০৪.
UTA AIR AFRIQUE বিমান কোম্পানির হোঁতকা বোয়িংটা প্যারি থেকে দৌড় শুরু করে লিবরেভিলের রানওয়েতে এসে গতি সংবরণ করল। গুটিগুটি করে রানওয়ে ছেড়ে যথাস্থানে এসে দাঁড়াল যাত্রীদের খালাস করবে বলে। মধ্য আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে গ্যাবন রাজ্যের রাজধানী লিবরেভিলের সঙ্গে এই একটিমাত্র কোম্পানিই বিমান সংযোগ রক্ষা করে। এবং কোম্পানিটি যথা কারণে ফ্রান্সের। স্বাধীন গ্যাবন আজও তাদের এককালের প্রভু ফ্রান্সের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল। এখন অবধি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢোকবার ইচ্ছা হলে গ্যাবনবাসীদের ফ্রান্সেই যেতে হয়।
ডক্টর সেনশর্মা, পিয়ের আর সুজনকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য রাজকীয় ব্যবস্থা করেছে গ্যাবন সরকার। গ্যাংওয়ের সিঁড়ি থেকে মাটিতে পা পড়ামাত্র একটা বিদেশি গাড়ির খোলা দরজা তাদের তাপনিয়ন্ত্রিত অন্দরমহলে আমন্ত্রণ জানাল।
গাড়িতে বসে টাইয়ের নটটা আলগা করে ঘাম মুছতে মুছতে পিয়ের বলল, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, তবু কী ভ্যাপসা গরম। উফ
ডক্টর সেনশর্মা বললেন, গ্যাবনের ঠিক মাঝখান দিয়ে বিষুবরেখা গেছে। গরম হবে না!
শোফারের পাশে সামনের সিটে যে আফ্রিকান ভদ্রলোক বসে ছিলেন, তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। বৈদেশিক মন্ত্রকের একজন অফিসার। পিয়ের গ্যাবনের আবহাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করল।
বিষুবরেখা যে সব দেশের ওপর দিয়ে গেছে, তার মধ্যে গ্যাবনের আবহাওয়া বরং তেমন উগ্র নয়। সারা বছর এখানকার তাপমাত্রা প্রায় একই থাকে। নব্বই থেকে পঁচানব্বই ডিগ্রি ফারেনহাইট। তা ছাড়া বৃষ্টিও হয় খুব। শুধু মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্ষার প্রকোপটা কম থাকে।
সুজন বলল, আমরা তাহলে ভালো সময়েই এসেছি বলতে হবে, বৃষ্টির মধ্যে কাজের অসুবিধে হত।
গাড়িটা এয়ারপোর্ট বিল্ডিং-এর সামনে এসে দাঁড়াল। গার্ড অব অনার দেবে বলে সামরিক বাহিনী প্রস্তুত। গাড়ি থেকে নামতেই চোস্ত বিদেশি পোশাক-পরা এক আফ্রিকান এগিয়ে এসে প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করলেন। ইনি বৈদেশিক মন্ত্রকের সেক্রেটারি মিস্টার বানিন। ফ্ল্যাগপোস্টে পতাকা তোলবার জন্য আহ্বান জানাতে ডক্টর সেনশর্মাকে এগিয়ে দিল পিয়ের। ডক্টর, আপনি যান। ব্যান্ডে গ্যাবনের জাতীয় সংগীতের সুর বাজছে। সুজন দেখল গ্যাবনের পতাকাটা ভারতের মতোই তেরঙা। অবশ্য রংগুলো অন্যরকম, মাঝখানে কোনও প্রতীকও নেই।
তিন দেশের পতাকা তুলে ফিরে এসে ডক্টর সেনশর্মা বললেন, আপনাদের পতাকার সঙ্গে আমাদের দেশের পতাকার খুব মিল আছে।
ঝকঝকে এক সারি দাঁত বার করে মিস্টার বানিন হাসলেন, আপনারা দুজন তো ভারতীয়? তা-ই না? জানেন, আমাদের এখানে একবার একটি ভারতীয় ছেলে একটা কবিতা আবৃত্তি করেছিল। কী যেন নাম কবিতাটার–আফ্রিকা বলেই মনে হচ্ছে। এগোতে এগোতে কথাবার্তা চলতে থাকে।
