অধ্যায় ৪
“এঃ হে! মেজবাবুর গজটা যে আমার ঘোড়ার মুখে পড়ে গেল! খেয়ে নেব যে!”
“খেয়ে নেবে মানে? খেলেই হল! তোমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?”
“তা অবিশ্যি ঠিক। কিন্তু আপনার গজটা টুকটুকে একখানা পাকা ফলের মতো এমনভাবে নাকের ডগায় ঝুলে আছে যে, ইচ্ছে করছে কপ করে পেড়ে খেয়ে ফেলি!”
“লোভ সংবরণ করো কুঁড়োরাম। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।”
“তা না হয় করলাম। কিন্তু একটু আগে আপনার মন্ত্রীব্যাটাকে বাগে পেয়েও আপনার মুখ চেয়ে আমার নৌকোকে সংবরণ করতে হয়েছে। অবিশ্যি এরকম কাঁচা চাল তো আপনি হরদম দিয়েই থাকেন।”
“ওহে, পাকা খেলুড়িদের কাঁচা চালের মধ্যেও অনেক দুরূহ প্যাঁচ থাকে। ও তুমি বুঝবে না। কাঁচা চাল বলে মনে হয় বটে, কিন্তু ও হল ছদ্মবেশী চাল।”
“তা বটে। এখন এই বাঁ ধারের দ্বিতীয় বোড়েটা এক ঘর ঠেললেই কিন্তু আপনার একটা ঘোড়া যায়। তখন ঘোড়াটা না মারলে আপনি চক্ষুলজ্জায় পড়ে যাবেন যে!”
“আহা, বোড়েটা তুমি ঠেলবেই বা কেন হে? তোমার কি চাল দেওয়ার মতো আর ঘুঁটি নেই?”
“তা থাকবে না কেন, বরং আপনিই বলে দিন আমি কোন ঘুঁটিটা চালব।”
“ঠিক আছে, তুমি বরং ডান ধারের তিন নম্বর বোড়েটা এগিয়ে দাও।”
“সেটা কি ভাল হবে মেজবাবু, তাতে আমার রাজা উদোম হয়ে যাবে যে!”
“তা বলে রাজাকে অত ঘেরাও করে রাখা কি ভাল? বায়ু চলাচলের পথটাও তো রাখতে হবে নাকি!”
“বায়ুর সঙ্গে-সঙ্গে আপনার মন্ত্রী আর গজেরও যে ঢুকে পড়ার রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে মেজবাবু!”
জন্মেজয় ভঞ্জ ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমার দোষ কী জানো কুঁড়োরাম, তুমি কিছু শিখতে চাও না।”
“কে বলে শিখতে চাই না! রোজই আমার বিস্তর শিক্ষা হচ্ছে তো! আপনাকে যত দেখছি তত শিখছি। তবে কিনা আজ আপনার চালগুলো বড্ড বেশি উচ্চাঙ্গের ছিল, তাই একটু হিমশিম খেতে হয়েছে বটে। আপনি কি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মেজবাবু?”
“না হে, দীর্ঘশ্বাসটা ইচ্ছে করে ফেলিনি, তবে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল!”
“সচরাচর রাজাগজাদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে না কিনা, তাই বললাম।”
“আজ আমার মনটা ভাল নেই হে কুঁড়োরাম।”
“বলেন কী মেজবাবু, রাজাগজাদের মন খারাপ হয় জন্মে শুনিনি। ওসব তো আমাদের হয়।”
“সে তো ঠিকই। মন-টনের মতো আজেবাজে জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় কে! মনখারাপ জিনিসটা কেমন তাই তো আমার জানা ছিল না। কী হল জানো, এক জোছনা রাতে আসমানির চরে বসেছিলাম। বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল। গাছপালায় একটা, ওই যে কী বলে, একটা মর্মরধ্বনি উঠছিল। ভারী শান্তি চারদিকে। ঠিক সেই সময়ে নিঃশব্দে একটা নৌকো এসে পাড়ে লাগল আর জনাপাঁচেক লোক নেমে এল। তাদের হাতে বন্দুক। একটু অবাক হলুম, এত রাতে এরা কী শিকার করতে এসেছে! বাঘটাঘ হলে অন্য কথা, কিন্তু আসমানির চরে তো বাঘভালুক নেই! একটু উদ্বেগও হল, কারণ ওরা হল আমারই প্রপৌত্র বিরু আর তার শিকারি বন্ধুরা। দেখলুম ওরা চোরের মতো চুপিচুপি হেঁটে মৃগদাবের দিকে যাচ্ছে। গোকুলেশ্বরের মৃগদাবের কথা তো তুমি নিশ্চয়ই জানো কুঁড়োরাম!”
