কর্নেল বৃষ্টির জন্য হাহুতাশ করছিলেন। সে-রাতেই বৃষ্টি এল। তখন আমি আমার সল্টলেকের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছি। বৃষ্টির সঙ্গে তুমুল মেঘগর্জন আর ঝোড়ো বাতাস। শরৎকালের বৃষ্টির যা অভ্যাস। তবে বৃষ্টিটা ঘণ্টাটাক স্থায়ী হল। ভাগ্যিস সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলাম। ইলিয়ট রোড একটু বৃষ্টিতেই নদী হয়ে যায়।
প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোককে কর্নেলের বাড়িতে অবশ্য আর দেখতে পাইনি। ষষ্ঠীচরণ বলেছিল, হালদারমশাই ঘুম ভেঙে আপনাদের দেখতে না পেয়ে রাগ করে চলে গেছেন। কফি খেতেও চাইলেন না।
বৃষ্টির ফলে রাতের আবহাওয়া স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছিল। সকালের কাগজে দেখলাম, কুসুমপুরের চেতনাউদ্যানের দ্বারোদঘাটনের খবর তিনের পাতায় ছবিসহ বেরিয়েছে। অনেকদিন পরে নিকুঞ্জদার ছবিও দেখতে পেলাম। বনমন্ত্রী ফিতে কেটেছেন। তার বক্তৃতার দু-চার লাইন, নিকুঞ্জদার এক লাইন এবং অনেকগুলো খাঁচা খুলে অনেক রকম পাখি উড়িয়ে দেওয়ার বর্ণনাও আছে।
ব্রেকফাস্টের পর কর্নেলকে রিং করলাম। ষষ্ঠীর সাড়া এল। দাদাবাবু নাকি? বাবামশাই তো এক্ষুণি বেইরে গেলেন। কিছু বলে যাননি।
নিশ্চয় বংশীবাবুর চুরি-যাওয়া ডামির খোঁজে বেরিয়েছেন। ওঁর এই এক অদ্ভুত বাতিক। মাথায় একটা আস্ত ডামি ঢুকে গেছে। বের না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না।
সাড়ে দশটায় হালদারমশাইয়ের ফোন এল। উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। জয়ন্তবাবু! সাংঘাতিক কাণ্ড!
বললাম, আপনার ক্লায়েন্টের ওপর আবার হামলা নাকি?
না না। অ্যাকসিডেন্ট।
অ্যাকসিডেন্ট? কী অ্যাকসিডেন্ট?
দত্তসায়েব কার অ্যাকসিডেন্টে মারা পড়েছেন। ওনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক। ছিলেন। উনি হেভিলি উন্ডেড। বাঁচেন কিনা!
কোথায় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?
হাইওয়েতে। বডি লইয়া আইছে পুলিশ। কর্নেলস্যার কইলেন, জয়ন্তরে আইতে কন।
কোথায়?
এভারগ্রিন নার্সিংহোমে। লেকভিউ রোড চেনেন তো? ১২ নম্বর লেকভিউ রোড। গোলপার্ক পার হইয়া ডানদিকে আউগাইয়া সাউদার্ন অ্যাভেনিউয়ের কাছাকাছি।
যাচ্ছি। বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম, তা ঠিক। তবে পথদুর্ঘটনা বিশেষ করে হাইওয়েতে তো প্রতিদিন ঘটছে। দত্তসায়েবের সম্ভবত বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। মিসেস দত্তের ওপর হামলা হয়েছে। তাকে একা রেখে গিয়েছিলেন।
তখনই বেরিয়ে পড়লাম। পিক আওয়ারে সারা রাস্তা ক্রমাগত ট্রাফিক জ্যাম। লেকভিউ রোডের নার্সিংহোমটা খুঁজে বের করতে অবশ্য দেরি হয়নি। কোটিপতিদের জন্য বিশাল নার্সিংহোম। নামটা শোনা ছিল। কখনও এখানে। আসার সুযোগ পাইনি।
পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে বেরুতেই হালদারমশাইকে আমার দিকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসতে দেখলাম। কাছে এসে চাপা গলায় বললেন, দত্তসায়েবের পোলা আইছে। অরে খবর দিল কেডা? ম্যাডাম আইছিলেন। পুলিশ ওনারে প্রোটেকশন দিয়া লইয়া গেল।
এই সময় কর্নেল বেরিয়ে এলেন। চুরুট ধরিয়ে বললেন, চলো। তোমাকে খামোকা কষ্ট দেওয়া হল। নিকুঞ্জবাবু এইমাত্র মারা গেলেন।
নিকুঞ্জদা? আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। নিকুঞ্জদা গাড়িতে ছিলেন?
