুটি খেয়ে মোটা বাঁশের লাঠিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একবার মাধব ঘোষালের কাছে যাওয়া দরকার। স্টেশনে নতুন কোনও লোক নামলে খবরটা দিতে বলেছেন মাধব।

ওদিকে নবীগঞ্জে রাত-পাহারা শুরু হয়েছে। নবীগঞ্জ বড় জায়গা। অনেকটা ছড়ানো এলাকার সবটা পাহারা দেওয়ার মতো লোক পাওয়া যায়নি। দুটো ব্যাচ হয়েছে। আজ এক ব্যাচ পাহারা দেবে, কাল আর-এক ব্যাচ। সবাই না ঘুমিয়ে পাহারা দিলে দু’দিনেই সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তাই এই ব্যবস্থা। ব্যাচ ভাগ হওয়ায় পাহারা দেওয়ার লোকও অর্ধেক হয়ে গেছে। চারজন-চারজন করে ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাধব বলে দিয়েছেন, সাড়াশব্দ করা চলবে না। সবাই যেন গা-ঢাকা দিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। দুঃখবাবুর ওপর ভার পড়েছে, দৌড়ে-দৌড়ে প্রত্যেকটা দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার এবং মাঝে-মাঝে এসে মাধবকে খবর দিয়ে যাওয়ার। এই প্রস্তাবে দুঃখবাবু দুঃখিত হননি। দৌড়তে তাঁর ভালই লাগছে। বেশ চাঙ্গা বোধ করছেন। রসুলপুরে আজ সকালে কুস্তি লড়ার পর তাঁর জীবনে যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। তার চেয়েও বড় কথা, গাঁট্টা, কাতুকুতু ইত্যাদি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। গাঁট্টার ভয়ে নয়, এখন তিনি মনের আনন্দেই সারা নবীগঞ্জ দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। জীবনে খেলাধুলো করেননি, আজ রাতে দৌড়তে-দৌড়তে কবাডি খেলুড়ের মতো চু-কিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে একবার রাজবাড়ির ফটকের পাশের ঝোপে লুকনো বাসব দত্ত বা নিমাই আর নিতাইকে ছুঁয়ে আসছেন, কখনও বোসপাড়ার মোড়ে নেতাজির স্ট্যাচুর পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা নয়ন বোস আর হরিহর পণ্ডিতকে ছুঁয়ে আসছেন, কখনওবা হাটখোলায় বস্তাচাপা দেওয়া হাবু ঘোষ আর পুঁটে সর্দারের পিঠে চাপড় মেরে আসছেন, কখনও বা চণ্ডীমণ্ডপের কলাঝাড়ের পেছনে গা-ঢাকা দেওয়া ব্যায়ামবীর ভল্লনাথ আর হরেন চৌধুরীকে চিমটি কেটে আসছেন। মনে আজ তাঁর ভারী আনন্দ।

নাগরা জুতোর শব্দ তুলে হন্তদন্ত হয়ে পয়েন্টসম্যান ভজনলাল যখন এসে বারোজন ডাকুর খবর দিল, তখন মাধব সচকিত হলেন। বললেন, “এসে গেছে?”

“আ গিয়া নেহি, ঘুস গিয়া, ডাকুলোগ সব ঘুসিয়ে পড়েছে। ডাল রুটি সেবা করতে আমার কুছু সোময় লেগেছিল, উসি সোময় ডাকুলোক ঘুসিয়ে পড়েছে।”

ওদিকে রাজবাড়িতে দোতলার ঘরে কিঙ্কর চেয়ারে বসে শুনছে আর বিছানায় বসে বিভোর হয়ে বীরচন্দ্র বীণা বাজাচ্ছে। কিঙ্করের চোখে একটা মুগ্ধতা লক্ষ করছে বীরচন্দ্র। বীণা কি ওর স্মৃতিশক্তির ওপর কাজ করবে? কে জানে!

একটা রাগ শেষ হতেই কিঙ্কর হঠাৎ বলে উঠল, “বীণা খুব ভাল জিনিস।”

“হ্যাঁ। খুব ভাল। অভাবকষ্ট সব ভুলে যাওয়া যায়।” কিঙ্কর হঠাৎ বলল, “বাবা কিন্তু ওদের বলেনি।”

“কী বলেনি?”

“যেকথাটা ওরা জানতে চেয়েছিল।”

“কোন কথা বলল তো?” কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলল, “তা, জানি না।”

বীরচন্দ্র একটু হেসে বলল, “রাজু একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকে, এই কথা তো?”

কিঙ্কর সবেগে মাথা নেড়ে বলে, “হাঁ, হ্যাঁ। বাবা বলেনি।”

বীরচন্দ্র হেসে বলল, “বললেইবা কী ক্ষতি হত বলো? আমরা রাজুকেও চিনি না, তার উঁচু জায়গা কোথায় তাও জানি না। ওসব কথা থাক। বীণা বাজাই, শোনো।”

কিঙ্কর ফের মন দিয়ে শুনল। বীণা থামতেই বলল, “ওরা রাজুকে খুন করবে। ওরা খারাপ।”

ওদিকে দুঃখবাবু হাটখোলায় বস্তাচাপা দেওয়া হাবু ঘোষকে একটা চাপড় মেরেই ফের ছুটতে যাচ্ছেন, সামনে চারজন লোক পথ থেকে সাঁত করে সরে যাচ্ছিল। দুঃখবাবু চুকিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে তাদের দুজনকে ছুঁয়ে ফেললেন। তারপর বললেন, “সজাগ থেকো, সজাগ থেকো। ভাল করে পাহারা দাও। ঘুরে বেড়িও না।”

বলেই আবার চুকিত-কিত-কিত-কিত করে ছুটতে শুরু করলেন। খানিকদূর গিয়েই তাঁর হঠাৎ মনে হল, আরে! তিনি কাঁদের ছুঁয়ে এলেন? অন্ধকারেও তিনি যাদের দেখেছেন তারা কি নবীগঞ্জের মানুষ? মনে হতেই দুঃখবাবু পট করে ঘুরে হাটখোলার দিকে ফিরে এলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না।

“হাবু, হাবু?”

হাবু কম্পিত গলায় বলল, “কী বলছ?”

“কিছু দেখেছ?”

“খুব দেখেছি। দেখে ভয়ে হিম হয়ে আছি।”

“সর্বনাশ!” বলে ফের ছুটতে লাগলেন দুঃখবাবু।

“ঘোষালমশাই, তারা ঢুকে পড়েছে।”

“জানি। কোনদিকে যায় একটু বুঝতে চেষ্টা করে। তারা রাজু নামে কাউকে খুঁজছে। রাজুটা যে কে, তা তো বুঝতে পারছি না। ওদের ওপর নজর রাখো।”

“যে আজ্ঞে।” বলে দুঃখবাবু দৌড় শুরু করে দিলেন।

কলাঝাড়ের পেছনে ভল্লনাথ হঠাৎ হরেন চৌধুরীকে চাপাস্বরে বলল, “ও মশাই, চিমটি কাটছেন কেন?”।

“কে চিমটি কাটছে? কী যে বলো না, কিছু ঠিক নেই।”

“এই তো কাটলেন!”

“তোমার মাথাটাই গেছে।”

“তবে কে কাটল?” বলে ভল্লনাথ পেছনে ঘাড় ঘুরিয়েই হঠাৎ ‘বাপরে বলে’ দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়তে গেল, কিন্তু পারল না। কাটা কলাগাছের একটা গোড়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে তার দাঁতকপাটি লাগল। হরেন চৌধুরী ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘোরাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আর দরকার হল না। মাথায় ঠাস করে কী একটা বস্তু এসে লাগতেই মূর্ছা হয়ে গড়িয়ে পড়লেন।

ঝোঁপের আড়াল থেকে দুটো ছায়ামূর্তির মতো তোক বেরিয়ে এল। একজন ভারী গলায় বলল, “পাহারা দিচ্ছিল। হুঁ, খুব পাহারাদার।”

অন্যজন পা দিয়ে ভল্লনাথকে একটু নেড়েচেড়ে বলল, “এটা বোধ হয় ব্যায়ামবীর, দেব নাকি গলার নলিটা কেটে?”

“দুর, মশামাছি মেরে কী হবে? আমাদের দরকার কিঙ্কর জাম্বুবানটাকে। তাকে না পেলে এত পরিশ্রমই বৃথা।”

“রাজবাড়িটা কোথায়?”

“এসে গেছি, চণ্ডীমণ্ডপ ছাড়িয়ে দক্ষিণে।” বলে লোকটা একটা শিস দিল। সঙ্গে-সঙ্গে পালটা কয়েকটা শিস শোনা গেল।

নেতাজির মূর্তির চারধারে তখন একটা গোল্লাছুট খেলা চলছে। নয়ন বোস প্রাণভয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, পেছনে মুগুর। হাতে একটা লোক। মুগুরের ঘায়ে আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে হরিহর পণ্ডিত। নয়নের কপাল খারাপ। হরিহর পণ্ডিতকে ডিঙিয়ে-ডিঙিয়ে বেশ দৌড়চ্ছিল এতক্ষণ, কিন্তু হঠাৎ তার গায়েই হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। গদাম করে মুগুরটা এসে লাগল মাথায়। নয়ন বোস চোখে সর্ষেফুল দেখতে-দেখতে অজ্ঞান হয়ে গেল। হাটখোলার অবস্থা আরও খারাপ। বস্তাচাপা হাবু ঘোষ হঠাৎ নাকে ধুলো ঢুকে হেঁচে ফেলার পর একটা লোক ছুটে এসে একখানা ঘেঁটে লাঠি দিয়ে বস্তাগুলোকে আচ্ছা করে পিটে দিয়ে গেল। দুটো বস্তাই আলুর বস্তার মত নিথর হয়ে পড়ে রইল।

নিমাই, নিতাই আর বাসব দত্ত রাজবাড়ির ফটকের মস্ত থামটার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে, একটু পেছনে পাঁচু ঘোরাঘুরি করছে। হঠাৎ পাঁচু একটু উৎকর্ণ হয়ে কী-একটু শুনে চাপা গলায় বলল, “এসে গেছে!”

