০৪. বার্তা
কড়া ধরে একবার নাড়াতেই দরজাটা সশব্দে খুলে গেল তুই কেমন মেয়ে রে? ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠলেন শ্রীময়ী, এই সেদিন এক কাণ্ড বাধিয়েছিলি, যদি কাজল না এসে পড়ত, তাহলে
তাহলে কি হত তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আগে ঘরে ঢুকতে দাও, বলে চট করে মায়ের পাশ কাটিয়ে সীমা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
দরজা বন্ধ করে পিছন ফিরলেন শ্রীময়ী, কিন্তু কিছু বলার আগেই মাকে জড়িয়ে ধরল সীমা, লক্ষ্মীটি মা, বকাবকি কোরো না। আগে আমার কথা শোনো।
কী শুনব? শ্রীময়ী শক্ত গলায় বললেন, তুই বলে গেছিস সাড়ে নয়টার মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরবি আর এখন প্রায় এগারোটা বাজে! আমার চিন্তা হয় না? এত রাতে আবার যদি একটা দুর্ঘটনা ঘটত? তোর সাহসকেও বলিহারি!
একগাল হেসে সীমা বলল, দুর্ঘটনা ঘটার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না যে। ছাত্রীর বাবা আমাকে তার মোটরে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
শ্রীময়ীর মুখের কঠিন রেখাগুলো একটু নরম হল, তুই বলে গেলি সাড়ে নয়টার মধ্যেই সার্কাস দেখে ফিরে আসবি। তোর ছাত্রীর সঙ্গে তার মা বাবাও যাবেন শুনে আমি অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু রাত যখন এগারোটা, তখনও তোর পাত্তা নেই। কাজেই দুশ্চিন্তা
বাধা দিয়ে সীমা বলে উঠল, সেজন্য আমি দায়ী নই মা। তোমার কাজলই আমার দেরি করিয়ে দিল। ছাড়তেই চায় না। তুমি বকাবকি করবে বলেছি, বলেছি, মা ভীষণ রাগ করবে। হেসেই উড়িয়ে দিল, বলল, আমার কথা বললে মা কিছুই বলবেন না।, তোমাকে তো চেনে না! বাইরের লোকের কাছে তুমি চমৎকার মানুষ, আর আমাকে
হ্যাঁ, তোমাকে আমি দিনরাত বকাবকি করছি, দাঁতে পিষছি, শ্রীময়ী হেসে ফেললেন, নেমকহারাম মেয়ে! তা কাজলকে তুই পেলি কোথায়? ও সার্কাস দেখতে গিয়েছিল বুঝি? এখানে আসতে বললি না কেন?
বলেছি তো, সীমার হাসিমুখ গম্ভীর হল, আমাকে অঞ্জন বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল, নামতে রাজি হল না।
–তবে যে বললি ছাত্রীর বাবা তার মোটরে করে তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন?
–ঠিকই বলেছি। ছাত্রীর বাবা-মা, আমার ছাত্রী, সবাই ছিল, সঙ্গে অঞ্জনও ছিল। তোমায় চমকে দেব বলে অঞ্জনের কথা আগে বলিনি। অঞ্জনের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলাম, সেদিনের ঘটনার কথাও বললাম। শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। সকলে মিলে গল্প করতে করতেই রাত হয়ে গেল। আমার ছাত্রী রুণু তো অঞ্জনকে ছাড়তেই চায় না, তার কাছে অঞ্জন দস্তুরমতো হিরো হয়ে গেছে।
সব বুঝলাম। কিন্তু বুদ্ধি করে অঞ্জনের ঠিকানাটা নিতে পারলি না?
ঠিকানা নেওয়ার দরকার নেই, সীমার কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক গম্ভীর, সার্কাসে গেলেই তাকে পাওয়া যাবে। তবে যাওয়ার উপায় নেই।
সার্কাসে গেলেই পাওয়া যাবে?শ্রীময়ী বিস্মিতকণ্ঠে বললেন, ও কি রোজ সার্কাস দেখতে যায়? আশ্চর্য শখ তত! সঙ্গী সাথীর দরকার নেই, আমিই তাহলে তোর সঙ্গে যাব। ইম্পিরিয়াল সার্কাস তো এখন নিয়মিত চলছে।
ইচ্ছে হলে তুমি যেতে পারো, আমি যাব না।
–কেন? যাবি না কেন?
