৪. ভুতু যদি কাঁকড়াবিছে ক্লাসে না ছাড়ত

ভুতু যদি কাঁকড়াবিছে ক্লাসে না ছাড়ত তা হলে সে ভজুরাম মেমোরিয়াল স্কুলের ফুটবল টিমে চান্স পেত। যদি ফুটবল টিমে চান্স পেত তা হলে সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কালুকে খেপাত না। কালু যদি না খেপত, তা হলে জয়পতাকাবাবুর মতো ভীতু আর নিরীহ লোকের ভিতরে বীরত্ব জেগে উঠত না। বীরত্ব না জাগলে এত লোক আজ জয়পতাকাবাবুকে মাটাডোরের ভূমিকায় দেখতে পেত না এবং মস্ত বড় একটা অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হত। আর ষাঁড়ের লড়াই না হলে জয়পতাকাবাবু কোনওদিনই কালুর পিঠে চড়ার মতো বিরল অভিজ্ঞতা লাভ করতেন না। আর তা হলে পটাশগড়ের জঙ্গলটাও তাঁর কাছে অজানা থেকে যেত। জয়পতাকাবাবু নিরুদ্দেশ না হলে স্কুল কাল বন্ধ দেওয়া হত না। এবং আগামী কাল ভুতুকে জয়পতাকার ক্লাসে অঙ্কের জন্য বিস্তর নাকাল হতে হত। সুতরাং সব দিক ভেবে দেখলে, যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে। এরকম একখানা কাণ্ড হওয়ার দরকার ছিল।

ভুতু ঘোষবাড়ির ছেলে বটে তবে তার নিজের মা বাবা নেই। ঘোষবাড়ির বড় সংসার। সকলেই লেখাপড়ায় ভাল, ভুতুর কাকা-জ্যাঠারা রীতিমত কৃতী মানুষ। কিন্তু সেই বাড়ির ছেলে হয়ে ভুতু বছর বছর পরীক্ষায় গাঁজা খায়। এক বিধবা পিসির কাছেই ভুতু মানুষ। সবাই বলে, পিসির লাই পেয়ে পেয়ে ভুতুর আজ এই দশা। দুষ্টুমির জন্য কুখ্যাতি তো তার আছেই। ফলে বাড়ির কেউ ভুতুকে সুনজরে দেখে না। ভুতু মারপিট করে বেড়ায়, গাছ বায়, ক্লাস পালিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে মেশে। গুণের মধ্যে, সে খেলাধুলোয় বেশ ভাল। প্রাইজটাইজ মেলাই পায়।

কাণ্ডখানা করে সে বেশ খুশি ছিল। কালুকে খেলার মাঠে লেলিয়ে দেওয়ায় খেলা তো কিছুক্ষণের জন্য পণ্ড হয়েছেই, তার ওপর টিমে ভুতু না থাকায় স্কুল গো-হারা হেরেছে।

ভুতু সন্ধের পর বই খুলে পড়ার ঘরে বসে বসে কাণ্ডখানা ভাবছিল আর ফিচিক-ফিচিক হাসছিল।

এমন সময় মেজো জ্যাঠামশাই ডেকে পাঠালেন। ভীষণ রাগী লোক। রাশভারীও বটে।

জ্যাঠামশাই অত্যন্ত গম্ভীরভাবে কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাদের বিদেয় করে দিয়ে ভুতুর দিকে তাকিয়ে জলদগম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি আজ যা করেছ তার জন্য কোনও শাস্তিই তোমার পক্ষে যথেষ্ট নয়।”

ভুতু একটু অবাক হল, ভয়ও পেল।

জ্যাঠামশাই বললেন, “তুমিই সেই কালপ্রিট, যে কালুকে খেপিয়ে নিয়ে খেলার মাঠে ছেড়ে দিয়েছিলে। অনেকেই সেটা স্বচক্ষে দেখেছে। তোমার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের ফলে তোমাদের মাস্টারমশাই জয়পতাকার কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, কালু তাঁকে নিয়ে গিয়ে পটাশগড়ের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছে। ওই জঙ্গল খুবই বিপজ্জনক জায়গা। তাঁর প্রাণ যাওয়াও বিচিত্র নয়। তার ওপর কালু তাঁকে কোন্ অবস্থায় ফেলে দিয়ে এসেছে তাও আমরা বুঝতে পারছি না।”

ভুতু অত্যন্ত ক্ষীণ গলায় বলল, “জয়পতাকাসার যে ওরকম কাণ্ড করবেন তা আমি জানতাম না।”

“কিন্তু এ তো জানতে যে কালুকে ওই ভিড়ের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার ফলে বহু লোকের চোট হতে পারত!”

“আজ্ঞে, আমার ভুল হয়েছে।”

“ওটুকু বললেই যথেষ্ট বলা হল না। তুমি যেমন লোকের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিলে, জয়পতাকাবাবু তেমনই লোকের উপকার করার জন্য বীরের মতোই এগিয়ে গিয়েছিলেন। সারা শহরে এখন তাঁর গুণগান হচ্ছে। আর তোমার নামে লোকে ধিক্কার দিচ্ছে। ছিঃ ছিঃ। তোমার জন্য কাল থেকে আমাদের মুখ দেখানোর জো নেই।”

খবর পেয়ে পিসি ছুটে এল। বলল, “ও ভাই গোবর্ধন, আমার ভুতু কি আর অত ভেবেচিন্তে কিছু করেছে? ছেলেমানুষ, একটা দুষ্টুমি করে ফেলেছে। ওকে ছেড়ে দে।”

গোবর্ধনাবাবু অতিশয় গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমার জন্যই তো ওকে মানুষ করা গেল না মেজদি। তোমার ভয়ে ওকে শাসন করা আমরা একরকম ছেড়েই দিয়েছি। ফলে কী হয়েছে জানো? স্পেয়ার দি কেন অ্যান্ড স্পয়েল দা চাই।”

পিসি এক গাল হেসে বলল, “আমিও তো সেই কথাই বলি। এসপার দিয়ে কেন, ওসপার দিয়ে চলো। তা কি আর ও শোনে?”

জ্যাঠা গম্ভীরতর হয়ে বললেন, “তাই বললুম বুঝি?”

“তাই বললি না নিজে কানে শুনলুম যে। তবে তুই ইংরেজিতে বললি আমি বাংলা করে নিলুম।”

জ্যাঠামশাই খুব হতাশ হয়ে ভুতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জয়পতাকার জন্য একটা দায়িত্ব আমাদের আছে। বিশেষ করে যখন তুমিই এ ব্যাপারটার মূলে আছ। শুনলুম, আগামীকাল ব্যোমকেশবাবু জয়পতাকার একটা সংবর্ধনাসভা করবেন বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু জয়পতাকাকে খুঁজে পাওয়া না গেলে ওটাকে উনি কনডোলেন্স মিটিং বলেও ঘোষণা করতে পারেন। ব্যাপারটা কতদূর গড়িয়েছে দেখেছ?”

“যে আজ্ঞে।”

“আর এই সবকিছুর মূলেই তুমি। পটাশগড়ের জঙ্গল যদি ভয়াবহ জায়গা না হত, তা হলে আমি তোমাকে সেখানে পাঠাতুম। কিন্তু সেটা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ হবে। জেনেশুনে তোমাকে বাঘ-ভালুকের সামনে ঠেলে দিতে পারি

। তা ছাড়া ওটা রহস্যময় জায়গাও বটে। রাতবিরেতে অত্যন্ত মিস্টিরিয়াস আলো দেখা যায়। আমি নিজেও দেখেছি দূর থেকে। সুতরাং ভেবে পাচ্ছি না কী করা উচিত।”

পিসি সঙ্গে-সঙ্গে বলে ওঠেন, “মিষ্টি কী রে? পটাশগড় বড় তেতো জায়গা। বাঘ-ভালুক ভূত-প্রেত রাক্ষস-খোক্কস ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী গোরিলা-সিংহ জিন-পরী সব আছে। সন্ধের পর ও জায়গার নামও উচ্চারণ করতে নেই। রাম রাম রাম রাম।”

“দ্যাখো দিদি, তুমি তো রাম নাম করে বেঁচে গেলে, কিন্তু ওদিকে জয়পতাকার কী হবে তা ভেবে দেখেছ?”

“ও আর ভাবব কী? জয়পতাকাই কি কাজটা ভাল করেছে?