চলো। যেতে যেতে বলছি।
হালদারমশাই পেছনে এবং কর্নেল সামনে বাঁ পাশে বসলেন। কর্নেলের বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার বিবরণ শুনলাম।
চেতনাউদ্যানের দ্বারোদঘাটন অনুষ্ঠান শুরুর কথা ছিল বিকেল চারটেয়। মন্ত্রীমশাইয়ের পৌঁছুতে এক ঘণ্টা দেরি হয়েছিল। ফিতে কাটা, পাখির খাঁচা খুলে পাখি উড়িয়ে দেওয়া, তারপর প্যান্ডেলে ভাষণ ইত্যাদিতে ছটা বেজে যায়। মন্ত্রী, ভি আই পি এবং এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তিরা একটু পরে চলে যান। বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্টের কজন বিজ্ঞানী, নিকুঞ্জবাবু এবং সাংবাদিকদের ডিনারের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। তারা আটটা নাগাদ ডিনার খান। দত্তসায়েব। ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন ফেরার জন্য। কিন্তু তিনি হোস্ট।
ডিনারে ঠাণ্ডা-গরম পানীয়ের ব্যবস্থা ছিল। রাত নটা নাগাদ সাংবাদিক এবং ফোটোগ্রাফারদের দলটি একটি লিমুজিন গাড়িতে চেপে কলকাতা রওনা হয়। ওটা দত্তসায়েবের গাড়ি। তার পেছনে বিজ্ঞানী অশোক মণ্ডলের অ্যাম্বাসাডারে তার সহকর্মীরা ছিলেন। দত্তসায়েব গিয়েছিলেন তার মারুতি জিপসিতে। নিকুঞ্জবাবু ভিড়ে না গিয়ে তারই সঙ্গী হতে চেয়েছিলেন। দত্তসায়েব নিজে ড্রাইভ করে একা গিয়েছিলেন। তাঁর বাংলো বাড়িতে কেয়ারটেকার লক্ষ্মীবাবু এবং অন্যান্য কর্মীকে কিছু নির্দেশ দেওয়ার পর যখন তিনি নিকুঞ্জবাবুকে নিয়ে রওনা হন, তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ৪০ কিলোমিটার সংকীর্ণ রাস্তার পর সোনাইতলার মোড়ে হাইওয়ে। তখন বৃষ্টিটা থেমে গেছে। কিন্তু রাস্তা পিছল ছিল। তাছাড়া রাত্রে হাইওয়েতে ট্রাক চলাচল বেড়ে যায়। সোনাইতলা থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে একটা বাঁক আছে। রাস্তা ওখানে উঁচু এবং দুধারে গভীর খাল। বাঁকের মুখে দত্তসায়েবের গাড়ির চাকা স্লিপ করে খাদে গড়িয়ে পড়ে এবং উল্টে যায়। নয়ানজুলি জলে ভরা। কিন্তু কিনারায় একটা আকাশমণির গাছ ছিল। ওল্টানো গাড়ি সেই গাছে আটকে যায়।
বাঁকের একটু তফাতে সার বেঁধে চারটে ট্রাক আসছিল। সামনেকার ট্রাকের চালক আবছা দেখতে পেয়েছিল একটা গাড়ি ছিটকে নিচে গিয়ে পড়ল। তাই সে বাঁকের মুখে পৌঁছুনোর আগেই থামার জন্য সিগন্যাল দিচ্ছিল। এর পর চারটি ট্রাকই একে একে দাঁড়িয়ে যায়। ট্রাকচালকেরা এবং তাদের অ্যাসিস্ট্যান্টরা তখনই উদ্ধারকাজে নামে। কাছাকাছি বসতি নেই। কিন্তু ততক্ষণে উল্টো দিক থেকেও কয়েকটি ট্রাক এসে গেছে। কাঁচ ভেঙে সবাই মিলে দত্তসায়েব এবং নিকুঞ্জবাবুকে বের করে। দুজনের শরীরই ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু দেহে প্রাণ ছিল। ৭ কিলোমিটার দূরে মহিমাপুর থানায় খবর দেয় এক ট্রাকচালক। অন্য এক। ট্রাকচালক ওঁদের ট্রাকে তুলে মহিমাপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। তারপর পুলিশ কৃষ্ণনগর থেকে অ্যাম্বুলেন্স আনিয়েছিল। দত্তসায়েবের বুকপকেটে কয়েকটা নেমকার্ড ছিল। কৃষ্ণনগর হাসপাতাল থেকে একজন ডাক্তার কলকাতায় মিসেস দত্তকে ট্রাঙ্ককল করেন। ভোর পাঁচটায় মিসেস দত্ত নিজের লোকজন এবং নার্সিংহোমের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পৌঁছান। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও কলকাতা নিয়ে যান ওঁদের। সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এভারগ্রিন নার্সিংহোমে দশটায় মারা যান দত্তসায়েব। তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। নিকুঞ্জবাবু মারা যান। আমি পৌঁছুনোর সময় অর্থাৎ প্রায় এগারোটা নাগাদ।
হালদারমশাই বললেন, সকালে ম্যাডামেরে ফোন করছিলাম। ওনার মেড সারভ্যান্ট কইল সায়েবের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করছে কোথায়। মেমসায়েব সেখানে গেছেন। তখন কর্নেলস্যারেরে ফোন করলাম।
কর্নেল বললেন, আমি হালদারমশাইয়ের কাছে খবর পেয়ে বালিগঞ্জ প্লেসে নিকুঞ্জবাবুর খোঁজে গিয়েছিলাম। দশটায় অশোকবাবু এলেন। উনি তো শুনেই আঁতকে উঠলেন। মিঃ দত্তের সঙ্গে নিকুঞ্জবাবুর আসার কথা। তাহলে নিকুঞ্জবাবুও– কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর আস্তে বললেন, সওয়া ১০টায় এভারগ্রিন থেকে কেউ ফোনে অশোকবাবুকে জানাল, সাংঘাতিক আহত অবস্থায় ওখানে নিকুঞ্জবাবুকে আনা হয়েছে। শোনামাত্র দুজনে ছুটে গেলাম। মিঃ দত্ত আর নিকুঞ্জবাবুকে তখন ও টি-তে রাখা হয়েছে। ডাঃ অধিকারী পরে আমাকে বললেন, মৃত্যুর আগে নিকুঞ্জবাবুর জ্ঞান ফিরেছিল। তিনি কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার চোয়াল ভেঙে গেছে। ইশারায় তিনি ডাক্তারকে কাগজ-কলম দিতে বলেন। একটা স্লিপ আর ডটপেন তাঁকে দেওয়া হয়। ডাঃ অধিকারী নিজে তাকে লিখতে সাহায্য করেন। কিন্তু অতিকষ্টে কাঁপা-কাঁপা হাতে একটা দুর্বোধ্য কথা লিখেই নিকুঞ্জবাবুর খিচুনি শুরু হয়। কী লিখতে চাইছিলেন কে জানে?
হালদারমশাই পিছনের সিট থেকে উত্তেজিতভাবে ঝুঁকে এলেন। দত্তসায়েবের পোলার লগে কথা কইতে ট্রাই করলাম। উরিব্বাস! কয় কী, হু দি হেল আর ইউ? আবার সঙ্গে সেই মাইয়াডাও ছিল। পোশাকে এক্কেরে মেমসায়েব, কিন্তু বাঙালি। আমারে কইল, এখন অনিরে ডিসটার্ব করবেন না।…
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ষষ্ঠীচরণের তৈরি কফি খেতে খেতে হালদারমশাই তার কালকের নৈশ অভিযান বর্ণনা করলেন। অনিরুদ্ধ তার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে লেক এরিয়ার অভিজাত সোয়ান ক্লাবে ছিল। সেখানে মদ জুয়া আর নির্লজ্জ কাণ্ডকারখানা হয়।
কর্নেল কফি খেতে খেতে একটুকরো কাগজে আতস কাঁচ রেখে কী পরীক্ষা করছিলেন। হঠাৎ ঘুরে হালদারমশাইকে বললেন, সূর্যনারায়ণ রায়ের বাড়িতে অমূল্যবাবু নামে এক ভদ্রলোক থাকেন। তিনি ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। ফিরেছেন কি না খবর নিতে পারবেন?
