৪. বিপদে পড়লে মানুষের বুদ্ধি খোলে

বিপদে পড়লে মানুষের বুদ্ধি খোলে। বাবুরাম যখনই বুঝতে পারলেন, বনি নিরাপদ নয় এবং তাঁদের ওপর কিছু লোক নজর রাখছে, তখন ঘাবড়ে গেলেও তিনি হাল ছাড়লেন না। বিপদ থেকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে উদ্ধার পেতে হবে। এবং জানতে হবে, বনির জন্মের ভিতরে কী রহস্য আছে। সুতরাং ডেলাওয়্যার ওয়াটার গ্যাপের রাস্তায় সেই দুর্ঘটনার জায়গায় যাওয়া ঠিক করলেও তিনি গোপনে যাওয়াই স্থির করলেন। নিজের গাড়িতে যাওয়া চলবে না, গাড়িটা শত্রুপক্ষ নিশ্চয়ই চেনে। তা ছাড়া সেই পোডড়া বাড়িটায় যেতে গেলে শক্তপোক্ত গাড়ির দরকার, শৌখিন গাড়ি ধকল সইতে পারবে না।

আমেরিকায় গাড়ি কেনা খুব সহজ। যে-কোনও শহরেই গাড়ির দোকানে সারি-সারি নতুন বা পুরনো গাড়ি সাজানো আছে। নগদ টাকাতেও কিনতে হবে না, ক্রেডিট কার্ডেই কেনা যায়। বাবুরাম উইক এণ্ডের আগের দিন গাড়ির ডিলারের কাছে গিয়ে খুব দেখেশুনে একটা জাপানি হোণ্ডা গাড়ি কিনলেন। জিপগাড়ির মতোই সেটার ফোর হুইল ড্রাইভের ব্যবস্থা আছে। সেলফ সিলিং টায়ার থাকার ফলে ফুটো হওয়ার ভয় নেই। পুরু ইস্পাতের পাতে তৈরি গাড়িটা খুব মজবুত। গাড়ি কিনে তিনি সেটা বাড়ি নিয়ে গেলেন না। সেটা বোকামি হবে। ডিলারকে বললেন, একটা বিশেষ জায়গায়, পার্কের ধারে যেন গাড়িটা আজ রাতের মধ্যেই রেখে আসা হয় এবং গাড়ির চাবি যেন ডিকির ভিতরে রেখে দেওয়া হয়।

আমেরিকায় গাড়ি চুরির ঘটনা খুব কমই ঘটে। আর বেশির ভাগ গাড়িই রাস্তাঘাটেই ফেলে রাখা হয়।

শনিবার বাবুরাম আর প্রতিভা সকালে উঠে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলেন। তারা একসঙ্গে বোলেন না। বাবুরাম যেন কোনও কাজে যাচ্ছেন, এমনভাবে ব্যাগট্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিউ ইয়র্কের দিকে চলে গেলেন। আর প্রতিভা বনিকে প্যারামবুলেটারে বসিয়ে, যেন ছেলেকে নিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন, এমনভাবে বেরোলেন। পার্কের কাছাকাছি এসে তিনি গাড়িটা দেখতে পেলেন। চারদিকটা লক্ষ করে দেখলেন, কোনও সন্দেহজনক লোককে দেখা যাচ্ছে না। তিনি ধীরে ধীরে বনিকে নিয়ে গাড়িটার কাছে এসে ডিকি থেকে চাবিটা বের করে গাড়ির দরজা খুলে বনিকে কোলে নিয়ে উঠে পড়লেন। প্যারামবুলেটরটা পার্কে একটা ঝোঁপের ভিতরে খুঁজে দিলেন।

খুব জোরে গাড়ি চালালে পাছে কেউ সন্দেহ করে এজন্য মোটামুটি স্বাভাবিক গতিতে চালিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কের রাস্তায় খানিক দূর এগোলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন, একটা লোক বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লিফট চাইছে।

প্রতিভা গাড়ি থামালে বাবুরাম উঠে এলেন গাড়িতে।

এর পর রুট এইট্টি ধরে সোজা পেনসিলভানিয়ার দিকে গাড়ি চালিয়ে দিলেন প্রতিভা।

জায়গাটা খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধে হল না। অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছিল একটা গ্যাস-স্টেশন সাইনের দু’ শো গজ দূরে, তাঁদের মনে আছে। পাশেই একজিট–অর্থাৎ হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে ছোটখাটো শহর বা পল্লী অঞ্চলে যাওয়ার রাস্তা। প্রতিভা একজিট দিয়ে হাইওয়ে থেকে নেমে এলেন। কিছু দূর গিয়েই বাঁ ধারে জঙ্গলের সেই রাস্তাটা দেখতে পেলেন।

হোণ্ডা গাড়িটা সত্যিই ভাল। জঙ্গলের রাস্তায় একটু টাল খেতে-খেতে দিব্যি চলতে লাগল। ঘুমন্ত বনিকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন বাবুরাম। হঠাৎ লক্ষ করলেন, বনি চোখ মেলে তাঁর দিকে চেয়ে আছে।

ছেলেকে আদর করে বাবুরাম বললেন, “বনি, তুই কিছু বলতে চাস? খিদে পেয়েছে?”

বনি চেয়ে থাকা ছাড়া আর খাওয়া এবং ঘুম ছাড়া আর কিছুই পারে না। তবু ওকে নিয়ে কেন যে কিছু লোকের এত মাথাব্যথা!

জঙ্গল পার হয়ে গাড়িটা একটু ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। সামনেই সেই ঝুরঝুরে পোড়ো বাড়িটা।

বাবুরাম জিজ্ঞেস করলেন, “প্রতিভা, তোমার ভয় করছে না

প্রতিভা মাথা নেড়ে বললেন, “না। ভয় কিসের? বনির জন্য আমি সব করতে পারি।”

“তা হলে এসো, বাড়িটা ভাল করে দেখা যাক। বিশেষ করে বেসমেন্টটা।”

বাবুরাম বনিকে কোলে নিয়ে নামলেন, সঙ্গে প্রতিভা। ধীরে-ধীরে তাঁরা বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত আমেরিকানদের বাড়ি যেমন হয় এবাড়িটাও তেমনই। একতলায় লিভিং রুম, ড্রয়িং রুম, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর ইত্যাদি। সবই ফাঁকা। তবে রান্নাঘরে গ্যাস উনুনটা রয়েছে। ফলে জলও আছে।

তাঁরা ধীরে-ধীরে বেসমেন্ট-অর্থাৎ মাটির তলার ঘরটিতে নামলেন। ঘরটা মাটির তলায় হলেও স্কাইলাইট দিয়ে যথেষ্ট আলো আসছে। বিশাল ঘর। এবং এ-ঘরটাও ফাঁকা। বাবুরাম সুইচ টিপলেন। অবাক কাণ্ড! আলো জ্বলল। তার মানে, বাড়িটার ইলেকট্রিক কানেকশন এখনও আছে।

বাবুরাম চারদিক ঘুরে দেখছিলেন। একটা ওয়েস্ট বাস্কেট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। বাবুরাম ওয়েস্ট বাস্কেটটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দেখলেন, ভিতরে দু-চারটে জিনিস রয়েছে। তার মধ্যে একটা ডিসপোজেবল ইনজেকশন, যার উঁচটা খুব লম্বা। আর লেবেলহীন কয়েকটা ইনজেকশনের অ্যামপুল। বাবুরাম জিনিসগুলি সংগ্রহ করে একটা চামড়ার ব্যাগে ভরে নিলেন।

প্রতিভাও চারদিক ঘুরে-ঘুরে দেখছিলেন। টয়লেটটা দেখতে ঢুকলেন প্রতিভা। টয়লেটেও একটি ওয়েস্ট বাসকেট রয়েছে। প্রতিভা দেখলেন তার মধ্যে কিছু টুকরো কাগজ। তিনি টুকরোগুলো বের করলেন। দু-চারটে ব্যবহৃত টিসু পেপার। আর ভেঁড়া একটা কার্ড। কার্ডের চারটে টুকরো জুড়লেন প্রতিভা। একটা ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন। ডক্টর লিভিংস্টোনস ক্লিনিক, পোর্টল্যান্ড, পেনসিলভানিয়া।

তিনি বাবুরামকে কার্ডটা দেখালেন। বাবুরাম সেটাও ব্যাগে ভরে নিলেন। বললেন, “আর তো কিছু দেখার নেই দেখছি।”

প্রতিভা চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “হয়তো আছে। কিন্তু আমরা তো আর ডিটেকটিভ নই।”

হতাশ হয়ে দু’জনে ওপরে উঠে এলেন। আর উঠেই শুনতে পেলেন জঙ্গল ভেদ করে একটা শক্তিশালী মোটরবাইক এগিয়ে আসছে। সম্ভবত তাঁদের দিকেই।

প্রতিভার মুখ শুকনো, “শুনতে পাচ্ছ?”

“পাচ্ছি। চলো, গাড়িতে উঠে পড়া যাক।”

প্রায় দৌড়ে গিয়ে তাঁরা দু’জন গাড়িতে উঠলেন। বাবুরাম বনিকে প্রতিভার কোলে দিয়ে বললেন, “এবার আমি চালাব। তুমি মাথা নিচু করে বসে থাকো।”

“মাথা নিচু করব কেন?”