ঠিকই বলেছেন। আফ্রিকা একটা বিখ্যাত কবিতা। আমাদের দেশের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। কিন্তু এই ছেলেটি কে? নাম মনে আছে? সুজন কৌতূহল বোধ করল।
নাম মনে নেই। তবে আমি জানি, ল্যাম্বারিনে কাজ করে।
পিয়ের পাশ থেকে বলে উঠল, জানেন তো ল্যাম্বারিন কেন বিখ্যাত? ডক্টর অ্যালবার্ট শোয়াইজারের সেই বিখ্যাত হাসপাতালে জন্যে। ডক্টর শোয়াইৎজার ওখানেই তাঁর জীবনের বেশির ভাগটা কাটিয়েছেন। এমন নিঃস্বার্থ সেবা দেখা যায় না।
মিস্টার বানিন ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ঠিক বলেছেন, ডক্টর শোয়াইৎজারের মেয়ে এখন রয়েছেন ওখানে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমাদের পতাকার কথা হচ্ছিল না? আমাদের পতাকার রং তিনটের প্রত্যেকটার একটা মানে আছে। মাথার দিকের সবুজ রংটা হচ্ছে অরণ্যের প্রতীক। সারা গ্যাবন জুড়েই দেখতে পাবেন গভীর অরণ্য। মাঝখানের সোনালি রংটা বিষুবরেখাকে বোঝাচ্ছে। গ্যাবনের ঠিক পেটের মাঝখান দিয়ে গেছে বিষুবরেখা। আর নীল রংটা সমুদ্রর জন্য। গ্যাবনের পুরো পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর।
এক্সকিউজ মি স্যার। পাশ থেকে বয়স্ক এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে পথরোধ করে দাঁড়ালেন। স্থানীয় ভাষায় নিজেদের মধ্যে দু-চারটে বাক্যবিনিময় শেষ হতেই মিষ্টার বানিন বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের এয়ারপোর্টের মেডিক্যাল অফিসার জানতে চাইছিলেন, ইয়েলো ফিভার, ম্যালেরিয়া আর স্লিপিং সিকনেসের জন্যে আপনারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন তো?
সুজন আর ডক্টর গোস্বামী মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল। পিয়ের মন্তব্য করল, সে আর বলতে!
আমার তো মনে হয়, মশারা বোধহয় নাতসি দস্যুদের থেকেও ভয়ংকর।
সুজন বলল, আমরা অবশ্য মশাকে অতটা ভয় পাই না। একসময় আমাদের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে একজন-না-একজন ম্যালেরিয়া রোগী থাকতই।
ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারির পিছুপিছু ওরা এয়ারপোর্টের রেস্তরাঁয় গিয়ে ঢুকল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরখানায় ওদের জন্য একটা টেবিল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চেয়ারে বসে সামনের বিশাল কাচের দেওয়ালের ওপারে সুজন দেখল, অসংখ্য তাল গাছের সারি একটা পাঁচিল তৈরি করে ফেলেছে। তার সামনে ফুলের কেয়ারিতে হালকা কমলা রঙের ফুল। ফুটে আছে। অনেকটা ক্যানা ফুলের মতো, কিন্তু লম্বা লম্বা পাপড়ির কানগুলো ছুঁচোলো। হালকা বেগুনি রঙের একটা করে গোলগাল নধর ডাঁটায় তিন-চার থোকা ফুল। রঙের বাহার চোখ টেনে রাখে।
পিয়ের বলল, মি. দাশগুপ্ত, ভারতে থাকার সময় শুনতাম, এমন বাঙালি নাকি দুর্লভ, যে জীবনে একটাও কবিতা লেখেনি
মৃদু হেসে মুখ ফেরাল সুজন, ফুলগুলো দারুণ!
মিস্টার বানিন বললেন, এটার নাম স্টারলিৎজিয়া। আফ্রিকার বর্ষাপ্রধান অঞ্চলে দেখা যায়। যাক–কী খাবেন বলুন?
