৪. মাঝরাতে পায়ে সুড়সুড়ি

মাঝরাতে পায়ে সুড়সুড়ি লাগায় ধড়মড় করে উঠে বসল ফটিক, ঘুমচোখে দেখল, পায়ের কাছে একটা লোক বসে আছে। সে তাড়াতাড়ি টিনের তোরঙ্গটা আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, “চোর! চোর!”

সেই চিৎকারে নিতাইও ঘুম ভেঙে উঠে বসল, “কোথায় চোর? কে চোর?”

“ওই যে চোর, দেখছিস না!” লোকটা ভারী বিরক্তির গলায় বলল, “ওঃ, কী চিল-চেঁচানিটাই চেঁচাচ্ছে দ্যাখ, যেন ডাকাত পড়েছে! তা চোর বলে কি পচে গেছি নাকি?”

লোকটার সাহস দেখে ফটিক হাঁ। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলল, “চোরের চেয়ে ডাকাত অনেক ভাল। তারা পা টিপে টিপে আসে না, উঁকিঝুঁকি মারে না, পায়ে সুড়সুড়ি দেয় না। চোরের হাবভাব অনেকটা ভূতের মতো। আর ডাকাতরা অনেক বীর, তারা বুক ফুলিয়ে আসে।”

লোকটা তেতো গলায়, “ওঃ ডাকাতের প্রশংসায় যে একেবারে নাল ঝরছে দেখছি! ছ্যাঃ ছ্যাঃ! ডাকাতি একটা ভদ্রলোকের মতো কাজ নাকি? কোনও আর্ট আছে ডাকাতির মধ্যে? রে-রে করে এল, গদাম গদাম করে দরজাকপাট ভাঙল, লাঠিসোঁটা বন্দুক বোয়াল দিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড করল, তারপর লুটপাট করে চলে গেল! না আছে বুদ্ধির খেলা, না কোনও হাতের সূক্ষ্ম কারিকুরি, না দূরদৃষ্টি, না রসবোধ। ডাকাতের প্রতিভার দরকার হয় না, বুঝলে? ও হচ্ছে মোটা দাগের কাজ। কিন্তু চোর হতে গেলে মগজ চাই। তেমন তেমন ভাল চোর একশো বছরে একটা জন্মায়।”

চোরের মুখে এসব শুনে ফটিকের আর কথা সরল না।

নিতাই বলল, “আপনি খুব বড় চোর নাকি?”

লোকটা দুঃখের সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বড় হওয়া কি মুখের কথা রে। চুরি বিদ্যেও হল সমুদ্রের মতো। যতই শেখো, শেখার শেষ নেই। আমি আর কী শিখেছি বলল। সমুদ্রের ধারে নুড়ি কুড়োচ্ছি মাত্র। নবা ওস্তাদের কাছে নাড়া বাঁধা ছিল। বছর পাঁচেক মাত্র শাগরেদ করেছি। এখনও কত কী শেখার বাকি।”

‘তা আপনি এত বড় চোর হয়ে আমাদের মতো ছোট মানুষের কাছে কী আর চুরি করবেন।”

লোকটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “এই না হলে বুদ্ধি! তোমাদের আছেটা কী বলো তো! ওই তো দুটো পলকা টিনের তোরঙ্গ আর পোঁটলা। ওসব তো ছিচকে চোরেও ছোঁবেনা। চুরি করতে এলে কি পায়ে সুড়সুড়ি দিতুম?”

ফটিক বলল, “তা হলে?”

“বাঃ, গাঁয়ে নতুন কেউ এলে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে না? কোন মতলবে আসা, কোন চক্করে ঘোরাফেরা, কাদের সঙ্গে মাখামাখি–এসব গুরুতর কথা না জানলে কি চলে?”

ফটিক বলল, “তা অবশ্য ঠিক। তবে আমাদের মতলব কিছু খারাপ ছিল না। কিন্তু দোগেছেতে এসে খুব শিক্ষা হল মশাই। আপনাদের গাঁয়ে আর নয়, কাল সকালেই মানে মানে ফিরে যাচ্ছি।”

লোকটা খক করে একটা শব্দ করল। সেটা হাসিও হতে পারে, কাশিও হতে পারে। তারপর বলল, “দোগেছে যে ভাল জায়গা নয় তা আমিও মানছি। তবে কিনা দোগেছের চেয়েও বিস্তর খারাপ জায়গা আছে।”

“তাই নাকি?” লোকটা ভালমানুষের গলায় বলল, “তা নয়? এই যে তুমি ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ এসে উদয় হলে তার জন্য দোগেছের লোক তোমার পেছনে লেগেছে কি? কেউ তোমার মাথায় চাঁটিও মারেনি, বকও দেখায়নি, দুয়োও দেয়নি। দিয়েছে বলো? তা হলে দোগেছে খারাপ হল কীসে?”