“যদি গুলি-টুলি চালায়। ওরা কেমন লোক তা তো জানি না।”

প্রতিভা তাই করলেন। বাবুরাম গাড়িটা ঘুরিয়ে নিতে-না-নিতেই ভীমবেগে প্রকাণ্ড একটা মোটরবাইক জঙ্গল ফুড়ে ফাঁকা জায়গাটায় পড়েই ব্রেক কষল। বাইকে দু’জন লোক। দু’জনেরই মাথায় কপাল-ঢাকা টুপি, চোখে প্রকাণ্ড গগলস। মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে বোঝা গেল, একজন শ্বেতাঙ্গ, অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গ। দু’জনেরই বিশাল চেহারা। তাদের গাড়িটা দেখেই একজন চেঁচিয়ে ইংরিজিতে বলল, “ওই তো ওরা! রোখো ওদের।”

জঙ্গলের রাস্তাটা সরু। মোটরবাইকটা টক করে ঘুরে গিয়ে পথটা আটকানোর চেষ্টা করল। বাবুরাম তার আগেই গাড়িটা চালিয়ে দিয়েছেন। এক সেকেণ্ডের ভগ্নাংশ সময়ের তফাতে বাবুরাম বেরিয়ে গেলেন।

কিন্তু বেরিয়ে গিয়েও ওদের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। সরু রাস্তায় গাড়ির চেয়ে মোটরবাইক অনেক বেশি সচল। সুতরাং বাইকটা গর্জন করতে-করতে পিছু নিয়ে ধেয়ে এল।

প্রতিভা আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “ওরা পিছু নিয়েছে কেন? কী চায় ওরা?”

বাবুরাম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “ওরা ভেবেছে আমরা বনিকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি। যতদূর মনে হচ্ছে ওরা আমাদের আটকাতে চাইছে।”

বলতে বলতেই একটা গুলির শব্দ হল। বাবুরাম আয়নায় দেখলেন, বাইকের পিছনে বসা লোকটার হাতে একটা বিপজ্জনক আগ্নেয়াস্ত্র গুলিটা কোথায় লাগল কিংবা লাগল না, তা বুঝতে পারলেন না বাবুরাম। তবে তিনি গাড়িটা যতদূর সম্ভব দ্রুতবেগে চালাতে লাগলেন।

পর-পর কয়েকবার গুলির আওয়াজ হল। প্রতিভা বনিকে বুকে চেপে উপুড় হয়ে ছিলেন। বললেন, “তোমাকে যে ওরা মেরে ফেলবে।”

বাবুরাম বললেন, “বোধ হয় পারবে না। মনে হচ্ছে গাড়ির কাঁচগুলোও বুলেটপ্রুফ। ঠাকুরকে ডাকো প্রতিভা।”

হোণ্ডা গাড়িটা লাফিয়ে লাফিয়ে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে চলছে, কিন্তু মোটরবাইকটাও সমানে পাল্লা দিচ্ছে। এভাবে রেস দিয়ে কতক্ষণ পারা যাবে? বাবুরাম এ-ও জানেন, পালাতে পারলেও লাভ নেই। এরা গিয়ে এদের দলকে জানাবে এবং তাঁর গাড়ি খুঁজে বের করতে ওদের অসুবিধে হবে না। বিশেষ করে বাবুরামের পালিয়ে থাকার জায়গা নেই। সুতরাং তিনি মাথা খাটাতে লাগলেন। যেমন করেই হোক এদের নিষ্ক্রিয় করা দরকার।

জঙ্গল সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও ঘন, কোথাও পাতলা, মাঝে-মাঝে ফাঁকা জায়গাও আছে। সামনে এরকম একটা ফাঁকা জায়গা দেখতে পেয়ে বাবুরাম দাঁতে দাঁত চেপে তৈরি হলেন। এখন তাঁকে একটা নিষ্ঠুর কাজ করতে হবে। এরকম কাজ তিনি জীবনে কখনও করেননি। তবে আত্মরক্ষার জন্য এ ছাড়া আর পথও নেই।

বাবুরাম চাপা স্বরে বললেন, “প্রতিভা, ভয় পেও না। বনিকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে থাকো, আর নিজেও সাবধান হও। একটা ঝাঁকুনি লাগতে পারে।”

ফাঁকা জায়গাটার চারধারে বিশাল বিশাল গাছ। বাবুরাম ফাঁকায় পড়েই বাঁ দিকে বাঁক নিলেন। গাড়িটা বোধ হয় খানাখন্দে পড়ে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু থামল না। বাবুরাম অ্যাকসেলেটরে প্রবল চাপ দিয়ে স্টিয়ারিং ডান দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। আচমকা বাঁক নিয়ে গাড়িটা উলটো মুখে ঘুরে যেতেই বাবুরাম দেখলেন মোটরবাইকটা লাফাতে লাফাতে ফাঁকায় এসে পৌঁছেছে। বাবুরাম আর দেরি করলেন না। সোজা গাড়িটা চালিয়ে দিলেন মোটরবাইকটার দিকে।

প্রবল একটা ধাতব সংঘর্ষের শব্দ হল। দু’জন লোক ছিটকে এবং খানিকটা উড়ে গিয়ে দু’ধারে পড়ল। মোটরবাইকটা একটা ডিগবাজি খেয়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেল।

বাবুরাম গাড়ি থামালেন।

প্রতিভা সাদা মুখে বললেন, “কী হল?”

“যা হওয়ার হয়ে গেছে। তোমরা ঠিক আছ?”

“আছি।”

বাবুরাম গাড়ি থেকে নামলেন। শ্বেতাঙ্গ লোকটার মাথা একটা গাছের গুঁড়িতে লেগে থেতলে গেছে। লোকটা মরেনি বটে, কিন্তু অজ্ঞান হয়ে আছে। প্রচর রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর উইনচিটার। কালোলোকটার অবস্থা খুবই খারাপ। ওর পিস্তলের নল গলায় ঢুকে গেছে। লোকটার ঘাড়ও মনে হল ভাঙা।

বাবুরাম ঘামছিলেন। তাঁর বমি পাচ্ছিল। বিবর্ণ মুখে ফিরে এসে গাড়িতে বসে তিনি বললেন, “প্রতিভা, একটা লোককে আমি মেরে ফেলেছি। অন্যটার কথা বলতে পারছি না।”

প্রতিভা সোজা হয়ে বসে বললেন, “যা করেছ সে তো ইচ্ছে করে নয়। না মারলে ওরাই আমাদের মারত। তোমাকে আর গাড়ি চালাতে হবে না। বনিকে নিয়ে বোসো। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।”

বাবুরামের হাত পা থর-থর করে কাঁপছে। পাংশুমুখে তিনি বললেন, “আমাদের কি উচিত নয় ওদের হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছে দেওয়া?”

প্রতিভা মাথা নেড়ে কঠিন গলায় বললেন, “হাসপাতালে পৌঁছে। দিলে আমাদের অনেক জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে।”

“এভাবে পড়ে থাকলে ওরা এমনিতেই মরে যাবে প্রতিভা।”

প্রতিভা একটু ভাবলেন। বিপদে পড়লে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের মাথাই বেশি ঠাণ্ডা থাকে। ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, “ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিককে ফোন করলে কেমন হয়। পোর্টল্যাণ্ড শহরটা এখান থেকে খুব কাছে।”

বাবুরাম মাথা নেড়ে বললেন, “সেটা তবু ভাল।”

প্রতিভা গাড়ি চালাতে লাগলেন। বনিকে কোলে নিয়ে বসে বাবুরাম নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়ছে। কষ্ট প্রতিভারও হচ্ছে। দু-দুটো লোককে ওভাবে জখম করা তো সোজা নিষ্ঠুর কাজ নয়। কিন্তু প্রতিভার বাস্তববোধ বেশি। তিনি জানেন এ ছাড়া উপায় ছিল না।

গ্যাস স্টেশনটায় এসে প্রতিভা গাড়ি থামিয়ে তেল ভরে নিতে লাগলেন। বাবুরাম গিয়ে ডক্টর লিভিংস্টোনের ছেঁড়া কার্ডটা বের করে ফোন নম্বর দেখে ডায়াল করলেন।

একজন মহিলা ফোন তুলে বললেন, “ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিক।”

বাবুরাম কাঁপা গলায় বললেন, “ম্যাডাম, জঙ্গলের মধ্যে দুটো লোক সাঙ্ঘাতিক আহত, ওদের সাহায্য দরকার।”

“কোন জঙ্গল?”

বাবুরাম কাঁপা গলাতেই কোনওরকমে জায়গাটার বিবরণ দিলেন।

“কীরকম অ্যাকসিডেন্ট?”

“খুব গুরুতর। ওদের মেডিক্যাল অ্যাটেনশন দরকার। ওদের মোটরবাইক….”।

বাবুরাম হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেলেন। হঠাৎ মেয়েটির গলা তীক্ষ্ণ শোনাল, “আপনি কে বলছেন?”

“আমার নাম বাবুরাম গাঙ্গুলি।”

“ওঃ।” বলে মেয়েটি এমনভাবে চুপ করে গেল যেটা বেশ সন্দেহজনক মনে হল বাবুরামের।

“আপনারা কি ব্যবস্থা নেবেন?”