আমায় যেতে বারণ করেছে, সীমার কণ্ঠ অভিমানে গাঢ় হয়ে এল, বলেছে, তোমার ভালোর জন্যই বলছি, এখানে আর আসবে না। আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও কখনো করবে না। আমি আর যাব না, মা। যে-লোক আমায় পছন্দ করে না, আমি তার ধারেকাছে ঘেঁষি না। গুণ্ডার হাত থেকে বাঁচিয়েছে, সেজন্য চিরকালই তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, কিন্তু তাই বলে আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে রাজি নই।
না রে, সীমা, শ্রীময়ী সস্নেহে তাকালেন মেয়ের দিকে, তোকে সে অপছন্দ করে না। বারণ করার নিশ্চয়ই অন্য কারণ আছে।
তুমি জানো না মা, সীমা উত্তেজিত হয়ে উঠল, সে বলতে নিষেধ করেছিল। আমি সাফ বলে দিয়েছি, সে আমি পারব না, মায়ের কাছে আমি কোনো কথাই লুকোই না। ফেলে-যাওয়া টাকার কথাও তাকে বলেছিলাম। উত্তরে কি বলল, জানো?
কী বলল?
লোকটা ভারি রুক্ষ। সোজা বলে দিল, টাকার দায়িত্ব যখন মা নিয়েছেন, ওটা নিয়ে আর তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। টাকা আমার, রেখে দিয়েছেন তোমার মা– সুতরাং তুমি এখানে নিতান্তই তৃতীয় ব্যক্তি।
শ্রীময়ীর মুখে ফুটল স্নিগ্ধ হাসির রেখা।
–তুমি হাসছ? হাসবেই তো! আমায় অপমান করলে তোমার তত ভালোই লাগে।
তা তো বটেই, শ্রীময়ী খোলাখুলি হেসে ফেললেন, আমি তোমার শত্রু কি না, তোমায় অপমান করলে আমি খুশি হব বৈকি!
-আরও একটা ব্যাপার আমার ভালো লাগেনি। একদিনের পরিচয়, এমন কিছু ঘনিষ্ঠতা এখনও হয়নি আমাকে দেখা হতেই তুমি সম্বোধন করল। আমি নিতান্ত খুকি নই, অনুমতি না নিয়ে আমায় তুমি বলবে কেন?
কাজল তোর চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তুমি বলেছে বলেই বুঝি মান গেছে? তুইই বা অত বড়ো মানুষটাকে নাম ধরে কথা বলছিস কেন? দাদা বলতে পারিস না?
-বয়ে গেছে দাদা বলতে। তোমার কাজল মানুষ হিসাবে ভালো হতে পারে, কিন্তু ভারি অভদ্র।
-কেন? তোর সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করেছে?
–ঠিক তা নয়। এখান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে হঠাৎ বলল, তুমি আমার সঙ্গে আর দেখা কোরো না। এখানেও আর এসো না। তবে প্রথমে আমায় দেখে খুব খুশি হয়েছিল। হোটলে নিয়ে গিয়ে সপরিবারে আমার ছাত্রীকে আর আমাকে দারুণ খাইয়ে দিল। প্রতিবাদ করেও লাভ হল না। আমি ছাড়া আর সবাই অঞ্জনকে দেখে মুগ্ধ, সে তো এখন সকলের চোখে হিরো।
-হ্যাঁ, সেদিনের ব্যাপারটা শুনলে হিরো মনে করা আশ্চর্য নয়।
–শুনে নয়, তাকে দেখেই সবাই চমকে গেছে।
এটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। অঞ্জনকে দেখে চমকে যাওয়ার কিছু নেই।
অঞ্জনকে দেখে নয়, তার খেলা দেখে সবাই চমকে গেছে।
–তার মানে?
–অঞ্জন সার্কাসে ছিল বটে, তবে দেখতে নয়– দেখাতে! সে ওখানে নিয়মিত খেলা দেখায়।
-তাই নাকি? কীসের খেলা দেখায়?
-বাঘ-সিংহ প্রভৃতি হিংস্র জানোয়ারের খেলা। বিশেষ করে একটা কালো বাঘকে নিয়ে সে যা কীর্তি করল, ভাবাই যায় না। জন্তুটাকে দেখলেই বুকের ভিতর ছাঁৎ করে ওঠে, কিন্তু অঞ্জন তাকে নিয়ে পোষা কুকুরের মতো খেলা দেখাল।
এটা মোটেই ভালো কথা নয়, শ্রীময়ী উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, আমি ওকে বারণ করে দেব। আর সীমা- তুই অঞ্জনকে নাম ধরে উল্লেখ করবি না, দাদা বলবি।
–বয়ে গেছে দাদা বলতে।
আজকালকার মেয়েগুলো যেমন অসভ্য, তেমনই উদ্ধত। লেখাপড়া শিখে সব জানোয়ার হয়েছে, শ্রীময়ী কঠিন স্বরে বললেন, এবার এস, দুটো গিলে নিয়ে আমাকে ছুটি দাও। আমার ঘুম পেয়েছে।
আজকালকার মেয়ে সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন শ্রীময়ী। সীমা বুঝল প্রতিবাদ নিল, সে মাকে অনুসরণ করল নিঃশব্দে।