হঃ! তা পারব।
রায়ভবনে দুটো অ্যালসেশিয়ান আছে কিন্তু। ঝুঁকি নেবেন না।
না, না। হালদারমশাই জোরে মাথা দোলালেন। আমি জানি। ওনাদের যে বুড়া সারভ্যান্ট আছে, কী য্যান নাম–
মন্টু।
আপনি চেনেন? গিছলেন নাকি?
হ্যাঁ। যাই হোক, মন্টুর সঙ্গে কথা বলে অমূল্যবাবুর খবর নিয়ে আমাকে জানাবেন। আর একটা সাহায্য চাই আপনার কাছে।
কী যে কন কর্নেলস্যার। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস।
কর্নেল একটু পরে বললেন, মিসেস দত্ত আপনার মক্কেল। কাজেই এ কাজটা আপনার পক্ষে হয়তো সহজ হবে।
হালদারমশাই ব্যস্তভাবে বললেন, নার্সিংহোমে ওনারে মিট করছি। উনি আইজ বিজি। সায়েবের বডির পোস্টমর্টেম, তারপর শেষকৃত্য এইসব আছে। উনি কাইল মর্নিংয়ে আমারে যাইতে কইলেন।
বাহ্! আপনি ওঁর কাছে জেনে নেবেন, অনির সঙ্গে ওঁর কখনও আলাপ হয়েছিল কি না।
হালদারমশাই কর্নেলের কথা দুটি অভ্যাসমতো নোটবইতে লিখে নিলেন। তারপর এক টিপ নস্যি নিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন এবং যাই গিয়া বলে সবেগে প্রস্থান করলেন।
বললাম, কাজটা ঠিক করলেন না কর্নেল! অত্যুৎসাহী ডিটেকটিভদ্রলোক নির্ঘাত রায়ভবনে গিয়ে কোনও বিভ্রাট বাধাবেন।
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। কফি শেষ করে চুরুট জ্বেলে আবার সেই টুকরো কাগজটা পরীক্ষা করতে থাকলেন।
বললাম, কী ওটা?
নিকুঞ্জবাবুর লেখা দুর্বোধ্য কথাটার জেরক্স কপি। আসলটা পুলিশের কাছে যাবে। তাই ডাঃ অধিকারীর কাছ থেকে অশোকবাবুর সাহায্যে এটা হাতিয়ে এনেছি। ওঁরা পরস্পর পরিচিত। তাছাড়া অধিকারী বসুন্ধরার একজন পৃষ্ঠপোষকও।
দেখাতে আপত্তি আছে?
মোটেও না। দেখ, পাঠোদ্ধার করতে পারো নাকি!
কাগজটা নিয়ে দেখি, ওতে জড়ানো হরফে কী একটা লেখা আছে।
বললাম, এ অক্ষরটা স্পষ্ট। পরেরটা ইউ? নাকি ডি? তারপর যেন ই।
কর্নেল ওটা ফেরত নিয়ে বললেন, মারুতি গাড়ি খুব হাল্কা আর ঠুনকো। তুমি তোমার প্রিয় ফিয়াটকে কক্ষণো ত্যাগ করো না জয়ন্ত।
না। ওকে ত্যাগ করে নতুন গাড়ি কেনার পয়সাও নেই।
আমার ধারণা, বাঁকের মুখ আর রাস্তাও বৃষ্টিতে ভিজে ছিল–এদিকে স্ত্রীর জন্য মনে উদ্বেগ, এবং এমনও হতে পারে যে, মিঃ দত্ত কিছুটা ড্রাঙ্ক হয়ে পড়েছিলেন। কাজেই দুর্ঘটনা ঘটা খুব স্বাভাবিক।
আমি উঠি। বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে অফিস না গেলেই নয়। অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটা একটু রোমাঞ্চের টাচ দিয়ে লিখব। পাবলিক খাবে।
উঁহু। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। তুমি এখনই স্টোরি করতে গিয়ে আমাকেও জড়াবে। তা হতে দিচ্ছি না। তার চেয়ে এখানেই খেয়েদেয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ি। ফুল স্টোরি যথাসময়ে লেখার সুযোগ পাবে।
কোথায় বেরুবেন?
দুর্ঘটনাস্থলটা একটু দেখে নিয়ে চেতনাউদ্যানে যাব। বসুন্ধরা ট্রাস্টের পক্ষ থেকে অশোকবাবু একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন ট্যুরিস্ট সেন্টারের ম্যানেজারবাবুকে।
আপনার অশোকবাবু কি সঙ্গে লেটারহেড নিয়ে ঘোরেন?
ওঁর ব্রিফকেসে প্যাড ছিল। না থাকলে আমাকে আবার বালিগঞ্জ প্লেসে। দৌড়তে হত।
কিন্তু ওখানে গিয়ে কী হবে?
হালদারমশাইয়ের মতো অবস্থা হবে কি না জানা দরকার। বলে কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! আজও তোর দাদাবাবুর নেমন্তন্ন।
ষষ্ঠীচরণ কফির পেয়ালা নিতে এল! সহাস্যে বলল, হালদেরমশাই এলেই দাদাবাবুর নেমন্তন্ন খাওয়া হয়। অথচ হালদেরমশাই বাদ পড়েন। এই এক সমিস্যে।
কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন, ঠিক বারোটায় খাব। যা হোক কিছু।
এক্ষুণি খান না। সব রেডি। বলে যষ্ঠীচরণ হাসতে হাসতে চলে গেল।
কর্নেল উঠে গেলেন। সোফায় পা ছড়িয়ে বসে কর্নেলের ছোটাছুটির মধ্যে একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। ডামি রহস্যের সঙ্গে রায়ভবনের সম্পর্ক স্পষ্ট হয়েছে। আবার সূর্যনারায়ণ রায়ের নাতি অনিরুদ্ধ দত্তসায়েবের প্রথম স্ত্রীর ছেলে। দত্তসায়েবের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন। এদিকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী চেতনাকে কেউ উড়ো চিঠিতে শাসাচ্ছিল এবং গতকাল ভোরে কোনও আততায়ী চেতনাকে লক্ষ্য করে পরপর দুবার গুলি ছুঁড়ে পালিয়ে যায়। হালদারমশাইয়ের মুখে তো বটেই, স্বয়ং রায়সায়েবের মুখেও কাল শুনেছি, অনিরুদ্ধ ভালো ছেলে নয়। রায়সায়েব বলছিলেন, অনি আবার কোনও কেলেঙ্কারি বাধিয়েছে নাকি? তার মানে, অনি অতীতেও দুষ্কর্ম করেছে। দাদামশাইয়ের প্রাইভেট টেলিফোন গোপনে নিজের ঘরে রেখেছে। ডামির অর্ডার যে দিয়েছিল, বংশীবাবু তার সঙ্গে ওই নাম্বারে কথা বলেছেন।
নাহ্। চুপচাপ সব দেখে যাওয়াই ভালো। মগজ ঘুলিয়ে তোলা ঠিক নয়। আমার দরকার শেষ পর্যন্ত একটা এক্সকুসিভ স্টোরি! ব্যস!
সত্যসেবক পত্রিকার চিফ অব দি নিউজ ব্যুরোকে ফোন করলাম। আমার সাড়া পেয়েই সত্যদা খাপ্পা হয়ে বললেন, জয়ন্ত! তোমার বিরুদ্ধে এক্সপ্ল্যানেশন লেটার টাইপ হচ্ছে। বাইপোস্ট পেয়ে যাবে।
দাদা! কাল থেকে শরীরটা খারাপ!
মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে কাজ হবে না জানিয়ে রাখছি। চেতনাউদ্যানের খবর আমরা ঘটা করে আগেও ছেপেছি, আজও ছাপলাম। ওপেনিং ফাংশনের স্টোরি আনতে রমেন গিয়েছিল। কিন্তু যার নামে উদ্যান সেই মিসেস চেতনা দত্তকে গুলি করার খবর সবাই পেল। আমরা মিস করেছি।
আজকের কাগজে?
হাঃ! চিফ এডিটর আমার ওপর ঝাল ঝাড়লেন। আমি তোমাকে ছাড়ছি না। আমারই চেষ্টায় তুমি স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট পোস্টে প্রমোশন পেয়েছ। মাইন্ড দ্যাট!
একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। মিসেস দত্তের ওপর হামলার খবর অন্য সব কাগজ কোন সূত্রে পেল? মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম, দাদা! ওস্তাদের মার শেষ। রাতে বলে একটা পুরনো কথা আছে, জানেন তো?
তুমি কদিনের ছোকরা হে? তুমি–
প্লিজ সত্যদা! শুনুন! চেতনাউদ্যান প্রকল্পে এক কোটি টাকা খরচ করেছেন যিনি, সেই অমিয় দত্ত গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
আমরা অলরেডি খবর পেয়ে গেছি। রমেন চলে গেছে নার্সিংহোমে।
কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে মিসটিরিয়াস অনেক কিছু আছে। আমি তার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি।
শাট আপ! এই বললে তুমি অসুস্থ!
সত্যদা! আমি কিন্তু কর্নেলের বাড়ি থেকে কথা বলছি।
আবার মিথ্যা কথা?
ঠিক আছে। কর্নেলকে দিচ্ছি। আপনি কথা বলুন।
দাও।
ঘুরে দেখি কর্নেল কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে বললেন, দৈনিক সত্যসেবকের সত্যবাবু বেচারা জয়ন্তকে মিথ্যামিথ্যি বকছেন।…হাঃ হাঃ হাঃ। বকেননি? আদর করছিলেন? বাহ্!….স্টোরি? হবে, হবে। একটু ধৈর্য ধরুন।…..সে কী! এ খবর অন্য সব কাগজ পেল কী। করে? এ তো গোপন রাখার কথা!….হ্যাঁ। সেটা সম্ভব। পুলিশ সোর্স থেকেও পেতে পারে। কিন্তু পুলিশ-নাহ্ সত্যবাবু! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মিঃ দত্ত একজন প্রভাবশালী শিল্পপতি।….ঠিক আছে। ছাড়ি।…..হ্যাঁ। ওটা নিছক দুর্ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে। প্লিজ! আপনারা যেন রঙ চড়াবেন না।….ধন্যবাদ।
কর্নেল রিসিভার রেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, আজকের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ার সময় পাইনি। কিন্তু কোন সোর্সে খবরটা রটল? জয়ন্ত! তুমি এখনই দৈনিক প্রতিভাতে ফোন করে খোঁজ নাও তো! প্রতিভা নাকি প্রথম পাতায় আলাদা করে ছেপেছে। অন্য সব কাগজ ভেতরের পাতায় উদ্বোধন অনুষ্ঠানের তলায় জুড়ে দিয়েছে।
প্রতিভা পত্রিকায় রিং করে রিপোর্টিংয়ে লাইন চাইলাম। সাড়া এলে বললাম, শমিতকে চাইছিলাম। আপনি কে বলছেন ভাই? আমি জয়ন্ত চৌধুরি।
জয়ন্তদা! আমি অলকেশ বলছি।
তুমি মর্নিং শিফটে? কোন অপরাধে তোমার এই শাস্তি হল?
না, জয়ন্তদা! ম্যানেজ করেছি। ইভনিং শোয়ে একটা ছবি দেখব।
ভালো। একটি জরুরি কথা অলকেশ!
বলুন জয়ন্তদা।
আচ্ছা, চেতনাউদ্যানের মিসেস চেতনা দত্তের ওপর হামলার খবর তোমরা প্রথম পাতায় ছেপেছ। তুমি জানো কোন সোর্সে খবর পেয়েছিলে তোমরা?
কাল মর্নিং শিফটে মনোজ ছিল। আজ তার অফ-ডে।
তুমি কিছু জানো না?
একটু ধরুন। জাস্ট এ মিনিট।
মিনিট তিনেক পরে অলকেশ বলল, জয়ন্তদা! চেতনাউদ্যান ওপেনিংয়ের পর ওখানেই কেউ রিপোর্টারদের জানিয়েছিলেন। প্রকাশ্য সভায় অসুস্থতার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে ডিনারের সময় কেউ নাকি চুপিচুপি রিপোর্টারদের জানিয়েছিলেন। নিউজ এডিটর মধুমিতাদি বললেন। আপনি কথা বলবেন ওঁর সঙ্গে?
নাহ্। থাক। পাবলিক বুথ থেকে রিং করছি। ছাড়ি।
টেলিফোন রেখে কর্নেলকে কথাটা জানালাম। কর্নেল বললেন, ইন্টারেস্টিং!
কিন্তু আমাদের রমেন জানাল না কেন? সে তো ছিল সেখানে।
কর্নেল তার অট্টহাসিটি হাসলেন। ককটেল ডিনারের ব্যাপার। রমেন মানে তোমাদের রমেন গাঙ্গুলি? সে তো দু-পেগেই ভুল বকতে শুরু করে। তুমি জানো না?
নড়ে বসলাম। তাই তো! রমেন একটুতেই আউট হয়ে যায়।
তাহলে দেখ, আমরা অনেক সময় জানি না যে আমরা কী জানি। কর্নেল : এই ঋষিবাক্য আওড়ে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। চলো। শিগগির দু-মুঠো খেয়ে নিই। কৃষ্ণন্নগরে গিয়ে পেটপুরে সরপুরিয়া খাওয়া যাবে।….
ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর নেশা একেই বলে! বরাবর দেখে আসছি, আমার প্রকৃতিবিদ বন্ধু পকেটের পয়সা খরচ করে যেমন প্রকৃতির অভ্যন্তরে নাক গলান, তেমনি কোন রহস্যময় ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই। এদিকে ওঁকে কেউ ডিটেকটিভ বললে চটে যান। কারণ ডিটেকটিভকেই নাকি দুর্জনেরা টিকটিকি বলে। ওঁর মতে, ডিটেকটিভ শব্দ থেকেই বাংলা স্ল্যাং টিকটিকির উদ্ভব।
সল্টলেকে আমার ফ্ল্যাটে ঝটপট স্যুটকেস গুছিয়ে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। ভি. আই. পি. রোডে একটা পেট্রোল পাম্প থেকে ফুল ট্যাংক তেল নিতে হল। কিন্তু দাম মেটালেন কর্নেল। তার যুক্তি হল, চেতনাউদ্যানের বার্ড স্যাংচুয়ারি তাঁকে বিদেশি পত্রিকায় সচিত্র নিবন্ধ লেখার সুযোগ দেবে এবং সে বাবদ তার দক্ষিণা প্রাপ্য হবে অন্তত এক হাজার ডলার। কাজেই যথেচ্ছ পেট্রোল খরচ করার ব্যাপারে তিনি কার্পণ্য করবেন না।
গত রাতের বৃষ্টির ফলে রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। একে কেন ন্যাশনাল হাইওয়ে বলা হয় জানি না। এই রাস্তায় দুর্ঘটনা না ঘটাটাই অস্বাভাবিক। শান্তিপুরের গোলকধাঁধা এবং বিপজ্জনক বাঁকগুলো কর্নেলের নির্দেশে পেরিয়ে অবশেষে যখন কৃষ্ণনগর পৌঁছুলাম, তখন সওয়া চারটে বেজে গেছে। বনেট খুলে রেডিয়েটারের জল বদলে ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করলাম। কর্নেল সেই সময় সত্যিই সরপুরিয়ার একটা পুরুষ্টু প্যাকেট এবং ফ্ল্যাস্কভর্তি চা বা কফি নিয়ে এলেন। বললেন, মারুতি দুর্ঘটনার খবর এখনও এখানে তাজা–অন্তত সরপুরিয়ার চেয়েও। তবে চাফি খুব গরম।
চাফি কী?
প্রকৃতিবিদ হাসলেন। চা এবং কফি মিলে চাফি। আশ্চর্য ডার্লিং। তুমি কখনও চাফি খাওনি? বলে গাড়িতে উঠলেন। চলো! আলো থাকতে থাকতে দুর্ঘটনার জায়গায় পৌঁছুতে হবে। সেখানেই বরং সরপুরিয়া আর চাফি সাবাড় করা যাবে।
আধঘণ্টা পরে বাঁকের সংকেত লক্ষ্য করলাম। মনে হলো, আজ বোর্ডটাতে নতুন করে রঙ মাখানো হয়েছে। একেবারে ইউ-এর গড়ন বাঁক। খুব বিপজ্জনক বাঁক। কারণ দু-ধারে ঘন সারবন্দি গাছ। এসব গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে। কর্নেলের নির্দেশে বাঁ দিকে একটা চাকা নামিয়ে গাড়ি দাঁড় করালাম। কর্নেল নেমে গেলেন। তারপর রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। বললাম, কী ব্যাপার? গাড়িটা এখনও পড়ে আছে নাকি?