মেয়েটি হঠাৎ মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, “এই ক্লিনিকের ফোন নম্বর আপনাকে কে দিল মিস্টার গাঙ্গুলি?”

“একটা গ্যাস স্টেশনের টেলিফোন ডিরেক্টরিতে।” বাবুরাম কোনওরকমে বানিয়ে বললেন।

“ঠিক আছে মিস্টার গাঙ্গুলি, আমাদের অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। আপনি। স্পটের কাছে হাইওয়েতে অপেক্ষা করুন।”

“আচ্ছা।” বলে বাবুরাম ফোন ছেড়ে তাড়াতাড়ি এসে গাড়িতে উঠলেন। বনিকে সিট থেকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “প্রতিভা, তাড়াতাড়ি করো। আমার সন্দেহ হচ্ছে ওই ক্লিনিকটা খুব সুবিধের নয়।”

প্রতিভা প্রশ্ন না করে গাড়ি ছেড়ে দিলেন। একটু এগিয়ে গিয়েই তিনি একটা একজিট ধরে হাইওয়ে থেকে নেমে অনেকটা ঘরে উলটো দিকের পথ ধরতে আবার হাইওয়েতে উঠে এলেন।

বাবুরাম চোখ বুজে ছিলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “বাড়িতে ফিরে যাওয়াটাও এখন নিরাপদ হবে কি না কে জানে!”

“প্রতিভা দৃঢ় গলায় বললেন, “ভয় নেই, আমরা বাড়ি যাচ্ছি না।”

“তা হলে কোথায়?”

জার্সি শহরের একটু বাইরের দিকে কয়েকটা পুরনো গুদামঘরের একটা সারি আছে। এখানে কিছু ভবঘুরে আস্তানা গেড়ে আছে। পুলিশ মাঝে-মাঝে এসে জায়গাটা তল্লাশ করে যায়। প্রতিভা সোজা এসে গুদামঘরের চত্বরে গাড়ি থামালেন।

প্রথমে দু-চারটে বাচ্চা ছুটে এল। পিছনে এক বুড়ি। এরা খুব সন্দিহান স্বভাবের লোক। উগ্রও বটে। ভ ভদ্রলোকদের এরা একদম পছন্দ করে না।

বুড়ি একটু এগিয়ে এসে বলল, “কী চাই?”

প্রতিভা জিজ্ঞেস করলেন, “ফ্রেড কোথায়?”

“তোমরা কি পুলিশের লোক?”

“না। ফ্রেডকে এবং তার দলবলকে বলল, আমি বনিকে নিয়ে এসেছি। আমার সাহায্য চাই।”

এই কথাবার্তার মাঝখানেই বিভিন্ন দরজা দিয়ে কয়েকজন নোংরা চেহারার মেয়ে আর পুরুষ বেরিয়ে এল। প্রত্যেকের চেহারাতেই একটা উগ্র ভাব।

বনিকে কোলে নিয়ে বাবুরাম নেমে চারদিকে চেয়ে বললেন, “এ কোথায় নিয়ে এলে প্রতিভা? এ যে ভবঘুরেদের আস্তানা। এরা ভয়ঙ্কর লোক”।

প্রতিভা মৃদুস্বরে বললেন, “এখন এ ছাড়া উপায় নেই।”

মেয়ে পুরুষগুলো এগিয়ে এসে তাঁদের একরকম ঘিরে ফেলল। হঠাৎই তাদের মধ্যে একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “এ তো সেই বাচ্চাটা! এই তো সেই দেবশিশু! দ্যাখো, দ্যাখো, ওর চোখের রং পালটে যাচ্ছে!”

বাবুরাম আর প্রতিভাও দেখলেন। বনির কালো চোখ হঠাৎ নীলকান্তমণি হয়ে উঠেছে। যেন আলো বেরিয়ে আসছে চোখ দিয়ে।

সকলে খানিকক্ষণ পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বনির দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে একে-একে হাঁটু গেড়ে বসে ভূমি চুম্বন করল। সেই বুড়িটা প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, “তোমাদের আমরা কী সাহায্য করতে পারি?”

প্রতিভা সংক্ষেপে বললেন, “শোনো, বেশি কথা বলার সময় নেই। কিছু দুষ্টু লোক আমাদের ছেলেটাকে চুরি করতে চায়। তারা আমাকে আর আমার স্বামীকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। আমরা ভারতবর্ষে চলে যেতে চাই। তোমরা আমাদের সাহায্য করবে?”

একজন পুরুষ বলল, “অবশ্যই করব। কী করতে বলল?”

“আমাদের বাড়ির ওপর ওরা নজর রেখেছে। আমাদের সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের পাশপোর্ট চাই, প্লেনের টিকিট চাই। সবই আমাদের বাড়ির মধ্যে রয়েছে।”

পুরুষটি একটু হাসল, “ওটা কোনও ব্যাপার নয়।”

প্রতিভা বলল, “টিকিট বা পাশপোর্ট বের করে আনা বিপজ্জনক হবে। ওরা খুব খারাপ লোক খুনখারাপিও করতে পারে।”

বুড়িটা বলল, “ভেবো না বাছা। আমরা অনেক সুলুকসন্ধান। জানি। একটা বাড়িতে ঢুকে কী করে জিনিস বের করতে হয় তা আমাদের বাচ্চারাও জানে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”

প্রতিভা বললেন, “আমাদের এই গাড়িটাও লুকিয়ে ফেলা দরকার। এটা ওরা বোধ হয় চিনে ফেলেছে!”

বাবুরাম অবাক হয়ে বললেন, “কী করে?”

“যে গ্যাস স্টেশনে আমরা তেল ভরেছি সেখানেও ওরা খোঁজ নেবে এবং উন্ডেড লোক দুটোও বলে দিতে পারে। সাবধানের মার নেই।”

বাবুরাম গলা চুলকে বললেন, “তা বটে। বিপদে তোমার বুদ্ধি খোলে। কিন্তু আমার বুদ্ধি ঘুলিয়ে যাচ্ছে।”

“ঘাবড়াবার কিছু নেই। এরা বনিকে দেবশিশু বলে ধরে নিয়েছে। এরা ওকে বাঁচাবেই।”

“কিন্তু দেশে ফিরতে হলে আমাদের টাকা চাই। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার কী হবে? আজ যে ব্যাঙ্ক বন্ধ। সেই সোমবার খুলবে।”

“ওটা নিয়ে ভেবো না। দেশে যেতে আমাদের সামান্য টাকা লাগবে। শুধু এয়ারপোর্টে যাওয়ার যেটুকু খরচ। আমার ব্যাগে পাঁচশো ডলার আছে। যথেষ্ট। দেশে গেলে টাকার তো অভাব হবে না।”

বাবুরাম তবু বললেন, “লাগেজ? আমাদের সঙ্গে তো জিনিসপত্র কিছুই নেই।”

“লাগবে না। তুমি বনিকে আমার কাছে রেখে কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে প্যান অ্যাম-এর কাছে খোঁজ করে দ্যাখো আজকের ফ্লাইটে দুটো সিট পাওয়া যায় কি না। যদি ভারতবর্ষের টিকিট না পাওয়া যায় তা হলেও ক্ষতি নেই। আমরা ইউরোপ পৌঁছতে পারলেও হবে। সেখানে দু’দিন অপেক্ষা করে দেশে ফিরবার ব্যবস্থা করব।”

বাবুরাম এই প্রস্তাব মেনে নিলেন।

পুরুষটি এগিয়ে এসে বলল, “তোমরা কী নিয়ে আলোচনা করছ। তা জানতে পারি?”

প্রতিভা লোকটাকে তাঁদের সমস্যার কথা বুঝিয়ে বললেন।

লোকটা মন দিয়ে শুনে বলল, “নো প্রবলেম। তোমাদের কিছু জামাকাপড় আমি একটা স্যুটকেসে ভরে নিয়ে আসব। আলমারির চাবি দাও, ডলারও বের করে আনব। আমি তোমাদের গাড়িটা নিয়েই যাচ্ছি। গাড়িটা আমি ফিরিয়ে আনব না। আর যদি কাউকে টেলিফোন করতে চাও তো ওই যে ল্যাম্পপোস্টটা দেখছ ওর পরেই বাঁ ধারে পাবলিক টেলিফোন পাবে।”

লোকটা গাড়ি নিয়ে চলে গেল। বাবুরাম গেলেন টেলিফোন করতে। দুরুদুরু বুকে প্রতিভা ভবঘুরেদের সঙ্গে তাদের নোংরা ঘরে গিয়ে বনিকে নিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

প্রায় এক ঘন্টা বাদে বাবুরাম ফিরে এসে বললেন, “প্যান অ্যাম-এর দিল্লি ফ্লাইটে দুটো সিট পাওয়া গেছে।”

প্রতিভা চিন্তিত মুখে বললেন, “এখন ভালয়-ভালয় প্লেনে উঠতে পারলে হয়”।

বুড়িটা এসে তাদের সামনে দুটো প্লাস্টিকের প্লেটে কিছু খাবার রেখে বলল, “শোনো বাছারা, যদি দুষ্ট লোকের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে হয় তা হলে ওরকম বাবু বিবির মতো পোশাক পরলে চলবে। এই আমাদের মতো উলোঝুলো পোশাক আর উইগ চাই।”

ওরকম নোংরা পোশাক পরার প্রস্তাবে বাবুরাম নাক সিটকোলেন। কিন্তু প্রতিভা বললেন, “আমরা ওই পোশাকই পরব বুড়িমা, আমাদের জোগাড় করে দাও।”

বুড়ি নির্বিকার মুখে বলল, “আমাদের দুটো বুড়োবুড়ি সেদিন মারা গেছে। ওই মেপল গাছটার তলায় তাদের পুঁতে দিয়েছি। তাদের একজোড়া পোশক আমার কাছে আছে। অন্য কেউ হলে পোশাক দুটোর জন্য অন্তত পাঁচ ডলার নিতুম। তোমাদের কাছ থেকে নেব না। তোমরা বনির মা বাবা কি না।”

বুড়ি পোশাক দুটো এনে দিল। একজোড়া পরচুলাও। পোশাক বলতে অত্যন্ত ময়লা একটা ঘন নীল রঙের কোট আর তাপ্লিমারা ট্রাউজার্স, একটা বেঢপ কামিজ আর জিনসের প্যান্ট।

বাবুরাম পোশাক দেখে বিবর্ণ হলেন ঘেন্নায়। প্রতিভা চাপাস্বরে বললেন, “বাঁচবার জন্য সব কিছু করতে হয়। ঘেন্না পেলে চলবে না।”

.

বাবুরামের বাড়ি থেকে অন্তত আধ মাইল দূরে হোন্ডা গাড়িটা একটা লেন-এর মধ্যে নিয়ে গেল মাইক-অর্থাৎ ভবঘুরে পুরুষটি। তারপর একটা আজঙ্গল জায়গায় গাড়িটা ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা হল। সমস্ত অঞ্চলটা মাইকের নখদর্পণে। কাজেই বড় রাস্তা ছেড়ে নানা ছোটখাটো বাজে-রাস্তা পেরিয়ে সে বাবুরামের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে চারদিকটা ভাল করে লক্ষ করল। এমনিতেই শহর দিনের বেলায় জনশূন্য থাকে। তবে আজ উইক এন্ড শুরু হয়েছে বলে অনেকে ঘরের কাজ করতে বাড়িতে রয়েছে।

সন্দেহজনক কিছু না দেখে মাইক রাস্তাটা পেরিয়ে বাবুরামের দরজায় উপস্থিত হল। ভবঘুরেরা ভিক্ষে-টিক্ষে চেয়ে বেড়ায়, সুতরাং তাকে চট করে কেউ সন্দেহ করবে না। মাইক চারপাশটা দেখে নিয়ে দরজাটা পরীক্ষা করল। কাঠ আর কাঁচের দরজা। খোলা শক্ত নয়। সাধারণ তালা। কেউ লক্ষ রাখছে কি না আড়াল থেকে কে জানে। সুতরাং ডোরবেলটা বারকয়েক বাজানোই ভাল। নজরদার তা হলে বুঝবে যে, সে ভিক্ষে চাইতেই এসেছে।

কিন্তু ডোরবেল বাজাতেই মাইক অবাক হয়ে দেখল, দরজাটা খুলে গেল। দরজা জুড়ে প্রকাণ্ড একটা শ্বেতাঙ্গ। বজ্রগম্ভীর গলায় লোকটা বলল, “কী চাও?”

মাইক ঘাবড়ে যাওয়ার মানুষ নয়। মুখটা একটু বিকৃত করে বলল, “রুটিটুটি কিছু আছে?”

“দূর হও!” বলে লোকটা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল।

“দাঁড়াও।” বলে মাইক তার জুতো দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে সেটা আটকাল।

দৈত্যাকার লোকটা বিভীষণ মুখে মাইকের দিকে তাকিয়ে তার দুঃসাহস দেখছিল।

মাইক বলল, “আমি খবর এনেছি। বনির খবর।”

লোকটা দরজা খুলে বিনা বাক্যব্যয়ে মাইকের কোটের কলার ধরে প্রায় ইঁদুরছানার মতো তুলে ঘরে টেনে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। “বনির খবর তুমি জানো? বলল কী খবর, বনি কোথায় আছে?”

লোকটা তার কলার ছাড়েনি। এরকম শক্তিশালী লোকের পাল্লায় এর আগে কখনও পড়েনি মাইক। সে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, “বলছি বলছি। কিন্তু আমি কী পাব?”

“পাবে! বলেই লোকটা তাকে শূন্যে তুলে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুকের ওপর একটা ভারী পা তুলে দাঁড়াল, নোংরা নেশাখোর, চোর, বাউণ্ডুলে, তোমাকে যে খুন না করে ছেড়ে দেব সেটাই বড় পাওনা বলে জেনো। এখন ঝেড়ে কাসো তো বাছাধন, বনি কোথায়?”

মাইক বুঝল, এই দৈত্যের হাত থেকে রেহাই পাওয়া শক্ত হবে। শুধু এ লোকটাই নয়, আড়চোখে সে দেখতে পেল, আরও দুটো লোক লিভিংরুমের দরজার কাছে বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়িয়ে। তাদের চেহারা ভাড়াটে খুনির মতোই। এরকম বিপদে পড়তে হবে জানলে সে বোকার মতো কিছুতেই ডোরবেল বাজাত ভারী পায়ের চাপে বুকের পাঁজরা মড়মড় করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে মাইকের। সে চি-চি করে বলতে চেষ্টা করল, “বনিকে দিয়ে তোমরা কী করবে? সে দেবশিশু।”

“সে খবরে তোর কী দরকার? সোজা কথায় জবাব দে, বনি কোথায়? তার মা বাবাকেও আমরা চাই। বাবুরাম আর তার বউ দুই শয়তান আমাদের আদেশ অমান্য করেছে, ওদের বেঁচে থাকবার অধিকার নেই।”

বুটের নিষ্পেষণে মাইকের বুকে এত যন্ত্রণা হচ্ছিল যে, সে আর বেশিক্ষণ চেতনা ধরে রাখতে পারবে না।

বাবুরামের বাড়ির অভ্যন্তরে যখন এই ঘটনা ঘটছে তখন বাড়ির বাইরে আরও একটি ঘটনা দানা বাঁধছে। বাড়ির অনতিদূরেই অনেকক্ষণ ধরে একটি ছোট গাড়ি পার্ক করা আছে। গাড়ির কাঁচ স্বচ্ছ বলে ভিতরটা দেখা যায় না। বাতানুকুল গাড়ির অভ্যন্তরে দু’জন মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে অনেকক্ষণ। তারা দেখেছে, একজন ভবঘুরে এল এবং তাকে অত্যন্ত কর্কশভাবে টেনে নেওয়া হল ভিতরে।

দু’জনের একজন বেঁটেখাটো ডক্টর ওয়াং। তিনি হঠাৎ মৃদুস্বরে বললেন, “যতদূর মনে হচ্ছে, বাড়ির ভিতরে আসল লোকেরা নেই। কিছু অবাঞ্ছিত লোক ঢুকে পড়েছে। আর ওই ভবঘুরেটা, নাঃ, ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে লি চিং।”

“আমি আপনার সঙ্গে যাব কি?”

ওয়াং মাথা নেড়ে বললেন, “কক্ষনো নয়। আমেরিকায় আমার লোকবল সামান্য। তোমার কিছু হলে আমি দুর্বল হয়ে পড়ব।”

“কিন্তু আপনার যদি কিছু হয় ডক্টর ওয়াং?”

ওয়াং মাথা নাড়লেন, “বর্বররা কখনওই আমার ক্ষতি করতে পারে না। জীবনে আমি অজস্র বিপদে পড়েছি। তুমি সতর্ক সজাগ হয়ে বাড়িটার ওপর নজর রাখো। আমাকে ভিতরে ঢুকতে হবে।”

ওয়াং গাড়ি থেকে নেমে সোজা গিয়ে ডোরবেল টিপলেন।

দু সেকেণ্ডের মধ্যে দরজা খুলে গেল। একজন ছিপছিপে লম্বা বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের মতো চেহারার লোক দরজার সামনে দাঁড়াতেই ওয়াং মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে একগাল হেসে বললেন, “সেই ওয়াণ্ডার চাইল্ড বনিকে দেখতে এসেছি আমি।”

“আপনি কে?”