পিয়ের বলল, থ্যাংকসআমার জন্য যা হোক একটা সফ্ট ড্রিংক বলে দিন। আর কিছু নয়।
সুজন ও ডক্টর সেনশর্মাও পিয়েরের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। সবার জন্যেই সফট ড্রিংকের অর্ডার দেওয়া হল। মিস্টার বানিন সিগারেটের প্যাকেটটা খুলে বাড়িয়ে ধরেন। পিয়ের আর সুজনের সিগারেটটা ধরিয়ে দিয়ে বানিন বললেন, আমার খুব ইচ্ছে ছিল, নিজেই আপনাদের সঙ্গে থাকব। কিন্তু কোনও উপায় নেই। অবশ্য আমি একজন লোক ঠিক করে রেখেছি। ভালো ফরাসি জানে, ইংরেজিটাও চলনসই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মোটামুটি খবরাখবরও রাখে। ও-ই থাকবে আপনাদের সঙ্গে। কোনও অসুবিধা হবে না। ওয়েল–উইশ ইউ সাকসেস। অরেঞ্জ স্কোয়াশের গ্লাসটা হাতে তুলে নিলেন বানিন।
সুজন বলল, আমাদের প্রোগ্রামটা কীরকম হবে, সেটা বোধহয় এখনই ঠিক করে ফেললে ভালো হত।
বানিন বললেন, আমরা একটা প্রোগ্রাম মোটামুটি ছকে রেখেছি। এবার আপনারা চিন্তা করে দেখুন। এখান থেকে আপনারা হোটেলে চলে যাবেন। একটু বিশ্রাম করে বিকেলবেলা যদি চান, শহরটা ঘুরে দেখতে পারেন। সন্ধেবেলা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে আপনাদের অভ্যর্থনা জানানো হবে। তারপর কাল ভোরবেলা হেলিকপ্টারে করে রওনা হয়ে যাবেন। এখান থেকে মোয়ান্ডা যেতে–এই ঘণ্টা চার-পাঁচ লাগবে।
মোয়ান্ডা মানে যেখানে ম্যাঙ্গানিজের খনি আছে? ডক্টর সেনশর্মা জানতে চাইলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ। মোয়ান্ডার খনি পৃথিবীর মধ্যে ম্যাঙ্গানিজের সবচেয়ে বড় খনি বললে ভুল হবে না।
সুজন জিজ্ঞেস করল, আমাদের গন্তব্যস্থলটা ঠিক কোথায়?
মোয়ান্ডা থেকে খুব দূরে নয়। শ-খানেক মাইলের মধ্যে। জায়গাটার নাম ওকলো। মোয়ান্ডা না গিয়ে আপনারা ফ্রান্সভিলেও যেতে পারতেন। ওকলোর সবচেয়ে কাছের বড় শহর ফ্রান্সভিল। তবে মোয়ান্ডায় আপনাদের বেস ক্যাম্পের ব্যবস্থা করার আসল কারণ হল, ওখান থেকে আপনারা প্রয়োজনমতো সবরকম টেকনিক্যাল সাহায্য পাবেন। কমিলগ কোম্পানি সবরকম ব্যবস্থা করে রেখেছে।
পিয়ের জানতে চাইল, ওকলো জায়গাটা গ্যাবনের কোন অংশে?
গ্যাবনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বলা যেতে পারে। কঙ্গো সীমান্ত এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। গ্যাবনের সবচেয়ে বড় নদী ওগোওয়ির তীরে এটা একটা মালভূমি অঞ্চল। এখানে ধারেকাছে কোনও বসতি পাবেন না। হয় আপনাদের কাজ সেরে মোয়ান্ডায় ফিরে আসতে হবে, নয়তো তাঁবু ফেলবার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা আপনারা মোয়ান্ডায় গিয়ে আগে সব পর্যবেক্ষণ করে নিন, তারপর স্থির করবেন।
সুজন হঠাৎ প্রশ্ন করল, আপনি বললেন, আমরা কাল এখান থেকে হেলিকপ্টারে রওনা হব। এত দূর পথ হেলিকপ্টারে না গিয়ে বরং মোয়ান্ডা থেকে সেই ব্যবস্থা করলে ভালো হত না কি?