উনি ইশারায় আমাকে ডাকলেন। কাছে গেলে বললেন, লক্ষ্য করছ? কী। প্রচণ্ড জোরে মিঃ দত্তের গাড়ি উল্টে গিয়েছিল যে কিনারায় আকাশমণি গাছের সারি ভেঙে দুমড়ে গেছে। ওই দেখ, নিচের সারিগুলো গাড়িটাকে জলে পড়তে দেয়নি। কানে শোনা আর চোখে দেখার মধ্যে কত তফাত থাকে, তাহলে বোঝো!
দেখতে অস্বস্তি হচ্ছিল। নিচে গাড়িটা অবশ্য নেই। পুলিশ ব্রেকভ্যান তুলে নিয়ে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু অজস্র কাঁচের টুকরো আর জমাট রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি রক্তকে ধুয়ে দিতে পারেনি। ভাঙা গাছগুলোর অনেক অংশ
ইতিমধ্যে লোকেরা তুলে নিয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছিল। কর্নেল পায়ের কাছে। ঘাসের দিকে তাকিয়েছিলেন। হঠাৎ হাঁটু মুড়ে বসে বুকপকেট থেকে আতস কাঁচ বের করলেন। তারপর পিচ পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে বললেন, আশ্চর্য! মিঃ দত্ত আচমকা এখানে যেন ব্রেক কষেছিলেন!
কীভাবে বুঝলেন?
এই দেবে-যাওয়া টায়ারের দাগগুলো ব্রেকভ্যানের। কিন্তু এই যে দেখছ ঘাসগুলো অল্প একটু ঘষে র্থেতলে গেছে, এটা মারুতির টায়ারের দাগ। ব্রেক কষার সঙ্গে সঙ্গে হাল্কা গাড়ি উল্টে গিয়ে গাছের সারিতে ধাক্কা মেরেছিল। বলে কর্নেল পিচের কিনারা পর্যন্ত আতস কাঁচে পরীক্ষা করতে থাকলেন।
অস্বস্তি এবং বিরক্তিতে অস্থির হয়ে রাস্তা পেরিয়ে আমার গাড়ির কাছে গেলাম। কর্নেল হাতের চেটোয় তুলে সম্ভবত পিচের কুচি পরীক্ষা করছিলেন। এবার দেখলাম সেগুলো রুমালে বেঁধে নিলেন। তারপর সোজা নাক বরাবর রাস্তা পেরিয়ে বাঁ দিকের ঘাস পরীক্ষায় ব্যস্ত হলেন।
তারপর দেখলাম, উনি এধারের সারবন্দি সরু-সরু গাছের ফোকর গলিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণের জন্য ওঁকে হারিয়ে ফেললাম। চেতনাউদ্যান এখনও অন্তত পঞ্চাশ কিলোমিটার। অস্বস্তিটা ক্রমশ পেয়ে বসল। মনে হল, এভাবে ওঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়া ঠিক হয়নি। কারণ গাড়িটা তো আমাকেই চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কর্নেলের আবির্ভাব ঘটল আমার গাড়ির পেছন দিকে। আর তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এবার চাফি এবং সরপুরিয়া সাবাড় করা যাক। বলে গাড়ির ভেতর হাত চালিয়ে ওঁর কিটব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করলেন। জয়ন্ত, আমার হাতে জল ঢেলে দাও। নোংরা ঘেঁটেছি। হাবাঁকটা লক্ষ্য করো আবার। সায়েবদের দেশে হাইওয়ে বা এক্সপ্রেস ওয়ের ধারে কখনও গাছ লাগানো হয় না। গাড়ির চালক পুরো রাস্তাটা দেখতে পায় যেন। আমাদের দেশে অবশ্য রাস্তার ধারে গাছ লাগানোটা একটা প্রাচীন ঐতিহ্য। আহা! জল ঢালো! তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন আস্ত ম্যানিকিন!