“আমি মোটেই ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ নই। আমিই আসল ফটিক ঘোষ।”

“সেটা প্রমাণ হবে কীসে?”

“প্রমাণ করার দরকার নেই মশাই। পিসি আসতে লিখেছিল বলে আসা। এত ভেজাল জানলে কে এত ঝামেলা করে আসত?”

লোকটা বলল, “পিসি আসতে লিখেছিল বললে, তা সে। চিঠিখানা কই?”

“চিঠিখানা খোয়া গেছে। রাসপুরের খালের ধারে মহাদেব দাস সেখানা হাতিয়ে নিয়েছে।”

“চিঠিখানার কত দাম জানো?”

“না। চিঠির আবার দাম কীসের?”

“সে আছে। যাকগে, হারিয়েই যখন ফেলেছ তখন আর কথা কী? তা এই মহাদেব দাস লোকটি কে বলল তো! কেমন চেহারা?”

“কেমন আর চেহারা! বেঁটেখাটো, কালোমতো, আমাদের ঠকিয়ে খেয়া পার করে পাঁচ টাকা আর কথার দাম হিসেবে আরও দু’টাকা নিয়েছিল।”

লোকটা খক করে ফের একটা শব্দ করল। হাসি বা কাশি যা হোক একটা হবে। তারপর বলল, “তোমাদের মতো মুরগি পেলে কে না জবাই করবে বলো! আমারই ইচ্ছে করছে। তবে কিনা আমি ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না।”

নিতাই বলল, “মহাদেব দাসকে চিনতে পারলেন?”

“না চিনে উপায় আছে! পাজি লোকদের আমি বিলক্ষণ চিনি।”

“আসলে লোকটা কে?”

“সেটা জেনেই কী অষ্টরম্ভা হবে?”

নিতাই গলাটা নামিয়ে বলল, “চিঠির দামের কথা কী যেন বলছিলেন?”

“বলেছি নাকি? ও হল বয়সের দোষ। মুখ ফসকে কী বলতে কী বেরিয়ে যায়।”

“বুঝেছি, আপনি আর ভেঙে বলবেন না। আচ্ছা, এই দোগেছে গাঁয়ে এত ফটিক ঘোষ কেন আসছে তা কি বলতে পারেন? আমরা যে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“ও বাপু, আমিও জানি না। রাম-শ্যাম-যদু-মধু কতই তো আসে। তা তোমরা কাল সকালেই তা হলে ফিরে যাচ্ছ?”

ফটিক বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। পিসির বাড়ির যত্নআত্তি তো খুব পেলুম। ভরপেট খাওয়া জুটল না, চণ্ডীমণ্ডপে শুয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে।”

“তা কষ্ট না করলে কি কেষ্ট পাওয়া যায় হে!”

ফটিক গরম হয়ে বলল, “আহা, কী কেষ্টই পেলুম! আর কষ্টেরও দরকার নেই, কেষ্টরও দরকার নেই।”

নিতাই ফটিকের দিকে চেয়ে বলল, “আহা, অত মাথা গরম করিসনে তো! ইনি একটা কিছু বলতে চাইছেন, সেটা একটু বুঝতে দে।”

লোকটা একটু উদাস গলায় বলল, “না না, আমি আর কী বলব? আসার পথও খোলা আছে, যাওয়ার পথও খোলা আছে। যেতে চাও

তো যেতেই পারো, কেউ তো আটকাচ্ছে না। তবে কি না–”

নিতাই মুখটা বাড়িয়ে বলল, “তবে কী?”

“এই বলছিলুম আর কী, কয়েকটা দিন এখানে থাকলে রগড়টা দেখে যেতে পারতে।”

“কীসের রগড়?”

“তা কি আমিই জানি ছাই। মনে হচ্ছে একখানা রগড় বেশ পাকিয়ে উঠছে।”

নিতাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু থাকার উপায় কী বলুন! এখানে থাকবই বা কোথায়, খাবই বা কী! আমাদের পয়সাকড়িও শেষ হয়ে আসছে।”

লোটা একটু দোনোমোনো করে বলল, “তা থাকতে চাইলে অবশ্য একটা কাজ করতে পারো।”

“কী বলুন তো!”

“দিনের আলো ফুটলে এই রাস্তা ধরে যদি সোজা চলে যাও তো ডানহাতি প্রথম রাস্তায় মোড় ফিরে কিছুদূর হাঁটলেই গড়াই বুড়ির বাড়িটা দেখতে পাবে। পাকা বাড়ি, তবে পুরনো, গড়াই বুড়ি এই গত মাঘ মাসে পটল তোলার পর থেকে বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। বুড়ির তিন কুলে কেউ ছিল না বলে দখল হয়নি।”

ফটিক বলল, “ও বারা, ও বাড়িতে নির্ঘাত সাপখোপ আছে।”

“গাঁয়ের ছেলে হয়ে সাপখোপ ভয় পেলে কি চলে? একটু সাবধানে থাকলে ভয়টা কীসের? চারটে দেওয়াল, মাথার ওপর ছাদ–আর চাই কী?”

নিতাই বলল, “থাকার ব্যবস্থা না হয় হল, কিন্তু খাওয়া?”

“দোগেছেকে যতটা খারাপ জায়গা বলে ভেবেছ, ততটা কিন্তু নয়। কুমোরপাড়ার মোড়ে নুটুবাবুর লঙ্গরখানা দেখতে পাবে। দু’ বেলা গরম ভাত, ডাল, তরকারি।”

ফটিক নাক সিঁটকে বলল, “লঙ্গরখানা! সেখানে তো ভিখিরিরা খায়।”

নোকটা নির্বিকারভাবে বলল, “তা খায়। ভিখিরিরা যায় বলে কি বাবুদের গালে উঠছে না নাকি? এ, যেন নবাবপুর এলেন। কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে গুচ্ছের চপ, শিঙাড়া, জিলিপি, অমৃতি গিলে পেট গরম করার চেয়ে নুটুবাবুর লঙ্গরখানার গরম গরম ডালভাত কি খারাপ হল?”

নিতাই বলল, “না না, নুটুবাবুর লঙ্গরখানাই ভাল কিন্তু আমরা যে কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে চপ, শিঙাড়া, জিলিপি আর অমৃতি খেয়েছি তা আপনি জানলেন কী করে?”

লোকটা তেমনই নির্বিকার গলায় বলল, “চোখকান খোলা রাখলেই জানা যায়। তোমাদের দোষ কি জানো? ভগবান দুটো চোখ দিয়েছেন, এক জোড়া কান দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো ঠিকমতো ব্যবহার করতেই শিখলে না। ছ্যাঃ ছ্যাঃ। যাকগে, ভোর হয়ে আসছে। আমি চলি।”

নিতাই বলল, “আপনার নামটা তো জানা হল না!”

লোকটা মাথা চুলকে বলল, “নাম! এই তো মুশকিলে ফেললে, কোন নামটা বলি বলল তো!”

“যেটা খুশি।”

“তা হলে তোমরা আমাকে নদিয়াদা বলে ডাকতে পারো। তবে বেশি খোঁজখবর করতে যেও না, তা হলে বিপাকে পড়বে। দরকারমতো আমি উদয় হব’খন।”

ফটিক হঠাৎ বলল, “গড়াই বুড়ির বাড়িতে তালা দেওয়া থাকলে ঢুকব কী করে? লোকে যদি চোর বলে ধরে?”

‘তালাটালা নেই, দড়ি দিয়ে কড়া দুটো বাঁধা আছে। আর যদি লোকে চোর বলে ধরে ঘাতক দেয়ই, তা হলে হাসিমুখে সেটা হজম করে নিও। হাটুরে কিল খেলে মানুষ পোক্ত হয়। আর একটা কথা। পুষ্যিপুত্তুরকে খুব হুঁশিয়ার।”

এই বলে লোকটা উঠে অন্ধকারে ফুস করে মিলিয়ে গেল।

ফটিক বলল, “ধ্যেত, এ লোকটা আমাদের ফাঁদে ফেলতে চাইছে।”

নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের ফাঁদে ফেলে কী লাভ? আমাদের আছেটা কী বল তো! কিন্তু পুষ্যিপুত্তুরটা আবার কে?”

“কে জানে! চোরছ্যাঁচড়ের কথায় বিশ্বাস করা ঠিক নয়। চল, আমরা ফিরেই যাই।”

“ফিরে যাওয়া তো আছেই। কিন্তু রহস্যটা কী, কেন এত ফটিক ঘোষ এখানে আসছে সেটা তো আর জানা হবে না, লোকটা হঠাৎ পুষ্যিপুতুরের কথাই বা বলে গেল কেন? আমার মনে হচ্ছে, একটু কষ্ট করে দুটো-একটা দিন থেকে যাওয়াই ভাল।”

ফটিক একটু গাঁইগুই করে রাজি হল। বলল, “কিন্তু বিপদ আপদ হলে কিন্তু তুই দায়ী।”

“বিপদআপদ তো কপালে আছেই মনে হচ্ছে। আর সেইজন্যই আমার মনটা চনমন করছে। পায়রাডাঙা ফিরে গিয়ে কোন লবডঙ্কা হবে বল তো!” ফটিক একটু ভেবে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “তা ঠিক।”