৪. বৈদ্যুতিক রহস্য

০৪. বৈদ্যুতিক রহস্য

আদিদাস গ্রেপ্তার। অ্যারেস্টেড। বন্দি।

খবরটা নিলয়ের মুখে না শুনলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।

 মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর সবচেয়ে ভারী সদস্য আদিদাস, ভবানীপুর অঞ্চলের অরণ্যদেবও বলা চলে, কিন্তু সে শুধু চেহারায় বা গুলির আকারে। ঝন্টুমামার শিষ্য হিসাবে নাম লেখাবার আগে যেটুকু লম্ফঝম্প করত, সবই আসর সাজিয়ে আলো জ্বেলে, তেল মেখে। কোনও ক্রিমিনাল কাজকম্মর মধ্যে আদিদাস….

আমার মুখের চেহারা লক্ষ করে নিলয় বলল, সত্যি বলতে ঝন্টুমামাকেও আমি কখনও এরকম বিচলিত দেখিনি।

খবরটা তাহলে নিলয় খোদ ঝন্টুমামার মুখেই শুনেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ঝন্টুমামা কী বলছেন?

-ঝন্টুমামার তো মুখে শুধু এক কথা। চাঁদের পিঠে বৃষ্টি পড়েছে শুনলেও এত অবাক হতুম না।

-তা আমাদের এখন করণীয় কী?

করণীয় আর কী! চক্রবেড়িয়া স্ট্রিটে বিজ্ঞানীগৃহে গমন। যদি কোনওভাবে সাহায্য করতে পারি।

ঝন্টুমামার ঘরে পা দেওয়ার আগেই আদিদাসের হাসিমুখ দেখে মনে হল, ওর ঠোঁটটা যেন দু-কান অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। একেবারে বেহেড নির্লজ্জ। যার জন্য আমরা দুর্ভাবনায় মুষড়ে পড়েছি, করুণ মুখে মন্থরগতিতে নতদৃষ্টিতে পা টেনে টেনে কোনওক্রমে এসে হাজির হলাম আর তিনি… তাহলে কি অ্যারেস্ট হওয়ার কথাটা মিথ্যে?

নিলয় সরাসরি জানতে চাইল, তুই যে শুনলাম হাজতবাস করছিস?

–হ্যাঁ, বেল দিয়ে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে।

ঝন্টুমামার কথা কানে আসতেই তাঁর মার্জারসুলভ বিচরণের ক্ষমতার কথা আরেকবার টের পাওয়া গেল।

–তোমরা ঘরে এসো, কথা আছে। আদিদাস, একটু চায়ের ব্যবস্থা কর।

নিলয় দেখি আড়চোখে চাইছে। তা সত্যি বলতে ঢোকামাত্র চা সহযোগে এভাবে আপ্যায়িত হওয়া, ঝন্টুমামার এখানে সত্যিই এক বিরল ঘটনা।

অতি কুৎসিত ব্যাপার। অতি কুৎসিত! ঝন্টমামার উত্তেজনা এখনও কমেনি দেখা যাচ্ছে।

আমি বললাম, আমরাও তো স্তম্ভিত। আদিদাস যে কোনও খারাপ কাজ…

–আদিদাস কিছুই করেনি। তাকে প্ররোচিত করা হয়েছে। শুধু আদিদাস কেন, সারা পাড়া একেবারে খেপে আগুন। তোমরা আসার মিনিট পঁচিশ আগেই মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর প্রবীণ সদস্যরা এসেছিলেন। তার মধ্যে আমার একজন মাস্টারমশাই অবধি ছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত নির্বিরোধ ঠান্ডা মাথার মাস্টারমশাই অবধি কী বলেছেন জান? বেটাদের তোমরা ধরে প্রহার লাগাও। আমরা তোমাদের পেছনে আছি।

আবার ঝন্টুমামার পায়চারি শুরু হল। কিন্তু কে কাকে ধরে প্রহার লাগাবে! কিছুই মাথায় ঢুকছে না।

