আমি মিত্তিকাকে নিয়ে মহাকাশযানের নির্জন করিডোর ধরে ফিরে আসছিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস এই মহাকাশযানের কোথাও লুকিয়ে আছে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর চিৎকার করে অস্ত্র হাতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ধরনের একটা আশংকায় আমার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ধকধক করে শব্দ করতে থাকে। করিডোরের মাঝামাঝি এসে আমি চাপাগলায় ফোবিকে ডাকলাম, ফোবি।
ফোবি আমার কানের কাছে থেকে উত্তর দিল, বলুন মহামান্য ইবান।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস শীতল ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে গেছে।
আমি জানি।
তুমি কেমন করে জানো? কার্গো বেতে তো নিউরাল নেটওয়ার্কের যোগাযোগ নেই।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে।
আমি চাপাগলায় চিৎকার করে বললাম, কী বললে?
বলেছি ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে।
আমার নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না, অবিশ্বাসের গলায় বললাম, কী বললে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে আছে?
ঠিক করে বললে বলতে হয় ভেসে আছে।
কেন?
মনে হয় তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
আমার জন্যে? আমার জন্যে কেন?
যতদূর মনে হয় মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণটি নিতে চায়।
ওর কাছে কি কোনো অস্ত্র আছে?
নেই।
একেবারে খালি হাতে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে?
হ্যাঁ। মানুষটি খুব আত্মবিশ্বাসী।
তুমি কীভাবে জানো?
ফোবি একটু ইতস্তত করে বলল, মানুষের চরিত্রের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য আমাদের বিশেষ করে প্রস্তুত করা হয়।
ও।
আমি মিত্তিকার দিকে তাকালাম, সে পুরো ব্যাপারটি এখনো বুঝতে পারছে না, খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকখানি আতঙ্ক নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো মুখে বলল, এখন কী হবে?
প্রশ্নটি অত্যন্ত সহজ এবং সরল কিন্তু এর উত্তরটি সহজ কিংবা সরল নয়। আমার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে যে এই প্রশ্নটির উত্তর কারোই জানা নেই। কিন্তু মিত্তিকাকে আমি সেকথা বলতে পারি না। মহাকাশযানের অধিনায়ক হিসেবে এরকম পরিবেশে যে-ধরনের উত্তর দেবার কথা আমি সেরকম একটি দিলাম। বললাম, পুরো ব্যাপারটি বিশ্লেষণ না করে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।
মিত্তিকা ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলল, তার মানে ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে?
মানুষকে মেরে ফেলা এত সহজ ব্যাপার নয়।
কিন্তু তুমি তো মানুষকে মেরে ফেলার জন্যে একটা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ।
আমি এই কথার কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না উত্তর দেয়ার সময় হলো না, কারণ ততক্ষণে আমরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পৌঁছে গেছি। নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে একজন মানুষ আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটি নিশ্চয়ই ম্যাঙ্গেল কাস।
প্রথমেই আমার যে কথাটি মনে হলো সেটি হচ্ছে ইচ্ছে করলেই আমি তাকে এখনই গুলি করে মেরে ফেলতে পারি। এই ধরনের একটা কথা আমার মাথায় এসেছে বলে পরমুহূর্তে হঠাৎ করে আমার নিজের উপর একধরনের ঘৃণাবোধের জন্ম হলো। আমি কিছু বলার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস ধীরে ধীরে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, ভরশূন্য পরিবেশে তার সহজে ঘােরার ভঙ্গি দেখে আমি বুঝতে পারলাম সে তার জীবনের দীর্ঘ সময় মহাকাশযানে কাটিয়েছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মানুষটি সুদর্শন বলে শুনেছিলাম এবং আমি দেখতে পেলাম কথাটি সত্য। তার মাথায় কালো চুল, খাড়া নাক, এবং গভীর নীল চোখ। গায়ের রঙ তামাটে এবং মুখে একধরনের চাপা হাসি। আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম মানুষটি সুদর্শন হলেও সেখানে একধরনের বিচিত্র কদর্যতা লুকিয়ে আছে। সেই কদর্যতাটি কেথায় তার চোখের দৃষ্টিতে নাকি মুখের চাপা হাসিতে আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। মানুষটি আমার চোখের দিকে তাকাল এবং তার মুখের হাসিটি আরো বিস্তৃত করে বলল, তোমাকে আমি একটি সুযোগ দিয়েছিলাম, তুমি সেই সুযোগ গ্রহণ করলে না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কথা বলার ভঙ্গিটি অত্যন্ত বিচিত্র। মনে হয় প্রত্যেকটা শব্দ আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করে এবং কথাটি শেষ হবার পরও মনে হয় তার কথা এখনো শেষ হয় নি।
কোনো একটি বিচিত্র কারণে ম্যাঙ্গেল ক্বাস কী বলছে আমি সেটা বুঝতে পারলাম এবং সেজন্যে আবার আমার নিজের উপর আবার একটু ঘৃণাবোধের জন্ম হলো। ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখের ভঙ্গি খুব ধীরে ধীরে পবির্তিত হলো, সে মুখের হাসি সরিয়ে সেখানে একধরনের অনুকম্পার ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে অস্ত্র ছিল, তুমি কেন আমাকে হত্যা করলে না?
যদি তোমাকে হত্যা করার প্রয়োজন হতো, আমি তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে হত্যা করতাম ম্যাঙ্গেল কাস।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নেড়ে আবার আলাদা আলাদাভাবে একটি একটি শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আমি কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াই হত্যা করতে পারি।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি কী চাও?
আপাতত এই মহাকাশযানটির কর্তৃত্ব চাই। এটিকে আমার নিজের এলাকায় নিতে চাই।
আমি দুঃখিত ম্যাঙ্গেল ক্বাস সেটি সম্ভব নয়। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক।
আমার কথা শেষ হবার আগেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার ডান হাত উপরে তুলে আমার মাথার উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করল, এবং হঠাৎ করে আমি ভয়ংকর আতংকে শিউরে উঠলাম, আমি বুঝতে পারলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস একজন হাইব্রিড২৪, একই সাথে যন্ত্র এবং মানুষ। তার শরীরের ভেতরে অস্ত্র, সেই অস্ত্র ব্যবহার করে সে তার আঙুলের ভেতর দিয়ে ভয়ংকর বিস্ফোরক ছুড়ে দিতে পারে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ বিদ্যুঝলকের মতো তার আঙুল থেকে বিস্ফোরক ছুটে এল। আমি মিত্তিকাকে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নিচে ঝাপিয়ে পড়লাম, মাথার উপর দিয়ে বিস্ফোরক ছুটে গেল এবং প্রচণ্ড বিস্ফোরণে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়াল চূর্ণ হয়ে গেল।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তার হাত নামিয়ে আনে, আমি দেখতে পেলাম তার আঙুলের ডগা থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে, শরীরের ভেতরে বিস্ফোরক লুকানো থাকে, চামড়া ভেদ করে সেটি বের হয়ে এসেছে। ভরশূন্য পরিবেশে আমি কয়েকবার লুটোপুটি খেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেল থেকে সাবলীল ভঙ্গিতে একটি লাফ দিয়ে একেবারে আমার সামনে এসে হাজির হলো— আমি ততক্ষণে উরু থেকে আমার অস্ত্রটি বের করে এনেছি। ম্যাঙ্গেল কৃাসের দিকে সেটি তাক করে বললাম, তুমি দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও ম্যাঙ্গেল ক্বাস।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস এমনভাবে হেসে উঠল যেন আমি অত্যন্ত মজার একটা কথা বলেছি। আমি কঠোর মুখে বললাম, আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক। আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি তুমি দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াও–
ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল এবং সে হাত উপরে না তুলে খুব ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। আমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে চিৎকার করে বললাম, খবরদার–
ম্যাঙ্গেল কাস ভক্ষেপ করল না। ধীরে ধীরে তার হাত আমার দিকে তুলে ধরতে শুরু করল এবং আমি তখন মরিয়া হয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির ট্রিগার টেনে ধরলাম। ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গেল এবং ম্যাঙ্গেল কাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেওয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়ল। আমি তখনো থরথর করে কাঁপছি, জীবনে কখনো কোনো মানুষকে নিজ হাতে খুন করতে হবে ভাবি নি। আমি গভীর বিতৃষ্ণা নিয়ে আবিষ্কার করলাম ব্যাপারটি এমন কিছু কঠিন নয়। মিত্তিকা আমার হাত ধরে বলল, ইবান।
কী হলো?
ঐ দেখ–
আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের গালের চামড়াকে ধরে টেনে লম্বা করে ফেলতে থাকে, আমি সবিস্ময়ে দেখলাম গলিত পলিমারের মতো সেটা উপরে উঠে আসছে, বেশ খানিকটা উপরে তুলে এনে ছেড়ে দিতেই সেটা শব্দ করে আবার রবারের মতো নিচে নেমে এল। মিত্তিকা শিউরে উঠে আমাকে জাপটে ধরে ফিসফিস করে বলল, দানব, নিশ্চয়ই দানব।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, বলল, না। দানব না। হাইব্রিড। আধা যন্ত্র আধা মানুষ। আমার চামড়ার উপর সূক্ষ্ম বায়োমারের আস্তরণ রয়েছে। সেটাকে ভেদ করে যাবার মতো কোনো বিস্ফোরক নেই। আমাকে হত্যা করার মতো কোনো অস্ত্র তৈরি হয়ে নি মেয়ে।
আমি হতচকিতের মতো তাকিয়ে রইলাম, ম্যাঙ্গেল কাসের চোখ দুটি হঠাৎ হিংস্র পশুর মতো জ্বলে ওঠে, সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আঙুল নির্দেশ করে বলল, কিন্তু তোমার মতো মানুষকে সহস্রবার ছিন্নভিন্ন করে দেবার। মতো অস্ত্র আমার দেহে আছে।
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে আরো এক পা এগিয়ে এল তারপর ফিসফিস করে বলল, কিন্তু আমি এই মুহূর্তে তোমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেব না। কারণ তোমাকে আমার প্রয়োজন।
আমি স্থির চোখে ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আমি কি তোমার নিকট থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতে পারি?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না, ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল, বলল, নিশ্চয়ই পেতে পারি। এই মেয়েটিকে আমি সেজন্যে শীতল ঘর থেকে বের করে এনেছি। তুমি নিশ্চয়ই এরকম কমবয়সী একটি মেয়ের শরীরকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখতে চাও না।
আমি চুপ করে রইলাম। ম্যাঙ্গেল ক্বাস চাপাগলায় বলল, চাও ইবান?
মিত্তিকা আমাকে ধরে আর্তচিৎকার করে থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি মাথা নাড়লাম, না চাই না।
চমৎকার।
ম্যাঙ্গেল কাস এবারে শূন্যে ভেসে আবার নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের কাছে ফিরে গেল, সেখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বিশ্রাম নিতে যাও। আমার যখন প্রয়োজন হবে আমি তোমাদের ডাকব।
আমি মিত্তিকাকে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, ম্যাঙ্গেল ক্বাস আবার ডাকল, ইবান।
বল।
তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি রেখে যাও। বুঝতেই পারছ এটি তোমার জন্যে একটি জঞ্জাল ছাড়া আর কিছু নয়।
আমি হাতের অস্ত্রটি ম্যাঙ্গেল কাসের দিকে ছুড়ে দিলাম, সে হাত দিয়ে সেটিকে সরিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর ঝুঁকে পড়ল, অস্ত্রটি সত্যি-সত্যি অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালের মতো ঘরে পাক খেয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে।
প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মিত্তিকাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে একটা বিশ্রামঘরে শুইয়ে আমি নিজের ঘরে ফিরে এসেছি। অধিনায়কের জন্যে আলাদা করে রাখা আমার এই ঘরটিতে আমি খুব একটা আসি নি। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আমি চমকে উঠলাম, আমার বিছানার পাশের আরামদায়ক চেয়ারে কেউ-একজন বসে আছে। আমাকে দেখে মানুষটি ঘুরে তাকাল এবং আমি তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটি রিতুন ক্লিস, সত্যিকারের মানুষ নন, তার হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, মহামান্য রিতুন ক্লিস, আপনি?
হ্যাঁ আমি।
আমি ভেবেছিলাম আপনি এই নিউরাল নেটওয়ার্ক থেকে মুক্তি নিয়ে আমাদের এখান থেকে চলে গেছেন।
হ্যাঁ, আমি মুক্তি চেয়েছিলাম, কিন্তু যে কারণে তুমি আমাকে হত্যা করতে পার নি, ঠিক সেই কারণে আমিও নিজেকে হত্যা করতে পারি নি। তা ছাড়া
তা ছাড়া?
তা ছাড়া ম্যাঙ্গেল ক্বাসের কাজ দেখে হঠাৎ আমার একটু কৌতূহল হলো, ইচ্ছে হলো সে কী করে দেখি।
দেখেছেন?