মিস্টার দাশগুপ্ত, এই একটা ব্যাপারে আজও আমরা অনেক পিছিয়ে। সারা দেশে এখনও রেলপথ বলে কিছু নেই। এখন অবশ্য লিবেরভিলের কাছে ওয়েন্ডো বন্দর থেকে গ্যাবনের উত্তর-পূর্ব কোণে ম্যাকাকাউ অবধি রেলপথ বসানোর কাজ চলছে। তবে তার মূল উদ্দেশ্য যাত্রী পরিবহন নয়। ম্যাকাকাউয়ের কাছে বেলিঙ্গায় প্রচুর লোহার আকরের সন্ধান পাওয়া গেছে, কিন্তু পরিবহনের অভাবে আজও খনির কাজ শুরু করা যায়নি।
সুইং ডোর ঠেলে একটি লোক এসে টেবিলের ওপর মিস্টার বানিনের সামনে একটা চিরকুট রেখে পিছিয়ে দাঁড়াল।
মিস্টার বানিন কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়ে লোকটিকে কাছে আঞ্চলিক ভাষায় কিছু বলতেই সে ঘাড় নেড়ে চলে গেল।
সরি! ডাক পড়েছে। এবার আমায় বিদায় নিতে হবে। সন্ধেবেলায় অবশ্য আবার দেখা হবে। তবে একটা কথা আপনাদের এখনও বলা হয়নি। আমি আপনাদের এই গ্যাবন সম্বন্ধে এমন একটা খবর দেব, যেটা বাইরের দেশের কোনও লোক জানে না এবং আমরাও চাই না, ব্যাপারটা জানাজানি হোক। এটা গ্যাবনেরই স্বার্থে, আর কিছু না। আপনাদের না বললেও হয়তো জানতে পারতেন, কিন্তু আপনাদের অনুসন্ধানের সুবিধে হবে মনে করেই বলছি। মঁসিয়ে পিয়ের, আপনি ফ্রান্সের লোক। তাই আমার কথা শুনে আপনিই হয়তো সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হবেন।
মোটেই না–আপনি নিশ্চিন্ত মনে বলতে পারেন। থ্যাংক গড–সেই পুরোনো পৃথিবীতে জন্ম নিইনি। আজ তাহলে আমি হতাম সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর দেশের লোক আর আপনি কালো নেটিভ কলোনিয়াল। হরিবল।
মিস্টার বানিন টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে পিয়েরের হাতটা টেনে নেন, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ সঁসিয়ে পিয়ের।
ডক্টর সেনশর্মা অস্ফুটস্বরে বলেন, উন্নত দেশের প্রতিনিধিরা যদি সবাই পিয়েরের মতো মনোভাব পোষণ করত, তাহলে বোধহয় আমাদের আজকে এখানে আসার প্রয়োজনই পড়ত না।
মিস্টার বানিন টেবিলের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে সামনে ঝুঁকে পড়ে চাপা গলায় বলেন, যে জায়গায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার কাছেই ইউরেনিয়ামের বিশাল সঞ্চয় আবিষ্কার হয়েছে। এটা একদম সিক্রেট। গ্যাবনের অন্যান্য অঞ্চলে কোথাও কোথাও ইউরেনিয়ামের খনি থেকে ইউরেনিয়াম ভোলা হয়, কিন্তু তার সবটাই ফ্রান্সের সহযোগিতায় এবং ফ্রান্সই তার একমাত্র ক্রেতা। আমরা চাইছি না, ইউরেনিয়ামের এই খনিটার পরিচালনভার বিদেশি দেশের হাতে চলে যাক। অথচ ব্যাপারটা জানাজানি হলেই চাপ সৃষ্টি হবে। গ্যাবন স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিকভাবে সে পুরোপুরি স্বনির্ভর হতে পারেনি। এখনও। এখন এই পারমাণবিক বিস্ফোরণটি যেখানে ঘটেছে, সেখান থেকে ইউরেনিয়ামের খনিটি খুবই কাছে বলতে হবে। আমরা সন্দেহ করছি এটা হয়তো কোনও সাবোতাজ৷ আমাদের পুরো খনিটাকেই ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল।
সুজন খাড়া হয়ে বসে চেয়ারে। আশ্চর্য তো! পুরো ব্যাপারটা একটা অন্যরকম চেহারা নিচ্ছে। কিন্তু আপনাদের সঙ্গে কাদের এমন শত্রুতা আছে যে…।
মিস্টার বানিন বললেন, শত্রুতা বা রেষারেষি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মধ্যেই আছে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, এইসব শত্রুতার পেছনে থাকে বড় বড় দেশের উসকানি। তারা নিজেদের স্বার্থ গোছাতে এক দেশের বিরুদ্ধে আরেক দেশকে উত্তেজিত করে। গ্যাবনে বর্তমানে নিরপেক্ষ সরকার থাকলেও অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতার ব্যাপারে প্রথম সারিতে রয়েছে আমেরিকা আর ফ্রান্স। আপনারা জানেন নিশ্চয়, প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে গ্যাবন খুবই লোভনীয়। লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, ইউরেনিয়াম, পেট্রোলিয়াম আর বনজ সম্পদের তো কথাই নেই। কাজেই বুঝতেই পারছেন…