–ওহ্। তোমরা তো পুরো ঘটনাটা শোননি, তা-ই না? ঝন্টুমামার খেয়াল হল এতক্ষণে।

সংক্ষেপে ঝন্টুমামার বিবৃতিটা পেশ করছি। ঘটনার সূত্রপাত চক্রবেড়িয়া স্কুলের খেলার মাঠে। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। এ পাড়ায় মাঠের অভাব, তাই স্কুলের মাঠে পাড়ার ছেলেরাও খেলতে যায়। তা নিয়ে কোনও মনোমালিন্যও ঘটে না। মিলেমিশেই খেলা চলে। স্কুলের মাঠের উত্তরদিকের পাঁচিলের লাগোয়া বেশ কয়েকটা বাড়ি আছে। কিন্তু তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রায়চৌধুরী বাড়ি। উল্লেখযোগ্য শুধু উচ্চতার কারণেই নয় কিন্তু। আশপাশের বাড়িঘরের চেয়ে অনেক লম্বা এই ছ-তলা বাড়িতে অতি অভদ্র ক-টি লোক বাস করে। ঝন্টুমামার মতে শুধু অভদ্র নয়, অশিক্ষিত, কারণ এখনও তাদের বাড়ির ফটকের পাশে পাথরে নেমপ্লেটে বড় বড় হরফে শোভা পাচ্ছে–কে এম রায়চৌধুরী, আইসিএস। বাবু কে এম শুধু দেহরক্ষা করেননি, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসও লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু কে এম-এর পুত্ররা এখনও সেই বিলিতি গন্ধকে জিইয়ে রাখতে চায়। তারা বিজাতীয় খেতাবকে বড়ই ভালোবাসে। তা বাসুক, তাতেও আপত্তি ছিল না, যদি তাদের ব্যবহারটা অন্তত মানুষের মতো হত। তারা শয়নে-স্বপনে সাহেব, তাই সাহেব ছাড়া আর কাউকে মানুষ মনে করে না। চক্রবেড়িয়া স্কুল তাদের কাছে মূর্খদের গোয়ালঘর। বাড়ির পেছনে একটা নইসেন্স। সত্যি বলতে, কে এম-এর আমলে স্কুল এখান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্যেও চেষ্টা চলেছিল। ওদের আরেকটা আপত্তি ছিল ওই খেলার মাঠ নিয়ে। যখন-তখন বল এসে পড়ে, জানলার কাঁচ ভাঙে। বেশ কয়েকবার স্কুলের কাছ থেকে কম্পেনসেশন অবধি আদায় করেছে। অর্থাৎ হেডমাস্টারমশাইকে নিজের পকেট থেকে পয়সা দিয়ে কাঁচ মিস্ত্রি পাঠিয়ে শার্সি লাগিয়ে দিতে হয়েছে। সেই জন্যেই বছর দুয়েক আগে স্কুল কমিটির সুপারিশে ওইদিককার পাঁচিলটা প্রায় তিনতলা সমান উঁচু আকার ধারণ করেছে। ফলে কাঁচ ভাঙা এবং সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনের ধমকানি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু সেদিন হঠাৎ বেমক্কা একটা কিকে ফুটবলটা পাঁচিল পার হয়ে পড়বি তো পড় রায়চৌধুরী বাড়ির ভেতরে গিয়ে পড়ল। অনেক কাকুতিমিনতি, ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি–তবু কোনও সাড়া নেই। ওদিকে সন্ধে হয়ে আসছে, বাড়ি ফিরতে হবে। এমন সময় স্কুলের উলটোদিকে ইলেকট্রিকের দোকানে মাইক টেস্ট করা হচ্ছিল। কার যেন মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সে দোকানদার পন্টুকে বলে-কয়ে ব্যাটারি আর মাইক ইশকুলের মাঠে নিয়ে এসে ঘোষণা শুরু করে দিল, আপনারা দয়া করে ফুটবলটি আমাদের দিয়ে দিন। ওটা ইশকুলের সম্পত্তি অর্থাৎ জাতীয় সম্পত্তি। কাজ হল, কিন্তু যেভাবে হল, সেটা কেউ আশা করেনি। রায়চৌধুরীদের কাছ থেকেও নয়। বাড়ির মেজ সাহেব ছাতে উঠে বলটাকে টিপ করে ছুঁড়ে মারলেন একেবারে পাঁচিলের মাথায় লাগানো সরু সরু লোহার বল্লমের ওপর। পুরো পাম্প করা বল গেঁথে গেল। এখনও বলটা ওইভাবেই পড়ে রয়েছে। তার পরের অবস্থার কথা সহজেই চিন্তা করা যায়। প্রচণ্ড হইহল্লা চিৎকার গালাগালি। ইতিমধ্যে রায়চৌধুরী বাড়ি থেকে পুলিশে খবর দিয়েছে। সেটাও ছেলেরা অনুমান করেছিল। তাই পুলিশের গাড়ি আসার আগেই তারা পালিয়েছিল। সন্ধেবেলায় মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর ঘরে মিটিং বসে এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে এর একটা প্রতিবাদ করা দরকার। প্রতিবাদের অভিনব বুদ্ধিটা বাতলেছিল আদিদাস এবং সে-ই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। কাজটা কিছুই নয়। রায়চৌধুরীদের বাড়ির সামনের দিকে রাস্তার ধারে তিন ফুট উঁচু একটা ইটের পাঁচিল আছে। তার ওপর সুন্দর সুন্দর টবে বসানো আছে নানা রকমের ছোট ছোট বাহারি গাছ। আদিদাস বলল, সে শুধু বাঁ হাতটা বাড়িয়ে ধরে ওই পাঁচিল ঘেঁষে একটা ছুট লাগাবে। তাহলে গাছগুলোর প্রাণহানি ঘটলেও…