হ্যাঁ দেখেছি। গত দুইশ বছরে প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। আমাদের সময় হাইব্রিড ছিল না। অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রক্রিয়া। অত্যন্ত বিচিত্র একটি ধারণা।
আমি একটি নিঃশ্বাস ফেললাম। রিতুন ক্লিস আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছে ইবান।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এটি কি বিচলিত হওয়ার মতো ব্যাপার নয়? আমি একটি মহাকাশযানের অধিনায়ক। সেই মহাকাশযানের শীতল ক্যাপসুল থেকে একটি দস্যু বের হয়ে পুরো মহাকাশযানটি দখল করে ফেলল। আমাকে এখন তার কথা শুনতে হবে, তা না হলে সে মানুষ খুন করে ফেলবে।
রিতুন ক্লিস শব্দ করে হাসলেন, বললেন, জীবনকে এত গুরত্ব দিয়ে নিতে হয় না। একটি দস্যুর যা করার কথা সে তাই করেছে। তুমি একটি মহাকাশযানের অধিনায়ক, তোমার যা করার কথা তুমি তাই কর।
আমি কী করব?
আমি সেটা কেমন করে বলি? তবে তুমি কী কর আমি সেটাও দেখার জন্যে খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছি।
মহামান্য রিতুন, আপনি সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান মানুষ। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, শুধুমাত্র পরিশ্রম করে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আমি বড় বিপদ দেখি নি, কীভাবে সেটার মুখোমুখি হতে হয় জানি না।
সেটা কেউই জানে না ইবান। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটা শিখতে হয়।
আমি আপনার কাছে সাহায্য চাই মহামান্য রিতুন।
মহামান্য রিতুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের এই পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে একটি পরাবাস্তব নাটিকার মতো আমি এর একজন দর্শক। এর ভালো-মন্দে আমার কিছু আসে যায় না। আমি এতে অংশ নিতে পারব না ইবান। আমি শুধু দেখে যাব।
আপনি বলতে চাইছেন ম্যাঙ্গেল ক্বাস যদি একজন একজন করে মানুষ খুন করতে থাকে আপনি এতটুকু বিচলিত হবেন না?
আমি বলতে পারছি না ইবান। আমি হয়ত বিচলিত হব, অভিনয় জেনেও মানুষ অভিনেতার ভালো অভিনয় দেখে অভিভুত হয়।
আমি দুই হাতে নিজের চুল ধরে টানতে থাকি তারপর কাতর গলায় বলি, মহামান্য রিতুন, আপনি একবার বলুন, আমি কী করব।
মহামান্য রিতুন দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, জীবনকে সহজভাবে নাও ইবান। খুব সহজভাবে নাও।
তার অর্থ কী?
আমি বলে দিলে তুমি বুঝবে না। তোমার নিজেকে সেটা বুঝতে হবে।
আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমি কি বুঝব?
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেউ সাধারণ নয়। সবাই অসাধারণ, সেটা শুধু তাকে জানতে হয়। কেউ তার জীবনে সেটা জানে কেউ জানে না।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমাকে বিশ্রাম নিতে বলেছে কিন্তু আমি জানি আমি বিশ্রাম নিতে পারব না। আমি আমার ঘরে নিদ্রাহীন হয়ে শুয়ে রইলাম, রিতুন ক্লিস আমাকে পুরো ব্যাপারটি সহজভাবে নিতে বলেছেন কিন্তু আমি এটা সহজভাবে নিতে পারছি না। আমাকে পঞ্চম মাত্রার একটা মহাকাশযানের অধিনায়ক করে পাঠানো হয়েছে কিন্তু ম্যাঙ্গেল ক্বাসের মতো একজন হাইব্রিড দস্যু সেই মহাকাশযানটির কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছে। এটি কি সহজভাবে নেয়া সম্ভব? আমি লি-হানের কাছে এটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম, আমার সেই সন্দেহটাই তো সত্যি প্রমাণিত হলো। আমি যদি পুরো ব্যাপারটি সহজভাবে নিতে চাই তাহলে ধরে নিতে হবে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। ফোবিয়ান থাকুক বা না থাকুক, আমি থাকি বা না থাকি, ম্যাঙ্গেল ক্বাস থাকুক বা না থাকুক কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ কোটি নক্ষত্রের অসংখ্য প্রাণীজগতের তুলনায় মানুষ ক্ষুদ্র একটি প্রাণী তাদের কয়েকজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে সেটি এমন কোনো গুরত্বপূর্ণ ঘটনা নয়। আমার বেঁচে থাকা না থাকাও এমন কোনো গুরত্বপূর্ণ ব্যাপার। নয়। আমি মোটামুটি একটা জীবন উপভোগ করেছি সেই জীবনকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কাজেই আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করতে পারি।
হঠাৎ করে আমি নিজের ভিতরে নতুন একধরনের শক্তি অনুভব করতে থাকি, মনে হতে থাকে সত্যিই জীবনকে সহজভাবে নিতে হবে— এর জটিলতা আমাকে যেন স্পর্শ করতে না পারে।
আমি শুয়ে থেকে থেকে নিজের অজান্তেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমাকে ম্যাঙ্গেল ক্বাস ঘুম থেকে ডেকে তুলল, আমি চোখ খুলে তাকাতেই সে বলল, ইবান, তুমি আমার সাথে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে চল।
আমি হাত দিয়ে চোখ মুছে বললাম, কেন?