“ডক্টর ওয়াং–একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিক। পদার্থবিদ এবং ইলেকট্রনিক্স বিশেষজ্ঞ।”

“বনি এখন নেই। ওরা বেড়াতে গেছে।”

ওয়াং ফের অভিবাদন করে বললেন, “আমি জানি কৌতূহলী মানুষেরা আপনাদের বিরক্ত করে। দয়া করে বিরক্ত হবেন না। আমি যথেষ্ট ধনী ব্যক্তি। শিশুটিকে পাঁচ মিনিট পরীক্ষা করতে দিলে আমি তার জন্য পাঁচশো ডলার দিতে প্রস্তুত।”

লোকটা হাত বাড়িয়ে বলল, “আগে পাঁচশো ডলার দাও, তারপর দেখব কী করা যায়।”

“অবশ্য, অবশ্য।” বলে ওয়াং হিপ-পকেট থেকে যে নোটের তাড়াটা বের করলেন তাতে একশো ডলারের নোটে অন্তত হাজার-দশেক ডলার আছে। অত্যন্ত অমায়িকভাবে ওয়াং পাঁচখানা নোট লোকটার হাতে দিয়ে বললেন, “আমি ধন্য।”

লম্বা লোকটা দরজাটা আর-একটু ফাঁক করে ধরে বলল, “চলে আসুন।”

ওয়াং ঘরে ঢুকতেই একটা হোঁচটের মতো খেলেন। তাঁর মনে হল, ঠিক হোঁচট এটা নয়, ওই লোকটাই তার জুতোর ডগায় একটু ঠোক্কর মারল।

লোকটা দরজাটা বন্ধ করে দিল।

সামনের দৃশ্যটা দেখে ওয়াং-এর যেন মুখ শুকিয়ে গেল। হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “এ কী? এসব কী হচ্ছে এখানে! অ্যাঁ!”

দৈত্য-চেহারার লোকটা মাইকের বুক থেকে পা নামিয়ে ওয়াং-এর দিকে ফিরে বলল, “এ লোকটা চোর।”

ওয়াং পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে বললেন, “চোর! চোর খুবই খারাপ জিনিস।”

প্রকাণ্ড লোকটা হাত বাড়িয়ে ওয়াং-এর সঙ্গে করমর্দন করে বলল, “এই বিশ্রী ব্যাপারটা তোমাকে দেখতে হল বলে দুঃখিত ডক্টর ওয়াং। আমার নাম জন স্মিথ।”

ওয়াং খুব অমায়িক গলায় বললেন, “আপনার পরিচয় পেয়ে খুব খুশি হলাম মিস্টার স্মিথ। কিন্তু আমি সেই অদ্ভুত শিশুটিকে দেখতে চাই।”

“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই ডক্টর ওয়াং। আগে এই চোরটার একটা ব্যবস্থা করে নিই।”

ওয়াং মেঝেয় আধমরা হয়ে পড়ে থাকা মাইকের দিকে তাকালেন। লোকটা ভবঘুরে। ওয়াং খুব বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “এ লোকটার অপরাধ কী? ও কী করেছে?”

মাইক নিজের বুক চেপে ধরে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বলল, “আমাকে ছেড়ে দাও, বনি কোথায় আছে আমি জানি না, টাকার লোভে মিথ্যে কথা বলেছিলুম।”

দৈত্যাকার লোকটা একটা রবার হোসের টুকরো জ্যাকেটের তলা থেকে বের করে সজোরে মাইকের গালে বসিয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে মাইক যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শিউরে উঠে অজ্ঞান হয়ে গেল।

ওয়াং অত্যন্ত নাভাস হয়ে বললেন, “আমি…আমি কোনও নিষ্ঠুর দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। আমার শরীর অস্থির লাগছে…”

সেই লম্বা নোকটা পিছন থেকে এসে ওয়াং-এর কাঁধে হাত রেখে বলল, “আপনি বসুন ডক্টর ওয়াং।”

একরকম চেপেই সে ওয়াংকে সোফায় বসিয়ে দিল। ওয়াং টের

পেলেন, বসানোর সময় তাঁর হিপ পকেট থেকে লোকটা ডলারের বান্ডিলটা অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে তুলে নিল।

ওয়াং বসে রুমালে কপাল মুছলেন। তারপর রুমালটা বুক পকেটে রাখলেন। তাঁর কুশলী হাতে পকেট থেকে একটা ডটপেন উঠে এল।

ওয়াং কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “মিস্টার জন স্মিথ, আমি একটু জল খেতে চাই।”

স্মিথ তাঁর সামনে এসে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে বলল, “নিশ্চয়ই ডক্টর ওয়াং। এই টম, একটু জল আনো।”

টম জল আনতে গেল। স্মিথ ওয়াং-এর দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর কী হল তা স্মিথ কখনও বলতে পারবে না। পিং করে একটা মৃদু শব্দ সে শুনল। তারপর আর তার কিছু মনে নেই।

তিন নম্বর লোকটা লিভিং রুমে টিভি চালিয়ে কোনও প্রোগ্রাম দেখছিল। ওয়াং নিঃশব্দে লিভিং রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। লোকটা তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে অবাক হয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। বলাটা আর হয়ে উঠল না তার। একটা ছোট্ট ছুঁচ গিয়ে সোজা তার মুখগহ্বরে ঢুকে গেল।

টম জল নিয়ে রান্নাঘর থেকে শিস দিতে দিতে ফিরে আসছিল। আচমকাই ঘাড়ে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা টের পেল সে। জলের গেলাসটা পড়ে গেল হাত থেকে। তারপর সেও পড়ল।

ওয়াং আর দেরি করলেন না। বাড়িটা ঘুরে দেখে নিলেন। বুঝলেন, বনি ও বাড়িতে তো নেই-ই, সম্ভবত কারও ভয়ে ওরা পালিয়েছে।

ওয়াং আগে গুন্ডাদের পকেট থেকে তাঁর ডলারগুলো বের করে নিলেন। তারপর ঠাণ্ডা জল নিয়ে এসে মাইকের পরিচর্যা করতে বসলেন। তার বুকে আর কপালে অত্যন্ত কুশলী হাতে কিছুক্ষণ মাসাজ করার পর মাইক ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চোখে আতঙ্ক।

ওয়াং বললেন, “কোনও ভয় নেই।”

“ওরা কোথায়?”

ওয়াং হেসে বললেন, “ঘুমোচ্ছে। ওই দ্যাখো কী নিশ্চিন্ত ঘুম!”

মাইক উঠে বসল। যেন গ্রহান্তরের জীব দেখছে এমনভাবে ওয়াং-এর দিকে হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “তুমি এই তিনটে দানবের মহড়া একা নিয়েছ! তাজ্জব। তোমাকে তো এরা মশামাছির মত টিপে মেরে ফেলতে পারে।”

ওয়াং খুব অমায়িকভাবে বলল, “দুর্বলের ভগবান আছেন। আর আছে ঈশ্বরদত্ত বুদ্ধি এবং কৌশল। এখন ওঠো। এখানে থাকা আর আমাদের পক্ষে নিরাপদ নয়।”

“দাঁড়াও। আমার কিছু কাজ আছে।”

এই বলে মাইক টপ করে উঠে সোজা দোতলায় শোওয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকল। কাবার্ড থেকে নির্দিষ্ট অ্যাটাচি কেস এবং বাক্স থেকে টাকার একটা বান্ডিল বের করে নিল। তারপর নেমে এসে বলল, “আমি যাচ্ছি। তোমাকে ধন্যবাদ।”

ওয়াং নিচু হয়ে অভিবাদন করে বললেন, “মাননীয় মহাশয়, তুমি অবশ্যই যেতে পারে। কিন্তু তোমাকে নিশ্চিন্ত করার জন্যই জানাতে চাই যে, আমি খুব ভাল লোক। আমি এদের মতো বদমাশ নই। আর তোমাকেও গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিতে কিছু চুরি করে পালাতে দিতে পারি না।”

মাইক ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমি চুরি করছি না।”

“তোমার হাতে একটা অ্যাটাচি কেস দেখতে পাচ্ছি। ওটা তোমার নয়। কারণ তোমার পোশাকটোশাক বা চেহারার সঙ্গে ওই দামি জিনিসটা মানাচ্ছে না।”

মাইক নিরুপায় হয়ে বলল, “এটা এ বাড়ির মালিকের জন্যই নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বাস করো।”

“বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। প্রমাণ কী?” মাইক সন্দিহান চোখে লোকটাকে নিরিখ করে বলল, “তোমাকে বলা যাবে না।”

“তা হলে তোমাকেও ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।”

মাইক বিপন্ন হয়ে চোখ মিটমিট করে বলল, “ওরা খুব বিপদে পড়েছে। কিছু দুষ্ট লোক ওদের খুন করে ওদের বাচ্চাটাকে চুরি করতে চাইছে।”

ওয়াং মাইকের কাঁধে হাত রেখে বলল, “পাঁচশো ডলার পেতে তোমার কেমন লাগবে?”

“খুব ভাল। কিন্তু আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।”

“বিশ্বাসঘাতকতা করার দরকার হলে আমি তোমার মুখ থেকেই জোর করে কথা বের করতে পারতুম। মনে রেখো ডক্টর ওয়াং একজন জিনিয়াস। আমার কাছে এমন জিনিস আছে যা দিয়ে তোমাকে অবশ বিহ্বল করে কথা বের করতে পারি। কিন্তু আমি সেরকম লোক নই।”

“তোমাকে বিশ্বাস করি কী করে?”

“করলে ঠকবে না। বনি নামক বাচ্চাটির যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে তা আমি জানি। আমি তাকে একবার দেখব বলে পৃথিবীর আর এক প্রান্ত থেকে অনেক কষ্ট করে ছুটে এসেছি। যতদূর অনুমান করছি এইসব বদমাশদের ভয়ে বনিকে নিয়ে তার মা বাবা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং তুমি তাদের সাহায্য করছ। খুব ভাল কথা। আমার মনে হয় সেটাই উচিত। তবে একটুক্ষণের জন্য হলেও বনিকে আমি দেখতে চাই।”

মাইক দ্বিধায় পড়লেও বুঝল, এ-লোকটাকে এড়ানো সহজ হবে। লোকটা ভয়ঙ্কর ধূর্ত। তবে মাইককে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে বলে মাইক খানিকটা কৃতজ্ঞও বোধ করছিল। দোনোমোনো করে সে বলল, “দ্যাখো, তোমাকে আমি নিয়ে যেতে রাজি। কিন্তু আমাদের ডেরায় ঢুকে কোনওরকম বেগড়বাঁই করলে কিন্তু আমরা সবাই মিলে তোমাকে ঢিট করে দেব।”

ওয়াং আবার প্রাচ্য রীতিতে অভিবাদন করে বলেন, “কথা দিচ্ছি বনির কোনও ক্ষতি আমরা করব না। আমি ভাল লোক।”

মাইক অগত্যা ওয়াং-এর সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তার ছোট্ট গাড়িটায় উঠল। সতর্কতার জন্য ওয়াং-এর নির্দেশে গাড়িটি নানা ঘুরপথে চালানো হল কিছুক্ষণ। তারপর ওয়াং বললেন, “নাঃ, কেউ আমাদের অনুসরণ করছে না। মাইক, এবার তুমি তোমার ডেরার পথ দেখাও।”

.

মাইককে গাড়িতে চেপে অন্য লোকের সঙ্গে ডেরায় আসতে দেখে ভবঘুরেরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিন্তু ওয়াং গাড়ি থেকে নেমে সকলকে এমন বিনীতভাবে প্রচুর অভিবাদন করতে লাগলেন। যে, ভবঘুরেরা তাঁর সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসতে পারল না।

বাবুরাম একটু দূর থেকে দৃশ্যটা দেখছিলেন। দেখতে-দেখতে হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা খবর চিড়িক দিয়ে গেল। এ-লোকটা ডক্টর ওয়াং না? চিনের বিশ্ববিখ্যাত দেশত্যাগী বৈজ্ঞানিক! বাঁ গালে লাল জড়লটা অবধি আছে। কিন্তু গতকালই তো এন বি সির খবরে বলেছে, ডক্টর ওয়াং লন্ডনে সেফ কাস্টডি থেকে পালিয়ে গেছেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গত বুধবার থেকে।

বাবুরাম এগিয়ে এসে ওয়াং-এর সামনে দাঁড়ালেন। খানিকক্ষণ কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, “আমার যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে তা হলে আপনি ডক্টর ওয়াং।”

ওয়াং আভূমি নত হয়ে অভিবাদন করে বিগলিত কণ্ঠে বললেন, “দেখা যাচ্ছে আমি সত্যিই বিশ্ববিখ্যাত। বাবুরাম গাঙ্গুলি, আপনিও কম বিশ্ববিখ্যাত নন। আমি টিভিতে আপনার ছবি দেখেছি। আপনার স্ত্রী এবং ছেলেকেও সবাই চিনে ফেলেছে।”

“ডক্টর ওয়াং, আপনি তো আমেরিকাতেই এলেন, তবে লন্ডনের সেফ হাউস থেকে পালালেন কেন?”

ওয়াং ব্যথিত গলায় বললেন, “না পালালে ওরা কী করত জানেন? আমাকে ভি আই পি সাজিয়ে এখানে এনে একরকম নজরবন্দী করে নানারকম জেরায় পেটের কথা বের করত। দেশত্যাগীদের কি ঝামেলার অন্ত আছে? তাতে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট হত, কাজের কাজ হত না। তাই পালিয়ে বন্ধুদের সাহায্যে ছদ্মবেশে ভূয়া পাসপোর্ট দেখিয়ে চলে এসেছি।”

বাবুরাম মাথা নেড়ে বললেন, “বুঝেছি, আপনি দুঃসাহসী মানুষ। দেশ ছেড়ে পালালেন কেন ডক্টর ওয়াং?”

“প্রতিভাবানদের কোনও দেশ নেই গাঙ্গুলি। পুরো পৃথিবীটাই তাদের কাজের জায়গা। একটা দেশে আটকে থাকলে তাদের চলে না। আমাকে আপনি বিশ্বনাগরিক বলে ভাবতে পারেন।”

বাবুরাম এই দুঃখেও ওয়াং-এর কথায় হাসলেন। বললেন, “আপনার কী একটা আবিষ্কার চুরি গেছে বলে শুনেছি।”

ডক্টর একথায় হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ ছলছল করতে লাগল। রুমাল বের করে তিনি চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, “ওকথা মনে করিয়ে দেবেন না বাবুরাম গাঙ্গুলি। সে ছিল আমার বুকের হাড়, চোখের মণির চেয়েও মূল্যবান। ওরকম বায়োমেকানিক রোবট কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি আজও। তার ভিতরে আমি এক অনন্ত শক্তির উৎস সৃষ্টি করেছিলাম। শুধু সেটার একটাই দোষ ছিল, সে নিজে থেকে কিছু করতে পারত না। তবে কাছাকাছি মানুষের ইচ্ছে বা চাহিদা অনুসারে সে অনেক অসম্ভব সম্ভব করতে পারে। তার নাম দিয়েছিলাম চি চেং। আমার ছেলে থাকলে সেও আমার এত প্রিয়পাত্র হত না, যতটা ছিল চি চেং।”

ওয়াং খানিকটা সামলে ওঠার পর বললেন, “গাঙ্গুলি, আপনার ছেলের বিষয়ে আমি শুনেছি। আমি কি তাকে একবার দেখতে পারি?”

“নিশ্চয়ই। আসুন ডক্টর ওয়াং।”

বাবুরাম গুদামের ভিতরে, যেখানে বনিকে কোলে নিয়ে প্রতিভা বসে ছিলেন, সেখানে নিয়ে গেলেন। প্রতিভা প্রথমে ওয়াংকে দেখে অস্বস্তি বোধ করলেও বাবুরামের ইশারায় বনিকে ওয়াং-এর হাতে দিলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে বনির চোখ দুখানা প্রথমে নীল তারপর সবুজ হয়ে গেল।

ওয়াং কিছুক্ষণ চোখ দুটোর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “এই রংগুলোর অর্থ আছে। ও আমাকে দেখে খুশি হয়েছে।”

বাবুরাম মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “বনির অসুখটা কী ডক্টর ওয়াং?”

ওয়াং বনিকে শুইয়ে দিয়ে তার সঙ্গীকে ডেকে একটা হুকুম দিলেন। তার সঙ্গী দৌড়ে গিয়ে একটা কালো বাক্স নিয়ে এল। ওয়াং সেই বাক্সটার ডালা খুলতে দেখা গেল ভিতরে নানা জটিল ও সূক্ষ্ম সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। এত জটিল যে, বাবুরাম অবধি যন্ত্রটার প্রকৃতি বুঝতে পারলেন না।

ওয়াং বললেন, “এটা অত্যাধুনিক একটা স্ক্যানার। কোনও ভয় নেই, এই যন্ত্র আপনার ছেলের কোনও ক্ষতি করবে না।”

আধ ঘণ্টা ধরে ওয়াং বনির শরীরের সর্বত্র একটা স্টেথসকোপ জাতীয় জিনিস লাগিয়ে পরীক্ষা করলেন। তার ভূ কুঞ্চিত, মুখে চিন্তার বলিরেখা। তারপর যন্ত্র গুটিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যর্থতা! আবার একটা ব্যর্থতা! লোকগুলো অপদার্থ।”

বাবুরাম উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ডক্টর ওয়াং?”

“আপনার ছেলের এমব্রায়োতে একটি বায়োনিক মাইক্রোচিপ কেউ সেট করে দিয়েছিল। জিনিসটা এত ছোট যে আপনার সে সম্পর্কে ধারণাই হবে না। চিপটা ঠিকমতো সেট হয়ে গেলে আপনার ছেলে হয়ে উঠত আধা-যন্ত্র, আধা-মানুষ। কিন্তু গবেষণাটি এখন পরীক্ষামূলক স্তরে আছে বলেই আমার ধারণা, যারা এটা করছে তারা খবর রাখছে, কোন মা কখন সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। তাদের অজান্তেই গর্ভস্থ সন্তানের মধ্যে ইনজেকশন দিয়ে ওই মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই মাইক্রোচিপের ধর্মই হল তা ভূণের শরীরে ঢুকেই শিরা-উপশিরা দিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছয়। সেই ভুণ যখন। সন্তান হয়ে জন্মাবে তখন হবে অত্যধিক মেধাবী, অত্যধিক কর্মপটু, কিন্তু তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে অন্য লোক। এইসব সন্তান মাঝে-মাঝে রিমোট কন্ট্রোলে প্রত্যাদেশ পাবে। এবং সেই আদেশ এরা অক্ষরে-অক্ষরে মানতে বাধ্য। এদের দিয়ে যা খুশি করানো যাবে। মিস্টার বাবুরাম গাঙ্গুলি, আমি দুঃখিত, আপনিও এইসব শয়তনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তবে বনির ক্ষেত্রে মাইক্রোচিপটা কোনও কারণে ঠিকমতো কাজ করছে না। কোনও একটা বায়ো মেকানিকাল গোলমাল ওর মস্তিষ্ক আর শরীরের মধ্যে একটা পরদা পড়ে গেছে। ওর মাথা ক্রিয়াশীল, কিন্তু শরীর নয়।”

বাবুরাম স্তম্ভিত হয়ে বললেন, “সর্বনাশ!”

“এব্যাপারে একসময়ে আমিও কিছুদূর গবেষণা করেছি। তাই আমি ব্যাপারটা এত চট করে ধরে ফেলতে পারলাম। তবে মিস্টার গাঙ্গুলি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস বনির মধ্যে এমন কিছু প্রতিক্রিয়া ওরা ওদের রিমোট সেনসরে ধরতে পেরেছে যাতে ওরাও উদ্বিগ্ন। ওরা হয়তো বনিকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করবে। আপনার এখন ওকে। নিয়ে পালিয়ে যাওয়াই উচিত।”

“আমরা পালাতেই চাইছি ডক্টর ওয়াং।”

“সেটা সহজ হবে না। আপনার বাড়িতে আজ তিনজন অতিকায় গুণ্ডাকে ঘায়েল করে মাইককে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করতে হয়েছে।”

“সর্বনাশ!”

“তাই বলছি, ওরা আপনার পালানোর পথ বন্ধ করার সবরকম চেষ্টা করবে।”

উদ্বেগে আতঙ্কে অস্থির হয়ে বাবুরাম বললেন, “তা হলে কী করব ওয়াং?”

তবু বিপদের ঝুঁকি নিয়েও আপনাকে পালাতেই হবে। নইলে ওরা বনিকে নিয়ে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে ওর মাথা চিরে দেখবে কেন ওদের প্ল্যানমতো কাজ হয়নি। ওরা হয়তো আরও অনেক শিশুকেই এরকম গবেষণার বস্তু করেছে। জানি না সেসব শিশুর ভাগ্যে কী ঘটছে। ওরা বর্বর! ওরা মানুষের চরম শত্রু!”

বাবুরাম স্ত্রীর দিকে তাকালেন। প্রতিভা মৃদুস্বরে বললেন, “ভয় পেও না। ঠাকুরের ওপর ভরসা রাখো। আমরা ঠিক পালাতে পারব। বিপদে মাথা ঠিক রাখতে হয়।”

বাবুরাম স্ত্রীর কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তায় একটু শান্ত হলেন।

ওয়াং বললেন, “শুনেছি আপনি ভবঘুরের ছদ্মবেশে পালাতে চান। ভাল পরিকল্পনা। তবে এয়ারপোর্টে তো আর ছদ্মবেশ চলবে না। পাশপোর্ট দেখানোর সময় ছদ্মবেশ খুলতেই হবে। তখন বিপদ। বাবুরাম গাঙ্গুলি, বিজ্ঞানের স্বার্থে আমি আপনাকে সাহায্য করব।”

“করবেন! বাঁচলাম।”

“এখন আমি যাচ্ছি। যথাসময়ে আমার দেখা পাবেন।”

“শুনুন ওয়াং। ডাক্তার লিভিংস্টোনের ক্লিনিক সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?”

“ক্লিনিকটা পোর্টল্যান্ডে?”

ওয়াং-এর খুদে-খুদে চোখ যতদূর সম্ভব বিস্ফারিত হল, “পোর্টল্যান্ডের ডক্টর লিভিংস্টোন?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি চেনেন?”

ওয়াং বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “ঠিক আছে। ও কথা পরে হবে আপনি আর দেরি করবেন না।”

বাবুরামের মনে হল, ডক্টর লিভিংস্টোন সম্পর্কে কী-একটা কথা চেপে গেলেন ওয়াং। একটু দ্রুত পদেই যেন ওয়াং বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটা বেশ দ্রুত বেরিয়ে গেল।

বাবুরাম আর প্রতিভা কিছুই খেতে পারলেন না। তাদের অনেক সাধাসাধি করে বডি হার মানল। তবে বনির খাবার যথেষ্টই সঙ্গে ছিল। তাকে প্রতিভা খাওয়ালেন। বিকেল হয়ে আসতেই বাবুরাম আর প্রতিভা তাঁদের ছদ্মবেশ পরে নিলেন। বনির মাথাতেও একটা পরচুলা পরিয়ে নেওয়া হল আর গায়ে মাখিয়ে দেওয়া হল শরীর ট্যান করার রং। বুড়িটা দু’জোড়া রোদ-চশমাও এনে দিল। এসব জিনিস ওরা কুড়িয়েও পায়, চুরিও করে।

ফ্রেড কোথাও গিয়েছিল। দুপুরেই ফিরে এসেছে। সে বলল, “এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছনোর কোনও চিন্তা নেই। আমি একটা ডাম্প ইয়ার্ড থেকে পুরনো ফোর্ড গাড়ি জোগাড় করেছি। সেটা বেশ চলে। তবে পুলিশে ধরলে বিপদ আছে। আমাদের লাইসেন্স নেই।”

বাবুরাম বললেন, “সাবধানে চালালে পুলিশ ধরবে না। ঠিক আছে, আমিই চালাব।”

সন্ধের কিছু আগে ফ্রেড আর মাইককে নিয়ে বাবুরাম সপরিবারে এয়ারপোর্টে রওনা হলেন। মুশকিল হল, তাঁরা নিজেদের নামেই প্লেনে টিকিট বুক করতে বাধ্য হয়েছেন। শত্রুপক্ষ খবর পেলে বিপদ আছে কপালে।

নিউ জার্সি পেরিয়ে গাড়ি ব্রুকলিন ব্রিজে উঠল, তারপর নিউ ইয়র্ক শহরকে পাশে ফেলে চলল সোজা জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি এয়ারপোর্টের দিকে। অনেকটা রাস্তা। কিন্তু রাস্তায় আর কিছু ঘটল না। গাড়িটা একটু-আধটু আওয়াজ করলেও শেষ অবধি বিশেষ গণ্ডগোল করল না!

টার্মিনালের সামনে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে মাইক আর ফ্রেড গেল গাড়িটা পার্ক করে আসতে। পার্ক করা বেশ ঝামেলার ব্যাপার।  

দু’জন ভবঘুরের ছদ্মবেশে টার্মিনালে ঢুকতে যেতেই লোজন বেশ তাকাতে লাগল তাদের দিকে। তবে দেশটা আমেরিকা। এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা খুব বেশি বলে কেউ কারও ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।

টার্মিনালে ঢুকে রেস্টরুম-এ গিয়ে দু’জনেই পর্যায়ক্রমে ছদ্মবেশ ছেড়ে এলেন।

বাবুরাম উদ্বেগের গলায় বললেন, “চারদিকে চোখ রেখো প্রতিভা।”

প্রতিভা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে আছেন। শান্ত গলায় বললেন, “কিছু হবে না। শান্ত হও। আমি চোখ রেখেছি।”

বাবুরাম চঞ্চল চোখে চারদিকে চাইতে লাগলেন। অনেক যাত্রীর ভিড়ে কাকে তিনি শত্রুপক্ষের লোক বলে চিহ্নিত করবেন? সামনের লাইনটাও বেশ লম্বা। একজন দীর্ঘকায় তোক এসে বাবুরামের পিছনে দাঁড়াল। শ্বেতাঙ্গ। মখচোখ যেন কেমন পাথরে। বাবুরাম একবার তাকিয়েই ভয়ে ভয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। চোরা চোখে লক্ষ করলেন লোকটা তার কোটের পকেটে হাত ভরে আছে।

লোকটা হঠাৎ খুব চাপাস্বরে বলল, “একটা পিস্তলের নল তোমার শরীরের দিকে তাক করা আছে। তোমার স্ত্রীকে বলো কোনওরকম চেঁচামেচি বা গণ্ডগোল না করে ধীরে-ধীরে টার্মিনালের বাইরে যেতে। তুমিও তাই করবে। বাইরে গাড়ি এসে তোমাদের তুলে নেবে।”

বাবুরাম ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন ভয়ে। একেবারে কাঠ।

লোকটা পিঠে বাস্তবিকই একটা কঠিন জিনিসের খোঁচা দিয়ে বলল, “পনেরো সেকেণ্ডের বেশি সময় দেব না। চারদিকে আমাদের লোক আছে মনে রেখো।

বাবুরাম সম্বিৎ ফিরে পেয়ে প্রতিভার কানে কানে বললেন, “আমার পিঠে পিস্তলের নল। বাইরে যেতে বলছে। কী করব প্রতিভা?”

প্রতিভা শান্ত গলায় বললেন, “এ যা বলছে তাই করতে হবে। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখো আর আমার পিছনেই থেকো।”

প্রতিভা বনিকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে লাইন থেকে বেরিয়ে এলেন, “তারপর দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। পিছনে বাবুরাম। তার পিছনে সেই লোকটি।”

দরজার কাছ বরাবর যেতেই ব্যস্তসমস্ত এক যাত্রী মালের ট্রলি নিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ট্রলিতে বেশ বড় বড় দুটো স্যুটকেস, ব্যাগ, ছাতা ইত্যাদি। লোকটি ট্রলিটা নিয়ে হুড়মড় করে ঢুকেই সোজা যেন বাবুরামের ঘাড়েই এসে পড়ছিলেন। বাবুরাম সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু লোকটা প্রায় উন্মাদের মতো ট্রলিটার একটা প্রবল ধাক্কা দিয়ে কনুইয়ের তোয় বাবুরামকে ছিটকে দিলেন।

একটা “ওঃ গড!” চিৎকার শোনা গেল। বাবুরাম সামলে উঠে পিছন ফিরে দেখলেন তাঁর অনুসরণকারী লম্বা লোকটা হাঁটু চেপে ধরে মেঝের ওপর বসে আছে। চোখে-মুখে বোকার মতো ভাব। যাত্রীটি নিচু হয়ে বারবার ক্ষমা চাইছে লোকটার কাছে, বড় তাড়াহুড়োয় তোমাকে জখম করে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না…

বলতে বলতে যাত্রীটি লোকটার বগলের তলায় হাত দিয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু বাবুরাম স্পষ্ট দেখলেন যাত্রীটির হাতে একটি চাকতির মতো কী জিনিস যেন। আহত লোকটা একবার উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে গেল।

এই গণ্ডগোলে হঠাৎ বাবুরাম দেখতে পেলেন, চার-পাঁচটা লোক এসে জলদিবাজ যাত্রীটিকে ঘিরে ফেলেছে। তাদের চেহারা বা হাবভাব সুবিধের নয়। যাত্রীটি হাত-পা নেড়ে কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে তাদের। লোকটা ওয়াং নন। তবে তাঁর শাকরেদ হতে পারে।

বাবুরাম প্রতিভার দিকে চেয়ে বললেন, “ফিরে এসো। বোধ হয় এ যাত্রা বেঁচে যাব।”

“ও লোকটা কে?”

“চিনি না।”

“ইচ্ছে করে এরকম করল নাকি?”

“তাই তো মনে হচ্ছে।”

“ তা হলে কিন্তু তোমার উচিত ওকেও সাহায্য করা। ওই দ্যাখো, কতগুলো লোক ওকে কেমন ঘিরে ধরেছে।”

বাবুরামের মনে হল, প্রতিভা ঠিকই বলেছে। লোকটা যদি তাঁদের বাঁচানোর জন্যই ওই কাণ্ড করে থাকে তাহলে বাবুরামেরও উচিত। লোকটার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া।

বাবুরাম কখনও মারপিট করেননি। বরাবর ভাল ছেলে ছিলেন। তবে খেলাধুলা করতেন। এখনও জগিং করেন, দু-চারটে আসনও। গায়ে তাঁর জোর আছে কি না তা তিনি জানেন না। এ সুযোগে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।

তিনি এগিয়ে যেতে যেতেই দেখলেন, দানবাকৃতি পাঁচটা লোক প্রায় ঠেসে ধরে যাত্রীটিকে পায়ে পায়ে দরজার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বাবুরাম চিন্তাভাবনা না করেই সামনে যে পড়ল সোজা তার মাজায় নিজের বুটসুষ্ঠু পা সজোরে বসিয়ে দিলেন।

বলতেই হবে মারটা বেশ জোরালোই হল। লোকটা লাথির চোটে ছিটকে পড়ে গেল। আর বাকি চারটে লোক এত অবাক হয়ে বাবুরামের দিকে তাকাল যে, বলার নয়।

ভূপাতিত লোকটার বিশেষ লাগেনি। মারটার খেয়ে এরা বেশ তৈরি হয়ে গেছে। লোকটা এক লাফে উঠে এসে বাবুরামের মুখে একটা ঘুসি চালিয়ে দিল। বাবুরাম খানিকটা শূন্যে উঠে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে দড়াম করে আছড়ে পড়লেন। লোকটা বাবুরামকে লাথি মারতে পা তুলেছিল, এমন সময় মশার কামড়ের মতো কিছু বিধল বোধ হয় তার ঘাড়ে। কেমন যেন বিহুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর ধীরে-ধীরে ভেঙে পড়ে গেল।

অন্য চারজন ধৃত লোকটিকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তাড়াতাড়ি এসে প্রতিভাকে পাকড়াও করল টেনে নিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে।

কিন্তু এ-সময়ে দরজাটা জ্যাম করে দু-দুটো মালের ট্রলি এসে এমন আটকে গেল যে, কিছুতেই ছাড়ানো যায় না দুটোকে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

দু’জন চিনা যাত্রী এই কাণ্ডের জন্য সকলের কাছে প্রচুর ক্ষমা চাইতে লাগলেন। কিন্তু তাতে পথ পরিষ্কার হল না। চারটে গুণ্ডা খেপে গিয়ে দমাদম ট্রলি থেকে মালপত্র তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগল। তাদের ধাক্কায় যাত্রীরাও ছিটকে যাচ্ছে এদিক-ওদিক ছুটে এল সিকিউরিটির লোকেরা। আর এই গণ্ডগোলে লাল জড়লওলা বেঁটেমতো একটা লোক একটু দূরে দাঁড়িয়ে শান্তমুখে একটু হাসল।

আগন্তুক চিনা, যাত্রী দুজনের মাল গুণ্ডারা ফেলে দেওয়ায় খেপে গিয়ে লাফ দিয়ে তারা ট্রলি ডিঙিয়ে এসে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করল গুণ্ডাদের। হাত লাগাল আগের যাত্রীটিও। এই ফাঁকে বনিকে নিয়ে সরে এসে স্বামীর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন প্রতিভা। তাঁর পাশে সেই বেঁটে চিনা ভ ভদ্রলোকও।

মৃদুস্বরে ওয়াং বললেন, “দ্যাট ওয়াজ এ ন্যাস্টি নক আউট পানচ। তোমার স্বামী কখনও বকসিং করেছে?

“না। জীবনে নয়।”

ওয়াং পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে এনে তা থেকে কয়েকটা লম্বা ছুঁচ তুলে নিলেন, বললেন, “আকুপাংচার, খুব কাজ হয়। ওর মুখে চোখে একটু জল দাও।”

বনির বোতলে জল ছিল। প্রতিভা সেই জল ঢেলে হাতের কোষে নিয়ে মুখে-চোখে ছিটিয়ে দিলেন বাবুরামের। আর দক্ষ হাতে বাবুরামের ঘাড়ে এবং আশপাশে উঁচগুলো বিধিয়ে দিলেন ওয়াং।

তিন চিনা কী কায়দা কবল কে জানে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই চার-চারটে গুণ্ডার দুজন ধরাশায়ী হয়ে প্রাণ হারাল। দু’জন পালাল।

ওয়াং মৃদুস্বরে বললেন, “এরা সব আমার চ্যালা। জরুরি পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য এদের বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছি আমি। আমেরিকান গুণ্ডারা ঘুসি আর ছোরাঘুরি আর পিস্তল ছাড়া কিছুই জানে না। বড় ক্রুড। বিজ্ঞানের যুগে কতরকম উপকরণ বেরিয়ে গেছে, এরা সেসব গ্রাহই করে না। দেখলে তো, তিনটে রোগাপটকা চিনার কাছে কেমন নাকাল হল চার-চারটে দশাসই আমেরিকান!”

এত দুঃখেও একটু হাসলেন প্রতিভা। বললেন, “আপনি না থাকলে কী যে হত!”

বাবুরাম চোখ মেললেন, কাতর শব্দ করলেন, তারপর উঠে বসে বললেন, “আমার চোয়াল বোধহয় ভেঙে গেছে।”

ওয়াং মৃদু হেসে বলেন, “না মিস্টার গাঙ্গুলি। আপনার শরীরে ষাঁড়ের মতো ক্ষমতা আছে। যাকগে, লড়াই শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছে আর বিপদ ঘটবে না। পুলিশও এসে গেছে। আর দেরী না করে লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ুন। ভাবখানা এমন করবেন যেন কিছুই হয়নি।”

বাবুরাম দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, “সবকিছুর জন্যই। আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা কৃতজ্ঞ।”

ওয়াং সংক্ষেপে যা বললেন, তার অর্থ, সব ভাল যার শেষ ভাল। বাবুরাম আর প্রতিভা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাতে পাশপোর্ট, টিকিট। হই-হট্টগোলে তাঁদের কেউ আলাদা করে লক্ষ করল না।

.

আতঙ্কিত, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত অবস্থায় বাবুরাম আর প্রতিভা যখন কলকাতায় পৌঁছলেন তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। তবে কলকাতার মাটিতে পা রেখে তাঁরা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। হঠাৎ এসেছেন বলে

তাঁদের নিয়ে যেতে কেউ বিমানবন্দরে আসেনি।

মালপত্র বলতে তাঁদের সঙ্গে সামান্যই জিনিস। কাস্টমস পেরিয়ে তাঁরা একটা প্রি-পেইড ট্যাক্সি নিলেন। বাড়ির দরজায় যখন এসে নামলেন তখন ঘুটঘুট্টি লোডশেডিং-এর অন্ধকার চারদিকে।

বাড়ির লোক খেয়ে-দেয়ে ঘুমোনোর আয়োজন করছিল। তাঁদের আগমনে সারা বাড়ি আনন্দে বিস্ময়ে ফের জেগে উঠল। বাবুরামের বাবা বলাইবাবু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনিও প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন। তাঁর নাতি এসেছে যে!