আমরা হেসে ফেললাম। ঝন্টুমামা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, এটা হাসির কথা নয়। এই প্রথম আদিদাস শুধু বাহুশক্তির ওপর নির্ভর করেনি। সে যে ভাবতে পারে, সেটাও বোঝা গেল।

-তা গেল, কিন্তু ভাবামাত্র অ্যারেস্ট এটা ওর মনোবিকাশকে না…।

নিলয় যতই গাম্ভীর্যের ভান করুক, যে কোনও মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারে, তাই তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে দিলাম, এসবই আপনার সাহচর্যের এফেক্ট। যা-ই হোক, তারপর কী হল শুনি।

-তারপরে যা হবার তা-ই। আদিদাস ছুটল আর টবগুলো টপাটপ পড়ল আর ফাটল। ছেলেরা রাস্তার উলটো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে জয়ধ্বনি দিল। গেটের গোঁফওয়ালা দারোয়ানের চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল এই কাণ্ড। কিন্তু রায়চৌধুরীদের অ্যালসেশিয়ানটা এরই মধ্যে ছুটে এসেছিল, কামড়াতে পারেনি, কিন্তু আদিদাসের জামার হাতার একটা খাবলা ছিঁড়ে নিয়েছিল। আর সেই জামার টুকরোটার জন্যই আদিদাস ধরা পড়ে গেল।

-কীরকম?

–ওরা পুলিশ কুকুর আনিয়েছিল। মঙ্গলচক্র অভিযাত্রীর যত সদস্য আর চক্রবেড়িয়া স্কুলের যত ছেলে সবাইকে….

–এইটুকু ঘটনার জন্য পুলিশের কুকুর?

–হ্যাঁ। প্রাক্তন ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি বলে কথা!