আমি মহাকাশযান ফোবিয়ানের গতিপথ পালটাতে চাই।
আমি ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না। শান্ত গলায় বললাম, কেন?
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চাই, সেটাই কি যথেষ্ট নয়?
সম্ভবত। কিন্তু আমি কারণটা জানতে চাই।
কেন?
কারণটা পছন্দ না হলে আমি রাজি না-ও হতে পারি।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, মনে হলো সে বিশ্বাস করতে পারছে না আমি কথাটা বলেছি। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শীতল গলায় বলল, তুমি সত্যি রাজি না হওয়ার সাহস রাখ?
আমি সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বললাম, আসলে রাখি না, আমি মহাকাশযানের অধিনায়ক, সাহস দেখানো আমার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না। তবে তুমি যদি আমাকে বল মহাকাশযানের গতিপথ পাল্টে দিয়ে কাছাকাছি। ব্ল্যাকহোলে ঝাপ দিতে চাও তাহলে আমি রাজি না-ও হতে পারি! তাতে আমি হয়ত তোমার হাতে এই মুহূর্তে মারা পড়ব, দুদিন পরে ব্ল্যাকহোলের ভয়ংকর মহাকর্ষ বলে শরীরের নিচের অংশ উপরের অংশ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া থেকে সেটা এমন কিছু খারাপ নয়।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস বলল, না, আমি ব্ল্যাকহোলে ঝাঁপ দেব না।
তাহলে কী করবে?
আমার একটি সুগঠিত দল রয়েছে, তাদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে, আমি তাদের তুলে নিতে চাই। আমি ভিতরে ভিতরে ভয়ানকভাবে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, তারাও কি তোমার মতো হাউব্রিড মানুষ?
না। হাইব্রিড মানুষ হওয়ার ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের নেই।
ও।
চল তাহলে। ম্যাঙ্গেল জ্বাস একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, নাকি তুমি রাজি নও?
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমি অবশ্যিই চাইব না তুমি তোমার সুগটিত দলকে এখানে তুলে আন, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কিছু করার নেই। সম্ভবত ভবিষ্যতে তোমাকে এবং তোমার পুরো দলকেই ধ্বংস করার এটি একটি সুযোগ।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর যে একদিন তুমি আমাকে এবং আমার দলকে ধ্বংস করবে?
হ্যাঁ। আমি সেটা খুব সহজেই করতে পারি। আমি এই মহাকাশযানের অধিনায়ক। পঞ্চম মাত্রার মহাকাশযান অধিনায়ক ছাড়া আর কারো নির্দেশে চালানো যায় না। তার অর্থ জানো?
ম্যাঙ্গেল ক্বাস মাথা নাড়ল, সে জানে।
আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, আমি ইচ্ছে করলেই তোমাদের সবাইকে নিয়ে এই মহাকাশযানটি ধ্বংস করে দিতে পারব। তোমাকে এবং তোমার সুগঠিত দলকে ধ্বংস করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। তবে আমি সেটা করতে চাই যখন আমি এর ভেতরে নেই তখন।
কথাটি খুব উঁচু স্তরের রসিকতা হয়েছে এরকম ভান করে আমি উচ্চ স্বরে হাসতে শুরু করি। ম্যাঙ্গেল ক্বাস কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচুগলায় বলল, গতরাতে যখন তোমার সাথে দেখা হয়েছিল তখন তুমি বিশেষ বিচলিত ছিলে, আজ ভোরে তোমাকে খুব আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে।
এখানে রাত এবং ভোর বলে কিছু নেই ম্যাঙ্গেল ক্বাস। কারো জন্যে পুরোটাই রাত, কারো জন্যে পুরোটাই সকাল।
তুমি কী বললে?
বিশেষ কিছু বলি নি আর আত্মবিশ্বাসের কথাটা সত্যি। আমি ঠিক করেছি জীবনটা খুব সহজভাবে নেব। সিদ্ধান্তটা নেবার পর হঠাৎ করে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে।
সহজভাবে?
হ্যাঁ। যার অর্থ বেঁচে থাকতেই হবে এরকম কোনো গো আমার মাঝে নেই। তার অর্থ বুঝতে পারছ?
ম্যাঙ্গেল ক্বাস কঠিন মুখে বলল, তুমি কোনটা বুঝাতে চাইছ সেটা হয়ত বুঝতে পারি নি।
আমারও তাই ধারণা। আমি বোঝাতে চাইছি যে আমার থেকে সাবধান। যে মারা যেতে প্রস্তুত তার থেকে ভয়ংকর আর কিছু নেই। আমি সুর পাল্টে বললাম, যা-ই হোক ওসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই, তার থেকে চলো দিনটি শুরু করার আগে ভালো কিছু খাওয়া যাক। আমার কাছে চমৎকার কিছু পানীয় আছে।
ম্যঙ্গেল ক্বাস সর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কী একটা ভাবল তারপর বলল, চল।
তুমি যেরকম আমার অতিথি, মিত্তিকাও আমার অতিথি। তাকে ডেকে আনলে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
না নেই।
চমৎকার।
মহাকাশযানের অধিনায়কের বিশেষ খাবার এবং বিশেষ পানীয় থাকা সত্ত্বেও আমাদের খাবারের অনুষ্ঠানটি মোটেও আনন্দদায়ক হলো না। মিত্তিকা চমৎকার একটি পোশাক পরে এলেও ম্যাঙ্গেল ক্বাসের সামনে বসে সে প্রায় কিছুই খেতে পারল না। ভরশূন্য পরিবেশে খাবার বিশেষ পদ্ধতির সাথেও সে পরিচিত নয়— ব্যাপারটি তার জন্যে বেশ কঠিন।
আমরা নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলাম, ম্যঙ্গেল ক্বাস হাইব্রিড মানুষ হলেও তাকে খেতে হয়, তাকে নিঃশ্বাস নিতে হয়। আমি এই ব্যপারটি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম। খাওয়ার পর আমি এবং ম্যাঙ্গেল ক্বাস নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের উপর। ঝুঁকে পড়লাম— সে ঠিক কোথায় যেতে চাইছে সেটি আমার জানা প্রযোজন। হোয়াইট ডোয়ার্ফ২৬ জাতীয় একটা নক্ষত্রের কাছাকাছি কিছু বড় গ্রহ রয়েছে তার একটি উপগ্রহের সাথে সে যোগাযোগ করছে বলে দাবি করল। আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললাম, অসম্ভব। যে-কোনো মানুষ ঐ গ্রহ উপগ্রহ থেকে দূরে থাকবে। ঐগুলো হচ্ছে অনাবিষ্কৃত অঞ্চল। গ্যালাক্টিক তথ্যকেন্দ্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে যে এই অঞ্চলে বুদ্ধিমান প্রাণের বিকাশ হয়েছে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, আমার কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রয়োজন নেই, আমার প্রয়োজন আমার দলের সকল মানুষকে। তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
বুদ্ধি ব্যাপারটি কী সেটা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, আমি সেই বিতর্কে যেতে চাচ্ছি না, আমি মেনে নিচ্ছি তোমার দলের মানুষেরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিন্তু এই অঞ্চলের মহাজাগতিক প্রাণী তোমার দলের মানুষ থেকেও বেশি বুদ্ধিমান হতে পারে। সেখানে উপস্থিত হওয়া নিরাপদ না-ও হতে পারে।
ম্যাঙ্গেল ক্বাস আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বলল, নিরাপত্তার ব্যাপারটি আমি তোমার কাছ থেকে শিখতে চাইছি না ইবান।
আমি সাথে সাথে হাত তুলে বললাম, ঠিক আছে, আমি সে-ব্যাপারে কোনো কথা বলছি না।
চমৎকার। তুমি তাহলে মহাকাশযানের গতিপথ পরিবর্তন কর। আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝে আমরা ঐ এলাকায় পৌঁছে যেতে চাই।
ফোবিয়ানের জ্বালানি নিয়ে একটা সমস্যা হতে পারে—
সেটি আমার সমস্যা নয়।
বেশ।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাজ শুরু করে দিলাম। ফোবিয়ানের মূল তথ্যকেন্দ্রে কিছু গোপন সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে তার গতিপথ পাল্টে দেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট কোডে নির্দেশ দিতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই ফোবিয়ানের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল।