হাসিরাশি মাসির মুখে হাসি নেই, বরং রাশি রাশি দুঃখ। হাসিখুশি মাসির খুশি উবে গিয়ে ফাঁসির আসামির মতো মুখের চেহারা। কাশীবাসী মাসির কাশী রওনা হওয়ার মতোই অবস্থা। তিন মাসি ভেতরবাড়িতে বারান্দায় গোল হয়ে বসে ডাক ছেড়ে কাঁদতে লেগেছেন। কান্নার শব্দে পাড়াপ্রতিবেশীরাও জড়ো হয়েছে। মাসিদের মাঝখানে সোজা হয়ে বসে চিতেন সবাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কাশীবাসী মাসি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, “বুড়োটাকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলুম, এ ছেলেধরা না হয়েই যায় না। ছেলেমানুষ বিপিনটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কাশীর গলিতে-গলিতে ভিক্ষে করাবে।”
হাসিরাশি মাসি বললেন, “সে তো তবু ভাল। কাশীতে ভিক্ষে করলে পুণ্যি হয়। লোকটার চোখ দ্যাখোনি! যেন ভাঁটার মতো ঘুরছে। বলে রাখছি, মিলিয়ে নিয়ে, এ-লোক হল ছদ্মবেশী কাঁপালিক। নরবলি দেওয়ার জন্য কচি বাচ্চা খুঁজতে বেরিয়েছে। তাই বিপিনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।”
হাসিখুশি মাসি বলে উঠলেন, “বালাই ষাট। ওকথা কি বলতে আছে? তবে বলেই যখন ফেললে ছোড়দি, তখন আমিও বলি, নরবলি দিয়েই কি ক্ষান্ত থাকবে ভেবেছ? তারপর বিপিনের আত্মাটাকে ভূত বানিয়ে দিন-রাত বেগার খাটাবে।”
প্রতিবেশী নরহরিবাবু বললেন, “তা অত ভাববার কী আছে? দিন না লোকটাকে আমাদের হাতে ছেড়ে। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দিই।”
কাশীবাসী মাসি আর্তনাদ করে উঠলেন, “ও বাবা! তার কি জো আছে? লোকটা যে বিপিনকে বশ করে ফেলেছে গো! দ্যাখোগে যাও, গুচ্ছের লুচি গিলে সে-লোক ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোচ্ছ, আর বিপিন তার পা টিপে দিচ্ছে। বলেই দিয়েছে, ভজনবাবুর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তা হলে সে আত্মহত্যা করবে।”
এইবার একটু ফাঁক পেয়ে চিতেন বলে উঠল, “আহা, সব জিনিসেরই যেমন খারাপ দিক আছে, তেমনই একটা ভাল দিকও আছে।”
হাসিরাশি মাসি ধমকে উঠলেন, “ভাল দিক আবার কী রে হতভাগা? এর মধ্যে কোন ভালটা তুই দেখলি?”
চিতেন হেসে বলল, “আছে গো মাসি, আছে। সেটা ভেঙে বলা যাবে না। তবে লেগে গেলে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হবে। বিপিনদাদা এক লম্ফে একেবারে মগডালে উঠে যাবেন।”
হাসিখুশি মাসি বললেন, “কেন, বিপিন কি হনুমান?”
চিতেন খুশি হয়ে বলল, “জব্বর কথাটা বলেছেন বটে মাসি। হনুমানই বটে! আমার অনুমান, এবার বিপিনদাদা হনুমানের মতো এক লাফে দুঃখের সমুদুর ডিঙিয়ে একেবারে সুখের স্বর্ণলঙ্কায় গিয়ে পড়বেন।”
ওদিকে বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরবাড়ির শোরগোল আর মড়াকান্না শুনে গোবিন্দ আর গোপাল একটু থতমত খেল।
গোপাল বলে, “কান্না কীসের? কেউ মরেছে নাকি?”