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে হল, ঝন্টুমামা অকারণে উত্তেজিত হননি। ঘটনাটার মধ্যে একটা নিদারুণ অপমানজনক ব্যাপার রয়েছে।

–ওদের একটা বৈজ্ঞানিক শাস্তি দিতে না পারলে আমার আর শান্তি নেই। তোমরা একটু হেল্প কর আমায়।

হেল্প! ঝন্টুমামাকে হেল্প করার সুযোগ! আমরা অভিভূত!

 ঝন্টুমামা বললেন, আচ্ছা বলতে পার কুকুরে কী খায়? মানে কী খেতে খুব পছন্দ করে? অবশ্য তোমরা আর জানবে কী করে! এক কাজ কর, চেনাশোনার মধ্যে কারও কাছ থেকে একটা পোষা অ্যালসেশিয়ান বরং কয়েক দিনের জন্য চেয়ে আন। ক-দিন আমি একটু স্টাডি করব।

আমি আর নিলয় এ ওর মুখের দিকে চাইছি দেখে ঝন্টুমামা বললেন, শুধু বসে বসে গল্প শুনে আর চা উড়িয়ে তো কিছু কাজের কাজ হবে না। যা বললাম, সেটা করার চেষ্টা কর। আমি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ধরে আনতে বলিনি।

ঝন্টুমামার মুখে এমন স্নাবিং যতই অসহনীয় ঠেকুক, স্বীকার করতে বাধা নেই, এরকমভাবে না বললে বোধহয় কাউকে যে কাটে না জাতীয় কুকুর সংগ্রহ করার উৎসাহ পেতাম না। রোমিওকে ঝন্টুমামার কাছে গচ্ছিত করার সাত দিন বাদে (ঝন্টুমামার নির্দেশমতো) আবার চক্রবেড়িয়ায় এলাম। রোমিও ঝন্টুমামার কোলে গলা উঁচু করে আদর খাচ্ছে।

-দারুণ! তুলনা নেই রোমিওর! ওর হেল্প না পেলে কিছুই করতে পারতাম না। বুঝলে? তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। যাক, আজকের রাতটাও রোমিও বরং আমার কাছে থা। কাল আমি নিজেই পৌঁছে দিয়ে আসব।

ঝন্টুমামার হঠাৎ এত উচ্ছ্বসের কারণ বুঝতে পারলাম আদিদাসের আগমনের পর।

একগাল হেসে আদিদাস জানাল, আঁধারে মিশে গেছে আর সব।

ঝন্টুমামা কি ফোটোগ্রাফির পাঠ বন্ধ করে এখন আদিদাসকে রবীন্দ্রসংগীত শেখাচ্ছেন!

–সব অন্ধকার। ডার্ক। হ্যাঁ–সব। রায়চৌধুরীদের বাড়িতে তিন দিন ধরে আলো জ্বলছে না।

আদিদাস হাসিমুখে বলেই চলেছে, স্যার রোমিওরে নিয়ে তিন দিন প্রাতভ্রমণে বেরলেন। রায়চৌধুরীদের বাড়ির জিমির সঙ্গে রোমিওর আর স্যারের ভাব হয়ে গেল, তারপরেই সব অন্ধকার। দেখে আসুন, পাড়ার সব বাড়িতে আলো জ্বলছে। কত ইঞ্জিনিয়ার আনল, কত কাণ্ড করল–কিছু হচ্ছে না। পাপের ফল ভোগ করতে হবে না?

বলে কী আদিদাস? এ আবার কীরকম কথা?

রোমিওর গলায় হাত বোলাতে বোলাতে ঝন্টুমামা বললেন, ঠিকই বলেছে আদিদাস। সবই সত্যি এবং আমারই কীর্তি। তোমাদের আরেকটা কাজ কাছে। একটা সুন্দর করে চিঠি লিখতে হবে। বাংলায়। ওই রায়চৌধুরীদের জন্য। বেশ গুছিয়ে লিখবে। মোদ্দা কথাটা অবশ্য খুবই সোজা, পাড়ার লোকের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলে আর কোনও দিনই রায়চৌধুরী বাড়িতে বিজলি আলো জ্বলবে না, পাখা বা এয়ারকুলারও চলবে না। এই চিঠি পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে যদি হেডমাস্টারমশাই অরবিন্দবাবুর কাছে গিয়ে ওরা ক্ষমা না চায় এবং নতুন একটা ফুটবল জমা না দেয়…

–কিন্তু এই চিঠি পেয়ে ওরা যদি আবার হেডমাস্টারমশাইয়ের পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দেয়…

হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে, তাঁর অনুমতি নিয়েই না চিঠিটা পাঠাচ্ছি। সেরকম যদি ঘটেও, উনি বলবেন, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কে কে চিঠি দিয়েছে, তার দায়িত্ব নিশ্চয় ওঁর নয়। তা ছাড়া তোমাদের হাতের লেখা দেখে ক্লাস নাইন-টেনের ছেলে তো মনেই হবে।

আর একটিও বাক্য ব্যয় না করে চিঠি লিখে উঠে চলে এসেছি। এরপর ঝন্টুমামা নিজে যদি খোঁজ না করেন তো কিছুতেই আর চক্রবেড়িয়া আসব না। নিলয় বলেছে, আমাদের উদ্দেশ্য যতই সৎ হোক, বেশি উৎসাহ দেখালে বড় খেলো হয়ে যেতে হয়।

নিলয়ের কথাটা তখন খুব মনে ধরেছিল, কিন্তু এক-একটা করে দিন পেরচ্ছে আর মনে হচ্ছে, পেট যেন ফাঁপছে। কাল রাত্তিরেই স্বপ্ন দেখেছি, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার একটা দুর্গের উঁচু পাঁচিলের ওপর বসে একটা কুকুর ডাকছে। ডাকটা ক্রমে যেন হাসির মতো শোনাতে লাগল। তারপরই দেখলাম কুকুরটা আমাদের সেই রোমিও। রোমিও যেন জিমিকে ভেংচাচ্ছে। ঘুম ভেঙে বুঝতে পারলাম কালো দুৰ্গটা আসলে রায়চৌধুরী বাড়ি।

ঝন্টুমামা পরের দিন সকালে হাজির না হলে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা যেত না। তবু বলব ঝন্টুমামা বড় নিষ্ঠুর। এতদিন যে যাইনি তা-ই নিয়ে একটি কথাও বললেন না। উলটে সেই এক খোঁচা, কনগ্রাচুলেশন। তোমাদের বালখিল্য হস্তাক্ষরের চিঠিতেই কাজ হয়েছে। বুঝলে?

বুঝলাম ঝন্টুমামার গলা ভেজাবার আয়োজন করা দরকার অবিলম্বে।

তবে শুধু চায়ে ঝন্টুমামা ভিজবেন কি না সন্দেহ। ভাগ্যিস নিলয় পণ্ডিতজির দোকান। থেকে ভোজপুরি ভাজাভুজির ব্যবস্থা করেছিল। ঝন্টুমামা চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে বললেন, নানা কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। এই কারণগুলি একে একে বল তো শুনি।

লোডশেডিং অর্থাৎ সরবরাহ বন্ধ হলে কিংবা বৈদ্যুতিক লাইনে কোনও গন্ডগোল দেখা দিলে…

–হ্যাঁ, ওই বৈদ্যুতিক লাইনেই গন্ডগোল হয়েছিল রায়চৌধুরীদের বাড়িতে। কিন্তু বড় মারাত্মক গন্ডগোল। ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই থেকে বিদ্যুৎ ঠিকই আসছে অথচ…

নিলয় বলে উঠল, ফিউজটা পরীক্ষা করা হয়েছিল কি?

–ফিউজ? সে তো প্রথমেই দেখা হয়েছিল। দেশি-বিদেশি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর–কম করে জনা পনেরো বিশেষজ্ঞ তিন দিন ধরে কত পরীক্ষা করল। কিন্তু পুরো নাজেহাল। কোনও সুরাহা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে মাথা নিচু করার পর তবে ফের আলো জ্বলেছে, পাখা ঘুরেছে।

–আপনি নিশ্চয় সারিয়ে দিয়ে এলেন?

–আমি? না না। আমি গন্ডগোলটা বাধিয়েছিলাম। সারাল পলু-ইলেকট্রিকের পন্টু। আসলে পন্টুকেও ওরা একবার অপমান করেছিল। সেই জন্য ওকেই পাঠিয়েছিলাম।

ঝন্টুমামা সিগারেট ধরিয়ে এবার মূল রহস্য উদ্ঘাটন করলেন।

–এক ইঞ্চি লম্বা একটা সুতো। হ্যাঁ–এই সুতোর টুকরোটাই হচ্ছে কালপ্রিট–আততায়ী –বিদ্যুৎকে বধ করেছিল। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তা-ই তো? ওই যে ফিউজের কথা হচ্ছিল, ফিউজ জিনিসটা চোখে দেখেছ তো? এক টুকরো পোর্সলিন যার মধ্যে থাকে এক ফালি তার। বৈদ্যুতিক লাইনে হঠাৎ যদি কোনও কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহ বেড়ে যায়, তখন এই ফিউজের তারটা আগে পুড়ে যায়, লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্ঘটনা রোধ করে। ইলেকট্রিক লাইনে গন্ডগোল হলে প্রথমেই পরীক্ষা করে দেখা হয় ফিউজ। রায়চৌধুরীদের বাড়িতেও তা-ই করা হয়েছিল। ফিউজের তার অটুট আছে বলেই সকলে দেখেছিল। আসলে সেটা কিন্তু দেখা নয়, মনে করা। ফিউজের তারটার দুটো প্রান্ত শুধু বাইরে থেকে চোখে পড়ে, তারটার মাঝখানটা একটা গর্তের মধ্যে থাকে। ইঞ্জিনিয়াররা ফিউজ হাতে নিয়ে দেখেছিল তারের প্রান্তটুকু ঠিকই যথাস্থানে লাগানো আছে। তারপর তারা তারটা টেনে পরীক্ষা করেছিল। তাতেও কিছু আবিষ্কার করতে পারেনি। এইখানেই হচ্ছে আমার কেরামতি। আমি ওই তারটাকে ছিঁড়ে তার মাঝখানে গিট বেঁধে দিয়েছিলাম সুতোর টুকরোটি। সুতো দিয়ে যে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হবে না, এ তো জানা কথা।

স্বয়ং বিশ্বকর্মা এলেও বোধহয় এ রহস্যভেদ করতে পারতেন না।

নিলয়ের কথা কানে না তুলেই প্রশ্ন করলাম, কিন্তু এ কাজে রোমিওকে হঠাৎ প্রয়োজন হল কেন?

–চোদ্দোটা মোগলাই ইনজেকশনের যন্ত্রণা এড়াবার জন্য। ওদের জিমিটা বেশ ফেরোশাস। অথচ রাত্তিরবেলা পাঁচিল টপকে রায়চৌধুরীদের মিটাররুমে তো ঢুকতেই হবে। না হলে কাজ সারব কী করে? সেই জন্যেই আগে রোমিওর সঙ্গে জিমির একটু বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিতে হল। সেই সুবাদে সকাল-বিকেল জিমি যখন বেড়াতে বেরত, রোজ ওকে বিস্কুট খাওয়াতাম। আমার ক্যালকুলেশনে ভুল হয়নি, রাত্তিরে যখন হানা দিলাম, জিমি ছুটে এসেছিল, কিন্তু কামড়ানো দূরের কথা হাঁকডাকও পাড়েনি। কুকুররা শুধু প্রভুভক্তই হয় না, তাদের কৃতজ্ঞতাবোধও আছে।

[প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, ১৯৮৪ অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ১৯৮৫ এপ্রিল]