কালু হল শিবের ষাঁড়। স্বয়ং মহাদেব যে-পিঠে চাপেন, সেখানে বসাটাও কি আম্পদ্ধা নয়? তা যার যেমন কর্ম তেমনই তো ফল হবে। শিবরাত্তিরে কালুকে কত লোক ভোগ দেয় জানিস? কত টাকাপয়সা ছুঁড়ে দেয় কালুর পায়ে? বৈতরণী পার হতে গেলে কালুর লেজ ছাড়া আমাদের গতি আছে? সেই কালুর পিঠে জয়পতাকা কোন সাহসে চাপে শুনি!”

গোবর্ধন আর কথা বাড়ালেন না। বাড়িয়ে লাভও নেই। তিনি ভুতুর দিকে চেয়ে বললেন, “নিজের অন্যায়টা বুঝবার চেষ্টা করো গে। আর জয়পতাকা যদি প্রাণ নিয়ে ফেরে, তবে তার কাছে গিয়ে একবার ক্ষমা চেও।”

ভুতু যখন রাত সাড়ে আটটা নাগাদ খেয়ে বিছানায় গেল তখন তার মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। চোখ দুটো ভারী-ভারী লাগছে, বুকটা ভার ঠেকছে। জয়পতাকাবাবুর কাছে ক্ষমা চাইতে সে রাজি। কিন্তু ক্ষমা করার জন্য জয়পতাকা যে ফিরবেন তার ঠিক কি?

ভুতুর যত দোষই থাক, তাকে কেউ ভীতু বলতে পারবে না। পটাশগড়ের জঙ্গলের যত বদনামই থাক, ভুতু সেখানে প্রায়ই দুপুরবেলা যায়। ভারী নির্জন জায়গা। বুনো কুল আর বনকরমচা পাওয়া যায় শীতকালে। টক-মিষ্টি ভারী সুন্দর স্বাদ। ভুতু একা-একা ওই জঙ্গলে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে। তার অত ভয় নেই।

খানিকক্ষণ শুয়ে থেকে ভুতু বুঝল যে, তার ঘুম আসবে না। মাথাটা বড্ড গরম। সে উঠে পড়ল। পাশের খাটে পিসি অঘোরে ঘুমোচ্ছ। তবে বাড়িতে বড়রা অনেকেই জেগে আছে। ঠাকুর কাজের লোক রাতে খাওয়ার পর সাফাইয়ের কাজ করছে।

ভুতু একটা সোয়েটার পরে নিল। সঙ্গে নিল স্কাউট-ছুরি। দরজা খুলে ভুতু বেরোল। তারপর চারদিক দেখে নিয়ে নিজস্ব সাইকেলটা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পটাশগড়ে দিনের বেলা এলেও রাতে কখনওই আসেনি। কাঠের পোলের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ভুতু নদীটা পেরিয়ে পটাশগড়ের অন্ধকার, নিঝুম, ঝি-ঝি-ডাকা জঙ্গলের সামনে পৌঁছে গেল। ভয়-ভয় ভাবটা শুরু হয়ে গেল। এই অন্ধকার জঙ্গলে ঢোকা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? আর এখানে কী করেই বা খুঁজে পাবে জয়পতাকাবাবুকে?

সাইকেলটা মাটিতে শুইয়ে রেখে ক্ষণকাল মাত্র দ্বিধা করল সে। তারপর দৃঢ় পায়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে।

ঢুকতেই সে একটা হরিণের মর্মন্তুদ আর্তনাদ শুনতে পেল। সঙ্গে চাপা একটা গরগর আওয়াজ। বাঘের ডিনার শুরু হল। ভুতু স্কাউট-ছুরিটা বাগিয়ে ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। এগোতে সাহস হল না। তারপর সব আবার চুপচাপ আর নিঝুম হয়ে গেল, সে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। পটাশগড়ের জঙ্গল সামনের দিকটা তেমন ঘন নয়। কিন্তু গভীর জঙ্গল ভীষণ ঘন। চলাই মুশকিল। পাতলা জঙ্গলের মধ্যে একটু জ্যোৎস্না পড়েছে। আবছা আলোয় চারদিকটা আরও গা-ছমছম করা। কিন্তু সাহস না করতে পারলে জয়পতাকাবাবুকে খুঁজে বের করা আরও কঠিন হবে।

হঠাৎ একটা টর্চের আলো তার ওপর ঝলক তুলে সরে গেল। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “ওই একটা বাচ্চা ভূত! বাবা গো!”

চমকে উঠেও গলাটা চিনল ভুতু। ব্যোমকেশবাবু।

আর একজন গম্ভীর গলায় বলল, “ভূত যদি এত শস্তা হত, তা হলে আর ভাবনা ছিল না হে ব্যোমকেশ।”

এ-গলাটাও চেনে ভুতু। এ-হল শ্যাম লাহিড়ী।

আর-একটা লোক বলল, “যাই হোক, ব্যোমকেশ কিছু একটা দেখেছে। সেটা জয়পতাকাও হতে পারে তো! চলো দেখি।”

এ-গলা জয়ধ্বনির। ভুতু প্রমাদ গুনল। আজ যে কাণ্ড সে করেছে তা সকলেই জেনে গেছে। লোকে তার সুনাম করছে না। এখন ধরা পড়লে বিপদ আছে।

সুবিধে হল এই গহিন জঙ্গলে গা-ঢাকা দেওয়ার মতো জায়গার অভাব নেই। ভুতু নিচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অন্যদিকে সরে যেতে লাগল। নিরাপদ দূরত্বে এসে ফের সোজা হল।

আর সোজা হয়েই সে দেখতে পেল, সামনে একটা জলা। খুব চওড়া। চাঁদের আলোয় জলটা ঝিকমিক করছে। জলার ধারে এর আগেও এসেছে ভুতু। তবে রাত্তিরে জলাটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। যেন সত্যি নয়, যেন স্বপ্ন-স্বপ্ন।

.

এই জলায় বাঘে জল খায়। অন্য সব বন্যপ্রাণীও আসে। কাদায় তাদের গভীর পায়ের ছাপ জ্যোৎস্নাতে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। এখানে গাছপালা না থাকায় চাঁদের আলো বেশ ফটফট করছে।

হঠাৎ ভুতু একটা পায়ের ছাপ লক্ষ্য করে চমকে গেল। নিচু হয়ে দেখল, মানুষের পায়ের ছাপই বটে। জয়পতাকাবাবু যদি জলায় নেমে থাকেন, তবে তো ভুতুকেও নামতেই হয়। আশায় ভরসায় ভয়টয় চলে গেল ভুতুর। জয়পতাকাবাবুর পায়ের ছাপ যখন পাওয়া গেছে, তখন জলার ওপাশে তাঁকে পাওয়া অসম্ভব নয়।

জলায় জোঁক আছে এবং ঢোঁড়া সাপ আছে। কিন্তু ভুতু সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। ঘপাস করে কাদায় নেমে পড়ল। হুপহুপ করে একটা হনুমান বড় গাছের মগডালে খানিক লাফালাফি করল। বোধহয় ভালুকটালুক দেখেছে। বাঘও দেখে থাকতে পারে। জলার ধারে ওরা তো আসবেই।

জলা পেরোতে অনেকটা সময় লাগল। ডাঙাজমিতে উঠে ভুতু তার ভেজা প্যান্ট থেকে যতটা পারে জল ঝরিয়ে নিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখল। এবার আরও নিবিড় জঙ্গল। এদিকটায় ভুতু কখনও আসেনি। এ-পাড়ে আর পায়ের ছাপ খুঁজে পেল না সে।

ডালপালা লতা-পাতায় নিশ্চিদ্র অরণ্য। এগোনো ভারী শক্ত। পায়ের ছাপ আর খুঁজে না পেয়ে ভুতু দমে গেল বটে, কিন্তু ক্ষীণ আশা ছাড়ল না।

“সার! জয়পতাকা সার!” বলে দু’বার বেশ জোরে ডাকল আর তখনই হঠাৎ হা হা করে একটা বাতাস বয়ে গেল। সেই বাতাসে পরিষ্কার শব্দ শোনা গেল, “ডিনার শেষ। ফিরে যাও।”

ভুতু দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। ডিনার শেষ! এর মানে কী? কে তাকে ফিরে যেতে বলছে? ভূত নাকি?

ভুতু আবার এগোতে গেল। আবার একটা পাগলাটে দমকা হাওয়া বলে গেল, “ফিরে যাও, ফিরে যাও, ডিনার শেষ।”

ফের ভুতু থমকে দাঁড়াল, একার অশরীরী কণ্ঠস্বর? এ তো বাতাসের শব্দ নয়! বাতাসের সঙ্গে কে যেন মিশিয়ে দিচ্ছে কথা। তাকে ফিরে যেতে বলছে কেন? ‘ডিনার শেষ’, একথাটার মানেই বা কী?

ভুতুর আর যাই দোষ থাক, সে ভীতু নয়। সে ডানপিটে আর একগুঁয়ে। স্কাউট-ছুরিটা খুলে নিয়ে সে শক্ত করে ধরল, তারপর এগোতে লাগল। এত দূর এসে ফিরে যাওয়ার মানেই হয় না। তা ছাড়া জয়পতাকাবাবুর খবর না নিয়ে সে ফিরবেও না।

জলার এ-পাশের জঙ্গল অনেক বেশি ঘন। গাছপালার এত জড়াজড়ি যে, পথ করে এগোনো ভীষণ শক্ত। দিক নির্ণয় করা অসম্ভব। জঙ্গলের ভিতরে ঢোকার পর চাঁদের আলো মুছে গিয়ে নিবিড় অন্ধকার। সোজা হয়ে ভুতু এগোতে পারছে না। সে কখনও চলছে গুঁড়ি মেরে, কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও সাপের মতো বুক ঘষটে। এইভাবে কতক্ষণ এগিয়েছে এবং কতটা, তা তার হিসেব নেই। কিন্তু হঠাৎ সে গাছপালা ভেদ করে একটা ছোট্ট খোলা জায়গায় এসে পড়ল। অনেকটা বড় একটা উঠোনের মতো জায়গা। বড় বড় ঘাস আছে, আর কিছু ঝোঁপঝাড়। সে হঠাৎ দেখতে পেল, একটা ভালুক মস্ত একটা গাছ থেকে তরতর করে নেমে এল। বোধহয় ফল বা মৌচাক ভেঙে মধু খেতে উঠেছিল। নেমে ভুতুর মতোই সে ফাঁকা জায়গাটার ওপাশে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবখানা যেন উঠোনটা পেরিয়ে সে এদিকে আসবে। ভুতু ভালুকটার মুখোমুখি পড়তে চায় না বলে দাঁড়িয়ে রইল। আর জ্যোৎস্নায় ভালুকটার গতিবিধি লক্ষ করতে লাগল।

ভালুকটা কিন্তু সরাসরি উঠোনটা পেরোল না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফাঁকা জায়গাটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বাঁ দিকে ঘুরে টলতে টলতে ঝোঁপঝাড় ভেঙে অনেকটা ঘুরে এপাশে এসে ভুতুর কয়েক হাত দূর দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল।

ব্যাপারটা লক্ষ করে ভুতু একটু অবাক হল। সামনে বড় বড় সবুজ ঘাসে ঢাকা চমৎকার চাতালটা কেন পেরোল না ভালুক-ভায়া?

ভাবতে ভাবতেই ভুতু আর-একটা কাণ্ড দেখল, এক পাল হরিণ তাদের দিঘল পায়ে কোথা থেকে এসে তার খুব কাছেই চাতালটার সামনে থমকে দাঁড়াল, এবং তারপর অবিকল ভালুকটার মতোই সাবধানে ডান দিকে ঘুরে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ওপাশের জঙ্গলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আর-একটু দাঁড়িয়ে থেকে ভুতু লক্ষ করল, কোনও বন্যপ্রাণীই চাতালটাকে পছন্দ করে না বা ভয় পায়। সে অন্তত দশ বারোটা শেয়ালকেও একইরকম অদ্ভুত আচরণ করতে দেখল।

চাতালটায় কী আছে? এমনিতে তো সাধারণ একটা ভোলা জায়গা বলেই মনে হয়, ভুতু চাতালটার খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর সাবধানে পা বাড়াল, কিন্তু নামতে পারল না। একটা বাধা পাচ্ছে, কিসের বাধা তা সে বুঝতে পারল না। কোনও দেয়াল নেই, কাঁচ নেই, বেড়া নেই, অথচ একটা অদৃশ্য বাধা। পা বা হাত কিছুতে ঠেকছে না, অথচ চেষ্টা করেও ভুতু খোলা জায়গাটায় নামতে পারল না।

ভারী অবাক হল সে। কেন নামতে পারছে না? কেন বন্যপ্রাণীরাও জায়গাটাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? বাধাটা কিসের?