বাসব বলল, “কে এসেছে?”

“তেনারা, শিস দেওয়ার শব্দ শুনলেন না?”

“শিস দেবে কেন?”

“ওটা ইশারা।”

“তা হলে এখন কী করব?”

“বন্দুকটা ফোঁটান। বন্দুক ফোঁটালে ভয় পেতে পারে।” বাসব নিজেই ঠকঠক করে কাঁপছে। বন্দুকটা তুলে কোনওরকমে আকাশমুখো করে ঘোড়াটা টিপতে যাবে, ঠিক এমন সময় একটা আধলা ইট এসে কপালে লাগল। বাসব দত্ত তার বন্দুকসমেত শুয়ে পড়ল ঘাসে। বন্দুকটাকে একেবারে পাশবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে। প্রথম লাঠির চোটেই “বাপ রে” বলে বসে পড়ল নিমাই। তারপর বাসব দত্তর পাশেই গড়িয়ে পড়ল। নিতাই কিছুক্ষণ মুগুরপেটাই হয়েও দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর কাটা কলাগাছের মতো বাসব দত্তের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল।

লোকগুলো খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নিপাটে পড়ে-থাকা মানুষগুলোর দিকে চেয়ে ছিল। একজন বলল, “এরা আগে থেকে নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। নইলে পাহারা রাখত না।”

সবচেয়ে লম্বা কালোমতো বিকট চেহারার সর্দার চারদিকটা ভাল করে দেখে নিয়ে বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “আরও একটা লোক ছিল, সে পালিয়েছে। সে গিয়ে গাঁয়ের লোককে ডেকে আনতে পারে। কয়েকজন নীচে পাহারায় থাক। এতক্ষণ গুলি, বোমা চালানো হয়নি; কিন্তু যদি গাঁয়ের তোক বাধা দিতে আসে তা হলে ঝাঁঝরা করে দিবি। আমাদের কাজে একটু সময় লাগবে।”

একটা লোক বলল, “কিন্তু কালু, কিঙ্করকে না পেলে তো

জিনিসটার হদিস পাওয়া যাবে না।”

“কিঙ্কর রাজবাড়িতেই আছে, খবর পেয়েছি। রাজবাড়িতে আগে যা বাজার হত এখন তার তিনগুণ হচ্ছে। তার মানে একজন খুব খানেওলা লোক এখানে লুকিয়ে আছে। কিঙ্কর ছাড়া কে?”

সবাই চাপাস্বরে বলে উঠল, “ঠিক কথা।“

সর্দার একটা লোকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “কেষ্ট, তুই কত বড় বোকার মতো কাজ করেছিস জানিস? শঙ্কর পালোয়ানকে মেরেছিলাম বাধ্য হয়ে, সে কিছুতেই কবুল করেনি। তারপর রাগের চোটে কিঙ্করকেও মারতে গিয়েছিলি। কিঙ্কর মরে গেলে ওই সোনার হদিস পাওয়া যেত? বেঁচে আছে বলে রক্ষে। তাও কথা বের করা যাবে কিনা জানি না। স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে শুনেছি। কিন্তু এখন আর কথা বলার সময় নেই। জনাছয়েক পাহারায় থাক। পাঁচজন আমার সঙ্গে ওপরে আয়।”

সর্দারের পিছু পিছু যে পাঁচজন রাজবাড়ির দিকে যাচ্ছিল, তাদের একজন বলল, “আচ্ছা সর্দার, স্মৃতিভ্রংশ হয়ে থাকলে কিঙ্করের কাছ থেকেই বা সোনার হদিস পাবে কেমন করে?”

“মারের চোটে মড়াও কথা বলে। তবে স্মৃতিভ্রংশ হয়ে একপক্ষে ভালই হয়েছে। নইলে হয়তো রাজপুত্তুরটাকেই সব বলে দিত।”

“বলেনি তা কী করে জানলে?”

“আমার আরও চোখ আছে রে। সব খবর পাই।”

দোতলার ঘরে বীণা বাজাচ্ছে বীরচন্দ্র, মোহিত হয়ে শুনছে কিঙ্কর। হঠাৎ বীণা থামিয়ে বীরচন্দ্র উৎকর্ণ হল, তারপর বীণাটা রেখে বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে বলল, “কিঙ্কর, লুকোতে হবে।”

কিঙ্কর একটু যেন অবাক হয়ে বলে, “কেন?”

“বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। এসো আমার সঙ্গে।” কিঙ্কর হঠাৎ শক্ত হয়ে মুঠো পাকিয়ে বলল, “সেই লোকটা? তাকে আমি পিষে ফেলব।”

বীরচন্দ্র ম্লান হেসে বলে, “তার আগে আত্মরক্ষা করা দরকার। আর সময় নেই। এসো। নীচে দরজায় শব্দ পাচ্ছি যেন। ওরা বাইরে থেকেই দরজা খুলতে জানে বোধ হয়। এসো।”

দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এল। বীরচন্দ্র ডান দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে কিঙ্করকে নিয়ে আর-একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে একতলায় এল। তারপর চোরাকুঠুরির দরজা খুলে নেমে এল পাতাল ঘরে। এখানে ঘুটঘুট্টি অন্ধকার আর সোঁদা গন্ধ। ইঁদুরের দৌড়োদৌড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

“কিঙ্কর, ভয় করছে না তো?”

“না।”

“শব্দ কোরো না।”

চোরাকুঠুরিতে দুখানা তরোয়াল আগে থেকেই রেখে গেছে বীরচন্দ্র। অন্ধকারেই হাতড়ে-হাতড়ে তোয়াল দুটো খুঁজে নিয়ে একখানা কিঙ্করের হাতে দিয়ে বলল, “এটা রাখো। খুব দরকার না হলে ব্যবহার কোরো না।”

কিঙ্কর বলল, “আমার তরোয়াল লাগে না, হাতই যথেষ্ট।”

“আচ্ছা বেশ।”

যে ছ’জন রাজবাড়ির ফটকে পাহারা দিচ্ছিল, তারা হঠাৎ অবাক হয়ে শুনল, একটা লোক চুকিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে এদিকেই ধেয়ে আসছে।

“ওটা কে রে?”

“পাগল-ফাগল হবে। একটু আগে হাটখোলার কাছেও দেখেছি।”

“খুব বেআদপ তো।”

“বেআদপটা দৌড়ে এসে পড়ল সামনে। তারপর পট করে সামনের লোকটাকে একটা থাপ্পড় মেরেই পিছু ফিরে আবার চু-কিত-কিত করে ছুটতে লাগল। চড়-খাওয়া লোকটাও পিছু-পিছু ছুটে গিয়ে পটাং করে একটা লাথি কষাল লোকটাকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় লোকটা লাথিটা এড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর লোকটাকে তুলে অনায়াসে একটা আছাড় মেরে হাত ঝাড়তে লাগল।

দৃশ্যটা দেখে বাকি পাঁচজনের মাথায় খুন চেপে গেল। তারা এমনিতেই খুনখারাপি করে বেড়ায়, একটা পেঁয়ো লোকের এহেন স্পর্ধা সহ্য করবে কী করে? “ধর, ধর ব্যাটাকে, লাশ ফেলে দিই।” বলে তারা পাঁচজন মিলে দুঃখবাবুকে তাড়া করল। দুঃখবাবু চুকিত-কিত-কিত-কিত করতে করতে ফের ছুটতে লাগলেন। পাঁচজনের একজন খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। দুঃখবাবু তাকে মাজা দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়েই ল্যাং মেরে ফেলে দিলেন। লোকটা যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন বজ্ৰাদপি কঠোর একটা গাঁট্টাও বসিয়ে দিলেন মাথায়। গাঁট্টাটা মেরে তাঁর খুবই আনন্দ হল। এতদিনে তিনি ভূতের ঋণ শোধ করছেন।

বাকি চারজন কাণ্ডটা দেখে আর কাণ্ডজ্ঞান রাখতে পারল না। একজন পিস্তল তুলে ফটাস করে গুলি চালিয়ে দিল। দুঃখবাবু মাথাটা সরিয়ে নিয়ে গুলিটা পাশ কাটালেন। তারপর নিচু হয়ে তেড়ে গিয়ে লোকটাকে ঠিক বাজারের শিবের ষাঁড়টার মতোই একখানা তো মারলেন। লোকটা ছিটকে শূন্যে উঠে গেল। ওই অবস্থাতেই তার পেটে একখানা ঘুসি মারলেন দুঃখবাবু। তারপর ফের চুকিত-কিত করে দৌড় লাগালেন। তিনি যে এত প্যাঁচ-পয়জার জানেন তা তাঁর নিজেরও এতকাল জানা ছিল না।

বাকি তিনটে লোক হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে মারমার করে ধেয়ে আসছে। তাদের হাতে ছোরা, বোমা, বন্দুক। একটা লোক একটা বোমা বোধ হয় ছুঁড়েও মারল। সেটা দুঃখবাবুর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে এসে সামনে পড়তেই দুঃখবাবু সেটাকে ফুটবলের মতো একখানা শট করলেন। সেটা ফের উড়ে গিয়ে বোধ হয় রাস্তার ধারে কোনও খানাখন্দে পড়ল। কিন্তু ফাটল না। কিন্তু শটটা মেরে দুঃখহরণের আবার আনন্দ হল। তিনি কি ফুটবলও খেলতে পারেন তা হলে? শটটা তো মন্দ হল না!