ডক্টর সেনশর্মা বললেন, শুনে মনে হচ্ছে, ওকলো অঞ্চলটা থেকে পিপলস রিপাবলিক অব কঙ্গোর দূরত্ব খুব বেশি নয়।
ঠিকই বলেছেন, কঙ্গোর রাজধানী ব্রাজাভিল থেকে ওকলো আকাশপথে বোধহয় ঘণ্টাখানেকের পথ।
ডক্টর সেনশর্মাকে এই প্রথম চঞ্চল হতে দেখল সুজন। হাত দুটোকে বুকের ওপর ঘষতে ঘষতে তিনি বললেন, আপনারা কি সন্দেহ করছেন যে, এই ইউরেনিয়াম যাতে ফ্রান্স বা আমেরিকার হাতে না যায় তাই সমাজতান্ত্রিক কঙ্গো বা তার পেছনে কোনও বড় শক্তি…
না না ডক্টর সেনশর্মা। এত সহজে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে আমরা অনেক অনুসন্ধান চালিয়েছি, কিন্তু কোনও ফল পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, মোনাডায় কমিলগ কোম্পানির সিকিয়োরিটি ব্যবস্থা অসাধারণ। এখানে রাডার অবধি আছে। সম্পূর্ণ আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে। ওরাও কিন্তু কোনও হদিশ দিতে পারেনি। ওরা অবশ্য পুরো ব্যাপারটা জানে না। কিন্তু তাহলেও কোনও প্লেন যদি ওকলোতে বোমা ফেলতে আসে, তাদের রাডারে অন্তত ধরা পড়া উচিত ছিল। আমরা অনেক খোঁজখবর করেছি, কিন্তু আজ অবধি এমন কোনও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি যে, বিস্ফোরণের দিন ওই সময় নাগাদ কোনও বিমান কারও চোখে পড়েছে।
আশ্চর্য। ভৌতিক ব্যাপারের মতো লাগছে। পিয়ের মন্তব্য করল।
না–এর পেছনে গভীর চক্রান্ত রয়েছে। সুজনের গলাটা তেতো হয়ে গেছে, আমার তো মনে হচ্ছে না এই রহস্য ভেদ করা আদৌ সম্ভব বলে।
ডক্টর সেনশর্মা সুজনের পিঠে হাত রাখেন, তুমিই আমাদের সবচেয়ে বড় ইন্সপিরেশন ব্রাদার। তুমি হতাশ হয়ে পড়লে আমরা কী করব? এই বুড়ো বয়েসে তোমার মতো ইয়াং ম্যান পাশে আছে বলেই না এসেছি।
পিয়ের চেয়ারে পিঠ রেখে বলে উঠল, ঠিক বলেছেন ডক্টর। আমারও কি সমস্যা কম? ডোন্ট মাইন্ড মিস্টার বানিন। আমার তো আর কোনও অভিযানে যাবার ইচ্ছে নেই। আপনাদের দেশের মানুষের হাসিটা এত সুন্দর। আমার তো এরই মধ্যে লিবেরভিলকে ভালো লেগে গেছে।
মিস্টার বানিন হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন। আশা করি, আজ সন্ধেয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর লিবেরভিলের প্রতি আপনার ভালোবাসা আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে খেয়াল রাখবেন, আপনার প্রতিও যাতে গ্যাবনিজদের ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবার সুযোগ পায়। উইশ ইউ গুড লাক–আমাকে এবার বিদায় নিতে হবে। চলুন, তার আগে আপনাদের আমি গাইড ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। বিকেলবেলা ও গাড়ি নিয়ে যাবে হোটেলে। শহরটা ঘুরে দেখে নিতে পারেন। ও হ্যাঁ, ভালো কথা–আপনাদের কাছে টুপি আছে তো?
টুপি? সুজন অবাক হয়ে যায়।
আজ্ঞে হ্যাঁ। এখানে দিনের বেলায় খালি মাথায় বাইরে বেরোনো খুবই বিপজ্জনক। যে কোনও মুহূর্তে সানস্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। এমনকী মেঘলা দিনেও হতে পারে। বিদেশি মানুষ অনেক সময় না বুঝে দারুণ বিপদে পড়ে যায়।
কিন্তু আমাদের কাছে তো…
চিন্তা করবেন না, আমি রোজারের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেব।