আবার একটা বাতাস হাহা করে বয়ে গেল খোলা জায়গাটা দিয়ে, “ফিরে যাও। ফিরে যাও, নইলে বিপদ।”

ভূতু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রাগে, “কিসের বিপদ? আমি বিপদকে ভয় পাই না।”

“ডিনার শেষ। ডিনার শেষ।”

“কে আপনি, সামনে এসে দাঁড়ান।” কোনও জবাব নেই।

অগত্যা ভুতু বন্যপ্রাণীদের মতোই অনেকটা ঘুরে চত্বরটা পার হল। তারপর আবার জঙ্গলে ঢুকল। তাকে চমকে দিয়েই হঠাৎ নীলচে আলোয় চারদিক ভরে গেল। ভারী মায়াবী নরম আলো। স্বপ্নের মতো। সেই আলোয় তার চারদিক উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। নিবিড় অরণ্যের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল।

ভুতু টের পেল আলোর উৎস তার পিছন দিকে, ওই চত্বরে।

ভুতু চত্বরটার দিকে দৌড়ে ফিরে গেল।

কিন্তু সে যখন পৌঁছল, তখন আলো নিভে গেছে। চত্বরটা আগেকার মতোই ফাঁকা আর নির্জন। ভুতু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর আবার ঘুরে তার পথে এগোতে লাগল।

জয়পতাকা যে খাদটার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, ভুতুও সেটার মধ্যে পড়ে যেতে পারত। তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে শূন্যে পা ফেলেও সে টাল সামলে নিতে পারল। আর পারল সে একজন ভাল খেলোয়াড় বলেই।

খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ভুতু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চারদিকে তাকাল। এগোনোর আর কোনও উপায় নেই, যদি না খাদটা কোনওক্রমে পেরনো যায়।

কাছেপিঠে কোথাও একটা খ্যাপা বাঘ গর্জন করে উঠল হঠাৎ। ভুতু অত্যন্ত তড়িৎগতিতে কাছে যে-গাছটা পেল, তাতে উঠে পড়ল। অনেকটা উঁচুতে উঠে সে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। খাদের ওপার আর এপারের গাছের ডালপালা পরস্পরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। খাদটা গম্ভীর হলেও চওড়া নয়। সাহস করে এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঝুল খেয়ে যাওয়া যায়। যে-ই কথাটা সে ভেবেছে, অমনি একটা হুতোম প্যাঁচা ‘ভুত-ভুতুম, ভুত-ভুতুম’ করে ডেকে তাকে সমর্থন জানাল।

সন্তর্পণে ভুতু একটা লম্বা ডাল বেয়ে এগোতে লাগল। ওপাশের একটা গাছের ডাল মাত্র হাত-দুয়েক দূরে নুয়ে আছে। ভুতু চোখ বুজে নিজের বিপজ্জনক অবস্থাটা খানিকটা বুঝে নিল। হাত বাড়িয়ে সে ডালটা নাগালে পাবে না। তবে এ-ডাল ছেড়ে যদি লাফিয়ে পড়ে তবে কপালজোরে ও-ডালটা ধরলেও ধরে ফেলতে পারে। কাজটা অবশ্য খুবই বিপজ্জনক। নিচে অতল খাদ হাঁ করে আছে।

ভুতু সাহস সঞ্চয় করে নিল। যা হওয়ার হবে। এ-এলাকায় সে হল গাছ বাওয়ার চ্যাম্পিয়ন। যে ডালটায় সে বসে আছে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো, সেটা ধরে সে ঝুলে পড়ল। তারপর শরীরটাকে একটু দুলিয়ে সে নিজেকে ছুঁড়ে দিল।

বাঁ হাতটা ফসকাল। কিন্তু পড়তে পড়তেও ডান হাতে সে ডালটা পেয়ে গেল। তার ভারে ডালটা এত নুয়ে গেল যে, একবার মনে হল ভেঙে পড়ে যাবে।

ভাঙল না, নুয়ে ফের উঠে গেল ওপরে। ভুতু কিছুক্ষণ ঝুলে থেকে খুব সন্তর্পণে ডাল বেয়ে গাছের মূল শাখাপ্রশাখায় পৌঁছে গেল।

গাছ থেকে নেমে যখন সে ফের মাটির ওপর দাঁড়াল, তখন তার ঘাম হচ্ছে পরিশ্রমে। কিন্তু থামলে তো চলবে না। জয়পতাকাবাবুর যদি কিছু হয়ে থাকে তবে সে-ই তো দায়ী।

বালিয়াড়িটার কাছাকাছি এসে পৌঁছতে আরও খানিকক্ষণ সময় লাগল তার। যখন পৌঁছল তখন নিশুত রাতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় চারদিক ভারী অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

বাতাসে একটা কণ্ঠস্বর ফের হাহাকার করে উঠল, “ডিনার শেষ। ডিনার শেষ।”

ভুতু বালিয়াড়ির মাঝখানে ধ্বংসস্তৃপটার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল, “কিসের ডিনার?”

কেউ জবাব দিল না।

ভুতু বালিয়াড়ির দিকে পা বাড়াল। সে এই জঙ্গলে চোরাবালি আছে বলে শুনেছে। এই সেই চোরাবালি নয় তো? সে একটা মরা গাছের ডাল কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে দেখল, ভুশ করে ডুবে যায়। তা হলে এই সেই চোরাবালি? কিন্তু ওই ধ্বংসস্তূপের ভিতরে সব রহস্যের সমাধান আছে–এরকম মনে হচ্ছিল তার।

সে জঙ্গলের মধ্যে চারপাশটা খুঁজে একটা শক্ত আর লম্বা ডাণ্ডা জোগাড় করে ফেলল। তারপর ডাণ্ডাটা বালির মধ্যে খুঁজে কতটা গভীর তা মেপে দেখার চেষ্টা করল। ডাণ্ডাটা সম্পূর্ণই ঢুকে গেল ভিতরে, কোথাও ঠেকল না।

কিন্তু ধৈর্য হারাল না সে। ওখানে যখন ধ্বংসস্তৃপ আছে, তখন পথও নিশ্চয়ই ছিল। সেটা খুঁজে বের করতে হবে।

সেই হাহাকার আবার বলে গেল, “পথ নেই। পথ নেই।”

ভুতু তবু ডাণ্ডাটা দিয়ে বালিয়াড়ির বিভিন্ন জায়গায় খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল, পিছনে কে যেন এসে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘুরে তাকাল। কেউ নেই। কিন্তু যেই ৫৮

আবার খোঁচাখুঁচি শুরু করল, তখনই স্পষ্ট টের পেল, পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে লক্ষ করছে। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস যেন পড়ল।

ভুতুর গায়ে একটু কাঁটা দিল। স্কাউট-ছুরিটা বাগিয়ে ধরে সে বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়াল, কেউ নেই। কিন্তু তবু যেন মনে হচ্ছে, কেউ আছে। সামনেই একটা মানুষ-সমান উঁচু ঝোঁপ। ভুতু এগিয়ে গিয়ে ঝোঁপটার গায়ে ডাণ্ডা দিয়ে কয়েকটা ঘা বসাল। তিন ঘা বসানোর পর চতুর্থবার লাঠিটা যেই তুলেছে, অমনি হঠাৎ তার হাত থেকে কে যেন এক মোচড়ে লাঠিটা কেড়ে নিল।

তারপর যে ঘটনা ঘটল তা চোখে দেখলেও বিশ্বাস হয় না। ভুতু দেখল, তার হাত-ছাড়া লাঠিটা শূন্যে লম্বমান হয়ে ঝুলে আছে। তারপর লাঠিটা ধীরে দুলতে দুলতে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে ভেসে-ভেসে চলে যেতে লাগল। আর লাঠিটার সঙ্গে-সঙ্গে বালির ওপর ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় পায়ের ছাপ ফুটে উঠতে লাগল।

ভুতুর গায়ে কাঁটা দিল। মাথা ঘুরে সে হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়েই যেত। অতি কষ্টে সে দাঁতে দাঁত চেপে, হাতে চিমটি কেটে নিজেকে ঠিক রাখল। দেখল লাঠিটা সেই ধ্বংসস্তূপে পৌঁছে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

স্তম্ভিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ভুতু। মাথাটা ধোঁয়াটে, বুকটা দুরদুর করছে। হাত-পা ঠাণ্ডা।

কিন্তু গোঁয়ারগোবিন্দ ডানপিটে ভুতু সহজে হার মানে না। সে ধীরে-ধীরে বালিয়াড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে পায়ের ছাপটা পরীক্ষা করল। মস্ত বড় পা, তবে আঙুল-টাঙুলের কোনও ছাপ নেই। হয়তো অদৃশ্য একজোড়া জুতো হেঁটে গেছে। বেশ গভীর ওজনদার ছাপ।

হঠাৎ ভূতের ভয়ডর কেটে গেল। তার মনে হল, ওই ধ্বংসস্তূপে যাওয়ার পথ হয়তো এইটাই। কেউ তাকে হয়তো পথ দেখাচ্ছে। সে ভূত হলে হবে, ভুতুর তাতে আপত্তি নেই।

ভুতু প্রথম ছাপটার ওপর একটা পা রেখে দেখল, না দেবে যাচ্ছে না। সাহসে ভর করে সে ছাপটার ওপর দাঁড়াল, তারপর পরের পা রাখল পরের ছাপটার ওপর। তারপর এইভাবে ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল। কপালে কিছু-কিছু ঘাম হচ্ছে। বুকটা দুরদুর করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। তবু শেষ অবধি দেখতে হবে। তার খুব মনে হচ্ছে, জয়পতাকাবাবু নিরুদ্দেশ হয়েছেন ওই ধ্বংসস্তৃপেই।

খুব ধীর পায়ে ভুতু এগোচ্ছিল। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তিও বোধ করছিল সে। কেবলই মনে হচ্ছে, সামনের ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে চোরা চোখে কেউ তাকে লক্ষ করছে।

হাহাকারের শব্দে বাতাসটা আর একবার বালিতে ঝড় তুলে বয়ে গেল। বলে গেল, “ফেরার পথ নেই। ফেরার পথ নেই। ডিনার শেষ।”

ঝড়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে চোখ ঢাকল ভুতু। বালির ঝাঁপটায় তার শরীর কণ্টকিত হল। তারপর চোখ চেয়ে যা দেখল তা আতঙ্কজনক। বালির ঝড়ে সামনের ও পিছনের সব পদচিহ্ন মুছে গেছে। সে ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে।

ভুতু কী করবে তা প্রথমে বুঝতে পারল না। এক-পা এদিক-ওদিক হলেই বালিতে ডুবে মরতে হবে। কিন্তু অনন্তকাল তো দাঁড়িয়ে থাকাও যাবে না।

ভুতু স্কুলের সেরা খেলোয়াড়। সে চমৎকার দৌড়তে পারে। যদি বাকি পথটুকু সে খুব জোরে দৌড়োয়, তা হলে হয়তো চোরাবালিতে ডুববার আগেই পৌঁছে যেতে পারবে ডাঙা ৬০

জমিতে। কিন্তু মুশকিল হল, বালির ওপর জোরে দৌড়নো অসম্ভব।

ভুতুকে বিপদের ঝুঁকি নিতেই হবে। সে-জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকবার জোড়পায়ে লাফিয়ে ওয়ার্ম আপ করে নিল। তারপর একশো মিটার দৌড়ে স্টার্ট নেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়াল। বুক ভরে দম নিল। তারপর চিতাবাঘের মতো দৌড় শুরু করল। প্রতি পদক্ষেপেই তার পা ক্রমে গ্রাস করে নিচ্ছে চোরাবালি, কিন্তু ভুতু সময় নিচ্ছে না। পরের বা বাড়িয়ে পেছনের পা টেনে নিয়ে প্রায় উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। শেষ কয়েক ফুট যখন বাকি তখন সে পড়ে গেল। কিন্তু পড়েই গড়াতে শুরু করল। তারপর কী হল মনে নেই।