তিনজনের একজন বড় গা ঘেঁষে এসে পড়েছে। দুঃখবাবু একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে পট করে হাত বাড়িয়ে একটা রদ্দা কষালেন তার ঘাড়ে। লোকটা কোঁক করে উঠল। দুঃখবাবু তার চুল মুঠো করে ধরে এক হ্যাঁচকায় তাকে হ্যামার থ্রোর ভঙ্গিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন পাশের খন্দে। রইল বাকি দুই।

দু’জনের একজনের হাতে ছোরা, অন্যজনের বন্দুক। কিন্তু কেউই অস্ত্র দুটো ব্যবহার করতে পারছে না ছুটতে হচ্ছে বলে। দুঃখবাবু দুজনকে দেখে নিয়ে মহানন্দে নানা রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে ছুটতে লাগলেন। কখনও জোরে, কখনও আস্তে। কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর দুঃখবাবু টের পেলেন লোক দুটো হেদিয়ে পড়েছে। সুতরাং তিনি এবার সোজা ছুটতে-ছুটতে মাধব ঘোষালের বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। পিছু-পিছু ফাতে-হাঁফাতে দুটো লোক।

“ঘোষালমশাই, এনেছি।”

“কাকে এনেছ?”

“এই দেখুন না?”

লোক দুটো এল টলতে টলতে। এসেই দড়াম-দড়াম করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

দুঃখবাবু একগাল হেসে বললেন, “বড্ড হেদিয়ে পড়েছে।”

লোক দুটো এতই হেদিয়ে পড়েছে যে, হাপরের মতো শব্দ করে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিল। বন্দুক আর ছোরা হাত থেকে খসে পড়ে আছে সামনে। ভজনলাল তাড়াতাড়ি গোরুর দড়ি এনে দু’জনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।

দুঃখবাবু বললেন, “ঘোষালমশাই, রাজবাড়িতে কিন্তু একটা দল ঢুকে পড়েছে। তাড়াতাড়ি চলুন।”

“রাজবাড়িতে? রাজবাড়িতে কেন? তারা তো রাজুকে খুঁজছে!”

“তা জানি না, তাড়াতাড়ি চলুন।”

মাধব ঘোষাল কয়েক সেকেণ্ড ভাবলেন। তারপরই লাফিয়ে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! আমি তো মস্ত আহাম্মক, রাজু আসলে বোধ হয় রাজকুমার। পুরো কথাটা কিঙ্কর বলতে পারছিল না। বলেই বোধ হয় তোতলাচ্ছিল। সর্বনাশ!”

সবাই মিলে রাজবাড়ির দিকে ছুটতে লাগল।

পাতালঘরে অন্ধকারে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে বসে ছিল বীরচন্দ্র। পাশে কিঙ্কর। বীরচন্দ্রের হাতে নাঙ্গা তরোয়াল। ওপরে ভারী-ভারী পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। হঠাৎ করে যেন একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল।

বীরচন্দ্র সবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিঙ্কর, তুমি এখানেই থাকো। নোড়ো না, আমি আসছি।”

“কোথায় যাচ্ছ?”

“আমার বনমালী আর রাঁধুনির কথা খেয়াল ছিল না, ওরা বোধ হয় বিপদে পড়েছে।” বলেই বীরচন্দ্র সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলায় ছুটতে লাগল। ৮৬

কিন্তু ওপরের বারান্দায় উঠে আসতেই একেবারে মুখোমুখি কালান্তক যমের মতো একটা লোক। হাতে বন্দুক। বীরচন্দ্রের দিকেই তাক করা।

“তরোয়াল ফেলে দাও! আমরা বন্দুক চালাতে চাই না।”

বীরচন্দ্র বলল, “তোমরা বনমালী আর রাঁধুনিকে কী করেছ? বলো, নইলে শাস্তি পাবে।”

“ইস, রাজাগিরি দেখানো হচ্ছে! অ্যাঁ! রাজাগিরি! শাস্তি দেবে?”

বীরচন্দ্র আর থাকতে পারল না। লম্বা তরোয়ালটা বোঁ করে চালিয়ে দিল। তরোয়ালের ঘায়ে বন্দুকটা খসে পড়ল লোকটার হাত থেকে।

বীরচন্দ্র একটা হুঙ্কার দিয়ে এগিয়ে যেতেই লোকটা দু কদম পিছিয়ে গেল। কিন্তু সে একা নয়। পেছনে আরও পাঁচ-পাঁচটা গুণ্ডা। বীরচন্দ্র হু-হুঁঙ্কারে তরোয়াল চালাতে লাগল বটে, লোকগুলো নাগালে এল না। একটা লোক পিস্তল তুলে দুবার গুলি চালিয়ে দিল।

বীরচন্দ্র জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।

সদার বলল, “আয়। এই সিঁড়ি দিয়ে ও উঠে এসেছিল। কিঙ্কর নিশ্চয়ই নীচে কোথাও আছে।”

কিঙ্করকে খুঁজে বের করতে খুব বেশি দেরি হল না তাদের। পাতালঘরে নেমে মুখে টর্চের আলো ফেলতেই কিঙ্কর প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপরই সে হঠাৎ লোকটাকে দেখতে পেল। লম্বা, কালো, ভয়ঙ্কর দুটো চোখ।

“তুই! তুই!” বলতে বলতে কিঙ্কর লাফিয়ে উঠল। দু হাত মুঠো পাকিয়ে বলল, “তোকে… তোকে…”

কিন্তু কিঙ্কর দু পা এগনোর আগেই বন্দুকের কুঁদোর ঘা এসে পড়ল কাঁধের হাড়ে। একটা চেন বোঁ করে এসে লাগল তার কপালে। কিঙ্কর বসে পড়ল।

সদার এগিয়ে এসে বলল, “এবার বল তো, সোনা কোথায় আছে। লক্ষ্মীছেলের মতো বলে দে।”

“জানি না।”

“খুব ভালই জানিস। বুড়ো রাজা মরার সময় তোর বাবা তার কাছে ছিল। মরার আগে বিশ্বাসী লোক বলে তাকেই খবরটা দিয়ে যায়। বলেছিল, আমার ছেলে বড় হলে খুব অভাব কষ্টে পড়বে। তখন তাকে সোনার হদিসটা দিও। বলেছিল কি না?”

কিঙ্কর কপালে হাত বোলাতে-বোলাতে বলল, “আমি জানি। মনে নেই। তুই খারাপ লোক।”

সর্দার কিঙ্করের পাঁজরে একটা লাথি মেরে বলল, “বল। নইলে মরবি।”

কিঙ্কর ফের লাফিয়ে উঠে লোকটার গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিল। কিন্তু চারদিক থেকে বন্দুকের কুঁদো, চেন, মুগুর বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল তার মাথায়, কাঁধে, কপালে, শরীরের প্রায় সর্বত্র। কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল কিঙ্কর।

“কোথায়? বল, নইলে…”

“জানি না। জানি না। জানি না। রা রাজু একটা উঁচু জায়গায় বসে থাকে।”

“ওটা কোনও জবাব নয়। ঠিক করে বল।”

কিঙ্কর মাথা নেড়ে বলে, “জানি না।”

“তোর বাবাকে কেন মেরেছিলাম জানিস? ঠিক এই অবাধ্যতার জন্যই। যখন তোর সামনেই তাকে গুলি করতে যাই তখনও আমার বিশ্বাস ছিল বাপকে বাঁচাতে তুই গুপ্ত খবরটা বলে দিবি। তুই বললি না, তোর বাপও মরল। এখনও যদি না বলিস তবে এবার তুই মরবি। মরতে চাস?”

“আমি জানি না। মনে পড়ছে না।”

সর্দার গম্ভীরভাবে বলল, “কেলো, ব্লেড চালা তো।”

কেলোর আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে ব্লেড ধরা। সে চকিতে এগিয়ে গিয়ে কিঙ্করের গালে আর দু হাতে হাতটা একবার বুলিয়ে দিল।

কিঙ্করের মুখ আর হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। আর একজন এগিয়ে গিয়ে একটা থলি থেকে একমুঠো নুন নিয়ে ছুঁড়ে মারল তার গায়ে।

কিঙ্কর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল। “এবার বল কিঙ্কর, নইলে কপালে আরও কষ্ট আছে।”

হঠাৎ দলের একটা লোক সর্দারের কানে কানে কী একটা বলল। সর্দার ভু কোঁচকাল। তারপর মাথা নাড়ল। বন্দুকটা তুলে কিঙ্করের দিকে তাক করে বলল, “এক থেকে তিন গুনব। তার মধ্যে বলা চাই। এক… দুই… তিন…”

তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ ঘরে বন্দুকের একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ হল। ওপর থেকে চাপড়া খসে পড়ল। ঘরটা কেঁপে উঠল।

কিঙ্কর একটা অদ্ভুত ‘ওয়াঃ’ শব্দ করে পড়ে গেল মেঝের ওপর।

সদার একটু হাসল, “এবার ব্যাটা বলবে। বন্দুককে খুব ভয় খায়।”

বলাই বাহুল্য, গুলি কিঙ্করের গায়ে লাগেনি, সর্দার শুধু ওর কানের পাশ দিয়ে গুলিটা চালিয়ে দিয়েছে।

মিনিট কয়েক বজ্রাহতের মতো পড়ে রইল কিঙ্কর। তারপর ধীরে-ধীরে চোখ মেলল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল। কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মতো চেয়ে থেকে হঠাৎ সে যেন শিউরে উঠে বলল, “রাজকুমার… বেদি… সোনা…”।

সদার মোলায়েম গলায় বলল, “বাঃ, এই তো স্মৃতি ফিরে আসছে দেখছি। আস্তে-আস্তে বল।”

কিঙ্কর কিছুক্ষণ সর্দারের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বিদ্বেগে উঠে দাঁড়াল, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই ধাক্কায় সবাইকে সরিয়ে চোখের পলকে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল ওপরে। তারপর দৌড়তে-দৌড়তে চিৎকার করতে লাগল, “রাজকুমার! রাজকুমার!”

সদার আর তার দলবলও উঠে এল ওপরে। বাইরে হাজার লোক তখন রাজবাড়ি প্রায় ঘিরে ফেলেছে। মাধব তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। যারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল তারাও সব গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে।

পুঁটে সর্দার বলল, “ঘোষালমশাই, বন্দুকের সামনে আমাদের সুবিধে হবে না। তবে একটা উপায় আছে। আমার এই লাঠিগাছ একসময়ে অনেক ভেলকি দেখিয়েছে। আজ বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু একবার চেষ্টা করতে পারি।”

বলেই পুঁটে সর্দার একটা হুঙ্কার ছেড়ে লাঠিটা বনবন করে ঘোরাতে-ঘোরাতে রাজবাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। চেঁচাতে লাগল, “খবর্দার! খবর্দার!”

চু-কিত-কিত-কিত করতে করতে দুঃখবাবুও ঢুকে পড়লেন। একটু পেছনে বন্দুক হাতে বাসব দত্ত। তাঁর পেছনে ভজনলাল।

পেছনের সিঁড়ি দিয়ে তরোয়াল হাতে বীরচন্দ্রও নেমে এল। পেছনে কিঙ্কর।

সদার আর স্যাঙাতরা পরিস্থিতিটা একটু বুঝে নিয়েই বন্দুক তুলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘটোৎকচের মতো পেছন থেকে তাদের ওপর এসে পড়ল কিঙ্কর। গোটা দলটা বেসামাল হয়ে যেতেই পটাপট লাঠি পড়তে লাগল। ভজনলাল আর পুঁটে মনের সুখে মারতে লাগল। দুঃখবাবু দুটোকে পেড়ে ফেললেন।

কিঙ্কর সর্দারকে দু হাতে তুলে আলাদা করে নিয়ে এল। তারপর তার গলা টিপে ধরে বলল, “তোর আজই শেষ রাত্রি।”

সদার মরেই যেত। কিন্তু বীরচন্দ্র এসে আটকাল, “কিঙ্কর, তোমাকে আমার দরকার। খুন করে জেলে গেলে তো আমার কাজ হবে না।”

ভজনলাল তাড়াতাড়ি এসে সর্দারকে বেঁধে ফেলল। বাঁধতে সে খুবই পটু। অন্যদের ইতিমধ্যেই বেঁধেছেদে পোঁটলা-পুটলির মতো সাজিয়ে রেখেছে একধারে।

মাধব এসে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে নিয়ে বললেন, “আরও একটু কাজ আছে। এদের আসল সর্দার ও-লোকটা নয়। আমাদেরই একজন। নইলে কে কোথায় লুকিয়ে পাহারা দিচ্ছে তা ওদের জানার কথা নয়। তা ছাড়া কিঙ্কর যে একটা গুপ্ত খবর জানে তাও বাইরের লোকের অনুমান করা শক্ত। সর্দার, বলো তো লোকটা কে?”

সদার বাঁধা অবস্থায় বলল, “জানি না।”

সঙ্গে-সঙ্গে কিঙ্করের একটা তো তার পেটে পড়তেই সে কোঁক করে উঠে বলল, “বলছি! বলছি!”

ভিড়ের ভেতর থেকে রায়বাবু এগিয়ে এসে বললেন, “কুলাঙ্গার, লাফাঙ্গা! একটা কোঁতকাও হজম করতে পারিস না? নাও বাবা ভজনলাল, আমাকেও বেঁধে ফেলো। তবে মারধোর কোরো না। ওসব হুডযুদ্ধ আমার সহ্য হয় না। আজ্ঞে হ্যাঁ, মাধববাবু, ঠিকই ধরেছেন। রাজামশাই মারা যাওয়ার সময় আমি ঘরের বাইরে ছিলাম। শঙ্করকে কিছু একটা বলতে দেখেছি, কিন্তু শুনতে পাইনি। সন্দেহটা তখন থেকে। শঙ্কর তারপর সেই যে হাওয়া হয়ে যায়, অনেকদিন বাদে এই মাসছয়েক আগে তার হদিস করতে পারি। আর আমার কিছু বলার নেই।”

ভজনলাল খুবই স্নেহের সঙ্গে রায়বাবুকেও বেঁধে ফেলল।

তারপর বলল, “এখুন এসব মাল কুথায় চালান হোবে ঘোষাল মহারাজ?”

“ভেবে দেখি। এখন সবাই বাড়ি যাও। রাত হয়েছে।”

মাধব দু’জনের ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করলেন। কিঙ্করের আঘাত গুরুতর। কিন্তু মস্ত মানুষ, মহা শক্তিমান। কাজেই প্রাণশক্তির জোরেই খাড়া থাকবে। বীরচন্দ্রের বাঁ হাতে দুটি গুলি লেগেছে। কিন্তু সেও সামলে যাবে।

একটু বাদে দুজনকে নিয়ে দরবার ঘরে এলেন মাধব। কিঙ্করকে বললেন, “তোমার স্মৃতিশক্তি ফিরে এসেছে তো!”

“যে আজ্ঞে। সিংহাসনের বেদির তলায় সোনা আছে এ-কথা বাবাই আমাকে বলে গিয়েছেন।”

কিঙ্কর গিয়ে শ্বেতপাথরের তৈরি বেদিটার সামনে দাঁড়াল। তারপর নিচু হয়ে বেদির ওপরের স্তরের যে-অংশটার কানা বেরিয়ে আছে সেই অংশটার কান ধরে সজোরে চাড় দিল। ভারী পাথর চড়চড় করে উঠে এল।

“দেখুন। “ মাধব এবং বীরচন্দ্র দেখলেন। পাথরের নীচে সোনার স্তর।

কিঙ্কর বলল, “গোটা বেদিটাই সোনার। চার থেকে পাঁচ মন সোনা ঢালাই করে তৈরি। ওপরে শ্বেতপাথর দিয়ে ঢাকা ছিল।”

বীরচন্দ্র অবাক হয়ে বলল, “এত সোনা! এ দিয়ে কী হবে?” মাধব হাসলেন, “কেন, তুমিই বলেছিলে টাকা থাকলে নবীগঞ্জের দুঃখ দূর করতে! তাই করবে। মানুষের হৃদয়ের রাজা হবে।”

বীরচন্দ্র বলল, “তবে তাই হোক।”

পরদিন ভোরবেলা ভারী সুন্দর করে রোদ উঠল। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। প্রজাপতি উড়ছে। গোরুর হাম্বা শোনা যাচ্ছে। হরিহরের পাঠশালায় ছেলেরা নামতা মুখস্থ করছে। পাঁচু পান্তাভাত খেতে বসেছে। হাবু ঘোষ খালে মাছ ধরছে। নিমাই-নিতাই দাঁতন করছে। বাসব দত্ত বন্দুকে তেল লাগাচ্ছে।

নয়ন বোস ম্যাজিক প্র্যাকটিস করছে। হরেন চৌধুরী গান গাইছে।

ওদিকে মাধব ডাকাতদের পুলিশের হাতে দিতে রাজি হননি। তাঁর বাড়িতে অনেকে জড়ো হয়েছে। একপাশে হাত-পা বাঁধা ডাকাতরা আর রায়বাবু লজ্জিতভাবে বসা। মাধব বললেন, “জেল খেটে কারও সংশোধন হয় না। আমি ওদের প্রস্তাব দিয়েছি নবীগঞ্জের উন্নতির জন্য বীরচন্দ্র যেসব কাজ করবেন তাতে এরা সবাই কায়িক শ্রম দেবে। পুকুর কাটা, রাস্তাঘাট তৈরি, নতুন স্কুলবাড়ি, হাসপাতাল, অনেক কাজ হাতে। কাজের ভেতর দিয়েই মানুষের সংশোধন হয়। কী হে, তোমরা রাজি তো! রায়বাবু কী বলেন?”

সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

সরকারমশাই সকালে বাজারে চলেছেন। পুঁটে সর্দারের সঙ্গে দেখা।

“এই যে ষষ্ঠীচরণ, তা খবর কী গো?” পুঁটে মাথা নেড়ে বলল, “না-না, বাজার আমার সকালেই হয়ে গেছে।”

বীরচন্দ্র স্থির করেছে, সে আর রাজবাড়িতে থাকবে না। রাজবাড়ি সংস্কার করে একটা কলেজ আর সংগ্রহশালা হবে।

বীরচন্দ্র এবার থেকে সাধারণ বাড়িতে অন্য পাঁচজনের মতো থাকবে।

রাত্রেই কথা হয়ে গেছে, কিঙ্কর আর দুঃখহরণ মিলে একটা কুস্তির আখড়া খুলবেন। নবীগঞ্জের ছেলেদের তালিম দেওয়া হবে সেখানে।

হেডসার এসেছেন দুঃখহরণবাবুর কাছে। হাত কচলে বলছেন, “এবারকার মতো দোষঘাট মাফ করে দিন দুঃখবাবু। আমাদের সকলের ইচ্ছে গেম-টিচারের পোস্টটা আপনিই নিন, তা হলে খেলাধুলোয় স্কুলের খুব নাম হবে।

দুঃখবাবু বললেন, “পরে ভেবে দেখব। আগে সামনের ওলিম্পিক থেকে কুস্তি আর ম্যারাথনের সোনার মেডেল দুটো নিয়ে আসি।” দুঃখবাবুর দুই বাঁদর ছেলে সকালে এসে খুব ভয়ে-ভয়ে বাবাকে প্রণাম করে গিয়ে লক্ষ্মীছেলের মতো পড়তে বসেছে। চণ্ডিকাঁদেবী একগলা ঘোমটা টেনে গরম লুচিভর্তি থালা নিয়ে এসেছেন। দুঃখবাবুর আর তেমন দুঃখ নেই।