গোবিন্দ বলল, “তাই তো মনে হচ্ছে।”
হলধরকে তারা ছাড়েনি। হলধর চিঁ চিঁ করে বলল, “ওরে বাবা, আমি মরা-টরা যে একদম পছন্দ করি না। এই বার আমাকে ছেড়ে দাও বাবাসকল।”
গোবিন্দ একটু শঙ্কিত গলায় বলল, “ভজনবুড়োটাই মরেনি তো গোপালদা! তা হলেই তোত চিত্তির। একান্নটা টাকা জলে গেল!”
“আমারও একান্ন টাকা। রেটটা কত্তাবাবু কম দিচ্ছিলেন বলে বেশ রাগ হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, রেটটা কম হওয়াতে ক্ষতিটাও কমই হল।”
গোবিন্দ বলল, “সেটা আবার কীরকম হিসেব গো গোপালদা?”
“বুঝলি না?”
“বুঝিয়ে দিলে তো বুঝব!”
“ধর, ভজনবুড়োকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়ার জন্য কত্তাবাবু যদি পাঁচশো টাকা করে বখশিশ কবুল করতেন, তা হলে আজ ওই পাঁচশো টাকা করেই জলে যেত। তবে দেখতে হবে ভজনবুড়ো সত্যিই মরেছে কি না।”
গোবিন্দ হতাশ গলায় বলল, “সে ছাড়া আর কে মরবে? দেড়শোর কাছাকাছি বয়স, মরলে তারই মরার কথা।”
গোপাল বলল, “মানলুম। কিন্তু ভজনবুড়ো মরলে এরা কাঁদবে কেন বলতে পারিস? ভজনবুড়ো মরলে এদের কী? সে এদের কে? পরস্য পর বই তো নয়।”
“আহা পর মরলে কি লোকে কাঁদে না? সবাই তো আর আমাদের মতো পাষণ্ড নয়। তা এ লোকটার কী ব্যবস্থা করবে?”
“একটা রদ্দা মেরে ঝোপে ঢুকিয়ে দে।”
হলধর এই আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই গোবিন্দ তার মাথায় একখানা রঙ্গা বসিয়ে অজ্ঞান করে একটা ঝোঁপের পেছনে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “বোষ্টম হয়ে আর কত পাপ যে করব?”
গোপাল কানখাড়া করে কান্নার শব্দ শুনে বলল, “এ যা কান্না শুনছি, তাতে একজন মরেছে বলে মনে হয় না। দু-তিনজন মরেছে বলে মনে হচ্ছে। মেলা লোকের গলাও শুনতে পাচ্ছি।”
গোবিন্দ উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, “তা হলে কী হবে গোপালদা?”
“লোকজন যখন জড়ো হয়েছে তখন সুবিধের কথাই। চল, পেছন দিক দিয়ে গিয়ে ভেতরবাড়িতে ঢুকে ভিড়ে মিশে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝি।”
তো তাই হল। দুজনে গুটিগুটি বাড়ির পেছন দিক দিয়ে উঠোনে ঢুকে দেখল, পনেরো-বিশজন লোক এই শীতের রাতে উঠোনে জড়ো হয়েছে। বারান্দায় একখানা হারিকেন জ্বলছে, তার একটুখানি মাত্র আলো। তাতে উঠোনের কারওই মুখ বুঝবার উপায় নেই। দুজনে মুড়িসুড়ি দিয়ে একটু পেছনে চেপে দাঁড়িয়ে গেল।
গোবিন্দ একটু চাপাগলায় বলল, “তিন-তিনটে যক্ষিবুড়ি কেমন সুর করে কাঁদছে দেখেছ, ঠিক যেন কালোয়াতি গান।”
সামনে একটা বেঁটেমতো লোক দাঁড়ানো। সে মুখটা ফিরিয়ে বলল, “আহা, কাঁদবে না? তিন বুড়ির অন্ধের নাড়ি বোনপোটাকে যে ছেলেধরা এসে নিয়ে যাচ্ছে!”