পড়ন্ত বেলায় অতিথিদের নিয়ে গাড়িটা হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেল সুজন। ভারতের হিসেবে এখন রাত নেমে আসার কথা। মনে পড়ে গেল, গ্যাবন দেশটা একে পশ্চিম আফ্রিকায়, তার ওপর লিবেরভিল তার একেবারে পশ্চিম প্রান্তে, আটলান্টিক মহাসাগরের কূলে একটি বন্দর। তা ছাড়া বিষুবরেখাও গেছে খুবই কাছ দিয়ে। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায় সুজন। একটা শহর বলে সহজে বিশ্বাস হতে চায় না। ঘন সবুজের সমারোহ শুধু। মাঝেসাঝে উঁকিঝুঁকি মারছে নিচু নিচু একতলা বা দোতলা বাড়িগুলো। অনেকটা বাংলো ধরনের দোচালা বাড়ি। বেশির ভাগ বাড়ির মাথায় পোড়া ইটের রঙের ঢেউ-খেলানো লোহার চাল। এমন একটা বাড়ি চোখে পড়ে না, যার সঙ্গে ফল-ফুলের বাগান নেই। তবে তারই মধ্যে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য খোপ-খোপ দেশলাই বাক্স ধাঁচের বাড়িও যে একেবারে নেই তা নয়। তবে উচ্চতায় তার কোনওটাই খুব বেশি নয়। আরেকটা জিনিস ওদের সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বেশির ভাগ বাড়ির জানলাতেই কাচের বদলে রয়েছে সরু তারের জাল। দেখলেই বোঝা যায় পোকামাকড়, মশা-মাছির উপদ্রব কতখানি। গাইড ছেলেটি স্বল্পভাষী। শোফারের পাশে সামনের সিটে বসেছে। ছেলেটির গায়ের রং কিন্তু তেমন কালো নয় বা চুলগুলোও এদেশীয়দের মতো কুণ্ডলী-পাকানো স্প্রিং-এর মতো নয়। গড়নটা স্থানীয় লোকজনের তুলনায় কিঞ্চিৎ ছোটখাটো। সবারই প্রশ্ন করার ইচ্ছে থাকলেও ডক্টর সেনশর্মাই প্রথম মুখ ফুটে জানতে চাইলেন। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসাবে প্রশ্নটা তাঁকেই মানায়। ছেলেটি মৃদু হেসে জানাল, সে ওমিয়িনি জাতের লোক। গ্যাবন দেশটা ছোট হলেও তার সাত লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ফাং যোদ্ধা, নোকিং, বাটেকে ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির মানুষ আছে। এমনকী মধ্য গ্যাবনের পুবদিকের গহন অরণ্যে যেখানে গোরিলা দেখা যায়, সেখানে সেই প্রসিদ্ধ পিগমিরাও আছে। তবে এদের মধ্যে পশ্চিমদিকে সমুদ্র উপকূলের বাসিন্দা ওমিয়িনিরাই প্রথম বিদেশি মানুষদের সান্নিধ্যে আসে। রোজার নামে এই ছেলেটিও ওমিয়িনি জাতির। ওরা সবাই প্রায় ক্রিশ্চান। তা ছাড়া ওদের অনেকেই ফরাসিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ।
রোজার নির্দ্বিধায় তার পারিবারিক ইতিহাস বলে চলে, কিন্তু বাকি সবাই অস্বস্তি বোধ করে। বিশেষ করে পিয়ের। সুজন প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিতে বলে, আচ্ছা, এই শহরের রাস্তাগুলো দেখছি বেশ বড় বড়। তা ছাড়া বড় রাস্তা থেকে যে ছোট রাস্তাগুলো বেরিয়েছে, সবই প্রায় সমকোণে। প্ল্যান্ড সিটি বলে মনে হচ্ছে।
আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই শহরটা একেবারে আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি করেছিল ফরাসিরা। জানেন নিশ্চয়, কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমরা ফরাসিদের অধীন ছিলাম।
সুজন আবার জানতে চায়, তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এই তো, প্রায় এসেই পড়েছি। আমরা সি-বিচের দিকে যাচ্ছি। জায়গাটা খুব সুন্দর। সমুদ্রের তীরটাও বেড়াবার পক্ষে খুব ভালো।
পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে পিয়ের বললো, যা গরম আর ঘাম, বেড়ানোর ইচ্ছে মাথায় উঠে গেছে।
দূর থেকে ভেসে-আসা ঢেউয়ের গর্জন কানে আসতেই বোঝা যায় সমুদ্রতীর আর বেশি দূরে নেই। সমুদ্রের গর্জন ক্রমশ কাছে আসছে। গাড়িটা একটা বাঁক নিতেই অসংখ্য গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে তটরেখা আর নীল সমুদ্র উঁকি মারল। গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রোজার বলল, যাবেন?
সুজন ডক্টর সেনশর্মার দিকে তাকাল। একটানা দু-দিন ধকল কম যায়নি। ডক্টর সেনশর্মার জন্যেই চিন্তিত ছিল সুজন, কিন্তু দেখা গেল তাঁরই উৎসাহ বেশি। তিনি সবার আগে নেমে পড়েছেন।
সমুদ্রের দিকে ক-পা এগোতে-না এগোতেই সুজন অবাক হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আরে, এগুলো আম গাছ না?