“জানি মেজবাবু।”
“সবাই জানে গোকুলেশ্বরের প্রাণ হল তার হরিণেরা। অনেক কষ্টে, অনেক খুঁজে সে নানা জাতের চল্লিশ-পঞ্চাশটা হরিণ জোগাড় করে এনে সেগুলোকে মায়ের মতো যত্নে পালে-পোষে। নানা গাছপালায় সাজানো তার মৃগদাবে গেলে চোখ আর মন দুই-ই জুড়িয়ে যায়। দশ-বারোজন লোক দিনরাত হরিণের পরিচর্যা করে। প্রতি সপ্তাহে পশুচিকিৎসক এসে হরিণদের চিকিৎসা করে যায়। দেখলুম, শিকারিরা ওই মৃগদাবের দিকেই যাচ্ছে। উদ্দেশ্যটা খুব ভাল মনে হল না আমার। সেদিন গোকুলেশ্বর আর তার পাঁচজন লোক নতুন হরিণের সন্ধানে নফরগঞ্জে গিয়েছিল। ফলে মৃগদাবে লোক ছিল খুব কম। বুঝলুম শিকারিরা সব খবর নিয়েই এসেছে। বুঝলে কুঁড়োরাম, সেই রাতেই জীবনে আমি প্রথম দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেই প্রথম টের পেলাম দীর্ঘশ্বাস কাকে বলে।”
“বুঝলুম। আমাদের অবশ্য দীর্ঘশ্বাসের কোনও অনটন নেই। তারপর কী হল বলুন।”
“তারপর দুটো বন্দুকের আওয়াজ হল। একটু বাদে শিকারিরা দুটো হরিণের লাশ বালির উপর দিয়ে হিড়হিড় করে টেনে এনে নৌকোয় তুলল। গোকুলেশ্বরের লোকেরা অবশ্য তাড়া করে এসেছিল, কিন্তু শিকারিরা ফায়ার করায় তারা আর এগোয়নি।”
“সেই থেকেই কি আপনার মন খারাপ মেজবাবু?”
“জীবনে সেই প্রথম মনখারাপের অভিজ্ঞতা হল, বুঝলে কুঁড়োরাম! দুনিয়াতে কাপুরুষ অনেক আছে জানি, কিন্তু তাদের একটা যে আমারই বংশধর, সেটা জানলে বড্ড জ্বালা হয় হে!”
কুঁড়োরাম মিইয়ে গিয়ে বললেন, “আমরা বংশানুক্রমে কাপুরুষ বটি, তবে আপনার জ্বালাটাও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। তারপর কী হল?”
“এ তল্লাটের বাচ্চা ছেলেটাও জানে, গোকুলেশ্বর ডাকাত ছিল। ভয়ংকর ডাকাত। তার নামে সাতটা খুনের মামলা ঝুলছে। তার মতো নৃশংস লোক দুটো ছিল না। সারেন্ডার করাতে সরকার বাহাদুর তাকে ক্ষমা করে দেন। এখন সে তার শাকরেদদের নিয়ে মৃগদাবেই থাকে। গত দশ বছর তার নামে কোনও নালিশ হয়নি। হরিণ নিয়েই সে ব্যস্ত থাকে। তার ধ্যানজ্ঞান ওই মৃগদাব।”
“এ তো সবাই জানে। কিন্তু হরিণদুটোকে বিরুবাবু মারলেন কেন?”
“সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। তবে কানাঘুষো শুনছি, বাবুরা নাকি আসমানির চরে গিয়ে সারাদিন বন্দুক ফোটাত বলে গোকুলের কোনও এক স্যাঙাত নাকি আপত্তি জানিয়েছিল। বলেছিল, ‘আসমানির চরে শিকার করা বারণ। হরিণেরা ভয় পাচ্ছে।’ কথাটা মিথ্যেও নয়। তাতেই হয়তো বাবুদের মানহানি হয়ে থাকবে। তা বলে হরিণ মেরে কেউ প্রতিশোধ নেয়? হরিণের মাংস খেয়েছ কখনও? খুব একটা সুস্বাদু নয়, রান্নারও ঝামেলা আছে। শিকারিরা হরিণদুটোর ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে দু’দিন ধরে পেঁপের রস আর দুধে ভিজিয়ে রেখে মজিয়ে নিয়ে তারপর রান্না করে বিশাল ভোজ খেয়েছে। কেন রে বাপু, দেশে খাসি বা পাঁঠার কি আকাল পড়েছিল যে, গোকুলের দুটো হরিণকে মারতে হল! আর গোকুলেশ্বরই কি ছেড়ে কথা কইবে ভেবেছ?”
“তা গোকুলেশ্বর কি কোনও হুমকি-টুমকি দিয়েছে নাকি মেজবাবু?”
“না, দেয়নি। আর সেটাই আরও চিন্তার কথা, বুঝলে? নফরগঞ্জ থেকে আরও সতেরোটা হরিণ এনেছে সে। ফিরে এসে ঘটনাটা শুনেছে। শুনে একটাও শব্দ করেনি। চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ দরজা বন্ধ করে ছিল। তারপর বেরিয়ে এসে রোজকার মতোই হরিণদের দেখভাল করে যাচ্ছে। যেন কোনও হেলদোলই নেই। কিন্তু আমার চোখকে তো ফাঁকি দেওয়া সোজা নয়। আমি লক্ষ করছি, তার চোখদুটো হঠাৎ একদম পালটে গিয়েছে। কোনও হুমকি নেই, আস্ফালন নেই, চেঁচামেচি নেই, পুলিশের কাছে নালিশ অবধি করেনি। তাই বড় ভয় হচ্ছে হে কুঁড়োরাম!”
“ভয়! আপনারও ভয় হয় মেজবাবু! ভয়টয় তো এই আমাদের মতো মনিষ্যিদের জন্য।”
“তাও বটে। ভয় জিনিসটা কেমন সেটা কখনও টেরই পাইনি কিনা। তাই যখন প্রথম ভয়টা মনে এল, তখন ভারী অসোয়াস্তি, আইঢাই, উদগার, জৃম্ভণ, আরও কী সব যেন হচ্ছিল।”
“কিন্তু শরীর না থাকলে এসব তো হওয়ার কথা নয় মেজবাবু!”
“তাও বটে! কিন্তু হচ্ছিল হে! ঠিক বোঝাতে পারব না। যে শত্রু চোখ রাঙায় না, তর্জন-গর্জন ছাড়ে না, লাফঝাঁপ করে না, কিন্তু চুপচাপ নিজের মনে হিসেব কষে যায়, তার মতো বিপজ্জনক শত্রু কেউ নয়।”
“কিন্তু গোকুলেশ্বর কী চায়, তা কি আন্দাজ করা গিয়েছে?”
মাথা নেড়ে জন্মেজয় বলেন, “না হে, তবে বিরু যে কিছু আন্দাজ করেছে, তা টের পাচ্ছি। কারণ, সে একজন বডিগার্ড মোতায়েন করেছে। বেশ শক্তপোক্ত বডিগার্ড, তার নাম ভুসিরাম। সে খবর পেয়েছে যে, গোকুলেশ্বরের লোকেরা নানা ভেক ধরে আশপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। তাদের সকলেরই নাম ‘গ’ দিয়ে শুরু। কী যে হবে কে জানে! আমার বংশটাই না লোপাট হয়ে যায়!”
খুব চিন্তিত মুখে একটু রাত করেই বাড়ি ফিরছিলেন কুঁড়োরাম। বেশ জোছনা ফুটেছে আজ। মাঠঘাট সব বেশ স্পষ্ট ঠাহর হচ্ছে। শিরশিরে একটা হাওয়া বইছে। কুলতলির মাঠটা পেরোলেই বাড়ি আর পোটাক রাস্তা। দিব্যদৃষ্টিটা হওয়ার পর থেকে আজকাল খুব সুবিধে হয়ে গিয়েছে। সবই দেখতে পান। যেমন এখন তিনি মাঠের মধ্যিখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন আশপাশে সামনে পিছনে ছোট-ছোট পরি উড়ে বেড়াচ্ছে, বেলুনের মতো গোল-গোল কয়েকটা মানুষ ঘাসের উপর খানিক হেঁটে, খানিক গড়িয়ে ঘুরে ঘুরে কী করছে কে জানে, ওই যে লম্বা লিকলিকে একটা লোক হঠাৎ হুস করে মাঠটা কোনাকুনি পার হয়ে কোথায় যেন চলে গেল। ছোট-ছোট মেঘের টুকরো পেঁজা তুলোর মতো ইতিউতি পড়ে আছে। লোককে বললে বিশ্বাস করতে চায় না বটে, কিন্তু তিনি যে এসব জলজ্যান্ত দেখছেন, তা তো আর মিছে নয়! সেদিন মেজবাবুকেও বলতে গিয়েছিলেন, তাতে জন্মেজয় ভঞ্জ খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “আমার আগে তোমার দিব্যদৃষ্টি হয় কী করে হে? তুমি তো আমার প্রজা! কখনও শুনেছ রাজার আগে প্রজার দিব্যদৃষ্টি ফুটেছে? সব জিনিসেরই তো একটা নিয়ম আছে নাকি!” কুঁড়োরামকে চুপ মেরে যেতে হল।
এ সময় হঠাৎ একেবারে কান ঘেঁষে কে যেন মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “বুড়োকর্তা, কাজটা কি আপনি ঠিক করলেন?”
কুঁড়োরাম আঁতকে উঠে বললেন, “কে রে?”
“আজ্ঞে, আমি গন্ধেশ্বর।”
ভারী অবাক হয়ে কুঁড়োরাম বলেন, “গন্ধেশ্বর!”
“যে আজ্ঞে। ছাগলের ব্যাপারী গন্ধেশ্বর। মনে নেই আমাকে?”
কুঁড়োরাম উত্তেজিত হয়ে বলেন, “মনে থাকবে না মানে! মনে না থেকে উপায় আছে? কিন্তু তোমার এমন ব্যবহার কেন বলো তো! মানছি তুমি একজন জ্ঞানী লোক, ছাগলের ব্যাপারে তোমার মতো এত পণ্ডিত কেউ নয়। এটাও না মেনে উপায় নেই যে তোমার তৃতীয় নয়নও ফুটেছে, কিন্তু তা বলে আমার গোপন তবিল হাপিস করা কি তোমার উচিত হল বাপু?”
গন্ধেশ্বর অত্যন্ত ব্যথিত গলায় বলে, “কথাটা কইতে আপনার বাধল না বুড়োকর্তা! ছিঃ ছিঃ, ভাবলে আমারই তো মাথা হেঁট হয়ে আসে! আপনার মতো একজন মানুষ যে একাজ করতে পারেন সেটা বিশ্বাসই হতে চায় না মশাই!”
কুঁড়োরাম ভড়কে গিয়ে বলেন, “তার মানে? আমি আবার কী করলাম হে?”
“সেই বৃত্তান্ত বলতেই তো আসা। আপনার তবিল চুরি হয়েছে বলে আপনার ছেলেরা পুলিশে এত্তেলা দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ এসে খোঁজখবর করাতে বুড়োকর্ত্রী বেরিয়ে এসে বললেন, ‘বুড়োর ভীমরতি হয়েছে। ও তবিল আমি কবেই সরিয়ে ফেলেছি। গয়নাগুলো তিন বউমাকে বাঁটোয়ারা করে দিয়েছি, আর টাকাগুলো সংসারের কাজে লাগছে। ওই গর্তের মধ্যে পড়ে থাকলে হয় চুরি হয়ে যেত, নয়তো টাকাগুলো পোকায় কাটত। ওখানে পাঁচটা টাকা শুধু পড়ে আছে।’ তাই বলছিলুম এই গরিবকে এত মেহনতের মধ্যে ফেলা কি আপনার ধর্মে সইবে? খাটুনির মজুরিটা অবধি ওঠেনি!”
কুঁড়োরাম একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলেন, “তাই তো হে, তা হলে তো তোমার খুব হয়রানি গিয়েছে! তা বাপু, তুমি কি চোর নাকি?”
“চোর! কীসের চোর! কোথায় চোর? কে চোর? চোরের কথা উঠছে কেন বলুন তো! এর মধ্যে চুরির আপনি কী দেখলেন বুড়োকর্তা?”
“তা হলে কি তুমি বলতে চাও যে তুমি চোর নও?”
“আমি! হাসালেন বুড়োকর্তা! ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, নইলে বলতে হয়, চোর তো বেরোলেন বুড়োকর্ত্রী! আর আমি! আমি তো আপনার ভাল ভেবে মনে করলাম, বুড়োকর্তার তো বয়স হয়েছে, তাঁর তবিলের দেখাশোনা করাটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। চারদিকে চোর-ছ্যাঁচড়ের যা উপদ্রব! তাই তবিল সব ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখার জন্য রাতবিরেতে কত কষ্ট করে, আপনার কাঁচা ঘুম বাঁচিয়ে, আপনার ছাগলদের সামলে ঠাকুরের সিংহাসন সরিয়ে উঁকি মেরে দেখি, সব ফক্কা। একখানা পাঁচ টাকার চাক্কি পড়ে আছে শুধু। ছিঃ ছিঃ বুড়োকর্তা, এভাবে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া কি আপনার উচিত কাজ হল? এর পর পাঁচজনকে মুখ দেখাবেন কী করে?”