গোবিন্দ চোখ বড় করে বলল, “নিয়ে গেছে?”
“এখনও নেয়নি, তবে নেবে। ছেলেধরাটা ঘরের মধ্যেই আছে।”
“বলো কী! তা ছেলেধরাটাকে ধরে–”
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “উঁহু, উঁহু, সে উপায় নেই। ছেলেধরার পেল্লায় চেহারা। চার হাত লম্বা, আশি ইঞ্চি বুকের ছাতি, মুগুরের মতো হাত, পেল্লায় গোঁফ আর রক্তবর্ণ চোখ সব সময়ে ভাঁটার মতো ঘুরছে। হাতে একখানা তলোয়ারও আছে বলে শুনেছি।”
“বলেন কী!”
পাশ থেকে একজন রোগাভোগা লোক বলল, “তলোয়ার নয়, তার হাতে রাম-দা। আর চার হাত কি বলছ, সে পাঁচ হাতের সিকি ইঞ্চি কম নয়। সন্ধের দিকে একটা গর্জন ছেড়েছিল তাতে আমার নারকোল গাছ থেকে দুটো নারকোল খসে পড়েছে।”
মাফলারে মুখ-ঢাকা একটা লোক চাপাগলায় বলল, “ফুঃ, তোমরা তাকে মানুষ ঠাওরালে নাকি? সে মোটেই মানুষ নয়, নির্যস অপদেবতা। আর সন্ধের মুখে তো আমার খুড়তুতো ভাই নন্দর সঙ্গে রথতলার মোড়ে তার দেখা। নন্দ ডাকাবুকো লোক, অত বড় চেহারার মানুষ দেখে ডাকাত বলে ধরতে গিয়েছিল। ধরলও জাপটে। লোকটা স্রেফ হাওয়া হয়ে গেল। দশ হাত পেছন থেকে ডাক দিয়ে বলল, “কী রে, ধরবি? আয় ধর দেখি।’ তা ভয় পেয়ে নন্দ চোঁ-চা দৌড়।”
গোপাল নিরীহ গলায় বলল, “ এখন ছেলেধরাটা ঘরের মধ্যে কী করছে?”
বেঁটে লোকটা বলল, “কী আর করবে! বিপিনকে বস্তায় পুরে বাঁধাছাঁদা করছে বোধ হয়।”
লম্বা একটা লোক বলল, “আরে না, না, সে বৃত্তান্তই নয়। বিপিনকে কখন বশীকরণ করে ফেলেছে। সে এখন লোকটার পা টিপছে।”
গোপাল বলল, “তা আমরা একটু লোকটাকে দেখতে পাই না?”
“দেখে হবেটা কী? ও না দেখাই ভাল।”
গোপাল আর গোবিন্দ একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল। গোবিন্দ বলল, “কিন্তু তা হলে শুটকো বুড়োটা কোথায় গেল বলল
তো গোপালদা! যা বিবরণ শুনছি তাতে তো সে এই লোক বলে মনে হচ্ছে না!”
গোপাল তোধিক গলা চেপে বলল, “তুই বড় আহাম্মক। এতদিন এ-লাইনে আছিস। আর এটা জানিস না যে, গাঁয়ের লোকেরা সবসময়ে তিলকে তাল করে! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস কী?”
“তা বটে! কিন্তু তেনাকে চাক্ষুষ করারই বা উপায় কী বলো!”
“একটা কথা আছে, সবুরে মেওয়া ফলে। দামি কথা। মনে রাখিস।”
ওদিকে তিন মাসির মাঝখানে বসেও চিতেনের চোখ ঠিকই কাজ করে যাচ্ছিল। সে একজন প্রতিভাবান মানুষ, কাজেই তার চোখ আর পাঁচজনের মতো ম্যাস্তামারা চোখ নয়। সব সময়ে চারদিককার সবকিছুকে দেখছে, বিচার-বিশ্লেষণ করছে এবং কাজেও লাগাচ্ছে। চিতেন আবছা আলোতেও দুজন অচেনা লোককে ভিড়ের পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। পাজি লোকদের সে লহমায় চিনতে পারে। এ-দু’জন যে পাকা পাজি, তা বুঝে নিতে তার এক মুহূর্তও সময় লাগল না।
চিতেন টপ করে উঠে পড়ল। ধীরেসুস্থে হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে গিয়ে নিচুগলায় জিজ্ঞেস করল, “এ-গাঁয়ে নতুন বুঝি?”
লোক দুটো একটু অস্বস্তিতে পড়ে দুজনে একসঙ্গেই বলে, “হ্যাঁ।”
“তা আপনারা কারা?” একজন বলল, “আমি গোপাল, আর ও গোবিন্দ।”
“বাঃ, বেশ, বেশ। তা কাজটা কী?”
গোপাল একটু আমতা-আমতা করে বলল, “একজন লোককে খুঁজতে আসা। সে বিশেষ ভাল লোক নয়। শুনলাম সে বিপিনবাবুর বাড়িতে থানা গেড়েছে।”
“কেমন লোক বলুন তো?”
“চেহারার বুড়োমানুষ। বয়স ধরুন হেসেখেলে দেড়শো বছর।”
চিতেন খুব ভাবিত হয়ে বলল, “দেড়শো বছর! নাঃ মশাই, একটু কমসম হলেও না হয় ভেবে দেখা যেত। এত বয়সের লোক কোথায় পাব বলুন তো! সাপ্লাই নেই যে!”
গোপাল একটু থতমত খেয়ে বলে, “তা কিছু কমও হতে
পারে।”
চিতেন একটু হেসে বলল, “তাই বলুন! তা ধরুন একশো বিশ ত্রিশ বছর হলে চলবে?”
“খুব চলবে।”
“শুটকো চেহারা বললেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব শুটকো।”
চিতেন একগাল হেসে বলল, “পেয়ে যাবেন।”
গোপাল উজ্জ্বল হয়ে বলল, “পাব মশাই? কোথায় পাব?”
“অত ভেঙে তো বলা যাবে না। তবে আমার হাতে একজন একশো ত্রিশ বছরের শুটকো চেহারার লোক আছে। কুড়িটা টাকা পেলে তাকে দেখিয়ে দিতে পারি। পছন্দ হলে আরও কিছু লাগবে।”
পটল বিরস মুখে বলে, “শুধু দেখতেই কুড়ি টাকা? দরটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না মশাই? তার ওপর যদি আসল লোক না হয়”
“আসল কি না জানি না মশাই, তবে তাঁর নাম রামভজন, তিনি একজন কৃপণ লোক খুঁজে বেড়াচ্ছেন।”
গোপাল চাপা গলায় গোবিন্দর কানে কানে বলল, “গেজেটা থেকে টাকাটা দিয়ে দে। পরে উসুল করে নিলেই হবে।”
গোবিন্দ বিরস মুখে তাই করল।
চিতেন টাকাটা ট্যাঁকে খুঁজে বলল, “উঠোনের ওই দিকটায় ওই যে চালাঘর দেখছেন ওখানে খড় গাদি করা আছে। ওর মধ্যে সেঁধিয়ে বসে থাকুন। একটু ঘুমিয়েও নিতে পারেন। প্রাতঃকাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। যখন তিনি প্রাতঃকৃত্য করতে বেরোবেন তখন তাঁকে দু চোখ ভরে দেখে নেবেন।”
“সে কী মশাই! আমাদের যে আজ রাতেই তাকে নিয়ে কত্তাবাবুর কাছে হাজির হওয়ার কথা!”
“পাগল নাকি? এই যে গাঁয়ের লোকেরা জড়ো হয়েছে দেখছেন, এরা সব সারারাত পাহারা দেবে। একজন ছেলেধরা এসে গাঁয়ের একটা লোককে ধরে নিয়ে যাবে, এমন মজা ছাড়ে কেউ? তা কত্তাবাবুটি কে?”
“আছেন একজন।”
“তা কত্তাবাবুর সঙ্গে বন্দোবস্তটা কীরকম হল?”
গোবিন্দ ক্ষোভের সঙ্গে বলে বসল, “সে আর বলবেন না। মশাই, মোটে একান্ন টাকা করে। এই যে এত হয়রানি হুজ্জত করতে হচ্ছে একান্ন টাকায় পোষায়, বলুন তো নায্য কথা!”
চিতেন খুব অবাক হয়ে বলে, “একান্ন টাকা! মোটে একান্ন টাকায় এত বড় কাজ! এর যে হেসেখেলে বাজারদর দু থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এঃ হেঃ হেঃ, আপনাদের যে বড্ড ঠকানো হচ্ছে দেখছি!”
গোপাল গোবিন্দকে কনুইয়ের একটা খুঁত দিয়ে চুপ করিয়ে রেখে নিজে বলল, “তা মশাই, ভোরের আগে কিছু করা যায় না? কত্তাবাবু যে বসে আছেন। বড্ড মেজাজি মানুষ। রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না কি না।”
চিতেন নাক সিঁটকে বলল, “অমন লোকের কাজ করা মানে ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ। আপনারা বরং গিয়ে কত্তাবাবুর কাজে ইস্তফা দিয়ে সন্নিসি হয়ে হিমালয়ে চলে যান।”
গোবিন্দ দুঃখের সঙ্গে বলল, “আমিও সেই কথাই গোপালদাকে বলি। রেটটা কম হয়ে যাচ্ছে বড়।”
চিতেন বলেন, “খুবই কম। রামভজনবাবুর বাজারদর এখন আকাশছোঁয়া। হবে নাই বা কেন? সাত ঘড়া মোহর আর সাত কলসি হিরেমুক্তোর মালিক বলে কথা, তাঁর মতো লোককে ধরবেন মাত্র একান্ন টাকা মজুরিতে? আপনাদের কত্তাবাবু যে দেখছি বিপিনবাবুর চেয়েও কঞ্জুষ।”
গোপাল আর গোবিন্দর চোখ হঠাৎ গোল হয়ে ভেতরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে চেয়ে থেকে গোপাল ফিসফিস করে বলল, “কী বললেন ভাই? ঠিক শুনেছি তো?”
“ঠিক শুনেছেন।”
“সাত ঘড়া কী যেন।”
“মোহর।”
“আর সাত কলসি কী যেন?”
“হিরে আর মুক্তো। অ্যাই বড়-বড় কাশীর পেয়ারার সাইজের হিরে আর সবেদার সাইজের বড় বড় মুক্তো। এখনও ভেবে দেখুন কত্তাবাবুর কাজ করবেন কি না।”
গোপাল বলল, “দুর, দুর। আমি এই এখনই এই মুহূর্তেই এখানে দাঁড়িয়ে কত্তাবাবুর কাজে ইস্তফা দিলুম। তুইও দিবি নাকি গোবিন্দ?”
“এই যে দিলুম।”
চিতেন খুশি হয়ে বলল, “বাঃ, বাঃ, চমৎকার। তা এই কত্তাবাবুটি কে?”
“বিদ্যাধরপুরের পাঁচুগোপাল। অতি বজ্জাত লোক।”
চিতেন বলল, “অ, তাই বলুন। রামভজনবাবু তাকেই প্রথমে পছন্দ করেছিলেন বটে। কিন্তু বিপিনবাবুকে দেখে তাঁর মত পালটেছে। এখন সব বিষয়সম্পত্তি বিপিনবাবুকেই দিয়ে যাবেন ঠিক করে ফেলেছেন।”
গোপাল ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “তা রামভজনবাবু এখন কোথায়?”
“তিনি এখন লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন, আর বিপিনদাদা তাঁর পা টিপছেন।”
গোপাল শশব্যস্তে বলল, “তা আমরা একটু তাঁর পদসেবা করার সুযোগ পাই না? দিন না একটু ব্যবস্থা করে। না হয় আরও কুড়িটা টাকা দিচ্ছি।”
চিতেন বলে, “খবরদার, ও-কাজ করবে না। ভজনবাবুর পা এখন বিপিনবাবুর দখলে। প্রাণ গেলেও ওই পা তিনি কারও হাতে ছাড়বেন না।”
গোপাল অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, “তা বললে কি হয় কখনও? ভজনবাবুর পায়ের ওপর কি আমাদেরও দাবি নেই? একজন দখল করে বসে থাকলেই হবে?”
গোবিন্দ বলল, “ঠিক কথা। ভজনবাবুর সেবা করার অধিকার সকলেরই আছে।”
চিতেন একটু হেসে বলল, “সেবার কথা আর বলবেন না মশাই। সেবা নিতে নিতে ভজনবাবুর এখন অরুচি। বললে বিশ্বাস করবেন না, তিনি তো সোনাদানা আগলে গহিন জঙ্গলের মধ্যে বাস করেন। জনমনিষি নেই। তা সেখানেও কী হয় জানেন? দু বেলা দুটো কেঁদো বাঘ এসে রোজ তাঁর পিঠ চুলকে দেয়। ঘুমনোর সময় দুটো গোখরা সাপ এসে তাঁর দু কানে লেজ ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম পাড়ায়। এই শীতকালে রাতের দিকে যখন হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা পড়ে তখন হলধর আর জলধর নামে দুটো ভালুক এসে দু’ধার দিয়ে ভজনবাবুকে জড়িয়ে ধরে ওম দেয়। গদাধর নামে একটা কেঁদো হনুমান বোজ তাঁর জন্য গাছ থেকে ফলটল পেড়ে আনে। কামধেনু নামের একটা গোরু এসে দুবেলা দু ঘটি করে দুধ দিয়ে যায়…”
গোপাল আর গোবিন্দর চোখ ক্রমে ছানাবড়া হচ্ছিল। গোপাল বলল, “বলেন কী মশাই!”
চিতেন একটু ফিচকে হেসে বলে, “ঠিকই বলছি। যাঁর অত সোনাদানা আছে তাঁকে কে না খ্যাতির করে বলুন। তবে ভজনবাবুর তো দিন ফুরিয়ে এল। শুনছি তিনি বিপিনবাবুকে সব দিয়েথুয়ে সমিসি হয়ে হিমালয়ে চলে যাবেন।”
গোপাল শশব্যস্তে বলল, “আচ্ছা না-হয় ভজনবাবুর পা না-ই টিপলুম, বিপিনবাবুর পদসেবা করারও কি সুযোগ হবে না মশাই?”
চিতেন দুঃখের সঙ্গে বলে, “বিপিনদাদার তো দুটো বই ঠ্যাং নেই। তা সে দুটোর জন্যও মেলা উমেদার। আমার খাতায় ইতিমধ্যেই বিশ-পঁচিশজনের নাম উঠে গেছে। মাথাপিছু কুড়ি টাকা রেট।”
গোপাল গোবিন্দকে ধমকে উঠে বলল, “হাঁ করে দেখছিস কী? দে টাকাটা গেঁজে থেকে বের করে।”
গোবিন্দর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ট্যাঁকে খুঁজে চিতেন বলল,
“বিপিনদাদা আমাকে তাঁর ম্যানেজার করে যে কী ঝঞ্ঝাটেই। ফেলেছেন।”
গোপাল চোখ কপালে তুলে বলল, “আপনিই তাঁর ম্যানেজার? প্রাতঃপেন্নাম হই।”
গোবিন্দ হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “কী সৌভাগ্য! এ যেন অমাবস্যায় চাঁদের উদয়। কী বলল গোপালদা?” “ঠিক বলেছিস। এ যেন কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।”