ডক্টর সেনশর্মাও অবাক হয়েছেন। সমুদ্রের তীর বরাবর অসংখ্য আম্রকুঞ্জ আর তাল গাছের সারি।
রোজার বলল, হ্যাঁ, এখানে খুব আম হয়।
সুজন হাসতে হাসতে বলল, ভারতীয়দের একটা গর্ব খর্ব হল। আমার ধারণা ছিল, ভারতের মতো আম বোধহয় আর কোথাও হয় না।
আম আর তাল গাছের সারি পেরিয়ে সমুদ্রের কিনারায় এসে দাঁড়াল সবাই। পিয়ের একটা আম গাছের ছায়ায় বসে পড়েছে। ঘাম মুছতে মুছতে ক্লান্ত। অদূরে একটা ধূসরবর্ণ মালবাহী বাষ্পীয় পোতের চিমনি দিয়ে অল্প অল্প ধোঁয়া বেরোচ্ছে। জাহাজটার কাছেই বহু বিশালাকার গাছের গুঁড়ি ভাসছে সমুদ্রের জলে। ঢেউয়ের ওঠাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃদু মৃদু দোল খাচ্ছে। জাহাজটা তার ক্রেনের শুড় নামিয়ে এক-এক করে গাছের গুঁড়িগুলো টেনে তুলছে।
রোজার বলল, এগুলো ওকোউমি গাছ। সারা গ্যাবন জুড়েই চিরবর্ষার গহন অরণ্যে বিশাল আকারের এই গাছগুলো দেখা যায়। এর কাঠ থেকে প্লাইউড তৈরি হয়। লিবেরভিল ও আরও দক্ষিণে পোর্ট জেন্টিল বন্দর থেকে এই কাঠ বিদেশে চালান যায়।
ডক্টর সেনশর্মা জিজ্ঞেস করলেন, কাঠগুলো কি নদীপথে ভাসিয়ে নিয়ে আসা হয়?
হ্যাঁ, লিবেরভিল বন্দরটার কাছে সমুদ্র দেশের ভেতর অবধি অনেকটা ঢুকে এসেছে। এই খাড়ির মুখে দুটি নদী এসে পড়েছে–কোমো আর এমবে। আরও পুবে এই দুই নদীর দু-ধারেই আছে গহন অরণ্য। সেখান থেকে ওকোউমি গাছ কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। স্রোতের টানে কাঠ ভেসে আসে। পোর্ট জেন্টিলেও একই দৃশ্য দেখতে পাবেন। সেখানে গ্যাবনের সবচেয়ে বড় নদী ওগোওয়ি দিয়ে কাঠ ভেসে আসে। আসলে এখন অবধি আমাদের দেশের রাস্তাঘাট তেমন উন্নত নয়।
পিয়ের কখন উঠে এসেছে, কেউ খেয়াল করেনি। হঠাৎ তার প্রশ্ন শোনা গেল, আচ্ছা– ওই ওখানে ওরা কী করছে?
কিছুটা দূরে দক্ষিণদিকে তীরের ওপর দশ-বারোজন লোক ঘোরাঘুরি করছে।
রোজার বলল, ওরা মাছ ধরে এনেছে। এখন মাছ কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করছে। দেখবেন, চলুন-না।
রোজারের পিছুপিছু এগোতে এগোতেই সুজন প্রশ্ন করল, আচ্ছা, গ্যাবন শব্দটার কি কোনও মানে আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ–গ্যাবন শব্দটা এসেছে পর্তুগিজ গ্যাবাও শব্দ থেকে। পনেরোশো সালে পর্তুগিজরা প্রথম তাদের জাহাজ ভেড়ায় পোর্ট জেন্টিলে। এখানে ওগোওয়ি নদীর মোহনায় আটলান্টিক উপকূলের আকৃতি দেখে তারা অবাক হয়ে যায়। সে যুগের পর্তুগিজদের পোশাক ছিল ঢোলাহাতা কোট আর টুপি। সেই পোশাকের সঙ্গে তারা এই ভূভাগের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পায়। গ্যাবাও পর্তুগিজদের কোটের নাম।
মজার ব্যাপার তো। পিয়ের বলল, আচ্ছা, লিবেরভিল মানে তো ফ্রি টাউন বা মুক্তির শহর। এর পেছনেও কোনও ইতিহাস আছে নাকি?
রাজার হেসে ঘাড় নাড়ে, ১৮৪৯ সালে ফরাসিরা একটি ক্রীতদাস চালান দেবার জাহাজ আটক করে এবং বন্দিদের কোমো নদীর মুখে এই শহরের কাছেই মুক্ত করে দেয়। সেই থেকেই এর নাম লিবেরভিল।
আহ! কী আরাম! পিয়ের হঠাৎ বুকের ওপর হাত বুলোতে শুরু করল।
কী হল?