এই বলেই গন্ধেশ্বর হনহন করে হেঁটে হাওয়া হয়ে গেল। বেশ অভিমান করেই চলে গেল বলে মনে হয়।
অপ্রস্তুত কুঁড়োরাম নিজের থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবতে লাগলেন, তাই তো! এসব হচ্ছেটা কী? কোথায় যেন একটা গড়বড় হয়ে যাচ্ছে! এ তো মোটেই ভাল কথা নয়! এত ভুলভাল করার লোক তো তিনি নন! ম্যাট্রিকে তিনি পাঁচটা লেটার পেয়েছিলেন, নিন্দুকেরা স্বীকার করুক বা না করুক, তাঁর মেধা তো আর কারও চেয়ে কম নয়! তবে ভুল হচ্ছে কী করে? ‘বাচস্পতি’ উপাধি তো তাঁকে মুখ দেখে দেয়নি। হুঁ হুঁ বাবা, বিস্তর শাস্ত্র ঘেঁটে তবে বাচস্পতি হওয়া যায়। অঙ্কে নম্বরটা একটু কম হয়েছিল ঠিকই, আর ইংরেজি তো ম্লেচ্ছ ভাষা, তাই সেই বাবদে নম্বরটা তিনি ধরছেন না। আর কীসে তিনি কম? এসব ভেবে নিজের উপর তো এখন তাঁর শ্রদ্ধাই হচ্ছে! নিজেকে একটা প্রণাম করতেও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু এই বয়সে অতটা ঝুঁকে নিজের পায়ের ধুলো নেওয়া ভারী শক্ত কাজ। একবার ঝুঁকলে পিঠ ব্যাটা আর সোজাই হতে চায় না। গত বোশেখ মাসে তো সেই বিপদই হয়েছিল। সক্কালে ঘুম থেকে উঠেই মনে হল, না, আজ একটা শুভদিন, আজকের দিনটা একজন বিচক্ষণ, সজ্জন, শাস্ত্রজ্ঞ, শিক্ষিত, দূরদ্রষ্টা, সমদর্শী, নিরহংকার, দয়ালু, উদারচেতা, অকুতোভয়, মোহমুক্ত, নির্লোভ, বিগতস্পৃহ, দেবতুল্য মানুষকে প্রণাম করে শুরু করা উচিত। কিন্তু বসে বসে আকাশপাতাল ভেবেও এমনতরো কাউকে মনে করতে পারলেন না। ঘণ্টাখানেক বাদে মনে হল, একমাত্র তিনি নিজে ছাড়া আর কেউই এমনতরো নেই। নিজেকে প্রণাম করতে একটু বাধো বাধো ঠেকছিল বটে, কিন্তু উপায়ই বা কী? আর সেইটে করতে গিয়ে সেই যে কুঁজো হলেন, পরের তিন দিন সবাই মিলে নানা রকম ডলাইমলাই করা সত্ত্বেও, আর সোজা হতে পারেননি। সেই থেকে নিজের উপর শ্রদ্ধাভক্তির বাড়াবাড়ি রকমের ভাব এসে গেলে নিজেকে সামলে রাখতে হয়। আজও সামলানোর চেষ্টা করছিলেন।
হঠাৎ কাছ থেকেই কে যেন ফস করে বলে বসল, “এই যে বাচস্পতিমশাই! তা এই ভরসন্ধেবেলা কুলতলির মাঠে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন বলুন তো! মতলবটা কী! একটু আগেই তো আড়াল থেকে দেখলাম বলুগুন্ডাটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে খোসগল্প জুড়ে দিয়েছেন, দেখে মনে হচ্ছিল দু’জনের ভারী ভাবসাব। কী ব্যাপার মশাই, কোনও ফন্দি আঁটছেন নাকি? রকমসকম তো তেমন সুবিধের ঠেকছে না!”
এই বাক্য শুনে কুঁড়োরামের বাক্য হরে গেল, হাঁ করে লোকটার দিকে চেয়ে রইলেন, কিন্তু চিনতে পারলেন না। লম্বা চওড়া লোক, দিব্যি জোয়ান তাগড়াই চেহারা, চোখে খর দৃষ্টি, মাথায় কদমছাঁট চুল, গায়ে ময়লা পিরান আর পরনে মালকোঁচা মারা ধুতি। বাক্য ফিরে পেতে খানিক সময় লাগল কুঁড়োরামের। তারপর ভয়ে ভয়ে বললেন, “না বাবা, মতলব কিছু খারাপ নয়। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি কিনা, তাই ঠাহর করবার চেষ্টা করছিলাম আর কী।”
লোকটা গুল্লুগুল্লু চোখে তাঁকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে বলে, “ওসব ভীমরতির গল্প আমাকে বলে লাভ হবে না। আপনি যে একজন জাঁহাবাজ লোক, তা আমরা জানি। বলুগুন্ডার সঙ্গে যে আপনার মেলামেশা, দহরম-মহরম আছে, সে খবরও আমাদের অজানা নেই। আর কুঠিবাড়ির কাছারিঘরে প্রায়ই কারও সঙ্গে আপনাকে গোপনে শলাপরামর্শ করতে দেখা যায় বলেও খবর আছে। আজও আপনি সেখানে গিয়েছিলেন।”
কুঁড়োরাম ফের বাক্য হারিয়ে ফেললেন এবং বেশ কিছুক্ষণ কোনও ভাল বা মন্দ বাক্য খুঁজেই পেলেন না। অনেক কষ্টে শেষে বললেন, “তা বাবা, বুড়োমানুষ তো, ভুলভাল করে ফেলি। ক্ষ্যামাঘেন্না করে দাও। আমি বরং তোমাকে আশীর্বাদ করছি, ধনেপুত্রে লক্ষ্মীলাভ হোক। এবার আমি তবে আসি?”
লোকটা বাঘা চোখে চেয়ে একটা হুংকার দিল,“আশীর্বাদ! কে আপনার আশীর্বাদ চেয়েছে শুনি! পট করে একটা আশীর্বাদ করে ফেললেই হল! এর পর তো হাটে-মাঠে-ঘাটে হ্যাতান্যাতা যে কেউ আশীর্বাদ করার জন্য তেড়ে আসবে! আশীর্বাদ করারও মুরোদ চাই মশাই। যারা ষণ্ডাগুন্ডাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে, যাদের গতিবিধি সন্দেহজনক, যারা ভদ্রলোকের পোশাক পরে নানা দুষ্কর্মের ইন্ধন জোগায়, তাদের আশীর্বাদ অভিশাপের চেয়েও খারাপ।”
হুংকার শুনে ভয়ে আরও একটু জড়সড় হয়ে গেলেন কুঁড়োরাম, গলাটাও কেমন যেন ফেঁসে গেল, ভিতর থেকে আওয়াজই বের করতে পারছিলেন না। অতি কষ্টে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা! আশীর্বাদ করাটা মোটেই উচিত কাজ হয়নি।”
লোকটা কুঁড়োরামকে ভস্ম করে দেওয়ার চোখে তাকিয়ে বলে, “বলুগুন্ডাটা কী বলে গেল আপনাকে শুনি!”
কুঁড়োরাম আকাশ থেকে পড়ে বললেন, “বলুগুন্ডা! না বাবা, বলুগুন্ডার সঙ্গে তো আমার দেখা হয়নি! আমার সঙ্গে তো গন্ধেশ্বরের কথা হচ্ছিল।”
লোকটা ভ্রূ কুঁচকে বাঘা গলায় বলে, “চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। গত দু’বছর ধরে আমি বলুর পিছু ধাওয়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তাকে এক মাইল দূর থেকেও চিনতে পারি। সে একজন স্মাগলার, সুপারি খুনি, আড়কাঠি, জালিয়াত, তোলাবাজ এবং কী নয়! আপনি সেই বলুকে বাঁচাতে একজন বাচস্পতি হয়েও মুখ মুছে মিছে কথা বলতে পারলেন? আপনার লজ্জা করল না?”
কুঁড়োরাম আমতা-আমতা করে বললেন, “তা লজ্জা একটু করছে বটে, বাবা! তা হলে কি বলছ বলুগুন্ডাকে আমার চেনা উচিত?”
লোকটা এবার একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলল, “চেনা উচিত কী বলছেন,আমার তো মনে হচ্ছে আপনি তার সঙ্গে গভীর ষড়যন্ত্রে যুক্ত আছেন! ঠিক কি না? আর কুঠিবাড়ির কাছারিঘরে কার সঙ্গে আপনার মেলামেশা হয়, সেটাও আমাদের জানা দরকার। এবার ঝেড়ে কাশুন তো!”
কুঁড়োরাম সভয়ে বললেন, “আমার যে বড় শ্লেষ্মার ধাত, একবার কাশলে সেই কাশি আর থামতেই চায় না! তা কাশব কি বাবা?”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “থাক, আর কাশির দরকার নেই। এবার বাড়ি যান। মনে রাখবেন আবার বলুগুন্ডার সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। আর কাছারিঘরের উপরেও আমরা নজর রাখছি।”
কুঁড়োরাম সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাত করে বলেন, “সে আর বলতে! তাই হবে বাবা!”
মানুষ ভাবে এক আর হয় আর-এক। কুঁড়োরাম কুলতলির মাঠে মারমুখো লোকটার কাছে যথেচ্ছ হেনস্থা হয়ে বাড়ি ফিরে কম্পিতবক্ষে স্থির করে ফেললেন, না, আর গন্ধেশ্বরের মুখদর্শনও করবেন না। মেজবাবুর সঙ্গেও আর দেখাসাক্ষাতের দরকার নেই। রাতে তিনি খাটের পাশের জানালাটা কটকটে করে এঁটে শুলেন। কিন্তু বড্ড ধকল গিয়েছে বলে বায়ু কুপিত হয়ে ঘুম আসছিল না। এপাশ-ওপাশ করছেন, এমন সময়, নিশুত রাতই হবে, জানালার বাইরে থেকে মোলায়েম গলায় কে যেন বলল, “বুড়োকর্তার কি আজ ঘুম আসছে না নাকি! বড্ড নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছি যে!”
কুঁড়োরাম গলাটা বিলক্ষণ চেনেন। গন্ধেশ্বর। কিন্তু না চেনবার চেষ্টা করতে করতে মটকা মেরে শুয়ে রইলেন। নড়াচড়া বন্ধ। মোলায়েম গলা আবার বলে, “বুড়োকর্তা দেখছি টোকনার ঠোকনা খেয়ে বড্ড লাতন হয়ে পড়েছেন! আরে দূর-দূর! আপনিও যেমন, টোকনা আবার একটা ভাবনার বিষয় হল? শূন্য কলসি বাজে বেশি। আপনি উলটে চোখ রাঙালেই দেখতেন পালানোর পথ পাচ্ছে না।”
এবার কুঁড়োরাম উঠে বসে খুব অভিমানের গলায় বললেন, “বাপু, তুমি তো গন্ধেশ্বর নও। তুমি তো বলুগুন্ডা। তা কথাটা আগে বলতে হয়!”
“বলেন কী কর্তা, আমি গন্ধেশ্বর নই? সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই জেনে আসছি যে আমার নাম গন্ধেশ্বর, ডাকনাম গ্যাদা, সেটা কি তবে মিথ্যে? আমার নাম বলুগুন্ডা একথা কি ওই মিথ্যেবাদী টোকনা আপনাকে বলেছে? ও যদি দশটা কথা কয় তা হলে তার মধ্যে এগারোটা মিছে কথা থাকে। খগেন মালকে কি আর আজ চিনলাম বুড়োকর্তা! ভালমানুষ সেজে বিরুবাবুর বন্ধু হয়ে কুঠিবাড়িতে ঢুকেছে বটে, কিন্তু ওর মতলব কী সে তো আমি জানি!”
“কী মতলব বাপু?”
“সে আর আপনার জেনে কাজ নেই। আপনি ঋষিতুল্য লোক, পাপীতাপীদের কথা যত না শোনেন ততই ভাল। তবে জেনে রাখুন, খগেনের কাছ থেকে যত দূরে থাকবেন ততই মঙ্গল। ওর হাওয়া-বাতাসও পারতপক্ষে গায়ে লাগাবেন না। টোকনা ভদ্রলোক সেজে আজ খগেন মাল হয়েছে বটে, কিন্তু চরিত্তির যাবে কোথা? কুঠিবাড়ির কোথায় সোনাদানা, হিরেজহরত লুকনো আছে তারই গন্ধে-গন্ধে এসে জুটেছে। আপনার উপরে চড়াও হয়েছিল তো সেই কারণেই।”
কুঁড়োরাম ভারী অবাক হয়ে বলেন, “কী কারণে বাপু? এর মধ্যে আমি আসছি কোত্থেকে?”
আড়ালে খুক করে একটু হাসি শোনা গেল গন্ধেশ্বরের। তারপর গলাটা এক পরদা নামিয়ে বলে, “আসছেন বুড়োকর্তা, আপনিও আসছেন।”
“বলো কী? আমি কীভাবে আসতে পারি?”
“তা এই ধরুন আপনি একজন ব্রেহ্মজ্ঞানী মানুষ তো বটে! লোকে বলাবলি করে আপনি জপতপ করতে করতে খুব উঁচু থাকে উঠে গিয়েছেন। তারা এমন কথাও বলে যে, কুঁড়োঠাকুর এখন সামনে পিছনে ভূত নিয়ে চলাফেরা করেন। রাস্তায়ঘাটে, বাজারেহাটে, আপনাকে নিয়ে খুব কথা হচ্ছে আজকাল। তারা বলে, কুঠিবাড়ির মেজকর্তার সঙ্গে কুঁড়োঠাকুরের সাঁট হয়েছে। দু’জনে এখন হরিহরাত্মা। লুকানো সোনাদানার বিলিব্যবস্থা এখন কুঁড়োঠাকুরের হাতে। পাপীতাপীরা একথা শুনে ভারী তেতে উঠেছে কিনা। আপনি তো আপনভোলা লোক তাই হয়তো খেয়াল করেন না যে, আপনি পথে বেরোলেই কিছু লোক আপনার পিছু নেয়। কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে কথা কইছেন, সব তারা হিসেবে রাখছে। তাতে একটা সুবিধেও হয়েছে কিন্তু, আপনাকে আর একাবোকা চলাফেরা করতে হচ্ছে না। এই বয়সে সেটাও একটা ভরসা, কী বলেন?”
এখন ভাদ্রের শেষ। একটুআধটু হিম পড়ে আজকাল। তা সত্ত্বেও কুঁড়োরামের এখন বেশ ঘাম হতে লেগেছে। তিনি ফাঁসা গলায় বললেন, “এটা কি তাদের উচিত হচ্ছে গন্ধেশ্বর? কারও পিছু নেওয়া কি ভাল?”
“শুধু পিছু নেওয়া কী বলছেন, আপনার বাড়ির চারদিকেই তারা প্রায় সবসময়ে চক্কর কাটছে। এই তো একটু আগেই দেখলুম, লম্বা গলার শুঁটকো একটা লোক আপনার জানলার পাশটিতে বেশ কিছুক্ষণ থানা গেড়ে ছিল। সে বিদেয় হল তো একজন দশাসই চেহারার লোক কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেল। সে ফিরে যাওয়ার পর একজন বেঁটে মোটা লোকও হাফপেন্টুল পরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে গিয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তল্লাটে আপনার খাতির বড্ড বেড়ে গিয়েছে কর্তা!”
কিন্তু এ খবরে কুঁড়োরামের তেমন আনন্দ হল না, বরং তিনি অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, “বাপু গন্ধেশ্বর, বাকি রাতটা দেখছি আর ঘুমের আশা নেই! এইভাবে আমাকে উদ্বেগে ফেলে দেওয়া কি ঠিক হল হে!”
“আজ্ঞে কর্তা, কাঁঠাল পাকলে ভোমা মাছিরা তো আসবেই! ওটাই নিয়ম কিনা! আর এই তক্কে খুব নামডাকও হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আপনার। সেটাও তো কম কথা নয়!”
নামডাক হচ্ছে শুনে বরং কুঁড়োরামের গলা আরও শুকিয়ে গেল। তিনি প্রায় এক ঘটি জল খেয়ে ফেললেন, তারপর দুর্গতিনাশিনীর জপ করতে করতে চোখ বুজলেন। জানালার বাইরে থেকে গন্ধেশ্বর বলল, “আজ মনে হচ্ছে আপনার ঊর্ধ্বগামী বায়ু আর নীচে নামবে না। তা হলে বরং পরে কখনও এসে শ্রীচরণে কয়েকটা কথা নিবেদন করে যাব।”
সকালে শয্যাত্যাগের পর প্রাতঃকৃত্য এবং জপতপ সেরেই কুঁড়োরাম হাঁক মারলেন, “কাশীম! কাশীম আছ নাকি হে!”
ডাক শুনে আজ তাঁর বড় ছেলে মনসারাম এসে দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, “বাবামশাই, ডাকছিলেন নাকি?”
কুঁড়োরাম বললেন, “ওহে, আমি ঠিক করেছি কিছুদিন কাশীতে গিয়ে থাকব। তোমরা তার ব্যবস্থা করো।”
মনসারাম প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, “বলেন কী বাবামশাই? চারদিকটা ম্লেচ্ছকণ্টকিত বলে আপনি কখনও এই পরগনার বাইরে যাননি, গোগাড়ি ছাড়া আর কোনও যানবাহনের সঙ্গে আপনার সংস্রব নেই, কখনও রেলগাড়িতে চাপেননি, তার উপর এই বয়সে কাশীযাত্রা কি আপনার সইবে?”
কুঁড়োরাম বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওহে, এই জায়গাও আমার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। অনিদ্রা, কোষ্ঠকাঠিন্য, শিরঃপীড়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিয়েছে। কাশীতে গিয়ে একটু হাঁফ ছাড়া দরকার।”
“তা হলে কাশীতে যাওয়ার আগে একবার কোবরেজমশাইকে দেখালে হয় না? কাশীতে গেলেই তো উপসর্গগুলোর উপশম হবে না! তার জন্য চিকিৎসা দরকার। তা ছাড়া আরও অসুবিধে আছে। রেলগাড়িতে নানা লোকের ভিড়। আপনি জপতপ, আচারবিচার সামলে এত দূর যেতে পারবেন কি?”
কুঁড়োরামও বুঝতে পারছিলেন সিদ্ধান্তটার মধ্যে একটা গোলমাল রয়েছে। তবু মুখে একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “তোমাদের দোষ কী জানো, তোমরা সব কথাতেই ফুট কাটো! ভোরবেলা উঠেই আমার মনটা তখন থেকে কাশী-কাশী করছে, সেটাও তোমাদের সহ্য হচ্ছে না! আরে বাপু তীর্থধর্মও তো করা দরকার, নাকি?”
“আজ্ঞে তা তো বটেই, তবে বয়সের কথাটা বিবেচনা করলে হুট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়াটা উচিত হবে না। আপনি বরং মায়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে পরামর্শ করে দেখুন।”
কুঁড়োরাম ফুস করে নিবে গিয়ে জুলজুল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তা হলে বরং কাশী এখন থাক। কী বলো? আচ্ছা বৃন্দাবনটা কি একটু কাছাকাছি হবে? তা হলে তুমি বরং আমার জন্য বৃন্দাবনের একটা টিকিট কেটে নিয়ে এসো।”
“না বাবামশাই, বৃন্দাবন আরও দূরে।”
“নাকি! তা হলে বরং হরিদ্বারের ব্যবস্থাই করো। সেটা তো আর দূরে নয়!”
“হরিদ্বার কাশী ছাড়িয়ে। কিন্তু আপনি হঠাৎ তীর্থে যাওয়ার জন্য উতলাই বা হয়েছেন কেন বাবামশাই?”
কুঁড়োরাম এ কথার জবাব দিলেন না। জুলজুল করে চেয়ে রইলেন। সন্ধেবেলা তাঁকে দেখে জন্মেজয় ভঞ্জ বোমার মতো ফেটে পড়ে বললেন, “তোমার আস্পদ্দা তো কম নয় হে কুঁড়োরাম! আমি জীবনে কাশী, বৃন্দাবন, হরিদ্বার যেতে পারিনি, আর আমার আগে তুমি সেখানে যাওয়ার কথা ভাবলে কী করে? তুমি না আমার প্রজা! রাজার আগে প্রজা তীর্থ করতে যায় কখনও শুনেছ?”