নাঃ–কিছু না। বুকটা এই প্রথম গর্বে ভরে ওঠার সুযোগ পেল। এতক্ষণে পিতৃপুরুষদের একটি ভালো কীর্তির কথা শুনলাম। আর সবই তো
পিয়েরের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি দেখে সবাই হাসতে শুরু করে।
আরও কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল, আম গাছের ছায়ায় তিন-চারজন মহিলা ঝকঝকে বিরাট বিরাট ছুরি হাতে মাছ কাটছে। কয়েকজন আবার বেতের ঝুড়িতে করে কাটা মাছ ধুয়ে আনছে আর কলাই-করা বড় বড় গামলায় মাছগুলো রাখছে। মহিলারা সবাই বেশ স্থূলকায়া। পরনে রংচঙে বড় বড় নকশাছাপা সুতির পোশাক। নিম্নবাসটা অনেকটা লুঙ্গির মতো করে পরেছে। গায়ের জামাগুলো ঢলঢলে হাতকাটা ফতুয়ার মতো।
রোজার বলল, ছেলেরা সমুদ্র থেকে মাছ ধরে এনেছে। মেয়েরা এবার এগুলো কেটেকুটে সাফ করে বাজারে নিয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে পিয়ের আরও এগিয়ে গিয়ে মূকাভিনয় শুরু করে দিয়েছে মহিলাদের সঙ্গে। হাবভাবে সে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল যে, এত বড় মাছ দেখে তার খুব খাবার লোভ হচ্ছে। মহিলারা প্রথমে একটু বিরক্ত বোধ করছিল বোধহয়, কিন্তু পিয়ের শেষ পর্যন্ত তাদের মুখে শুধু হাসিই ফোঁটায়নি, বিরাট একটা মাছও উপহার হিসেবে আদায় করে ছেড়েছে। মহাগর্বে মাছ দোলাতে দোলাতে পিয়ের গাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
দেখুন–দেখুন– হঠাৎ রোজারের ডাক শুনে সবাই পেছন ফিরে তাকাল। সমুদ্রের দিকে আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা কালোমতো তেকোনা জিনিস চোখে পড়ল। জলের ওপর উঁচু হয়ে রয়েছে। দেখতে-না দেখতে সামুদ্রিক প্রাণীটা ভেসে উঠল। সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে তার ঘোলাটে হলুদ শরীরটা। বিরাট একটা হাঙর।
পশ্চিম আফ্রিকার পুরো উপকূল জুড়েই এদের দৌরাত্ম। এখানকার লোকে এদের সামুদ্রিক নেকড়ে বলে। রোজারের কথা শুনতে শুনতেই ওরা গাড়িতে গিয়ে উঠল।
গাড়িটা এবার ভিন্ন পথে হোটেলের দিকে এগিয়ে যায়। শহরে একেবারে কেন্দ্র দিয়ে চলেছে। লিবেরভিলের সম্পূর্ণ এক অন্য চেহারা এখানে। কাউকে যদি রাতারাতি চোখ বেঁধে প্যারি থেকে এনে এখানে ছেড়ে দেওয়া যায়, তাহলে প্রথমটা সে হয়তো বুঝতেই পারবে না যে এটা প্যারি নয়। রাস্তার দু-ধারে প্রশস্ত বুলেভার্ড। ইউরোপিয়ান স্টাইলের কাফে আর রঙিন ছাতার ছায়ায় সাজানো সরু সরু পা-ওয়ালা সুদৃশ্য চেয়ার-টেবিল। বেশির ভাগ দোকানের নামই ফরাসিতে লেখা। একটা বাড়ির গায়ে বিশাল হরফে লেখা DISCOTHEQUE সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
রোজার বলে, সবরকম আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় লিবেরভিলে। সারা গ্যাবনের মধ্যে লিবেরভিল আর পোট জেটিলেই শুধু এরকম দৃশ্য দেখতে পাবেন।
সুজন ও ডক্টর সেনশর্মা বিস্ময় প্রকাশ করেন, কিন্তু পিয়ের বিড়বিড় করে বলে, সুযোগ-সুবিধা সবই আছে। তবে সেগুলো মহামান্য ইউরোপিয়ান অতিথিদের জন্যে। ব্যাবসার নামে গ্যাবনে বসে গ্যাবনেরই কাঁচামাল লুট করবে অথচ এতটুকু কষ্ট করতে হবে না।
শহরটাকে একবার চক্কর দিয়ে গাড়িটা হোটেলে ওদের নামিয়ে দিয়ে গেল। রোজার সন্ধেবেলায় এসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবে।